বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন এবং আশ্রয়হীনদের দুর্দশা

তাছনিয়া আক্তার লাইবা

জলবায়ু পরিবর্তন বলতে আমরা সাধারণত বুঝিÑ কোনো জায়গার গড় আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি ও অর্থপূর্ণ পরিবর্তন; যার ব্যাপ্তি কয়েক যুগ থেকে কয়েক লক্ষ বছর পর্যন্ত হতে পারে। পৃথিবীর বয়সের সঙ্গে জলবায়ুরও পরিবর্তন ঘটছে। এ বিষয়টি আমাদের সকলেরই জানা আছে যে, বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ওপর জলবায়ুর পরিবর্তন নির্ভর করে। বর্তমানকালে জলবায়ু পরিবর্তনের দুটি কারণ ধরা হয়, প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট কারণ। কারণ যাই থাকুক না কেন জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে আমাদেরই ওপর।

ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে বাংলাদেশ খুবই ভঙ্গুর অবস্থানে রয়েছে। তাই এদেশটি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাবের প্রত্যক্ষ শিকার। জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও নদী বিধৌত ব-দ্বীপ বাংলাদেশ আরও প্রাকৃতিক সংকটের মুখোমুখি হয়। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ভূমিকম্প, নদী ভাঙন, জলাবদ্ধতা ও পানি বৃদ্ধি এবং মাটির লবণাক্ততাকে প্রধান প্রাকৃতিক বিপদ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ সরকার। বিশ্বব্যাংকের World Risk Report 2019 অনুযায়ী বাংলাদেশ Global warming বা বৈশ্বিক উষ্ণতার ঝুঁকিতে থাকা পাঁচটি ক্যাটাগরিতে বন্যার ক্ষেত্রে প্রথম, ঘূর্ণিঝড়ে দ্বিতীয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি দশম অবস্থানে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাবগুলোর ভেতর কয়েকটি কারণ খুবই আশঙ্কাজনক, যেমনÑ নদী ভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, মরুকরণ, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস, সুপেয় পানির অভাব, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিধস ইত্যাদি। এই প্রভাবগুলো বেশিমাত্রায় আশঙ্কাজনক কারণ এসবের দ্বারা প্রতি বছরই অসংখ্য মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ছে, হারাচ্ছে তাদের জীবিকা নির্বাহের উৎসগুলো।

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এই যে লক্ষ লক্ষ আশ্রয়হীন মানুষ তাদের সহযোগিতার জন্য বিশ্ব নেতাদের কোনো আগ্রহ নেই, নেই এমন কোনো আইনগত কাঠামো তৈরির যা প্রত্যক্ষভাবে তাদের সুরক্ষা দেবে। কিন্তু এই মানুষগুলোর দুঃখ-দুর্দশার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়, দায়ী আমরা, পৃথিবীর ধনী ব্যবসায়ী যারা প্রতিনিয়ত প্রকৃতি থেকে সম্পদ আহরণ করে সেটাকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে পরিবর্তন করে অর্জন করছে মুনাফা, বিনিময়ে প্রকৃতির ভা-ার ফুরোচ্ছে এবং রুদ্রমূর্তি ধারণ করছে ভারসাম্য হারিয়ে।

বর্তমান পৃথিবীতে প্রতি ত্রিশ জনে ৫ জন করে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে। ২০১৭ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে এই হার ১৮.৮ মিলিয়ন এবং ২০৫০ সাল নাগাদ এই হার হবে ৫০ মিলিয়ন।

সুন্দরবন আছে বলে এখনো আমাদের উপকূলীয় অঞ্চল হারিয়ে যায়নি, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হলে, সুন্দরবনের মারাত্মক ক্ষতি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। অতএব সেক্ষেত্রে এই হার আরো বাড়তে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তুচ্যুতিকে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়Ñ সাময়িক এবং স্থায়ী বাস্তুচ্যুতি। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের কারণে কেউ বাস্তুহারা হলে সেটিকে সাময়িক বাস্তুচ্যুতি বলা যায়। অন্যদিকে নদী ভাঙন, খরা, মরুকরণ ইত্যাদি ঘটলে সেটিকে স্থায়ী বাস্তুচ্যুতি বলা যায় এবং আমরা সবাই জানি যে, বাংলাদেশের জন্য নদীভাঙন একটি কত বড় অভিশাপ। সম্প্রতি রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, মাদারীপুরের বিভিন্ন জায়গা পদ্মা নদীর গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে। কিছুদিন পূর্বেও যে পরিবারটি ছিল অসংখ্য ভূমির মালিক, রাতারাতিই নিজের বসতবাড়িটিও হারিয়ে ফেলেছে। যাদের সামর্থ্য আছে, অর্থাৎ যারা ধনী তারা জায়গা বদল করে শহরের দিকে এগিয়ে আসছে। চাপ বাড়ছে শহরের উপর। কিন্তু যারা গরিব তাদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ এবং শোচনীয়। এটা যেন পৃথিবীর এক নিষ্ঠুর নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, যেকোনো প্রতিকূলতার মূল্য সর্বদা দরিদ্র লোকগুলোকেই দিতে হয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে তারা ঘর-বাড়ি হারায়, এমনকি ফসলি জমিটিও হারায় একইসঙ্গে জীবিকাও হারিয়ে ফেলে। খাদ্য ও বাসস্থানের সঙ্কট তাদের নৈতিকতার স্খলন ঘটায়। সমাজে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায়।

এখন কথা হচ্ছে তাদের এ অবস্থার জন্য তারা দায়ী নয়। প্রশ্ন আসে দায়ী কে? এক্ষেত্রে আমরা ফিরে যেতে পারি ইতিহাসের পাতায়। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী মূলত সেই সকল ধনী দেশগুলো যারা জন্ম দিয়েছিল শিল্প-বিপ্লবের। সভ্যতার উন্নতির জন্য শিল্প বিপ্লবের দরকার ছিল, কিন্তু সেটা প্রকৃতিকে নিঃস্ব এবং দূষিত করে নয়। সেই সকল দেশগুলো এখন উন্নতির চরম শিখরে অবস্থান করছে, অপরদিকে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো সেই ঐতিহাসিক শিল্প বিপ্লবের দূষণের ভুক্তভোগী হচ্ছে। অতএব, তারাই পরোক্ষভাবে দায়ী এই লক্ষ লক্ষ মানুষকে আশ্রয়হীন করার জন্য। দায়ীদের আমরা চিহ্নিত করলাম, ভুক্তভোগীদেরও করলাম এখন প্রয়োজন প্রতিকারের। কোথায় পাবে প্রতিকার? কারা দায়িত্ব নিবে এ সকল মানুষের?

বিশ্ববাসীর সামনে এই সত্য একটু দেরি করেই আসে, সকলেই প্রত্যক্ষ করছেন, তবু তারা নীরব এই সমস্যাটিতে। আঠারো শতক পর্যন্ত পরিবেশ নিয়ে ভাববার কারো কোনো প্রয়োজন হয়নি, কারণ তখন শিল্প বিপ্লবের সুবিধা ভোগেই সবাই ব্যস্ত ছিল এবং এই নবজাগরণকে একটি আশীর্বাদ রূপেই বরণ করেছিল। ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে শিল্পায়ন এবং উন্নয়নের নেতিবাচক ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় এবং এটা যে প্রত্যক্ষভাবে পরিবেশের ক্ষতি করছে এটা প্রতীয়মান হয়। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে চলমান সেই অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়নের রাশ টেনে ধরবার জন্য কিছু আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে পরিবেশ আইনের এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়। বিশ্বব্যাপী এটার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। পরিবেশ বাঁচানোর জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণসহ বিভিন্ন বিষয়ে কনভেনশন, চুক্তি, নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু কোথাও এই মানুষগুলোর প্রতিকারের বিধান আসেনি। জলবায়ুর পরিবর্তন মেকাবেলায় জাতিসংঘের প্রথম নীতিমালা হচ্ছে ইউনাইটেড নেশন কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ১৯৯২ (ইউএনএফসিসিসি)। এখানে শুধু কার্বন নির্গমন কমানোর প্রয়োজনীয়তা, উন্নয়ন এবং পরিবেশের ভেতর একটি সামঞ্জস্য রক্ষা করার কথা বলা হয়। অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা হচ্ছে ‘প্যারিস চুক্তি’। এই চুক্তিতে প্রতিটি দেশকে লক্ষ্য বেঁধে দেয়া হয় একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় কার্বন নির্গমনের। পাশাপাশি দুটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল নেয়া হয়। একটি হলোÑ এভাস্টেশন এবং অপরটি মিটিগেশন। এই এভাস্টেশনের পলিসির আওতায় ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং পূর্ব সতর্কতামূলক কার্যক্রম রাখা হয়। কিন্তু এখানে কোথাও এসব স্থায়ীভাবে আশ্রয়হীন বা বাস্তুচ্যুত লোকদের পুনর্বাসন এবং ক্ষতিপূরণের কথা সরাসরি বলা হয়নি, এমনকি তাদের আলাদাভাবে চিহ্নিতও করা হয়নি। অতএব দেখা গেল আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইন এসকল অসহায় গোষ্ঠীকে কোনো প্রতিকার দিচ্ছে না।

এই ভঙ্গুর গোষ্ঠীকে প্রতিকার দিতে চাইলে তাদের একটি সঞ্চায়ন প্রয়োজন, যেটার মাধ্যমে এই মানুষগুলোর অধিকারসমূহ একটি শক্তিশালী এবং কঠোর আইনের ভেতর ফেলা যায়। আমরা কি তাদের ‘রিফ্যুজি’ বা শরণার্থী হিসেবে দেখতে পারি? ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন রিফ্যুজি ১৯৫১ বলে, রাষ্ট্রের দ্বারা নিগৃহীত এবং নির্যাতিত হওয়ার ভয় থেকে যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী জাতিগত কারণে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী এবং ভিন্ন রাজনৈতিক দল হওয়ার জন্য দেশের সীমানা অতিক্রম করে তবে তাকে শরণার্থী বলা হবে।

আমরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত লোকদের এই সংজ্ঞায় আনতে পারছি না কারণ তারা দেশীয় সীমানা অতিক্রম করে না। যদি তাদের আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করি তবে বলা যায়, যে লোকটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে নিজের বাসস্থান থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে এবং দেশের সীমানার ভেতর অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়েছে তাকেই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত বলা হবে। এই অধিবেশন যখন হয়েছিল তখন এ বিষয়টি প্রত্যাশিতই ছিল না সে জন্য তাদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়নি।

অতএব বাকি থাকলো আর একটি আইনÑ মানবাধিকার আইন। ১৯৪৮ সালের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় সর্ব প্রথম ব্যক্তি অধিকার বিকাশের জন্য কতিপয় মৌলিক অধিকার ঘোষণা করা হয় এবং এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৬৫ সালে দুটি মানবাধিকার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এবং এই চুক্তিগুলো আইনত বাধ্যতামূলক। একই সঙ্গে এগুলো প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন। আমরা আন্তর্জাতিক আইনসমূহের এই ভাগটিতে ওই সকল বাস্তুচ্যুত লোকদের অধিকারসমূহ অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। কিন্তু এতে করে তাদের অধিকারগুলো সুনির্দিষ্ট করা হবে না। তাদের এই স্পর্শকাতর বিষয়টি খুবই নিবিড় এবং আন্তরিকভাবে সমাধান করা উচিত।

অতএব আমাদের প্রয়োজন একটি সুনির্দিষ্ট কনভেনশন, যেটা শুধুমাত্র এই সকল মানুষের অধিকার এবং প্রতিকারের বিধান তৈরি করবে। স্বাক্ষরিত রাষ্ট্রসমূহ এর বিধানগুলো কঠোরভাবে মেনে চলবে।

এবারে আসা যাক, বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোতে। বাংলাদেশে পরিবেশ নিয়ে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ আইন আছে প্রায় ২টিরও বেশি। দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে পরিবেশের ব্যাপারটি গুরুত্বসহকারে দেখা হয়নি। অনুচ্ছেদ ১৮ক অনুযায়ী এটিকে কেবল রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমরা সবাই জানি যে, সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগ আইনগতভাবে কার্যকর করা যায় না, আদালত এই বিধানগুলোকে কেবলমাত্র ব্যাখ্যা করতে পারবে। কিন্তু এই স্পর্শকাতর বিষয়টি মৌলিক অধিকার অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

আমরা যদি এসকল বাস্তুচ্যুতদের অধিকারগুলো অনুচ্ছেদ ৩২ এর আওতায় অর্থাৎ জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রক্ষণের ভিতর নিয়ে আসি তবে বিষয়টি আরো জটিল হয়ে পারে। কারণ এসকল মৌলিক অধিকার ভোগে কেউ বাধাগ্রস্ত হয়ে সংক্ষুব্ধ হলে অনুচ্ছেদ ১০২ অনুযায়ী সর্বোচ্চ আদালতে রিট দায়ের করতে পারবে। এই সকল মানুষ এমনিতেই অসহায় এবং মূলত সমাজের নিচুতলার এবং অধিকার সম্পর্কে অসচেতন। তাই যে কোনো আইনি ঝামেলায় যাওয়ার মতো মানসিক অবস্থা তাদের থাকে না, যেহেতু রিটের অন্যতম একটি শর্ত হচ্ছে ব্যক্তিগতভাবে সংক্ষুব্ধ হতে হবে, তাই জনস্বার্থমূলক মামলা দায়ের করার ক্ষেত্রে কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে এক্ষেত্রে।

অন্য সকল আইনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট-২০১২, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজিক অ্যাকশন প্ল্যান ২০০৯, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড অ্যাক্ট ২০১০ এ সকল বাস্তুচ্যুতদের অধিকার কিছু মাত্রায় সংরক্ষণ করেছে। Disaster Management Act 2012-এ বলা হয়েছে, The Act aims at setting up an institutional mechanism for disaster management, reduction of vulnerabilities, rehabilitation and providing humanitarian assistance to the victims of natural disaster and Climate Change. এই আইনের লক্ষ্য হচ্ছে এসব মানুষদের মানবিক (humanitarian) সহায়তা দেয়া। যখন আমরা মানবিক সহায়তার কথা বলছি, তখন এটার গুরুত্ব লোপ পাচ্ছে। কারণ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আইনগত কোনো কিছু কার্যকর করা যায় না। তাদের অধিকারগুলো মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। The Bangladesh Climate Change Strategy Action Plan বলছেÑ এ সকল মানুষদের পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য সহযোগিতা দেয়া হবে তাদের পুনর্বাসনের জন্য। কিন্তু কী ধরনের সহযোগিতা, কোন কোন ক্ষেত্রে দেয়া হবে এসব বিষয় সেখানে অনুপস্থিত। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এটা একটা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবেলার কৌশলগত পরিকল্পনা মাত্র। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ যদি তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করেন সেক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আইনের আশ্রয় নিলেও আদালত সাজা দিতে পারবে না যেহেতু এটা বলবৎযোগ্য আইন (Hard Law) নয়। দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ, যেখানে জাতীয় পর্যায়ে অর্থ সংগ্রহ করা হয় এ সকল লোকদের সহযোগিতার জন্য। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর বিরুদ্ধে সমালোচনা রয়েছে যে, অর্থ বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে বাছাইপর্বেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করা হয়। অর্থাৎ এটি দুর্নীতি নামক রাহুতে আক্রান্ত হয়ে আসল উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে।

আমাদের জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত নীতিমালা, আইন এবং কলা-কৌশল সত্ত্বেও আমরা এদের সুরক্ষা দিতে পারছি না। কারণ এ সকল আইনসমূহ সুস্পষ্ট নয় তাদের অধিকার রক্ষায়, আইন নিজেই অসংখ্য ছিদ্রপথ তৈরি করে রেখেছে দায় এড়ানোর। অধিকারের সঙ্গে দায় খুব নিবিড়ভাবে জড়িত। অধিকার দিলে দায়িত্ব এড়ানো যাবে না কোনোভাবেই, সেজন্যই হয়তো তাদের অধিকার সুস্পষ্ট করা হয়নি।

জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকদের উচিত দায়িত্বকে না এড়িয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করা। শুধু এই সকল মানুষদের রক্ষাকল্পে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো নেয়া যেতে পারেÑ

সবার পূর্বে একটি বলবৎযোগ্য আইন তৈরি করা শুধু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয়ে বাস্তুচ্যুতদের অধিকার রক্ষা এবং প্রতিকার বিধানে।

অঞ্চলভিত্তিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। বরিশালের ক্ষতিগ্রস্ত কোনো ব্যক্তি বা পরিবারকে নোয়াখালীতে পুনর্বাসন করলে প্রথা এবং সংস্কৃতিগত ফল তৈরি হতে পারে। সেজন্য অঞ্চলভিত্তিক পুনর্বাসন জরুরি।

পুনর্বাসনের সঙ্গে তাদের জীবিকার বিষয়টিও নিশ্চিত করা, যারা কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত তাদের আবাদি জমির কাছাকাছি পুনর্বাসন করা। যারা জেলে তাদের নদ-নদী এলাকায় পুনর্বাসন করা।

ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বৃহদাকারের হাউজিং প্রকল্প গ্রহণ করা।

মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা পরিবারে সদস্যানুযায়ী।

অঞ্চলভিত্তিক Community Union থাকতে পারে তাদের অধিকার সুরক্ষিত করতে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তাদের হয়ে আদালতে প্রতিনিধিত্ব করবে।

একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, যেটি শুধু এসব মানুষদের সহযোগিতায় কাজ করবে।

পরিশেষে আমাদের সবারই তাদের প্রতি সহমর্মী হওয়া উচিত। তাদের বাস্তুচ্যুতির জন্য তারা কোনোভাবেই দায়ী নয়। শুধুমাত্র মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে আমরা তাদের সহযোগিতা করতে পারি না; খাদ্য, বাসস্থান, মৌলিক অধিকার, বাস্তুচ্যুতির মাধ্যমে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। মানবাধিকার মানুষের অবিচ্ছেদ্য (ওহধষরবহধনষব) অধিকার, শুধুমাত্র মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর বিচার করা যায় না, উচিতও নয়।

[লেখক : শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]

সোমবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২০ , ১৩ মাঘ ১৪২৬, ১ জমাদিউস সানি ১৪৪১

বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন এবং আশ্রয়হীনদের দুর্দশা

তাছনিয়া আক্তার লাইবা

জলবায়ু পরিবর্তন বলতে আমরা সাধারণত বুঝিÑ কোনো জায়গার গড় আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি ও অর্থপূর্ণ পরিবর্তন; যার ব্যাপ্তি কয়েক যুগ থেকে কয়েক লক্ষ বছর পর্যন্ত হতে পারে। পৃথিবীর বয়সের সঙ্গে জলবায়ুরও পরিবর্তন ঘটছে। এ বিষয়টি আমাদের সকলেরই জানা আছে যে, বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ওপর জলবায়ুর পরিবর্তন নির্ভর করে। বর্তমানকালে জলবায়ু পরিবর্তনের দুটি কারণ ধরা হয়, প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট কারণ। কারণ যাই থাকুক না কেন জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে আমাদেরই ওপর।

ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে বাংলাদেশ খুবই ভঙ্গুর অবস্থানে রয়েছে। তাই এদেশটি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাবের প্রত্যক্ষ শিকার। জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও নদী বিধৌত ব-দ্বীপ বাংলাদেশ আরও প্রাকৃতিক সংকটের মুখোমুখি হয়। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ভূমিকম্প, নদী ভাঙন, জলাবদ্ধতা ও পানি বৃদ্ধি এবং মাটির লবণাক্ততাকে প্রধান প্রাকৃতিক বিপদ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ সরকার। বিশ্বব্যাংকের World Risk Report 2019 অনুযায়ী বাংলাদেশ Global warming বা বৈশ্বিক উষ্ণতার ঝুঁকিতে থাকা পাঁচটি ক্যাটাগরিতে বন্যার ক্ষেত্রে প্রথম, ঘূর্ণিঝড়ে দ্বিতীয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি দশম অবস্থানে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাবগুলোর ভেতর কয়েকটি কারণ খুবই আশঙ্কাজনক, যেমনÑ নদী ভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, মরুকরণ, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস, সুপেয় পানির অভাব, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিধস ইত্যাদি। এই প্রভাবগুলো বেশিমাত্রায় আশঙ্কাজনক কারণ এসবের দ্বারা প্রতি বছরই অসংখ্য মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ছে, হারাচ্ছে তাদের জীবিকা নির্বাহের উৎসগুলো।

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এই যে লক্ষ লক্ষ আশ্রয়হীন মানুষ তাদের সহযোগিতার জন্য বিশ্ব নেতাদের কোনো আগ্রহ নেই, নেই এমন কোনো আইনগত কাঠামো তৈরির যা প্রত্যক্ষভাবে তাদের সুরক্ষা দেবে। কিন্তু এই মানুষগুলোর দুঃখ-দুর্দশার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়, দায়ী আমরা, পৃথিবীর ধনী ব্যবসায়ী যারা প্রতিনিয়ত প্রকৃতি থেকে সম্পদ আহরণ করে সেটাকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে পরিবর্তন করে অর্জন করছে মুনাফা, বিনিময়ে প্রকৃতির ভা-ার ফুরোচ্ছে এবং রুদ্রমূর্তি ধারণ করছে ভারসাম্য হারিয়ে।

বর্তমান পৃথিবীতে প্রতি ত্রিশ জনে ৫ জন করে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে। ২০১৭ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে এই হার ১৮.৮ মিলিয়ন এবং ২০৫০ সাল নাগাদ এই হার হবে ৫০ মিলিয়ন।

সুন্দরবন আছে বলে এখনো আমাদের উপকূলীয় অঞ্চল হারিয়ে যায়নি, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হলে, সুন্দরবনের মারাত্মক ক্ষতি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। অতএব সেক্ষেত্রে এই হার আরো বাড়তে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তুচ্যুতিকে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়Ñ সাময়িক এবং স্থায়ী বাস্তুচ্যুতি। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের কারণে কেউ বাস্তুহারা হলে সেটিকে সাময়িক বাস্তুচ্যুতি বলা যায়। অন্যদিকে নদী ভাঙন, খরা, মরুকরণ ইত্যাদি ঘটলে সেটিকে স্থায়ী বাস্তুচ্যুতি বলা যায় এবং আমরা সবাই জানি যে, বাংলাদেশের জন্য নদীভাঙন একটি কত বড় অভিশাপ। সম্প্রতি রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, মাদারীপুরের বিভিন্ন জায়গা পদ্মা নদীর গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে। কিছুদিন পূর্বেও যে পরিবারটি ছিল অসংখ্য ভূমির মালিক, রাতারাতিই নিজের বসতবাড়িটিও হারিয়ে ফেলেছে। যাদের সামর্থ্য আছে, অর্থাৎ যারা ধনী তারা জায়গা বদল করে শহরের দিকে এগিয়ে আসছে। চাপ বাড়ছে শহরের উপর। কিন্তু যারা গরিব তাদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ এবং শোচনীয়। এটা যেন পৃথিবীর এক নিষ্ঠুর নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, যেকোনো প্রতিকূলতার মূল্য সর্বদা দরিদ্র লোকগুলোকেই দিতে হয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে তারা ঘর-বাড়ি হারায়, এমনকি ফসলি জমিটিও হারায় একইসঙ্গে জীবিকাও হারিয়ে ফেলে। খাদ্য ও বাসস্থানের সঙ্কট তাদের নৈতিকতার স্খলন ঘটায়। সমাজে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায়।

এখন কথা হচ্ছে তাদের এ অবস্থার জন্য তারা দায়ী নয়। প্রশ্ন আসে দায়ী কে? এক্ষেত্রে আমরা ফিরে যেতে পারি ইতিহাসের পাতায়। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী মূলত সেই সকল ধনী দেশগুলো যারা জন্ম দিয়েছিল শিল্প-বিপ্লবের। সভ্যতার উন্নতির জন্য শিল্প বিপ্লবের দরকার ছিল, কিন্তু সেটা প্রকৃতিকে নিঃস্ব এবং দূষিত করে নয়। সেই সকল দেশগুলো এখন উন্নতির চরম শিখরে অবস্থান করছে, অপরদিকে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো সেই ঐতিহাসিক শিল্প বিপ্লবের দূষণের ভুক্তভোগী হচ্ছে। অতএব, তারাই পরোক্ষভাবে দায়ী এই লক্ষ লক্ষ মানুষকে আশ্রয়হীন করার জন্য। দায়ীদের আমরা চিহ্নিত করলাম, ভুক্তভোগীদেরও করলাম এখন প্রয়োজন প্রতিকারের। কোথায় পাবে প্রতিকার? কারা দায়িত্ব নিবে এ সকল মানুষের?

বিশ্ববাসীর সামনে এই সত্য একটু দেরি করেই আসে, সকলেই প্রত্যক্ষ করছেন, তবু তারা নীরব এই সমস্যাটিতে। আঠারো শতক পর্যন্ত পরিবেশ নিয়ে ভাববার কারো কোনো প্রয়োজন হয়নি, কারণ তখন শিল্প বিপ্লবের সুবিধা ভোগেই সবাই ব্যস্ত ছিল এবং এই নবজাগরণকে একটি আশীর্বাদ রূপেই বরণ করেছিল। ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে শিল্পায়ন এবং উন্নয়নের নেতিবাচক ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় এবং এটা যে প্রত্যক্ষভাবে পরিবেশের ক্ষতি করছে এটা প্রতীয়মান হয়। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে চলমান সেই অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়নের রাশ টেনে ধরবার জন্য কিছু আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে পরিবেশ আইনের এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়। বিশ্বব্যাপী এটার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। পরিবেশ বাঁচানোর জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণসহ বিভিন্ন বিষয়ে কনভেনশন, চুক্তি, নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু কোথাও এই মানুষগুলোর প্রতিকারের বিধান আসেনি। জলবায়ুর পরিবর্তন মেকাবেলায় জাতিসংঘের প্রথম নীতিমালা হচ্ছে ইউনাইটেড নেশন কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ১৯৯২ (ইউএনএফসিসিসি)। এখানে শুধু কার্বন নির্গমন কমানোর প্রয়োজনীয়তা, উন্নয়ন এবং পরিবেশের ভেতর একটি সামঞ্জস্য রক্ষা করার কথা বলা হয়। অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা হচ্ছে ‘প্যারিস চুক্তি’। এই চুক্তিতে প্রতিটি দেশকে লক্ষ্য বেঁধে দেয়া হয় একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় কার্বন নির্গমনের। পাশাপাশি দুটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল নেয়া হয়। একটি হলোÑ এভাস্টেশন এবং অপরটি মিটিগেশন। এই এভাস্টেশনের পলিসির আওতায় ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং পূর্ব সতর্কতামূলক কার্যক্রম রাখা হয়। কিন্তু এখানে কোথাও এসব স্থায়ীভাবে আশ্রয়হীন বা বাস্তুচ্যুত লোকদের পুনর্বাসন এবং ক্ষতিপূরণের কথা সরাসরি বলা হয়নি, এমনকি তাদের আলাদাভাবে চিহ্নিতও করা হয়নি। অতএব দেখা গেল আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইন এসকল অসহায় গোষ্ঠীকে কোনো প্রতিকার দিচ্ছে না।

এই ভঙ্গুর গোষ্ঠীকে প্রতিকার দিতে চাইলে তাদের একটি সঞ্চায়ন প্রয়োজন, যেটার মাধ্যমে এই মানুষগুলোর অধিকারসমূহ একটি শক্তিশালী এবং কঠোর আইনের ভেতর ফেলা যায়। আমরা কি তাদের ‘রিফ্যুজি’ বা শরণার্থী হিসেবে দেখতে পারি? ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন রিফ্যুজি ১৯৫১ বলে, রাষ্ট্রের দ্বারা নিগৃহীত এবং নির্যাতিত হওয়ার ভয় থেকে যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী জাতিগত কারণে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী এবং ভিন্ন রাজনৈতিক দল হওয়ার জন্য দেশের সীমানা অতিক্রম করে তবে তাকে শরণার্থী বলা হবে।

আমরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত লোকদের এই সংজ্ঞায় আনতে পারছি না কারণ তারা দেশীয় সীমানা অতিক্রম করে না। যদি তাদের আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করি তবে বলা যায়, যে লোকটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে নিজের বাসস্থান থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে এবং দেশের সীমানার ভেতর অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়েছে তাকেই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত বলা হবে। এই অধিবেশন যখন হয়েছিল তখন এ বিষয়টি প্রত্যাশিতই ছিল না সে জন্য তাদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়নি।

অতএব বাকি থাকলো আর একটি আইনÑ মানবাধিকার আইন। ১৯৪৮ সালের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় সর্ব প্রথম ব্যক্তি অধিকার বিকাশের জন্য কতিপয় মৌলিক অধিকার ঘোষণা করা হয় এবং এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৬৫ সালে দুটি মানবাধিকার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এবং এই চুক্তিগুলো আইনত বাধ্যতামূলক। একই সঙ্গে এগুলো প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন। আমরা আন্তর্জাতিক আইনসমূহের এই ভাগটিতে ওই সকল বাস্তুচ্যুত লোকদের অধিকারসমূহ অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। কিন্তু এতে করে তাদের অধিকারগুলো সুনির্দিষ্ট করা হবে না। তাদের এই স্পর্শকাতর বিষয়টি খুবই নিবিড় এবং আন্তরিকভাবে সমাধান করা উচিত।

অতএব আমাদের প্রয়োজন একটি সুনির্দিষ্ট কনভেনশন, যেটা শুধুমাত্র এই সকল মানুষের অধিকার এবং প্রতিকারের বিধান তৈরি করবে। স্বাক্ষরিত রাষ্ট্রসমূহ এর বিধানগুলো কঠোরভাবে মেনে চলবে।

এবারে আসা যাক, বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোতে। বাংলাদেশে পরিবেশ নিয়ে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ আইন আছে প্রায় ২টিরও বেশি। দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে পরিবেশের ব্যাপারটি গুরুত্বসহকারে দেখা হয়নি। অনুচ্ছেদ ১৮ক অনুযায়ী এটিকে কেবল রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমরা সবাই জানি যে, সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগ আইনগতভাবে কার্যকর করা যায় না, আদালত এই বিধানগুলোকে কেবলমাত্র ব্যাখ্যা করতে পারবে। কিন্তু এই স্পর্শকাতর বিষয়টি মৌলিক অধিকার অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

আমরা যদি এসকল বাস্তুচ্যুতদের অধিকারগুলো অনুচ্ছেদ ৩২ এর আওতায় অর্থাৎ জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রক্ষণের ভিতর নিয়ে আসি তবে বিষয়টি আরো জটিল হয়ে পারে। কারণ এসকল মৌলিক অধিকার ভোগে কেউ বাধাগ্রস্ত হয়ে সংক্ষুব্ধ হলে অনুচ্ছেদ ১০২ অনুযায়ী সর্বোচ্চ আদালতে রিট দায়ের করতে পারবে। এই সকল মানুষ এমনিতেই অসহায় এবং মূলত সমাজের নিচুতলার এবং অধিকার সম্পর্কে অসচেতন। তাই যে কোনো আইনি ঝামেলায় যাওয়ার মতো মানসিক অবস্থা তাদের থাকে না, যেহেতু রিটের অন্যতম একটি শর্ত হচ্ছে ব্যক্তিগতভাবে সংক্ষুব্ধ হতে হবে, তাই জনস্বার্থমূলক মামলা দায়ের করার ক্ষেত্রে কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে এক্ষেত্রে।

অন্য সকল আইনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট-২০১২, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজিক অ্যাকশন প্ল্যান ২০০৯, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড অ্যাক্ট ২০১০ এ সকল বাস্তুচ্যুতদের অধিকার কিছু মাত্রায় সংরক্ষণ করেছে। Disaster Management Act 2012-এ বলা হয়েছে, The Act aims at setting up an institutional mechanism for disaster management, reduction of vulnerabilities, rehabilitation and providing humanitarian assistance to the victims of natural disaster and Climate Change. এই আইনের লক্ষ্য হচ্ছে এসব মানুষদের মানবিক (humanitarian) সহায়তা দেয়া। যখন আমরা মানবিক সহায়তার কথা বলছি, তখন এটার গুরুত্ব লোপ পাচ্ছে। কারণ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আইনগত কোনো কিছু কার্যকর করা যায় না। তাদের অধিকারগুলো মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। The Bangladesh Climate Change Strategy Action Plan বলছেÑ এ সকল মানুষদের পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য সহযোগিতা দেয়া হবে তাদের পুনর্বাসনের জন্য। কিন্তু কী ধরনের সহযোগিতা, কোন কোন ক্ষেত্রে দেয়া হবে এসব বিষয় সেখানে অনুপস্থিত। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এটা একটা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবেলার কৌশলগত পরিকল্পনা মাত্র। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ যদি তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করেন সেক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আইনের আশ্রয় নিলেও আদালত সাজা দিতে পারবে না যেহেতু এটা বলবৎযোগ্য আইন (Hard Law) নয়। দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ, যেখানে জাতীয় পর্যায়ে অর্থ সংগ্রহ করা হয় এ সকল লোকদের সহযোগিতার জন্য। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর বিরুদ্ধে সমালোচনা রয়েছে যে, অর্থ বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে বাছাইপর্বেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করা হয়। অর্থাৎ এটি দুর্নীতি নামক রাহুতে আক্রান্ত হয়ে আসল উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে।

আমাদের জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত নীতিমালা, আইন এবং কলা-কৌশল সত্ত্বেও আমরা এদের সুরক্ষা দিতে পারছি না। কারণ এ সকল আইনসমূহ সুস্পষ্ট নয় তাদের অধিকার রক্ষায়, আইন নিজেই অসংখ্য ছিদ্রপথ তৈরি করে রেখেছে দায় এড়ানোর। অধিকারের সঙ্গে দায় খুব নিবিড়ভাবে জড়িত। অধিকার দিলে দায়িত্ব এড়ানো যাবে না কোনোভাবেই, সেজন্যই হয়তো তাদের অধিকার সুস্পষ্ট করা হয়নি।

জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকদের উচিত দায়িত্বকে না এড়িয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করা। শুধু এই সকল মানুষদের রক্ষাকল্পে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো নেয়া যেতে পারেÑ

সবার পূর্বে একটি বলবৎযোগ্য আইন তৈরি করা শুধু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয়ে বাস্তুচ্যুতদের অধিকার রক্ষা এবং প্রতিকার বিধানে।

অঞ্চলভিত্তিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। বরিশালের ক্ষতিগ্রস্ত কোনো ব্যক্তি বা পরিবারকে নোয়াখালীতে পুনর্বাসন করলে প্রথা এবং সংস্কৃতিগত ফল তৈরি হতে পারে। সেজন্য অঞ্চলভিত্তিক পুনর্বাসন জরুরি।

পুনর্বাসনের সঙ্গে তাদের জীবিকার বিষয়টিও নিশ্চিত করা, যারা কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত তাদের আবাদি জমির কাছাকাছি পুনর্বাসন করা। যারা জেলে তাদের নদ-নদী এলাকায় পুনর্বাসন করা।

ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বৃহদাকারের হাউজিং প্রকল্প গ্রহণ করা।

মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা পরিবারে সদস্যানুযায়ী।

অঞ্চলভিত্তিক Community Union থাকতে পারে তাদের অধিকার সুরক্ষিত করতে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তাদের হয়ে আদালতে প্রতিনিধিত্ব করবে।

একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, যেটি শুধু এসব মানুষদের সহযোগিতায় কাজ করবে।

পরিশেষে আমাদের সবারই তাদের প্রতি সহমর্মী হওয়া উচিত। তাদের বাস্তুচ্যুতির জন্য তারা কোনোভাবেই দায়ী নয়। শুধুমাত্র মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে আমরা তাদের সহযোগিতা করতে পারি না; খাদ্য, বাসস্থান, মৌলিক অধিকার, বাস্তুচ্যুতির মাধ্যমে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। মানবাধিকার মানুষের অবিচ্ছেদ্য (ওহধষরবহধনষব) অধিকার, শুধুমাত্র মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর বিচার করা যায় না, উচিতও নয়।

[লেখক : শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]