অনুৎপাদনশীল আয় খাত

মো. নূরুন্নবী ইসলাম

শারীরিক বা মানসিক শ্রমের মাধ্যমে নতুন উপযোগ তৈরি হয়। আর এই উপযোগ অভাব পূরণ করে, তৈরি হয় তার বিনিময় মূল্য, বৃদ্ধি পায় সমাজে আয় ও উৎপাদনের খাত। সমাজের এই আয় এবং উৎপাদন খাত নতুন করে বিনিয়োগ হয়ে সমাজের চাকা গতিশীল করে সমাজ তার অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনের পথে হাঁটে। কিন্তু সমাজে এখন এমন কিছু আয়ের খাত তৈরি হয়েছে যার মাধ্যমে কোন উপযোগ তৈরি হয় না বা কারো অভাব পূরণে অবদান নাই কিন্তু তার থেকে এক বিশেষ গোষ্ঠী আয় করছে। এই আয়ের মাধ্যমে এই গোষ্ঠী শুধু জীবিকা নির্বাহ করাই নয় বরং বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। বাংলাদেশে এই রকম আয় খাতগুলো দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করছে যার মানে এই, উৎপাদন বা পরিশ্রমের মাধ্যমে আয় করার চেয়ে সবাই অনুৎপাদনশীল আয় খাতগুলোতে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। আবার অন্য দিকে ভয়ংকর দুচিন্তার বিষয় হলো বাংলাদেশের কৃষিতে নতুন কৃষক প্রয়োজনীয় হারে যেমন তৈরি হচ্ছে না তেমন কৃষিতে নতুন বা দক্ষ শ্রমিক কমে যাচ্ছে। এই সমস্যা আমাদের অর্থনীতিতে এক ভয়ংকর বার্তা দিচ্ছে। আমরা যদি এই খাতগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ও যুগোপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ না করি তাহলে আমাদের সামনে খুবই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে যাকে সামাল দেয়া তখন একরকম অসম্ভব হয়ে যেতে পারে।

প্রয়োজনীয় সময় ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূণতা অর্জন না করলে বা যতটুকু করা যায় তার সর্বোচ্চ করার প্রচেষ্টা না থাকলে শুধুমাত্র শিল্প বা আমদানির ওপর নির্ভর করে কোন দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতে পারে না। আবার জনশক্তি যদি একটা বিশেষ ঘোরের মাঝে থেকে তাদের কাজ ভুলে যায় তাহলে তা আরো ক্ষতিকর কিছুর ইঙ্গিত করে। কৃষকের ঘরের সন্তান আর কৃষক হচ্ছে না। আমি বলছি না যে কৃষকের ঘরের সন্তান কৃষকই হতে হবে। কিন্তু যখন কৃষকের সন্তান পড়াশুনা করে চাকরি পাবার পর কৃষক এবং কৃষির প্রতি সম্মান রাখে না বা কেউ বাধ্য হলেও কৃষিতে না গিয়ে অন্য পেশায় যায় তখন এ বিষয়টি আমাদের মেনে নিতেই হবে কৃষির অর্থনৈতিক অবস্থা যেমন সম্ভাবনাময় নয় তেমনি এর সামাজিক মর্যাদাও কমে গেছে। সমাজে আর কৃষকের সঙ্গে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না, একজন রিক্সা বা ভ্যানচালক যতটুকু অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পায় একজন কৃষক তেমনটি পায় না। আবার কৃষি খাতে বিনিয়োগ কৃষককেই করতে হয় কিন্তু তার লাভের সম্ভাবনা খুবই কম। কৃষি খাতে আর নতুন কৃষক বা কৃষি শ্রমিক যে হারে আশা উচিত সে হারে আসছে না। কৃষক নিজেও চায় না তার সন্তান কৃষক হোক বা কৃষি সংশ্লিষ্ট কোন পেশায় থাক। এখন কৃষির চেয়ে দোকান করা, দালালি করা, ভ্যান চালানো, গার্মেন্টে কাজ করা অনেক বেশি অর্থনৈতিক নিরাপত্তার মাধ্যমে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করে। বাবা তার সন্তানকে কোন না কোনোভাবে এই শিক্ষা দেয় জীবনে যাই করো না কেন কৃষক হইও না।

