ভবিষ্যতের অশনিসংকেত

অলোক আচার্য

আমাদের দৈনন্দিন কাজের একটি বড় সময়েই প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার করা হয়। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত আমরা এসব পণ্য ব্যবহার করছি। তারপর ব্যবহার শেষ হলেই ছুড়ে ফেলছি আশেপাশে। আমরা নিত্যদিন এসব ব্যবহার করছি কারণ এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। আজকাল এর ব্যবহার এত বেড়েছে যে বলা চলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক। যার বিরুদ্ধে এখন মূলত সারা বিশে্বেই আলোচনা। সারা বিশ্বেই যেন ক্রমশ সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ওপর মহাবিরক্ত। অথচ প্রথমে মানুষের জীবনযাত্রাকে একটু সহজই করেছিল! তারপর সেটিই মানুষের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। বিদায় করতে পারলেই বাঁচা যায়। তবে চাইলেই সব দ্রুত হয় না। এখন আমরা চাইলেও খুব দ্রুত এসবের ব্যবহার রোধ করতে পারছি না। যেমনটা পারিনি পলিথিনের ব্যবহার ঠেকাতে। আইন করেও এর ব্যবহার বন্ধ করতে পারিনি। প্লাস্টিকের পণ্য মানুষের বেশ সুবিধা করেছিল। কিন্তু সেই সুবিধা যখন আরও বেশি হলো অর্থাৎ একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকে পৌঁছালো তখনই সমস্যার উৎপত্তি। প্লাস্টিকের একটি স্ট্র ব্যবহার করে আমরা যে ডাব খাচ্ছি তাও প্রকৃতির জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে তরুণ এবং যুব জনগোষ্ঠী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিক দূষণের জন্য বেশি দায়ী। এর মধ্যে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক পণ্যই বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এক গবেষণায় বলছে, মুদি দোকান থেকে কেনা পণ্য বহন করার জন্য যেসব ব্যাগ ব্যাবহার করা হয়, সেগুলো প্রকৃতিতে মিশে যেতে ২০ বছর সময় লাগে। চা, কফি, জুস কিংবা কোমল পানীয়ের জন্য যেসব প্লাষ্টিকের কাপ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। আর ডায়াপার এবং প্লাস্টিক বোতল ৪৫০ বছর পর্যন্ত পঁচে না। এভাবে প্লাস্টিক ব্যবহার পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। সাগর, নদী, পুকুর কোথাও পলিথিন ও প্লাস্টিকের দূষণ থেকে বাদ যাচ্ছে না। সাগরের মৃত প্রাণীদের পেটে পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর প্লাস্টিক। যা আমরা বিভিন্ন সময় সাগরের বুকে নিক্ষেপ করছি। একবারও ভেবে দেখছি না আমার ফেলে দেয়া এই প্লাস্টিক পণ্য প্রাণিকুলের জন্য সংকট বয়ে আনবে।

প্লাস্টিক ক্ষতিকর জানা সত্ত্বে আমরা আমরা ব্যবহার করি এবং পরিবেশ দূষণের জন্য যেখানে সেখানে ফেলে দেই। কিন্তু কেন করছি? উত্তরটি পলিথিনের ব্যবহারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বহনযোগ্যতা, দাম কম এবং তুলনামূলক টেকসই হওয়ায় এর ব্যবহার বেড়ে চলেছে। প্রতিদিন হাটে-বাজারে, দোকানে, মার্কেটে জনপ্রিয় জিনিস হলো প্লাস্টিক। এই মুহূর্তে প্লাস্টিকের যোগ্য বিকল্প নেই যা ব্যবহার করলে পরিবেশ রক্ষা করতে পারি। প্লাস্টিক যদিও রিসাইকেল করে পুনর্ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা হয় এবং তা হচ্ছেও। তবে প্রশ্নটি হলো সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ক্ষেত্রে। আমাদের নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের একটি বড় অংশই রিসাইকেলের বাইরে থেকে যাচ্ছে যা মানবজাতির জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। আমরা যখন নদীতে প্লাস্টিক ছুড়ে ফেলছি তখন তা রিসাইকেল কে করবে? আমাদের পাশর্্বেবর্তী দেশ ভারত আগামী ২০২২ সালের মধ্যে প্লাস্টিকমুক্ত দেশ গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ঘরে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের আসবাবপত্র আমাদের প্লাস্টিক দূষণের আপাত প্রধান কারণ নয়। কারণ এসব পণ্য দীর্ঘদিন ব্যবহার করা হয় এবং এগুলোর একটি বড় অংশই রিসাইকেল করা হয়। কিন্তু আমরা বাজার থেকে যে শ্যাম্পু, প্লাস্টিকের ব্যাগ, স্ট্র, ছোট বোতল বা এ ধরনের ছোট ছোট পণ্য ব্যবহার করছি এসব পণ্যই পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলছে। এসব ব্যবহারের পরপরই আমরা ছুড়ে ফেলছি রাস্তায়, ড্রেনে, নদীতে, পার্কে, সাগরে। এক কথায় যে কোন স্থানে। ছুড়ে ফেলাটাই তো আমাদের অভ্যাস! এগুলো একত্রিত করে পুড়িয়ে ফেলার কার্যক্রমও চোখে পরে না। এত কষ্ট কেউ করছেও না। একবার ভাবুন তো, প্রতিদিন কত মানুষ প্রতিদিন ছোট ছোট নিত্যব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করছে আবার তা ছুড়ে ফেলছে। এসব জঞ্জাল পরিষ্কার করার কেউ নেই। ফলে মাটির কোথাও না কোথাও এসব আবর্জনা থেকে যাচ্ছে। প্রতিদিন আমাদের অনেকেই খালি হাতে বাজারে যাই আর ফিরে আসি প্লাস্টিকের কোন জিনিস কিনে। তারপর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে আশেপাশেই ছুড়ে ফেলে দেই। সেই জিনিস আমাদের জন্য কতটা ক্ষতির কারণ হতে পারে তা ভাবার কোন সময় নেই বা পরিবেশের প্রতি কোন দায়িত্বও নেই।

আমরা জেনেও ভুলে যাই যে প্লাস্টিক কোন প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি হয় না বরং এর প্রভাব এতটা মারাত্মক যে যুগের পর যুগ তা মাটিতে দিব্যি ঠিক থাকে। প্লাস্টিক পচতে বহু বহু বছর সময় লেগে যায়। মানুষের কাছে জনপ্রিয় হওয়ায় এর ব্যবহার কমার কোন লক্ষণ নেই। এর ব্যবহার যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলা যায়, যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া হয় তাহলে আজ পলিথিন যে বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে তখন প্লাস্টিকও বুমেরাং হবে আমাদের জন্য। ভারতে প্লাস্টিকমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্য হিসেবে গত অক্টোবর থেকেই ছয়টি প্লাস্টিকজাত পণ্যের ব্যবহার ও আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। বিশে্বের সবচেয়ে দূষিত এলাকার তালিকায় থাকা দেশটির শহর ও গ্রামগুলো থেকে ‘ওয়ার-টাইম’ প্লাস্টিক পণ্য তুলে দিতে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কেবল ভারত নয় একবারের বেশি ব্যবহারযোগ্য নয় এমন প্লাস্টিক ব্যাগ ও অন্যান্য পণ্যের ব্যবহার কমানোর বড় ধরনের পরিকল্পনা করেছে চীন। এর আওতায় চলতি বছরের মধ্যেই অপচনশীল একবার ব্যাবহারযোগ্য ব্যাগ দেশের প্রধান প্রধান শহরে নিষিদ্ধ করা হবে। আর ২০২২ সাল নাগাদ এসব ব্যাগ নিষিদ্ধ হবে বাকি শহর ও নগরে। চীনের রেস্টুরেন্টগুলোতেও ২০২০ সালের শেষ নাগাদ একবার ব্যাবহারযোগ্য প্লাস্টিক স্ট্র ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হবে। চীনের সবচেয়ে বড় ময়লার ভাগাড়টি প্রায় ১০০টি ফুটবল মাঠের সমান। সেটিও এরই মধ্যে ভরে গেছে। এসব দেখে একবার আমাদের অবস্থা ভাবুন? আমাদের এত জায়গা কোথায়? আমাদের দেশেও এখন ওয়ান টাইম পণ্যের জয়জয়কার। বিয়ে, জন্মদিনসহ যে কোন অনুষ্ঠানে এসব পণ্যের ব্যবহার চোখে পরে। আবার ব্যবহারের পর আশেপাশেই সেগুলো ছুড়ে ফেলছি। সারা বিশ্বেই প্লাস্টিকের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার এবং এর পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। এসব প্লাস্টিকজাত পণ্যের একটি বড় অংশই সমুদ্রে গিয়ে পৌঁছাছে। প্লাস্টিকের এই বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ কি? এটি সস্তা, সহজে বহনযোগ্য এবং বেশ স্থায়ী।

প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকজাত পণ্য আমাদের দেশের মানুষের হাত ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেসব পণ্যের কম অংশই আবার রিসাইকেল হওয়ার জন্য কারখানায় ফিরে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের অন্যান্য কল্যাণকর আবিষ্কারের মতোই প্লাস্টিক আবিষ্কার ছিল একটি চমৎকার। কিন্তু অনেক আবিষ্কারের মতোই আজ প্লাস্টিক আমাদের মানব সভ্যতাকেই হুমকির ভেতর ফেলছে। এর জন্য দায়ী মানুষ। আমরা এর সঠিক ব্যবহার করতে পারছি না। আমাদের মতো দেশে জনগণ যেখানে সচেতন নয়, পরিবেশ নিয়ে কম মানুষেরই মাথাব্যথা রয়েছে সেখানে প্লাস্টিক হুমকি হবেই। যেখানে সেখানে ব্যবহার্য জিনিস ছুড়ে ফেলার প্রবণতা এ সংকটকে ঘণীভূত করছে। প্লাস্টিকের বিরূপ প্রভাব থেকে পরিবেশকে মুক্ত করার জন্য আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। যদিও তা সহজসাধ্য নয়। কারণ এখন যে বিপুল ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের ব্যবহার করা হচ্ছে তা হুটহাট শেষ করা যায় না। বিকল্প কোন উপায় ভাবতে হবে। যাতে প্লাস্টিকের ব্যবহার একটু একটু করে কমিয়ে আনা যায়। একটা সময় তো প্লাস্টিকের এত বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার ছিল না। তখন পরিবেশের দূষণও ছিল কম। এর ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হুমকি বাড়ছে। বিশেষ করে সাগরের তলদেশ এসব প্লাস্টিকজাত সামগ্রীতে পূর্ণ হচ্ছে। যা সমগ্র জীববৈচিত্র্যের জন্যই হুমকিস্বরূপ। সর্বশেষে মালয়েশিয়ার একটি তথ্য উল্লেখ্য করছি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, ১৫০ কনটেইনার প্লাস্টিক বর্জ্য মালয়েশিয়া ফেরত পাঠিয়েছে। তারা ১৫০টি কনটেইনারে করে ৩ হাজার ৭৩৭ টন প্লাস্টিক বর্জ্য ১৩টি দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। গত বছরের জুলাই থেকে এ পর্যন্ত এই পরিমাণ বর্জ্য ফেরত দেয়া হয়েছে। চলতি বছরের মাঝামাঝিতে আরও ১১০টি কনটেইনার বর্জ্য ফেরত পাঠানো হবে। প্রশ্ন হলো আমরা কবে এই আপাত সমস্যা সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের কবল থেকে মুক্ত হতে পারব। কীভাবে এ প্রশ্নবিদ্ধ জনপ্রিয় পণ্যটি ব্যবহার একেবারে প্রান্তিক পর্যায় থেকে বন্ধ করা যাবে? কারণ প্রশ্ন তো আমাদের নিজেদের সচেতনতা।

[লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট]

sopnil.roy@gmail.com

বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ২২ মাঘ ১৪২৬, ১০ জমাদিউল সানি ১৪৪১

একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক

ভবিষ্যতের অশনিসংকেত

অলোক আচার্য

আমাদের দৈনন্দিন কাজের একটি বড় সময়েই প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার করা হয়। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত আমরা এসব পণ্য ব্যবহার করছি। তারপর ব্যবহার শেষ হলেই ছুড়ে ফেলছি আশেপাশে। আমরা নিত্যদিন এসব ব্যবহার করছি কারণ এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। আজকাল এর ব্যবহার এত বেড়েছে যে বলা চলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক। যার বিরুদ্ধে এখন মূলত সারা বিশে্বেই আলোচনা। সারা বিশ্বেই যেন ক্রমশ সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ওপর মহাবিরক্ত। অথচ প্রথমে মানুষের জীবনযাত্রাকে একটু সহজই করেছিল! তারপর সেটিই মানুষের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। বিদায় করতে পারলেই বাঁচা যায়। তবে চাইলেই সব দ্রুত হয় না। এখন আমরা চাইলেও খুব দ্রুত এসবের ব্যবহার রোধ করতে পারছি না। যেমনটা পারিনি পলিথিনের ব্যবহার ঠেকাতে। আইন করেও এর ব্যবহার বন্ধ করতে পারিনি। প্লাস্টিকের পণ্য মানুষের বেশ সুবিধা করেছিল। কিন্তু সেই সুবিধা যখন আরও বেশি হলো অর্থাৎ একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকে পৌঁছালো তখনই সমস্যার উৎপত্তি। প্লাস্টিকের একটি স্ট্র ব্যবহার করে আমরা যে ডাব খাচ্ছি তাও প্রকৃতির জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে তরুণ এবং যুব জনগোষ্ঠী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিক দূষণের জন্য বেশি দায়ী। এর মধ্যে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক পণ্যই বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এক গবেষণায় বলছে, মুদি দোকান থেকে কেনা পণ্য বহন করার জন্য যেসব ব্যাগ ব্যাবহার করা হয়, সেগুলো প্রকৃতিতে মিশে যেতে ২০ বছর সময় লাগে। চা, কফি, জুস কিংবা কোমল পানীয়ের জন্য যেসব প্লাষ্টিকের কাপ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। আর ডায়াপার এবং প্লাস্টিক বোতল ৪৫০ বছর পর্যন্ত পঁচে না। এভাবে প্লাস্টিক ব্যবহার পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। সাগর, নদী, পুকুর কোথাও পলিথিন ও প্লাস্টিকের দূষণ থেকে বাদ যাচ্ছে না। সাগরের মৃত প্রাণীদের পেটে পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর প্লাস্টিক। যা আমরা বিভিন্ন সময় সাগরের বুকে নিক্ষেপ করছি। একবারও ভেবে দেখছি না আমার ফেলে দেয়া এই প্লাস্টিক পণ্য প্রাণিকুলের জন্য সংকট বয়ে আনবে।

প্লাস্টিক ক্ষতিকর জানা সত্ত্বে আমরা আমরা ব্যবহার করি এবং পরিবেশ দূষণের জন্য যেখানে সেখানে ফেলে দেই। কিন্তু কেন করছি? উত্তরটি পলিথিনের ব্যবহারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বহনযোগ্যতা, দাম কম এবং তুলনামূলক টেকসই হওয়ায় এর ব্যবহার বেড়ে চলেছে। প্রতিদিন হাটে-বাজারে, দোকানে, মার্কেটে জনপ্রিয় জিনিস হলো প্লাস্টিক। এই মুহূর্তে প্লাস্টিকের যোগ্য বিকল্প নেই যা ব্যবহার করলে পরিবেশ রক্ষা করতে পারি। প্লাস্টিক যদিও রিসাইকেল করে পুনর্ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা হয় এবং তা হচ্ছেও। তবে প্রশ্নটি হলো সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ক্ষেত্রে। আমাদের নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের একটি বড় অংশই রিসাইকেলের বাইরে থেকে যাচ্ছে যা মানবজাতির জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। আমরা যখন নদীতে প্লাস্টিক ছুড়ে ফেলছি তখন তা রিসাইকেল কে করবে? আমাদের পাশর্্বেবর্তী দেশ ভারত আগামী ২০২২ সালের মধ্যে প্লাস্টিকমুক্ত দেশ গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ঘরে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের আসবাবপত্র আমাদের প্লাস্টিক দূষণের আপাত প্রধান কারণ নয়। কারণ এসব পণ্য দীর্ঘদিন ব্যবহার করা হয় এবং এগুলোর একটি বড় অংশই রিসাইকেল করা হয়। কিন্তু আমরা বাজার থেকে যে শ্যাম্পু, প্লাস্টিকের ব্যাগ, স্ট্র, ছোট বোতল বা এ ধরনের ছোট ছোট পণ্য ব্যবহার করছি এসব পণ্যই পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলছে। এসব ব্যবহারের পরপরই আমরা ছুড়ে ফেলছি রাস্তায়, ড্রেনে, নদীতে, পার্কে, সাগরে। এক কথায় যে কোন স্থানে। ছুড়ে ফেলাটাই তো আমাদের অভ্যাস! এগুলো একত্রিত করে পুড়িয়ে ফেলার কার্যক্রমও চোখে পরে না। এত কষ্ট কেউ করছেও না। একবার ভাবুন তো, প্রতিদিন কত মানুষ প্রতিদিন ছোট ছোট নিত্যব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করছে আবার তা ছুড়ে ফেলছে। এসব জঞ্জাল পরিষ্কার করার কেউ নেই। ফলে মাটির কোথাও না কোথাও এসব আবর্জনা থেকে যাচ্ছে। প্রতিদিন আমাদের অনেকেই খালি হাতে বাজারে যাই আর ফিরে আসি প্লাস্টিকের কোন জিনিস কিনে। তারপর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে আশেপাশেই ছুড়ে ফেলে দেই। সেই জিনিস আমাদের জন্য কতটা ক্ষতির কারণ হতে পারে তা ভাবার কোন সময় নেই বা পরিবেশের প্রতি কোন দায়িত্বও নেই।

আমরা জেনেও ভুলে যাই যে প্লাস্টিক কোন প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি হয় না বরং এর প্রভাব এতটা মারাত্মক যে যুগের পর যুগ তা মাটিতে দিব্যি ঠিক থাকে। প্লাস্টিক পচতে বহু বহু বছর সময় লেগে যায়। মানুষের কাছে জনপ্রিয় হওয়ায় এর ব্যবহার কমার কোন লক্ষণ নেই। এর ব্যবহার যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলা যায়, যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া হয় তাহলে আজ পলিথিন যে বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে তখন প্লাস্টিকও বুমেরাং হবে আমাদের জন্য। ভারতে প্লাস্টিকমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্য হিসেবে গত অক্টোবর থেকেই ছয়টি প্লাস্টিকজাত পণ্যের ব্যবহার ও আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। বিশে্বের সবচেয়ে দূষিত এলাকার তালিকায় থাকা দেশটির শহর ও গ্রামগুলো থেকে ‘ওয়ার-টাইম’ প্লাস্টিক পণ্য তুলে দিতে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কেবল ভারত নয় একবারের বেশি ব্যবহারযোগ্য নয় এমন প্লাস্টিক ব্যাগ ও অন্যান্য পণ্যের ব্যবহার কমানোর বড় ধরনের পরিকল্পনা করেছে চীন। এর আওতায় চলতি বছরের মধ্যেই অপচনশীল একবার ব্যাবহারযোগ্য ব্যাগ দেশের প্রধান প্রধান শহরে নিষিদ্ধ করা হবে। আর ২০২২ সাল নাগাদ এসব ব্যাগ নিষিদ্ধ হবে বাকি শহর ও নগরে। চীনের রেস্টুরেন্টগুলোতেও ২০২০ সালের শেষ নাগাদ একবার ব্যাবহারযোগ্য প্লাস্টিক স্ট্র ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হবে। চীনের সবচেয়ে বড় ময়লার ভাগাড়টি প্রায় ১০০টি ফুটবল মাঠের সমান। সেটিও এরই মধ্যে ভরে গেছে। এসব দেখে একবার আমাদের অবস্থা ভাবুন? আমাদের এত জায়গা কোথায়? আমাদের দেশেও এখন ওয়ান টাইম পণ্যের জয়জয়কার। বিয়ে, জন্মদিনসহ যে কোন অনুষ্ঠানে এসব পণ্যের ব্যবহার চোখে পরে। আবার ব্যবহারের পর আশেপাশেই সেগুলো ছুড়ে ফেলছি। সারা বিশ্বেই প্লাস্টিকের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার এবং এর পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। এসব প্লাস্টিকজাত পণ্যের একটি বড় অংশই সমুদ্রে গিয়ে পৌঁছাছে। প্লাস্টিকের এই বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ কি? এটি সস্তা, সহজে বহনযোগ্য এবং বেশ স্থায়ী।

প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকজাত পণ্য আমাদের দেশের মানুষের হাত ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেসব পণ্যের কম অংশই আবার রিসাইকেল হওয়ার জন্য কারখানায় ফিরে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের অন্যান্য কল্যাণকর আবিষ্কারের মতোই প্লাস্টিক আবিষ্কার ছিল একটি চমৎকার। কিন্তু অনেক আবিষ্কারের মতোই আজ প্লাস্টিক আমাদের মানব সভ্যতাকেই হুমকির ভেতর ফেলছে। এর জন্য দায়ী মানুষ। আমরা এর সঠিক ব্যবহার করতে পারছি না। আমাদের মতো দেশে জনগণ যেখানে সচেতন নয়, পরিবেশ নিয়ে কম মানুষেরই মাথাব্যথা রয়েছে সেখানে প্লাস্টিক হুমকি হবেই। যেখানে সেখানে ব্যবহার্য জিনিস ছুড়ে ফেলার প্রবণতা এ সংকটকে ঘণীভূত করছে। প্লাস্টিকের বিরূপ প্রভাব থেকে পরিবেশকে মুক্ত করার জন্য আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। যদিও তা সহজসাধ্য নয়। কারণ এখন যে বিপুল ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের ব্যবহার করা হচ্ছে তা হুটহাট শেষ করা যায় না। বিকল্প কোন উপায় ভাবতে হবে। যাতে প্লাস্টিকের ব্যবহার একটু একটু করে কমিয়ে আনা যায়। একটা সময় তো প্লাস্টিকের এত বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার ছিল না। তখন পরিবেশের দূষণও ছিল কম। এর ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হুমকি বাড়ছে। বিশেষ করে সাগরের তলদেশ এসব প্লাস্টিকজাত সামগ্রীতে পূর্ণ হচ্ছে। যা সমগ্র জীববৈচিত্র্যের জন্যই হুমকিস্বরূপ। সর্বশেষে মালয়েশিয়ার একটি তথ্য উল্লেখ্য করছি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, ১৫০ কনটেইনার প্লাস্টিক বর্জ্য মালয়েশিয়া ফেরত পাঠিয়েছে। তারা ১৫০টি কনটেইনারে করে ৩ হাজার ৭৩৭ টন প্লাস্টিক বর্জ্য ১৩টি দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। গত বছরের জুলাই থেকে এ পর্যন্ত এই পরিমাণ বর্জ্য ফেরত দেয়া হয়েছে। চলতি বছরের মাঝামাঝিতে আরও ১১০টি কনটেইনার বর্জ্য ফেরত পাঠানো হবে। প্রশ্ন হলো আমরা কবে এই আপাত সমস্যা সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের কবল থেকে মুক্ত হতে পারব। কীভাবে এ প্রশ্নবিদ্ধ জনপ্রিয় পণ্যটি ব্যবহার একেবারে প্রান্তিক পর্যায় থেকে বন্ধ করা যাবে? কারণ প্রশ্ন তো আমাদের নিজেদের সচেতনতা।

[লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট]

sopnil.roy@gmail.com