১৩টি দেশে আক্রান্তের সন্ধান লাভ

বিশ্ববাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান ডাব্লিউএইচও’র

শতাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া নতুন নিউমোনিয়াসদৃশ করোনাভাইরাসের বিস্তার চীন আটকাতে সক্ষম হবে বলে আশাবাদ জানিয়েছেন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান টেড্রোস আধানম গ্যাব্রেইয়েসুস। একইসঙ্গে বিশ্ববাসীকে শান্ত থাকারও আহ্বান জানান তিনি। উদ্বেগ থাকলেও চীন থেকে এখনি বিদেশি নাগরিকদের সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন নেই বলেও মন্তব্য করেছেন টেড্রোস। চীনা গণমাধ্যমের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

গত সোমবার প্রথমাবের মতো জার্মানিতে করোনা আক্রান্ত এক রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর ফলে জার্মানিসহ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, নেপাল, ফ্রান্স, সৌদি আরব, কানাডাসহ কমপক্ষে ১৩টি দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মিলেছে। করোনা ভাইরাস নিয়ে বিশ্বজুড়ে তুমুল উৎকণ্ঠার মধ্যেই চীনা কর্তৃপক্ষ আরও মানুষের আক্রান্ত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র তার দেশের নাগরিকদের চীন ভ্রমণে সতর্ক করেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উহান থেকে নিজেদের নাগরিক ফিরিয়ে আনতে বিমান পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান। একই ধরনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া ও ফ্রান্স।

সর্বশেষ শ্রীলঙ্কা এবং কম্বোডিয়াসহ ডজনখানেকের বেশি দেশে নিউমোনিয়া সদৃশ এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সন্ধান মিললেও চীনের বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও রাজধানী কলকাতায় প্রথমবারের মতো করোনা অক্রান্ত এক নারীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ নিয়ে বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারেও দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। এমন পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বেইজিংয়ে চীনের স্টেট কাউন্সিলর ওয়াং ই’র সঙ্গে বৈঠক করেছেন ডব্লিউএইচওর প্রধান গ্যাব্রেইয়েসুস। ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধে চীনের সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপে তিনি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, তাদের শীর্ষ কর্মকর্তার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকানোর লক্ষ্যে চীনের সঙ্গে অংশীদারিত্ব আরও জোরদার করা। সম্প্রতি চীন থেকে বিভিন্ন দেশে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত মানুষের খোঁজ মিললেও তাদের মধ্যে কেবল একজনের দেহেই ভাইরাসটি অন্য মানবদেহ থেকে সংক্রমিত হয়েছিল- এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার কথা জানিয়েছে ডব্লিউএইচও। এক টুইটার বার্তায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ‘এখন পর্যন্ত চীনের বাইরে খুব বেশি মানুষের মধ্যে মানবদেহ থেকে মানবদেহে ভাইরাসটির সংক্রমণ দেখা যায়নি বলে আমরা আনন্দিত। ভাইরাসটির বিস্তৃতি সার্বক্ষণিকভাবে আমাদের নজরদারিতে আছে।’

এদিকে করোনাভাইরাস ঠেকাতে চীনের সঙ্গে যাতায়াত বন্ধসহ সীমান্ত সিলগালা করছে হংকং। এ ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে মূল ভূখণ্ড চীনের সঙ্গে যাতায়াত এবং বাসিন্দাদের আন্তঃসীমান্ত ভ্রমণও বন্ধ করে দিচ্ছে হংকং। হংকংয়ের নেতা ক্যারি লাম গতকাল বলেছেন, চীনের সঙ্গে হংকংয়ের দ্রুতগতির রেল সেবা বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে বন্ধ করা হবে। বন্ধ রাখা হবে নৌ এবং ফেরি চলাচলও। হংকং থেকে মূল ভূখণ্ড চীনে বিমানের ফ্লাইট অর্ধেকে নামিয়ে আনা হবে এবং চীন থেকে মানুষ ব্যক্তিগত ভ্রমণে হংকংয়ে আসার অনুমতিও আর পাবে না।

