ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ও সিএনজি খাত নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা

একদিকে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে, অন্যদিকে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কমিয়ে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ও সিএনজি খাত নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অথচ সংকটকালে এ দুটো খাতকে ব্যাপক উৎসাহ দেয়া হয়েছিল।

সরকার বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলা করতে একসময় শিল্পকারখানার মালিকদের নিজ উদ্যোগে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে উৎসাহিত করেছে। আবার ঢাকার বায়ুদূষণ কমাতে যানবাহনে গ্যাসের ব্যবহার চালু করতে সিএনজি ফিলিং স্টেশন স্থাপনেও ব্যবসায়ীদের উৎসাহ-সহযোগিতা দেয়া হয়েছে। সরকারের আগ্রহে এসব খাতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। এখন সরকারের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার নীতিতে শঙ্কিত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু একাদশ জাতীয় সংসদের ৬ষ্ঠ অধিবেশনে বলেছেন, দেশে বর্তমানে দেশে ১০ দশমিক ৬৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিএফসি) উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মজুদ রয়েছে। দেশে বিদ্যমান গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে বর্তমানে দৈনিক ২ হাজার ৫৭০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ) গ্যাস উৎপাদন (উত্তোলন) করা হচ্ছে। এই হারে গ্যাস উৎপাদন অব্যাহত থাকলে উক্ত মজুদ (১০ দশমিক ৬৩ টিসিএফ) গ্যাস দিয়ে আর ১১ বছর ব্যবহার করা সম্ভব হবে। পেট্রোবাংলার তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে দৈনিক গড়ে মোট ৩ হাজার ১৬০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ) গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এরমধ্যে দেশীয় গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ ২ হাজার ৫৭০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ) এবং আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহের পরিমাণ দৈনিক ৫৯০ এমএমসিএফ। তবে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা গড়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার এমএমসিএফ। গ্যাস সংকটের কথা বলে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানি বাড়ানো হচ্ছে, দেশীয় গ্যাসের দামও বাড়ানো হচ্ছে। আবার গ্যাসের সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক মূল্য নিশ্চিত করতে করার কথা বলতে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ও সিএনজি খাতে গ্যাস বন্ধ করে দেয়ার কথাও ভাবছে সরকার।

বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে ২০৩০ সালে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ৪০ হাজার মেগাওয়াট হবে। এই পরিকল্পনায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিল্পাঞ্চলের চাহিদাসহ সারাদেশের চাহিদা বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এখন যদি শিল্পকারখানাগুলোতে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকে উৎসাহিত করা হয়, তাহলে গ্রিড বিদ্যুতের যথাযথ ব্যবহার হবে না। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হবে। ওই কর্মকর্তা জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়লেও পূর্বাভাস অনুযায়ী চাহিদা বাড়েনি। ফলে স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার একটা বড় অংশ অলস বসে থাকছে। পরিস্থিতির সামাল দিতে শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা- যা ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ নামে পরিচিত, তাতে লাগাম পরাতে চায় সরকার। বিপরীতে শিল্পকারখানায় জাতীয় গ্রিড থেকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াতে চায়। এজন্য ক্যাপটিভে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি সরবরাহ কমিয়ে আনার চিন্তাও রয়েছে।

তবে ক্যাপটিভ নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগের সঙ্গে ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তারা দ্বিমত প্রকাশ করে বলছেন, ক্যাপটিভের ক্ষেত্রে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত দেশের শিল্প খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করবে। তাদের দাবি, শিল্পোৎপাদন চালু রাখতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রয়োজন। কিন্তু গ্রিড বিদ্যুতে সেই নিশ্চয়তা নেই। এজন্য ব্যয় বেশি হলেও তারা ক্যাপটিভ বা নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে গাজীপুরের কারখানাগুলোতে বছরে ৪৩৮ ঘণ্টা, চট্টগ্রামে ৩৩৮ ঘণ্টা, সাভারে ৩৩০ ঘণ্টা এবং নারায়ণগঞ্জে ২৯২ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়। একজন টেক্সটাইল কারখানার মালিক জানিয়েছেন, ক্যাপটিভ পাওয়ারপ্ল্যান্ট চালাতে তেল খরচসহ বছরে তার বাড়তি ১০ কোটি টাকা খরচ হয়। কিন্তু উৎপাদন যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সে জন্য এই অতিরিক্ত খরচ মেনে নিতে হচ্ছে।

