সম্ভাবনাময় চা শিল্প খাতে নজর পড়ুক

ধীরে ধীরে চা এ দেশে একটি কৃষিভিত্তিক শ্রমঘন শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রফতানি আয় বৃদ্ধি, আমদানি বিকল্প দ্রব্য উৎপাদন এবং গ্রামীণ দারিদ্য হ্রাসকরণের মাধ্যমে চা জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দিকেই। ক্রমান্বয়ে চায়ের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু সে তুলনায় উৎপাদন বাড়ছে না। বাংলাদেশ ১৯৮৯ সালে চা উৎপাদনে বিশ্বে ১২তম স্থানে ছিল। গত শতকের শেষের দিকে ১১তম অবস্থানে ছিল। কয়েক বছর আগে দশম অবস্থানে ছিল। ‘বাংলাদেশ টি বোর্ড’ (বিটিবি) সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালে দেশে চা উৎপাদন হয়েছিল ৫৩.১৫ মিলিয়ন কেজি। এ সময়ে ভোগের পরিমাণ ছিল ৩৬.৯৫ মিলিয়ন কেজি। সে বছরে ১.৩ মিলিয়ন কেজি চা রফতানি করা সম্ভব হয়েছিল। ২০১৭ সালে এসে এ উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৭৮.৯৫ মিলিয়ন কেজিতে। ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৮৫.০৫ মিলিয়ন কেজি। গত বছর উৎপাদন ছিল ৮২.১৩ মিলিয়ন কেজি। চা রফতানিতে বাংলাদেশ ৮ম। কিন্তু দুই যুগ আগে বাংলাদেশ ২য় অবস্থানে ছিল। এ সময়ের ব্যবধানে দেশে ভোগ তথা ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যটির ব্যবহার বেড়েছে ১৩২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর বিপরীতে উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০০১ সালে দেশে মাথাপিছু চা ভোগের পরিমাণ ছিল ২৯৩ গ্রাম। ২০১৩ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৩৭৯ গ্রামে। গত বছরেই তা ৫০০ গ্রাম ছাড়িয়ে যায়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকা ও চাষ সম্প্রসারণের সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছি। চা শিল্প খাতে একটু নজর দিলে চায়ের দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা সম্ভব হবে।

চা চাষের সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে উত্তরের জেলাগুলোতে। ২০১৭ সালে উত্তরাঞ্চলে চা উৎপাদন ছিল ৫৪ লাখ কেজি। ২০১৮ সালে তা ৫৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৮৫ লাখ কেজি। এ বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও বেশি উৎপাদন হবে বলে আশাবাদী। এ অঞ্চলের মাটি উন্নতমানের চা উৎপাদনের জন্য বেশ উপযোগী। এখানে চা উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বান্দরবানের রুমায় চা চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পঞ্চগড়ের অগার্নিক চা তো বিদেশে রফতানি হচ্ছে। ঠাকুরগাঁতেও সীমিত পরিসরে চা চাষ হচ্ছে। লালমনিরহাট, নীলফামারিতে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। পাবর্ত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। চট্টগ্রামের হালদা ভ্যালীর পরিত্যক্ত স্থানে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে চা চাষে ব্যাপক সাফল্য এসেছে। ২০১৮ সালে ৯ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে এখান থেকে। এখানকার ‘গ্রীন টি’ চীনে রফতানি হচ্ছে। একটু উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সিলেট, মৌলবীবাজার, হবিগঞ্জের চায়ের মান বৃদ্ধি করা যেতে পারে। চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল থেকে পাইলটিং হিসাবে শুরু করতে পারি। বাড়তি চাহিদা মেটাতে দেশের উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট জেলায় উন্নতমানের চা উৎপাদন বেগবান করতে হবে। সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। চা-শিল্পকে দেশের শিল্প না বলে অনেকে আভিজাত্যের শিল্প বলে থাকেন। কারণ গুটিকয়েক মালিকের হাতে জিম্মি এ শিল্প। এ শিল্প দেখিয়ে তাদের অনেকে বেশ সুযোগ-সুবিধা নেন দেশ-বিদেশ থেকে। কিন্তু চা-কেন্দ্রিক সুযোগ-সুবিধা নিলেও অনেকে চায়ের উন্নয়নে কাজে লাগান না! এ ব্যাপারে সরকার কঠোর হলেই বিপুল সম্ভাবনা দেখা দেবে এ শিল্পে।

চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাগানগুলোর সর্বোচ্চ কাযর্কারিতাও বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে উৎপাদনশীলতাও। উৎপাদনশীলতায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন বৈশ্বিক গড়ের নিচে। ভারত, চীন, শ্রীলংকা ও কেনিয়া দেশগুলোর মধ্যে হেক্টরপ্রতি আড়াই হাজার কেজির কাছাকাছি উৎপাদন করে। বৈশ্বিক উৎপাদনশীলতায় এগিয়ে রয়েছে কেনিয়া। এর পরেই রয়েছে ভারত ও জাপান। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আবহাওয়া চা উৎপাদনের অনুকূলে থাকলেও এখানে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন মাত্র ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ কেজির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাংলাদেশে আধুনিক প্রযুক্তির অভাব রয়েছে। ফলে অন্য দেশের চেয়ে উৎপাদন কম হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ চা আমদানি করতে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে দেশের বাণিজ্য ভারসাম্য প্রতিকূলে যাচ্ছে। চা শিল্পের সমস্যাগুলো হচ্ছে- পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা, চায়ের বস্তা/মোড়ক/বাক্স সরবরাহের সমস্যা, অর্থাভাব, ব্যবস্থাপনার দুবর্লতা, শ্রমিক সমস্যা, পয়ঃনিষ্কাশন ও সেচ সমস্যা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট, আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা, ভালো বীজের অভাব, রাসায়নিক সারের অপ্রাচুর্যতা ও সময়োচিত সরবরাহ, যন্ত্রপাতি ও খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহের ঘাটতি, গুদামের সমস্যা, প্রয়োজনীয় ঋণব্যবস্থার সমস্যা, অনিশ্চিত বৃষ্টিপাত, উৎপাদনের উচ্চব্যয়, মূল্যের অস্থিতিশীলতা, গবেষণার সীমিত সুযোগ, রোগবালাই ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ ইত্যাদি।

চা শিল্প বিনিয়োগের অভাবে তীব্র আর্থিক সংকটের সম্মুখীন। বিদ্যমান ব্যাংক ঋণের সুদের হার এত বেশি যে বিনিয়োগের জন্য ঋণের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করা উৎপাদনকারীদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চা চাষাধীন জমির মধ্যে প্রায় ১৬ শতাংশ অতিবয়স্ক, অলাভজনক চা এলাকা রয়েছে যার হেক্টর প্রতি বার্ষিক গড় উৎপাদন মাত্র ৪৮২ কেজি। এছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে চা শিল্পকে প্রতি বছরই খরার মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ফলে অসংখ্য গাছ মরে যাচ্ছে। এ কারণেও চায়ের উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। এ খাতের উন্নয়নে ব্যাংক সুদের হার কমানো, আমদানিকে নিরুৎসাহিত, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, শ্রম অসন্তুষ্টি কমাতে আরও সুবিধা বাড়ানো ও জমি ইজারা নিয়ে বিরোধগুলোর দ্রুত নি®পত্তি করতে হবে।

অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রফতানি বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশের চা শিল্পের উন্নয়নের জন্য কৌশলগত কমর্পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকার চা চাষের উন্নয়নে হাতে নিয়েছে পরিকল্পনা। ‘বাংলাদেশ চা বোর্ড’ বাংলাদেশের চা শিল্পের উন্নয়নের জন্য কৌশলগত কমর্পরিকল্পনা ‘ভিশন ২০২৫’-এর বাস্তবায়ন শুরু করেছে। এর আওতায় ২০২৫ সালের মধ্যে বাষির্ক ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদনের মাইলফলক অতিক্রমের লক্ষ্য নিধার্রণ করা হয়েছে। প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, বাগান সম্প্রসারণ, নতুন যন্ত্রপাতি ক্রয়, গভীর ও হস্তচালিত নলকূপ স্থাপন, বাগান এলাকায় কূপ খনন, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ ও সড়ক উন্নয়ন ইত্যাদি। প্রকল্পের আওতায় উন্নত জাতের চা চারা রোপণ করা হবে। চাবোর্ড, চা গবেষণা ইনস্টিটিউট সার্বিকভাবে সসাসরি বাস্তবায়নে সহায়তা করছে। এ লক্ষ্য পূরণের জন্য বৃহদায়তনের বাগানের পাশাপাশি ক্ষুদ্রায়তনের জমিতে চায়ের আবাদ বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। পাবর্ত্যাঞ্চলে চা সম্প্রসারণে নিয়েছে বেশকিছু প্রকল্প। বিদেশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে চায়ের শ্রেণী বিন্যাস করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সাধারণ কালো চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঠাণ্ডা চা, সুগন্ধি চা, মসলাযুক্ত চা, ঔষধি চায়ের মতো বিশেষ ক্যাটাগরির চা রফতানি করা হবে। রফতানিযোগ্য চা উন্নত মোড়কে প্যাকেটজাত এবং চায়ের উৎপাদন ও গুণাগুণ-স¤পর্কিত পর্যাপ্ত তথ্যাবলিসহ রফতানি করা হবে। এসব পরিকল্পনা ও সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগালে চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের ক্রমবধর্মান চাহিদা পূরণ করে বিপুল পরিমাণ চা বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া চায়ের আমদানিকে নিরুৎসাহিত করে উৎপাদন বাড়াতে হবে। চায়ের বাজার ধরে রাখতে হলে আমাদের উচ্চফলনশীল জাতের চা চাষ বাড়াতে হবে।

একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায় যে, চা শ্রমিকের বেশিরভাগই নারী। প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ। কিন্তু শ্রমের মূল্য তেমন পায় না বলে বিভিন্ন অভিযোগ আছে। পাহাড়ি নারীদের অংশগ্রহণ বেশি। চা বাগানগুলোতে বর্তমানে স্থায়ীভাবে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৯০ হাজার। অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত আছে আরও ৩০ হাজার শ্রমিক। তবে চা শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সাড়ে ৩ লাখ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৭ লাখ মানুষ জড়িত। আমাদের দেশে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রতিদিনই বাড়ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে বিবেচনায় নিলে ২০২৫ সাল নাগাদ চায়ের মোট চাহিদা দাঁড়াবে ১২৯ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন কেজি এবং বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে একই সময়ে চায়ের উৎপাদন হবে মাত্র ৮৫ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন কেজি।

জিডিপিতে চা খাতের অবদান ০.৮১ শতাংশ। অবদান কম নয়। বাংলাদেশ ১.৩ মিলিয়ন কেজি চা রফতানি করে থাকে। গত ১০ বছরে বিশ্বে চায়ের চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশ, কেনিয়া ও শ্রীলংকা বিশ্বের চা চাহিদার শতকরা ৫২ ভাগ চাহিদা পূরণ করে থাকে। বাজার চাহিদা ধরে রাখতে হবে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে দেশের অবদান বাড়াতে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বর্ধিত বাজার দখল করতে পারলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে যাবে। দেশে চায়ের বাজারের আকার সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি। এটি শ্রমঘন শিল্প। এখানে ব্যাপক কর্মসংস্থান করার সুযোগ আছে। চাখাতের উন্নয়ন হলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিভিন্ন বাজার সৃষ্টি হবে। নতুন নতুন এলাকায় চাবাগান সম্প্রসারণ করলে ব্যাপক গতি আসবে। আশার কথা, দেশের উত্তরাঞ্চলে চায়ের চাষ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চট্টগ্রামেও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহেও চা চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। এবং বাড়ছে। এখন বৃহত্তর সিলেট ও পার্বত্য অঞ্চলের চাবাগানগুলোতে বিশেষ নজর দিতে হবে। কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে।

বিশ্বজুড়ে ক্রেতারা চায়ের রঙ, ঘ্রাণ ও স্বাদ এই তিনটি বিষয়ে গুণগত মান উন্নত করার ওপরই জোরালো তাগিদ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে চা শিল্প ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেও যুগোপযোগী আধুনিকায়ন ও প্রত্যাশিত মানে উন্নীত হয়নি। চাশিল্পের শ্রমিকদের উন্নয়নেও নানা কমর্সূচি নিতে হবে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে দিতে হবে নানা প্রণোদনা। এবং সেগুলোর সর্বোচ্চ ও যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো জরুরি। গবেষণা কাজের ক্ষেত্র সরকারি বরাদ্দের পরিমাণ বাড়াতে হবে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। বিদেশে বাজার সম্প্রসারণ করতে হবে। চা বাগান এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বাড়াতে হবে বা আলাদা করা যেতে পারে।

[লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট ]

শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২০ , ১৭ মাঘ ১৪২৬, ৫ জমাদিউল সানি ১৪৪১

সম্ভাবনাময় চা শিল্প খাতে নজর পড়ুক

আবু আফজাল সালেহ

image

ধীরে ধীরে চা এ দেশে একটি কৃষিভিত্তিক শ্রমঘন শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রফতানি আয় বৃদ্ধি, আমদানি বিকল্প দ্রব্য উৎপাদন এবং গ্রামীণ দারিদ্য হ্রাসকরণের মাধ্যমে চা জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দিকেই। ক্রমান্বয়ে চায়ের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু সে তুলনায় উৎপাদন বাড়ছে না। বাংলাদেশ ১৯৮৯ সালে চা উৎপাদনে বিশ্বে ১২তম স্থানে ছিল। গত শতকের শেষের দিকে ১১তম অবস্থানে ছিল। কয়েক বছর আগে দশম অবস্থানে ছিল। ‘বাংলাদেশ টি বোর্ড’ (বিটিবি) সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালে দেশে চা উৎপাদন হয়েছিল ৫৩.১৫ মিলিয়ন কেজি। এ সময়ে ভোগের পরিমাণ ছিল ৩৬.৯৫ মিলিয়ন কেজি। সে বছরে ১.৩ মিলিয়ন কেজি চা রফতানি করা সম্ভব হয়েছিল। ২০১৭ সালে এসে এ উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৭৮.৯৫ মিলিয়ন কেজিতে। ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৮৫.০৫ মিলিয়ন কেজি। গত বছর উৎপাদন ছিল ৮২.১৩ মিলিয়ন কেজি। চা রফতানিতে বাংলাদেশ ৮ম। কিন্তু দুই যুগ আগে বাংলাদেশ ২য় অবস্থানে ছিল। এ সময়ের ব্যবধানে দেশে ভোগ তথা ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যটির ব্যবহার বেড়েছে ১৩২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর বিপরীতে উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০০১ সালে দেশে মাথাপিছু চা ভোগের পরিমাণ ছিল ২৯৩ গ্রাম। ২০১৩ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৩৭৯ গ্রামে। গত বছরেই তা ৫০০ গ্রাম ছাড়িয়ে যায়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকা ও চাষ সম্প্রসারণের সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছি। চা শিল্প খাতে একটু নজর দিলে চায়ের দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা সম্ভব হবে।

চা চাষের সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে উত্তরের জেলাগুলোতে। ২০১৭ সালে উত্তরাঞ্চলে চা উৎপাদন ছিল ৫৪ লাখ কেজি। ২০১৮ সালে তা ৫৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৮৫ লাখ কেজি। এ বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও বেশি উৎপাদন হবে বলে আশাবাদী। এ অঞ্চলের মাটি উন্নতমানের চা উৎপাদনের জন্য বেশ উপযোগী। এখানে চা উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বান্দরবানের রুমায় চা চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পঞ্চগড়ের অগার্নিক চা তো বিদেশে রফতানি হচ্ছে। ঠাকুরগাঁতেও সীমিত পরিসরে চা চাষ হচ্ছে। লালমনিরহাট, নীলফামারিতে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। পাবর্ত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। চট্টগ্রামের হালদা ভ্যালীর পরিত্যক্ত স্থানে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে চা চাষে ব্যাপক সাফল্য এসেছে। ২০১৮ সালে ৯ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে এখান থেকে। এখানকার ‘গ্রীন টি’ চীনে রফতানি হচ্ছে। একটু উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সিলেট, মৌলবীবাজার, হবিগঞ্জের চায়ের মান বৃদ্ধি করা যেতে পারে। চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল থেকে পাইলটিং হিসাবে শুরু করতে পারি। বাড়তি চাহিদা মেটাতে দেশের উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট জেলায় উন্নতমানের চা উৎপাদন বেগবান করতে হবে। সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। চা-শিল্পকে দেশের শিল্প না বলে অনেকে আভিজাত্যের শিল্প বলে থাকেন। কারণ গুটিকয়েক মালিকের হাতে জিম্মি এ শিল্প। এ শিল্প দেখিয়ে তাদের অনেকে বেশ সুযোগ-সুবিধা নেন দেশ-বিদেশ থেকে। কিন্তু চা-কেন্দ্রিক সুযোগ-সুবিধা নিলেও অনেকে চায়ের উন্নয়নে কাজে লাগান না! এ ব্যাপারে সরকার কঠোর হলেই বিপুল সম্ভাবনা দেখা দেবে এ শিল্পে।

চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাগানগুলোর সর্বোচ্চ কাযর্কারিতাও বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে উৎপাদনশীলতাও। উৎপাদনশীলতায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন বৈশ্বিক গড়ের নিচে। ভারত, চীন, শ্রীলংকা ও কেনিয়া দেশগুলোর মধ্যে হেক্টরপ্রতি আড়াই হাজার কেজির কাছাকাছি উৎপাদন করে। বৈশ্বিক উৎপাদনশীলতায় এগিয়ে রয়েছে কেনিয়া। এর পরেই রয়েছে ভারত ও জাপান। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আবহাওয়া চা উৎপাদনের অনুকূলে থাকলেও এখানে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন মাত্র ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ কেজির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাংলাদেশে আধুনিক প্রযুক্তির অভাব রয়েছে। ফলে অন্য দেশের চেয়ে উৎপাদন কম হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ চা আমদানি করতে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে দেশের বাণিজ্য ভারসাম্য প্রতিকূলে যাচ্ছে। চা শিল্পের সমস্যাগুলো হচ্ছে- পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা, চায়ের বস্তা/মোড়ক/বাক্স সরবরাহের সমস্যা, অর্থাভাব, ব্যবস্থাপনার দুবর্লতা, শ্রমিক সমস্যা, পয়ঃনিষ্কাশন ও সেচ সমস্যা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট, আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা, ভালো বীজের অভাব, রাসায়নিক সারের অপ্রাচুর্যতা ও সময়োচিত সরবরাহ, যন্ত্রপাতি ও খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহের ঘাটতি, গুদামের সমস্যা, প্রয়োজনীয় ঋণব্যবস্থার সমস্যা, অনিশ্চিত বৃষ্টিপাত, উৎপাদনের উচ্চব্যয়, মূল্যের অস্থিতিশীলতা, গবেষণার সীমিত সুযোগ, রোগবালাই ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ ইত্যাদি।

চা শিল্প বিনিয়োগের অভাবে তীব্র আর্থিক সংকটের সম্মুখীন। বিদ্যমান ব্যাংক ঋণের সুদের হার এত বেশি যে বিনিয়োগের জন্য ঋণের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করা উৎপাদনকারীদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চা চাষাধীন জমির মধ্যে প্রায় ১৬ শতাংশ অতিবয়স্ক, অলাভজনক চা এলাকা রয়েছে যার হেক্টর প্রতি বার্ষিক গড় উৎপাদন মাত্র ৪৮২ কেজি। এছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে চা শিল্পকে প্রতি বছরই খরার মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ফলে অসংখ্য গাছ মরে যাচ্ছে। এ কারণেও চায়ের উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। এ খাতের উন্নয়নে ব্যাংক সুদের হার কমানো, আমদানিকে নিরুৎসাহিত, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, শ্রম অসন্তুষ্টি কমাতে আরও সুবিধা বাড়ানো ও জমি ইজারা নিয়ে বিরোধগুলোর দ্রুত নি®পত্তি করতে হবে।

অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রফতানি বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশের চা শিল্পের উন্নয়নের জন্য কৌশলগত কমর্পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকার চা চাষের উন্নয়নে হাতে নিয়েছে পরিকল্পনা। ‘বাংলাদেশ চা বোর্ড’ বাংলাদেশের চা শিল্পের উন্নয়নের জন্য কৌশলগত কমর্পরিকল্পনা ‘ভিশন ২০২৫’-এর বাস্তবায়ন শুরু করেছে। এর আওতায় ২০২৫ সালের মধ্যে বাষির্ক ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদনের মাইলফলক অতিক্রমের লক্ষ্য নিধার্রণ করা হয়েছে। প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, বাগান সম্প্রসারণ, নতুন যন্ত্রপাতি ক্রয়, গভীর ও হস্তচালিত নলকূপ স্থাপন, বাগান এলাকায় কূপ খনন, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ ও সড়ক উন্নয়ন ইত্যাদি। প্রকল্পের আওতায় উন্নত জাতের চা চারা রোপণ করা হবে। চাবোর্ড, চা গবেষণা ইনস্টিটিউট সার্বিকভাবে সসাসরি বাস্তবায়নে সহায়তা করছে। এ লক্ষ্য পূরণের জন্য বৃহদায়তনের বাগানের পাশাপাশি ক্ষুদ্রায়তনের জমিতে চায়ের আবাদ বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। পাবর্ত্যাঞ্চলে চা সম্প্রসারণে নিয়েছে বেশকিছু প্রকল্প। বিদেশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে চায়ের শ্রেণী বিন্যাস করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সাধারণ কালো চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঠাণ্ডা চা, সুগন্ধি চা, মসলাযুক্ত চা, ঔষধি চায়ের মতো বিশেষ ক্যাটাগরির চা রফতানি করা হবে। রফতানিযোগ্য চা উন্নত মোড়কে প্যাকেটজাত এবং চায়ের উৎপাদন ও গুণাগুণ-স¤পর্কিত পর্যাপ্ত তথ্যাবলিসহ রফতানি করা হবে। এসব পরিকল্পনা ও সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগালে চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের ক্রমবধর্মান চাহিদা পূরণ করে বিপুল পরিমাণ চা বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া চায়ের আমদানিকে নিরুৎসাহিত করে উৎপাদন বাড়াতে হবে। চায়ের বাজার ধরে রাখতে হলে আমাদের উচ্চফলনশীল জাতের চা চাষ বাড়াতে হবে।

একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায় যে, চা শ্রমিকের বেশিরভাগই নারী। প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ। কিন্তু শ্রমের মূল্য তেমন পায় না বলে বিভিন্ন অভিযোগ আছে। পাহাড়ি নারীদের অংশগ্রহণ বেশি। চা বাগানগুলোতে বর্তমানে স্থায়ীভাবে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৯০ হাজার। অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত আছে আরও ৩০ হাজার শ্রমিক। তবে চা শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সাড়ে ৩ লাখ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৭ লাখ মানুষ জড়িত। আমাদের দেশে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রতিদিনই বাড়ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে বিবেচনায় নিলে ২০২৫ সাল নাগাদ চায়ের মোট চাহিদা দাঁড়াবে ১২৯ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন কেজি এবং বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে একই সময়ে চায়ের উৎপাদন হবে মাত্র ৮৫ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন কেজি।

জিডিপিতে চা খাতের অবদান ০.৮১ শতাংশ। অবদান কম নয়। বাংলাদেশ ১.৩ মিলিয়ন কেজি চা রফতানি করে থাকে। গত ১০ বছরে বিশ্বে চায়ের চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশ, কেনিয়া ও শ্রীলংকা বিশ্বের চা চাহিদার শতকরা ৫২ ভাগ চাহিদা পূরণ করে থাকে। বাজার চাহিদা ধরে রাখতে হবে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে দেশের অবদান বাড়াতে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বর্ধিত বাজার দখল করতে পারলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে যাবে। দেশে চায়ের বাজারের আকার সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি। এটি শ্রমঘন শিল্প। এখানে ব্যাপক কর্মসংস্থান করার সুযোগ আছে। চাখাতের উন্নয়ন হলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিভিন্ন বাজার সৃষ্টি হবে। নতুন নতুন এলাকায় চাবাগান সম্প্রসারণ করলে ব্যাপক গতি আসবে। আশার কথা, দেশের উত্তরাঞ্চলে চায়ের চাষ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চট্টগ্রামেও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহেও চা চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। এবং বাড়ছে। এখন বৃহত্তর সিলেট ও পার্বত্য অঞ্চলের চাবাগানগুলোতে বিশেষ নজর দিতে হবে। কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে।

বিশ্বজুড়ে ক্রেতারা চায়ের রঙ, ঘ্রাণ ও স্বাদ এই তিনটি বিষয়ে গুণগত মান উন্নত করার ওপরই জোরালো তাগিদ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে চা শিল্প ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেও যুগোপযোগী আধুনিকায়ন ও প্রত্যাশিত মানে উন্নীত হয়নি। চাশিল্পের শ্রমিকদের উন্নয়নেও নানা কমর্সূচি নিতে হবে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে দিতে হবে নানা প্রণোদনা। এবং সেগুলোর সর্বোচ্চ ও যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো জরুরি। গবেষণা কাজের ক্ষেত্র সরকারি বরাদ্দের পরিমাণ বাড়াতে হবে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। বিদেশে বাজার সম্প্রসারণ করতে হবে। চা বাগান এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বাড়াতে হবে বা আলাদা করা যেতে পারে।

[লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট ]