হতাশায় বিএনপি

সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা, নেতৃত্বে আস্থাহীনতা বাড়ছে

সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা ও নেতৃত্বে আস্থাহীনতার কারণেই ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। নির্বাচনে হেরে হতাশায় ভুগছে দলটির নেতাকর্মীরা। এর চাপ দেখা যায় দলটির ডাকা গতকালের হরতালেও। কোন নেতাকর্মীই মাঠে নামেনি। দীর্ঘদিন সময় খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার অনুপস্থিতিতে দল পরিচালিত হওয়ায় দলে সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা চলছে; নেতাকর্মীরাও আস্থাহীনতায় ভুগছে, যার প্রভাব পড়েছে দুই সিটির ভোটে।

এছাড়া ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ- এই দুই সিটিতেই অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট না দেয়া, মেয়র প্রার্থী ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, মাঠ পর্যায়ে যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের কাউন্সিলর মনোনয়ন না দেয়া এবং বিএনপি নেতাকর্মীরা ভোটের মাঠে না নামার কারণেই দলটির প্রার্থীদের বিপর্যয় ঘটেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

যদিও ভোটের ফল প্রকাশের পর এ ব্যাপারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপির এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেয়া হয়েছে। যারা এই বাধা অতিক্রম করে ভোটকেন্দ্রে গিয়েছেন, তাদের সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা ভয়ভীতি, হুমকি-ধামকি, মারধর করে বের করে দিয়েছে। ভোটকেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। বিএনপি মহাসচিব নিজেদের এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেয়ার অভিযোগ করলেও এর প্রতিবাদে গতকাল তাদের আহ্বান করা হরতালেও নগরবাসীর কোন সাড়া মেলেনি। হতাশায় নিমজ্জিত দলটির কর্মীসমর্থকরা হরতাল পালনে ঢাকার রাজপথে নামেননি।

এদিকে হরতাল শেষে গতকাল বিকেলে নয়া পল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে দলটির কয়েকজন নেতাকর্মী জড়ো হলে ৩০ মিনিটের মধ্যে তাদের সরে যাওয়ার আল্টিমেটাম দেয় পুলিশ। কিন্তু তিন মিনিটের মধ্যেই হতাশাগ্রস্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের নিয়ে এলাকা ত্যাগ করেন দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান রুহুল কবির রিজভী।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মোট দুই হাজার ৪৬৮টি কেন্দ্রে ১৪ হাজার ৪৩৪টি বুথ (ভোটকক্ষ) ছিল। প্রতিটি কেন্দ্রে ন্যূনতম ১৪ থেকে ১৫টি করে বুথ ছিল। কিন্তু ভোটের দিন ন্যূনতম অর্ধশত কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের কোন এজেন্ট ছিল না। ভোটকেন্দ্রে দলটির এজেন্টরা আসেনি। ঢাকা দক্ষিণের ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬১, ৬২ ও ৬৩ নম্বর ওয়ার্ড এবং উত্তরের ১, ২৪ ও ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডসহ বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডের বিভিন্ন কেন্দ্রে বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের কোন এজেন্ট ছিল না। বিএনপি প্রার্থীরা কেন্দ্রে এজেন্ট না দেয়ায় দলটির কর্মী-সমর্থকরাও কেন্দ্রে আসেনি। অথচ আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীদের এজেন্ট কেন্দ্রে সক্রিয় ছিল।

ঢাকা মহানগর বিএনপি ও যুবদলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলখানায় বন্দী। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়াও ফেরারি আসামি, বিদেশে পলাতক। এ নিয়ে দলের বর্তমান নীতিনির্ধারকরা আন্দোলন করতে পারছেন না, ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়নও করা হচ্ছে না, তৃণমূল পর্যায়ে মামলা-হামলার শিকার হওয়া নেতাকর্মীদের কোন খোঁজখবরও রাখা হচ্ছে না।

আবার যাদের কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল, তাদের অনেকেরই এলাকায় কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই, অনেক প্রার্থীকে এলাকার লোকজন চিনেই না, দীর্ঘদিন এলাকায় নিরুত্তাপ, তারা প্রকাশ্য প্রচরণায়ও নামেনি; টাকা-পয়সাও ব্যয় করেনি। কেউ কেউ ভাড়াটে টোকাইয়ের মাধ্যমে পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ করেছে; কিন্তু দলীয় কর্মীসমর্থকদের প্রচারণায় সম্পৃক্ত করেনি। নগরবাসীর দ্বারে দ্বারে ভোট চাননি; অনেকে দলের পদ ধরে রাখার জন্য কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন। এসব কারণেই বিএনপির বড় ধরনের পরাজয় হয়েছে বলে দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মনে করছেন।

বিএনপির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটিতে কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী আসনে কাউন্সিলর পদে বিএনপির প্রায় দুইশ প্রার্থী ছিল। তাদের অনেকে এলাকায় নিজেদের আওয়ামী লীগ সমর্থক পরিচয় দিয়েও চলাফেরা করেন। দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়ন না দিয়ে দলটির সিনিয়র নেতারা কেউ ১০টি, কেউ ১৫টি, কেউ ২০টি ওয়ার্ডের দায়িত্ব নিয়ে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছেন। অনুগত ও নিজেদের কোরামের নেতাকর্মীদের মনোনয়ন দিয়েছেন। এতে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল হয়েছে; কিন্তু দলের যোগ্য, ত্যাগী ও সক্রিয় নেতাদের অনেকে মনোয়ন পাননি।

তবে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও ঢাকা দক্ষিণের বিএনপির ন্যূনতম তিনজন কাউন্সিলর প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। তাদের এজেন্ট ও কর্মীসমর্থকরা ভোট গণনার সময় পর্যন্ত কেন্দ্রে উপস্থিত ছিল। তারা স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের মাঠে নামাতেও সক্ষম হয়েছেন। এর ফলও তারা পেয়েছেন। তাছাড়া বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় কর্মী সভা করার ওপরও খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি।

সোমবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ২০ মাঘ ১৪২৬, ৮ জমাদিউল সানি ১৪৪১

সিটি নির্বাচনে ভরাডুবি

হতাশায় বিএনপি

সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা, নেতৃত্বে আস্থাহীনতা বাড়ছে

রাকিব উদ্দিন

সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা ও নেতৃত্বে আস্থাহীনতার কারণেই ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। নির্বাচনে হেরে হতাশায় ভুগছে দলটির নেতাকর্মীরা। এর চাপ দেখা যায় দলটির ডাকা গতকালের হরতালেও। কোন নেতাকর্মীই মাঠে নামেনি। দীর্ঘদিন সময় খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার অনুপস্থিতিতে দল পরিচালিত হওয়ায় দলে সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা চলছে; নেতাকর্মীরাও আস্থাহীনতায় ভুগছে, যার প্রভাব পড়েছে দুই সিটির ভোটে।

এছাড়া ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ- এই দুই সিটিতেই অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট না দেয়া, মেয়র প্রার্থী ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, মাঠ পর্যায়ে যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের কাউন্সিলর মনোনয়ন না দেয়া এবং বিএনপি নেতাকর্মীরা ভোটের মাঠে না নামার কারণেই দলটির প্রার্থীদের বিপর্যয় ঘটেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

যদিও ভোটের ফল প্রকাশের পর এ ব্যাপারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপির এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেয়া হয়েছে। যারা এই বাধা অতিক্রম করে ভোটকেন্দ্রে গিয়েছেন, তাদের সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা ভয়ভীতি, হুমকি-ধামকি, মারধর করে বের করে দিয়েছে। ভোটকেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। বিএনপি মহাসচিব নিজেদের এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেয়ার অভিযোগ করলেও এর প্রতিবাদে গতকাল তাদের আহ্বান করা হরতালেও নগরবাসীর কোন সাড়া মেলেনি। হতাশায় নিমজ্জিত দলটির কর্মীসমর্থকরা হরতাল পালনে ঢাকার রাজপথে নামেননি।

এদিকে হরতাল শেষে গতকাল বিকেলে নয়া পল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে দলটির কয়েকজন নেতাকর্মী জড়ো হলে ৩০ মিনিটের মধ্যে তাদের সরে যাওয়ার আল্টিমেটাম দেয় পুলিশ। কিন্তু তিন মিনিটের মধ্যেই হতাশাগ্রস্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের নিয়ে এলাকা ত্যাগ করেন দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান রুহুল কবির রিজভী।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মোট দুই হাজার ৪৬৮টি কেন্দ্রে ১৪ হাজার ৪৩৪টি বুথ (ভোটকক্ষ) ছিল। প্রতিটি কেন্দ্রে ন্যূনতম ১৪ থেকে ১৫টি করে বুথ ছিল। কিন্তু ভোটের দিন ন্যূনতম অর্ধশত কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের কোন এজেন্ট ছিল না। ভোটকেন্দ্রে দলটির এজেন্টরা আসেনি। ঢাকা দক্ষিণের ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬১, ৬২ ও ৬৩ নম্বর ওয়ার্ড এবং উত্তরের ১, ২৪ ও ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডসহ বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডের বিভিন্ন কেন্দ্রে বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের কোন এজেন্ট ছিল না। বিএনপি প্রার্থীরা কেন্দ্রে এজেন্ট না দেয়ায় দলটির কর্মী-সমর্থকরাও কেন্দ্রে আসেনি। অথচ আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীদের এজেন্ট কেন্দ্রে সক্রিয় ছিল।

ঢাকা মহানগর বিএনপি ও যুবদলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলখানায় বন্দী। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়াও ফেরারি আসামি, বিদেশে পলাতক। এ নিয়ে দলের বর্তমান নীতিনির্ধারকরা আন্দোলন করতে পারছেন না, ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়নও করা হচ্ছে না, তৃণমূল পর্যায়ে মামলা-হামলার শিকার হওয়া নেতাকর্মীদের কোন খোঁজখবরও রাখা হচ্ছে না।

আবার যাদের কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল, তাদের অনেকেরই এলাকায় কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই, অনেক প্রার্থীকে এলাকার লোকজন চিনেই না, দীর্ঘদিন এলাকায় নিরুত্তাপ, তারা প্রকাশ্য প্রচরণায়ও নামেনি; টাকা-পয়সাও ব্যয় করেনি। কেউ কেউ ভাড়াটে টোকাইয়ের মাধ্যমে পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ করেছে; কিন্তু দলীয় কর্মীসমর্থকদের প্রচারণায় সম্পৃক্ত করেনি। নগরবাসীর দ্বারে দ্বারে ভোট চাননি; অনেকে দলের পদ ধরে রাখার জন্য কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন। এসব কারণেই বিএনপির বড় ধরনের পরাজয় হয়েছে বলে দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মনে করছেন।

বিএনপির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটিতে কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী আসনে কাউন্সিলর পদে বিএনপির প্রায় দুইশ প্রার্থী ছিল। তাদের অনেকে এলাকায় নিজেদের আওয়ামী লীগ সমর্থক পরিচয় দিয়েও চলাফেরা করেন। দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়ন না দিয়ে দলটির সিনিয়র নেতারা কেউ ১০টি, কেউ ১৫টি, কেউ ২০টি ওয়ার্ডের দায়িত্ব নিয়ে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছেন। অনুগত ও নিজেদের কোরামের নেতাকর্মীদের মনোনয়ন দিয়েছেন। এতে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল হয়েছে; কিন্তু দলের যোগ্য, ত্যাগী ও সক্রিয় নেতাদের অনেকে মনোয়ন পাননি।

তবে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও ঢাকা দক্ষিণের বিএনপির ন্যূনতম তিনজন কাউন্সিলর প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। তাদের এজেন্ট ও কর্মীসমর্থকরা ভোট গণনার সময় পর্যন্ত কেন্দ্রে উপস্থিত ছিল। তারা স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের মাঠে নামাতেও সক্ষম হয়েছেন। এর ফলও তারা পেয়েছেন। তাছাড়া বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় কর্মী সভা করার ওপরও খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি।