আমি ভোট দিয়েছি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচন। এ নির্বাচনে ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহৃত হয়েছে। বহু বছর ধরে এই মেশিনটি নির্বাচনে ব্যবহারের তোড়জোড় চলছে, কিন্তু বিরোধী দলের কাছে মেশিনের বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষে ব্যাপকভাবে তা ব্যবহার করা এতদিন সম্ভব হয়নি। অপব্যবহার না করলে মেশিন কিন্তু কখনও মানুষের মতো বিশ্বাসঘাতকতা করে না। পৃথিবীর মধ্যে এখন যে গতির সৃষ্টি হয়েছে তার সঙ্গে সঙ্গতি না রাখলে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে যাব। ইভিএম দ্রুতগতিতে নির্ভুলভাবে ভোট গ্রহণ এবং হিসাব-নিকাশ করতে পারে; ইভিএমের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, মানুষের দেয়া সূত্রের বাইরে গিয়ে ইভিএম কিছু করতে পারে না। ইভিএমের কার্যক্রম মানুষ দ্বারা নির্ধারিত ফর্মূলায় কাজ করে। ইভিএমকে যে ফর্মূলায় কাজ করতে সৃষ্টি করা হয়েছে সে ফর্মুলার বাইরে গিয়ে কাজ করতে হলে এ সিস্টেমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনের সহায়তা প্রয়োজন। তাই ইভিএম দিয়ে নির্ধারিত ফর্মুলার বাইরে কাজ করানোর জন্য মানুষই দায়ী, মেশিনটি নিজে নয়। তাই মানুষ ঠিক না হলে কোন পদ্ধতিই নির্ভরযোগ্য নয়। বিগত সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে সব নির্বাচনী কেন্দ্রে এ মেশিন ব্যবহৃত হয়েছে সেসব কেন্দ্রে ভোট পড়েছে তুলনামূলকভাবে কম। এতে মনে হয় এই মেশিনে ভোট জালিয়তি তত সহজ নয়।

এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, কমিউনিস্ট পার্টিসহ অন্যান্য দল অংশগ্রহণ করায় নির্বাচনী প্রচারণায় কিছুটা প্রাণ ফিরে এসেছিল, প্রতিযোগিতার আবহ সৃষ্টি হয়েছিল। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ সব নির্বাচনেই থাকে, এবারও ছিল। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে; জিতেছে আওয়ামী লীগ প্রার্থী। প্রচার, প্রচারণা আর পোস্টারের আধিক্য নির্বাচনকে উৎসবমুখর করে তুলেছিল: কিন্তু ভোটের দিন ভোটারের উপস্থিতি ছিল খুবই কম, মাত্র ২৭ পারসেন্ট। আওয়ামী লীগের বিয়াল্লিশ বা জামায়াত আর বিএনপি’র ৪০ পারসেন্ট ভোটার গেল কই? ভোটারের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় কম হওয়ার কারণ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাংবাদিকেরা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে যাচ্ছেন। নির্বাচনের দিন আওয়ামী লীগ কর্মীদের আনাগোনা ছিলো উৎসবমুখর, কিন্তু বিএনপি জেতার জন্য মনেপ্রাণে চেষ্টা করেছে বলে মনে হয়নি। আমার নির্বাচনী কেন্দ্রে বিএনপির নির্বাচনী বুথ ছিল না, ভেতরে পোলিং এজেন্টের দায়িত্ব পালনের জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় প্রভাবশালী মাতব্বর বা করিৎকর্মা কোন যুবককে বিএনপির ব্যাচ পরতে দেখিনি। যে সব মাতব্বর ও ডাকসাইটে যুবক কয়েক বছর পূর্বেও প্রকাশ্যে বিএনপি করত তাদের গলায় নৌকার ব্যাজ দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। একচেটিয়া পরিবেশ সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগের সুবিধা হয়েছে। ভোটকেন্দ্রগুলোতে আওয়ামী লীগের কর্মীদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ বজায় ছিল। তারপরও বিএনপি আওয়ামী লীগের অর্ধেক ভোট পেয়েছে। সম্মুখ কৌশলে হেরে গিয়ে বিএনপি এখন নিরব ভোটের মাধ্যমে জয়ের আশা করে। বিএনপি মনে করে ভোটারেরা নিরবে বিএনপি’র পক্ষে বিপ্লব ঘটিয়ে দেবে; কারণ জনগণ তাদের পক্ষে। কিন্তু সংসদ এবং সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির অন্তর্নিহিত নীরব ভোটের বিপ্লব ঘটেনি। বিএনপি’র বোঝা উচিত যে, নির্বাচনের দিন কর্মীর সংশ্লিষ্টতার কোন বিকল্প নেই। বিএনপির মতে ভোটার কেন্দ্রে এমনভাবে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে যা বিএনপির কর্মীদের জন্য অনুকূল ছিল না। তাদের পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি, কেউ ঢুকলে পরে তাদের বের করে দিয়েছে- এ অভিযোগগুলো বিএনপির। তবে আমার ভোটকেন্দ্রে এমন ঘটনা ঘটেনি, কেউ সম্ভবত বিএনপির পোলিং এজেন্ট হতে সাহস করেনি। বহু কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট না থাকার সত্যতা নির্বাচন কমিশনও স্বীকার করেছে।

ভোটার কম হওয়ার জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার মেয়র ও কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের দায়ী করেছেন, কারণ তারা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে সক্ষম হননি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয়তো জানেন না যে, এখন কারও কথায় কেউ ভোট দেয় না, ভোটকেন্দ্রে যায় না। আমার শিক্ষিত স্ত্রীও আমার কথায় ভোট দিতে প্রথমে সম্মত হয়নি, সে বললো, ‘ভোট দিয়ে কি হবে?’ বললাম, ‘নতুন পদ্ধতিটি দেখে এসো’। নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য দ্বিতীয়বার বলার পর সে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোটটি নিজে দিতে পারেনি। তাকে বিনা আহ্বানে সহায়তা করতে গিয়ে তৃতীয় ব্যক্তি তার ভোটটি দিয়ে দেয়; সে যাকে ভোট দেবে বলে মনস্থির করে ভোট কেন্দ্রে গিয়েছিল তৃতীয় ব্যক্তি তাকেই ভোট দেয়ায় প্রতিবাদ না করে সে বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে আসার আগে প্রিসাইডিং অফিসারসহ সবার সম্মুখে যখন সে তৃতীয় ব্যক্তি দ্বারা ভোট দেয়ার ঘটনাটি বললো তখন পুলিশ, আনসারসহ সবাই একযোগে হেসে উঠে। অভিজ্ঞতা মানুষের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে এক বছর পূর্বে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সবার ছিল। আশি, নব্বই পার্সেন্ট ভোট কাস্ট হওয়া সত্ত্বেও জাঁদরেল বিএনপি নেতারাও দুই, তিন পারসেন্টের বেশি ভোট পাননি। শুধু যে এই নির্বাচন কমিশনের আমলে এমন ভোট হয়েছে তা কিন্তু নয়, জাতীয় পার্টি এবং বিএনপির আমলেও বেলা ১১টার মধ্যে সব ভোট কাস্ট হয়ে যেতে দেখেছি। মাগুরা নির্বাচনে বিএনপি যে অরাজকতার সৃষ্টি করেছিল তাতে বিরক্ত হয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার লজ্জায় দ্রুত মাগুরা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। লজ্জা পেলেও তিনি কিন্তু কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেননি। আর এই মাগুরার নির্বাচনের কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্ভব হয়েছিল। তাই তো বিএনপি বা জাতীয় পার্টি নির্বাচন কমিশন নিয়ে বড় গলায় কথা বলতে পারে না। এই অবস্থার উত্তরণ আর হলো না, হবে কী না তা শুধু ভবিতব্যই জানে।

