মুজিব শতবর্ষ

মুজিব শাসন আমল : ১৯৭২

২৯ জানুয়ারি

ভারত হতে ২৫ কোটি টাকার নিত্যব্যবহার্য পণ্য আনা হচ্ছে

ভারতীয় দ্রব্যাদি সাহায্য কর্মসূচি অনুযায়ী যেসকল দ্রব্য বাংলাদেশে আমদানি করা হবে তা বহনের জন্য যানবাহনের অভাবের দরুণ ঐসকল দ্রব্যাদি চট্টগ্রাম বা চালনা বন্দরে প্রেরণ করা হবে না। উপযুক্ত যানবাহনে করে তা সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ করা হবে। গত শুক্রবারে অফিসার ও ব্যাংকারদের এক সমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব এমআর সিদ্দিকী উক্ত বিষয় প্রকাশ করেন। জনাব সিদ্দিকী বলেন যে, ভারতীয় দ্রব্যাদির সাহায্য মাধ্যমে ২৫ কোটি টাকার দ্রব্যাদি আমদানি করা হবে। কেরোসিনের মতো অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদিও তার মধ্যে থাকবে। এই সকল দ্রব্যাদির সরবরাহ আগামি দুই মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। মন্ত্রী মহোদয় অতঃপর বলেন যে, বাংলাদেশকে ঝামেলা মুক্তভাবে বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য শুরু করতে হবে। কেননা বাংলাদেশ হতে সকল বৈদেশিক মুদ্রা পাকিস্তানিরা নিয়ে গেছে। কাজেই বিদেশি রাষ্ট্রের নিকট হতে এখনও আকর্ষণীয় বিনিময় বাণিজ্যের প্রস্তাবের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব ইউরোপীয় কতিপয় দেশসহ সাতটি দেশের বাণিজ্য প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করবে এবং তাদের সাথে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে আশা করা যায়। তিনি উল্লেখ করেন যে, এই ধরনের ব্যবস্থা সাময়িকভাবে করা হচ্ছে। কার্যকরি আমদানি নীতি শীঘ্রই ঘোষণা করা হবে।

জনাব সিদ্দিকী বলেন, মূলত বাংলাদশ গরিব দেশ নয়। এখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তার কিছু কিছু আহরণ করা হয়েছে এবং এখানে বহু সম্পদ অনাবিষ্কৃত অবস্থায় রয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার অবস্থা কোনো সময়ই খারাপ অবস্থায় থাকবে না। কেননা আমাদের আমদানি অপেক্ষা রপ্তানির পরিমাণ বেশি হবে। তিনি জানান যে, পাকিস্তানি আমলে দেশরক্ষা বাবদ জাতীয় বাজেটের শতকরা ৬০ ভাগ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করতে হতো। কিন্তু বাংলাদেশে সেই অবস্থা থাকবে না। কেননা বর্তমান যুগে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অস্ত্রশস্ত্রের ওপর নির্ভর করে না। তা নির্ভর করে বৈদেশিক সম্পর্কের ওপর।

৩০ জানুয়ারি

এবার গ্রাম গড়ে তোলার কাজে ব্রতী হন- বঙ্গবন্ধু

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিধ্বস্ত বাংলার গ্রামকে গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করার জন্য মুক্তিবাহিনীর বীর তরুণ যোদ্ধা ও দেশের জনসাধারণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু দৃঢ়প্রত্যয়ের সাথে বলেন যে, বাংলার মাটি সোনার চেয়ে মাটি। তাই বাংলা মানুষের সাফল্যমণ্ডিত হবে। তিনি তার দেশের মানুষকে ‘সোনার মানুষ’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘যেদিন সাড়ে সাত কোটি মানুষ সুখী হবে সেদিন সোনার স্বাধীনতা সার্থক হবে।’ রবিবার তিনি স্টেডিয়ামে ন্যাপ (মোজাফফর গ্রুপ) কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলাবাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে ভাষণ দিচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘অস্ত্র সমর্পণের উদ্দেশ্য এই নয় যে, অস্ত্র কেড়ে নেয়া। বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এখনও ষড়যন্ত্র চলছে। দরকার হলে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এই অস্ত্র ফেরত দেয়া হবে।’ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘আমরা কোনো দেশের ও মানুষের বিরুদ্ধে নই; আমরা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যেকোনো চ্যালেঞ্জই আসুক না কেন, আমরা তার মোকাবেলা করব। আমেরিকা কিংবা যে কেউই হোক না কেন, আমাদের স্বাধীনতা না মেনে নিলে আমরা তার মোকাবিলা করব।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, সর্বাধিক আত্মদানের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করে দেওয়ার শক্তি বিশ্বের কারও নাই। তিনি বলেন, ‘দেশে গণতন্ত্র অবশ্যই কায়েম হবে। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে সুখী করার জন্য সরকার দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।’ তিনি আরও বলেন যে, বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমেই জনগণের সুখ সমৃদ্ধি আসবে। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের গরিব জনসাধারণের বিরুদ্ধে আমার বলার কিছু নাই।’ বাংলাদেশের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন পাকিস্তানি হাতাদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে।

তিনি উল্লেখ করেন যে, পাকিস্তানি পশুবাহিনী সহযোগী দালালদের কিছুতেই ক্ষমা করা হবে না। বঙ্গবন্ধু ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘আপনারা দলমত নির্বিশেষে অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন।’

পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক উচ্ছেদকৃত বস্তিবাসীদের জন্য বিনামূল্যে ৯ হাজার প্লট

গত বৎসর ২৫ মার্চের পর ঢাকার বস্তি এলাকা হতে যারা উচ্ছেদ হয়েছে তাদের মধ্যে বিনামূল্যে ৯ হাজার প্লট বিতরণের জন্য পূর্ত ও নির্মাণ দপ্তর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। রোববার এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে পূর্ত ও গৃহনির্মাণ দপ্তরের মন্ত্রী জনাব মতিউর রহমান বলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। মন্ত্রী মহোদয় জানান যে, প্রতিটি প্লট এর আয়তন হবে এক কাঠা। মিরপুর এলাকার উপকণ্ঠে এবং দ্বিতীয় রাজধানী নামে পরিচিত এলাকার উত্তর ভাগে এই প্লটগুলো অবস্থিত। প্লটগুলোতে পানি সরবরাহ, পয়ঃপ্রণালী, সড়ক এবং বিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকবে। যৌথ পায়খানা ও প্রসাবখানার ব্যবস্থা করা হবে। তবে নিজেদের খরচেই ঘর তৈরি করতে হবে। জনাব মতিউর রহমান জানান যে, এই পুনর্বাসন কর্মসূচি কার্যকরী করার জন্য সরকার ২৬ লক্ষ টাকা ব্যয় করবে। তিনি বলেন যে, ব্যাপকভাবে যাচাই করার পর একটি কমিটির মাধ্যমে প্লট বরাদ্দ করা হবে। এই ব্যাপারে ছিন্নমূল বাসিন্দাদের সত্যিকার প্রতিনিধির সাথেও পরামর্শ করা হবে। পূর্ত ও গৃহনির্মাণ দপ্তরের মন্ত্রী এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন যে, কিছু সংখ্যক লোক পরিত্যক্ত সরকারি জমি দখলের জন্য বাস্তুচ্যুতদের উস্কানি প্রদান করছে। সরকার তা বরদাশত করবে না। তিনি আরও বলেন যে, বিনা অনুমতিতে সরকারি জমি দখলকারীদের অবশ্যই জমি ছেড়ে দিতে হবে। ঢাকা সম্পর্কে তিনি বলেন যে, ঢাকা বর্তমানে একটি দেশের রাজধানীতে পরিণত হয়েছে তাই এই নগরীকে সুন্দর করার জন্য সকলেরই সচেষ্ট হওয়া উচিত।

চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাধিকার থাকবে-বঙ্গবন্ধু

দেশের চাকুরির ব্যাপারে মুক্তি সংগ্রামীদের অগ্রাধিকার থাকবে। রবিবার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাসাবোর গণবাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে তার ভাষণে একথা বলেন। তিনি বলেন, ‘এই ব্যাপারে আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ইতোমধ্যে নির্দেশ দিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, মুক্তিবাহিনী সদস্যদের চাকুরি দেয়ার ব্যাপারে সরকার কোনো প্রচেষ্টা হতে বিরত থাকবে না। এছাড়া তিনি মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মিলিশিয়া পুলিশ ও রিজার্ভ বাহিনীতে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের পুলিশ হবে জনগণের পুলিশ।

৩১ জানুয়ারি

পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের দায়িত্ব বাংলাদেশ নিবে না- বঙ্গবন্ধু

ঢাকা। বঙ্গবন্ধু আজ ডেভিড ফ্রস্টের সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি এই নব্য প্রতিষ্ঠিত জাতির লক্ষ লক্ষ বুভুক্ষু মানুষের সাহায্যের জন্য বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসার আবেদন জানান।

তিনি আরো বলেন, মানবতার নামে যারাই সাহায্য দিবেন, আমি তাদেরই দান গ্রহণ করব। ইয়াহিয়া খানের অমানববাচিত কার্যকলাপের ফলে আজ বাংলাদেশের শতকরা ৮৫ জন মানুষ দুর্বিষহ দুঃখকষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এ সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে বঙ্গবন্ধু প্রায়শ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার জন্য কোনো জাতি কোনোদিন এত মূল্য দেয়নি।

সূত্র : দিনলিপি, বঙ্গবন্ধুর শাসন সময়, ১৯৭২

বুধবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২০ , ১৫ মাঘ ১৪২৬, ৩ জমাদিউস সানি ১৪৪১

মুজিব শতবর্ষ

মুজিব শাসন আমল : ১৯৭২

image

২৯ জানুয়ারি

ভারত হতে ২৫ কোটি টাকার নিত্যব্যবহার্য পণ্য আনা হচ্ছে

ভারতীয় দ্রব্যাদি সাহায্য কর্মসূচি অনুযায়ী যেসকল দ্রব্য বাংলাদেশে আমদানি করা হবে তা বহনের জন্য যানবাহনের অভাবের দরুণ ঐসকল দ্রব্যাদি চট্টগ্রাম বা চালনা বন্দরে প্রেরণ করা হবে না। উপযুক্ত যানবাহনে করে তা সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ করা হবে। গত শুক্রবারে অফিসার ও ব্যাংকারদের এক সমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব এমআর সিদ্দিকী উক্ত বিষয় প্রকাশ করেন। জনাব সিদ্দিকী বলেন যে, ভারতীয় দ্রব্যাদির সাহায্য মাধ্যমে ২৫ কোটি টাকার দ্রব্যাদি আমদানি করা হবে। কেরোসিনের মতো অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদিও তার মধ্যে থাকবে। এই সকল দ্রব্যাদির সরবরাহ আগামি দুই মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। মন্ত্রী মহোদয় অতঃপর বলেন যে, বাংলাদেশকে ঝামেলা মুক্তভাবে বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য শুরু করতে হবে। কেননা বাংলাদেশ হতে সকল বৈদেশিক মুদ্রা পাকিস্তানিরা নিয়ে গেছে। কাজেই বিদেশি রাষ্ট্রের নিকট হতে এখনও আকর্ষণীয় বিনিময় বাণিজ্যের প্রস্তাবের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব ইউরোপীয় কতিপয় দেশসহ সাতটি দেশের বাণিজ্য প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করবে এবং তাদের সাথে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে আশা করা যায়। তিনি উল্লেখ করেন যে, এই ধরনের ব্যবস্থা সাময়িকভাবে করা হচ্ছে। কার্যকরি আমদানি নীতি শীঘ্রই ঘোষণা করা হবে।

জনাব সিদ্দিকী বলেন, মূলত বাংলাদশ গরিব দেশ নয়। এখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তার কিছু কিছু আহরণ করা হয়েছে এবং এখানে বহু সম্পদ অনাবিষ্কৃত অবস্থায় রয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার অবস্থা কোনো সময়ই খারাপ অবস্থায় থাকবে না। কেননা আমাদের আমদানি অপেক্ষা রপ্তানির পরিমাণ বেশি হবে। তিনি জানান যে, পাকিস্তানি আমলে দেশরক্ষা বাবদ জাতীয় বাজেটের শতকরা ৬০ ভাগ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করতে হতো। কিন্তু বাংলাদেশে সেই অবস্থা থাকবে না। কেননা বর্তমান যুগে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অস্ত্রশস্ত্রের ওপর নির্ভর করে না। তা নির্ভর করে বৈদেশিক সম্পর্কের ওপর।

৩০ জানুয়ারি

এবার গ্রাম গড়ে তোলার কাজে ব্রতী হন- বঙ্গবন্ধু

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিধ্বস্ত বাংলার গ্রামকে গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করার জন্য মুক্তিবাহিনীর বীর তরুণ যোদ্ধা ও দেশের জনসাধারণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু দৃঢ়প্রত্যয়ের সাথে বলেন যে, বাংলার মাটি সোনার চেয়ে মাটি। তাই বাংলা মানুষের সাফল্যমণ্ডিত হবে। তিনি তার দেশের মানুষকে ‘সোনার মানুষ’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘যেদিন সাড়ে সাত কোটি মানুষ সুখী হবে সেদিন সোনার স্বাধীনতা সার্থক হবে।’ রবিবার তিনি স্টেডিয়ামে ন্যাপ (মোজাফফর গ্রুপ) কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলাবাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে ভাষণ দিচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘অস্ত্র সমর্পণের উদ্দেশ্য এই নয় যে, অস্ত্র কেড়ে নেয়া। বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এখনও ষড়যন্ত্র চলছে। দরকার হলে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এই অস্ত্র ফেরত দেয়া হবে।’ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘আমরা কোনো দেশের ও মানুষের বিরুদ্ধে নই; আমরা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যেকোনো চ্যালেঞ্জই আসুক না কেন, আমরা তার মোকাবেলা করব। আমেরিকা কিংবা যে কেউই হোক না কেন, আমাদের স্বাধীনতা না মেনে নিলে আমরা তার মোকাবিলা করব।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, সর্বাধিক আত্মদানের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করে দেওয়ার শক্তি বিশ্বের কারও নাই। তিনি বলেন, ‘দেশে গণতন্ত্র অবশ্যই কায়েম হবে। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে সুখী করার জন্য সরকার দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।’ তিনি আরও বলেন যে, বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমেই জনগণের সুখ সমৃদ্ধি আসবে। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের গরিব জনসাধারণের বিরুদ্ধে আমার বলার কিছু নাই।’ বাংলাদেশের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন পাকিস্তানি হাতাদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে।

তিনি উল্লেখ করেন যে, পাকিস্তানি পশুবাহিনী সহযোগী দালালদের কিছুতেই ক্ষমা করা হবে না। বঙ্গবন্ধু ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘আপনারা দলমত নির্বিশেষে অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন।’

পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক উচ্ছেদকৃত বস্তিবাসীদের জন্য বিনামূল্যে ৯ হাজার প্লট

গত বৎসর ২৫ মার্চের পর ঢাকার বস্তি এলাকা হতে যারা উচ্ছেদ হয়েছে তাদের মধ্যে বিনামূল্যে ৯ হাজার প্লট বিতরণের জন্য পূর্ত ও নির্মাণ দপ্তর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। রোববার এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে পূর্ত ও গৃহনির্মাণ দপ্তরের মন্ত্রী জনাব মতিউর রহমান বলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। মন্ত্রী মহোদয় জানান যে, প্রতিটি প্লট এর আয়তন হবে এক কাঠা। মিরপুর এলাকার উপকণ্ঠে এবং দ্বিতীয় রাজধানী নামে পরিচিত এলাকার উত্তর ভাগে এই প্লটগুলো অবস্থিত। প্লটগুলোতে পানি সরবরাহ, পয়ঃপ্রণালী, সড়ক এবং বিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকবে। যৌথ পায়খানা ও প্রসাবখানার ব্যবস্থা করা হবে। তবে নিজেদের খরচেই ঘর তৈরি করতে হবে। জনাব মতিউর রহমান জানান যে, এই পুনর্বাসন কর্মসূচি কার্যকরী করার জন্য সরকার ২৬ লক্ষ টাকা ব্যয় করবে। তিনি বলেন যে, ব্যাপকভাবে যাচাই করার পর একটি কমিটির মাধ্যমে প্লট বরাদ্দ করা হবে। এই ব্যাপারে ছিন্নমূল বাসিন্দাদের সত্যিকার প্রতিনিধির সাথেও পরামর্শ করা হবে। পূর্ত ও গৃহনির্মাণ দপ্তরের মন্ত্রী এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন যে, কিছু সংখ্যক লোক পরিত্যক্ত সরকারি জমি দখলের জন্য বাস্তুচ্যুতদের উস্কানি প্রদান করছে। সরকার তা বরদাশত করবে না। তিনি আরও বলেন যে, বিনা অনুমতিতে সরকারি জমি দখলকারীদের অবশ্যই জমি ছেড়ে দিতে হবে। ঢাকা সম্পর্কে তিনি বলেন যে, ঢাকা বর্তমানে একটি দেশের রাজধানীতে পরিণত হয়েছে তাই এই নগরীকে সুন্দর করার জন্য সকলেরই সচেষ্ট হওয়া উচিত।

চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাধিকার থাকবে-বঙ্গবন্ধু

দেশের চাকুরির ব্যাপারে মুক্তি সংগ্রামীদের অগ্রাধিকার থাকবে। রবিবার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাসাবোর গণবাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে তার ভাষণে একথা বলেন। তিনি বলেন, ‘এই ব্যাপারে আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ইতোমধ্যে নির্দেশ দিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, মুক্তিবাহিনী সদস্যদের চাকুরি দেয়ার ব্যাপারে সরকার কোনো প্রচেষ্টা হতে বিরত থাকবে না। এছাড়া তিনি মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মিলিশিয়া পুলিশ ও রিজার্ভ বাহিনীতে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের পুলিশ হবে জনগণের পুলিশ।

৩১ জানুয়ারি

পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের দায়িত্ব বাংলাদেশ নিবে না- বঙ্গবন্ধু

ঢাকা। বঙ্গবন্ধু আজ ডেভিড ফ্রস্টের সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি এই নব্য প্রতিষ্ঠিত জাতির লক্ষ লক্ষ বুভুক্ষু মানুষের সাহায্যের জন্য বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসার আবেদন জানান।

তিনি আরো বলেন, মানবতার নামে যারাই সাহায্য দিবেন, আমি তাদেরই দান গ্রহণ করব। ইয়াহিয়া খানের অমানববাচিত কার্যকলাপের ফলে আজ বাংলাদেশের শতকরা ৮৫ জন মানুষ দুর্বিষহ দুঃখকষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এ সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে বঙ্গবন্ধু প্রায়শ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার জন্য কোনো জাতি কোনোদিন এত মূল্য দেয়নি।

সূত্র : দিনলিপি, বঙ্গবন্ধুর শাসন সময়, ১৯৭২