টাঙ্গাইলে বুড়িগঙ্গা নদী

পুনরুদ্ধার প্রকল্পে খননের নামে কোটি কোটি টাকা পানিতে

নিষিদ্ধ বাংলা ড্রেজার ব্যবহার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু কর্মকর্তার মদদ রয়েছে

বার বার মেয়াদ বৃদ্ধি করে দীর্ঘ ১০ বছরে বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার (নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম) প্রকল্পের কাজ হয়েছে খুব সামান্যই। এভাবে নদী খননের নামে সরকারের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেড। এই প্রকল্পে গত তিন বছর আগে ৯০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হলেও এই নদী খননের চিহ্ন নেই। পরে চলতি বছরে কালিহাতী অংশে নতুন করে ৫৪ কোটি ২৪ লাখ টাকার কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু এশিয়ান ড্রেজার একটিমাত্র সাকশন ড্রেজার ব্যবহার করছে। পাশাপাশি শতাধিক নিষিদ্ধ বাংলা ড্রেজার দিয়ে নদী খনন শুরু করেছে। তারা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে ১৪.৫ কিলোমিটার নদী খননের কাজ পেলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজসে সাব ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে অবাধে শতাধিক লোকাল ড্রেজার বসিয়ে বালু ও মাটি উত্তোলন করে বিক্রি করে চলেছে। এ কারণে স্থানীয়দের মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলেছে এশিয়ান ড্রেজার লিমিটেড ছাড়া কেউ এই খনন কাজ করতে পারবে না।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, নদী খনন করে পানি প্রবাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করা, বুড়িগঙ্গা-তুরাগ রুটে সারা বছর নৌ-চলাচলের উপযোগী করাসহ সেচ ও মৎস্য উন্নয়নের জন্য নেয়া প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ। ৯৪৪ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে বিগত ২০১০ সালে প্রকল্পটি নেয়ার পর তিন দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সাল পর্যন্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত ডিজাইন বদলাতে হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বৃদ্ধি করা হচ্ছে। তবে ৩ বছরের এই প্রকল্প বাস্তবায়নে লাগতে পারে ১১ বছর। এছাড়া আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত ২০১০ সালের এপ্রিলে নেয়া প্রকল্পটি বিগত ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু দু’দফায় ব্যয় না বাড়িয়ে মেয়াদ বাড়ানো হয়। এতেও কাজ না হওয়ায় সর্বশেষ উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধনের সময় ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ ঠিক করা হয়। এক্ষেত্রে মূল ডিপিপির তুলনায় ৬ বছর ৬ মাস বা ১৭৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ সময় বেশি লাগছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরাও ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলছেন। নতুন করে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১২৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।

সরেজমিন নদী খনন এলাকা কালিহাতী উপজেলার বেলুটিয়া গ্রামে নারায়ণগঞ্জ থেকে দুইটি ড্রেজিং মেশিন আনা হয়েছে খননের জন্য। ড্রেজিংয়ে নিয়োজিত আরিফুল ইসলাম জানান, দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে তিনিসহ ড্রেজিংয়ের কাজে নিয়োজিত ২০ জন রয়েছেন। এখানে স্থানীয় এলাকাবাসীর কারণে তারা আড়াই বছরের খননকাজ শুরু করতে পারেনি। খনন করতে গেলেই স্থানীয় এলাকাবাসীর বাধার মুখে পড়তে হয়। তাই বাধ্য হয়েই তারা খননকাজ বন্ধ রেখেছে। আবদুস সাত্তার খান জানান, গত তিন বছর বেলুটিয়া এলাকায় পানি প্রবাহের মূল উৎসমুখ খনন করা হয়। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে ভরাট হয়ে তা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। এ কারণে এ কাজে নিয়োজিতরা আবার অন্য জায়গায় খনন করতে শুরু করে। এতে করে এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে তা বন্ধ করে দেয়। তাদের দাবি জমি অধিগ্রহণের টাকা না পাওয়া পর্যন্ত এ এলাকায় নদী খনন করতে দেয়া হবে না। মোজাম ম-ল জানান, তার জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে ৫২ হাজার টাকা মূল্যে। তার ৬০ খতিয়ানের ২১৬ দাগের ও ২৭ দাগের ৮০ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি কোন জমির মূল্য পাননি। এ নিয়ে কয়েকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে কোন লাভ হয়নি। একই অভিযোগ দেলোয়ার হোসেনের। তিনি জানান, ২২৩ খতিয়ানের ৬৭০ দাগের ১১৯ শতাংশ জমি ৮৫ হাজার টাকা মূল্যে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তিনি শুনেছেন তার অধিগ্রহণের টাকা সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে এসেছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারেন লাখে ১০ হাজার টাকা দিলে তাকে জমি অধিগ্রহণের চেক দেয়া হবে। পরে তিনি চেক না নিয়ে ফিরে আসেন। এক অভিযোগ আবদুল আওয়াল প্রামানিকের। তিনি জানান, ৪২ খতিয়ানের ১০৮ শতাংশ জমি ৬০ হাজার টাকা দরে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তার কাছে লাখে সাত হাজার টাকা দাবি করেন সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, নদী খননের কাজ টাঙ্গাইল অংশে দুইটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে। এরমধ্যে মির্জাপুর অংশে বংগজ ড্রেজিং লিমিটেড এবং কালিহাতী অংশে এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেড। তবে নীতিমালায় উল্লেখ্য আছে নদী খননের কাজে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিজেরাই নদী খনন করবেন এবং এতে কোন প্রকার সাব ঠিকাদার বা নিষিদ্ধ লোকাল ড্রেজার ব্যবহার করা যাবে না। প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম ছিল ভূমি অধিগ্রহণ, গাইড বাধ নির্মাণ, কায়িক পরিশ্রম ও ড্রেজারের মাধ্যমে নদী খনন, সেডিমেন্ট বেসিন নির্মাণ ও সংরক্ষণ কাজ, ব্রিজের ফাউন্ডেশন ট্রিটমেন্ট এবং পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করা। এদিকে উপজেলার জোকারচর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেড একটিমাত্র ড্রেজার মেশিন দিয়ে নদী খনন করছে। এ সময় ড্রেজিংয়ের কাজে নিয়োজিত নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জানান, টাঙ্গাইলের কালিহাতী অংশে নদী খননের কাজ পেয়েছে এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেড। কিন্তু তারা ‘মা’ এন্টারপ্রাইজকে নদী খননের জন্য সাব ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছে। এতে করে সাব ঠিকাদাররা নদী খননের নামে শতাধিক লোকাল ড্রেজার বসিয়ে বালু ও মাটি উত্তোলন করে চলেছে। আর এসব উত্তোলনকৃত বালু ও মাটি বিক্রি করে চলেছেন। আবার ‘মা’ এন্টারপ্রাইজ সাব কন্ট্রাক নিয়ে তারা আবার এলাকার বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছ থেকে ২৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে নদী খননের কাজ দিয়েছে। এরমধ্যে উপজেলার বল্লববাড়ির বাছেদ ২৫০ মিটার, সরাতৈল গ্রামের জহরুল ইসলাম ৫০০ মিটার, চানমিয়া ও গুলজার ২৫০ মিটার, কুর্শাবেনু গ্রামের রফিক খান ৫০০ মিটারে লোকাল ড্রেজার বসিয়ে নদী খনন করছেন। এরপর চার কিলোমিটার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আবার আনিস মিয়া ২০০ মিটার, নুরুল ইসলাম ৩০০ মিটার, পটল গ্রামের সোহেল মিয়া ৫০০ মিটার, এরপর ৫০০ মিটার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরপর ইউপি সদস্য সুলতান ৫০০ মিটার, পরের ৫০০ মিটার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরপর থেকে মশিউর ৫০০ মিটার, ইউপি চেয়ারম্যান আলিম ৫০০ মিটার, ইউপি সদস্য সোনা মিয়া ২৫০ মিটার, রাসেল ভূঁইয়া ৫০০ মিটার, এলেঙ্গা পৌর এলাকার লাভু মিয়া ৫০০ মিটার, বাশি গ্রামের জলিল মিয়া ৩০০ মিটার নদী খননের কাজ পেয়েছেন। নদী খননের কাজ পেয়েই তারা দীর্ঘদিন ধরে নদীতে নিষিদ্ধ লোকাল ড্রেজার বসিয়ে বালু ও মাটি উত্তোলন করে প্রতিদিন শতশত ট্রাক মাটি ও বালু বিক্রি করছেন।

এদিকে এভাবে নদী খননের নামে লোকাল ড্রেজার বসিয়ে বালু ও মাটি উত্তোলনের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে পুরো এলাকা। স্থানীয়দের অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব প্রকল্পটি (নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম) এভাবে নিয়ম বহির্ভূতভাবে নদী খনন করলে নদীর পারের মানুষ আরও হুমকির মুখে পড়বে। আর এ কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন যেখানে বালু দেখে সেখানেই নদী খনন শুরু করে। জোকারচর গ্রামের শেখ আবুল হাশেম জানান, এখানে নদী খনন হচ্ছে না-তো সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় করছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। যেভাবে লোকাল ড্রেজার দিয়ে নদী খনন করা হচ্ছে এটা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সব জেনেও না জানার ভান করেন। আমরা কিছু বললেই স্থানীয় সরকার দলীয় ক্যাডারবাহিনী দিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হয়। এ কারণে স্থানীয় লোকজন কিছু বলতে সাহস পায় না।

কালিহাতী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরিয়ার রহমান জানান, প্রকল্পটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের। এ কারণে এসব কিছু তদারকির দায়িত্বও তাদের। আর লোকাল ড্রেজারের বিষয় নিয়ে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করলে তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম জানান, খনন কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেড কোনভাবেই সাব ঠিকাদার দিয়ে নদী খনন করতে পারবে না। তারা যদি সাব ঠিকাদার দিয়ে নদী খননকাজ করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে লোকাল ড্রেজার বসিয়ে নদী খননের বিষয়টি জানেন না তিনি। মির্জাপুর অংশে ২১ কোটি ৯১ লাখ টাকা এবং কালিহাতী অংশে এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেড কাজ করছে ৫৪ কোটি ২৪ লাখ টাকার। এর আগে ১৪টি প্যাকেজের কাজে ৯০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

সাব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মা’ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সুজন খান জানান, এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেডের একজন প্রতিনিধি বাসাইল উপজেলার বাদল মিয়ার সঙ্গে তার ব্যবসায়ীক একটি সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণে বাদল মিয়া তাকে জানিয়েছেন আপনার প্রতিষ্ঠান ‘মা’ এন্টারপ্রাইজকে সাব ঠিকাদার দিয়ে নদী খননে সহযোগিতা করতে হবে। তবে এ খননকাজে সাব ঠিকাদার দেয়া যাবে কি না এ বিষয়ে তার জানা নেই।

এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম রেজার ব্যবহৃত মুঠোফোনে (০১৭১১৫৪০৩০৬) বারবার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি।

image

টাঙ্গাইল : বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পে নদী খননের কাজ চলছে -সংবাদ

আরও খবর
বিদেশিদের বেতন-ভাতার নামে পাচার ২৬ হাজার কোটি টাকা
বাংলাদেশকে আর কেউ পেছনে টেনে নিতে পারবে না : প্রধানমন্ত্রী
রোমে বাংলাদেশ চ্যান্সেরি ভবন উদ্বোধন
সিটি নির্বাচনের সব তথ্য প্রকাশের দাবি তাবিথ-ইশরাকের
ফিলিপাইনের আপত্তিতে ঝুলে আছে মামলার অগ্রগতি
রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির অবস্থান তলানিতে
একুশে পদক পাচ্ছেন ২০ জন
নব্য জেএমবির নারী শাখার প্রধান গ্রেফতার
সীমান্তে নিহত ১১ বাংলাদেশি
পদ্মা সেতুর কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে
শিশু বাবা-মাসহ সামরিক হাসপাতালে ভর্তি
ক্ষণগণনা : আর ৩৯ দিন
আ-মরি বাংলা ভাষা

বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ২৩ মাঘ ১৪২৬, ১১ জমাদিউল সানি ১৪৪১

টাঙ্গাইলে বুড়িগঙ্গা নদী

পুনরুদ্ধার প্রকল্পে খননের নামে কোটি কোটি টাকা পানিতে

নিষিদ্ধ বাংলা ড্রেজার ব্যবহার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু কর্মকর্তার মদদ রয়েছে

জেলা বার্তা পরিবেশক, টাঙ্গাইল

image

টাঙ্গাইল : বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পে নদী খননের কাজ চলছে -সংবাদ

বার বার মেয়াদ বৃদ্ধি করে দীর্ঘ ১০ বছরে বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার (নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম) প্রকল্পের কাজ হয়েছে খুব সামান্যই। এভাবে নদী খননের নামে সরকারের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেড। এই প্রকল্পে গত তিন বছর আগে ৯০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হলেও এই নদী খননের চিহ্ন নেই। পরে চলতি বছরে কালিহাতী অংশে নতুন করে ৫৪ কোটি ২৪ লাখ টাকার কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু এশিয়ান ড্রেজার একটিমাত্র সাকশন ড্রেজার ব্যবহার করছে। পাশাপাশি শতাধিক নিষিদ্ধ বাংলা ড্রেজার দিয়ে নদী খনন শুরু করেছে। তারা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে ১৪.৫ কিলোমিটার নদী খননের কাজ পেলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজসে সাব ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে অবাধে শতাধিক লোকাল ড্রেজার বসিয়ে বালু ও মাটি উত্তোলন করে বিক্রি করে চলেছে। এ কারণে স্থানীয়দের মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলেছে এশিয়ান ড্রেজার লিমিটেড ছাড়া কেউ এই খনন কাজ করতে পারবে না।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, নদী খনন করে পানি প্রবাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করা, বুড়িগঙ্গা-তুরাগ রুটে সারা বছর নৌ-চলাচলের উপযোগী করাসহ সেচ ও মৎস্য উন্নয়নের জন্য নেয়া প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ। ৯৪৪ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে বিগত ২০১০ সালে প্রকল্পটি নেয়ার পর তিন দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সাল পর্যন্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত ডিজাইন বদলাতে হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বৃদ্ধি করা হচ্ছে। তবে ৩ বছরের এই প্রকল্প বাস্তবায়নে লাগতে পারে ১১ বছর। এছাড়া আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত ২০১০ সালের এপ্রিলে নেয়া প্রকল্পটি বিগত ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু দু’দফায় ব্যয় না বাড়িয়ে মেয়াদ বাড়ানো হয়। এতেও কাজ না হওয়ায় সর্বশেষ উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধনের সময় ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ ঠিক করা হয়। এক্ষেত্রে মূল ডিপিপির তুলনায় ৬ বছর ৬ মাস বা ১৭৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ সময় বেশি লাগছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরাও ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলছেন। নতুন করে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১২৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।

