রায় ১৬ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি

ক্ষোভ আপিল বিভাগের

বিনা পরোয়ানায় ৫৪ ধারায় গ্রেফতারের বিষয়ে ১৬ বছরেও হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে আপিল বিভাগ বলেছেন, তাহলে রায় দিয়ে লাভ কি? এটা কি আইওয়াশ?

গতকাল প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ৬ সদস্যেরর আপিল বেঞ্চ এমন মন্তব্য করেন। বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা ও রিমান্ড সংক্রান্ত ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশনার বিষয়ে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আবেদন গ্রহণ করে এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য ১৬ এপ্রিল দিন ধার্য করেছেন আপিল বিভাগ। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। রিটের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট ইদ্রিসুর রহমান ও ব্যারিস্টার সারা হোসেন।

আদালত বলেন, ৫৪ ধারায় গ্রেফতার তো আমাদের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে? আত্মীয়স্বজনদের ক্ষেত্রেও হতে পারে। ডিসেপিয়ারেন্স (গুম) হয়ে গেল, ৫ বছর তার কোন খবর নাই? এর দায় দায়িত্ব কে নিবে? রাষ্ট্র নিবে? রাষ্ট্রপক্ষকে আদালত বলেন, এই রায় পুরোটা রিভিউ হবে না। কোন কোন ক্ষেত্রে আপত্তি, তা সুনির্দিষ্ট করে লিখিত দেন। ১৬ এপ্রিল ২০২০ পরবর্তী তারিখ ধার্য করা হলো।

পরে মাহবুবে আলম বলেন, আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে আমরা রিভিউ আবেদন করি। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জঙ্গিসহ বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় বিদ্যমান আইনের সঙ্গে কোন কোন নির্দেশনা অসঙ্গতিপূর্ণ নয়, সে বিষয়গুলো আদালতে তুলে ধরতে আমরা রিভিউ করেছি।

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের করা আপিল খারিজ করে দিয়েছে আপিল বিভাগ। এ বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল ২০১৬ সালের ২৪ মে আপিল বিভাগ কিছু নির্দেশনা দিয়ে খারিজ করে দেয়।

১৯৯৮ সালে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে বেসরকারি ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়। ওই বছরের ২৩ জুলাই মিন্টো রোডের গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে মারা যান রুবেল। এরপর তৎকালীন সরকার রুবেল হত্যা তদন্তের জন্য বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের সমন্বয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত শেষে কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ করে। এ সুপারিশ বাস্তবায়িত না হওয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) হাইকোর্টে রিট করে। ওই রিট মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল এ ব্যাপারে কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে ছয় মাসের মধ্যে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রচলিত বিধান সংশোধন করতে নির্দেশ দেয়া হয়। পাশাপাশি ওই ধারাগুলো সংশোধনের আগে কয়েক দফা নির্দেশনা মেনে চলার জন্য সরকারকে বলা হয়।

২০০৪ সালে আপিল বিভাগ সরকারের লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) মঞ্জুর করে। তবে হাইকোর্টের ওই নির্দেশনাগুলো স্থগিত করেনি। দীর্ঘদিন পরে ২০১৬ সালের ১৭ মে আপিল শুনানি শেষে ২৪ মে রায় ঘোষণা করেন।

ওই বছরের ১০ নভেম্বর ৫৪ ধারা নিয়ে দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করা হয়। যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য ১০ দফা নীতিমালা করে দেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটদের জন্য নয় দফা নীতিমালা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব পালনের বিষয়ে সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।

নীতিমালায় সর্বোচ্চ আদালত বলেন, গ্রেফতারের স্থান ও সময়ে ব্যক্তির স্বাক্ষরসহ গ্রেফতারের পরপরই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এ বিষয়ে একটি মেমোরেন্ডাম তৈরি করবেন। গ্রেফতারের সময় ও স্থান এবং আটক রাখার জায়গা গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির আত্মীয়কে জানাতে হবে। আত্মীয়স্বজনকে না পেলে বিষয়টি ব্যক্তির নির্দেশনা অনুসারে তার বন্ধুকে জানাতে হবে। এ কাজে ১২ ঘণ্টা অতিক্রম করা যাবে না।

‘কোন যুক্তিতে, কাউকে কোন তথ্যে বা অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে, ঠিকানাসহ তা কেস ডায়েরিতে লিখতে হবে। আটক ব্যক্তি কোন কর্মকর্তার তদারকিতে রয়েছেন, তাও উল্লেখ করতে হবে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতারের জন্য কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা যাবে না। গ্রেফতারের সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও উপস্থিত মানুষের সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তাদের পরিচয় বলতে হবে, প্রয়োজনে পরিচয়পত্র দেখাতে হবে’।

রায়ে আদালত আরও বলেন, ‘গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির শরীরে কোন আঘাত থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তা রেকর্ড করে চিকিৎসার জন্য তাকে কাছের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের কাছ থেকে সনদপত্রাদি নিতে হবে’। ব্যক্তির গ্রেফতার যদি তার বাসা বা কর্মক্ষেত্র থেকে না হয়, সেক্ষেত্রে থানায় নেয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যে বিষয়টি তার স্বজনকে লিখিতভাবে জানাতে হবে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি চাইলে তাকে যেকোন স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ বা আইনজীবীর কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। কোন ব্যক্তিকে যখন আদালতে হাজির করা হবে, তখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তার ফরওয়ার্ডিং লেটারে উল্লেখ করবেন যে, কেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত শেষ করা সম্ভব নয়। ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ সুনির্দিষ্ট বলে তিনি মনে করছেন, তাও উল্লেখ করতে হবে।

ম্যাজিস্ট্রেট, বিচারকদের জন্য গাইডলাইনে বলা হয়েছে, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ (২) ধারা অনুসারে ডায়েরির অনুলিপি ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাউকে আদালতে হাজির করে আটকাদেশ চাইলে ম্যাজিস্ট্রেট, আদালত, ট্রাইব্যুনাল একটি বন্ড গ্রহণ করে তাকে মুক্তি দিয়ে দেবেন। আটক থাকা কোন ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অন্য কোন সুনির্দিষ্ট মামলায় যদি গ্রেফতার দেখাতে চায়, সেক্ষেত্রে যদি ডায়েরির অনুলিপিসহ তাকে হাজির না করা হয়, তাহলে আদালত তা মঞ্জুর করবেন না। গ্রেফতার দেখানোর আবেদনের ভিত্তি না থাকলে বিচারক আবেদন খারিজ করে দেবেন।

উপরোক্ত শর্ত অনুসারে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির আটকের পর থেকে ১৫ দিনের মধ্যে মামলার তদন্ত শেষ না হলে এবং মামলাটি যদি দায়রা আদালত বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক এক্সক্লুসিভলি বিচারযোগ্য হয়, সেক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যক্তিকে ৩৪৪ ধারা অনুসারে রিমান্ড দিতে পারেন, যা একবারে ১৫ দিনের বেশি হবে না। ফরওয়ার্ডিং লেটার এবং মামলার ডায়েরিতে তাকে আটক রাখার মতো যথাযথ উপাদান পাওয়া গেলে বিচারিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করা পর্যন্ত আদালত পুনঃআটকের আদেশ দিতে পারেন। কোন কাজ থেকে বিরত রাখতে ইতোমধ্যে গ্রেফতারকৃত কোন ব্যক্তিকে আটকের আবেদন বিচারক মঞ্জুর করবেন না।

‘১৬৭ ধারায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কোন আদালতে হাজির করা হলে শর্তগুলো পূরণ করা হয়েছে কিনা, সেটা দেখা ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারকের দায়িত্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ যদি কাউকে আইনের বাইরে গিয়ে আটক করে থাকেন, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট দ-বিধির ২২০ ধারায় তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবেন। হেফাজতে কারও মৃত্যু হলে বিচারক মেডিকেল বোর্ড গঠন করে মৃত ব্যক্তিকে পরীক্ষা করাবেন। এমনকি দাফন হয়ে গেলেও সেটা করতে হবে। নিপীড়নে মৃত্যু হয়েছে বলে প্রতিবেদন পাওয়া গেলে হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন অনুসারে ওই কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কমান্ডিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নিতে হবে। মেডিকেল প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে নির্যাতনের ফলে হেফাজতে মৃত্যু বা নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হলে বিচারক স্বপ্রণোদিত হয়ে ওই অপরাধ আমলে নেবেন। মামলা দায়েরের অপেক্ষা করবেন না।

পূর্ণাঙ্গ এই রায়টি পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। গতকাল যার শুনানি নিয়ে আদালত পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করে দেন।

শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ১ ফল্গুন ১৪২৬, ১৯ জমাদিউল সানি ১৪৪১

৫৪ ধারায় গ্রেফতার

রায় ১৬ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি

ক্ষোভ আপিল বিভাগের

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

বিনা পরোয়ানায় ৫৪ ধারায় গ্রেফতারের বিষয়ে ১৬ বছরেও হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে আপিল বিভাগ বলেছেন, তাহলে রায় দিয়ে লাভ কি? এটা কি আইওয়াশ?

গতকাল প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ৬ সদস্যেরর আপিল বেঞ্চ এমন মন্তব্য করেন। বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা ও রিমান্ড সংক্রান্ত ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশনার বিষয়ে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আবেদন গ্রহণ করে এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য ১৬ এপ্রিল দিন ধার্য করেছেন আপিল বিভাগ। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। রিটের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট ইদ্রিসুর রহমান ও ব্যারিস্টার সারা হোসেন।

আদালত বলেন, ৫৪ ধারায় গ্রেফতার তো আমাদের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে? আত্মীয়স্বজনদের ক্ষেত্রেও হতে পারে। ডিসেপিয়ারেন্স (গুম) হয়ে গেল, ৫ বছর তার কোন খবর নাই? এর দায় দায়িত্ব কে নিবে? রাষ্ট্র নিবে? রাষ্ট্রপক্ষকে আদালত বলেন, এই রায় পুরোটা রিভিউ হবে না। কোন কোন ক্ষেত্রে আপত্তি, তা সুনির্দিষ্ট করে লিখিত দেন। ১৬ এপ্রিল ২০২০ পরবর্তী তারিখ ধার্য করা হলো।

পরে মাহবুবে আলম বলেন, আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে আমরা রিভিউ আবেদন করি। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জঙ্গিসহ বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় বিদ্যমান আইনের সঙ্গে কোন কোন নির্দেশনা অসঙ্গতিপূর্ণ নয়, সে বিষয়গুলো আদালতে তুলে ধরতে আমরা রিভিউ করেছি।

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের করা আপিল খারিজ করে দিয়েছে আপিল বিভাগ। এ বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল ২০১৬ সালের ২৪ মে আপিল বিভাগ কিছু নির্দেশনা দিয়ে খারিজ করে দেয়।

১৯৯৮ সালে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে বেসরকারি ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়। ওই বছরের ২৩ জুলাই মিন্টো রোডের গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে মারা যান রুবেল। এরপর তৎকালীন সরকার রুবেল হত্যা তদন্তের জন্য বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের সমন্বয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত শেষে কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ করে। এ সুপারিশ বাস্তবায়িত না হওয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) হাইকোর্টে রিট করে। ওই রিট মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল এ ব্যাপারে কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে ছয় মাসের মধ্যে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রচলিত বিধান সংশোধন করতে নির্দেশ দেয়া হয়। পাশাপাশি ওই ধারাগুলো সংশোধনের আগে কয়েক দফা নির্দেশনা মেনে চলার জন্য সরকারকে বলা হয়।

২০০৪ সালে আপিল বিভাগ সরকারের লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) মঞ্জুর করে। তবে হাইকোর্টের ওই নির্দেশনাগুলো স্থগিত করেনি। দীর্ঘদিন পরে ২০১৬ সালের ১৭ মে আপিল শুনানি শেষে ২৪ মে রায় ঘোষণা করেন।

ওই বছরের ১০ নভেম্বর ৫৪ ধারা নিয়ে দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করা হয়। যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য ১০ দফা নীতিমালা করে দেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটদের জন্য নয় দফা নীতিমালা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব পালনের বিষয়ে সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।

নীতিমালায় সর্বোচ্চ আদালত বলেন, গ্রেফতারের স্থান ও সময়ে ব্যক্তির স্বাক্ষরসহ গ্রেফতারের পরপরই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এ বিষয়ে একটি মেমোরেন্ডাম তৈরি করবেন। গ্রেফতারের সময় ও স্থান এবং আটক রাখার জায়গা গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির আত্মীয়কে জানাতে হবে। আত্মীয়স্বজনকে না পেলে বিষয়টি ব্যক্তির নির্দেশনা অনুসারে তার বন্ধুকে জানাতে হবে। এ কাজে ১২ ঘণ্টা অতিক্রম করা যাবে না।

‘কোন যুক্তিতে, কাউকে কোন তথ্যে বা অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে, ঠিকানাসহ তা কেস ডায়েরিতে লিখতে হবে। আটক ব্যক্তি কোন কর্মকর্তার তদারকিতে রয়েছেন, তাও উল্লেখ করতে হবে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতারের জন্য কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা যাবে না। গ্রেফতারের সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও উপস্থিত মানুষের সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তাদের পরিচয় বলতে হবে, প্রয়োজনে পরিচয়পত্র দেখাতে হবে’।

রায়ে আদালত আরও বলেন, ‘গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির শরীরে কোন আঘাত থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তা রেকর্ড করে চিকিৎসার জন্য তাকে কাছের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের কাছ থেকে সনদপত্রাদি নিতে হবে’। ব্যক্তির গ্রেফতার যদি তার বাসা বা কর্মক্ষেত্র থেকে না হয়, সেক্ষেত্রে থানায় নেয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যে বিষয়টি তার স্বজনকে লিখিতভাবে জানাতে হবে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি চাইলে তাকে যেকোন স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ বা আইনজীবীর কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। কোন ব্যক্তিকে যখন আদালতে হাজির করা হবে, তখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তার ফরওয়ার্ডিং লেটারে উল্লেখ করবেন যে, কেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত শেষ করা সম্ভব নয়। ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ সুনির্দিষ্ট বলে তিনি মনে করছেন, তাও উল্লেখ করতে হবে।

ম্যাজিস্ট্রেট, বিচারকদের জন্য গাইডলাইনে বলা হয়েছে, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ (২) ধারা অনুসারে ডায়েরির অনুলিপি ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাউকে আদালতে হাজির করে আটকাদেশ চাইলে ম্যাজিস্ট্রেট, আদালত, ট্রাইব্যুনাল একটি বন্ড গ্রহণ করে তাকে মুক্তি দিয়ে দেবেন। আটক থাকা কোন ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অন্য কোন সুনির্দিষ্ট মামলায় যদি গ্রেফতার দেখাতে চায়, সেক্ষেত্রে যদি ডায়েরির অনুলিপিসহ তাকে হাজির না করা হয়, তাহলে আদালত তা মঞ্জুর করবেন না। গ্রেফতার দেখানোর আবেদনের ভিত্তি না থাকলে বিচারক আবেদন খারিজ করে দেবেন।

উপরোক্ত শর্ত অনুসারে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির আটকের পর থেকে ১৫ দিনের মধ্যে মামলার তদন্ত শেষ না হলে এবং মামলাটি যদি দায়রা আদালত বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক এক্সক্লুসিভলি বিচারযোগ্য হয়, সেক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যক্তিকে ৩৪৪ ধারা অনুসারে রিমান্ড দিতে পারেন, যা একবারে ১৫ দিনের বেশি হবে না। ফরওয়ার্ডিং লেটার এবং মামলার ডায়েরিতে তাকে আটক রাখার মতো যথাযথ উপাদান পাওয়া গেলে বিচারিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করা পর্যন্ত আদালত পুনঃআটকের আদেশ দিতে পারেন। কোন কাজ থেকে বিরত রাখতে ইতোমধ্যে গ্রেফতারকৃত কোন ব্যক্তিকে আটকের আবেদন বিচারক মঞ্জুর করবেন না।

‘১৬৭ ধারায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কোন আদালতে হাজির করা হলে শর্তগুলো পূরণ করা হয়েছে কিনা, সেটা দেখা ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারকের দায়িত্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ যদি কাউকে আইনের বাইরে গিয়ে আটক করে থাকেন, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট দ-বিধির ২২০ ধারায় তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবেন। হেফাজতে কারও মৃত্যু হলে বিচারক মেডিকেল বোর্ড গঠন করে মৃত ব্যক্তিকে পরীক্ষা করাবেন। এমনকি দাফন হয়ে গেলেও সেটা করতে হবে। নিপীড়নে মৃত্যু হয়েছে বলে প্রতিবেদন পাওয়া গেলে হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন অনুসারে ওই কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কমান্ডিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নিতে হবে। মেডিকেল প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে নির্যাতনের ফলে হেফাজতে মৃত্যু বা নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হলে বিচারক স্বপ্রণোদিত হয়ে ওই অপরাধ আমলে নেবেন। মামলা দায়েরের অপেক্ষা করবেন না।

পূর্ণাঙ্গ এই রায়টি পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। গতকাল যার শুনানি নিয়ে আদালত পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করে দেন।