আওয়ামী লীগে কোন গুণগত পরিবর্তন হয়েছে কি?

এএন রাশেদা

গত ২৪ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদ-এ ‘মুজিব শতবর্ষ’ কলামে প্রকাশিত হয়েছে নিম্নোক্ত খবরটি যা আবার প্রকাশিত হয়েছিল ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৫৭ দৈনিক সংবাদেই। খবরটির শিরোনাম ছিল “খুলনায় পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ২৪ জন নেতা ও কর্মী গ্রেফতার/আওয়ামী লীগের গুণ্ডামিতে শহরে ত্রাসের রাজত্ব : ১৪৪ ধারা জারি”। ৪ সেপ্টেম্বর নিজস্ব সংবাদদাতা কর্তৃক টেলিফোনে প্রেরিত সংবাদে বলা হয়েছিল : ‘গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে খুলনায় অস্ত্রসহ বাবু বীরেন দাস এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কর্মী জনাব ফেরদৌস ও গফুরসহ ২৪ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জেলা কর্তৃপক্ষ শহরে ১৪৪ ধারা জারি করিয়া ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি আয়োজিত সভা বন্ধ করিয়া দিয়াছেন। ... ফলে শহরে ত্রাসের রাজত্ব বিরাজ করিতেছে। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, গতকল্য মুজিবুর রহমান যখন গুটি কয়েক সমর্থক সমবিভ্যাহারে এখানে সভা করিতে আসেন তখন আওয়ামী লীগ কর্তৃক ২১ দফা ওয়াদা খেলাফে বিক্ষুব্ধ এক জনতা সমবেত হইয়া তাহাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করিয়া তোলে এবং স্থানীয় শ্রমিক দল কর্তৃক শেখ মুজিবের সমীপে লিখিত একটি খোলা চিঠি বিলি করা হয়। জনাব মুজিবুর রহমানের ক্রমাগত হুংকারে যখন জনতা তাদের রুটি ও রুজির সহিত জড়িত নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসায় বিরত হইতে অস্বীকার করে, তখন পূর্ব হইতে আমদানিকৃত একদল গুণ্ডা লাঠি ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র লইয়া নিরস্ত্র জনতার ওপর ঝাঁপাইয়া পড়ে। কিন্তু জনতার প্রতিরোধে গুণ্ডাদল শেষ পর্যন্ত সরিয়া পড়িতে বাধ্য হয়। গুণ্ডাদলের বুহ্য রচনা করিয়া যখন সভা করা সম্ভব হইল না, তখন শেখ মুজিব সভাস্থল ত্যাগ করেন। ... তখন জনতা মুহুর্মুহু ‘বিশ্বাসঘাতক আওয়ামী লীগ ধ্বংস হোক; কুচক্রী দল ফিরিয়া যাও; গণতান্ত্রিক দল জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করিয়া তোলে। জনসভায় নিরস্ত্র জনতার ওপর গুণ্ডা লেলাইয়া দেয়ার প্রতিবাদে অদ্য সকালের দিকে একটি শোভাযাত্রা বাহির হইলে ... পুনরায় অংশগ্রহণকারী জনতার ওপর ইস্টক ও সোডার বোতল নিক্ষেপ করিতে থাকে। ... আওয়ামী গুণ্ডাদল অদ্য স্থানীয় ন্যাশনাল পার্টির জনৈক কর্মীর পুস্তকের দোকান মডার্ন লাইব্রেরিতেও হামলা করে। আওয়ামী লীগের গুণ্ডামিতে খুলনায় ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক মহলে দারুণ ক্ষোভের সঞ্চার হইয়াছে ...। তারযোগে অপর এক খবরে প্রকাশ, অদ্য ১০ হাজার ছাত্র, শ্রমিক ও জনসাধারণ শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা সহকারে খুলনা শহর প্রদক্ষিণ করিয়া শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। উল্লেখ্য যে, গতকল্য জনাব মুজিবুর এখানে আওয়ামী লীগের এক জনসভায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বিরুদ্ধে বিষোদগার ও উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা দেন।

উল্লেখ্য যে, উক্ত সময়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেই খুলনায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ওপর হামলা চালিয়েছিল। অথচ ’৫৪ সালে একে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যুক্তফ্রন্ট গঠন করে স্বৈরাচারী মুসলিম লীগ সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। আবার ১৯৫৭ সালের ২৬-২৭ জুলাই সম্মেলনের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হয়েছিল, যেখানে কমিউনিস্ট পার্টির অনেক সদস্য প্রকাশ্যে কাজ শুরু করেছিলেন।

১৯৫৮ সালে মার্শাল ’ল জারি করে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে। ১৯৬২ সালে ছাত্রসমাজ শিক্ষা সঙ্কোচন নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে। এরই ধারাবাহিকতায় এলো ১৯৬৯, ১৯৭০। সে কথা পরে বলব।

১৯৭১-এ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এলো এ স্বাধীনতা। এই স্বাধীন দেশে আজও সেইসব অন্যায় ও অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ অব্যাহত আছে এবং আরও বিকশিত হয়েছে। পত্রিকার পাতায় প্রায় প্রতিদিনই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তপনার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। গত ২৩ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এ প্রকাশিত হয়েছে ‘ঢাবি’-র হলে পিটিয়ে চার ছাত্রকে পুলিশে দিল ছাত্রলীগ’, ‘ছাত্রলীগে দুই দফায় সংঘর্ষ/চবিতে অবরোধ’, ‘ক্যাসিনো ব্রাদার্সের ১৩০ ফ্ল্যাটের খোঁজ’- অর্থাৎ গেন্ডারিয়া আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকের কাহিনী; ২৪ জানুয়ারি দৈনিক ‘প্রথম আলো’তে প্রকাশিত হয়েছে ‘পাঁচ বছরে ছাত্রলীগের বিভিন্ন উপপক্ষের মধ্যে অন্তত দেড়’শ বার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।’ এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত হচ্ছে সব ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের টর্চার সেল আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের জ্ঞাতসারেই। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবরারকে মারতে মারতে মেরেই ফেলা হলো নৃশংসভাবে। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি দখল, বাড়ি দখল, নারীর ওপর পৈশাচিক নির্যাতন, নদী দখল, অবৈধ বালু উত্তোলন- এহেন অপরাধ নেই, যা তারা করে না। এসব কাহিনী আরব্য রজনীর গল্পের মত, শেষ হবার নয়। আওয়ামী লীগ নেতাদের পুকুর চুরি, সমুদ্র চুরি, টাকা পাচারের ঘটনা এখন সারাদেশ জুড়ে এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখে, সবার মুখে মুখে। প্রশ্ন জাগে, এইসব চেহারা কি শুধুই ২০২০ সালের? উত্তর ‘না’। আমার ব্যক্তিগত জীবনে ১৯৬৮ সাল থেকে দেখছি, তখন যদিও মাত্রায় কম ছিল, তার বেশিরভাগ ছিল গুণ্ডামিতে। আর স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি দেখছি -ছাত্রলীগের মুর্খতা, স্বার্থপরতা, হিংস্রতা, অর্থললুপতা। ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ যখন দুর্বল হয় তখন বোঝে ঐক্যবদ্ধতার প্রয়োজনীয়তা। তাদের এই আচরণ মনে করিয়ে দেয় ওই ধূর্ত শেয়ালের গল্প। যে শেয়াল এক কুয়োর ভেতর পড়ে গিয়েছিল। এক পিপাসার্ত ছাগল সেই কুয়োর ভেতর তাকাতে গেলে -শেয়াল বলে উঠল, এসো ভাই পানি খুব মিষ্টি। ছাগল ঝাপ দিল আর শেয়াল তার মাথায় পা রেখে কুয়ো থেকে বেরিয়ে এলো। ছাত্রলীগ আর আওয়ামী লীগের ইতিহাস সে কথাই বলে। আইয়ুব খানের মার্শাল’ল থেকে পরিত্রাণের জন্য ছাত্রলীগ ঐক্যের কথা ভেবেছিল। বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা তৎকালীন ডাকসু’র ভিপি তোফায়েল আহমেদের “ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলি” শিরোনামে তার স্মৃতিচারণে তা আছে, তিনি লিখেছেন : “৬৯-এর জানুয়ারি ৪টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে ঐতিহাসিক ১১ দফার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়- ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।’ ডাকসু ভিপি’র কক্ষে বসেই আমরা ১১ দফার ভিত্তিতে গণআন্দোলন শুরু করি। আজ যখন স্মৃতিকথা লিখছি, বারবার মনে পড়ছে ’৬৯-এর ১১ দফা প্রণেতাদের- ছাত্রলীগ সভাপতি প্রয়াত আবদুর রউফ ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মো. আলী, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি প্রয়াত সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দোহা, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ, এনএসএফ- একাংশের সভাপতি প্রয়াত ইব্রাহীম খলিল ও সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম মুন্সীর কথা। এ ছাত্র নেতাদের প্রত্যেকেই ছিলেন খ্যাতিমান ও বড় নেতা। আমি ডাকসুর ভিপি হিসেবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করি; সঙ্গে ছিলেন ডাকসু’র জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী”। তোফায়েল আহমেদের মুখ থেকেই শোনা গেল তৎকালীন ছাত্রনেতাদের অবদানের কথা। তিনি আরও বলেন, “জনরোষের ভয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান সব রাজবন্দিদের মুক্তি দিলেন। ” এখানেই প্রশ্নজ্জএই জনরোষ কি ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের একার সৃষ্টি ছিল? তা তো না। তাই সেই নাজিম কামরানকেই একদিন এক টেলিভিশন চ্যানেলে ক্ষোভের সঙ্গে বলতে শোনা গেল- “আমাদের সবার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে সব রাজবন্দি মুক্তি পেলেন, অথচ ২৩ ফেব্রুয়ারিতে শুধু শেখ মুজিবকে নিয়ে সংবর্ধনার আয়োজন করা হলো আমাদের না জানিয়েই।” বলতে হয় সেই ধূর্ত শেয়ালের মতোই আচরণ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের। অথচ ৬ দফার আন্দোলন গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করেনি, করেছিল সব ছাত্র সংগঠনের ১১ দফা। ’৫২ থেকে ’৬৯ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই ছিল সব দলের অংশগ্রহণ, জামায়াত-শিবির ছাড়া। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান না হলে রাজবন্দিদের মুক্তি হতো না। তৎকালীন শেখ মুজিবের তো নয়ই, সে কথা তোফায়েল আহমেদও স্বীকার করেছেন। সেদিন কমিউনিস্ট পার্টির কিংবদন্তি নেতা মণি সিংহ, তেভাগা আন্দোলনের মণি কৃষ্ণ সেন, কমরেড মন্মথ দে, কমরেড সন্তোষ ব্যানার্জী, কমরেড অমল সেন প্রমুখ নেতারা মুক্তি পেয়েছিলেন।

এরই প্রেক্ষিতে এলো ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন। আর আওয়ামী লীগ পেল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। বঙ্গবন্ধুই হলেন বাঙালির একক কণ্ঠস্বর। ২৫ মার্চ রাতে শুরু হলো পাক আর্মির নিধনযজ্ঞ। রাত ১২টার পর বঙ্গবন্ধু দিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা। তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমেদ এবং অন্যান্য নেতাদের বিচক্ষণতায় মরণপণ যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন তারা, ভারতের মাটিতে। তবে কমিউনিস্ট পার্টিরও ছিল ব্যাপক অংশগ্রহণ। শুধু ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী নয়; ছিল ভারতের সিপিআই (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া) ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক ব্লকের সম্পৃক্ততা। কমিউনিস্ট পার্টি আন্তর্জাতিক পার্টি। সে জন্যই তার নাম বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি। সে সময়ে ভারতের কংগ্রেস সরকারে সিপিআই-র সম্পৃক্ততা ছিল। তাই তাজউদ্দিন সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা প্রদানের ব্যাপারে সিপিআই-এর ছিল অনন্য ভূমিকা। সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার যে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলেন- সেখানে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির- সাংবাদিক বজলুর রহমান, ডা. সারওয়ার আলী, ন্যাপের নুরুদ্দিন আহমেদ এবং আওয়ামী লীগের আবদুস সামাদ আজাদ (যিনি পূর্বে কমিউনিস্ট পার্টিরই ছিলেন)। মুক্তিযুদ্ধ শুধু আওয়ামী লীগেরই ছিল-এমন একটি প্রচারণার মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠনের। তাই মাওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, মোজাফ্ফর আহমেদ ও মনোরঞ্জন ধরকে সেই কমিটিতে রাখা হয়েছিল- ছবি তুলে বিশ্বকে দেখানোর জন্য। সে কমিটির কোনো সভা আর কখনোই হয়নি এবং স্বাধীনতার পরও তাদের কোনো পরামর্শ বঙ্গবন্ধু নেননি। তবে রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “একটি দল ঐক্য ঐক্য করিয়া আমার মাথা খাইয়া ফেলছে; যদি ঐক্যের প্রয়োজন থাকে তাহলে সাইনবোর্ড পাল্টাইয়া আমার দলে যোগ দিন।” বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানটি ১৯৬৯ সালে ছাত্র সমাজের ১১ দফা তৈরির আগে দিলেন না কেন?- সে প্রশ্ন তো আসতেই পারে।

যাহোক, ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ‘ডাকসু’ নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিল। ভিপি পদে আজকের সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, জিএস পদে মাহবুব জামান, নাট্য সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন ম. হামিদ, নিরঞ্জন অধিকারী, শহিদুল আলম বাদলসহ (প্রয়াত) অন্যরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে নাটক, আবৃত্তি, গান, গল্প বলা প্রভৃতি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন আর কার্জন হলে প্রতি ডিপার্টমেন্টে বিজ্ঞান প্রদর্শনীর আয়োজন- শিক্ষার্থীদের ভীষণভাবে আলোড়িত করেছিল।

অথচ পরের বছর ১৯৭৩-এ ডাকসু-তে লেনিন-গামা পরিষদ (অর্থাৎ ভিপি প্রার্থী ছাত্র ইউনিয়নের নূহ-উল-আলম লেনিন ও জিএস প্রার্থী ছাত্রলীগের ইসমত কাদির গামার যৌথ প্যানেল) গঠন করে সাধারণ ছাত্রদের বুকে ছাত্র ইউনিয়ন কঠিন আঘাত দিয়েছিল। আসলে যা পদাঘাতেরই সামিল। কথায় বলে সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। তাই ডাকসু’র ব্যালট বাক্স ছিনতাই হলো, আর ছাত্র ইউনিয়নের বিনাশ শুরু হলো। পঁচাত্তর পরবর্তী কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন- আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগকে কুয়া থেকে উঠতে মাথা পেতে দিয়েছিল। আজ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ ১৯৫৭ সালের সেই চেহারাতেই ফিরে গেছে। তাই আজকাল ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির সব কর্মসূচিতে পুলিশ দিয়ে পেটানো হয়। কর্মীদের মাথা, পা ভেঙে দেয়া হয়। অথচ যারা বারংবার কৃষককে স্বর্বস্বান্ত করছে ধানের ন্যায্যমূল্য না দিয়ে, শ্রমিকদের হরহামেশাই বেতন না দিয়ে কলকারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে, শেয়ার বাজারে মানুষকে পথের ভিখেরি বানাচ্ছে, টাকা পাচার করছে, আবার কেউ কেউ দেশকে ধর্মান্ধতার পথে নিয়ে যাচ্ছে- অথচ তাদের গায়ে টোকা দেয়া হয় না। তারা যতই বিজ্ঞানকে অস্বীকার করুক, বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধিৎসুতার বিরুদ্ধে বিষোদগার করুক, মেয়েদের তেতুলের সঙ্গে তুলনা করুক, তাতে কিছু যায় আসে না। যে কথা বলছিলাম- ১৯৭২ সালে ডাকসু শিক্ষার্থীদের মাঝে সাংস্কৃতিক বিকাশে যেসব কার্যক্রম নিয়েছিল ছাত্র ইউনিয়নও সেভাবেই নিয়েছিল। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন স্লোগান দিয়েছিল : ‘লাখো শহীদের আত্মদানে মুক্ত স্বদেশ, এসো মোরা দেশ গড়ি’। তখন বুয়েটে ছাত্রলীগ ব্যঙ্গ করে স্লোগান দিয়েছিল- ‘আঁচলে আঁচলে ধরি, এসো মোরা দেশ গড়ি’। শুনতে কষ্ট হলেও তার নেতৃত্বে ছিলেন শেখ কামাল নিজেই। অর্থাৎ অধিকাংশ মেয়েরা ছাত্র ইউনিয়ন করতো। কারণ ছাত্রীরা নিরাপদ মনে করতো, কাজেই তাদের ব্যঙ্গ করে ঐ স্লোগান। সেই সময় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ‘দশ দফার আন্দোলন’ ঘোষণা করেছিল- ভুয়া তাঁতি ধরা, ভুয়া, রেশন কার্ড ধরা, গ্রামে গ্রামে গিয়ে নিরক্ষরতা দূর করার কাজে অংশ নেয়া ইত্যাদি। অথচ সেই দশ দফার আন্দোলনে ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ ছিল খুবই ম্রিয়মান।

পরিশেষে বলতে হয়, আজ দেশ আবারও পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণায় চলে গেছে। বাইশ পরিবারের জায়গায় বাইশ’শ বা তারও বেশি পরিবারের জন্ম হয়েছে। গরিব মারা ও ধনিক তোষণ নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। শাসকগোষ্ঠীর পশ্চাৎমুখী ধ্যান-ধারণা ও অবৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনা মানুষের প্রশ্ন করার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নেই। স্কুলসমূহ যেমন ধনী দরিদ্রে ভাগ হয়েছে তেমনি ভেতরেও হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টানে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। পাকিস্তান আমলেও যা ছিল না- সেই ধর্মশিক্ষা আজ বাধ্যতামূলক হয়েছে। কার্যত আওয়ামী লীগ তার পূর্ব পরিচয়ে ফিরে গেছে- ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। সংবিধানে অঙ্গীকারাবদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি তাদের কাছে গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই ১৯৫৭ আর ২০২০ সাল আজ সমার্থক হয়ে গেছে- মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থাশীলদের কাছে। ১৯৭৩-এর ভুল আর যেন কোনো সময়ই না হয়।

[লেখক : সাবেক অধ্যাপক, নটরডেম কলেজ, সম্পাদক শিক্ষাবার্তা]

বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ২৯ মাঘ ১৪২৬, ১৭ জমাদিউল সানি ১৪৪১

আওয়ামী লীগে কোন গুণগত পরিবর্তন হয়েছে কি?

এএন রাশেদা

গত ২৪ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদ-এ ‘মুজিব শতবর্ষ’ কলামে প্রকাশিত হয়েছে নিম্নোক্ত খবরটি যা আবার প্রকাশিত হয়েছিল ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৫৭ দৈনিক সংবাদেই। খবরটির শিরোনাম ছিল “খুলনায় পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ২৪ জন নেতা ও কর্মী গ্রেফতার/আওয়ামী লীগের গুণ্ডামিতে শহরে ত্রাসের রাজত্ব : ১৪৪ ধারা জারি”। ৪ সেপ্টেম্বর নিজস্ব সংবাদদাতা কর্তৃক টেলিফোনে প্রেরিত সংবাদে বলা হয়েছিল : ‘গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে খুলনায় অস্ত্রসহ বাবু বীরেন দাস এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কর্মী জনাব ফেরদৌস ও গফুরসহ ২৪ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জেলা কর্তৃপক্ষ শহরে ১৪৪ ধারা জারি করিয়া ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি আয়োজিত সভা বন্ধ করিয়া দিয়াছেন। ... ফলে শহরে ত্রাসের রাজত্ব বিরাজ করিতেছে। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, গতকল্য মুজিবুর রহমান যখন গুটি কয়েক সমর্থক সমবিভ্যাহারে এখানে সভা করিতে আসেন তখন আওয়ামী লীগ কর্তৃক ২১ দফা ওয়াদা খেলাফে বিক্ষুব্ধ এক জনতা সমবেত হইয়া তাহাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করিয়া তোলে এবং স্থানীয় শ্রমিক দল কর্তৃক শেখ মুজিবের সমীপে লিখিত একটি খোলা চিঠি বিলি করা হয়। জনাব মুজিবুর রহমানের ক্রমাগত হুংকারে যখন জনতা তাদের রুটি ও রুজির সহিত জড়িত নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসায় বিরত হইতে অস্বীকার করে, তখন পূর্ব হইতে আমদানিকৃত একদল গুণ্ডা লাঠি ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র লইয়া নিরস্ত্র জনতার ওপর ঝাঁপাইয়া পড়ে। কিন্তু জনতার প্রতিরোধে গুণ্ডাদল শেষ পর্যন্ত সরিয়া পড়িতে বাধ্য হয়। গুণ্ডাদলের বুহ্য রচনা করিয়া যখন সভা করা সম্ভব হইল না, তখন শেখ মুজিব সভাস্থল ত্যাগ করেন। ... তখন জনতা মুহুর্মুহু ‘বিশ্বাসঘাতক আওয়ামী লীগ ধ্বংস হোক; কুচক্রী দল ফিরিয়া যাও; গণতান্ত্রিক দল জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করিয়া তোলে। জনসভায় নিরস্ত্র জনতার ওপর গুণ্ডা লেলাইয়া দেয়ার প্রতিবাদে অদ্য সকালের দিকে একটি শোভাযাত্রা বাহির হইলে ... পুনরায় অংশগ্রহণকারী জনতার ওপর ইস্টক ও সোডার বোতল নিক্ষেপ করিতে থাকে। ... আওয়ামী গুণ্ডাদল অদ্য স্থানীয় ন্যাশনাল পার্টির জনৈক কর্মীর পুস্তকের দোকান মডার্ন লাইব্রেরিতেও হামলা করে। আওয়ামী লীগের গুণ্ডামিতে খুলনায় ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক মহলে দারুণ ক্ষোভের সঞ্চার হইয়াছে ...। তারযোগে অপর এক খবরে প্রকাশ, অদ্য ১০ হাজার ছাত্র, শ্রমিক ও জনসাধারণ শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা সহকারে খুলনা শহর প্রদক্ষিণ করিয়া শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। উল্লেখ্য যে, গতকল্য জনাব মুজিবুর এখানে আওয়ামী লীগের এক জনসভায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বিরুদ্ধে বিষোদগার ও উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা দেন।

উল্লেখ্য যে, উক্ত সময়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেই খুলনায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ওপর হামলা চালিয়েছিল। অথচ ’৫৪ সালে একে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যুক্তফ্রন্ট গঠন করে স্বৈরাচারী মুসলিম লীগ সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। আবার ১৯৫৭ সালের ২৬-২৭ জুলাই সম্মেলনের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হয়েছিল, যেখানে কমিউনিস্ট পার্টির অনেক সদস্য প্রকাশ্যে কাজ শুরু করেছিলেন।

১৯৫৮ সালে মার্শাল ’ল জারি করে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে। ১৯৬২ সালে ছাত্রসমাজ শিক্ষা সঙ্কোচন নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে। এরই ধারাবাহিকতায় এলো ১৯৬৯, ১৯৭০। সে কথা পরে বলব।

১৯৭১-এ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এলো এ স্বাধীনতা। এই স্বাধীন দেশে আজও সেইসব অন্যায় ও অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ অব্যাহত আছে এবং আরও বিকশিত হয়েছে। পত্রিকার পাতায় প্রায় প্রতিদিনই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তপনার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। গত ২৩ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এ প্রকাশিত হয়েছে ‘ঢাবি’-র হলে পিটিয়ে চার ছাত্রকে পুলিশে দিল ছাত্রলীগ’, ‘ছাত্রলীগে দুই দফায় সংঘর্ষ/চবিতে অবরোধ’, ‘ক্যাসিনো ব্রাদার্সের ১৩০ ফ্ল্যাটের খোঁজ’- অর্থাৎ গেন্ডারিয়া আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকের কাহিনী; ২৪ জানুয়ারি দৈনিক ‘প্রথম আলো’তে প্রকাশিত হয়েছে ‘পাঁচ বছরে ছাত্রলীগের বিভিন্ন উপপক্ষের মধ্যে অন্তত দেড়’শ বার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।’ এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত হচ্ছে সব ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের টর্চার সেল আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের জ্ঞাতসারেই। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবরারকে মারতে মারতে মেরেই ফেলা হলো নৃশংসভাবে। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি দখল, বাড়ি দখল, নারীর ওপর পৈশাচিক নির্যাতন, নদী দখল, অবৈধ বালু উত্তোলন- এহেন অপরাধ নেই, যা তারা করে না। এসব কাহিনী আরব্য রজনীর গল্পের মত, শেষ হবার নয়। আওয়ামী লীগ নেতাদের পুকুর চুরি, সমুদ্র চুরি, টাকা পাচারের ঘটনা এখন সারাদেশ জুড়ে এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখে, সবার মুখে মুখে। প্রশ্ন জাগে, এইসব চেহারা কি শুধুই ২০২০ সালের? উত্তর ‘না’। আমার ব্যক্তিগত জীবনে ১৯৬৮ সাল থেকে দেখছি, তখন যদিও মাত্রায় কম ছিল, তার বেশিরভাগ ছিল গুণ্ডামিতে। আর স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি দেখছি -ছাত্রলীগের মুর্খতা, স্বার্থপরতা, হিংস্রতা, অর্থললুপতা। ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ যখন দুর্বল হয় তখন বোঝে ঐক্যবদ্ধতার প্রয়োজনীয়তা। তাদের এই আচরণ মনে করিয়ে দেয় ওই ধূর্ত শেয়ালের গল্প। যে শেয়াল এক কুয়োর ভেতর পড়ে গিয়েছিল। এক পিপাসার্ত ছাগল সেই কুয়োর ভেতর তাকাতে গেলে -শেয়াল বলে উঠল, এসো ভাই পানি খুব মিষ্টি। ছাগল ঝাপ দিল আর শেয়াল তার মাথায় পা রেখে কুয়ো থেকে বেরিয়ে এলো। ছাত্রলীগ আর আওয়ামী লীগের ইতিহাস সে কথাই বলে। আইয়ুব খানের মার্শাল’ল থেকে পরিত্রাণের জন্য ছাত্রলীগ ঐক্যের কথা ভেবেছিল। বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা তৎকালীন ডাকসু’র ভিপি তোফায়েল আহমেদের “ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলি” শিরোনামে তার স্মৃতিচারণে তা আছে, তিনি লিখেছেন : “৬৯-এর জানুয়ারি ৪টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে ঐতিহাসিক ১১ দফার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়- ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।’ ডাকসু ভিপি’র কক্ষে বসেই আমরা ১১ দফার ভিত্তিতে গণআন্দোলন শুরু করি। আজ যখন স্মৃতিকথা লিখছি, বারবার মনে পড়ছে ’৬৯-এর ১১ দফা প্রণেতাদের- ছাত্রলীগ সভাপতি প্রয়াত আবদুর রউফ ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মো. আলী, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি প্রয়াত সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দোহা, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ, এনএসএফ- একাংশের সভাপতি প্রয়াত ইব্রাহীম খলিল ও সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম মুন্সীর কথা। এ ছাত্র নেতাদের প্রত্যেকেই ছিলেন খ্যাতিমান ও বড় নেতা। আমি ডাকসুর ভিপি হিসেবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করি; সঙ্গে ছিলেন ডাকসু’র জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী”। তোফায়েল আহমেদের মুখ থেকেই শোনা গেল তৎকালীন ছাত্রনেতাদের অবদানের কথা। তিনি আরও বলেন, “জনরোষের ভয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান সব রাজবন্দিদের মুক্তি দিলেন। ” এখানেই প্রশ্নজ্জএই জনরোষ কি ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের একার সৃষ্টি ছিল? তা তো না। তাই সেই নাজিম কামরানকেই একদিন এক টেলিভিশন চ্যানেলে ক্ষোভের সঙ্গে বলতে শোনা গেল- “আমাদের সবার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে সব রাজবন্দি মুক্তি পেলেন, অথচ ২৩ ফেব্রুয়ারিতে শুধু শেখ মুজিবকে নিয়ে সংবর্ধনার আয়োজন করা হলো আমাদের না জানিয়েই।” বলতে হয় সেই ধূর্ত শেয়ালের মতোই আচরণ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের। অথচ ৬ দফার আন্দোলন গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করেনি, করেছিল সব ছাত্র সংগঠনের ১১ দফা। ’৫২ থেকে ’৬৯ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই ছিল সব দলের অংশগ্রহণ, জামায়াত-শিবির ছাড়া। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান না হলে রাজবন্দিদের মুক্তি হতো না। তৎকালীন শেখ মুজিবের তো নয়ই, সে কথা তোফায়েল আহমেদও স্বীকার করেছেন। সেদিন কমিউনিস্ট পার্টির কিংবদন্তি নেতা মণি সিংহ, তেভাগা আন্দোলনের মণি কৃষ্ণ সেন, কমরেড মন্মথ দে, কমরেড সন্তোষ ব্যানার্জী, কমরেড অমল সেন প্রমুখ নেতারা মুক্তি পেয়েছিলেন।

এরই প্রেক্ষিতে এলো ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন। আর আওয়ামী লীগ পেল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। বঙ্গবন্ধুই হলেন বাঙালির একক কণ্ঠস্বর। ২৫ মার্চ রাতে শুরু হলো পাক আর্মির নিধনযজ্ঞ। রাত ১২টার পর বঙ্গবন্ধু দিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা। তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমেদ এবং অন্যান্য নেতাদের বিচক্ষণতায় মরণপণ যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন তারা, ভারতের মাটিতে। তবে কমিউনিস্ট পার্টিরও ছিল ব্যাপক অংশগ্রহণ। শুধু ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী নয়; ছিল ভারতের সিপিআই (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া) ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক ব্লকের সম্পৃক্ততা। কমিউনিস্ট পার্টি আন্তর্জাতিক পার্টি। সে জন্যই তার নাম বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি। সে সময়ে ভারতের কংগ্রেস সরকারে সিপিআই-র সম্পৃক্ততা ছিল। তাই তাজউদ্দিন সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা প্রদানের ব্যাপারে সিপিআই-এর ছিল অনন্য ভূমিকা। সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার যে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলেন- সেখানে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির- সাংবাদিক বজলুর রহমান, ডা. সারওয়ার আলী, ন্যাপের নুরুদ্দিন আহমেদ এবং আওয়ামী লীগের আবদুস সামাদ আজাদ (যিনি পূর্বে কমিউনিস্ট পার্টিরই ছিলেন)। মুক্তিযুদ্ধ শুধু আওয়ামী লীগেরই ছিল-এমন একটি প্রচারণার মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠনের। তাই মাওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, মোজাফ্ফর আহমেদ ও মনোরঞ্জন ধরকে সেই কমিটিতে রাখা হয়েছিল- ছবি তুলে বিশ্বকে দেখানোর জন্য। সে কমিটির কোনো সভা আর কখনোই হয়নি এবং স্বাধীনতার পরও তাদের কোনো পরামর্শ বঙ্গবন্ধু নেননি। তবে রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “একটি দল ঐক্য ঐক্য করিয়া আমার মাথা খাইয়া ফেলছে; যদি ঐক্যের প্রয়োজন থাকে তাহলে সাইনবোর্ড পাল্টাইয়া আমার দলে যোগ দিন।” বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানটি ১৯৬৯ সালে ছাত্র সমাজের ১১ দফা তৈরির আগে দিলেন না কেন?- সে প্রশ্ন তো আসতেই পারে।

যাহোক, ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ‘ডাকসু’ নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিল। ভিপি পদে আজকের সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, জিএস পদে মাহবুব জামান, নাট্য সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন ম. হামিদ, নিরঞ্জন অধিকারী, শহিদুল আলম বাদলসহ (প্রয়াত) অন্যরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে নাটক, আবৃত্তি, গান, গল্প বলা প্রভৃতি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন আর কার্জন হলে প্রতি ডিপার্টমেন্টে বিজ্ঞান প্রদর্শনীর আয়োজন- শিক্ষার্থীদের ভীষণভাবে আলোড়িত করেছিল।

অথচ পরের বছর ১৯৭৩-এ ডাকসু-তে লেনিন-গামা পরিষদ (অর্থাৎ ভিপি প্রার্থী ছাত্র ইউনিয়নের নূহ-উল-আলম লেনিন ও জিএস প্রার্থী ছাত্রলীগের ইসমত কাদির গামার যৌথ প্যানেল) গঠন করে সাধারণ ছাত্রদের বুকে ছাত্র ইউনিয়ন কঠিন আঘাত দিয়েছিল। আসলে যা পদাঘাতেরই সামিল। কথায় বলে সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। তাই ডাকসু’র ব্যালট বাক্স ছিনতাই হলো, আর ছাত্র ইউনিয়নের বিনাশ শুরু হলো। পঁচাত্তর পরবর্তী কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন- আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগকে কুয়া থেকে উঠতে মাথা পেতে দিয়েছিল। আজ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ ১৯৫৭ সালের সেই চেহারাতেই ফিরে গেছে। তাই আজকাল ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির সব কর্মসূচিতে পুলিশ দিয়ে পেটানো হয়। কর্মীদের মাথা, পা ভেঙে দেয়া হয়। অথচ যারা বারংবার কৃষককে স্বর্বস্বান্ত করছে ধানের ন্যায্যমূল্য না দিয়ে, শ্রমিকদের হরহামেশাই বেতন না দিয়ে কলকারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে, শেয়ার বাজারে মানুষকে পথের ভিখেরি বানাচ্ছে, টাকা পাচার করছে, আবার কেউ কেউ দেশকে ধর্মান্ধতার পথে নিয়ে যাচ্ছে- অথচ তাদের গায়ে টোকা দেয়া হয় না। তারা যতই বিজ্ঞানকে অস্বীকার করুক, বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধিৎসুতার বিরুদ্ধে বিষোদগার করুক, মেয়েদের তেতুলের সঙ্গে তুলনা করুক, তাতে কিছু যায় আসে না। যে কথা বলছিলাম- ১৯৭২ সালে ডাকসু শিক্ষার্থীদের মাঝে সাংস্কৃতিক বিকাশে যেসব কার্যক্রম নিয়েছিল ছাত্র ইউনিয়নও সেভাবেই নিয়েছিল। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন স্লোগান দিয়েছিল : ‘লাখো শহীদের আত্মদানে মুক্ত স্বদেশ, এসো মোরা দেশ গড়ি’। তখন বুয়েটে ছাত্রলীগ ব্যঙ্গ করে স্লোগান দিয়েছিল- ‘আঁচলে আঁচলে ধরি, এসো মোরা দেশ গড়ি’। শুনতে কষ্ট হলেও তার নেতৃত্বে ছিলেন শেখ কামাল নিজেই। অর্থাৎ অধিকাংশ মেয়েরা ছাত্র ইউনিয়ন করতো। কারণ ছাত্রীরা নিরাপদ মনে করতো, কাজেই তাদের ব্যঙ্গ করে ঐ স্লোগান। সেই সময় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ‘দশ দফার আন্দোলন’ ঘোষণা করেছিল- ভুয়া তাঁতি ধরা, ভুয়া, রেশন কার্ড ধরা, গ্রামে গ্রামে গিয়ে নিরক্ষরতা দূর করার কাজে অংশ নেয়া ইত্যাদি। অথচ সেই দশ দফার আন্দোলনে ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ ছিল খুবই ম্রিয়মান।

পরিশেষে বলতে হয়, আজ দেশ আবারও পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণায় চলে গেছে। বাইশ পরিবারের জায়গায় বাইশ’শ বা তারও বেশি পরিবারের জন্ম হয়েছে। গরিব মারা ও ধনিক তোষণ নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। শাসকগোষ্ঠীর পশ্চাৎমুখী ধ্যান-ধারণা ও অবৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনা মানুষের প্রশ্ন করার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নেই। স্কুলসমূহ যেমন ধনী দরিদ্রে ভাগ হয়েছে তেমনি ভেতরেও হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টানে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। পাকিস্তান আমলেও যা ছিল না- সেই ধর্মশিক্ষা আজ বাধ্যতামূলক হয়েছে। কার্যত আওয়ামী লীগ তার পূর্ব পরিচয়ে ফিরে গেছে- ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। সংবিধানে অঙ্গীকারাবদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি তাদের কাছে গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই ১৯৫৭ আর ২০২০ সাল আজ সমার্থক হয়ে গেছে- মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থাশীলদের কাছে। ১৯৭৩-এর ভুল আর যেন কোনো সময়ই না হয়।

[লেখক : সাবেক অধ্যাপক, নটরডেম কলেজ, সম্পাদক শিক্ষাবার্তা]