সরেজমিন নদী খনন এলাকা কালিহাতী উপজেলার বেলুটিয়া গ্রামে নারায়ণগঞ্জ থেকে দুইটি ড্রেজিং মেশিন আনা হয়েছে খননের জন্য। ড্রেজিংয়ে নিয়োজিত আরিফুল ইসলাম জানান, দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে তিনিসহ ড্রেজিংয়ের কাজে নিয়োজিত ২০ জন রয়েছেন। এখানে স্থানীয় এলাকাবাসীর কারণে তারা আড়াই বছরের খননকাজ শুরু করতে পারেনি। খনন করতে গেলেই স্থানীয় এলাকাবাসীর বাধার মুখে পড়তে হয়। তাই বাধ্য হয়েই তারা খননকাজ বন্ধ রেখেছে। আবদুস সাত্তার খান জানান, গত তিন বছর বেলুটিয়া এলাকায় পানি প্রবাহের মূল উৎসমুখ খনন করা হয়। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে ভরাট হয়ে তা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। এ কারণে এ কাজে নিয়োজিতরা আবার অন্য জায়গায় খনন করতে শুরু করে। এতে করে এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে তা বন্ধ করে দেয়। তাদের দাবি জমি অধিগ্রহণের টাকা না পাওয়া পর্যন্ত এ এলাকায় নদী খনন করতে দেয়া হবে না। মোজাম ম-ল জানান, তার জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে ৫২ হাজার টাকা মূল্যে। তার ৬০ খতিয়ানের ২১৬ দাগের ও ২৭ দাগের ৮০ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি কোন জমির মূল্য পাননি। এ নিয়ে কয়েকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে কোন লাভ হয়নি। একই অভিযোগ দেলোয়ার হোসেনের। তিনি জানান, ২২৩ খতিয়ানের ৬৭০ দাগের ১১৯ শতাংশ জমি ৮৫ হাজার টাকা মূল্যে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তিনি শুনেছেন তার অধিগ্রহণের টাকা সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে এসেছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারেন লাখে ১০ হাজার টাকা দিলে তাকে জমি অধিগ্রহণের চেক দেয়া হবে। পরে তিনি চেক না নিয়ে ফিরে আসেন। এক অভিযোগ আবদুল আওয়াল প্রামানিকের। তিনি জানান, ৪২ খতিয়ানের ১০৮ শতাংশ জমি ৬০ হাজার টাকা দরে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তার কাছে লাখে সাত হাজার টাকা দাবি করেন সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, নদী খননের কাজ টাঙ্গাইল অংশে দুইটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে। এরমধ্যে মির্জাপুর অংশে বংগজ ড্রেজিং লিমিটেড এবং কালিহাতী অংশে এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেড। তবে নীতিমালায় উল্লেখ্য আছে নদী খননের কাজে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিজেরাই নদী খনন করবেন এবং এতে কোন প্রকার সাব ঠিকাদার বা নিষিদ্ধ লোকাল ড্রেজার ব্যবহার করা যাবে না। প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম ছিল ভূমি অধিগ্রহণ, গাইড বাধ নির্মাণ, কায়িক পরিশ্রম ও ড্রেজারের মাধ্যমে নদী খনন, সেডিমেন্ট বেসিন নির্মাণ ও সংরক্ষণ কাজ, ব্রিজের ফাউন্ডেশন ট্রিটমেন্ট এবং পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করা। এদিকে উপজেলার জোকারচর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেড একটিমাত্র ড্রেজার মেশিন দিয়ে নদী খনন করছে। এ সময় ড্রেজিংয়ের কাজে নিয়োজিত নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জানান, টাঙ্গাইলের কালিহাতী অংশে নদী খননের কাজ পেয়েছে এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেড। কিন্তু তারা ‘মা’ এন্টারপ্রাইজকে নদী খননের জন্য সাব ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছে। এতে করে সাব ঠিকাদাররা নদী খননের নামে শতাধিক লোকাল ড্রেজার বসিয়ে বালু ও মাটি উত্তোলন করে চলেছে। আর এসব উত্তোলনকৃত বালু ও মাটি বিক্রি করে চলেছেন। আবার ‘মা’ এন্টারপ্রাইজ সাব কন্ট্রাক নিয়ে তারা আবার এলাকার বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছ থেকে ২৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে নদী খননের কাজ দিয়েছে। এরমধ্যে উপজেলার বল্লববাড়ির বাছেদ ২৫০ মিটার, সরাতৈল গ্রামের জহরুল ইসলাম ৫০০ মিটার, চানমিয়া ও গুলজার ২৫০ মিটার, কুর্শাবেনু গ্রামের রফিক খান ৫০০ মিটারে লোকাল ড্রেজার বসিয়ে নদী খনন করছেন। এরপর চার কিলোমিটার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আবার আনিস মিয়া ২০০ মিটার, নুরুল ইসলাম ৩০০ মিটার, পটল গ্রামের সোহেল মিয়া ৫০০ মিটার, এরপর ৫০০ মিটার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরপর ইউপি সদস্য সুলতান ৫০০ মিটার, পরের ৫০০ মিটার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরপর থেকে মশিউর ৫০০ মিটার, ইউপি চেয়ারম্যান আলিম ৫০০ মিটার, ইউপি সদস্য সোনা মিয়া ২৫০ মিটার, রাসেল ভূঁইয়া ৫০০ মিটার, এলেঙ্গা পৌর এলাকার লাভু মিয়া ৫০০ মিটার, বাশি গ্রামের জলিল মিয়া ৩০০ মিটার নদী খননের কাজ পেয়েছেন। নদী খননের কাজ পেয়েই তারা দীর্ঘদিন ধরে নদীতে নিষিদ্ধ লোকাল ড্রেজার বসিয়ে বালু ও মাটি উত্তোলন করে প্রতিদিন শতশত ট্রাক মাটি ও বালু বিক্রি করছেন।

এদিকে এভাবে নদী খননের নামে লোকাল ড্রেজার বসিয়ে বালু ও মাটি উত্তোলনের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে পুরো এলাকা। স্থানীয়দের অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব প্রকল্পটি (নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম) এভাবে নিয়ম বহির্ভূতভাবে নদী খনন করলে নদীর পারের মানুষ আরও হুমকির মুখে পড়বে। আর এ কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন যেখানে বালু দেখে সেখানেই নদী খনন শুরু করে। জোকারচর গ্রামের শেখ আবুল হাশেম জানান, এখানে নদী খনন হচ্ছে না-তো সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় করছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। যেভাবে লোকাল ড্রেজার দিয়ে নদী খনন করা হচ্ছে এটা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সব জেনেও না জানার ভান করেন। আমরা কিছু বললেই স্থানীয় সরকার দলীয় ক্যাডারবাহিনী দিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হয়। এ কারণে স্থানীয় লোকজন কিছু বলতে সাহস পায় না।

কালিহাতী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরিয়ার রহমান জানান, প্রকল্পটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের। এ কারণে এসব কিছু তদারকির দায়িত্বও তাদের। আর লোকাল ড্রেজারের বিষয় নিয়ে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করলে তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম জানান, খনন কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেড কোনভাবেই সাব ঠিকাদার দিয়ে নদী খনন করতে পারবে না। তারা যদি সাব ঠিকাদার দিয়ে নদী খননকাজ করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে লোকাল ড্রেজার বসিয়ে নদী খননের বিষয়টি জানেন না তিনি। মির্জাপুর অংশে ২১ কোটি ৯১ লাখ টাকা এবং কালিহাতী অংশে এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেড কাজ করছে ৫৪ কোটি ২৪ লাখ টাকার। এর আগে ১৪টি প্যাকেজের কাজে ৯০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

সাব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মা’ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সুজন খান জানান, এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেডের একজন প্রতিনিধি বাসাইল উপজেলার বাদল মিয়ার সঙ্গে তার ব্যবসায়ীক একটি সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণে বাদল মিয়া তাকে জানিয়েছেন আপনার প্রতিষ্ঠান ‘মা’ এন্টারপ্রাইজকে সাব ঠিকাদার দিয়ে নদী খননে সহযোগিতা করতে হবে। তবে এ খননকাজে সাব ঠিকাদার দেয়া যাবে কি না এ বিষয়ে তার জানা নেই।

এশিয়ান ড্রেজিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম রেজার ব্যবহৃত মুঠোফোনে (০১৭১১৫৪০৩০৬) বারবার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি।