পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার কেন বন্ধ করবেন?

নিগার সুলতানা সুপ্তি

তথ্য-প্রযুক্তির এ যুগে সবকিছুই যেন আমাদের হাতের মুঠোয়। যেকোনো সমস্যা সমাধানের বুদ্ধিমত্তাই প্রমাণ করে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব। কিন্তু এত কিছুর পরও কিছু দিক দিয়ে আমরা যেন খুবই অসহায়। পৃথিবী আর মানবসভ্যতার বয়স দিনকে দিন যত বাড়ছে, আমরা ততই কিছু অমীমাংসিত সমস্যার সম্মুখীন হয়ে চলছি, যার সমাধান বের করতে গিয়ে প্রায়শই আমাদের অনেক জটিলতার বাধা পেরোতে হচ্ছে। বিশ্বের বড় বড় নেতৃবৃন্দ আজ নিজেদের অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রাখতে সবাই একসাথে হাত মেলাচ্ছেন। আর সেই প্রধান সমস্যা, যা কি না আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্নে হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে, সেটা হলো ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা।’

জলবায়ু পরিবর্তনের একাধিক কারণ আমাদের সামনে রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়- এসব যতটা না প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট তার থেকেও বেশি মানবসৃষ্ট। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্লাস্টিক দূষণ। আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য দ্রব্যের মোড়কে প্রতিদিনই পলিথিন এবং প্লাস্টিক মোড়ক ব্যবহার করা হচ্ছে এবং উক্ত দ্রব্যগুলো ব্যবহারের পর বর্জ্য হিসেবে পলিথিন এবং প্লাস্টিকের মোড়কগুলো ড্রেন, রাস্তা-ঘাট, মাঠে-ময়দানে, নদী-নালা, খালবিল এবং ফসলের মাঠে ফেলা হচ্ছে। পলিথিন এবং প্লাস্টিক বর্জ্য মাটিতে ফেলার দরুন মাটি তার উর্বরতা হারাচ্ছে, ড্রেন, নদী-নালা, খাল-বিলে ফেলার দরুন ড্রেনগুলো ময়লা পানি নিষ্কাশনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং নদী-নালা এবং খালবিলগুলি মাছ চাষে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সমূদ্রের ঢেউ এবং সূর্যের আলোর প্রভাবে প্লাস্টিকের পণ্য ধীরে ধীরে টুকরো হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। পানি ও অন্যান্য খাদ্যের সঙ্গে একসময় এই মাইক্রোপ্লাস্টিক বিভিন্ন জীবের দেহে প্রবেশ করে। একসময় ফুড চেইন বিশেষ করে মাছের মাধ্যমে মানুষের শরীরেও প্রবেশ করে, যা মানবদেহে চরম স্বাস্থ্য বিপর্যয় ঘটায়। এছাড়া ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে, যা ভূগর্ভস্থ ও ভূ-পৃষ্ঠীয় পানির সঙ্গে মিশে যায়। আর এভাবেই পানি গ্রহণে তা খাদ্যচক্রে ঢোকার ফলে প্রতিনিয়ত আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। অন্যদিকে প্লাস্টিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে।

একদিকে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্লাস্টিকের (পলিথিনসহ) ব্যবহার বাড়ছে। মানুষের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে বর্ধিত পরিমাণে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশেও প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। ২০১৪ সালের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বছরে গড়ে মাথাপ্রতি প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহৃত হয় ৩ দশমিক ৫ কিলোগ্রাম। ইউরোপের গড় মাথাপ্রতি বছরে ১৩৬ কিলোগ্রাম এবং উত্তর আমেরিকায় ১৩৯ কিলোগ্রাম। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের পরিমাণ কম হলেও নগরায়ণের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বাড়ছে সে পরিমাণ। কেবল প্লাস্টিক পণ্যের পরিমাণ নয়, বাংলাদেশে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহারবৈচিত্র্যও বাড়ছে। আমাদের দেশে এর প্রভাব খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারি প্রচুর বৃষ্টিপাতের পর। বিভিন্ন ডোবা, নালা, খাল-বিল, ড্রেনে গিয়ে প্লাস্টিক পদার্থগুলো জমা হয়। যেহেতু এসব পদার্থ সহজে বিয়োজিত হয় না, তাই বৃষ্টির পর এসব পদার্থ পয়ঃনিষ্কাশনে প্রভাব ফেলে। ফলশ্রুতিতে দেখা যায়, রাস্তাঘাটে পানি জমে থাকে, সেই সাথে বাড়ে রোগের প্রাদুর্ভাব। ডায়রিয়া, কলেরাসহ অনেক রোগে আক্রান্ত হয় শহরবাসী। জীবনযাপন হয়ে ওঠে আরো কষ্টসাধ্য। পলিথিন এবং প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো মাটিতে পড়ার দরুন মাটি তার মৌলিকত্ব হারাচ্ছে এবং এই সমস্ত মাটিতে কোন ভৌত কাঠামো নির্মাণ করলেও ভৌত কাঠামো নির্মাণ দুর্বল হতে পারে। পলিথিন ব্যাগ খুবই সহজলভ্য হওয়ার কারণে শহর এলাকায় তরিতরকারির খোসা, মাছের অপ্রয়োজনীয় অংশ, খাবারের উচ্ছিষ্টাদি এবং বাসা-বাড়ির ময়লা-আবর্জনাদি পলিথিন ব্যাগে ভরার পর সেগুলো কোন ডাস্টবিনে অথবা রাস্তার পাশে ফেলা হয়। উল্লিখিত বর্জ্যগুলো পলিথিন ব্যাগে থাকার দরুন একটা মারাত্মক দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয় বা আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে এবং পথচারীসহ আশপাশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। প্লাস্টিক অপচনশীল রাসায়নিকদ্রব্য, যা পরিবেশে সহজে মিশে না। তাই পরিবেশের ওপর প্লাস্টিক নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। ব্যবহৃত প্লাস্টিক যখন আমরা যেখানে-সেখানে ফেলে দিই, তখন সেই প্লাস্টিক চলে যায় ড্রেন, খাল-বিল, নদী-নালা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে সমুদ্রে। ফলে জীববৈচিত্র্যের ওপরও ফেলছে মারাত্মক প্রভাব। চোখ বন্ধ করে নিজেকে প্রশ্ন করুন তো- এসবের জন্য দায়ী কে বা কারা?

এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় অর্ধেক সামুদ্রিক কচ্ছপ প্রতিবছর প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ গলাধঃকরণ করছে, যে কারণে এদের অনেকেই মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, প্লাস্টিকদ্রব্য তাদের প্রজননেও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এই সামুদ্রিক কচ্ছপগুলোর অস্তিত্বই হুমকিই ভেতরে পড়ে যাচ্ছে। ২০১০ সালের ১৯ এপ্রিল The seattles Time (দ্য সিয়াটল টাইম) নামক দৈনিকে একটি খবর খুব সাড়া দিয়েছিল। সিয়াটল সমুদ্র সৈকতে মৃত পড়ে থাকতে দেখা যায় একটি বিশাল তিমিকে। পরে যখন সেই তিমির মৃত্যুর কারণ নিয়ে গবেষণা করা হয়, তখন দেখা যায় তিমির পাকস্থলিতে পাওয়া গিয়েছে বহু প্লাস্টিক পদার্থ। সেসব প্লাস্টিকই সেই তিমির মৃত্যুর কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়।

বিশ্বে প্লাস্টিক রি-সাইক্লিংয়ের শীর্ষে রয়েছে জাপান। শিল্প-কারখানা থেকে শুরু করে গৃহস্থালির ফেলে দেয়া জিনিসকে কীভাবে পুনর্ব্যবহার করা যায় সেদিকে তারা খুবই মনোযোগী। সেজন্য তারা আলাদাভাবে ও পরিষ্কারভাবে এসব বর্জ্য সংরক্ষণ করে থাকে। তারা বিশ্বাস করে মানুষ চাইলেই প্রকৃতির দূষণ বন্ধ করা সম্ভব। আমাদের উচিত প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ বর্জন করা, আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার সীমিত করা, পাটজাত দ্রব্যের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের দেশের হারানো ঐতিহ্য পাটশিল্পকে পুনরায় জাগিয়ে তোলা। সব জায়গায় প্লাস্টিকের পরিবর্তে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা, জনগণকে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করে গড়ে তোলা, পাটজাতীয় পদার্থ ব্যবহারের কারণে সরকারিভাবে ভোক্তা এবং উদ্যোক্তাদের পুরস্কৃত করে তাদের এসবের ব্যবহারে আরও উৎসাহিত করা। গত ৫ ফেব্রুয়ারি পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় সমাবর্তনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘প্লাস্টিক ও পলিথিন নিষিদ্ধ করা উচিত।’ সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হলেই প্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ২৯ মাঘ ১৪২৬, ১৭ জমাদিউল সানি ১৪৪১

পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার কেন বন্ধ করবেন?

নিগার সুলতানা সুপ্তি

তথ্য-প্রযুক্তির এ যুগে সবকিছুই যেন আমাদের হাতের মুঠোয়। যেকোনো সমস্যা সমাধানের বুদ্ধিমত্তাই প্রমাণ করে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব। কিন্তু এত কিছুর পরও কিছু দিক দিয়ে আমরা যেন খুবই অসহায়। পৃথিবী আর মানবসভ্যতার বয়স দিনকে দিন যত বাড়ছে, আমরা ততই কিছু অমীমাংসিত সমস্যার সম্মুখীন হয়ে চলছি, যার সমাধান বের করতে গিয়ে প্রায়শই আমাদের অনেক জটিলতার বাধা পেরোতে হচ্ছে। বিশ্বের বড় বড় নেতৃবৃন্দ আজ নিজেদের অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রাখতে সবাই একসাথে হাত মেলাচ্ছেন। আর সেই প্রধান সমস্যা, যা কি না আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্নে হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে, সেটা হলো ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা।’

জলবায়ু পরিবর্তনের একাধিক কারণ আমাদের সামনে রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়- এসব যতটা না প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট তার থেকেও বেশি মানবসৃষ্ট। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্লাস্টিক দূষণ। আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য দ্রব্যের মোড়কে প্রতিদিনই পলিথিন এবং প্লাস্টিক মোড়ক ব্যবহার করা হচ্ছে এবং উক্ত দ্রব্যগুলো ব্যবহারের পর বর্জ্য হিসেবে পলিথিন এবং প্লাস্টিকের মোড়কগুলো ড্রেন, রাস্তা-ঘাট, মাঠে-ময়দানে, নদী-নালা, খালবিল এবং ফসলের মাঠে ফেলা হচ্ছে। পলিথিন এবং প্লাস্টিক বর্জ্য মাটিতে ফেলার দরুন মাটি তার উর্বরতা হারাচ্ছে, ড্রেন, নদী-নালা, খাল-বিলে ফেলার দরুন ড্রেনগুলো ময়লা পানি নিষ্কাশনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং নদী-নালা এবং খালবিলগুলি মাছ চাষে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সমূদ্রের ঢেউ এবং সূর্যের আলোর প্রভাবে প্লাস্টিকের পণ্য ধীরে ধীরে টুকরো হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। পানি ও অন্যান্য খাদ্যের সঙ্গে একসময় এই মাইক্রোপ্লাস্টিক বিভিন্ন জীবের দেহে প্রবেশ করে। একসময় ফুড চেইন বিশেষ করে মাছের মাধ্যমে মানুষের শরীরেও প্রবেশ করে, যা মানবদেহে চরম স্বাস্থ্য বিপর্যয় ঘটায়। এছাড়া ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে, যা ভূগর্ভস্থ ও ভূ-পৃষ্ঠীয় পানির সঙ্গে মিশে যায়। আর এভাবেই পানি গ্রহণে তা খাদ্যচক্রে ঢোকার ফলে প্রতিনিয়ত আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। অন্যদিকে প্লাস্টিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে।

একদিকে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্লাস্টিকের (পলিথিনসহ) ব্যবহার বাড়ছে। মানুষের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে বর্ধিত পরিমাণে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশেও প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। ২০১৪ সালের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বছরে গড়ে মাথাপ্রতি প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহৃত হয় ৩ দশমিক ৫ কিলোগ্রাম। ইউরোপের গড় মাথাপ্রতি বছরে ১৩৬ কিলোগ্রাম এবং উত্তর আমেরিকায় ১৩৯ কিলোগ্রাম। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের পরিমাণ কম হলেও নগরায়ণের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বাড়ছে সে পরিমাণ। কেবল প্লাস্টিক পণ্যের পরিমাণ নয়, বাংলাদেশে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহারবৈচিত্র্যও বাড়ছে। আমাদের দেশে এর প্রভাব খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারি প্রচুর বৃষ্টিপাতের পর। বিভিন্ন ডোবা, নালা, খাল-বিল, ড্রেনে গিয়ে প্লাস্টিক পদার্থগুলো জমা হয়। যেহেতু এসব পদার্থ সহজে বিয়োজিত হয় না, তাই বৃষ্টির পর এসব পদার্থ পয়ঃনিষ্কাশনে প্রভাব ফেলে। ফলশ্রুতিতে দেখা যায়, রাস্তাঘাটে পানি জমে থাকে, সেই সাথে বাড়ে রোগের প্রাদুর্ভাব। ডায়রিয়া, কলেরাসহ অনেক রোগে আক্রান্ত হয় শহরবাসী। জীবনযাপন হয়ে ওঠে আরো কষ্টসাধ্য। পলিথিন এবং প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো মাটিতে পড়ার দরুন মাটি তার মৌলিকত্ব হারাচ্ছে এবং এই সমস্ত মাটিতে কোন ভৌত কাঠামো নির্মাণ করলেও ভৌত কাঠামো নির্মাণ দুর্বল হতে পারে। পলিথিন ব্যাগ খুবই সহজলভ্য হওয়ার কারণে শহর এলাকায় তরিতরকারির খোসা, মাছের অপ্রয়োজনীয় অংশ, খাবারের উচ্ছিষ্টাদি এবং বাসা-বাড়ির ময়লা-আবর্জনাদি পলিথিন ব্যাগে ভরার পর সেগুলো কোন ডাস্টবিনে অথবা রাস্তার পাশে ফেলা হয়। উল্লিখিত বর্জ্যগুলো পলিথিন ব্যাগে থাকার দরুন একটা মারাত্মক দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয় বা আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে এবং পথচারীসহ আশপাশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। প্লাস্টিক অপচনশীল রাসায়নিকদ্রব্য, যা পরিবেশে সহজে মিশে না। তাই পরিবেশের ওপর প্লাস্টিক নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। ব্যবহৃত প্লাস্টিক যখন আমরা যেখানে-সেখানে ফেলে দিই, তখন সেই প্লাস্টিক চলে যায় ড্রেন, খাল-বিল, নদী-নালা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে সমুদ্রে। ফলে জীববৈচিত্র্যের ওপরও ফেলছে মারাত্মক প্রভাব। চোখ বন্ধ করে নিজেকে প্রশ্ন করুন তো- এসবের জন্য দায়ী কে বা কারা?

এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় অর্ধেক সামুদ্রিক কচ্ছপ প্রতিবছর প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ গলাধঃকরণ করছে, যে কারণে এদের অনেকেই মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, প্লাস্টিকদ্রব্য তাদের প্রজননেও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এই সামুদ্রিক কচ্ছপগুলোর অস্তিত্বই হুমকিই ভেতরে পড়ে যাচ্ছে। ২০১০ সালের ১৯ এপ্রিল The seattles Time (দ্য সিয়াটল টাইম) নামক দৈনিকে একটি খবর খুব সাড়া দিয়েছিল। সিয়াটল সমুদ্র সৈকতে মৃত পড়ে থাকতে দেখা যায় একটি বিশাল তিমিকে। পরে যখন সেই তিমির মৃত্যুর কারণ নিয়ে গবেষণা করা হয়, তখন দেখা যায় তিমির পাকস্থলিতে পাওয়া গিয়েছে বহু প্লাস্টিক পদার্থ। সেসব প্লাস্টিকই সেই তিমির মৃত্যুর কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়।

বিশ্বে প্লাস্টিক রি-সাইক্লিংয়ের শীর্ষে রয়েছে জাপান। শিল্প-কারখানা থেকে শুরু করে গৃহস্থালির ফেলে দেয়া জিনিসকে কীভাবে পুনর্ব্যবহার করা যায় সেদিকে তারা খুবই মনোযোগী। সেজন্য তারা আলাদাভাবে ও পরিষ্কারভাবে এসব বর্জ্য সংরক্ষণ করে থাকে। তারা বিশ্বাস করে মানুষ চাইলেই প্রকৃতির দূষণ বন্ধ করা সম্ভব। আমাদের উচিত প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ বর্জন করা, আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার সীমিত করা, পাটজাত দ্রব্যের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের দেশের হারানো ঐতিহ্য পাটশিল্পকে পুনরায় জাগিয়ে তোলা। সব জায়গায় প্লাস্টিকের পরিবর্তে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা, জনগণকে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করে গড়ে তোলা, পাটজাতীয় পদার্থ ব্যবহারের কারণে সরকারিভাবে ভোক্তা এবং উদ্যোক্তাদের পুরস্কৃত করে তাদের এসবের ব্যবহারে আরও উৎসাহিত করা। গত ৫ ফেব্রুয়ারি পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় সমাবর্তনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘প্লাস্টিক ও পলিথিন নিষিদ্ধ করা উচিত।’ সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হলেই প্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।