অন্যদিকে, নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়া চীনের হুবেই প্রদেশ থেকে নিজ নাগরিকদের সরিয়ে আনার প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারত। মঙ্গলবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমারের বরাতে এ খবর জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এক টুইটার বার্তায় রবীশ বলেন, ‘চীনের হুবেই প্রদেশে করোনা-২০১৯ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সমস্যায় পড়া ভারতীয় নাগরিকদের সরিয়ে আনার প্রস্তুতি শুরু করেছি আমরা।’ অবরুদ্ধ উহান শহর থেকে ভারতীয়দের সরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে কর্তৃপক্ষ কাজ করছে বলে জানিয়েছেন তিনি। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের উৎস হুবেইয়ের রাজধানী উহান থেকে আনুমানিক ২৫০ জন ভারতীয়কে ফিরিয়ে আনার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমান প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে এর আগে ভারতের স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানানো হয়।

ইউরোপের দেশ জার্মানিতে প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। দেশটির বাভারিয়া অঙ্গরাজ্যে এক ব্যক্তির শরীরে এ ভাইরাস পাওয়া গেছে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে রাজ্যের স্টার্নবার্গ এলাকায় আলাদা করে রাখা হয়েছে। সোমবার রাতে জার্মান স্বাস্থ্য বিভাগের মুখপাত্র জানিয়েছেন, আক্রান্ত ব্যক্তি এখনও পর্যন্ত ভালো আছেন। তার কাছ থেকে অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা কম। ওই ব্যক্তির সংস্পর্শে যারা এসেছেন, তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে কী কী উপসর্গ দেখা দেয়।

এদিকে করোনা আতঙ্কে সতর্ক পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত। দিল্লি ও মুম্বাই শহরের কয়েকটি হাসপাতালে অনেক রোগীকে আলাদাভাবে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া কেরালায় চার শতাধিক মানুষকে নিজেদের বাড়িতেই নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন বিমানবন্দরে প্রায় ৩০ হাজার যাত্রীকে পরীক্ষা করা হয়েছে।

দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ডা. শওকত আলী জানিয়েছেন, কেরালায় তিনটি শহরের বিভিন্ন হাসপাতালের নির্জন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন সাত রোগী পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। এদের মধ্যে ছয় জনের শরীরেই করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। আর বাকি একজনের ফলাফল এখনও হাতে আসেনি। গত ১ জানুয়ারির পর চীন ভ্রমণ করে আসা ব্যক্তিদের জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্টের মতো লক্ষণ থাকলে কাছের চিকিৎসাকেন্দ্রে হাজির হওয়ার পরামর্শ দেয় ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

চীনের রাজধানী বেইজিংসহ ২৯টি প্রদেশে এটি ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়াও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, নেপাল, ফ্রান্স, সৌদি আরব, কানাডাসহ কমপক্ষে ১৩টি দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মিলেছে। অস্ট্রেলিয়ায় গতকাল পর্যন্ত পাঁচজনের সংক্রমিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তারা সবাই চীনের উহান থেকে অস্ট্রেলিয়ায় গেছেন। তাদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। কম্বোডিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত সোমবার জানিয়েছে, তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত একজনকে শনাক্ত করেছে। তার বয়স ৬০ বছর। তিনিও চীনের উহান শহর থেকে কম্বোডিয়ায় গেছেন। তার অবস্থা স্থিতিশীল।

জাপানের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ গত শনিবার জানায়, তারা সংক্রমিত চার ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছে। সর্বশেষ যে ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়, তার বয়স ৪০ বছর। তিনি পুরুষ। উহান থেকে জাপান ভ্রমণে আসেন তিনি। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বাকি তিনজনের মধ্যে দুজন পুরুষ ও একজন নারী। তারাও চীন উহান থেকে জাপানে আসেন। গত রোববার মালয়েশিয়া জানায়, করোনাভাইরাস সংক্রমিত চারজনকে শনাক্ত করেছে মালয়েশিয়া। তারা সবাই চীনের নাগরিক। তারা চীনের উহান থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে মালয়েশিয়া ভ্রমণে আসেন।

নেপাল জানায়, উহান থেকে আসা ৩২ বছর বয়সী এক সংক্রমিত ব্যক্তিকে তারা শনাক্ত করেছে। তাকে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সিঙ্গাপুর এখন পর্যন্ত সংক্রমিত পাঁচজনকে শনাক্ত করার কথা জানিয়েছে। তারা সবাই চীনের উহান থেকে সিঙ্গাপুরে গেছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার গণমাধ্যমে জানিয়েছে, সোমবার পর্যন্ত দেশটিতে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত চারজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন পুরুষ ও একজন নারী। তারা সবাই চীনের উহান থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় গেছেন। শ্রীলঙ্কায় গত সোমবার পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের সংক্রমিত এক ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তার বয়স ৪৩ বছর। তিনি চীনের নাগরিক। হুবেই প্রদেশ থেকে এই নারী পর্যটক হিসেবে গত সপ্তাহে শ্রীলঙ্কায় আসেন। তাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

তাইওয়ানে গতকাল পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সংক্রমিত পাঁচজনকে শনাক্ত করেছে। সর্বশেষ তাইওয়ানের এক ৫০ বছর বয়সী নারীকে শনাক্ত করা হয়। তিনি উহানে কাজ করছিলেন। গত ২০ জানুয়ারি তিনি তাইওয়ান গেছেন। থাইল্যান্ডে গতকাল পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সংক্রমিত আটজনকে শনাক্ত করেছে। তাদের মধ্যে তিনজন চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাকি পাঁচজনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আটজনের মধ্যে একজন থাই নাগরিক। বাকিরা চীনা নাগরিক। ভিয়েতনামে গতকাল পর্যন্ত সংক্রমিত দু’জনকে শনাক্ত করেছে। উহান থেকে এক ব্যক্তি চলতি মাসের শুরুর দিকে হো চি মিন সিটিতে আসেন। তার কাছ থেকে তার ছেলে আক্রান্ত হয়। গত সোমবার পর্যন্ত কানাডায় করোনাভাইরাসে সংক্রমিত এক ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছে। তিনি পুরুষ। তিনি উহান ভ্রমণ করেছেন। তার স্ত্রীও সংক্রমিত হয়েছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রে গতকাল পর্যন্ত করোনাভাইরাস সংক্রমিত পাঁচ ব্যক্তিকে শনাক্ত করার কথা জানা গেছে। সংক্রমিত ব্যক্তিরা সম্প্রতি উহান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। ফ্রান্সে গতকাল পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সংক্রমিত তিন ব্যক্তি শনাক্ত করা হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্সেই প্রথম এই ভাইরাসে সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়। তিনজনই সম্প্রতি চীন সফর করেন। গতকাল জার্মানি প্রথম জানায়, তারা সংক্রমিত এক ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছে। তাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, নতুন এ ভাইরাসের জীবাণুকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নভেল করোনাভাইরাস ২০১৯-সিওভি নাম দিয়েছে। গত সপ্তাহে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে তারা নতুন এ করোনাভাইরাসটি চীনে ‘জরুরি অবস্থা’ সৃষ্টি করেছে বলে জানালেও এখনি বিশ্বের উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি বলে মন্তব্য করেছে। নিউমোনিয়াসদৃশ এ ভাইরাসটির সংক্রমণ ঠেকাতে চলতি সপ্তাহে চীন উহানে সেনাবাহিনী মোতায়েনে বাধ্য হয়েছে। এক কোটি ১০ লাখ বাসিন্দার শহরটির সঙ্গে সব ধরনের পরিবহন যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে।

বুধবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২০ , ১৫ মাঘ ১৪২৬, ৩ জমাদিউস সানি ১৪৪১

