বিচারের পথ মসৃণ করুন

খন্দকার মুনতাসীর মামুন

বিলম্বিত বিচার মানে বিচারবঞ্চিত হওয়া। এটি বিশ্বজুড়ে প্রচলিত প্রবচন। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, বাংলাদেশে এমন ঘটনাই ঘটছে অহরহ। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচারের অপেক্ষায় ঝুলছে ৩০ লক্ষাধিক মামলা। ঝুলে আছে চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার প্রক্রিয়াও।

১.

২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যেরবাজারে আওয়ামী লীগের ঈদ-পরবর্তী জনসভা শেষে বের হওয়ার পথে গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা শাহ এএমএস কিবরিয়া। চিকিৎসার জন্য ঢাকা নেয়ার পথেই তিনি মারা যান। ওই হামলায় তার ভাতিজা শাহ মঞ্জুরুল হুদা, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা আবদুর রহিম, আবুল হোসেন ও সিদ্দিক আলী নিহত হন। আহত হন ৭০ জন। ঘটনার পরদিন আবদুল মজিদ খান বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা করেন। এরপর কেটে গেল ১৫ বছর। শেষ হলো না বিচার।

২.

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি সাংবাদিক দম্পতিকে ঢাকায় পশ্চিম রাজাবাজার এলাকায় তাদের বাসায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ঘটনার সময় ওই বাসায় থাকা তাদের একমাত্র শিশু সন্তান মাহি সরওয়ার মেঘ বেঁচে যায়। হত্যাকাণ্ডের পর আট বছরে তদন্তে অগ্রগতি নেই। এমন পরিস্থিতিতে সান্ত¡না পাওয়ার পথও খুঁজে পাচ্ছে না সাংবাদিক দম্পতির বিপর্যস্ত পরিবার দুটি।

৩.

২০১৩ সালের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জের শিক্ষার্থী তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে অপহরণ ও খুন করা হয়। ৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা চারারগোপ এলাকার খাল থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের পর দেশজুড়ে আলোড়ন পড়ে যায়। অভিযোগের আঙুল উঠে নারায়ণগঞ্জের একটি অভিজাত পরিবারের দিকে। ক্ষমতাশালী হওয়ার কারণে তাদের কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি।

৪.

২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের চকবাজার তেলিপট্টি এলাকার নিজ বাসার গলির মুখে অঞ্জলি দেবীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া মাদরাসার সাবেক ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। নার্সিং কলেজে ছাত্রীদের হিজাব পরা নিয়ে আন্দোলনের সময় অঞ্জলি দেবীকে আইনি নোটিস দিয়েছিলেন রেজা। অঞ্জলী দেবীর স্বামী রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পুলিশ আসামিদের খুঁজে পায় না, শুধু বারবার আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আমি তাদের পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছি, যেভাবে হত্যাকাণ্ডটি হয়েছে, তাতে আমার মনে হয়েছে এটা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কাজ। পরিষ্কারভাবে পুলিশকে সেই কথাটি বলেছি, কিন্তু তারা কিছুই করেনি।’

৫.

২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রামের জিইসির মোড় এলাকায় ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। এ ঘটনার পর তার স্বামী বাবুল আক্তার বাদি হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন। অস্ত্র আইনের মামলাটি বিচারাধীন থাকলেও মাহমুদা হত্যা মামলায় এখনও অভিযোগপত্র জমা দেয়নি গোয়েন্দা পুলিশ। এখন এ মামলায় কারাগারে কেউ নেই।

৬.

২০১৬ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরে টিউশনি করাতে গিয়ে আর বাসায় ফেরেননি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু। অনেক খোঁজাখুঁজির পর রাতে তনুদের বাসার অদূরে সেনানিবাসের ভেতরের একটি জঙ্গলে তার মরদেহ পায় স্বজনরা। পরদিন তার বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহায়ক ইয়ার হোসেন বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা ঘাতকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। থানা পুলিশ ও ডিবির পর ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল থেকে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। ২০১৭ সালের মে মাসে সিআইডি তনুর জামা-কাপড় থেকে নেয়া নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করে তিনজন পুরুষের শুক্রাণু পাওয়ার কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল। পরে সন্দেহভাজনদের ডিএনএ ম্যাচিং করা হলেও রিপোর্ট আসেনি।

৭.

