আবদুল মান্নান : অন্তরঙ্গ আলোকে

ড. জাহাঙ্গীর আলম

আমার অত্যন্ত কাছের মানুষ, অত্যন্ত আপনজন ছিলেন সদ্যপ্রয়াত নেতা কৃষিবিদ আবদুল মান্নান। বয়সে আমার ছোট, কিন্তু মেধা ও মর্যাদার পরিমাপে অনেক বড়। নির্লোভ চেতনায় অনেক মহান। জনহিতকর মনন ও মানসিকতায় এক অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। তার মতো একজন পরোপকারী বন্ধু ও পথপ্রদর্শক আজকের দিনে বিরল। তার অকাল মৃত্যুর সংবাদ আমার কাছে অকস্মাৎ বজ্রপাতের মতো লেগেছে। মনে হয়েছে, এতে আমরই বুঝি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়ে গেল। এ অনুভূতি শুধু আমারই নয়, আরও অনেকের। আরও হাজার হাজার কৃষিবিদের। আরও লক্ষ লক্ষ গুণগ্রাহী, ভক্ত ও অনুরক্তের। আমরা সবাই তাকে মিস করছি। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় আমরা নীল হয়ে আছি। অশ্রুসিক্ত নয়নে বারবার তাকে স্মরণ করছি। গত ১৮ জানুয়ারি সকালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। গত ২০ জানুয়ারি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন চত্বরে তাকে ফুলে ফুলে ভরে দিয়ে আমরা শেষ বিদায় জানিয়েছি।

আমার জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতম রাজনীতিক ছিলেন আবদুল মান্নান। একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু, ভাই ও সহযাত্রী। প্রথম পরিচয় ১৯৬৯ সালে। তখন তিনি নতুন ভর্তি হয়েছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, কৃষি অনুষদে। সিট পেয়েছেন শামসুল হক হলে। এ ব্লকে। ওই সময় আমিও ছিলাম একই হলের বাসিন্দা। থাকতাম একই ব্লকে। ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে তার সঙ্গে আমার আলাপ, পরিচয়। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতিতে তখন অগ্রদূত-প্রভাতীর (অরাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন) গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় রাজনীতির ছোঁয়া লেগেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। আমি তখন শামসুল হক হলের (তৎকালীন কায়েদে আজম হল) সাধারণ সম্পাদক। প্রথম বর্ষের ছাত্রদের মধ্যে মান্নানই ছিলেন আমার প্রধান সহচর। আমাদের দু’দফা আন্দোলনসহ জাতীয় স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি মিটিং ও মিছিলে তিনি ছিলেন সামনের কাতারের একজন লড়াকু সৈনিক। প্রতিটি সংগ্রামে-প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা ছিল তার। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে তিনি অক্লান্তভাবে কাজ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের একজন দৃঢ়চেতা সংগঠক হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ও আমি অংশ নিয়েছিলাম দুটো ভিন্ন সেক্টরে। স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে আবার ছাত্রলীগের পতাকাতলে সমবেত হয়েছি দুজনেই। তখন আমি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ-সভাপতি। তিনি সদস্য। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে উজ্জীবিত মুজিববাদের এক তুখোড় প্রবক্তা ছিলেন তিনি। পরে তিনি ছাত্রলীগ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি হয়েছিলেন। বাকসুর সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন বিপুল ভোটে।

১৯৭৫ সালে আমার চাকরি হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলে। ঢাকা এলে তিনি আমার অফিসে আসতেন। কখনও উঠতেন আমার বাসায়। আমরা বহু সময় কাটিয়েছি ছাত্র রাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে। বঙ্গবন্ধু নেই, এটি ছিল অনেক দুঃখের, মর্ম যাতনার বিষয়। কিন্তু তাতে তিনি মনোবল হারাননি কখনোই। তার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, ‘রাতের তপস্যা শেষে আসবেই দিন’। আশির দশকের গোড়ার দিকে তিনি সরাসরিভাবে যুক্ত হন ঢাকার ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে। অতঃপর ১৯৮৩-৮৫ সালে তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এটি ছিল আমার কাছে অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। মনে হতো, তিনি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বকে জাতীয় নেতৃত্বের মাঝে নিজেকে ঠাঁয় করে নিয়েছেন। আমাদের মর্যাদা বাড়িয়েছেন। এ সময় আমার বাসা ছিল পূর্ব রাজাবাজার। আমতলার পাশে। হরতাল-অবরোধের আগের রাতে মাঝেমধ্যে তিনি আমার বাসায় থাকতেন। ঘুমোতেন আমার সঙ্গে। ভোরে আমার নামাজ শেষ হতেই এক কাপ চা-বিস্কুট খেয়ে মাঠে নেমে পড়তেন। তিনি পিকেটিং করতেন ফার্মগেট এলাকায়।

ছাত্র রাজনীতি শেষে তিনি যোগ দেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে। প্রথমে সহ-প্রচার সম্পাদক, পরে প্রচার সম্পাদক এবং অতঃপর সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে তিনি এই গৌরবময় সংগঠনটির নেতৃত্বে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে বগুড়া-১ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর অনুষ্ঠিত দুটো নির্বাচনেও তিনি একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার নির্বাচনী এলাকার জনগণের মাঝে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় নেতা, একজন আপন মানুষ। তাদের কল্যাণে তিনি অধিকাংশ সময় সারিয়াকান্দি সোনাতলা এলাকায় ঘুরে বেরিয়েছেন, ভোটারদের জন্য কাজ করেছেন। তাদের উন্নয়নের সাথি হয়েছেন। আমার সুযোগ হয়েছিল ২০১৭ সালের বন্যার পর সারিয়াকান্দি যাওয়ার। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ছিল আমাদের এই যাত্রা ও রিলিফ সামগ্রী বিতরণের আয়োজন। ওই সময় রাজনীতিক অবদুল মান্নানের প্রতি এলাকার সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভালোবাসার নিদর্শন আমি দেখেছি। তাদের নেতার প্রতি ভালোবাসায় আমিও আপ্লুত হয়েছি। গত ২০ জানুয়ারি ২০২০ ওই এলাকার লাখো মানুষ শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রিয় নেতাকে অশ্রুশিক্ত চোখে বিদায় জানিয়েছেন।

দেশের কৃষিবিদদের কাছে আবদুল মান্নান ছিলেন একজন মেধাবী ও তেজদীপ্ত নেতা এবং পথপ্রদর্শক। তিনি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের মহাসচিব পদে পরপর দু’বার নির্বাচিত হয়েছিলেন। কৃষিবিদদের আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি বরবরই একাত্ম ছিলেন। ১৯৭৭ সালে যখন প্রকৃতির আন্দোলন তুঙ্গে, তখন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা সত্ত্বেও তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। ওই সময় কৃষিবিদ অ্যাকশন কমিটির সচিব হিসেবে আমাকে তিনি অনেক সাহস জুগিয়েছেন, সঙ্গ দিয়েছেন। এরপর যতবার কৃষিবিদদের জন্য কর্মক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, তিনি তা নিরসনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। তার কাছে ব্যক্তিগতভাবে কোন সমস্যার কথা বলে এর সমাধান না পেয়ে কখনোই কোন কৃষিবিদ ফিরে আসেননি। তিনি ছিলেন পরিচিত কৃষিবিদদের জন্য ভরসা ও সাশ্রয়স্থল। কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি প্রতিটি সমস্যাকে নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেছেন। প্রতিষ্ঠানিক সমস্যাগুলোকে দ্রুত নিরসনের চেষ্টা করেছেন। কৃষি গবেকষকদের ইনসিটু প্রমোশন ও চাকরির মেয়াদ ৬৫ বছর করার বিষয়ে তিনি খুবই তৎপর ছিলেন। কৃষির নানা সমস্যা নিয়ে আমার সঙ্গে প্রায়ই টেলিফোনে কথা হতো তার। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত জানতে চাইতেন। অনেক আলোচনা সভায় আমার বই বা পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা থেকে তিনি উদ্ধৃতি দিতেন। আমাকে অনেক কদর করেছেন তিনি। আপ্যায়ন করেছেন। সম্মান করেছেন। আমি তার ভীষণ গুণমুগ্ধ। তার মৃত্যুর খবর শুনে মনে হাচ্ছিল আমার হৃদয় স্পন্দনও যেন থেমে যাচ্ছে। আজ তিনি নেই। কিন্তু আমার অনুভবে তিনি বেঁচে আছেন। থাকবেন। মহান আল্লাহর কাছে তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আমিন।

[লেখক : কৃষিবিদ]

বুধবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২০ , ১৫ মাঘ ১৪২৬, ৩ জমাদিউস সানি ১৪৪১

আবদুল মান্নান : অন্তরঙ্গ আলোকে

ড. জাহাঙ্গীর আলম

আমার অত্যন্ত কাছের মানুষ, অত্যন্ত আপনজন ছিলেন সদ্যপ্রয়াত নেতা কৃষিবিদ আবদুল মান্নান। বয়সে আমার ছোট, কিন্তু মেধা ও মর্যাদার পরিমাপে অনেক বড়। নির্লোভ চেতনায় অনেক মহান। জনহিতকর মনন ও মানসিকতায় এক অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। তার মতো একজন পরোপকারী বন্ধু ও পথপ্রদর্শক আজকের দিনে বিরল। তার অকাল মৃত্যুর সংবাদ আমার কাছে অকস্মাৎ বজ্রপাতের মতো লেগেছে। মনে হয়েছে, এতে আমরই বুঝি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়ে গেল। এ অনুভূতি শুধু আমারই নয়, আরও অনেকের। আরও হাজার হাজার কৃষিবিদের। আরও লক্ষ লক্ষ গুণগ্রাহী, ভক্ত ও অনুরক্তের। আমরা সবাই তাকে মিস করছি। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় আমরা নীল হয়ে আছি। অশ্রুসিক্ত নয়নে বারবার তাকে স্মরণ করছি। গত ১৮ জানুয়ারি সকালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। গত ২০ জানুয়ারি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন চত্বরে তাকে ফুলে ফুলে ভরে দিয়ে আমরা শেষ বিদায় জানিয়েছি।

আমার জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতম রাজনীতিক ছিলেন আবদুল মান্নান। একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু, ভাই ও সহযাত্রী। প্রথম পরিচয় ১৯৬৯ সালে। তখন তিনি নতুন ভর্তি হয়েছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, কৃষি অনুষদে। সিট পেয়েছেন শামসুল হক হলে। এ ব্লকে। ওই সময় আমিও ছিলাম একই হলের বাসিন্দা। থাকতাম একই ব্লকে। ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে তার সঙ্গে আমার আলাপ, পরিচয়। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতিতে তখন অগ্রদূত-প্রভাতীর (অরাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন) গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় রাজনীতির ছোঁয়া লেগেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। আমি তখন শামসুল হক হলের (তৎকালীন কায়েদে আজম হল) সাধারণ সম্পাদক। প্রথম বর্ষের ছাত্রদের মধ্যে মান্নানই ছিলেন আমার প্রধান সহচর। আমাদের দু’দফা আন্দোলনসহ জাতীয় স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি মিটিং ও মিছিলে তিনি ছিলেন সামনের কাতারের একজন লড়াকু সৈনিক। প্রতিটি সংগ্রামে-প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা ছিল তার। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে তিনি অক্লান্তভাবে কাজ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের একজন দৃঢ়চেতা সংগঠক হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ও আমি অংশ নিয়েছিলাম দুটো ভিন্ন সেক্টরে। স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে আবার ছাত্রলীগের পতাকাতলে সমবেত হয়েছি দুজনেই। তখন আমি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ-সভাপতি। তিনি সদস্য। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে উজ্জীবিত মুজিববাদের এক তুখোড় প্রবক্তা ছিলেন তিনি। পরে তিনি ছাত্রলীগ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি হয়েছিলেন। বাকসুর সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন বিপুল ভোটে।

১৯৭৫ সালে আমার চাকরি হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলে। ঢাকা এলে তিনি আমার অফিসে আসতেন। কখনও উঠতেন আমার বাসায়। আমরা বহু সময় কাটিয়েছি ছাত্র রাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে। বঙ্গবন্ধু নেই, এটি ছিল অনেক দুঃখের, মর্ম যাতনার বিষয়। কিন্তু তাতে তিনি মনোবল হারাননি কখনোই। তার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, ‘রাতের তপস্যা শেষে আসবেই দিন’। আশির দশকের গোড়ার দিকে তিনি সরাসরিভাবে যুক্ত হন ঢাকার ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে। অতঃপর ১৯৮৩-৮৫ সালে তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এটি ছিল আমার কাছে অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। মনে হতো, তিনি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বকে জাতীয় নেতৃত্বের মাঝে নিজেকে ঠাঁয় করে নিয়েছেন। আমাদের মর্যাদা বাড়িয়েছেন। এ সময় আমার বাসা ছিল পূর্ব রাজাবাজার। আমতলার পাশে। হরতাল-অবরোধের আগের রাতে মাঝেমধ্যে তিনি আমার বাসায় থাকতেন। ঘুমোতেন আমার সঙ্গে। ভোরে আমার নামাজ শেষ হতেই এক কাপ চা-বিস্কুট খেয়ে মাঠে নেমে পড়তেন। তিনি পিকেটিং করতেন ফার্মগেট এলাকায়।

ছাত্র রাজনীতি শেষে তিনি যোগ দেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে। প্রথমে সহ-প্রচার সম্পাদক, পরে প্রচার সম্পাদক এবং অতঃপর সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে তিনি এই গৌরবময় সংগঠনটির নেতৃত্বে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে বগুড়া-১ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর অনুষ্ঠিত দুটো নির্বাচনেও তিনি একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার নির্বাচনী এলাকার জনগণের মাঝে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় নেতা, একজন আপন মানুষ। তাদের কল্যাণে তিনি অধিকাংশ সময় সারিয়াকান্দি সোনাতলা এলাকায় ঘুরে বেরিয়েছেন, ভোটারদের জন্য কাজ করেছেন। তাদের উন্নয়নের সাথি হয়েছেন। আমার সুযোগ হয়েছিল ২০১৭ সালের বন্যার পর সারিয়াকান্দি যাওয়ার। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ছিল আমাদের এই যাত্রা ও রিলিফ সামগ্রী বিতরণের আয়োজন। ওই সময় রাজনীতিক অবদুল মান্নানের প্রতি এলাকার সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভালোবাসার নিদর্শন আমি দেখেছি। তাদের নেতার প্রতি ভালোবাসায় আমিও আপ্লুত হয়েছি। গত ২০ জানুয়ারি ২০২০ ওই এলাকার লাখো মানুষ শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রিয় নেতাকে অশ্রুশিক্ত চোখে বিদায় জানিয়েছেন।

দেশের কৃষিবিদদের কাছে আবদুল মান্নান ছিলেন একজন মেধাবী ও তেজদীপ্ত নেতা এবং পথপ্রদর্শক। তিনি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের মহাসচিব পদে পরপর দু’বার নির্বাচিত হয়েছিলেন। কৃষিবিদদের আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি বরবরই একাত্ম ছিলেন। ১৯৭৭ সালে যখন প্রকৃতির আন্দোলন তুঙ্গে, তখন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা সত্ত্বেও তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। ওই সময় কৃষিবিদ অ্যাকশন কমিটির সচিব হিসেবে আমাকে তিনি অনেক সাহস জুগিয়েছেন, সঙ্গ দিয়েছেন। এরপর যতবার কৃষিবিদদের জন্য কর্মক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, তিনি তা নিরসনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। তার কাছে ব্যক্তিগতভাবে কোন সমস্যার কথা বলে এর সমাধান না পেয়ে কখনোই কোন কৃষিবিদ ফিরে আসেননি। তিনি ছিলেন পরিচিত কৃষিবিদদের জন্য ভরসা ও সাশ্রয়স্থল। কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি প্রতিটি সমস্যাকে নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেছেন। প্রতিষ্ঠানিক সমস্যাগুলোকে দ্রুত নিরসনের চেষ্টা করেছেন। কৃষি গবেকষকদের ইনসিটু প্রমোশন ও চাকরির মেয়াদ ৬৫ বছর করার বিষয়ে তিনি খুবই তৎপর ছিলেন। কৃষির নানা সমস্যা নিয়ে আমার সঙ্গে প্রায়ই টেলিফোনে কথা হতো তার। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত জানতে চাইতেন। অনেক আলোচনা সভায় আমার বই বা পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা থেকে তিনি উদ্ধৃতি দিতেন। আমাকে অনেক কদর করেছেন তিনি। আপ্যায়ন করেছেন। সম্মান করেছেন। আমি তার ভীষণ গুণমুগ্ধ। তার মৃত্যুর খবর শুনে মনে হাচ্ছিল আমার হৃদয় স্পন্দনও যেন থেমে যাচ্ছে। আজ তিনি নেই। কিন্তু আমার অনুভবে তিনি বেঁচে আছেন। থাকবেন। মহান আল্লাহর কাছে তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আমিন।

[লেখক : কৃষিবিদ]