মুজিব শাসন আমল : ১৯৭২

৩ ফেব্রুয়ারি

কাজে ফাঁকি দিলে শাস্তি দেয়া হবে-সরকারি কর্মচারীদের প্রতি বঙ্গবন্ধু

ঢাকা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ সরকারি অফিসার ও কর্মচারীদের এই বলে হুঁশিয়ার করে দেন যে, তারা যথাসময়ে অফিসের কাজে যোগ না দিলে কাজে কর্মে গাফিলতি করলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আজ ইস্যুকৃত এক নির্দেশ পত্রে তিনি বলেন যে, সরকারি চাকরিদের কাজ কর্মের ধরন দেখার জন্যে তিনি মাঝে মাঝে আকস্মিকভাবে বিভিন্ন অফিস পরিদর্শনের ইচ্ছে রাখেন। বহু সংখ্যক অফিসার ও কর্মচারী অফিসের কাজে যোগদান দেয়ার ব্যাপারে সময়নিষ্ঠ নন এবং কাজেও গাফলতি করছেন বলে আমি জানতে পেরেছি। বাংলাদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিক তার দেশের জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে বলে সরকার ও অমি যে ব্যক্তিগতভাবে আশা পোষণ করছি, তার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। সরকারি কর্মচারীরা কীভাবে কাজ চালাচ্ছেন তা প্রত্যক্ষ করার জন্য আমি সময় সময় আকস্মিকভাবে বিভিন্ন সরকারি অফিস পরিদর্শনের ইচ্ছে রাখি। এ সময়ে কোন অফিসার কিম্বা কোনো কর্মচারীকে কাজের শৈথিল্য করতে দেখা গেলে সরকার তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হবেন।

৪ ফেব্রুয়ারি

কোলকাতায় বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাসের বৃহত্তম সংবর্ধনা দেয়া হবে

কোলকাতা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিমবঙ্গে দুই দিন সফরের জন্য কোলকাতা পৌঁছলে তাকে এমন এক স্মরণীয় সংবর্ধনা দেয়া হবে, যা কোনো জননেতাকে কখনও দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তি সগ্রামে ভারত বাংলার জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করেছে-সেই মিত্র প্রতিবেশী ভারতের মাটিতে প্রধানমন্ত্রী পর্দাপণ করলে তাকে শীর্ষস্থানীয় সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারীরা এবং বিপুল ধ্বনিমুখর জনতা অভিনন্দন জানাবেন। সদলবলে প্রধানমন্ত্রীর বিমানটি সাড়ে ১০টার কাছাকাছি নাগাদ দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছবে। এর কয়েক ঘণ্টা আগেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হতি ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে দিল্লি থেকে কোলকাতা আসবেন। বঙ্গবন্ধুকে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর একটি দল গার্ড-অব-অনার প্রদর্শন করবেন। এর সঙ্গে সঙ্গে উভয় দেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হবে। বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবার পরপরই বঙ্গবন্ধু এবং তার দলবল তিনটি হেলিকপ্টারে আরোহণ করবেন এবং বাংলার শরণার্থীদের যেসব শিবিরে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল, তা দেখতে ‘লবণ হৃদের’ দিকে যাত্রা করবেন। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর এই প্রথম বিদেশ সফরে আসছেন। তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীর সঙ্গে বিকেল দুটো তিনটের মধ্যে রাজভবনে দু’দেশের সামগ্রিক সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি আলোচনা করবেন। বঙ্গবন্ধু বিগ্রেড প্যারেড গ্রাউন্ডে জনসভায় ভাষণ দেবেন। কোলকাতা মহানগরীর ইতিহাসে এটাই

সম্ভবত: সর্বাধিক জনাকীর্ণ জনসমাবেশ হচ্ছে। শ্রীমতি গান্ধীও এ জনসভায় ভাষণ দেবেন। সন্ধ্যায় শ্রীমতি গান্ধী রাজভবনে বঙ্গবন্ধুর সম্মানে একটি ভোজসভার আয়োজন করবেন। এরপর একটা সাংস্কৃৃতিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। পরদিন বঙ্গবন্ধু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্যে শান্তি নিকেতন যাবেন। বঙ্গবন্ধু রাজভবনের কোলকাতা পৌরসভা কর্তৃক আয়োজিত নাগরিক সম্বর্ধনায় যোগদান করবেন। বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য বহু সংখ্যক প্রতিনিধিদল এবং গণ্যমান্য ব্যক্তি আসবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের জনাকীর্ণ রাজধানীতে বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় নেতাকে এক নজর দেখার জন্যে এসে ভিড় জমাচ্ছেন-যে নেতা তার দেশের সাত কোটি মানুষকে বহু বিপদাপদ কাটিয়ে স্বাধীনতার লক্ষ্যে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন।

মোটামুটি হিসেবে মনে হচ্ছে, কেবল কোলকাতা শহরেই এক কোটিরও অধিক সংখ্যক মানুষ বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য এবং তার কথা শোনার জন্য সমবেত হবে। বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে যে বিপুল আয়োজন করা হচ্ছে, তা সম্পন্ন করতে দিনরাত কাজ হচ্ছে। সমগ্র শহরে বহু তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বিপুল জনতার স্থান সংকুলান হবে না বলে শহরের আরও ৭টি পার্কে তাদের আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে তাদের কাছে বক্তৃতা রিলে করে শোনানোর ব্যবস্থা করা হবে। কোলকাতায় বঙ্গবন্ধুর আগমন বার্তা এবং তার ভাষণ বাংলাদেশ বেতার রিলে করে শোনাবে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন তা রেকর্ড করবে।

৫ ফেব্রুয়ারি

সার্বিক অর্থনৈতিক পুনর্বাসন ব্যবস্থা ঘোষণা

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের জন্য ২ হাজার কোটি টাকার এক ব্যাপক পরিকল্পনা পরীক্ষা করে দেখছে। ভবিষ্যতে যাতে আর সাহায্য দান না করতে হয় তেমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলাই এর লক্ষ্য। সাহায্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রী জনাব এ এইচ এম কামারুজ্জামান গতকাল শনিবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, দখলদার বাহিনী দেশব্যাপী যে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তাতে আজ সামগ্রিক অর্থনীতি ভেঙে গেছে। তাঁতির হাতে সুতো নেই, কৃষকের লাঙল নেই, ছাত্রের বই নেই, ব্যবসায়ীদের দোকান-পাট নেই। আর শিল্পপতিদের কারখানা কলকজা অপহৃত বা বিধ্বস্ত। এ পরিপ্রেক্ষিতে সুসমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে এ সমস্যার সর্বাধিক সমাধান অত্যাবশ্যক। শুধু রিলিফ দিয়ে চিরদিন চলতে পারে না। তিনি বলেন যে, সরকার সেই চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

উদ্বাস্তু সমস্যা : জনাব কামারুজ্জামান বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণের আশু প্রয়োজন হচ্ছে খাদ্য ও আশ্রয়। এ ব্যাপারেও সরকার ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তিনি জানান যে, দেশের প্রায় এক কোটি লোক মিত্র রাষ্ট্র ভারতে চলে গিয়েছিল। তাদের আশ্রয় প্রয়োজন। তেমনি এখানেও প্রায় আরও চার কোটি লোককে হানাদার বাহিনী গৃহহারা করে গেছে। পুনর্বাসন পরিকল্পনায় নির্বিশেষে এদের সবার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

এতিমদের লালন : জনাব কামারুজ্জামান প্রকাশ করেন যে, দেশে বিপুল সংখ্যক এতিম যথাযথ ট্রেনিংয়ের অভাবে ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এতিমখানায় যাদের লালন করা হচ্ছে তারাও মূলতঃ বাইরের জীবনে এসে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করে। সুতরাং এতিমদের লালন-পালনের ব্যাপারে বিপ্লবী পরিবর্তন সাধন করতে হবে। তিনি বলেন যে, এতিমখানাগুলোর বর্তমান মনোভাব অবশ্যই বদলাতে হবে। এ উদ্দেশ্যে অদূর ভবিষ্যতে প্রতি বিভাগে একটি করে এতিমখানা নির্মাণ করা হবে। এসব এতিমখানায় লেখাপড়া ও পেশাগত ট্রেনিং-এর সুব্যবস্থা থাকবে। তিনি বলেন যে, দেশের প্রতিটি মানুষ জাতীয় সম্পদ। সুতরাং জাতীয় ক্ষেত্রে তারা যাতে অবদান রাখতে সমর্থ হয়। সে জন্য তাদের গড়ে তুলতে হবে।

হাজার এতিমের শিক্ষাকেন্দ্র : তিনি প্রকাশ করেন যে, ভারতের বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি ড. ত্রিগুণা সেন বাংলাদেশে এক হাজার এতিমের জন্য একটি পেশাগত শিক্ষাশিবির গড়ার প্রস্তাব দিয়েছেন এবং বঙ্গবন্ধু এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের অনুমোদনও দান করেছেন।

৫ ফেব্রুয়ারি

মিরপুরে আরও আড়াইশ’ দুষ্কৃতকারী গ্রেফতার

ঢাকা। মিরপুরের ১ নম্বর ও ২ নম্বর সেকশন ছাড়িয়ে আরও সামনে অস্ত্র তল্লাশি অভিযান চালানো হয়। এই দুটি এলাকা পরিষ্কার করা হয়। তল্লাশির মাধ্যমে উক্ত এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলবারুদ উদ্ধার করা হয়। উল্লেখিত এলাকা থেকে প্রায় আড়াইশ’ দুষ্কৃতকারীকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, বেশকিছু সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য এবং হানাদার বাহিনীর সহযোগী আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে মিরপুর এবং মোহাম্মদপুরে আত্মগোপন করেছিল। তারা অস্ত্র জমাদানের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ অমান্য করে। উক্ত এলাকায় অস্ত্র সংগ্রহ অভিযানকালে বাংলাদেশ বাহিনীর ওপর তারা গুলিবর্ষণ করে। বাংলাদেশ বাহিনী এবং পুলিশ খণ্ড খণ্ড ভাবে মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে বিভিন্ন অংশ ঘেরাও করে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের জন্য তল্লাশি চালায়। উক্ত এলাকা থেকে কয়েকশ’ দুষ্কৃতকারীকে গ্রেফতার করা হয়। অস্ত্র তল্লাশি অভিযানকালে উভয় পক্ষের বেশকিছু সংখ্যক ব্যক্তি হতাহত হয়।

সূত্র : দিনলিপি, বঙ্গবন্ধুর শাসন সময়, ১৯৭২

শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২০ , ১৭ মাঘ ১৪২৬, ৫ জমাদিউল সানি ১৪৪১

মুজিব শাসন আমল : ১৯৭২

৩ ফেব্রুয়ারি

কাজে ফাঁকি দিলে শাস্তি দেয়া হবে-সরকারি কর্মচারীদের প্রতি বঙ্গবন্ধু

ঢাকা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ সরকারি অফিসার ও কর্মচারীদের এই বলে হুঁশিয়ার করে দেন যে, তারা যথাসময়ে অফিসের কাজে যোগ না দিলে কাজে কর্মে গাফিলতি করলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আজ ইস্যুকৃত এক নির্দেশ পত্রে তিনি বলেন যে, সরকারি চাকরিদের কাজ কর্মের ধরন দেখার জন্যে তিনি মাঝে মাঝে আকস্মিকভাবে বিভিন্ন অফিস পরিদর্শনের ইচ্ছে রাখেন। বহু সংখ্যক অফিসার ও কর্মচারী অফিসের কাজে যোগদান দেয়ার ব্যাপারে সময়নিষ্ঠ নন এবং কাজেও গাফলতি করছেন বলে আমি জানতে পেরেছি। বাংলাদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিক তার দেশের জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে বলে সরকার ও অমি যে ব্যক্তিগতভাবে আশা পোষণ করছি, তার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। সরকারি কর্মচারীরা কীভাবে কাজ চালাচ্ছেন তা প্রত্যক্ষ করার জন্য আমি সময় সময় আকস্মিকভাবে বিভিন্ন সরকারি অফিস পরিদর্শনের ইচ্ছে রাখি। এ সময়ে কোন অফিসার কিম্বা কোনো কর্মচারীকে কাজের শৈথিল্য করতে দেখা গেলে সরকার তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হবেন।

৪ ফেব্রুয়ারি

কোলকাতায় বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাসের বৃহত্তম সংবর্ধনা দেয়া হবে

কোলকাতা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিমবঙ্গে দুই দিন সফরের জন্য কোলকাতা পৌঁছলে তাকে এমন এক স্মরণীয় সংবর্ধনা দেয়া হবে, যা কোনো জননেতাকে কখনও দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তি সগ্রামে ভারত বাংলার জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করেছে-সেই মিত্র প্রতিবেশী ভারতের মাটিতে প্রধানমন্ত্রী পর্দাপণ করলে তাকে শীর্ষস্থানীয় সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারীরা এবং বিপুল ধ্বনিমুখর জনতা অভিনন্দন জানাবেন। সদলবলে প্রধানমন্ত্রীর বিমানটি সাড়ে ১০টার কাছাকাছি নাগাদ দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছবে। এর কয়েক ঘণ্টা আগেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হতি ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে দিল্লি থেকে কোলকাতা আসবেন। বঙ্গবন্ধুকে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর একটি দল গার্ড-অব-অনার প্রদর্শন করবেন। এর সঙ্গে সঙ্গে উভয় দেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হবে। বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবার পরপরই বঙ্গবন্ধু এবং তার দলবল তিনটি হেলিকপ্টারে আরোহণ করবেন এবং বাংলার শরণার্থীদের যেসব শিবিরে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল, তা দেখতে ‘লবণ হৃদের’ দিকে যাত্রা করবেন। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর এই প্রথম বিদেশ সফরে আসছেন। তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীর সঙ্গে বিকেল দুটো তিনটের মধ্যে রাজভবনে দু’দেশের সামগ্রিক সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি আলোচনা করবেন। বঙ্গবন্ধু বিগ্রেড প্যারেড গ্রাউন্ডে জনসভায় ভাষণ দেবেন। কোলকাতা মহানগরীর ইতিহাসে এটাই

সম্ভবত: সর্বাধিক জনাকীর্ণ জনসমাবেশ হচ্ছে। শ্রীমতি গান্ধীও এ জনসভায় ভাষণ দেবেন। সন্ধ্যায় শ্রীমতি গান্ধী রাজভবনে বঙ্গবন্ধুর সম্মানে একটি ভোজসভার আয়োজন করবেন। এরপর একটা সাংস্কৃৃতিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। পরদিন বঙ্গবন্ধু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্যে শান্তি নিকেতন যাবেন। বঙ্গবন্ধু রাজভবনের কোলকাতা পৌরসভা কর্তৃক আয়োজিত নাগরিক সম্বর্ধনায় যোগদান করবেন। বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য বহু সংখ্যক প্রতিনিধিদল এবং গণ্যমান্য ব্যক্তি আসবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের জনাকীর্ণ রাজধানীতে বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় নেতাকে এক নজর দেখার জন্যে এসে ভিড় জমাচ্ছেন-যে নেতা তার দেশের সাত কোটি মানুষকে বহু বিপদাপদ কাটিয়ে স্বাধীনতার লক্ষ্যে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন।

মোটামুটি হিসেবে মনে হচ্ছে, কেবল কোলকাতা শহরেই এক কোটিরও অধিক সংখ্যক মানুষ বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য এবং তার কথা শোনার জন্য সমবেত হবে। বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে যে বিপুল আয়োজন করা হচ্ছে, তা সম্পন্ন করতে দিনরাত কাজ হচ্ছে। সমগ্র শহরে বহু তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বিপুল জনতার স্থান সংকুলান হবে না বলে শহরের আরও ৭টি পার্কে তাদের আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে তাদের কাছে বক্তৃতা রিলে করে শোনানোর ব্যবস্থা করা হবে। কোলকাতায় বঙ্গবন্ধুর আগমন বার্তা এবং তার ভাষণ বাংলাদেশ বেতার রিলে করে শোনাবে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন তা রেকর্ড করবে।

৫ ফেব্রুয়ারি

সার্বিক অর্থনৈতিক পুনর্বাসন ব্যবস্থা ঘোষণা

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের জন্য ২ হাজার কোটি টাকার এক ব্যাপক পরিকল্পনা পরীক্ষা করে দেখছে। ভবিষ্যতে যাতে আর সাহায্য দান না করতে হয় তেমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলাই এর লক্ষ্য। সাহায্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রী জনাব এ এইচ এম কামারুজ্জামান গতকাল শনিবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, দখলদার বাহিনী দেশব্যাপী যে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তাতে আজ সামগ্রিক অর্থনীতি ভেঙে গেছে। তাঁতির হাতে সুতো নেই, কৃষকের লাঙল নেই, ছাত্রের বই নেই, ব্যবসায়ীদের দোকান-পাট নেই। আর শিল্পপতিদের কারখানা কলকজা অপহৃত বা বিধ্বস্ত। এ পরিপ্রেক্ষিতে সুসমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে এ সমস্যার সর্বাধিক সমাধান অত্যাবশ্যক। শুধু রিলিফ দিয়ে চিরদিন চলতে পারে না। তিনি বলেন যে, সরকার সেই চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

উদ্বাস্তু সমস্যা : জনাব কামারুজ্জামান বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণের আশু প্রয়োজন হচ্ছে খাদ্য ও আশ্রয়। এ ব্যাপারেও সরকার ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তিনি জানান যে, দেশের প্রায় এক কোটি লোক মিত্র রাষ্ট্র ভারতে চলে গিয়েছিল। তাদের আশ্রয় প্রয়োজন। তেমনি এখানেও প্রায় আরও চার কোটি লোককে হানাদার বাহিনী গৃহহারা করে গেছে। পুনর্বাসন পরিকল্পনায় নির্বিশেষে এদের সবার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

এতিমদের লালন : জনাব কামারুজ্জামান প্রকাশ করেন যে, দেশে বিপুল সংখ্যক এতিম যথাযথ ট্রেনিংয়ের অভাবে ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এতিমখানায় যাদের লালন করা হচ্ছে তারাও মূলতঃ বাইরের জীবনে এসে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করে। সুতরাং এতিমদের লালন-পালনের ব্যাপারে বিপ্লবী পরিবর্তন সাধন করতে হবে। তিনি বলেন যে, এতিমখানাগুলোর বর্তমান মনোভাব অবশ্যই বদলাতে হবে। এ উদ্দেশ্যে অদূর ভবিষ্যতে প্রতি বিভাগে একটি করে এতিমখানা নির্মাণ করা হবে। এসব এতিমখানায় লেখাপড়া ও পেশাগত ট্রেনিং-এর সুব্যবস্থা থাকবে। তিনি বলেন যে, দেশের প্রতিটি মানুষ জাতীয় সম্পদ। সুতরাং জাতীয় ক্ষেত্রে তারা যাতে অবদান রাখতে সমর্থ হয়। সে জন্য তাদের গড়ে তুলতে হবে।

হাজার এতিমের শিক্ষাকেন্দ্র : তিনি প্রকাশ করেন যে, ভারতের বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি ড. ত্রিগুণা সেন বাংলাদেশে এক হাজার এতিমের জন্য একটি পেশাগত শিক্ষাশিবির গড়ার প্রস্তাব দিয়েছেন এবং বঙ্গবন্ধু এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের অনুমোদনও দান করেছেন।

৫ ফেব্রুয়ারি

মিরপুরে আরও আড়াইশ’ দুষ্কৃতকারী গ্রেফতার

ঢাকা। মিরপুরের ১ নম্বর ও ২ নম্বর সেকশন ছাড়িয়ে আরও সামনে অস্ত্র তল্লাশি অভিযান চালানো হয়। এই দুটি এলাকা পরিষ্কার করা হয়। তল্লাশির মাধ্যমে উক্ত এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলবারুদ উদ্ধার করা হয়। উল্লেখিত এলাকা থেকে প্রায় আড়াইশ’ দুষ্কৃতকারীকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, বেশকিছু সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য এবং হানাদার বাহিনীর সহযোগী আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে মিরপুর এবং মোহাম্মদপুরে আত্মগোপন করেছিল। তারা অস্ত্র জমাদানের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ অমান্য করে। উক্ত এলাকায় অস্ত্র সংগ্রহ অভিযানকালে বাংলাদেশ বাহিনীর ওপর তারা গুলিবর্ষণ করে। বাংলাদেশ বাহিনী এবং পুলিশ খণ্ড খণ্ড ভাবে মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে বিভিন্ন অংশ ঘেরাও করে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের জন্য তল্লাশি চালায়। উক্ত এলাকা থেকে কয়েকশ’ দুষ্কৃতকারীকে গ্রেফতার করা হয়। অস্ত্র তল্লাশি অভিযানকালে উভয় পক্ষের বেশকিছু সংখ্যক ব্যক্তি হতাহত হয়।

সূত্র : দিনলিপি, বঙ্গবন্ধুর শাসন সময়, ১৯৭২