প্রচারণা শেষ আজ শনিবার ভোট

অস্ত্রবাজে সয়লাব ঢাকা! আ’লীগ-বিএনপির পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থীদের শেষ মুহূর্তের প্রচারণা চলছে। নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, আজ মধ্যরাতেই শেষ হচ্ছে এই প্রচারণা; শনিবার ভোট। দুই সিটিতে মেয়র পদ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির লড়াই জমে উঠেছে। রাজধানী ছেয়ে গেছে নৌকা আর ধানের শীষের পোস্টার আর নির্বাচনী ক্যাম্পে। দলীয়ভাবে মেয়র এবং নির্দলীয় কাউন্সিলর নির্বাচন হলেও দল সমর্থিত কাউন্সিলর ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা দলীয় মেয়রের পক্ষে মিছিল করছেন। বিচ্ছিন্ন কয়েকটি সংঘর্ষ ছাড়া দুই সিটিতে প্রার্থীদের প্রচারণা শান্তিপূর্ণভাবেই চলছে। তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা ভোটের দিন কেন্দ্র দখল ও সহিংসতার আভাস দিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন। যা নগরবাসীকে আতঙ্ক ও শঙ্কায় ফেলার পাশাপাশি নির্বাচনী পরিবেশ উত্তপ্ত করে তুলেছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী মঙ্গলবার বলেছেন, বিএনপি ভোটের দিন কেন্দ্র দখল নিতে, নির্বাচনের দিন সশস্ত্র মহড়া দিতে, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে, বাইরে থেকে অস্ত্রধারী গুণ্ডাদের ঢাকায় এনে জড়ো করছে। বিষয়টি দেখতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. খন্দকার মোশাররফ হোসেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের এ অভিযোগ হাস্যকর মন্তব্য করে বলেছেন, তারাই (আওয়ামী লীগ) এটা করছে। প্রায় ত্রিশ লক্ষ নেতাকর্মী তারা ঢাকা শহরে এনেছে এবং অস্ত্রশস্ত্রসহ এনেছে। কারণ, পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোন রকম ব্যবস্থা নেবে না ওবায়দুল কাদের সাহেব এই ‘উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে’ দিতে এই কথা বলেছেন।

এখন পর্যন্ত সিটি ভোট নিয়ে রাজধানীতে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। নানা প্রতিশ্রতি আর কথামালায় ভোটারের মন জয় করে প্রত্যেক প্রার্থীই চাচ্ছেন ভোটের মাঠে জয়ী হতে। ইতোমধ্যে দুই সিটিতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। ফলে নির্বাচনী আমেজ সৃষ্টি হলেও ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন ভোটাররা। আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও অনেক জায়গায় ইসির কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এদিকে প্রচারের শেষ মুহূর্তে এসে অবৈধ প্রচারসামগ্রী অপসারণের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছে ইসি। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে জরুরিভিত্তিতে এসব প্রচারসামগ্রী অপসারণে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ইসির তথ্যানুযায়ী, দুই সিটির ৬৪ শতাংশ ভোটকেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা দুটি বড়ো দলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ প্রসঙ্গে বলেন, মারামারি হওয়া খারাপ। আমাদের তাৎক্ষণিক করার কিছু নেই। এটা হলে মামলা হবে। পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে বলেন, সুনির্দিষ্টভাবে কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাতে বড়ো ধরনের আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে এমন নয়। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে দুটি অতর্কিত ঘটনা ঘটে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা না করার জন্য বলা হয়েছে। রিটার্নিং অফিসারকেও এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

দুই সিটিতে মেয়র প্রার্থী ১৩ জন। উত্তর সিটিতে সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ৫৪টি পদে ২৫১ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের ১৮টি পদে ৭৭ জন ভোটের মাঠে আছেন। দক্ষিণ সিটিতে ২ জন সাধারণ কাউন্সিলর এবং ২ জন সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় অবশিষ্ট সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ৭৩টি পদে ৩৩৫ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের ২৩টি পদে ৮২ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। গত ১০ জানুয়ারি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারণা শুরু করেন। এরপর থেকে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা ভোটারদের দোরগোড়ায় ছুটছেন। তীব্র শীতেও থেমে নেই প্রার্থীদের প্রচার।

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) নির্বাচন বিধিমালা অনুযায়ী, ভোটগ্রহণ শুরুর ৩২ ঘণ্টা আগে প্রচারকাজ বন্ধ করতে হবে। ভোটগ্রহণ শুরু ১ ফেব্রুযারি সকাল ৮টায়। এক্ষেত্রে প্রচার বন্ধ করতে হবে ৩০ জানুয়ারি মধ্যরাত ১২টায়। বিধি অনুযায়ী ‘কোন নির্বাচনি এলাকার ভোটগ্রহণ শুরুর পূর্ববর্তী ৩২ ঘণ্টা, ভোটগ্রহণের দিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা এবং ভোটগ্রহণের দিন রাত ১২টা থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে উক্ত নির্বাচনি এলাকায় কোন ব্যক্তি কোন জনসভা আহবান, অনুষ্ঠান বা তাতে যোগদান করা এবং কোন মিছিল বা শোভাযাত্রা সংগঠিত বা তাতে যোগদান করতে পারবেন না। উক্ত সময়ে কোন আক্রমণাত্মক কাজ বা বিশৃঙ্খলামূলক আচরণ করতে পারবেন না। ভোটার বা নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত বা দায়িত্ব পালনরত কোন ব্যক্তিকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা যাবে না। কোন অস্ত্র বা শক্তিও প্রদর্শন বা ব্যবহার করতে পারবেন না। উল্লেখিত আইন ভঙ্গ করলে তিনি ন্যূনতম ছয় মাস ও অনধিক সাত বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকবে দুই সিটি : নগরীকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হচ্ছে। কাল থেকে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বসানো হচ্ছে নিরাপত্তা চৌকি। ভোটারদের নিরাপত্তা আর ভোটদান নির্বিঘ্ন করতে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হচ্ছে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও আনসার মিলে অর্ধ লক্ষেরও বেশি সদস্য নির্বাচনের মাঠে কাজ করছেন। নির্বাচনি অপরাধ দমন ও সংক্ষিপ্ত বিচার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মাঠে রয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেটরা।

যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা : ঢাকার দুই সিটিতে আগামী ১ ফেব্রুয়ারি ভোট উপলক্ষে ৩১ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১২টা থেকে নির্বাচনের দিন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রাজধানীতে অটোরিকশা, ট্যাক্সি ক্যাব, মাইক্রোবাস, এসইউভি, পিকআপ, বাস, ট্রাক ও অন্যান্য মোটরচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। এছাড়া ৩০ জানুয়ারি মধ্যরাত থেকে ২ ফেব্রুযারি ভোর ৬টা পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের অনুমোদন নিয়ে প্রার্থী, তাদের এজেন্ট, স্থানীয় ও বিদেশি পর্যবেক্ষকরা এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকতে পারবেন। অ্যাম্বুলেন্স, নির্বাচন কর্মকর্তা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং টেলিকম প্রভৃতি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের যানবাহন এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে।

দুই সিটির ৬৪ শতাংশ ভোট কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ: ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই হাজার ৪৮৮টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে এক হাজার ৫৯৭টি ভোটকেন্দ্রকেই গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তর সিটিতে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের সংখ্যা ৮৭৬টি, দক্ষিণে ৭২১টি। বাকি ৮৯১টি কেন্দ্র সাধারণ কেন্দ্র হিসেবে গণ্য হবে। সব মিলিয়ে দুই সিটির মোট ভোটকেন্দ্রের ৬৪ শতাংশ কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ। ইসি জানায়, গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে।

আতিকুল : উত্তরে নৌকার প্রার্থী আতিকুল ইসলাম গুলশানের শহীদ ফজলে রাব্বি পার্ক থেকে প্রচারণা শুরু করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় প্রচারণা চালাতে পারেননি তিনি। পরে মহাখালী ওয়ারলেস গেট এলাকাসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রচারণা চালান তিনি। প্রচারণার সময় তিনি বলেন, আমি গত নয় মাস একটি কঠিন অনুশীলন করেছি। সেই অনুশীলনের অভিজ্ঞতা থেকে আপনাদের আধুনিক ঢাকা উপহার দিতে পারব ইনশাআল্লাহ্। নৌকা দিয়েছে স্বাধীনতা, নৌকা দিয়েছে লাল-সবুজের পতাকা। আগামী ১ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনকে সামনে রেখে আনুরোধ করবো, আপনারা আবার নৌকাকে বিজয়ী করে একটি আধুনিক ঢাকা গড়ার সুযোগ করে দিন। আপনাদের ভোটে আমি মেয়র নির্বাচিত হলে কথা দিতে চাই, একটি আধুনিক, সচল, গতিময় ঢাকা উপহার দিতে সর্বাত্মক কাজ করবো। নৌকার কোন ব্যাক গিয়ার নেই, নৌকার গিয়ার একটিই সেটা হলো উন্নয়নের গিয়ার। নৌকা মার্কা নির্বাচিত হলে উন্নয়ন হবেই।

তাবিথ : গতকাল নর্দ্দা এলাকায় প্রচারণা চালান উত্তরে ধানের শীষের প্রার্থী তাবিথ আউয়াল। প্রচারণার সময় তিনি বলেন, যেভাবে ভোটারদের সাড়া পাচ্ছি, তাতে ধানের শীষের বিজয় ঠেকানো যাবে না। বিজয়ী হওয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি আমরা নিয়েছি। আমরা ভোটকেন্দ্রে যাব, আমাদের পোলিং এজেন্টরা যাবেন, প্রার্থীরা যাবেন। ভোটের পরিবেশ নির্বাচন কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে। সব পরিস্থিতিতে যেন ভোটাররা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে তা কমিশনকেই নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বারিধারা ডিওএইচএস দক্ষিণ গেট (ইউনাইটেড হাসপাতালের পাশে) এবং কালাচাঁদপুর এলাকায়ও প্রচারণা চালান।

তাপস : দক্ষিণে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস গতকাল নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেন। এরপর তিনি প্রেসক্লাবে এক মতবিনিময় সভায়ও অংশ নেন। এ সময় তিনি বলেন, ঢাকাবাসীর চাহিদা বেশি নয়। চার-পাঁচটা মৌলিক সমস্যা সমাধান করলেই তারা সন্তুষ্ট। কিন্তু আমরা অনেক সময় অতিবাহিত করে ফেলেছি। আমি দায়িত্ব নেয়ার ৯০ দিনের মধ্যে ঢাকাবাসীর মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান করব।

ইশরাক : দক্ষিণে বিএনপির মেয়রপ্রার্থী ইশরাক হোসেন পুরান ঢাকায় প্রচারণা চালিয়েছেন। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আমরা নানা বাধা-বিপত্তির মুখে পড়েছি তা আপনাদের সামনে সবসময় তুলে ধরেছি, আপনারাও সব দেখেছেন। আমি বলতে চাই, আগামী ১ ফেব্রুয়ারি সব ভোটাররা নির্ভয়ে নির্বিঘে্ন ভোটকেন্দ্রে যাবেন। আমরা আমাদের সব দায়িত্ব পালন করব, যাতে করে ভোটাররা সব ভয়ভীতি, হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে ভোটকেন্দ্রে যেয়ে নির্বিঘে্ন ভোট দিতে পারেন এবং তাদের অধিকার করার লক্ষ্যে ধানের শীষের প্রার্থীদের ভোট দিয়ে বিজয়ী করবেন।

বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২০ , ১৬ মাঘ ১৪২৬, ৪ জমাদিউস সানি ১৪৪১

প্রচারণা শেষ আজ শনিবার ভোট

অস্ত্রবাজে সয়লাব ঢাকা! আ’লীগ-বিএনপির পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

ফয়েজ আহমেদ তুষার ও ইমদাদুল হাসান রাতুল

image

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থীদের শেষ মুহূর্তের প্রচারণা চলছে। নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, আজ মধ্যরাতেই শেষ হচ্ছে এই প্রচারণা; শনিবার ভোট। দুই সিটিতে মেয়র পদ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির লড়াই জমে উঠেছে। রাজধানী ছেয়ে গেছে নৌকা আর ধানের শীষের পোস্টার আর নির্বাচনী ক্যাম্পে। দলীয়ভাবে মেয়র এবং নির্দলীয় কাউন্সিলর নির্বাচন হলেও দল সমর্থিত কাউন্সিলর ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা দলীয় মেয়রের পক্ষে মিছিল করছেন। বিচ্ছিন্ন কয়েকটি সংঘর্ষ ছাড়া দুই সিটিতে প্রার্থীদের প্রচারণা শান্তিপূর্ণভাবেই চলছে। তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা ভোটের দিন কেন্দ্র দখল ও সহিংসতার আভাস দিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন। যা নগরবাসীকে আতঙ্ক ও শঙ্কায় ফেলার পাশাপাশি নির্বাচনী পরিবেশ উত্তপ্ত করে তুলেছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী মঙ্গলবার বলেছেন, বিএনপি ভোটের দিন কেন্দ্র দখল নিতে, নির্বাচনের দিন সশস্ত্র মহড়া দিতে, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে, বাইরে থেকে অস্ত্রধারী গুণ্ডাদের ঢাকায় এনে জড়ো করছে। বিষয়টি দেখতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. খন্দকার মোশাররফ হোসেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের এ অভিযোগ হাস্যকর মন্তব্য করে বলেছেন, তারাই (আওয়ামী লীগ) এটা করছে। প্রায় ত্রিশ লক্ষ নেতাকর্মী তারা ঢাকা শহরে এনেছে এবং অস্ত্রশস্ত্রসহ এনেছে। কারণ, পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোন রকম ব্যবস্থা নেবে না ওবায়দুল কাদের সাহেব এই ‘উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে’ দিতে এই কথা বলেছেন।

এখন পর্যন্ত সিটি ভোট নিয়ে রাজধানীতে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। নানা প্রতিশ্রতি আর কথামালায় ভোটারের মন জয় করে প্রত্যেক প্রার্থীই চাচ্ছেন ভোটের মাঠে জয়ী হতে। ইতোমধ্যে দুই সিটিতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। ফলে নির্বাচনী আমেজ সৃষ্টি হলেও ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন ভোটাররা। আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও অনেক জায়গায় ইসির কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এদিকে প্রচারের শেষ মুহূর্তে এসে অবৈধ প্রচারসামগ্রী অপসারণের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছে ইসি। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে জরুরিভিত্তিতে এসব প্রচারসামগ্রী অপসারণে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ইসির তথ্যানুযায়ী, দুই সিটির ৬৪ শতাংশ ভোটকেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা দুটি বড়ো দলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ প্রসঙ্গে বলেন, মারামারি হওয়া খারাপ। আমাদের তাৎক্ষণিক করার কিছু নেই। এটা হলে মামলা হবে। পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে বলেন, সুনির্দিষ্টভাবে কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাতে বড়ো ধরনের আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে এমন নয়। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে দুটি অতর্কিত ঘটনা ঘটে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা না করার জন্য বলা হয়েছে। রিটার্নিং অফিসারকেও এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

দুই সিটিতে মেয়র প্রার্থী ১৩ জন। উত্তর সিটিতে সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ৫৪টি পদে ২৫১ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের ১৮টি পদে ৭৭ জন ভোটের মাঠে আছেন। দক্ষিণ সিটিতে ২ জন সাধারণ কাউন্সিলর এবং ২ জন সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় অবশিষ্ট সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ৭৩টি পদে ৩৩৫ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের ২৩টি পদে ৮২ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। গত ১০ জানুয়ারি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারণা শুরু করেন। এরপর থেকে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা ভোটারদের দোরগোড়ায় ছুটছেন। তীব্র শীতেও থেমে নেই প্রার্থীদের প্রচার।

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) নির্বাচন বিধিমালা অনুযায়ী, ভোটগ্রহণ শুরুর ৩২ ঘণ্টা আগে প্রচারকাজ বন্ধ করতে হবে। ভোটগ্রহণ শুরু ১ ফেব্রুযারি সকাল ৮টায়। এক্ষেত্রে প্রচার বন্ধ করতে হবে ৩০ জানুয়ারি মধ্যরাত ১২টায়। বিধি অনুযায়ী ‘কোন নির্বাচনি এলাকার ভোটগ্রহণ শুরুর পূর্ববর্তী ৩২ ঘণ্টা, ভোটগ্রহণের দিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা এবং ভোটগ্রহণের দিন রাত ১২টা থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে উক্ত নির্বাচনি এলাকায় কোন ব্যক্তি কোন জনসভা আহবান, অনুষ্ঠান বা তাতে যোগদান করা এবং কোন মিছিল বা শোভাযাত্রা সংগঠিত বা তাতে যোগদান করতে পারবেন না। উক্ত সময়ে কোন আক্রমণাত্মক কাজ বা বিশৃঙ্খলামূলক আচরণ করতে পারবেন না। ভোটার বা নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত বা দায়িত্ব পালনরত কোন ব্যক্তিকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা যাবে না। কোন অস্ত্র বা শক্তিও প্রদর্শন বা ব্যবহার করতে পারবেন না। উল্লেখিত আইন ভঙ্গ করলে তিনি ন্যূনতম ছয় মাস ও অনধিক সাত বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকবে দুই সিটি : নগরীকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হচ্ছে। কাল থেকে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বসানো হচ্ছে নিরাপত্তা চৌকি। ভোটারদের নিরাপত্তা আর ভোটদান নির্বিঘ্ন করতে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হচ্ছে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও আনসার মিলে অর্ধ লক্ষেরও বেশি সদস্য নির্বাচনের মাঠে কাজ করছেন। নির্বাচনি অপরাধ দমন ও সংক্ষিপ্ত বিচার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মাঠে রয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেটরা।

যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা : ঢাকার দুই সিটিতে আগামী ১ ফেব্রুয়ারি ভোট উপলক্ষে ৩১ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১২টা থেকে নির্বাচনের দিন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রাজধানীতে অটোরিকশা, ট্যাক্সি ক্যাব, মাইক্রোবাস, এসইউভি, পিকআপ, বাস, ট্রাক ও অন্যান্য মোটরচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। এছাড়া ৩০ জানুয়ারি মধ্যরাত থেকে ২ ফেব্রুযারি ভোর ৬টা পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের অনুমোদন নিয়ে প্রার্থী, তাদের এজেন্ট, স্থানীয় ও বিদেশি পর্যবেক্ষকরা এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকতে পারবেন। অ্যাম্বুলেন্স, নির্বাচন কর্মকর্তা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং টেলিকম প্রভৃতি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের যানবাহন এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে।

দুই সিটির ৬৪ শতাংশ ভোট কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ: ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই হাজার ৪৮৮টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে এক হাজার ৫৯৭টি ভোটকেন্দ্রকেই গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তর সিটিতে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের সংখ্যা ৮৭৬টি, দক্ষিণে ৭২১টি। বাকি ৮৯১টি কেন্দ্র সাধারণ কেন্দ্র হিসেবে গণ্য হবে। সব মিলিয়ে দুই সিটির মোট ভোটকেন্দ্রের ৬৪ শতাংশ কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ। ইসি জানায়, গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে।

আতিকুল : উত্তরে নৌকার প্রার্থী আতিকুল ইসলাম গুলশানের শহীদ ফজলে রাব্বি পার্ক থেকে প্রচারণা শুরু করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় প্রচারণা চালাতে পারেননি তিনি। পরে মহাখালী ওয়ারলেস গেট এলাকাসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রচারণা চালান তিনি। প্রচারণার সময় তিনি বলেন, আমি গত নয় মাস একটি কঠিন অনুশীলন করেছি। সেই অনুশীলনের অভিজ্ঞতা থেকে আপনাদের আধুনিক ঢাকা উপহার দিতে পারব ইনশাআল্লাহ্। নৌকা দিয়েছে স্বাধীনতা, নৌকা দিয়েছে লাল-সবুজের পতাকা। আগামী ১ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনকে সামনে রেখে আনুরোধ করবো, আপনারা আবার নৌকাকে বিজয়ী করে একটি আধুনিক ঢাকা গড়ার সুযোগ করে দিন। আপনাদের ভোটে আমি মেয়র নির্বাচিত হলে কথা দিতে চাই, একটি আধুনিক, সচল, গতিময় ঢাকা উপহার দিতে সর্বাত্মক কাজ করবো। নৌকার কোন ব্যাক গিয়ার নেই, নৌকার গিয়ার একটিই সেটা হলো উন্নয়নের গিয়ার। নৌকা মার্কা নির্বাচিত হলে উন্নয়ন হবেই।

তাবিথ : গতকাল নর্দ্দা এলাকায় প্রচারণা চালান উত্তরে ধানের শীষের প্রার্থী তাবিথ আউয়াল। প্রচারণার সময় তিনি বলেন, যেভাবে ভোটারদের সাড়া পাচ্ছি, তাতে ধানের শীষের বিজয় ঠেকানো যাবে না। বিজয়ী হওয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি আমরা নিয়েছি। আমরা ভোটকেন্দ্রে যাব, আমাদের পোলিং এজেন্টরা যাবেন, প্রার্থীরা যাবেন। ভোটের পরিবেশ নির্বাচন কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে। সব পরিস্থিতিতে যেন ভোটাররা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে তা কমিশনকেই নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বারিধারা ডিওএইচএস দক্ষিণ গেট (ইউনাইটেড হাসপাতালের পাশে) এবং কালাচাঁদপুর এলাকায়ও প্রচারণা চালান।

তাপস : দক্ষিণে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস গতকাল নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেন। এরপর তিনি প্রেসক্লাবে এক মতবিনিময় সভায়ও অংশ নেন। এ সময় তিনি বলেন, ঢাকাবাসীর চাহিদা বেশি নয়। চার-পাঁচটা মৌলিক সমস্যা সমাধান করলেই তারা সন্তুষ্ট। কিন্তু আমরা অনেক সময় অতিবাহিত করে ফেলেছি। আমি দায়িত্ব নেয়ার ৯০ দিনের মধ্যে ঢাকাবাসীর মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান করব।

ইশরাক : দক্ষিণে বিএনপির মেয়রপ্রার্থী ইশরাক হোসেন পুরান ঢাকায় প্রচারণা চালিয়েছেন। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আমরা নানা বাধা-বিপত্তির মুখে পড়েছি তা আপনাদের সামনে সবসময় তুলে ধরেছি, আপনারাও সব দেখেছেন। আমি বলতে চাই, আগামী ১ ফেব্রুয়ারি সব ভোটাররা নির্ভয়ে নির্বিঘে্ন ভোটকেন্দ্রে যাবেন। আমরা আমাদের সব দায়িত্ব পালন করব, যাতে করে ভোটাররা সব ভয়ভীতি, হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে ভোটকেন্দ্রে যেয়ে নির্বিঘে্ন ভোট দিতে পারেন এবং তাদের অধিকার করার লক্ষ্যে ধানের শীষের প্রার্থীদের ভোট দিয়ে বিজয়ী করবেন।