বর্তমানে দেশের বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৭৮৭ মেগাওয়াট। কিন্তু চাহিদা সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৫৭ মেগাওয়াট; শীতে আরও কম। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে প্রায় এক হাজার ৭৭১টি শিল্পকারখানায় ক্যাপটিভ বিদ্যুৎতের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এগুলোতে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে প্রতিদিন। যার মাধ্যমে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সেগুলো শিল্পকারখানার মালিকরা ব্যবহার করছেন। পাওয়ার সেলের দাবি, এখান থেকে ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরকারি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা গেলে প্রতিইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ অন্তত ৬৭ পয়সা কমানো সম্ভব হতো।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে গত ১১ ডিসেম্বর ‘শিল্পকারাখানায় ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ’ চালু রাখা সংক্রান্ত একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বিদ্যুৎ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্যাপটিভ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের অপচয় হয় বিধায় এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ দেন। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের অপর এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, যেসব শিল্প এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব, সেসব এলাকায় ক্যাপটিভ বিদ্যুতের জন্য গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ করা হবে। বিদ্যুতের বিতরণ কোম্পানিগুলোকে এ ধরনের অঞ্চলের তালিকা দ্রুত প্রস্তুত করার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে যেসব জায়গায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে, সেখানে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ চালু থাকবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, শিল্পকারখানার জন্য নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সরকার এজন্য উদ্যোগ নিয়েছে। ধীরে ধীরে ক্যাপটিভ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত। ক্যাপটিভের গ্যাস বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পেলে আরও সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এতে অপচয়ও কম হবে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, সবার জন্য নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে ক্যাপটিভ পাওয়ারের গ্যাস বন্ধ বা সীমিত করার বিষয়টি ভাবতে পারে সরকার। তবে এখনও সে অবস্থা তৈরি হয়নি। বর্তমান অবস্থায় ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ বা সীমিত করা হলে শিল্পকারখানার ক্ষতি হবে। যার প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়বে।

২০০০ সালে সিএনজির ব্যবহার শুরুর সময়ে প্রতি ঘনমিটার সিএনজি সাড়ে ৭ টাকা করে বিক্রি হতো, সর্বশেষ প্রতি ঘনমিটারের মূল্য ছিল ৩৮ টাকা। গত বছর জুনে আরও ৫ টাকা বাড়িয়ে প্রতি ঘনমিটার এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৩ টাকায়। বর্তমানে সারাদেশে ৫৬০টি সিএনজি ফিলিং স্টেশন রয়েছ্ েঅভিযোগ রয়েছে, যানবাহনে অটোগ্যাস বা তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের বাজার প্রতিষ্ঠিত করতেও সিএনজি খাতকে ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এদিকে ক্যাপটিভ পাওয়ারে সর্বশেষ গ্যাসের মূল্য ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৮ টাকা ৯৮ পয়সা, যা গত জুনে বাড়িয়ে ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্শন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর এ বিষয়ে সংবাদকে বলেন, ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশ মেলায় গিয়ে ঢাকা শহরসহ সারাদেশকে বায়ুদূষণ থেকে রক্ষার জন্য পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবে সিএনজিকে বেসরকারিকরণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে সময় থেকেই সিএনজির গোড়াপত্তন হয়। প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ উৎসাহেই ব্যবসায়ীরা এ খাতে বিনিয়োগ করেছিলেন। এছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলা পাঁচ লক্ষাধিক থ্রি হুইলারের চালকসহ এ খাতে প্রায় ১০ লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, বর্তমানে এ খাতে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। ফারহান নূর বলেন, দেশে উৎপাদিত গ্যাসের ৫ শতাংশেরও কম সিএনজি খাতে ব্যবহার হয়। অথচ সরকার গ্যাসের মোট রাজস্বের ২২ শতাংশের বেশি পাচ্ছে এই খাত থেকে। এখন সিএনজি খাতে সরকারের নেতিবাচক সিদ্ধান্তের প্রভাব ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি এ খাত সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শ্রেণী-পেশার মানুষের ওপরও পড়বে।

শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ১ ফল্গুন ১৪২৬, ১৯ জমাদিউল সানি ১৪৪১

গ্যাসের দাম বাড়িয়ে-সরবরাহ কমিয়ে

ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ও সিএনজি খাত নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা

ফয়েজ আহমেদ তুষার

একদিকে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে, অন্যদিকে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কমিয়ে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ও সিএনজি খাত নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অথচ সংকটকালে এ দুটো খাতকে ব্যাপক উৎসাহ দেয়া হয়েছিল।

সরকার বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলা করতে একসময় শিল্পকারখানার মালিকদের নিজ উদ্যোগে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে উৎসাহিত করেছে। আবার ঢাকার বায়ুদূষণ কমাতে যানবাহনে গ্যাসের ব্যবহার চালু করতে সিএনজি ফিলিং স্টেশন স্থাপনেও ব্যবসায়ীদের উৎসাহ-সহযোগিতা দেয়া হয়েছে। সরকারের আগ্রহে এসব খাতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। এখন সরকারের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার নীতিতে শঙ্কিত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু একাদশ জাতীয় সংসদের ৬ষ্ঠ অধিবেশনে বলেছেন, দেশে বর্তমানে দেশে ১০ দশমিক ৬৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিএফসি) উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মজুদ রয়েছে। দেশে বিদ্যমান গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে বর্তমানে দৈনিক ২ হাজার ৫৭০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ) গ্যাস উৎপাদন (উত্তোলন) করা হচ্ছে। এই হারে গ্যাস উৎপাদন অব্যাহত থাকলে উক্ত মজুদ (১০ দশমিক ৬৩ টিসিএফ) গ্যাস দিয়ে আর ১১ বছর ব্যবহার করা সম্ভব হবে। পেট্রোবাংলার তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে দৈনিক গড়ে মোট ৩ হাজার ১৬০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ) গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এরমধ্যে দেশীয় গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ ২ হাজার ৫৭০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ) এবং আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহের পরিমাণ দৈনিক ৫৯০ এমএমসিএফ। তবে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা গড়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার এমএমসিএফ। গ্যাস সংকটের কথা বলে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানি বাড়ানো হচ্ছে, দেশীয় গ্যাসের দামও বাড়ানো হচ্ছে। আবার গ্যাসের সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক মূল্য নিশ্চিত করতে করার কথা বলতে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ও সিএনজি খাতে গ্যাস বন্ধ করে দেয়ার কথাও ভাবছে সরকার।

বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে ২০৩০ সালে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ৪০ হাজার মেগাওয়াট হবে। এই পরিকল্পনায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিল্পাঞ্চলের চাহিদাসহ সারাদেশের চাহিদা বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এখন যদি শিল্পকারখানাগুলোতে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকে উৎসাহিত করা হয়, তাহলে গ্রিড বিদ্যুতের যথাযথ ব্যবহার হবে না। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হবে। ওই কর্মকর্তা জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়লেও পূর্বাভাস অনুযায়ী চাহিদা বাড়েনি। ফলে স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার একটা বড় অংশ অলস বসে থাকছে। পরিস্থিতির সামাল দিতে শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা- যা ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ নামে পরিচিত, তাতে লাগাম পরাতে চায় সরকার। বিপরীতে শিল্পকারখানায় জাতীয় গ্রিড থেকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াতে চায়। এজন্য ক্যাপটিভে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি সরবরাহ কমিয়ে আনার চিন্তাও রয়েছে।

তবে ক্যাপটিভ নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগের সঙ্গে ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তারা দ্বিমত প্রকাশ করে বলছেন, ক্যাপটিভের ক্ষেত্রে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত দেশের শিল্প খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করবে। তাদের দাবি, শিল্পোৎপাদন চালু রাখতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রয়োজন। কিন্তু গ্রিড বিদ্যুতে সেই নিশ্চয়তা নেই। এজন্য ব্যয় বেশি হলেও তারা ক্যাপটিভ বা নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে গাজীপুরের কারখানাগুলোতে বছরে ৪৩৮ ঘণ্টা, চট্টগ্রামে ৩৩৮ ঘণ্টা, সাভারে ৩৩০ ঘণ্টা এবং নারায়ণগঞ্জে ২৯২ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়। একজন টেক্সটাইল কারখানার মালিক জানিয়েছেন, ক্যাপটিভ পাওয়ারপ্ল্যান্ট চালাতে তেল খরচসহ বছরে তার বাড়তি ১০ কোটি টাকা খরচ হয়। কিন্তু উৎপাদন যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সে জন্য এই অতিরিক্ত খরচ মেনে নিতে হচ্ছে।

বর্তমানে দেশের বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৭৮৭ মেগাওয়াট। কিন্তু চাহিদা সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৫৭ মেগাওয়াট; শীতে আরও কম। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে প্রায় এক হাজার ৭৭১টি শিল্পকারখানায় ক্যাপটিভ বিদ্যুৎতের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এগুলোতে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে প্রতিদিন। যার মাধ্যমে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সেগুলো শিল্পকারখানার মালিকরা ব্যবহার করছেন। পাওয়ার সেলের দাবি, এখান থেকে ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরকারি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা গেলে প্রতিইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ অন্তত ৬৭ পয়সা কমানো সম্ভব হতো।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে গত ১১ ডিসেম্বর ‘শিল্পকারাখানায় ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ’ চালু রাখা সংক্রান্ত একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বিদ্যুৎ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্যাপটিভ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের অপচয় হয় বিধায় এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ দেন। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের অপর এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, যেসব শিল্প এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব, সেসব এলাকায় ক্যাপটিভ বিদ্যুতের জন্য গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ করা হবে। বিদ্যুতের বিতরণ কোম্পানিগুলোকে এ ধরনের অঞ্চলের তালিকা দ্রুত প্রস্তুত করার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে যেসব জায়গায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে, সেখানে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ চালু থাকবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, শিল্পকারখানার জন্য নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সরকার এজন্য উদ্যোগ নিয়েছে। ধীরে ধীরে ক্যাপটিভ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত। ক্যাপটিভের গ্যাস বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পেলে আরও সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এতে অপচয়ও কম হবে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, সবার জন্য নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে ক্যাপটিভ পাওয়ারের গ্যাস বন্ধ বা সীমিত করার বিষয়টি ভাবতে পারে সরকার। তবে এখনও সে অবস্থা তৈরি হয়নি। বর্তমান অবস্থায় ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ বা সীমিত করা হলে শিল্পকারখানার ক্ষতি হবে। যার প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়বে।

২০০০ সালে সিএনজির ব্যবহার শুরুর সময়ে প্রতি ঘনমিটার সিএনজি সাড়ে ৭ টাকা করে বিক্রি হতো, সর্বশেষ প্রতি ঘনমিটারের মূল্য ছিল ৩৮ টাকা। গত বছর জুনে আরও ৫ টাকা বাড়িয়ে প্রতি ঘনমিটার এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৩ টাকায়। বর্তমানে সারাদেশে ৫৬০টি সিএনজি ফিলিং স্টেশন রয়েছ্ েঅভিযোগ রয়েছে, যানবাহনে অটোগ্যাস বা তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের বাজার প্রতিষ্ঠিত করতেও সিএনজি খাতকে ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এদিকে ক্যাপটিভ পাওয়ারে সর্বশেষ গ্যাসের মূল্য ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৮ টাকা ৯৮ পয়সা, যা গত জুনে বাড়িয়ে ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্শন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর এ বিষয়ে সংবাদকে বলেন, ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশ মেলায় গিয়ে ঢাকা শহরসহ সারাদেশকে বায়ুদূষণ থেকে রক্ষার জন্য পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবে সিএনজিকে বেসরকারিকরণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে সময় থেকেই সিএনজির গোড়াপত্তন হয়। প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ উৎসাহেই ব্যবসায়ীরা এ খাতে বিনিয়োগ করেছিলেন। এছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলা পাঁচ লক্ষাধিক থ্রি হুইলারের চালকসহ এ খাতে প্রায় ১০ লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, বর্তমানে এ খাতে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। ফারহান নূর বলেন, দেশে উৎপাদিত গ্যাসের ৫ শতাংশেরও কম সিএনজি খাতে ব্যবহার হয়। অথচ সরকার গ্যাসের মোট রাজস্বের ২২ শতাংশের বেশি পাচ্ছে এই খাত থেকে। এখন সিএনজি খাতে সরকারের নেতিবাচক সিদ্ধান্তের প্রভাব ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি এ খাত সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শ্রেণী-পেশার মানুষের ওপরও পড়বে।