শতাধিক প্রাণ কেড়ে নিল করোনা

১৩টি দেশে আক্রান্তের সন্ধান লাভ

বিশ্ববাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান ডাব্লিউএইচও’র

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

শতাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া নতুন নিউমোনিয়াসদৃশ করোনাভাইরাসের বিস্তার চীন আটকাতে সক্ষম হবে বলে আশাবাদ জানিয়েছেন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান টেড্রোস আধানম গ্যাব্রেইয়েসুস। একইসঙ্গে বিশ্ববাসীকে শান্ত থাকারও আহ্বান জানান তিনি। উদ্বেগ থাকলেও চীন থেকে এখনি বিদেশি নাগরিকদের সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন নেই বলেও মন্তব্য করেছেন টেড্রোস। চীনা গণমাধ্যমের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

গত সোমবার প্রথমাবের মতো জার্মানিতে করোনা আক্রান্ত এক রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর ফলে জার্মানিসহ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, নেপাল, ফ্রান্স, সৌদি আরব, কানাডাসহ কমপক্ষে ১৩টি দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মিলেছে। করোনা ভাইরাস নিয়ে বিশ্বজুড়ে তুমুল উৎকণ্ঠার মধ্যেই চীনা কর্তৃপক্ষ আরও মানুষের আক্রান্ত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র তার দেশের নাগরিকদের চীন ভ্রমণে সতর্ক করেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উহান থেকে নিজেদের নাগরিক ফিরিয়ে আনতে বিমান পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান। একই ধরনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া ও ফ্রান্স।

সর্বশেষ শ্রীলঙ্কা এবং কম্বোডিয়াসহ ডজনখানেকের বেশি দেশে নিউমোনিয়া সদৃশ এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সন্ধান মিললেও চীনের বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও রাজধানী কলকাতায় প্রথমবারের মতো করোনা অক্রান্ত এক নারীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ নিয়ে বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারেও দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। এমন পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বেইজিংয়ে চীনের স্টেট কাউন্সিলর ওয়াং ই’র সঙ্গে বৈঠক করেছেন ডব্লিউএইচওর প্রধান গ্যাব্রেইয়েসুস। ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধে চীনের সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপে তিনি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, তাদের শীর্ষ কর্মকর্তার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকানোর লক্ষ্যে চীনের সঙ্গে অংশীদারিত্ব আরও জোরদার করা। সম্প্রতি চীন থেকে বিভিন্ন দেশে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত মানুষের খোঁজ মিললেও তাদের মধ্যে কেবল একজনের দেহেই ভাইরাসটি অন্য মানবদেহ থেকে সংক্রমিত হয়েছিল- এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার কথা জানিয়েছে ডব্লিউএইচও। এক টুইটার বার্তায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ‘এখন পর্যন্ত চীনের বাইরে খুব বেশি মানুষের মধ্যে মানবদেহ থেকে মানবদেহে ভাইরাসটির সংক্রমণ দেখা যায়নি বলে আমরা আনন্দিত। ভাইরাসটির বিস্তৃতি সার্বক্ষণিকভাবে আমাদের নজরদারিতে আছে।’

এদিকে করোনাভাইরাস ঠেকাতে চীনের সঙ্গে যাতায়াত বন্ধসহ সীমান্ত সিলগালা করছে হংকং। এ ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে মূল ভূখণ্ড চীনের সঙ্গে যাতায়াত এবং বাসিন্দাদের আন্তঃসীমান্ত ভ্রমণও বন্ধ করে দিচ্ছে হংকং। হংকংয়ের নেতা ক্যারি লাম গতকাল বলেছেন, চীনের সঙ্গে হংকংয়ের দ্রুতগতির রেল সেবা বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে বন্ধ করা হবে। বন্ধ রাখা হবে নৌ এবং ফেরি চলাচলও। হংকং থেকে মূল ভূখণ্ড চীনে বিমানের ফ্লাইট অর্ধেকে নামিয়ে আনা হবে এবং চীন থেকে মানুষ ব্যক্তিগত ভ্রমণে হংকংয়ে আসার অনুমতিও আর পাবে না।