একের পর এক ব্লগার খুন হয়েছেন। কিন্তু ঘাতকরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এসব খুনের পরিকল্পনাকারী কিংবা হত্যাকারী কেউই গ্রেফতার না হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুধু তাই নয়, এসব হত্যাকাণ্ডের মামলাগুলোর তদন্তেও তেমন কোন অগ্রগতি নেই। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এসে তদন্ত করার পরও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার সুরাহা হয়নি। এটিসহ অন্য মামলাগুলোর তদন্ত থমকে আছে।

উল্লেখিত সব হত্যার ঘটনা দেশে চাঞ্চল্য তৈরি করেছিল। এসব হত্যা মামলার বিচারের দাবিতে সাধারণ মানুষও রাজপথে নেমেছিল। সাগর-রুনি হত্যার ঘটনার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি। চাঞ্চল্যকর এসব হত্যা মামলার কোন কূল-কিনারা করা যায়নি নাকি করা হয়নি- তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। ভিকটিমের স্বজনরা মনে করেন, তদন্তে আসামিদের চিহ্নিত করা গেলেও রাজনৈতিক কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ত্বকী হত্যার ঘটনায় আসামির নামও ঘোষণা করা হয়েছিল। মিতু হত্যার পর তার স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের রহস্যজনক পদত্যাগ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। নিহত সাংবাদিক সাগরের মা সালেহা খানম সন্তান হত্যার বিচার না পেয়ে বলেছেন, ‘রাষ্ট্র যদি না চায় তাহলে তো কারও বের করার ক্ষমতা নেই। সরকারের যদি সদিচ্ছা না থাকে তাহলে আর কী। কত বড় বড় ঘটনা বের হয়ে গেল। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার আসামিদের ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। আর সাগর-রুনির খুনের রহস্য বের হবে না? এসব প্রশ্ন আমাদেরও। সাধারণ হিসাব, বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত না করতে পারলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে না।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আমরা অনেক চাঞ্চল্যকর মামলার দ্রুত সুরাহা করতে দেখেছি। নুসরাত হত্যার ঘটনায় দ্রুত আসামিদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাজনৈতিক চাপমুক্ত হয়ে কাজ করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে ভালো কাজ করতে পারে তার বহু উদাহরণ আছে। উল্লিখিত চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলাগুলোর সুরাহা না হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক অর্জনই ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

বিচার বিলম্বিত হচ্ছে কোথায়? বিলম্বিত হওয়ার অনেকগুলো জায়গা আছে। তদন্তের ধীরগতি, তদন্ত আটকে যাওয়া, বিষয়টি রাজনৈতিক হয়ে যাওয়া। আমরা মনে করি, এই রাজনীতি মানুষের জন্য নয়। এ রাজনীতি নিষ্ঠুরতার, প্রভাব বিস্তারের, ভোগদখলের এবং অমানবিককরণের। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনীতির হর্তাকর্তাবিধাতারা দেশবাসীকে সন্ত্রাস থেকে মুক্তি দিতে চাইছেন কিনা? যদি অপরাধের প্রতিবিধান চাইতেন, তাহলে দলীয় স্বার্থ রক্ষার চেয়ে দেশের কল্যাণ সাধনই প্রধান কর্তব্য বলে বিবেচিত হতো। দলীয় অন্ধত্ব কাটাতে পারলে হয়ত আসুরিক দাপটের বাড়বাড়ন্ত হতো না।

কোন কোন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বারবার বদলানো হয়। পুলিশের অদক্ষতা এবং অজ্ঞতাও অনেক সময় তদন্তকে এগিয়ে যেতে দেয় না। প্রযুক্তির ব্যবহার করে যেখানে দ্রুত অপরাধী শনাক্ত করা যায়, সেখানে পুলিশি তদন্ত পদ্ধতি এখনও মান্ধাতার আমলের ধারায় পরিচালিত হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, হত্যাকাণ্ডের মূল আসামিদের বাদ দিয়ে নিরপরাধীদের আসামি করে চার্জশিট দেয়া হয়। হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারে এমন দক্ষতা পুলিশের মধ্যে গড়ে ওঠেনি।

ফরেনসিক বিভাগের ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক ও মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টদের অবহেলা দেশের আদালতগুলোয় মামলার জট বৃদ্ধির আরেকটি প্রধান কারণ। আদালত ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আদেশ-নির্দেশ, ভুক্তভোগীদের আবেদন-নিবেদনেও সাড়া দিচ্ছেন না মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক। দীর্ঘদিনেও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন (ভিসেরা রিপোর্ট) ও আসামির বয়স নির্ধারণসহ তদন্ত সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিবেদন জমা দিচ্ছেন না তারা। ফলে একদিকে ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে বিচার ঝুলে থাকছে বছরের পর বছর।

ভিকটিমের স্বজনরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অভিযোগ উঠেছে, কোন একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে রক্ষার জন্য চাঞ্চল্যকর অনেক মামলার নিষ্পত্তি করা হয় না। আমরা বলতে চাই, আইন সবার জন্য সমান। নাগরিকদের ন্যায়বিচার দেয়া, অপরাধীর বিচার করা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রহস্য দ্রুত উদ্ঘাটন ও অপরাধীদের গ্রেফতারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সময় সময় পুলিশ ও র‌্যাবপ্রধানদের নির্দেশ দিয়ে থাকে। তবে রাজনৈতিক কারণে অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে কি না, সেদিকেও খতিয়ে দেখতে হবে। এটা মনে রাখা উচিত, অপরাধীর শাস্তি না হলে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে দেশজুড়ে সন্ত্রাসী পক্ষই উৎসাহিত হবে। তখন লাগাম টেনে ধরা কঠিন হবে সব পক্ষের জন্যই। আমরা এ জাতীয় সামাজিক-রাজনৈতিক জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। দেখতে চাই না বহুকথিত গডফাদার পরিচালিত নষ্ট, ভ্রষ্ট ও পচে যাওয়া সমাজ। চাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন সুস্থ সমাজ। চাই মানবিকবোধের সমাজ।

দোষীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা আর নির্দোষের সাজা পাওয়ার দৃষ্টান্ত হয়ে চাঞ্চল্যকর সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলা ৩০ বছর পর আবার সামনে এলো। দীর্ঘ তিন দশক পর চাঞ্চল্যকর সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলার যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত আসামিদের শনাক্ত করা এবং গ্রেফতারের জন্য পিবিআই সাধুবাদ পেতে পারে। ২৮ বছর পর আদালতে মামলাটি সচল করার জন্য সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চও ধন্যবাদ পেতে পারে। কিন্তু একইসঙ্গে এই প্রশ্ন ওঠা সংগত, যে বিচারিক প্রক্রিয়ায় মামলাটির তদন্ত প্রায় তিন দশক বন্ধ থাকল, তাদের জবাবদিহি কীভাবে নিশ্চিত হবে? এ মামলা আবারও মানুষের সামনে বড় করে যে প্রশ্নটি হাজির করেছে তা হলো সমাজ ও রাষ্ট্রে কার বা কাদের ক্ষমতায় আইন-আদালত-পুলিশ-গোয়েন্দা সবাইকে প্রভাবিত করা যায় বা করা হয়? কার বা কাদের নির্দেশে পুলিশ মিথ্যা আসামির নাটক সাজায়? আর কারা নির্দোষ হয়েও ‘জজ মিয়া’, ‘জাহালম’ কিংবা ‘ছিনতাইকারী মিন্টু’ হয়ে বছরের পর বছর বিনা বিচারে জেল খাটেন, সমাজ-সংসার হারিয়ে আমৃত্যু কোন ‘ভুলের’ মাশুল দেন।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যা কিছু করা দরকার তার সবই সরকারকে করতে হবে। বিচারের পথ মসৃণ করা বা দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার কাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখাই গণতান্ত্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্য। আমরা আশা করব, চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডসহ সব অপরাধের দ্রুত এবং সঠিক বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবে।

Suva.muntasir@gmail.com

রবিবার, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ২৬ মাঘ ১৪২৬, ১৪ জমাদিউল সানি ১৪৪১

চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর অগ্রগতি নেই

বিচারের পথ মসৃণ করুন

খন্দকার মুনতাসীর মামুন

বিলম্বিত বিচার মানে বিচারবঞ্চিত হওয়া। এটি বিশ্বজুড়ে প্রচলিত প্রবচন। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, বাংলাদেশে এমন ঘটনাই ঘটছে অহরহ। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচারের অপেক্ষায় ঝুলছে ৩০ লক্ষাধিক মামলা। ঝুলে আছে চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার প্রক্রিয়াও।

১.

