চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ৫টি ২০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন ১৮ কোটি টাকা মূল্যের মোবাইল ক্রেন সরবারাহের কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। তবে দরপত্রে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে পাইয়ে দিতে ‘অবাস্তব’ শর্ত আরোপের অভিযোগ উঠেছে। অভিজ্ঞতা ও কারিগরি ক্ষেত্রে ওই সব শর্তকে ‘অবাস্তব’ উল্লেখ করেছে প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব শর্তের কারণে এটি মোনপলি হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। গচ্ছা যেতে পারে কোটি কোটি টাকা।
বাংলাদেশি মালিকানাধীন সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ওয়েল পাউয়ার সার্ভিস লিমিটেডের একক আবেদনের প্রেক্ষিতে গত বছরের ২৬ নভেম্বর আহ্বানকৃত দরপত্র জমা দেয়ার নির্ধারিত তারিখ ছিল গত ২২ জানুয়ারি। এর ঠিক দুই দিন আগে দুইটি বড় ধরনের শর্তের পরিবর্তন করে প্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) এর স্বাক্ষরে সংশোধনী জারী করা হয়। যাতে শুধু মাত্র সেনিবেগন (জার্মানি) নামক একটি প্রস্তুতকারক ছাড়া অন্য সব ক্রেন প্রস্তুতকারক দরপত্র দাখিলে অযোগ্য হয়ে পড়ে। দরপত্র দাখিলের নতুন তারিখ ঘোষণা করে আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি। কোন দলিল ক্রেতার অনুরোধের প্রেক্ষিতে কারিগরি শর্তের বড় ধরনের পরিবর্তন অন্য সব দরপত্র দলিল ক্রেতাদের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে প্রিবিড কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা ব্যাহত না করে সংশোধন করার বিধান থাকলেও এ ক্ষেত্রে তা অনুসরন করা হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি প্রতিষ্ঠানকে সামনে রেখে আরোপিত শর্তের মধ্যে আছে ইঞ্জিনের মেরামত সহজ করার জন্য কেনি টিল্টিং টাইপ (কেবিন কাত করে উপরের দিকে উঠানো যায়) অবশ্যই থাকতে হবে। ওই সংশোধনী জারির পরপরই কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আপত্তি জানিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দাখিল করেন। তারা অভিযোগে উল্লেখ করেন, ক্রেন প্রস্তুতকারকদের মধ্যে সেনিবেগন নামক একজন প্রস্তুতকারক তাদের কেবিনের ঠিক নিচে ইঞ্জিন স্থাপন করে বিধায় ইঞ্জিন মেরামত করার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে টিল্টিং কেবিন ব্যবহার করে। কিন্তু একই ধরনের অন্য সব ক্রেন প্রস্তুতকারক তাদের ইঞ্জিন কেবিন থেকে ১০/১৫ ফুট দুরে পিছনের দিকে বডির উপরে খোলা জায়গায় স্থাপিত বিধায় ইঞ্জিন মেরামতের সুবিধার্থে কেবিন টিল্টিং এর প্রয়োজন নাই ফলে তাদের ক্ষেত্রে এই শর্ত প্রযোজ্য নয়।
প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর আবেদনের প্রেক্ষিতে দরপত্র জমা দেয়ার তারিখ আসন্ন হলেও বিষয়টি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট না করায় আরোপিত শর্তের কারণে বিশ্ববিখ্যাত ক্রেন প্রস্তুত কারক যথা টাডানো (জাপান), গ্রোভ মেনিটোক (ইউএসএ), টেরেক্স (সুইজারল্যান্ড), কেটো (জাপান), লোকাটলি (ইতালি), এর মতো বিশ্ববিখ্যাত ক্রেন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্র দাখিলে অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এমনকি যে সব প্রস্তুতকারকের একই ধরনের ক্রেন চট্টগ্রাম বন্দরসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সফলতার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে। সম্প্রতি আরোপিত শর্তের কারণে তারা সবাই ওই দরপত্র থেকে ছিটকে পড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানায়, টিল্টিং কেবিনের নিচে স্থাপিত ইঞ্জিনে একদিকে যেমন মেরামত ও সংরক্ষণের জন্য প্রবেশ সহজসাধ্য নয়, অপরদিকে ঝুঁকিবহুল। প্রায় এক বছর আগে চট্টগ্রাম বন্দরে একটি ইকুইপমেন্টের এ ধরনের টিল্টিং কেবিনের নিচে স্থাপিত ইঞ্জিনে কাজ করতে গিয়ে কেবিনের নিছে চাপা পড়ে একজন কারিগরের মৃত্যু হয়েছে।
অপর শর্তটি একই প্রতিষ্ঠানকে সামনে রেখে দরপত্র দাতার অভিজ্ঞতার পরিবর্তন করা হয়েছে। দরপত্র দলিলে শর্ত ছিল, ওই সরবরাহ কাজের জন্য দরপত্র দাতার কন্টেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি সরবরাহের কমপক্ষে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। বাংলাদেশি মালিকানাধীন সিঙ্গাপুরের ওই প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতার বয়স ৫ বছর না হওয়ায় এবং তাদের কন্টেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং এর ইকুইপমেন্ট সরবরাহের অভিজ্ঞতায় ঘাটতি থাকায় তাদের অনুরোধে দরপত্র দাতার অভিজ্ঞতার মানদণ্ডের অবনতি করে ৫ বছরের স্থলে ৩ বছর করা হয় এবং ইকুইপমেন্ট সরবরাহের অভিজ্ঞতা না থাকলে ওয়ার্ক/সার্ভিসের অভিজ্ঞতা থাকলে ওই ক্রেন সরবরাহের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন্দর সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কোন দরপত্রে একজন দরপত্র দাতাকে সামনে রেখে দরপত্র দাতার অভিজ্ঞতার মানদণ্ডের অবনতি এই প্রথম এবং বন্দরের ক্রয় কাজের ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত। ওই প্রতিষ্ঠানটির মালিকের বিভিন্ন নামে বাংলাদেশেও তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেগুলুর মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার করে বন্দরে এককভাবে কাজ নেয়ার অভিযোগ অনেক দিনের।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানায়, উম্মুক্ত দরপত্রে এই প্রতিষ্ঠানের অবাস্তব শর্ত অনুযায়ী এককভাবে ওই ক্রেনসমূহ সরবরাহে সফল হলে ইতিমধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষের জন্য সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ১০৪টি ইকুইপমেন্ট ক্রয়ের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করে ওই প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রতিযোগিতাবিহীন এককভাবে সব ইকুইপমেন্ট সরবরাহের পথ সুগম হবে বলে তাদের ধারণা। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জুলফিকার আজিজের দৃষ্টি আকর্ষণে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
রবিবার, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ২৬ মাঘ ১৪২৬, ১৪ জমাদিউল সানি ১৪৪১
নিরুপম দাশগুপ্ত, চট্টগ্রাম ব্যুরো
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ৫টি ২০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন ১৮ কোটি টাকা মূল্যের মোবাইল ক্রেন সরবারাহের কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। তবে দরপত্রে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে পাইয়ে দিতে ‘অবাস্তব’ শর্ত আরোপের অভিযোগ উঠেছে। অভিজ্ঞতা ও কারিগরি ক্ষেত্রে ওই সব শর্তকে ‘অবাস্তব’ উল্লেখ করেছে প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব শর্তের কারণে এটি মোনপলি হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। গচ্ছা যেতে পারে কোটি কোটি টাকা।
বাংলাদেশি মালিকানাধীন সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ওয়েল পাউয়ার সার্ভিস লিমিটেডের একক আবেদনের প্রেক্ষিতে গত বছরের ২৬ নভেম্বর আহ্বানকৃত দরপত্র জমা দেয়ার নির্ধারিত তারিখ ছিল গত ২২ জানুয়ারি। এর ঠিক দুই দিন আগে দুইটি বড় ধরনের শর্তের পরিবর্তন করে প্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) এর স্বাক্ষরে সংশোধনী জারী করা হয়। যাতে শুধু মাত্র সেনিবেগন (জার্মানি) নামক একটি প্রস্তুতকারক ছাড়া অন্য সব ক্রেন প্রস্তুতকারক দরপত্র দাখিলে অযোগ্য হয়ে পড়ে। দরপত্র দাখিলের নতুন তারিখ ঘোষণা করে আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি। কোন দলিল ক্রেতার অনুরোধের প্রেক্ষিতে কারিগরি শর্তের বড় ধরনের পরিবর্তন অন্য সব দরপত্র দলিল ক্রেতাদের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে প্রিবিড কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা ব্যাহত না করে সংশোধন করার বিধান থাকলেও এ ক্ষেত্রে তা অনুসরন করা হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি প্রতিষ্ঠানকে সামনে রেখে আরোপিত শর্তের মধ্যে আছে ইঞ্জিনের মেরামত সহজ করার জন্য কেনি টিল্টিং টাইপ (কেবিন কাত করে উপরের দিকে উঠানো যায়) অবশ্যই থাকতে হবে। ওই সংশোধনী জারির পরপরই কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আপত্তি জানিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দাখিল করেন। তারা অভিযোগে উল্লেখ করেন, ক্রেন প্রস্তুতকারকদের মধ্যে সেনিবেগন নামক একজন প্রস্তুতকারক তাদের কেবিনের ঠিক নিচে ইঞ্জিন স্থাপন করে বিধায় ইঞ্জিন মেরামত করার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে টিল্টিং কেবিন ব্যবহার করে। কিন্তু একই ধরনের অন্য সব ক্রেন প্রস্তুতকারক তাদের ইঞ্জিন কেবিন থেকে ১০/১৫ ফুট দুরে পিছনের দিকে বডির উপরে খোলা জায়গায় স্থাপিত বিধায় ইঞ্জিন মেরামতের সুবিধার্থে কেবিন টিল্টিং এর প্রয়োজন নাই ফলে তাদের ক্ষেত্রে এই শর্ত প্রযোজ্য নয়।
প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর আবেদনের প্রেক্ষিতে দরপত্র জমা দেয়ার তারিখ আসন্ন হলেও বিষয়টি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট না করায় আরোপিত শর্তের কারণে বিশ্ববিখ্যাত ক্রেন প্রস্তুত কারক যথা টাডানো (জাপান), গ্রোভ মেনিটোক (ইউএসএ), টেরেক্স (সুইজারল্যান্ড), কেটো (জাপান), লোকাটলি (ইতালি), এর মতো বিশ্ববিখ্যাত ক্রেন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্র দাখিলে অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এমনকি যে সব প্রস্তুতকারকের একই ধরনের ক্রেন চট্টগ্রাম বন্দরসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সফলতার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে। সম্প্রতি আরোপিত শর্তের কারণে তারা সবাই ওই দরপত্র থেকে ছিটকে পড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানায়, টিল্টিং কেবিনের নিচে স্থাপিত ইঞ্জিনে একদিকে যেমন মেরামত ও সংরক্ষণের জন্য প্রবেশ সহজসাধ্য নয়, অপরদিকে ঝুঁকিবহুল। প্রায় এক বছর আগে চট্টগ্রাম বন্দরে একটি ইকুইপমেন্টের এ ধরনের টিল্টিং কেবিনের নিচে স্থাপিত ইঞ্জিনে কাজ করতে গিয়ে কেবিনের নিছে চাপা পড়ে একজন কারিগরের মৃত্যু হয়েছে।
অপর শর্তটি একই প্রতিষ্ঠানকে সামনে রেখে দরপত্র দাতার অভিজ্ঞতার পরিবর্তন করা হয়েছে। দরপত্র দলিলে শর্ত ছিল, ওই সরবরাহ কাজের জন্য দরপত্র দাতার কন্টেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি সরবরাহের কমপক্ষে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। বাংলাদেশি মালিকানাধীন সিঙ্গাপুরের ওই প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতার বয়স ৫ বছর না হওয়ায় এবং তাদের কন্টেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং এর ইকুইপমেন্ট সরবরাহের অভিজ্ঞতায় ঘাটতি থাকায় তাদের অনুরোধে দরপত্র দাতার অভিজ্ঞতার মানদণ্ডের অবনতি করে ৫ বছরের স্থলে ৩ বছর করা হয় এবং ইকুইপমেন্ট সরবরাহের অভিজ্ঞতা না থাকলে ওয়ার্ক/সার্ভিসের অভিজ্ঞতা থাকলে ওই ক্রেন সরবরাহের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন্দর সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কোন দরপত্রে একজন দরপত্র দাতাকে সামনে রেখে দরপত্র দাতার অভিজ্ঞতার মানদণ্ডের অবনতি এই প্রথম এবং বন্দরের ক্রয় কাজের ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত। ওই প্রতিষ্ঠানটির মালিকের বিভিন্ন নামে বাংলাদেশেও তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেগুলুর মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার করে বন্দরে এককভাবে কাজ নেয়ার অভিযোগ অনেক দিনের।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানায়, উম্মুক্ত দরপত্রে এই প্রতিষ্ঠানের অবাস্তব শর্ত অনুযায়ী এককভাবে ওই ক্রেনসমূহ সরবরাহে সফল হলে ইতিমধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষের জন্য সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ১০৪টি ইকুইপমেন্ট ক্রয়ের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করে ওই প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রতিযোগিতাবিহীন এককভাবে সব ইকুইপমেন্ট সরবরাহের পথ সুগম হবে বলে তাদের ধারণা। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জুলফিকার আজিজের দৃষ্টি আকর্ষণে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।