বর্তমান সময়ের অন্যতম সমালোচিত বিষয় কিশোর গ্যাং। শহরের চেয়ে গ্রামেও এর উপস্থিতি কোন অংশে কম নয়। সামাজিক অস্থিরতার পেছনে তাদের অপ-অংশগ্রহণ আছে। শহরে আগে টোকইদের মাঝে মোটামুটিভাবে অপরাধ কর্মগুলো সীমাবদদ্ধ থাকলেও এখন তা সকল শিশু কিশোরের মাঝে ছড়িয়ে গেছে। ভালোবাসা ও ভালো থাকার চেয়ে টাকার সঙ্গে থাকা বিলাসিতার থাকা অধিক বেশি আগ্রহের বলে এই সমস্যাগুলো হচ্ছে। অর্থের পেছনে ছুটে পারিবারিক বন্ধনের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে কমে যাচ্ছে নৈতিকতার দৃঢ়তা। পরিবার থেকে যে ভাঙ্গন শুরু হচ্ছে তা সমাজ এবং রাষ্ট্রকেও খারাপভাবে প্রভাবিত করছে। আমাদের আজ একটা কিছু করে সব কিছু ঠিক করা সম্ভব না আর তাই সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে আমাদের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আমাদের সমাজে যদি আয়ের খাতগুলো সব উৎপাদনমুখী হয় তাহলে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনতে এটি যেমন ভূমিকা রাখবে তেমনি বিলাসবহুল জীবনের প্রতি আগ্রহ কমে যাবে। কোন একজন ব্যাক্তি ঘুষ খাবার পর বাজারে গিয়ে দোকানদার যেমন দাম চায় সেই দামেই কেনে বা বাজারের বিলাসবহুল দ্রব্য কেনার চেষ্টা করে। ঘুষখোরদের দ্রব্যের দাম নিয়ে অনাপত্তি বা তার দেখাদেখি আরও কিছু লোক তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করতে শুরু করে যাতে করে সমাজে এই অনুৎপাদনশীল আয় খাতগুলোর প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়; যা আমাদের সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে নিম্নমুখী করে তুলছে। বাংলাদেশে অনুৎপাদনশীল আয়ের প্রধান প্রধান খাতগুলো মাঝে আছে-

১. রাজনীতি ২. জুয়া বা বাজি, ৩. ঘুষ, ৪. চাঁদাবাজি, ৫. মধ্যস্বত্বভোগী ৬. চুরি ছিনতাই, ৭. ঋণ ব্যবসা, ৮. অসুস্থ বিনোদন ও ৯. মাদক ইত্যাদি।

প্রত্যেক মানুষ তার প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে অর্থাৎ সবার ভেতর শ্রেষ্ঠ হওয়ার বাসনা আছে। সবাই চায় সমাজের লোক তাকে সম্মান করুক সামাজিক অনুষ্ঠানে বা বিচার শালিসে তার আসন হোক বিশেষ মর্যাদার আর এই ক্ষেত্রে যখন অর্থ এবং রাজনৈতিক প্রভাব সবচেয়ে কাজের তখন রাজনীতির প্রতি রাজনৈতিক জ্ঞান থেকে নয় বরং অনুৎপাদনশীল আয় খাতের বৈধ উপায়ের জন্য রাজনীতির প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। আর তাই সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যেমন অনেকে দল পরির্তন করে তেমনি যে কোন সরকারের সঙ্গেই সমঝোতা করে চলার মত মানসিকতা রাখে। বর্তমানের তরুণ সমাজে তাদের দাপট তৈরির জন্য তাদের অনেক খাপছাড়া কাজের বিরুদ্ধে যেন কেউ কোন কথা বলতে না পারে তার জন্য রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয় বা স্বেচ্ছায় রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয় তাদের ব্যবহার করার জন্য ও তাদের মাধ্যমে ব্যবহার হওয়ার জন্য। বর্তমানে রাজনীতি অনুৎপাদনশীল খাতের আয়ের মধ্যে একরকম অলিখিত বৈধতা লাভ করায় অন্য খাতগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বা ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে।

