পাবলিক পরীক্ষায় বিশৃঙ্খলা ও অনিয়ম রোধ হচ্ছে না

পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস পরীক্ষার সময়ও কোচিং বন্ধ নেই ভুল প্রশ্ন-পুরাতন প্রশ্নে এসএসসি

পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা অনিয়ম কিছুতেই রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও বিতরণ প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজ করা এবং পরীক্ষা চলার সময়ে কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার নিয়ম চালু করা হলেও পাবলিক পরীক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা চলছেই। এমসিকিউ প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভুল প্রশ্নপত্র বিতরণ ও পুরাতন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়াসহ বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এবারের এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন অনুষ্ঠিত বাংলা বিষয়ের পরীক্ষায় নিষিদ্ধ নোট-গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্নপত্র তুলে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি প্রথম দিনের পরীক্ষায় অনিয়মের জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সে সর্ম্পকে জরুরি প্রতিবেদন দেয়ার জন্য ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর জিয়াউল হককে নির্দেশ দিয়েছেন বলে সংবাদকে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।

কয়েক বছর আগে পাবলিক পরীক্ষায় অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা নিয়মিত হয়ে উঠেছিল। গত দু’তিন বছর অনিয়ম-বিশৃঙ্খলার অভিযোগ অনেকটাই কমে গিয়েছিল। কিন্তু পুরোপুরি রোধ হয়নি। তা এবার আবার সবার সামনে চলে এসেছে। গত কয়েক বছর দু’একটি ঘটনা ঘটলেও শিক্ষা প্রশাসন অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিল। এছাড়া শিক্ষামন্ত্রী পরীক্ষা চলাকালীন এক মাস সব ধরনের কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু দু’এক বছর যেতে না যেতেই অবস্থা আবার আগের মতো হয়ে উঠেছে। এবার অধিকাংশ কোচিং সেন্টার খোলা রয়েছে বলে জানা গেছে। বরাবরই নিষিদ্ধ নোট গাইড বই ব্যবসায়ী, কোচিংবাজ শিক্ষক ও কোচিং সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর এসএম আমিরুল ইসলাম গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্নপত্রে যে ভুলগুলো হয়েছে; যেসব অনিয়ম হয়েছে, বিশেষ করে ২০১৬ ও ২০১৮ সালের সিলেবাস অনুযায়ী প্রশ্নপত্র তৈরি বা কোন বিষয় পরীক্ষার্থীর স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়েছে কিনা যেসব বিষয় খুঁজে বের করা হচ্ছে।’ ঢাকা বোর্ডের প্রশ্নপত্র ঢাকা বোর্ডে ছাপা হয় না জানিয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, ‘আমাদের প্রশ্নপত্র আমরা ছাপি না; লটারির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ঠিক করা হয়। আমাদের প্রশ্নপত্রটি কোন বোর্ডের তৈরি সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রথম পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগ সংক্রান্ত সবগুলো বিষয় চুলচেড়া বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। যারাই এর জন্য দায়ী থাকবেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

গত ৩ ফেব্রুয়ারি এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার প্রথম দিনে নিষিদ্ধ গাইড বই থেকে হুবহু তুলে দেয়া হয়েছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এসএসসির বাংলা প্রথম পত্রের সৃজনশীল প্রশ্ন। এমসিকিউ অংশের একাধিক প্রশ্নের রয়েছে একাধিক উত্তর। এতে বিভ্রান্তিতে পরে পরীক্ষার্থীরা। এছাড়া নতুন ও পুরাতন (২০১৬ ও ২০১৮) সিলেবাসের প্রশ্ন নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে কেন্দ্রে সচিব ও দায়িত্বরত শিক্ষকরা। বাংলা প্রথম পত্রে মোট ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় ৭০ নম্বর হয় সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে। বাকি ৩০ নম্বরের এমসিকিউ (মাল্টিপল চয়েস কোশ্চেন)। ৭০ নম্বরের সৃজনশীল প্রশ্নের মধ্যে ৪০ নম্বর হুবহু খোলা বাজারের গাইড বই থেকে তুলে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে, যা তিন/চার বছর আগের অন্য শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্নের সঙ্গে প্রায় মিল পাওয়া গেছে।

রাজধানীসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বরিশাল, বাগেরহাট, ময়মনসিংহ, নীলফামারীতে বিশৃঙ্খল অবস্থায় এসএসসি পরীক্ষা নেয়া হয়। যশোর, শেরপুর, ফরিদপুর ও গাইবান্ধায় ২০১৮ সালের সিলেবাসের প্রশ্নপত্র বিতরণেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ ব্যাপারে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখক প্রফেসর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, ‘যারা বাংলার বিষয়ে স্বতন্ত্রভাবে একটা প্রশ্ন করতে পারেন না, তারা শিক্ষা বোর্ড চালান কেমন করে? গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দেয়ায় অভিযুক্তদের লজ্জা-শরম নেই, কিছুদিন পরপরই তারা এটা করেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ন্যূনতম চারটি শিক্ষা বোর্ডের শীর্ষ পদেই পদায়ন করা হয়েছে নানা কারণে বিতর্কিত কর্মকর্তা। তাদের সঙ্গে নিষিদ্ধ নোট গাইড বইয়ের ব্যবসায়ী, কোচিং সেন্টারের মালিক, বাণিজ্যনির্ভর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা ব্যবসায়ীদের গভীর সখ্যতা রয়েছে। এ কারণেই এবারের এসএসসি পরীক্ষার শুরুতেই এক ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এছাড়া বিগত সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তি ও কর্মকর্তা, এ সংক্রান্ত কয়েকটি তদন্ত প্রতিবেদন বাস্তবায়ন না করা, প্রতিবেদন গোপন রাখা এবং যাদের গাফিলতির কারণে পাবলিক পরীক্ষায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় ওইসব কর্মকর্তার কোন শাস্তি না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা বা প্রতারণা থামছে না।

এবারের এসএসসি প্রথম পরীক্ষার আগের দিন ২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর রামপুরা, গাজীপুর ও খুলনা থেকে পৃথক অভিযানে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রতারণা ও গুজব সৃষ্টির অভিযোগে চারজনকে আটক করে র‌্যাব।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জে দাখিল পরীক্ষার্থীদের উত্তর সরবরাহ করার দায়ে পাঁচ শিক্ষকের প্রত্যেককে দুই বছরের কারাদ- ও দশ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাদ্রাসা কেন্দ্রে এই ঘটনা ঘটে। একই দিনে খুলনা মহানগরীর পৃথক দু’টি স্থানে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব-৬ খুলনার সদস্যরা এসএসসি’র ভুয়া প্রশ্নপত্র ফাঁস ও পরীক্ষার রেজাল্ট পরিবর্তনের গুজব সৃষ্টিকারী প্রতারক চক্রের দুই সক্রিয় সদস্যকে আটক করেছে।

নিষিদ্ধ নোট ও গাইড বই থেকে প্রশ্নপত্র

২০১৬ সালে অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি পরীক্ষায়ও গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দিয়ে বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্ন করা হয়। ওই ঘটনায় শিক্ষা প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়। কিন্তু ওই ঘটনার জন্য দায়ী কর্মকর্তাকে সম্প্রতি একটি শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। ওই বছর এইচএসসির জীববিজ্ঞান (তত্ত্বীয়) প্রথম পত্রের পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ‘ফেসবুক’ এ ছড়িয়ে পড়ে প্রশ্নপত্র। পরবর্তীতে জীববিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। ওইদিন পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা ১০ মিনিট আগেই প্রশ্নপত্র ফেসবুকে পাওয়া যায়। ফেইসবুক থেকে মুহূর্তের মধ্যে তা সামাজিক যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই বছরের এইচএসসি’র প্রায় প্রতিটি বিষয়ের ক্ষেত্রেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে।

২০১৭ সালে গাইড বই থেকে রাজশাহী বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার আরআইএম ডিগ্রি কলেজের দু’জন শিক্ষকের এমপিও বাতিল করার উদ্যোগ নেয়া হয়।

এর আগে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এইচএসসির ইংরেজি প্রশ্নপত্র ও এসএসসির পদার্থ বিজ্ঞানের ইংরেজি ভার্সনের প্রশ্নপত্র হুবহু গাইড বই অনুসরণ করে তৈরি করার অভিযোগ পাওয়া যায়, ওই ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়। এ ঘটনা খতিয়ে দেখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব এএস মাহমুদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তদন্ত প্রতিবেদনটি আলোর মুখ দেখেনি।

২০১৪ সালের ৯ এপ্রিল ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি’র ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে ওই পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। ওই ঘটনা তদন্তে তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব সোহরাব হোসাইনের (পরর্তীতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সিনিয়র সচিব) নেতৃত্বে ওই বছরের ১০ এপ্রিল একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়।

ওই কমিটি প্রশ্ন প্রণয়নের পুরো প্রক্রিয়া ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্নের সুপারিশ করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। তবে ওই কমিটি প্রায় তিন মাসেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে পারেনি। কীভাবে, কখন ও কোথায় থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে সে সর্ম্পকেও কোন রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি তদন্ত কমিটি।

ওই তদন্ত কমিটি চারটি প্রধান সুপারিশ করেছিল। সেগুলো হলো- প্রশ্ন প্রণয়ন ও বিতরণে ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু, লটারির মাধ্যমে সেট নির্ধারণ করে পরীক্ষার দিন সকালে প্রশ্ন ছাপানো, ২০ সেট প্রশ্নের পান্ডুলিপি তৈরি করে সেখান থেকে পাঁচ সেট নির্ধারণ এবং প্রশ্ন তৈরি, রেটিং, মডারেশন ও ডিজিটাল প্রিন্টিং সিস্টেমে ছাপার উপযোগী আউটপুট পাওয়ার জন্য সফটওয়ার তৈরি।

এছাড়া বিজি প্রেস ছাড়া অন্য কোথাও প্রশ্ন ছাপানো, পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্রসংখ্যা সীমিত রাখা এবং ঝুঁকিপূর্ণ, জেলা ও উপজেলা সদর থেকে দূরবর্তী কেন্দ্র বাতিলের সুপারিশ করা হয়। পাবলিক পরীক্ষার বিষয় সংখ্যা যৌক্তিকভাবে কমিয়ে অনধিক পাঁচটি বিষয়ের পরীক্ষা নেয়া এবং এমসিকিউ প্রশ্নের নম্বর কমিয়ে আনারও সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদনে পাবলিক পরীক্ষা আইনে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে কঠোরভাবে তা প্রয়োগেরও সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু কোন পদক্ষেপই প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে কাজে আসছে না। পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছেই।

এর আগে ২০১৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ঢালাওভাকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে, যা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে প্রমাণিত হয়। ওই বছরের এসএসসি পরীক্ষায়ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন বিষয়ের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠে। কিন্ত ওইসব অভিযোগের কোন সুরাহা করতে পারেনি শিক্ষা প্রশাসন।

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ২০১৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা শিক্ষায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘গাইড বই থেকে প্রশ্ন করলে চাকরি থাকবে না; এমপিও বন্ধ হয়ে যাব।

বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ২২ মাঘ ১৪২৬, ১০ জমাদিউল সানি ১৪৪১

পাবলিক পরীক্ষায় বিশৃঙ্খলা ও অনিয়ম রোধ হচ্ছে না

পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস পরীক্ষার সময়ও কোচিং বন্ধ নেই ভুল প্রশ্ন-পুরাতন প্রশ্নে এসএসসি

রাকিব উদ্দিন

পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা অনিয়ম কিছুতেই রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও বিতরণ প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজ করা এবং পরীক্ষা চলার সময়ে কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার নিয়ম চালু করা হলেও পাবলিক পরীক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা চলছেই। এমসিকিউ প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভুল প্রশ্নপত্র বিতরণ ও পুরাতন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়াসহ বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এবারের এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন অনুষ্ঠিত বাংলা বিষয়ের পরীক্ষায় নিষিদ্ধ নোট-গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্নপত্র তুলে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি প্রথম দিনের পরীক্ষায় অনিয়মের জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সে সর্ম্পকে জরুরি প্রতিবেদন দেয়ার জন্য ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর জিয়াউল হককে নির্দেশ দিয়েছেন বলে সংবাদকে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।

কয়েক বছর আগে পাবলিক পরীক্ষায় অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা নিয়মিত হয়ে উঠেছিল। গত দু’তিন বছর অনিয়ম-বিশৃঙ্খলার অভিযোগ অনেকটাই কমে গিয়েছিল। কিন্তু পুরোপুরি রোধ হয়নি। তা এবার আবার সবার সামনে চলে এসেছে। গত কয়েক বছর দু’একটি ঘটনা ঘটলেও শিক্ষা প্রশাসন অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিল। এছাড়া শিক্ষামন্ত্রী পরীক্ষা চলাকালীন এক মাস সব ধরনের কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু দু’এক বছর যেতে না যেতেই অবস্থা আবার আগের মতো হয়ে উঠেছে। এবার অধিকাংশ কোচিং সেন্টার খোলা রয়েছে বলে জানা গেছে। বরাবরই নিষিদ্ধ নোট গাইড বই ব্যবসায়ী, কোচিংবাজ শিক্ষক ও কোচিং সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর এসএম আমিরুল ইসলাম গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্নপত্রে যে ভুলগুলো হয়েছে; যেসব অনিয়ম হয়েছে, বিশেষ করে ২০১৬ ও ২০১৮ সালের সিলেবাস অনুযায়ী প্রশ্নপত্র তৈরি বা কোন বিষয় পরীক্ষার্থীর স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়েছে কিনা যেসব বিষয় খুঁজে বের করা হচ্ছে।’ ঢাকা বোর্ডের প্রশ্নপত্র ঢাকা বোর্ডে ছাপা হয় না জানিয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, ‘আমাদের প্রশ্নপত্র আমরা ছাপি না; লটারির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ঠিক করা হয়। আমাদের প্রশ্নপত্রটি কোন বোর্ডের তৈরি সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রথম পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগ সংক্রান্ত সবগুলো বিষয় চুলচেড়া বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। যারাই এর জন্য দায়ী থাকবেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