নির্বাচিত মেয়রদ্বয় বলেছেন, ভোটার কম হওয়ার অর্থই হচ্ছে দেশের মানুষের জীবনমান অনেক উন্নত হয়েছে, কারণ উন্নত দেশে ভোটারদের ভোট দেয়ার আগ্রহ খুবই কম। উন্নত দেশের লোকেরা রাজনীতি নিয়ে শোরগোল তোলে না, রাস্তা-ঘাট, চায়ের দোকানে বসে রাজনীতি নিয়ে আলোচনাও করে না। উন্নত দেশের বেশিরভাগ যুবক তাদের দেশের পার্লামেন্টের সদস্য সংখ্যা কতজন তা জানে না; স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, ভাইস চ্যান্সলর, সেন্ট্রাল ব্যাংকের গভর্নরের নাম মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। সুযোগ পেলেই তারা শুধু আনন্দে মেতে উঠে। উন্নত দেশে আনন্দে মেতে থাকার বহু ব্যবস্থা রয়েছে, তারা ভোট দেয়াকে কখনোই উৎসব মনে করে না। তাই কে প্রার্থী হলো তার খোঁজ নেয়ার গরজও তাদের নেই। কিন্তু গণতন্ত্র রাখতে হলে কিছু ভোট লাগে। এজন্য কিছু কিছু দেশ ভোট দানে উৎসাহিত করতে প্রণোদনা এবং ভোট না দিলে শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। অস্ট্রেলিয়ায় ভোট প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ব্রাজিলে ভোট দিতে অস্বীকৃতি জানালে জরিমানা হয়। নাগরিকদের ভোট প্রদানে উৎসাহিত করতে ভোট প্রদান সহজতর করা হয়েছে। আমেরিকার মহাকাশচারীরাও মহাকাশে অবস্থান করে ভোট দিতে পারেন। এস্তোনিয়ার ভোটারেরা ঘরে বসেই অনলাইনে ভোট দিতে পারেন। বাংলাদেশ এখনও সেই পর্যায়ে উন্নত হয়নি; এখনও দুজন লোক একত্রিত হলে ধর্ম বা রাজনীতি ছাড়া অন্য কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে না, এখনও রাজনীতি বা ধর্মের জন্য মানুষ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে। তবে অর্থনৈতিক উন্নতি যে হয়েছে তা দুনিয়ার সবাই স্বীকার করে, বিএনপিও করে। আওয়ামী লীগের আমলে দেশের অভাবিত উন্নতির কথা অস্বীকার করতে না পেরে বিএনপি বলে থাকে যে, ‘সুশাসন ছাড়া কেবল উন্নয়ন দিয়ে জনসমর্থন পাওয়া যায় না’। কিন্তু এ উন্নয়ন তো শুধু বিগত এক বছরে হয়নি- শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হচ্ছে। তাহলে এক বছর পূর্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের নির্বাচনে ৭০-৮০ পারসেন্ট ভোট কাস্ট হলো কীভাবে? এক বছর আগে কি দেশ উন্নত ছিল না? মেয়রদ্বয়ের কথা থেকে মনে হয়, সংসদ নির্বাচনের সময় দেশ ছিল গরিব, দুঃখী।

নির্বাচনের পূর্বে বিএনপির নেতিবাচক বক্তব্য বিএনপির জন্য বুমেরাং হয়েছে; প্রায় সব নেতা এ মর্মে বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলেছেন যে, ‘ভোটের ফলাফল পূর্ব নির্ধারিত’। ইভিএমে ধানের শিষে ভোট দিলেও নাকি নৌকা মার্কায় সে ভোট চলে যাবে। বিএনপির প্রার্থী এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যখন এমন বক্তব্য দেন তখন কর্মীরা সর্বত্র তা প্রচারও করেছে। বিএনপি জনগণকে এমন একটি ধারণা দিয়েছে যে, বিএনপির পক্ষে গণজোয়ার থাকলেও ইভিএমের কারসাজিতে জিতবে আওয়ামী লীগ। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে বিএনপির ভোটারেরা ভোট দিতে যায়নি; তাদের ভোট যদি বিএনপির পক্ষে কাস্ট না হয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে চলে যায় তাহলে ভোট দিয়ে লাভ কী। ভোট কম কাস্ট হওয়ার পেছনে বিএনপির নেতাদের ঘরে বসে থাকাটাও দায়ী। নির্বাচনের দিন বিএনপির কোন নেতাকে আমার কেন্দ্র ও আশেপাশের কোন কেন্দ্রে দেখা যায়নি। নেতাদের আনাগোনা থাকলে বিএনপির কর্মীরা উজ্জীবিত হতো। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে কর্মীরা হয়তো পোলিং এজেন্ট হতে ভয় পেয়েছে, কিন্তু নেতারাও কি ভয় পান? তাহলে রাজনীতি করার দরকার কি? বঙ্গবন্ধু ৫৫ বছরের জীবনে তের বছর জেল খেটেছেন, জেলে নেয়ার জন্য পোশাক-পরিচ্ছদ একটি বাক্সে সব সময় প্রস্তুত করে রাখা হতো। তাই আওয়ামী লীগের নেতারা বলে যাচ্ছেন, ‘বিএনপি জেতার জন্য নির্বাচন করেনি, নির্বাচন করেছে অভিযোগ করার জন্য’। অন্যদিকে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া আধিপত্য ও জয় আওয়ামী লীগের ভোটারদেরও ভোট প্রদানে নিরুৎসাহিত করেছে; তাদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল- আওয়ামী লীগ জিতবেই- তাই ভোট দেয়ার গরজ বোধ করেনি। উইন উইন সিচ্যুয়েশন থাকলে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের ভোটারেরা ভোটকেন্দ্রে অবশ্যই যেত। বাসা বদলের কারণে অনেকে ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে অবস্থান করে থাকেন, তাই যানবাহনের অভাব অনেককে ভোটকেন্দ্রে আসতে নিরুৎসাহিত করেছে।

ইভিএমে ভোট দেয়া সহজ হলেও অনেকের নিকট পদ্ধতিটি অজানা ছিল। ভোটের প্রতি আগ্রহ না থাকায় ভোট দেয়ার পদ্ধতি শিখে নেয়ার গরজও ছিল না। ইভিএমের স্বচ্ছতা নিয়ে বিএনপি প্রথম থেকেই আশঙ্কা করে আসছে; এ আশঙ্কা দূর করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। জালভোট রোধে ইভিএম কার্যকর। ভেরিফিকেশন হওয়া ছাডা ভোট দেয়া যায় না। ইভিএমে একবার ভোট দেয়া হয়ে গেলে ওই ভোটার আর ভোট দিতে পারে না। ভেরিফিকেশন অপরিহার্য হওয়ায় জাল ভোট দেয়ার সুযোগ ছিল না। কারো আইডি কার্ড, ভোটার কার্ড বা ভোটার নম্বর দিয়ে জালভোট দেয়াও সম্ভব নয়; কারণ ইভিএম ভোটারের ছবি দেখায়। ছবিটি ইগনোর করা হলেও আঙ্গুলের প্রিন্ট নকল করার কোন সুযোগ নেই। তবে ভেরিফিকেশন হয়ে গেলে দুর্বল নির্বাচনী ব্যবস্থায় অন্য লোক গিয়ে ভোট দিতে পারে। এছাড়াও আগের রাতে ভোটের বাক্স ভরে রাখার ব্যবস্থাও ইভিএমে নেই। ইভিএমের সফটওয়ার বিকল করা, হ্যাকিং করা, ভোট কারচুপি করা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিলেও এমন ঘটনা এ মেয়র নির্বাচনে পরিলক্ষিত হয়নি। তবে ধরে আনতে বললে বেঁধে আনার মানসিকতা থেকে প্রতি নির্বাচনেই দলীয় কর্মীরা কা-জ্ঞানহীন বাড়াবাড়ি করে থাকে।

ভোট প্রদানে ইলেকট্রনিক পদ্ধতির প্রয়োগ হলেও প্রচার-প্রচারণায় ছিল ম্যানুয়্যাল পদ্ধতি। ভোটের পরদিন হাজার হাজার পোস্টার রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল। লেমিনেটেড থাকায় পোস্টারের এ আবর্জনা ধ্বংস করাও কঠিন। নির্বাচনে পোস্টার অপ্রয়োজনীয়। দলীয় মার্কা যখন ভোটের কেন্দ্রবিন্দু তখন প্রার্থীর পোস্টার টাঙানোর উপযোগিতা কম। লোকের গুণাগুণ বিচার করে সাধারণত কেউ ভোট দেয় না। চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন যত্রতত্র পোস্টার লাগানো বন্ধ করতে পেরেছিলেন, এখন কি অবস্থা জানি না। হাজার হাজার টন পোস্টারের আর্বজনা সরাতে জয়ী মেয়রদের গলদঘর্ম হতে হয়েছে, তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে তারা এ আবর্জনা সরাতে সক্ষম হয়েছেন।। ইভিএম একটি ভালো পদ্ধতি, এ মেশিনটির অপব্যবহার বন্ধের ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। ভোট সংগ্রহের অপকৌশল রোধের জন্য ইভিএমকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তোলা দরকার। ইভিএমের মাধ্যমে নেয়া ভোটের রেজাল্ট দিতে বিলম্ব জনগণের আশঙ্কাকে ঘনীভূত করেছে। এ বিষয় নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য হচ্ছে, অনেক কেন্দ্র থেকে ম্যানুয়ালী ভোটের ফলাফল মূল কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে; কিন্তু শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এমন ভুল কোনভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না। ভোটকেন্দ্রে ভোটার কেন যায়নি তা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ সব রাজনৈতিক দল এবং জনতা সম্যকভাবে অবহিত, আমাদের লেখা ও আলোচনা প্যাঁচাল পাড়া ছাড়া আর কিছুই নয়। নির্বাচন কমিশন নিয়ে আরেকটু প্যাঁচাল আগামী কলামে থাকবে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

zeauddinahmed@gmail.com

রবিবার, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ২৬ মাঘ ১৪২৬, ১৪ জমাদিউল সানি ১৪৪১

আমি ভোট দিয়েছি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচন। এ নির্বাচনে ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহৃত হয়েছে। বহু বছর ধরে এই মেশিনটি নির্বাচনে ব্যবহারের তোড়জোড় চলছে, কিন্তু বিরোধী দলের কাছে মেশিনের বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষে ব্যাপকভাবে তা ব্যবহার করা এতদিন সম্ভব হয়নি। অপব্যবহার না করলে মেশিন কিন্তু কখনও মানুষের মতো বিশ্বাসঘাতকতা করে না। পৃথিবীর মধ্যে এখন যে গতির সৃষ্টি হয়েছে তার সঙ্গে সঙ্গতি না রাখলে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে যাব। ইভিএম দ্রুতগতিতে নির্ভুলভাবে ভোট গ্রহণ এবং হিসাব-নিকাশ করতে পারে; ইভিএমের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, মানুষের দেয়া সূত্রের বাইরে গিয়ে ইভিএম কিছু করতে পারে না। ইভিএমের কার্যক্রম মানুষ দ্বারা নির্ধারিত ফর্মূলায় কাজ করে। ইভিএমকে যে ফর্মূলায় কাজ করতে সৃষ্টি করা হয়েছে সে ফর্মুলার বাইরে গিয়ে কাজ করতে হলে এ সিস্টেমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনের সহায়তা প্রয়োজন। তাই ইভিএম দিয়ে নির্ধারিত ফর্মুলার বাইরে কাজ করানোর জন্য মানুষই দায়ী, মেশিনটি নিজে নয়। তাই মানুষ ঠিক না হলে কোন পদ্ধতিই নির্ভরযোগ্য নয়। বিগত সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে সব নির্বাচনী কেন্দ্রে এ মেশিন ব্যবহৃত হয়েছে সেসব কেন্দ্রে ভোট পড়েছে তুলনামূলকভাবে কম। এতে মনে হয় এই মেশিনে ভোট জালিয়তি তত সহজ নয়।

এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, কমিউনিস্ট পার্টিসহ অন্যান্য দল অংশগ্রহণ করায় নির্বাচনী প্রচারণায় কিছুটা প্রাণ ফিরে এসেছিল, প্রতিযোগিতার আবহ সৃষ্টি হয়েছিল। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ সব নির্বাচনেই থাকে, এবারও ছিল। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে; জিতেছে আওয়ামী লীগ প্রার্থী। প্রচার, প্রচারণা আর পোস্টারের আধিক্য নির্বাচনকে উৎসবমুখর করে তুলেছিল: কিন্তু ভোটের দিন ভোটারের উপস্থিতি ছিল খুবই কম, মাত্র ২৭ পারসেন্ট। আওয়ামী লীগের বিয়াল্লিশ বা জামায়াত আর বিএনপি’র ৪০ পারসেন্ট ভোটার গেল কই? ভোটারের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় কম হওয়ার কারণ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাংবাদিকেরা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে যাচ্ছেন। নির্বাচনের দিন আওয়ামী লীগ কর্মীদের আনাগোনা ছিলো উৎসবমুখর, কিন্তু বিএনপি জেতার জন্য মনেপ্রাণে চেষ্টা করেছে বলে মনে হয়নি। আমার নির্বাচনী কেন্দ্রে বিএনপির নির্বাচনী বুথ ছিল না, ভেতরে পোলিং এজেন্টের দায়িত্ব পালনের জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় প্রভাবশালী মাতব্বর বা করিৎকর্মা কোন যুবককে বিএনপির ব্যাচ পরতে দেখিনি। যে সব মাতব্বর ও ডাকসাইটে যুবক কয়েক বছর পূর্বেও প্রকাশ্যে বিএনপি করত তাদের গলায় নৌকার ব্যাজ দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। একচেটিয়া পরিবেশ সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগের সুবিধা হয়েছে। ভোটকেন্দ্রগুলোতে আওয়ামী লীগের কর্মীদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ বজায় ছিল। তারপরও বিএনপি আওয়ামী লীগের অর্ধেক ভোট পেয়েছে। সম্মুখ কৌশলে হেরে গিয়ে বিএনপি এখন নিরব ভোটের মাধ্যমে জয়ের আশা করে। বিএনপি মনে করে ভোটারেরা নিরবে বিএনপি’র পক্ষে বিপ্লব ঘটিয়ে দেবে; কারণ জনগণ তাদের পক্ষে। কিন্তু সংসদ এবং সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির অন্তর্নিহিত নীরব ভোটের বিপ্লব ঘটেনি। বিএনপি’র বোঝা উচিত যে, নির্বাচনের দিন কর্মীর সংশ্লিষ্টতার কোন বিকল্প নেই। বিএনপির মতে ভোটার কেন্দ্রে এমনভাবে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে যা বিএনপির কর্মীদের জন্য অনুকূল ছিল না। তাদের পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি, কেউ ঢুকলে পরে তাদের বের করে দিয়েছে- এ অভিযোগগুলো বিএনপির। তবে আমার ভোটকেন্দ্রে এমন ঘটনা ঘটেনি, কেউ সম্ভবত বিএনপির পোলিং এজেন্ট হতে সাহস করেনি। বহু কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট না থাকার সত্যতা নির্বাচন কমিশনও স্বীকার করেছে।

ভোটার কম হওয়ার জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার মেয়র ও কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের দায়ী করেছেন, কারণ তারা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে সক্ষম হননি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয়তো জানেন না যে, এখন কারও কথায় কেউ ভোট দেয় না, ভোটকেন্দ্রে যায় না। আমার শিক্ষিত স্ত্রীও আমার কথায় ভোট দিতে প্রথমে সম্মত হয়নি, সে বললো, ‘ভোট দিয়ে কি হবে?’ বললাম, ‘নতুন পদ্ধতিটি দেখে এসো’। নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য দ্বিতীয়বার বলার পর সে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোটটি নিজে দিতে পারেনি। তাকে বিনা আহ্বানে সহায়তা করতে গিয়ে তৃতীয় ব্যক্তি তার ভোটটি দিয়ে দেয়; সে যাকে ভোট দেবে বলে মনস্থির করে ভোট কেন্দ্রে গিয়েছিল তৃতীয় ব্যক্তি তাকেই ভোট দেয়ায় প্রতিবাদ না করে সে বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে আসার আগে প্রিসাইডিং অফিসারসহ সবার সম্মুখে যখন সে তৃতীয় ব্যক্তি দ্বারা ভোট দেয়ার ঘটনাটি বললো তখন পুলিশ, আনসারসহ সবাই একযোগে হেসে উঠে। অভিজ্ঞতা মানুষের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে এক বছর পূর্বে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সবার ছিল। আশি, নব্বই পার্সেন্ট ভোট কাস্ট হওয়া সত্ত্বেও জাঁদরেল বিএনপি নেতারাও দুই, তিন পারসেন্টের বেশি ভোট পাননি। শুধু যে এই নির্বাচন কমিশনের আমলে এমন ভোট হয়েছে তা কিন্তু নয়, জাতীয় পার্টি এবং বিএনপির আমলেও বেলা ১১টার মধ্যে সব ভোট কাস্ট হয়ে যেতে দেখেছি। মাগুরা নির্বাচনে বিএনপি যে অরাজকতার সৃষ্টি করেছিল তাতে বিরক্ত হয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার লজ্জায় দ্রুত মাগুরা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। লজ্জা পেলেও তিনি কিন্তু কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেননি। আর এই মাগুরার নির্বাচনের কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্ভব হয়েছিল। তাই তো বিএনপি বা জাতীয় পার্টি নির্বাচন কমিশন নিয়ে বড় গলায় কথা বলতে পারে না। এই অবস্থার উত্তরণ আর হলো না, হবে কী না তা শুধু ভবিতব্যই জানে।

নির্বাচিত মেয়রদ্বয় বলেছেন, ভোটার কম হওয়ার অর্থই হচ্ছে দেশের মানুষের জীবনমান অনেক উন্নত হয়েছে, কারণ উন্নত দেশে ভোটারদের ভোট দেয়ার আগ্রহ খুবই কম। উন্নত দেশের লোকেরা রাজনীতি নিয়ে শোরগোল তোলে না, রাস্তা-ঘাট, চায়ের দোকানে বসে রাজনীতি নিয়ে আলোচনাও করে না। উন্নত দেশের বেশিরভাগ যুবক তাদের দেশের পার্লামেন্টের সদস্য সংখ্যা কতজন তা জানে না; স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, ভাইস চ্যান্সলর, সেন্ট্রাল ব্যাংকের গভর্নরের নাম মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। সুযোগ পেলেই তারা শুধু আনন্দে মেতে উঠে। উন্নত দেশে আনন্দে মেতে থাকার বহু ব্যবস্থা রয়েছে, তারা ভোট দেয়াকে কখনোই উৎসব মনে করে না। তাই কে প্রার্থী হলো তার খোঁজ নেয়ার গরজও তাদের নেই। কিন্তু গণতন্ত্র রাখতে হলে কিছু ভোট লাগে। এজন্য কিছু কিছু দেশ ভোট দানে উৎসাহিত করতে প্রণোদনা এবং ভোট না দিলে শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। অস্ট্রেলিয়ায় ভোট প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ব্রাজিলে ভোট দিতে অস্বীকৃতি জানালে জরিমানা হয়। নাগরিকদের ভোট প্রদানে উৎসাহিত করতে ভোট প্রদান সহজতর করা হয়েছে। আমেরিকার মহাকাশচারীরাও মহাকাশে অবস্থান করে ভোট দিতে পারেন। এস্তোনিয়ার ভোটারেরা ঘরে বসেই অনলাইনে ভোট দিতে পারেন। বাংলাদেশ এখনও সেই পর্যায়ে উন্নত হয়নি; এখনও দুজন লোক একত্রিত হলে ধর্ম বা রাজনীতি ছাড়া অন্য কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে না, এখনও রাজনীতি বা ধর্মের জন্য মানুষ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে। তবে অর্থনৈতিক উন্নতি যে হয়েছে তা দুনিয়ার সবাই স্বীকার করে, বিএনপিও করে। আওয়ামী লীগের আমলে দেশের অভাবিত উন্নতির কথা অস্বীকার করতে না পেরে বিএনপি বলে থাকে যে, ‘সুশাসন ছাড়া কেবল উন্নয়ন দিয়ে জনসমর্থন পাওয়া যায় না’। কিন্তু এ উন্নয়ন তো শুধু বিগত এক বছরে হয়নি- শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হচ্ছে। তাহলে এক বছর পূর্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের নির্বাচনে ৭০-৮০ পারসেন্ট ভোট কাস্ট হলো কীভাবে? এক বছর আগে কি দেশ উন্নত ছিল না? মেয়রদ্বয়ের কথা থেকে মনে হয়, সংসদ নির্বাচনের সময় দেশ ছিল গরিব, দুঃখী।

নির্বাচনের পূর্বে বিএনপির নেতিবাচক বক্তব্য বিএনপির জন্য বুমেরাং হয়েছে; প্রায় সব নেতা এ মর্মে বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলেছেন যে, ‘ভোটের ফলাফল পূর্ব নির্ধারিত’। ইভিএমে ধানের শিষে ভোট দিলেও নাকি নৌকা মার্কায় সে ভোট চলে যাবে। বিএনপির প্রার্থী এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যখন এমন বক্তব্য দেন তখন কর্মীরা সর্বত্র তা প্রচারও করেছে। বিএনপি জনগণকে এমন একটি ধারণা দিয়েছে যে, বিএনপির পক্ষে গণজোয়ার থাকলেও ইভিএমের কারসাজিতে জিতবে আওয়ামী লীগ। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে বিএনপির ভোটারেরা ভোট দিতে যায়নি; তাদের ভোট যদি বিএনপির পক্ষে কাস্ট না হয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে চলে যায় তাহলে ভোট দিয়ে লাভ কী। ভোট কম কাস্ট হওয়ার পেছনে বিএনপির নেতাদের ঘরে বসে থাকাটাও দায়ী। নির্বাচনের দিন বিএনপির কোন নেতাকে আমার কেন্দ্র ও আশেপাশের কোন কেন্দ্রে দেখা যায়নি। নেতাদের আনাগোনা থাকলে বিএনপির কর্মীরা উজ্জীবিত হতো। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে কর্মীরা হয়তো পোলিং এজেন্ট হতে ভয় পেয়েছে, কিন্তু নেতারাও কি ভয় পান? তাহলে রাজনীতি করার দরকার কি? বঙ্গবন্ধু ৫৫ বছরের জীবনে তের বছর জেল খেটেছেন, জেলে নেয়ার জন্য পোশাক-পরিচ্ছদ একটি বাক্সে সব সময় প্রস্তুত করে রাখা হতো। তাই আওয়ামী লীগের নেতারা বলে যাচ্ছেন, ‘বিএনপি জেতার জন্য নির্বাচন করেনি, নির্বাচন করেছে অভিযোগ করার জন্য’। অন্যদিকে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া আধিপত্য ও জয় আওয়ামী লীগের ভোটারদেরও ভোট প্রদানে নিরুৎসাহিত করেছে; তাদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল- আওয়ামী লীগ জিতবেই- তাই ভোট দেয়ার গরজ বোধ করেনি। উইন উইন সিচ্যুয়েশন থাকলে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের ভোটারেরা ভোটকেন্দ্রে অবশ্যই যেত। বাসা বদলের কারণে অনেকে ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে অবস্থান করে থাকেন, তাই যানবাহনের অভাব অনেককে ভোটকেন্দ্রে আসতে নিরুৎসাহিত করেছে।

ইভিএমে ভোট দেয়া সহজ হলেও অনেকের নিকট পদ্ধতিটি অজানা ছিল। ভোটের প্রতি আগ্রহ না থাকায় ভোট দেয়ার পদ্ধতি শিখে নেয়ার গরজও ছিল না। ইভিএমের স্বচ্ছতা নিয়ে বিএনপি প্রথম থেকেই আশঙ্কা করে আসছে; এ আশঙ্কা দূর করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। জালভোট রোধে ইভিএম কার্যকর। ভেরিফিকেশন হওয়া ছাডা ভোট দেয়া যায় না। ইভিএমে একবার ভোট দেয়া হয়ে গেলে ওই ভোটার আর ভোট দিতে পারে না। ভেরিফিকেশন অপরিহার্য হওয়ায় জাল ভোট দেয়ার সুযোগ ছিল না। কারো আইডি কার্ড, ভোটার কার্ড বা ভোটার নম্বর দিয়ে জালভোট দেয়াও সম্ভব নয়; কারণ ইভিএম ভোটারের ছবি দেখায়। ছবিটি ইগনোর করা হলেও আঙ্গুলের প্রিন্ট নকল করার কোন সুযোগ নেই। তবে ভেরিফিকেশন হয়ে গেলে দুর্বল নির্বাচনী ব্যবস্থায় অন্য লোক গিয়ে ভোট দিতে পারে। এছাড়াও আগের রাতে ভোটের বাক্স ভরে রাখার ব্যবস্থাও ইভিএমে নেই। ইভিএমের সফটওয়ার বিকল করা, হ্যাকিং করা, ভোট কারচুপি করা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিলেও এমন ঘটনা এ মেয়র নির্বাচনে পরিলক্ষিত হয়নি। তবে ধরে আনতে বললে বেঁধে আনার মানসিকতা থেকে প্রতি নির্বাচনেই দলীয় কর্মীরা কা-জ্ঞানহীন বাড়াবাড়ি করে থাকে।

ভোট প্রদানে ইলেকট্রনিক পদ্ধতির প্রয়োগ হলেও প্রচার-প্রচারণায় ছিল ম্যানুয়্যাল পদ্ধতি। ভোটের পরদিন হাজার হাজার পোস্টার রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল। লেমিনেটেড থাকায় পোস্টারের এ আবর্জনা ধ্বংস করাও কঠিন। নির্বাচনে পোস্টার অপ্রয়োজনীয়। দলীয় মার্কা যখন ভোটের কেন্দ্রবিন্দু তখন প্রার্থীর পোস্টার টাঙানোর উপযোগিতা কম। লোকের গুণাগুণ বিচার করে সাধারণত কেউ ভোট দেয় না। চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন যত্রতত্র পোস্টার লাগানো বন্ধ করতে পেরেছিলেন, এখন কি অবস্থা জানি না। হাজার হাজার টন পোস্টারের আর্বজনা সরাতে জয়ী মেয়রদের গলদঘর্ম হতে হয়েছে, তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে তারা এ আবর্জনা সরাতে সক্ষম হয়েছেন।। ইভিএম একটি ভালো পদ্ধতি, এ মেশিনটির অপব্যবহার বন্ধের ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। ভোট সংগ্রহের অপকৌশল রোধের জন্য ইভিএমকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তোলা দরকার। ইভিএমের মাধ্যমে নেয়া ভোটের রেজাল্ট দিতে বিলম্ব জনগণের আশঙ্কাকে ঘনীভূত করেছে। এ বিষয় নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য হচ্ছে, অনেক কেন্দ্র থেকে ম্যানুয়ালী ভোটের ফলাফল মূল কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে; কিন্তু শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এমন ভুল কোনভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না। ভোটকেন্দ্রে ভোটার কেন যায়নি তা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ সব রাজনৈতিক দল এবং জনতা সম্যকভাবে অবহিত, আমাদের লেখা ও আলোচনা প্যাঁচাল পাড়া ছাড়া আর কিছুই নয়। নির্বাচন কমিশন নিয়ে আরেকটু প্যাঁচাল আগামী কলামে থাকবে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

zeauddinahmed@gmail.com