২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যেরবাজারে আওয়ামী লীগের ঈদ-পরবর্তী জনসভা শেষে বের হওয়ার পথে গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা শাহ এএমএস কিবরিয়া। চিকিৎসার জন্য ঢাকা নেয়ার পথেই তিনি মারা যান। ওই হামলায় তার ভাতিজা শাহ মঞ্জুরুল হুদা, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা আবদুর রহিম, আবুল হোসেন ও সিদ্দিক আলী নিহত হন। আহত হন ৭০ জন। ঘটনার পরদিন আবদুল মজিদ খান বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা করেন। এরপর কেটে গেল ১৫ বছর। শেষ হলো না বিচার।

২.

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি সাংবাদিক দম্পতিকে ঢাকায় পশ্চিম রাজাবাজার এলাকায় তাদের বাসায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ঘটনার সময় ওই বাসায় থাকা তাদের একমাত্র শিশু সন্তান মাহি সরওয়ার মেঘ বেঁচে যায়। হত্যাকাণ্ডের পর আট বছরে তদন্তে অগ্রগতি নেই। এমন পরিস্থিতিতে সান্ত¡না পাওয়ার পথও খুঁজে পাচ্ছে না সাংবাদিক দম্পতির বিপর্যস্ত পরিবার দুটি।

৩.

২০১৩ সালের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জের শিক্ষার্থী তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে অপহরণ ও খুন করা হয়। ৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা চারারগোপ এলাকার খাল থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের পর দেশজুড়ে আলোড়ন পড়ে যায়। অভিযোগের আঙুল উঠে নারায়ণগঞ্জের একটি অভিজাত পরিবারের দিকে। ক্ষমতাশালী হওয়ার কারণে তাদের কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি।

৪.

২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের চকবাজার তেলিপট্টি এলাকার নিজ বাসার গলির মুখে অঞ্জলি দেবীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া মাদরাসার সাবেক ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। নার্সিং কলেজে ছাত্রীদের হিজাব পরা নিয়ে আন্দোলনের সময় অঞ্জলি দেবীকে আইনি নোটিস দিয়েছিলেন রেজা। অঞ্জলী দেবীর স্বামী রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পুলিশ আসামিদের খুঁজে পায় না, শুধু বারবার আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আমি তাদের পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছি, যেভাবে হত্যাকাণ্ডটি হয়েছে, তাতে আমার মনে হয়েছে এটা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কাজ। পরিষ্কারভাবে পুলিশকে সেই কথাটি বলেছি, কিন্তু তারা কিছুই করেনি।’

৫.

২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রামের জিইসির মোড় এলাকায় ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। এ ঘটনার পর তার স্বামী বাবুল আক্তার বাদি হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন। অস্ত্র আইনের মামলাটি বিচারাধীন থাকলেও মাহমুদা হত্যা মামলায় এখনও অভিযোগপত্র জমা দেয়নি গোয়েন্দা পুলিশ। এখন এ মামলায় কারাগারে কেউ নেই।

৬.

২০১৬ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরে টিউশনি করাতে গিয়ে আর বাসায় ফেরেননি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু। অনেক খোঁজাখুঁজির পর রাতে তনুদের বাসার অদূরে সেনানিবাসের ভেতরের একটি জঙ্গলে তার মরদেহ পায় স্বজনরা। পরদিন তার বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহায়ক ইয়ার হোসেন বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা ঘাতকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। থানা পুলিশ ও ডিবির পর ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল থেকে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। ২০১৭ সালের মে মাসে সিআইডি তনুর জামা-কাপড় থেকে নেয়া নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করে তিনজন পুরুষের শুক্রাণু পাওয়ার কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল। পরে সন্দেহভাজনদের ডিএনএ ম্যাচিং করা হলেও রিপোর্ট আসেনি।

৭.

একের পর এক ব্লগার খুন হয়েছেন। কিন্তু ঘাতকরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এসব খুনের পরিকল্পনাকারী কিংবা হত্যাকারী কেউই গ্রেফতার না হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুধু তাই নয়, এসব হত্যাকাণ্ডের মামলাগুলোর তদন্তেও তেমন কোন অগ্রগতি নেই। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এসে তদন্ত করার পরও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার সুরাহা হয়নি। এটিসহ অন্য মামলাগুলোর তদন্ত থমকে আছে।

উল্লেখিত সব হত্যার ঘটনা দেশে চাঞ্চল্য তৈরি করেছিল। এসব হত্যা মামলার বিচারের দাবিতে সাধারণ মানুষও রাজপথে নেমেছিল। সাগর-রুনি হত্যার ঘটনার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি। চাঞ্চল্যকর এসব হত্যা মামলার কোন কূল-কিনারা করা যায়নি নাকি করা হয়নি- তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। ভিকটিমের স্বজনরা মনে করেন, তদন্তে আসামিদের চিহ্নিত করা গেলেও রাজনৈতিক কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ত্বকী হত্যার ঘটনায় আসামির নামও ঘোষণা করা হয়েছিল। মিতু হত্যার পর তার স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের রহস্যজনক পদত্যাগ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। নিহত সাংবাদিক সাগরের মা সালেহা খানম সন্তান হত্যার বিচার না পেয়ে বলেছেন, ‘রাষ্ট্র যদি না চায় তাহলে তো কারও বের করার ক্ষমতা নেই। সরকারের যদি সদিচ্ছা না থাকে তাহলে আর কী। কত বড় বড় ঘটনা বের হয়ে গেল। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার আসামিদের ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। আর সাগর-রুনির খুনের রহস্য বের হবে না? এসব প্রশ্ন আমাদেরও। সাধারণ হিসাব, বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত না করতে পারলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে না।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আমরা অনেক চাঞ্চল্যকর মামলার দ্রুত সুরাহা করতে দেখেছি। নুসরাত হত্যার ঘটনায় দ্রুত আসামিদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাজনৈতিক চাপমুক্ত হয়ে কাজ করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে ভালো কাজ করতে পারে তার বহু উদাহরণ আছে। উল্লিখিত চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলাগুলোর সুরাহা না হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক অর্জনই ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

বিচার বিলম্বিত হচ্ছে কোথায়? বিলম্বিত হওয়ার অনেকগুলো জায়গা আছে। তদন্তের ধীরগতি, তদন্ত আটকে যাওয়া, বিষয়টি রাজনৈতিক হয়ে যাওয়া। আমরা মনে করি, এই রাজনীতি মানুষের জন্য নয়। এ রাজনীতি নিষ্ঠুরতার, প্রভাব বিস্তারের, ভোগদখলের এবং অমানবিককরণের। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনীতির হর্তাকর্তাবিধাতারা দেশবাসীকে সন্ত্রাস থেকে মুক্তি দিতে চাইছেন কিনা? যদি অপরাধের প্রতিবিধান চাইতেন, তাহলে দলীয় স্বার্থ রক্ষার চেয়ে দেশের কল্যাণ সাধনই প্রধান কর্তব্য বলে বিবেচিত হতো। দলীয় অন্ধত্ব কাটাতে পারলে হয়ত আসুরিক দাপটের বাড়বাড়ন্ত হতো না।

কোন কোন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বারবার বদলানো হয়। পুলিশের অদক্ষতা এবং অজ্ঞতাও অনেক সময় তদন্তকে এগিয়ে যেতে দেয় না। প্রযুক্তির ব্যবহার করে যেখানে দ্রুত অপরাধী শনাক্ত করা যায়, সেখানে পুলিশি তদন্ত পদ্ধতি এখনও মান্ধাতার আমলের ধারায় পরিচালিত হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, হত্যাকাণ্ডের মূল আসামিদের বাদ দিয়ে নিরপরাধীদের আসামি করে চার্জশিট দেয়া হয়। হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারে এমন দক্ষতা পুলিশের মধ্যে গড়ে ওঠেনি।

ফরেনসিক বিভাগের ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক ও মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টদের অবহেলা দেশের আদালতগুলোয় মামলার জট বৃদ্ধির আরেকটি প্রধান কারণ। আদালত ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আদেশ-নির্দেশ, ভুক্তভোগীদের আবেদন-নিবেদনেও সাড়া দিচ্ছেন না মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক। দীর্ঘদিনেও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন (ভিসেরা রিপোর্ট) ও আসামির বয়স নির্ধারণসহ তদন্ত সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিবেদন জমা দিচ্ছেন না তারা। ফলে একদিকে ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে বিচার ঝুলে থাকছে বছরের পর বছর।

ভিকটিমের স্বজনরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অভিযোগ উঠেছে, কোন একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে রক্ষার জন্য চাঞ্চল্যকর অনেক মামলার নিষ্পত্তি করা হয় না। আমরা বলতে চাই, আইন সবার জন্য সমান। নাগরিকদের ন্যায়বিচার দেয়া, অপরাধীর বিচার করা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রহস্য দ্রুত উদ্ঘাটন ও অপরাধীদের গ্রেফতারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সময় সময় পুলিশ ও র‌্যাবপ্রধানদের নির্দেশ দিয়ে থাকে। তবে রাজনৈতিক কারণে অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে কি না, সেদিকেও খতিয়ে দেখতে হবে। এটা মনে রাখা উচিত, অপরাধীর শাস্তি না হলে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে দেশজুড়ে সন্ত্রাসী পক্ষই উৎসাহিত হবে। তখন লাগাম টেনে ধরা কঠিন হবে সব পক্ষের জন্যই। আমরা এ জাতীয় সামাজিক-রাজনৈতিক জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। দেখতে চাই না বহুকথিত গডফাদার পরিচালিত নষ্ট, ভ্রষ্ট ও পচে যাওয়া সমাজ। চাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন সুস্থ সমাজ। চাই মানবিকবোধের সমাজ।

দোষীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা আর নির্দোষের সাজা পাওয়ার দৃষ্টান্ত হয়ে চাঞ্চল্যকর সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলা ৩০ বছর পর আবার সামনে এলো। দীর্ঘ তিন দশক পর চাঞ্চল্যকর সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলার যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত আসামিদের শনাক্ত করা এবং গ্রেফতারের জন্য পিবিআই সাধুবাদ পেতে পারে। ২৮ বছর পর আদালতে মামলাটি সচল করার জন্য সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চও ধন্যবাদ পেতে পারে। কিন্তু একইসঙ্গে এই প্রশ্ন ওঠা সংগত, যে বিচারিক প্রক্রিয়ায় মামলাটির তদন্ত প্রায় তিন দশক বন্ধ থাকল, তাদের জবাবদিহি কীভাবে নিশ্চিত হবে? এ মামলা আবারও মানুষের সামনে বড় করে যে প্রশ্নটি হাজির করেছে তা হলো সমাজ ও রাষ্ট্রে কার বা কাদের ক্ষমতায় আইন-আদালত-পুলিশ-গোয়েন্দা সবাইকে প্রভাবিত করা যায় বা করা হয়? কার বা কাদের নির্দেশে পুলিশ মিথ্যা আসামির নাটক সাজায়? আর কারা নির্দোষ হয়েও ‘জজ মিয়া’, ‘জাহালম’ কিংবা ‘ছিনতাইকারী মিন্টু’ হয়ে বছরের পর বছর বিনা বিচারে জেল খাটেন, সমাজ-সংসার হারিয়ে আমৃত্যু কোন ‘ভুলের’ মাশুল দেন।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যা কিছু করা দরকার তার সবই সরকারকে করতে হবে। বিচারের পথ মসৃণ করা বা দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার কাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখাই গণতান্ত্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্য। আমরা আশা করব, চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডসহ সব অপরাধের দ্রুত এবং সঠিক বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবে।

Suva.muntasir@gmail.com