অন্যদিকে, নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়া চীনের হুবেই প্রদেশ থেকে নিজ নাগরিকদের সরিয়ে আনার প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারত। মঙ্গলবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমারের বরাতে এ খবর জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এক টুইটার বার্তায় রবীশ বলেন, ‘চীনের হুবেই প্রদেশে করোনা-২০১৯ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সমস্যায় পড়া ভারতীয় নাগরিকদের সরিয়ে আনার প্রস্তুতি শুরু করেছি আমরা।’ অবরুদ্ধ উহান শহর থেকে ভারতীয়দের সরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে কর্তৃপক্ষ কাজ করছে বলে জানিয়েছেন তিনি। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের উৎস হুবেইয়ের রাজধানী উহান থেকে আনুমানিক ২৫০ জন ভারতীয়কে ফিরিয়ে আনার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমান প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে এর আগে ভারতের স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানানো হয়।

ইউরোপের দেশ জার্মানিতে প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। দেশটির বাভারিয়া অঙ্গরাজ্যে এক ব্যক্তির শরীরে এ ভাইরাস পাওয়া গেছে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে রাজ্যের স্টার্নবার্গ এলাকায় আলাদা করে রাখা হয়েছে। সোমবার রাতে জার্মান স্বাস্থ্য বিভাগের মুখপাত্র জানিয়েছেন, আক্রান্ত ব্যক্তি এখনও পর্যন্ত ভালো আছেন। তার কাছ থেকে অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা কম। ওই ব্যক্তির সংস্পর্শে যারা এসেছেন, তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে কী কী উপসর্গ দেখা দেয়।

এদিকে করোনা আতঙ্কে সতর্ক পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত। দিল্লি ও মুম্বাই শহরের কয়েকটি হাসপাতালে অনেক রোগীকে আলাদাভাবে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া কেরালায় চার শতাধিক মানুষকে নিজেদের বাড়িতেই নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন বিমানবন্দরে প্রায় ৩০ হাজার যাত্রীকে পরীক্ষা করা হয়েছে।

দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ডা. শওকত আলী জানিয়েছেন, কেরালায় তিনটি শহরের বিভিন্ন হাসপাতালের নির্জন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন সাত রোগী পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। এদের মধ্যে ছয় জনের শরীরেই করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। আর বাকি একজনের ফলাফল এখনও হাতে আসেনি। গত ১ জানুয়ারির পর চীন ভ্রমণ করে আসা ব্যক্তিদের জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্টের মতো লক্ষণ থাকলে কাছের চিকিৎসাকেন্দ্রে হাজির হওয়ার পরামর্শ দেয় ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

চীনের রাজধানী বেইজিংসহ ২৯টি প্রদেশে এটি ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়াও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, নেপাল, ফ্রান্স, সৌদি আরব, কানাডাসহ কমপক্ষে ১৩টি দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মিলেছে। অস্ট্রেলিয়ায় গতকাল পর্যন্ত পাঁচজনের সংক্রমিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তারা সবাই চীনের উহান থেকে অস্ট্রেলিয়ায় গেছেন। তাদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। কম্বোডিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত সোমবার জানিয়েছে, তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত একজনকে শনাক্ত করেছে। তার বয়স ৬০ বছর। তিনিও চীনের উহান শহর থেকে কম্বোডিয়ায় গেছেন। তার অবস্থা স্থিতিশীল।

জাপানের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ গত শনিবার জানায়, তারা সংক্রমিত চার ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছে। সর্বশেষ যে ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়, তার বয়স ৪০ বছর। তিনি পুরুষ। উহান থেকে জাপান ভ্রমণে আসেন তিনি। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বাকি তিনজনের মধ্যে দুজন পুরুষ ও একজন নারী। তারাও চীন উহান থেকে জাপানে আসেন। গত রোববার মালয়েশিয়া জানায়, করোনাভাইরাস সংক্রমিত চারজনকে শনাক্ত করেছে মালয়েশিয়া। তারা সবাই চীনের নাগরিক। তারা চীনের উহান থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে মালয়েশিয়া ভ্রমণে আসেন।

নেপাল জানায়, উহান থেকে আসা ৩২ বছর বয়সী এক সংক্রমিত ব্যক্তিকে তারা শনাক্ত করেছে। তাকে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সিঙ্গাপুর এখন পর্যন্ত সংক্রমিত পাঁচজনকে শনাক্ত করার কথা জানিয়েছে। তারা সবাই চীনের উহান থেকে সিঙ্গাপুরে গেছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার গণমাধ্যমে জানিয়েছে, সোমবার পর্যন্ত দেশটিতে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত চারজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন পুরুষ ও একজন নারী। তারা সবাই চীনের উহান থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় গেছেন। শ্রীলঙ্কায় গত সোমবার পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের সংক্রমিত এক ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তার বয়স ৪৩ বছর। তিনি চীনের নাগরিক। হুবেই প্রদেশ থেকে এই নারী পর্যটক হিসেবে গত সপ্তাহে শ্রীলঙ্কায় আসেন। তাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

তাইওয়ানে গতকাল পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সংক্রমিত পাঁচজনকে শনাক্ত করেছে। সর্বশেষ তাইওয়ানের এক ৫০ বছর বয়সী নারীকে শনাক্ত করা হয়। তিনি উহানে কাজ করছিলেন। গত ২০ জানুয়ারি তিনি তাইওয়ান গেছেন। থাইল্যান্ডে গতকাল পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সংক্রমিত আটজনকে শনাক্ত করেছে। তাদের মধ্যে তিনজন চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাকি পাঁচজনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আটজনের মধ্যে একজন থাই নাগরিক। বাকিরা চীনা নাগরিক। ভিয়েতনামে গতকাল পর্যন্ত সংক্রমিত দু’জনকে শনাক্ত করেছে। উহান থেকে এক ব্যক্তি চলতি মাসের শুরুর দিকে হো চি মিন সিটিতে আসেন। তার কাছ থেকে তার ছেলে আক্রান্ত হয়। গত সোমবার পর্যন্ত কানাডায় করোনাভাইরাসে সংক্রমিত এক ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছে। তিনি পুরুষ। তিনি উহান ভ্রমণ করেছেন। তার স্ত্রীও সংক্রমিত হয়েছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রে গতকাল পর্যন্ত করোনাভাইরাস সংক্রমিত পাঁচ ব্যক্তিকে শনাক্ত করার কথা জানা গেছে। সংক্রমিত ব্যক্তিরা সম্প্রতি উহান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। ফ্রান্সে গতকাল পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সংক্রমিত তিন ব্যক্তি শনাক্ত করা হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্সেই প্রথম এই ভাইরাসে সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়। তিনজনই সম্প্রতি চীন সফর করেন। গতকাল জার্মানি প্রথম জানায়, তারা সংক্রমিত এক ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছে। তাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, নতুন এ ভাইরাসের জীবাণুকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নভেল করোনাভাইরাস ২০১৯-সিওভি নাম দিয়েছে। গত সপ্তাহে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে তারা নতুন এ করোনাভাইরাসটি চীনে ‘জরুরি অবস্থা’ সৃষ্টি করেছে বলে জানালেও এখনি বিশ্বের উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি বলে মন্তব্য করেছে। নিউমোনিয়াসদৃশ এ ভাইরাসটির সংক্রমণ ঠেকাতে চলতি সপ্তাহে চীন উহানে সেনাবাহিনী মোতায়েনে বাধ্য হয়েছে। এক কোটি ১০ লাখ বাসিন্দার শহরটির সঙ্গে সব ধরনের পরিবহন যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে।