পনেরো বছরেও কিবরিয়া হত্যার বিচার হলো না

মোহাম্মদ শাহজাহান

এ বছর ২৭ জানুয়ারি শাহ এএমএস কিবরিয়ার ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় যে, দীর্ঘ পনেরো বছরেও কূটনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সফল অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যার বিচার হয়নি। আরও দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বিচার প্রক্রিয়ার কোন অগ্রগতিও নেই। এ নিবন্ধ লেখার প্রাক্কালে মামলার সরকারপক্ষের কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট কিশোর কুমার কর, পেশকার আমিনুর রহমান খান ও বিচারকের কার্যালয়ের স্টেনো হুসেন আহমদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত প্রায় ৫ মাস ধরে মামলার বিচারক নেই এবং তিন বছর তিন মাস ধরে মামলার কোন সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসেননি। ২০১৫ সালের শেষ দিকে হবিগঞ্জ আমলি আদালত থেকে সিলেট বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলাটি স্থানান্তরিত হয়। এ মামলার সাক্ষীর সংখ্যা ১৭১ জন। ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত ৪৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হেেছ। মামলায় বিচারক রেজাউল করিম গত বছর অবসরকালীন ছুটিতে যাওয়ার পর থেকে ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ থেকে অদ্যাবধি বিচারকের শূন্যপদে কোন বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়নি।

২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে রেজাউল করিম যোগদান করেছিলেন। এর আগের বিচারক মোহাম্মদ মকবুল হাসান ২০১৭ সালের ৩ আগস্ট থেকে ২০১৮ এর ১ জুলাই পর্যন্ত দীর্ঘ ১১ মাস একাধারে ছুটিতে ছিলেন। ১৪ আগস্ট (২০১৮) পুনরায় মামলার চার্জ গ্রহণ করে কয়েক মাস পর জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে বদলি হয়ে যান। মামলার আসামির সংখ্যা ৩২ জন। মুফতি হান্নানসহ এ মামলার অপর ৩ আসামির অন্য মামলায় ফাঁসি হওয়ার পর তা কার্যকর করা হয়েছে। বাকি ২৯ আসামির মধ্যে ১০ জন জেলহাজতে, ১২ জন জামিনে এবং ৭ জন পলাতক রয়েছেন। ৩ বছরের বেশি সময় ধরে মামলার কোন সাক্ষীর সাক্ষ্য না হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ শুরু থেকে দায়িত্ব পালনরত স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট কিশোর কুমার কর জানান, ‘নিরাপত্তা ও অসুস্থতার কারণে প্রায়ই আসামিদের আদালতে হাজির করা হয় না। লুৎফুজ্জামান বাবরসহ কয়েকজন আসামি রয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন আদালতে মামলা রয়েছে। ওইসব মামলায়ও তাদের আদালতে হাজির হতে হয়।’ কিবরিয়া হত্যা মামলার সর্বশেষ তারিখ ছিল গত বছর (২০১৯) ২৭ নভেম্বর এবং পরবর্তী তারিখ হচ্ছে ৪ ফেব্রুয়ারি।

১৫ বছর আগে ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি সন্ধ্যার দিকে তার নির্বাচনী এলাকা হবিগঞ্জে জনসভা শেষে গাড়িতে ওঠার সময় সুপরিকল্পিত গ্রেনেড হামলায় তিনি নিহত হন। ২৭ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লসকরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ আয়োজিত বৈদ্যেরবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত জনসভার জন্য কয়েকদিন ধরেই প্রচার চলছিল। কারও কারও মতে, ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে ওরা ওই দলের জনপ্রিয় সংসদ সদস্য ও নেতাদের নিধন প্রক্রিয়া শুরু করে। গাজীপুর জেলার জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং কয়েকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যার পর হবিগঞ্জের সংসদ সদস্য এসএএমএস কিবরিয়াকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেকনোক্রেট কোটা থেকে শামস কিবরিয়াকে মন্ত্রী করা হয়েছিল। অবশ্য ১৯৯২ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার পর এই প্রখ্যাত কূটনীতিবিদ দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত হন। তাছাড়া ’৯৬-এর নির্বাচনে কিবরিয়া আওয়ামী লীগ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরপর শেখ হাসিনার ৫ বছরের শাসনামলে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চাঙ্গা রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন অর্থমন্ত্রী শাহ কিবরিয়া। ২১ বছর পর দলকে ক্ষমতায় আনতে যেমন কিবরিয়ার বুদ্ধিমত্তা, কৌশল ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কাজে লেগেছে তেমনি অর্থমন্ত্রী হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য ও অসাধারণ। আর এজন্যই তিনি শত্রুপক্ষের টার্গেটে পরিণত হন।

শামস কিবরিয়া ১৯৭১ সালে আমাদের বৈরী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান দূতাবাসের লোভনীয় চাকরি স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে শুধু অংশই নেননি, নেতৃত্বও দিয়েছেন। শাহ কিবরিয়া এবং এএমএ মুহিতসহ আরও কয়েকজন বাঙালি ’৭১-এর ৪ আগস্ট ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাস ছেড়ে বহির্বিশ্বে স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন শুরু করেন। এ সময় কিবরিয়া বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দেয়া ছাড়াও মার্কিন সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তিনি ১৯৯২ সালে উপদেষ্টাম-লীর সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হন ১৯৯৪ সালে।

দেশ-বিদেশের ষড়যন্ত্রের শিকার আওয়ামী লীগ ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে মাত্র ৬২ আসনে জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনে শাহ কিবরিয়া বিজয়ী হয়ে নিজেই শুধু সংসদ সদস্য হননি, তার জেলা হবিগঞ্জের ৪টি আসনই আওয়ামী লীগ লাভ করে। ক্ষমতা দখল করেই স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত চক্রের প্ররোচনায় চারদলীয় জোট সরকার দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও বিরোধী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন শুরু করে। তখনও নীরবে বসে থাকতে পারলেন না কিবরিয়া। বিভিন্ন দৈনিকে এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে কলাম লেখা শুরু করলেন তিনি। নিজে বের করলেন সাপ্তাহিক মৃদুভাষণ। দেশ ও দলের এই চরম দুঃসময়ে শাহ কিবরিয়া সম্পাদিত এ সাপ্তাহিকটি অন্যায়-অবিচার, অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করে।

দায়িত্বশীল মানুষ কিবরিয়া সত্তরোর্ধ্ব বয়সেও মাসে দু’বার নিয়মিত নিজের নির্বাচনী এলাকায় যাতায়াত করতেন। গ্রেনেড হামলায় আহত দেশের এই গুণী সন্তান অনেকটা বিনা চিকিৎসাতেই আহতাবস্থা থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়াকে কীভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে, তার বর্ণনা রয়েছে তার পুত্রের একটি সাক্ষাৎকারে।

অধ্যাপক ড. রেজা কিবরিয়ার এ ক্ষুব্ধ বক্তব্য ২০০৫ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। ড. রেজা কিবরিয়া বলেছেন, আমার বাবা ৪ ঘণ্টা বিনা চিকিৎসায় থেকে মারা গেছেন। হবিগঞ্জ হাসপাতালে গেট বন্ধ করে দেয়া হয়, আমার আহত বাবাকে হাসপাতালে ঢুকতে দেয়া হয়নি। সেখানে কোন ডাক্তার ছিল না কেন? ৭৩ বছর বয়সী লোক হওয়ার পরও তার ইনজেকশন কেন সবশেষে দেয়া হলো, অ্যাম্বুলেন্স কেন তেল ছাড়া পাঠানো হলো, যেখানে ৪০ মিনিট সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তার সারা শরীরের প্রায় ২শ’ ছিদ্র থেকে রক্ত ঝরেছে, আওয়ামী লীগ নেতারা বিভিন্ন জায়গায় ফোন করেছিলেন, কেউ ফোন ধরেনি। ঢাকার অদূরে কাঁচপুর ব্রিজের কাছে এসে আমার বাবা মারা যান। অথচ সিলেটে দুটি হেলিকপ্টার প্রস্তুত ছিল। কেন তাকে হেলিকপ্টারে আনা হয়নি? ওই সময় হবিগঞ্জে প্রায় দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। এর রহস্য কি? এ জঘন্য হত্যাকা-ে সরকারের হাত আছে কিনা, তা জনগণই বিচার করবেন। (দৈনিক জনকণ্ঠ, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৫)।

কিবরিয়া হত্যার ২৪ দিনের মাথায় শহীদ কিবরিয়া স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ২০০৫-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান প্রয়াত অর্থমন্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায় কেঁদে ফেলেন। কৃতজ্ঞকণ্ঠে কবি বলেন, ‘আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া সাহেব আমাকে দেখতে শুধু হাসপাতালে যাননি, চিকিৎসার জন্য বিদেশেও প্রেরণ করেন। কিবরিয়া সাহেব চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে এতদিন আমি হয়তো বেঁচে থাকতাম না।’ হাসিনা সরকারের অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া অসুস্থ কবিকে চিকিৎসার জন্য একবার দিল্লি এবং দু’বার সিঙ্গাপুরে প্রেরণ করেন। অথচ দুই বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি খালেদা জিয়ার জোট সরকারের আমলে বলতে গেলে বিনা চিকিৎসাতেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।

২০০৭ সালে বাংলাবার্তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারদানকালে সাবেক সচিব ড. আকবর আলি খান বলেন, ‘কিবরিয়া সাহেব অর্থমন্ত্রী থাকাকালে দীর্ঘদিন অর্থ সচিব ছিলেন তিনি। একপর্যায়ে তিনি বলেন, কবি শামসুর রাহমানের অসুস্থ থাকার সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন হবিগঞ্জে। হবিগঞ্জ থেকে সচিবকে ফোন করে বলেন, ‘কবি গুরুতর অসুস্থ, তাকে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসার জন্য বিদেশে প্রেরণ করেন।’ সচিব বলেন, ‘চিকিৎসার অর্থ বরাদ্দের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুমতির প্রয়োজন।’ মন্ত্রীর তাৎক্ষণিক নির্দেশ, ‘প্রধানমন্ত্রীর অনুমতিসহ সবকিছু আমি ঢাকায় ফিরে করে দেব।’ এ ছিলেন মানুষ কিবরিয়া।

ছাত্র হিসেবে, কূটনীতিক হিসেবে, মন্ত্রী হিসেবে, জননেতা হিসেবে, লেখক-সম্পাদক হিসেবে, বন্ধু হিসেবেÑ সর্বক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন এক অনন্য মানুষ। তার ন্যায়পরায়ণতা, সততা, যোগ্যতা, দক্ষতার কোন তুলনা হয় না। এ মানুষটিকেই চারদলীয় জোট সরকারের লেলিয়ে দেয়া মানুষরূপী জানোয়াররা হত্যা করেছে।

কিবরিয়া হত্যাকা- কোন মামুলি হত্যাকা- নয়। এর সঙ্গে তৎকালীন জোট সরকারের হোমড়া-চোমড়ারা জড়িত রয়েছে বলেই অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। শামস কিবরিয়াকে হত্যার পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকার অন্তত ১ বছর ৯ মাস রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। কিন্তু ওই সময়ে কিবরিয়া হত্যার বিচার শুরু করা দূরের কথা একটি বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত পর্যন্ত করা হয়নি। একইভাবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করা, ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক এবং বোমা হামলার ঘটনাগুলোও খালেদা সরকার তাদের ৫ বছর ‘মাটিচাপা’ দিয়ে রেখেছিল। আর তখনই প্রশ্ন ওঠে, ২১ আগস্টের হামলা ও কিবরিয়া হত্যা ষড়যন্ত্রে খালেদার জোট সরকারের রুই-কাতলারা জড়িত ছিল বলেই ওরা এ স্পর্শকাতর মামলাগুলো ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে গেছে।

খালেদা-নিজামীর জোট সরকারের পর সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন-ইয়াজউদ্দিনের ‘পুতুল’ সরকারও ২১ আগস্ট, ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলা ও কিবরিয়া হত্যার বিচারে কোন আন্তরিকতা দেখায়নি। ইতিপূর্বে কিবরিয়া হত্যা মামলার তদন্ত ও বিচারের ব্যাপারে জালিয়াতি ও কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। যেমন ১৬ জানুয়ারি ২০১০ দৈনিক প্রথম আলো ও দৈনিক সমকাল খবর দেয়Ñ ‘শামস কিবরিয়া হত্যাকা-ের ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির ফাইল মন্ত্রণালয় থেকে গায়েব হয়ে গেছে।’ এরপর শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। ওই বছর ১৮ জানুয়ারি (২০১০) দৈনিক ভোরের কাগজ ও দৈনিক আমাদের সময় জানায়, ‘তদন্ত রিপোর্টের সন্ধান মিলেছে।’ ২৭ জানুয়ারি (২০০৫) নিহত কিবরিয়া হত্যা মামলার তদন্তের জন্য পরদিন ২৮ জানুয়ারি পুলিশের সিলেট রেঞ্জের তৎকালীন প্রধান একেএম মাহফুজুল হকের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ১৩ মার্চ ২০০৫ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সরকারের প্রভাবশালীদের নির্দেশ মোতাবেক সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ১৯ মার্চ (২০০৫) মামলার সাজানো চার্জশিট দাখিল করেন।

কিবরিয়া পরিবার গোড়া থেকেই বলে আসছে, হত্যাকারীদের সঙ্গে হত্যার মদদদাতাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিএনপির রুই-কাতলারা যে এ হত্যাকা-ে জড়িত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেকের ধারণ, শুধু কিবরিয়া হত্যা-ষড়যন্ত্রে জড়িত বলেই গত দু’দশক ধরে পলাতক রয়েছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রভাবশালী একান্ত সচিব হারিছ চৌধুরী। তাছাড়া খালেদাপুত্র তারেক রহমানের খাস অনুগামী তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ফখরুদ্দীন আমলে তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেছেন, হাইকমান্ডের নির্দেশে তিনি কিবরিয়া হত্যার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন।

কিবরিয়া পরিবার কিবরিয়া হত্যার বিচারের ব্যাপারে খুবই হতাশ। ক্ষোভের সঙ্গে কিবরিয়াপুত্র ড. রেজা কিবরিয়া বলেছেন, ‘বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রণযোগ্য তদন্ত ছাড়া তো মামলার বিচার হতে পারে না।’ যার শেষ ভালো, তার সব ভালো। কিবরিয়ার দল টানা ১১ বছর ধরে ক্ষমতায়। আমরা আশা করব, দেশ ও জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যার সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য বিচার হবে। পঞ্চদশ মৃত্যুবার্ষিকীতে সাবেক অর্থমন্ত্রী বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা শামস কিবরিয়ার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

২৩ জানুয়ারি, ২০২০।

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা]

bandhu.ch77@yahoo.com

মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২০ , ১৪ মাঘ ১৪২৬, ২ জমাদিউস সানি ১৪৪১

পনেরো বছরেও কিবরিয়া হত্যার বিচার হলো না

মোহাম্মদ শাহজাহান

image

এ বছর ২৭ জানুয়ারি শাহ এএমএস কিবরিয়ার ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় যে, দীর্ঘ পনেরো বছরেও কূটনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সফল অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যার বিচার হয়নি। আরও দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বিচার প্রক্রিয়ার কোন অগ্রগতিও নেই। এ নিবন্ধ লেখার প্রাক্কালে মামলার সরকারপক্ষের কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট কিশোর কুমার কর, পেশকার আমিনুর রহমান খান ও বিচারকের কার্যালয়ের স্টেনো হুসেন আহমদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত প্রায় ৫ মাস ধরে মামলার বিচারক নেই এবং তিন বছর তিন মাস ধরে মামলার কোন সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসেননি। ২০১৫ সালের শেষ দিকে হবিগঞ্জ আমলি আদালত থেকে সিলেট বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলাটি স্থানান্তরিত হয়। এ মামলার সাক্ষীর সংখ্যা ১৭১ জন। ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত ৪৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হেেছ। মামলায় বিচারক রেজাউল করিম গত বছর অবসরকালীন ছুটিতে যাওয়ার পর থেকে ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ থেকে অদ্যাবধি বিচারকের শূন্যপদে কোন বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়নি।

২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে রেজাউল করিম যোগদান করেছিলেন। এর আগের বিচারক মোহাম্মদ মকবুল হাসান ২০১৭ সালের ৩ আগস্ট থেকে ২০১৮ এর ১ জুলাই পর্যন্ত দীর্ঘ ১১ মাস একাধারে ছুটিতে ছিলেন। ১৪ আগস্ট (২০১৮) পুনরায় মামলার চার্জ গ্রহণ করে কয়েক মাস পর জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে বদলি হয়ে যান। মামলার আসামির সংখ্যা ৩২ জন। মুফতি হান্নানসহ এ মামলার অপর ৩ আসামির অন্য মামলায় ফাঁসি হওয়ার পর তা কার্যকর করা হয়েছে। বাকি ২৯ আসামির মধ্যে ১০ জন জেলহাজতে, ১২ জন জামিনে এবং ৭ জন পলাতক রয়েছেন। ৩ বছরের বেশি সময় ধরে মামলার কোন সাক্ষীর সাক্ষ্য না হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ শুরু থেকে দায়িত্ব পালনরত স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট কিশোর কুমার কর জানান, ‘নিরাপত্তা ও অসুস্থতার কারণে প্রায়ই আসামিদের আদালতে হাজির করা হয় না। লুৎফুজ্জামান বাবরসহ কয়েকজন আসামি রয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন আদালতে মামলা রয়েছে। ওইসব মামলায়ও তাদের আদালতে হাজির হতে হয়।’ কিবরিয়া হত্যা মামলার সর্বশেষ তারিখ ছিল গত বছর (২০১৯) ২৭ নভেম্বর এবং পরবর্তী তারিখ হচ্ছে ৪ ফেব্রুয়ারি।

১৫ বছর আগে ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি সন্ধ্যার দিকে তার নির্বাচনী এলাকা হবিগঞ্জে জনসভা শেষে গাড়িতে ওঠার সময় সুপরিকল্পিত গ্রেনেড হামলায় তিনি নিহত হন। ২৭ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লসকরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ আয়োজিত বৈদ্যেরবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত জনসভার জন্য কয়েকদিন ধরেই প্রচার চলছিল। কারও কারও মতে, ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে ওরা ওই দলের জনপ্রিয় সংসদ সদস্য ও নেতাদের নিধন প্রক্রিয়া শুরু করে। গাজীপুর জেলার জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং কয়েকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যার পর হবিগঞ্জের সংসদ সদস্য এসএএমএস কিবরিয়াকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেকনোক্রেট কোটা থেকে শামস কিবরিয়াকে মন্ত্রী করা হয়েছিল। অবশ্য ১৯৯২ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার পর এই প্রখ্যাত কূটনীতিবিদ দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত হন। তাছাড়া ’৯৬-এর নির্বাচনে কিবরিয়া আওয়ামী লীগ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরপর শেখ হাসিনার ৫ বছরের শাসনামলে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চাঙ্গা রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন অর্থমন্ত্রী শাহ কিবরিয়া। ২১ বছর পর দলকে ক্ষমতায় আনতে যেমন কিবরিয়ার বুদ্ধিমত্তা, কৌশল ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কাজে লেগেছে তেমনি অর্থমন্ত্রী হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য ও অসাধারণ। আর এজন্যই তিনি শত্রুপক্ষের টার্গেটে পরিণত হন।

শামস কিবরিয়া ১৯৭১ সালে আমাদের বৈরী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান দূতাবাসের লোভনীয় চাকরি স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে শুধু অংশই নেননি, নেতৃত্বও দিয়েছেন। শাহ কিবরিয়া এবং এএমএ মুহিতসহ আরও কয়েকজন বাঙালি ’৭১-এর ৪ আগস্ট ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাস ছেড়ে বহির্বিশ্বে স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন শুরু করেন। এ সময় কিবরিয়া বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দেয়া ছাড়াও মার্কিন সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তিনি ১৯৯২ সালে উপদেষ্টাম-লীর সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হন ১৯৯৪ সালে।

দেশ-বিদেশের ষড়যন্ত্রের শিকার আওয়ামী লীগ ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে মাত্র ৬২ আসনে জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনে শাহ কিবরিয়া বিজয়ী হয়ে নিজেই শুধু সংসদ সদস্য হননি, তার জেলা হবিগঞ্জের ৪টি আসনই আওয়ামী লীগ লাভ করে। ক্ষমতা দখল করেই স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত চক্রের প্ররোচনায় চারদলীয় জোট সরকার দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও বিরোধী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন শুরু করে। তখনও নীরবে বসে থাকতে পারলেন না কিবরিয়া। বিভিন্ন দৈনিকে এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে কলাম লেখা শুরু করলেন তিনি। নিজে বের করলেন সাপ্তাহিক মৃদুভাষণ। দেশ ও দলের এই চরম দুঃসময়ে শাহ কিবরিয়া সম্পাদিত এ সাপ্তাহিকটি অন্যায়-অবিচার, অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করে।

দায়িত্বশীল মানুষ কিবরিয়া সত্তরোর্ধ্ব বয়সেও মাসে দু’বার নিয়মিত নিজের নির্বাচনী এলাকায় যাতায়াত করতেন। গ্রেনেড হামলায় আহত দেশের এই গুণী সন্তান অনেকটা বিনা চিকিৎসাতেই আহতাবস্থা থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়াকে কীভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে, তার বর্ণনা রয়েছে তার পুত্রের একটি সাক্ষাৎকারে।

অধ্যাপক ড. রেজা কিবরিয়ার এ ক্ষুব্ধ বক্তব্য ২০০৫ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। ড. রেজা কিবরিয়া বলেছেন, আমার বাবা ৪ ঘণ্টা বিনা চিকিৎসায় থেকে মারা গেছেন। হবিগঞ্জ হাসপাতালে গেট বন্ধ করে দেয়া হয়, আমার আহত বাবাকে হাসপাতালে ঢুকতে দেয়া হয়নি। সেখানে কোন ডাক্তার ছিল না কেন? ৭৩ বছর বয়সী লোক হওয়ার পরও তার ইনজেকশন কেন সবশেষে দেয়া হলো, অ্যাম্বুলেন্স কেন তেল ছাড়া পাঠানো হলো, যেখানে ৪০ মিনিট সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তার সারা শরীরের প্রায় ২শ’ ছিদ্র থেকে রক্ত ঝরেছে, আওয়ামী লীগ নেতারা বিভিন্ন জায়গায় ফোন করেছিলেন, কেউ ফোন ধরেনি। ঢাকার অদূরে কাঁচপুর ব্রিজের কাছে এসে আমার বাবা মারা যান। অথচ সিলেটে দুটি হেলিকপ্টার প্রস্তুত ছিল। কেন তাকে হেলিকপ্টারে আনা হয়নি? ওই সময় হবিগঞ্জে প্রায় দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। এর রহস্য কি? এ জঘন্য হত্যাকা-ে সরকারের হাত আছে কিনা, তা জনগণই বিচার করবেন। (দৈনিক জনকণ্ঠ, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৫)।

কিবরিয়া হত্যার ২৪ দিনের মাথায় শহীদ কিবরিয়া স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ২০০৫-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান প্রয়াত অর্থমন্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায় কেঁদে ফেলেন। কৃতজ্ঞকণ্ঠে কবি বলেন, ‘আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া সাহেব আমাকে দেখতে শুধু হাসপাতালে যাননি, চিকিৎসার জন্য বিদেশেও প্রেরণ করেন। কিবরিয়া সাহেব চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে এতদিন আমি হয়তো বেঁচে থাকতাম না।’ হাসিনা সরকারের অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া অসুস্থ কবিকে চিকিৎসার জন্য একবার দিল্লি এবং দু’বার সিঙ্গাপুরে প্রেরণ করেন। অথচ দুই বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি খালেদা জিয়ার জোট সরকারের আমলে বলতে গেলে বিনা চিকিৎসাতেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।

২০০৭ সালে বাংলাবার্তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারদানকালে সাবেক সচিব ড. আকবর আলি খান বলেন, ‘কিবরিয়া সাহেব অর্থমন্ত্রী থাকাকালে দীর্ঘদিন অর্থ সচিব ছিলেন তিনি। একপর্যায়ে তিনি বলেন, কবি শামসুর রাহমানের অসুস্থ থাকার সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন হবিগঞ্জে। হবিগঞ্জ থেকে সচিবকে ফোন করে বলেন, ‘কবি গুরুতর অসুস্থ, তাকে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসার জন্য বিদেশে প্রেরণ করেন।’ সচিব বলেন, ‘চিকিৎসার অর্থ বরাদ্দের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুমতির প্রয়োজন।’ মন্ত্রীর তাৎক্ষণিক নির্দেশ, ‘প্রধানমন্ত্রীর অনুমতিসহ সবকিছু আমি ঢাকায় ফিরে করে দেব।’ এ ছিলেন মানুষ কিবরিয়া।

ছাত্র হিসেবে, কূটনীতিক হিসেবে, মন্ত্রী হিসেবে, জননেতা হিসেবে, লেখক-সম্পাদক হিসেবে, বন্ধু হিসেবেÑ সর্বক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন এক অনন্য মানুষ। তার ন্যায়পরায়ণতা, সততা, যোগ্যতা, দক্ষতার কোন তুলনা হয় না। এ মানুষটিকেই চারদলীয় জোট সরকারের লেলিয়ে দেয়া মানুষরূপী জানোয়াররা হত্যা করেছে।