গত ৩ ফেব্রুয়ারি এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার প্রথম দিনে নিষিদ্ধ গাইড বই থেকে হুবহু তুলে দেয়া হয়েছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এসএসসির বাংলা প্রথম পত্রের সৃজনশীল প্রশ্ন। এমসিকিউ অংশের একাধিক প্রশ্নের রয়েছে একাধিক উত্তর। এতে বিভ্রান্তিতে পরে পরীক্ষার্থীরা। এছাড়া নতুন ও পুরাতন (২০১৬ ও ২০১৮) সিলেবাসের প্রশ্ন নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে কেন্দ্রে সচিব ও দায়িত্বরত শিক্ষকরা। বাংলা প্রথম পত্রে মোট ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় ৭০ নম্বর হয় সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে। বাকি ৩০ নম্বরের এমসিকিউ (মাল্টিপল চয়েস কোশ্চেন)। ৭০ নম্বরের সৃজনশীল প্রশ্নের মধ্যে ৪০ নম্বর হুবহু খোলা বাজারের গাইড বই থেকে তুলে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে, যা তিন/চার বছর আগের অন্য শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্নের সঙ্গে প্রায় মিল পাওয়া গেছে।

রাজধানীসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বরিশাল, বাগেরহাট, ময়মনসিংহ, নীলফামারীতে বিশৃঙ্খল অবস্থায় এসএসসি পরীক্ষা নেয়া হয়। যশোর, শেরপুর, ফরিদপুর ও গাইবান্ধায় ২০১৮ সালের সিলেবাসের প্রশ্নপত্র বিতরণেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ ব্যাপারে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখক প্রফেসর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, ‘যারা বাংলার বিষয়ে স্বতন্ত্রভাবে একটা প্রশ্ন করতে পারেন না, তারা শিক্ষা বোর্ড চালান কেমন করে? গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দেয়ায় অভিযুক্তদের লজ্জা-শরম নেই, কিছুদিন পরপরই তারা এটা করেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ন্যূনতম চারটি শিক্ষা বোর্ডের শীর্ষ পদেই পদায়ন করা হয়েছে নানা কারণে বিতর্কিত কর্মকর্তা। তাদের সঙ্গে নিষিদ্ধ নোট গাইড বইয়ের ব্যবসায়ী, কোচিং সেন্টারের মালিক, বাণিজ্যনির্ভর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা ব্যবসায়ীদের গভীর সখ্যতা রয়েছে। এ কারণেই এবারের এসএসসি পরীক্ষার শুরুতেই এক ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এছাড়া বিগত সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তি ও কর্মকর্তা, এ সংক্রান্ত কয়েকটি তদন্ত প্রতিবেদন বাস্তবায়ন না করা, প্রতিবেদন গোপন রাখা এবং যাদের গাফিলতির কারণে পাবলিক পরীক্ষায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় ওইসব কর্মকর্তার কোন শাস্তি না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা বা প্রতারণা থামছে না।

এবারের এসএসসি প্রথম পরীক্ষার আগের দিন ২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর রামপুরা, গাজীপুর ও খুলনা থেকে পৃথক অভিযানে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রতারণা ও গুজব সৃষ্টির অভিযোগে চারজনকে আটক করে র‌্যাব।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জে দাখিল পরীক্ষার্থীদের উত্তর সরবরাহ করার দায়ে পাঁচ শিক্ষকের প্রত্যেককে দুই বছরের কারাদ- ও দশ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাদ্রাসা কেন্দ্রে এই ঘটনা ঘটে। একই দিনে খুলনা মহানগরীর পৃথক দু’টি স্থানে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব-৬ খুলনার সদস্যরা এসএসসি’র ভুয়া প্রশ্নপত্র ফাঁস ও পরীক্ষার রেজাল্ট পরিবর্তনের গুজব সৃষ্টিকারী প্রতারক চক্রের দুই সক্রিয় সদস্যকে আটক করেছে।

নিষিদ্ধ নোট ও গাইড বই থেকে প্রশ্নপত্র

২০১৬ সালে অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি পরীক্ষায়ও গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দিয়ে বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্ন করা হয়। ওই ঘটনায় শিক্ষা প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়। কিন্তু ওই ঘটনার জন্য দায়ী কর্মকর্তাকে সম্প্রতি একটি শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। ওই বছর এইচএসসির জীববিজ্ঞান (তত্ত্বীয়) প্রথম পত্রের পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ‘ফেসবুক’ এ ছড়িয়ে পড়ে প্রশ্নপত্র। পরবর্তীতে জীববিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। ওইদিন পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা ১০ মিনিট আগেই প্রশ্নপত্র ফেসবুকে পাওয়া যায়। ফেইসবুক থেকে মুহূর্তের মধ্যে তা সামাজিক যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই বছরের এইচএসসি’র প্রায় প্রতিটি বিষয়ের ক্ষেত্রেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে।

২০১৭ সালে গাইড বই থেকে রাজশাহী বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার আরআইএম ডিগ্রি কলেজের দু’জন শিক্ষকের এমপিও বাতিল করার উদ্যোগ নেয়া হয়।

এর আগে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এইচএসসির ইংরেজি প্রশ্নপত্র ও এসএসসির পদার্থ বিজ্ঞানের ইংরেজি ভার্সনের প্রশ্নপত্র হুবহু গাইড বই অনুসরণ করে তৈরি করার অভিযোগ পাওয়া যায়, ওই ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়। এ ঘটনা খতিয়ে দেখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব এএস মাহমুদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তদন্ত প্রতিবেদনটি আলোর মুখ দেখেনি।

২০১৪ সালের ৯ এপ্রিল ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি’র ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে ওই পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। ওই ঘটনা তদন্তে তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব সোহরাব হোসাইনের (পরর্তীতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সিনিয়র সচিব) নেতৃত্বে ওই বছরের ১০ এপ্রিল একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়।

ওই কমিটি প্রশ্ন প্রণয়নের পুরো প্রক্রিয়া ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্নের সুপারিশ করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। তবে ওই কমিটি প্রায় তিন মাসেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে পারেনি। কীভাবে, কখন ও কোথায় থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে সে সর্ম্পকেও কোন রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি তদন্ত কমিটি।

ওই তদন্ত কমিটি চারটি প্রধান সুপারিশ করেছিল। সেগুলো হলো- প্রশ্ন প্রণয়ন ও বিতরণে ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু, লটারির মাধ্যমে সেট নির্ধারণ করে পরীক্ষার দিন সকালে প্রশ্ন ছাপানো, ২০ সেট প্রশ্নের পান্ডুলিপি তৈরি করে সেখান থেকে পাঁচ সেট নির্ধারণ এবং প্রশ্ন তৈরি, রেটিং, মডারেশন ও ডিজিটাল প্রিন্টিং সিস্টেমে ছাপার উপযোগী আউটপুট পাওয়ার জন্য সফটওয়ার তৈরি।

এছাড়া বিজি প্রেস ছাড়া অন্য কোথাও প্রশ্ন ছাপানো, পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্রসংখ্যা সীমিত রাখা এবং ঝুঁকিপূর্ণ, জেলা ও উপজেলা সদর থেকে দূরবর্তী কেন্দ্র বাতিলের সুপারিশ করা হয়। পাবলিক পরীক্ষার বিষয় সংখ্যা যৌক্তিকভাবে কমিয়ে অনধিক পাঁচটি বিষয়ের পরীক্ষা নেয়া এবং এমসিকিউ প্রশ্নের নম্বর কমিয়ে আনারও সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদনে পাবলিক পরীক্ষা আইনে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে কঠোরভাবে তা প্রয়োগেরও সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু কোন পদক্ষেপই প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে কাজে আসছে না। পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছেই।

এর আগে ২০১৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ঢালাওভাকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে, যা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে প্রমাণিত হয়। ওই বছরের এসএসসি পরীক্ষায়ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন বিষয়ের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠে। কিন্ত ওইসব অভিযোগের কোন সুরাহা করতে পারেনি শিক্ষা প্রশাসন।

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ২০১৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা শিক্ষায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘গাইড বই থেকে প্রশ্ন করলে চাকরি থাকবে না; এমপিও বন্ধ হয়ে যাব।