বর্তমানে ক্রিকেট বাজিসহ নানারকম বাজি শহর থেকে গ্রামে বেশ জনপ্রিয়। শিশু কিশোর থেকে শুরু করে নানা বয়সের মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় কাজ না করে খেলা দেখে তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে এবং অনেকেই বাজির মাধ্যমে তার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করতে চায়। তরুণদের মাঝে একটা বিশেষ শ্রেণী এর মাধ্যমে নিজেদের একটা গ্রুপ ও আয়ের পথ তৈরি করেছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেদের প্রয়োজনে ছোটখাটো অপরাধ থেকে শুরু করে সুযোগের অপব্যবহার করে বড় বড় অপরাধ করে বসে। অল্প বয়সের এ অলসতা ভবিষ্যতের জন্যও বেশ ক্ষতির কারণ।

একজন পুলিশ তার দায়িত্বের জায়গা থেকে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দিবে বা মামলার নিরপেক্ষ তদন্ত করবে কেননা সে এ কাজ করার জন্যই বেতন পায়। আবার একজন চেয়ারম্যান বয়স্ক ভাতার কার্ড যার প্রয়োজন তাকে দিবে তার দায়িত্বের জায়গা থেকে। কিন্তু এমন সব দায়িত্ব পূরণের জায়গায় অবৈধ লেনদেন হয় তখন সমাজের স্বাভাবিক কাজগুলো আর নিয়মে হয় না। কাজের গতিরোধ হয়, ব্যবস্থার ওপর আস্থা নষ্ট হয়; যা একজন নাগরিককে হতাশ করে। ক্ষমতা বা টাকার অপব্যবহার ছাড়া যদি দায়িত্ব পালন করা হয় তাহলে দেশের উৎপাদনের গতি অনেক অনেক বেড়ে যাবে।

কোন পণ্য বা দ্রব্য উৎপাদনকারী যে মূল্যে দ্রব্য উৎপাদন এবং বিক্রি করে তার চেয়ে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মূল্যে তা ভোক্তার কাছে বিক্রি হয়। পরিবহন বা শ্রমিক মূল্য ছাড়াও চাঁদাবাজি এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। এই চাঁদাবাজির কারণে অনেক ক্ষেতে অনেক উন্নয়ন কাজ যেমন তার মান বজায় রাখতে পারে না তেমনি অনেক বিনিয়োগ কারীকে অর্থ বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করে। ব্যবসার অনিশ্চয়তা উৎপাদনের অনিশ্চয়তা সর্বোপরি সামাজিক নিরাপত্তা এর মাধ্যমে বিঘ্নিত হয় পুরো উৎপাদন ব্যবস্থা।

একটি নষ্ট আপেলকে তাজা বলে বিশ্বাস করানো অপরাধের পর্যায়েই পড়ে। আবার কোন দ্রব্যের উৎপাদনকারী, বিক্রেতা বা ভোক্তা না হয়েও যখন দ্রব্যের দামের উপর অবৈধ প্রভাব তৈরি করা হয় তা বাজার ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু সুবিধাভোগীর কারণে মানহীন পণ্য বাজারে চলে আসে। ক্রেতা ও বিক্রেতা এর ফলে তাদের অর্থ খরচ করলেও সেবা পর্যাপ্ত পায় না।

শারীরিক এবং মানসিক শ্রমের মাধ্যমে তৈরি সম্পদ যদি নিজের কাজে না লাগে এবং তা যদি অন্য কেউ ভোগ করে তাহলে নিজের ভেতর ক্ষোভ, রাগ এবং ঘৃণা তৈরি হতে বাধ্য। এ অবস্থায় একজন ব্যক্তি তার সৃষ্টিশীল চিন্তাকেও কাজে লাগানোর মানসিকতা হারিয়ে ফেলে। এতে একদিকে একদল হতাশ হচ্ছে আর অন্যদল অল্পে অনেক আয়ের আশায় যুক্ত হতে থাকে ভয়াবহ অনুৎপাদনশীল খাতের সঙ্গে।

একজন ব্যক্তি ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে তার মনের স্বাভাবিক শান্তির কথা ভুলে শুধু ঋণ পরিশোধের জন্যই কাজ করতে থাকে এবং তার যে উৎপাদন ক্ষমতা সেটাও ব্যাহত হয় আবার যারা ক্ষমতাবান তারা ঋণখেলাপির রূপ ধারণ করে দেশের ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিপদে ফেলে। ঋণ ব্যবসার কারণে মজুতদারি এবং সুদে টাকা প্রদান একটি দুষ্টচক্রে জড়িয়ে নিচ্ছে সমাজের এক বিশেষ শ্রেণীর মানুষকে।

মাদক যেমন মাদক গ্রহণকারীর স্বাভাবিক বুদ্ধি বিবেক নষ্ট করে দেয় তেমনি তার কাজের ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। এই মাদকের মাধ্যমে মানুষের সক্ষমতা ও সৃষ্টিশীলতার পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। তার আর্থিক, পারিবারিক, ব্যক্তি ও সামাজিক জীবন ধ্বংস করে দেয়া হয়। মাদক এবং মাদক ব্যবসা সমাজের সম্ভাবনার গতিরোধ করছে এত কারো কোন সন্দেহ নাই থাকা উচিত না।

মানুষের যদি নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি ও সমাজের প্রতি কর্তব্য ও দায় না থাকে তাহলে তার কাজ তার কাছে মনে হবে মরণ ফাঁস। কাজ থেকে সব সময় দূরে থাকার চেষ্টা করবে। এর পাশাপাশি যদি সমাজে সস্তা বিনোদনগুলো সহজ লভ্য হয় এবং তার প্রতি সমাজের বিরাট অংশ বুঁদ হয়ে থাকে তাহলে সমাজে ভালো কিছু আশা খুবই কঠিন। বাংলাদেশে বর্তমানে জ্ঞান চর্চার চেয়ে সস্তা বিনোদন যেভাবে জনপ্রিয় হচ্ছে ও আয়ের পথ তৈরি করছে তাতে করে খুব তাড়াতড়ি আমরা একটি বোধশক্তিহীন জাতিতে পরিণত হতে পারি।

সমাজের আয়ের খাতগুলো হোক নতুন কিছু তৈরির কারখানা। শ্রম এবং শ্রমিকের প্রতি সম্মান এবং আস্থা হবে যার ভিত্তি। শুধু নিজের প্রয়োজনে যে খাতগুলো পরিচলিত হবে না বরং লক্ষ্য থাকবে সমাজের সকল মানুষের মঙ্গল সাধনের। উত্তোরোত্তর সৃষ্টির মাধ্যমে যে খাতগুলো আনবে সমৃদ্ধি এবং সাম্য।

বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৩০ মাঘ ১৪২৬, ১৮ জমাদিউল সানি ১৪৪১

অর্থনীতির অশনিসংকেত

অনুৎপাদনশীল আয় খাত

মো. নূরুন্নবী ইসলাম

শারীরিক বা মানসিক শ্রমের মাধ্যমে নতুন উপযোগ তৈরি হয়। আর এই উপযোগ অভাব পূরণ করে, তৈরি হয় তার বিনিময় মূল্য, বৃদ্ধি পায় সমাজে আয় ও উৎপাদনের খাত। সমাজের এই আয় এবং উৎপাদন খাত নতুন করে বিনিয়োগ হয়ে সমাজের চাকা গতিশীল করে সমাজ তার অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনের পথে হাঁটে। কিন্তু সমাজে এখন এমন কিছু আয়ের খাত তৈরি হয়েছে যার মাধ্যমে কোন উপযোগ তৈরি হয় না বা কারো অভাব পূরণে অবদান নাই কিন্তু তার থেকে এক বিশেষ গোষ্ঠী আয় করছে। এই আয়ের মাধ্যমে এই গোষ্ঠী শুধু জীবিকা নির্বাহ করাই নয় বরং বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। বাংলাদেশে এই রকম আয় খাতগুলো দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করছে যার মানে এই, উৎপাদন বা পরিশ্রমের মাধ্যমে আয় করার চেয়ে সবাই অনুৎপাদনশীল আয় খাতগুলোতে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। আবার অন্য দিকে ভয়ংকর দুচিন্তার বিষয় হলো বাংলাদেশের কৃষিতে নতুন কৃষক প্রয়োজনীয় হারে যেমন তৈরি হচ্ছে না তেমন কৃষিতে নতুন বা দক্ষ শ্রমিক কমে যাচ্ছে। এই সমস্যা আমাদের অর্থনীতিতে এক ভয়ংকর বার্তা দিচ্ছে। আমরা যদি এই খাতগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ও যুগোপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ না করি তাহলে আমাদের সামনে খুবই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে যাকে সামাল দেয়া তখন একরকম অসম্ভব হয়ে যেতে পারে।

প্রয়োজনীয় সময় ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূণতা অর্জন না করলে বা যতটুকু করা যায় তার সর্বোচ্চ করার প্রচেষ্টা না থাকলে শুধুমাত্র শিল্প বা আমদানির ওপর নির্ভর করে কোন দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতে পারে না। আবার জনশক্তি যদি একটা বিশেষ ঘোরের মাঝে থেকে তাদের কাজ ভুলে যায় তাহলে তা আরো ক্ষতিকর কিছুর ইঙ্গিত করে। কৃষকের ঘরের সন্তান আর কৃষক হচ্ছে না। আমি বলছি না যে কৃষকের ঘরের সন্তান কৃষকই হতে হবে। কিন্তু যখন কৃষকের সন্তান পড়াশুনা করে চাকরি পাবার পর কৃষক এবং কৃষির প্রতি সম্মান রাখে না বা কেউ বাধ্য হলেও কৃষিতে না গিয়ে অন্য পেশায় যায় তখন এ বিষয়টি আমাদের মেনে নিতেই হবে কৃষির অর্থনৈতিক অবস্থা যেমন সম্ভাবনাময় নয় তেমনি এর সামাজিক মর্যাদাও কমে গেছে। সমাজে আর কৃষকের সঙ্গে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না, একজন রিক্সা বা ভ্যানচালক যতটুকু অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পায় একজন কৃষক তেমনটি পায় না। আবার কৃষি খাতে বিনিয়োগ কৃষককেই করতে হয় কিন্তু তার লাভের সম্ভাবনা খুবই কম। কৃষি খাতে আর নতুন কৃষক বা কৃষি শ্রমিক যে হারে আশা উচিত সে হারে আসছে না। কৃষক নিজেও চায় না তার সন্তান কৃষক হোক বা কৃষি সংশ্লিষ্ট কোন পেশায় থাক। এখন কৃষির চেয়ে দোকান করা, দালালি করা, ভ্যান চালানো, গার্মেন্টে কাজ করা অনেক বেশি অর্থনৈতিক নিরাপত্তার মাধ্যমে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করে। বাবা তার সন্তানকে কোন না কোনোভাবে এই শিক্ষা দেয় জীবনে যাই করো না কেন কৃষক হইও না।

বর্তমান সময়ের অন্যতম সমালোচিত বিষয় কিশোর গ্যাং। শহরের চেয়ে গ্রামেও এর উপস্থিতি কোন অংশে কম নয়। সামাজিক অস্থিরতার পেছনে তাদের অপ-অংশগ্রহণ আছে। শহরে আগে টোকইদের মাঝে মোটামুটিভাবে অপরাধ কর্মগুলো সীমাবদদ্ধ থাকলেও এখন তা সকল শিশু কিশোরের মাঝে ছড়িয়ে গেছে। ভালোবাসা ও ভালো থাকার চেয়ে টাকার সঙ্গে থাকা বিলাসিতার থাকা অধিক বেশি আগ্রহের বলে এই সমস্যাগুলো হচ্ছে। অর্থের পেছনে ছুটে পারিবারিক বন্ধনের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে কমে যাচ্ছে নৈতিকতার দৃঢ়তা। পরিবার থেকে যে ভাঙ্গন শুরু হচ্ছে তা সমাজ এবং রাষ্ট্রকেও খারাপভাবে প্রভাবিত করছে। আমাদের আজ একটা কিছু করে সব কিছু ঠিক করা সম্ভব না আর তাই সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে আমাদের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আমাদের সমাজে যদি আয়ের খাতগুলো সব উৎপাদনমুখী হয় তাহলে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনতে এটি যেমন ভূমিকা রাখবে তেমনি বিলাসবহুল জীবনের প্রতি আগ্রহ কমে যাবে। কোন একজন ব্যাক্তি ঘুষ খাবার পর বাজারে গিয়ে দোকানদার যেমন দাম চায় সেই দামেই কেনে বা বাজারের বিলাসবহুল দ্রব্য কেনার চেষ্টা করে। ঘুষখোরদের দ্রব্যের দাম নিয়ে অনাপত্তি বা তার দেখাদেখি আরও কিছু লোক তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করতে শুরু করে যাতে করে সমাজে এই অনুৎপাদনশীল আয় খাতগুলোর প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়; যা আমাদের সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে নিম্নমুখী করে তুলছে। বাংলাদেশে অনুৎপাদনশীল আয়ের প্রধান প্রধান খাতগুলো মাঝে আছে-

১. রাজনীতি ২. জুয়া বা বাজি, ৩. ঘুষ, ৪. চাঁদাবাজি, ৫. মধ্যস্বত্বভোগী ৬. চুরি ছিনতাই, ৭. ঋণ ব্যবসা, ৮. অসুস্থ বিনোদন ও ৯. মাদক ইত্যাদি।

প্রত্যেক মানুষ তার প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে অর্থাৎ সবার ভেতর শ্রেষ্ঠ হওয়ার বাসনা আছে। সবাই চায় সমাজের লোক তাকে সম্মান করুক সামাজিক অনুষ্ঠানে বা বিচার শালিসে তার আসন হোক বিশেষ মর্যাদার আর এই ক্ষেত্রে যখন অর্থ এবং রাজনৈতিক প্রভাব সবচেয়ে কাজের তখন রাজনীতির প্রতি রাজনৈতিক জ্ঞান থেকে নয় বরং অনুৎপাদনশীল আয় খাতের বৈধ উপায়ের জন্য রাজনীতির প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। আর তাই সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যেমন অনেকে দল পরির্তন করে তেমনি যে কোন সরকারের সঙ্গেই সমঝোতা করে চলার মত মানসিকতা রাখে। বর্তমানের তরুণ সমাজে তাদের দাপট তৈরির জন্য তাদের অনেক খাপছাড়া কাজের বিরুদ্ধে যেন কেউ কোন কথা বলতে না পারে তার জন্য রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয় বা স্বেচ্ছায় রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয় তাদের ব্যবহার করার জন্য ও তাদের মাধ্যমে ব্যবহার হওয়ার জন্য। বর্তমানে রাজনীতি অনুৎপাদনশীল খাতের আয়ের মধ্যে একরকম অলিখিত বৈধতা লাভ করায় অন্য খাতগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বা ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে।

বর্তমানে ক্রিকেট বাজিসহ নানারকম বাজি শহর থেকে গ্রামে বেশ জনপ্রিয়। শিশু কিশোর থেকে শুরু করে নানা বয়সের মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় কাজ না করে খেলা দেখে তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে এবং অনেকেই বাজির মাধ্যমে তার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করতে চায়। তরুণদের মাঝে একটা বিশেষ শ্রেণী এর মাধ্যমে নিজেদের একটা গ্রুপ ও আয়ের পথ তৈরি করেছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেদের প্রয়োজনে ছোটখাটো অপরাধ থেকে শুরু করে সুযোগের অপব্যবহার করে বড় বড় অপরাধ করে বসে। অল্প বয়সের এ অলসতা ভবিষ্যতের জন্যও বেশ ক্ষতির কারণ।

একজন পুলিশ তার দায়িত্বের জায়গা থেকে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দিবে বা মামলার নিরপেক্ষ তদন্ত করবে কেননা সে এ কাজ করার জন্যই বেতন পায়। আবার একজন চেয়ারম্যান বয়স্ক ভাতার কার্ড যার প্রয়োজন তাকে দিবে তার দায়িত্বের জায়গা থেকে। কিন্তু এমন সব দায়িত্ব পূরণের জায়গায় অবৈধ লেনদেন হয় তখন সমাজের স্বাভাবিক কাজগুলো আর নিয়মে হয় না। কাজের গতিরোধ হয়, ব্যবস্থার ওপর আস্থা নষ্ট হয়; যা একজন নাগরিককে হতাশ করে। ক্ষমতা বা টাকার অপব্যবহার ছাড়া যদি দায়িত্ব পালন করা হয় তাহলে দেশের উৎপাদনের গতি অনেক অনেক বেড়ে যাবে।

কোন পণ্য বা দ্রব্য উৎপাদনকারী যে মূল্যে দ্রব্য উৎপাদন এবং বিক্রি করে তার চেয়ে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মূল্যে তা ভোক্তার কাছে বিক্রি হয়। পরিবহন বা শ্রমিক মূল্য ছাড়াও চাঁদাবাজি এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। এই চাঁদাবাজির কারণে অনেক ক্ষেতে অনেক উন্নয়ন কাজ যেমন তার মান বজায় রাখতে পারে না তেমনি অনেক বিনিয়োগ কারীকে অর্থ বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করে। ব্যবসার অনিশ্চয়তা উৎপাদনের অনিশ্চয়তা সর্বোপরি সামাজিক নিরাপত্তা এর মাধ্যমে বিঘ্নিত হয় পুরো উৎপাদন ব্যবস্থা।

একটি নষ্ট আপেলকে তাজা বলে বিশ্বাস করানো অপরাধের পর্যায়েই পড়ে। আবার কোন দ্রব্যের উৎপাদনকারী, বিক্রেতা বা ভোক্তা না হয়েও যখন দ্রব্যের দামের উপর অবৈধ প্রভাব তৈরি করা হয় তা বাজার ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু সুবিধাভোগীর কারণে মানহীন পণ্য বাজারে চলে আসে। ক্রেতা ও বিক্রেতা এর ফলে তাদের অর্থ খরচ করলেও সেবা পর্যাপ্ত পায় না।

শারীরিক এবং মানসিক শ্রমের মাধ্যমে তৈরি সম্পদ যদি নিজের কাজে না লাগে এবং তা যদি অন্য কেউ ভোগ করে তাহলে নিজের ভেতর ক্ষোভ, রাগ এবং ঘৃণা তৈরি হতে বাধ্য। এ অবস্থায় একজন ব্যক্তি তার সৃষ্টিশীল চিন্তাকেও কাজে লাগানোর মানসিকতা হারিয়ে ফেলে। এতে একদিকে একদল হতাশ হচ্ছে আর অন্যদল অল্পে অনেক আয়ের আশায় যুক্ত হতে থাকে ভয়াবহ অনুৎপাদনশীল খাতের সঙ্গে।

একজন ব্যক্তি ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে তার মনের স্বাভাবিক শান্তির কথা ভুলে শুধু ঋণ পরিশোধের জন্যই কাজ করতে থাকে এবং তার যে উৎপাদন ক্ষমতা সেটাও ব্যাহত হয় আবার যারা ক্ষমতাবান তারা ঋণখেলাপির রূপ ধারণ করে দেশের ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিপদে ফেলে। ঋণ ব্যবসার কারণে মজুতদারি এবং সুদে টাকা প্রদান একটি দুষ্টচক্রে জড়িয়ে নিচ্ছে সমাজের এক বিশেষ শ্রেণীর মানুষকে।

মাদক যেমন মাদক গ্রহণকারীর স্বাভাবিক বুদ্ধি বিবেক নষ্ট করে দেয় তেমনি তার কাজের ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। এই মাদকের মাধ্যমে মানুষের সক্ষমতা ও সৃষ্টিশীলতার পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। তার আর্থিক, পারিবারিক, ব্যক্তি ও সামাজিক জীবন ধ্বংস করে দেয়া হয়। মাদক এবং মাদক ব্যবসা সমাজের সম্ভাবনার গতিরোধ করছে এত কারো কোন সন্দেহ নাই থাকা উচিত না।

মানুষের যদি নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি ও সমাজের প্রতি কর্তব্য ও দায় না থাকে তাহলে তার কাজ তার কাছে মনে হবে মরণ ফাঁস। কাজ থেকে সব সময় দূরে থাকার চেষ্টা করবে। এর পাশাপাশি যদি সমাজে সস্তা বিনোদনগুলো সহজ লভ্য হয় এবং তার প্রতি সমাজের বিরাট অংশ বুঁদ হয়ে থাকে তাহলে সমাজে ভালো কিছু আশা খুবই কঠিন। বাংলাদেশে বর্তমানে জ্ঞান চর্চার চেয়ে সস্তা বিনোদন যেভাবে জনপ্রিয় হচ্ছে ও আয়ের পথ তৈরি করছে তাতে করে খুব তাড়াতড়ি আমরা একটি বোধশক্তিহীন জাতিতে পরিণত হতে পারি।

সমাজের আয়ের খাতগুলো হোক নতুন কিছু তৈরির কারখানা। শ্রম এবং শ্রমিকের প্রতি সম্মান এবং আস্থা হবে যার ভিত্তি। শুধু নিজের প্রয়োজনে যে খাতগুলো পরিচলিত হবে না বরং লক্ষ্য থাকবে সমাজের সকল মানুষের মঙ্গল সাধনের। উত্তোরোত্তর সৃষ্টির মাধ্যমে যে খাতগুলো আনবে সমৃদ্ধি এবং সাম্য।