কিবরিয়া হত্যাকা- কোন মামুলি হত্যাকা- নয়। এর সঙ্গে তৎকালীন জোট সরকারের হোমড়া-চোমড়ারা জড়িত রয়েছে বলেই অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। শামস কিবরিয়াকে হত্যার পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকার অন্তত ১ বছর ৯ মাস রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। কিন্তু ওই সময়ে কিবরিয়া হত্যার বিচার শুরু করা দূরের কথা একটি বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত পর্যন্ত করা হয়নি। একইভাবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করা, ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক এবং বোমা হামলার ঘটনাগুলোও খালেদা সরকার তাদের ৫ বছর ‘মাটিচাপা’ দিয়ে রেখেছিল। আর তখনই প্রশ্ন ওঠে, ২১ আগস্টের হামলা ও কিবরিয়া হত্যা ষড়যন্ত্রে খালেদার জোট সরকারের রুই-কাতলারা জড়িত ছিল বলেই ওরা এ স্পর্শকাতর মামলাগুলো ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে গেছে।

খালেদা-নিজামীর জোট সরকারের পর সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন-ইয়াজউদ্দিনের ‘পুতুল’ সরকারও ২১ আগস্ট, ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলা ও কিবরিয়া হত্যার বিচারে কোন আন্তরিকতা দেখায়নি। ইতিপূর্বে কিবরিয়া হত্যা মামলার তদন্ত ও বিচারের ব্যাপারে জালিয়াতি ও কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। যেমন ১৬ জানুয়ারি ২০১০ দৈনিক প্রথম আলো ও দৈনিক সমকাল খবর দেয়Ñ ‘শামস কিবরিয়া হত্যাকা-ের ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির ফাইল মন্ত্রণালয় থেকে গায়েব হয়ে গেছে।’ এরপর শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। ওই বছর ১৮ জানুয়ারি (২০১০) দৈনিক ভোরের কাগজ ও দৈনিক আমাদের সময় জানায়, ‘তদন্ত রিপোর্টের সন্ধান মিলেছে।’ ২৭ জানুয়ারি (২০০৫) নিহত কিবরিয়া হত্যা মামলার তদন্তের জন্য পরদিন ২৮ জানুয়ারি পুলিশের সিলেট রেঞ্জের তৎকালীন প্রধান একেএম মাহফুজুল হকের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ১৩ মার্চ ২০০৫ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সরকারের প্রভাবশালীদের নির্দেশ মোতাবেক সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ১৯ মার্চ (২০০৫) মামলার সাজানো চার্জশিট দাখিল করেন।

কিবরিয়া পরিবার গোড়া থেকেই বলে আসছে, হত্যাকারীদের সঙ্গে হত্যার মদদদাতাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিএনপির রুই-কাতলারা যে এ হত্যাকা-ে জড়িত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেকের ধারণ, শুধু কিবরিয়া হত্যা-ষড়যন্ত্রে জড়িত বলেই গত দু’দশক ধরে পলাতক রয়েছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রভাবশালী একান্ত সচিব হারিছ চৌধুরী। তাছাড়া খালেদাপুত্র তারেক রহমানের খাস অনুগামী তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ফখরুদ্দীন আমলে তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেছেন, হাইকমান্ডের নির্দেশে তিনি কিবরিয়া হত্যার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন।

কিবরিয়া পরিবার কিবরিয়া হত্যার বিচারের ব্যাপারে খুবই হতাশ। ক্ষোভের সঙ্গে কিবরিয়াপুত্র ড. রেজা কিবরিয়া বলেছেন, ‘বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রণযোগ্য তদন্ত ছাড়া তো মামলার বিচার হতে পারে না।’ যার শেষ ভালো, তার সব ভালো। কিবরিয়ার দল টানা ১১ বছর ধরে ক্ষমতায়। আমরা আশা করব, দেশ ও জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যার সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য বিচার হবে। পঞ্চদশ মৃত্যুবার্ষিকীতে সাবেক অর্থমন্ত্রী বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা শামস কিবরিয়ার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

২৩ জানুয়ারি, ২০২০।

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা]

bandhu.ch77@yahoo.com