আমজনতার অর্থনীতি

একজন সৃজনশীল সুভাষ দত্ত

বিশিষ্ট অভিনেতা, চলচ্চিত্রকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সুভাষ দত্ত (৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৩০-১৬ নভেম্বর ২০১২) ছিলেন একজন সৃজনশীল সত্তা, কুশলী কৃতবিদ, সৎ ও স্বচ্ছ মনের অধিকারী। প্রায় এক যুগ আগে নিজের সহযাত্রী আত্মীয়ের সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু দেখে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তার উপলব্ধির স্তরে এমন আলোড়ন সৃষ্টি হয় যে, পরবর্তী কালে তিনি সর্ববাদী, সাত্ত্বিক সাধনায় নিবেদিত হন। তার ‘আলিঙ্গন’ ছবিতে এ ধরনের একটি চরিত্রের সঙ্গে সাক্ষাত ঘটেছিল আমাদের। তার মধ্যে আমরা এমন একটি চরিত্রের সন্ধান পাই যার কাছে সকল ধর্ম ও মতের মধ্যে ঐকমত্যের মর্মবাণী অনুভূত হয়। রামকৃষ্ণ মিশনের অনুরক্ত অনুসারী, বেলুড়মঠের নরেন্দ্রপুরের আত্মিক সাধনার সাত্ত্বিক পুরুষ সুভাষ দত্ত ‘মনরে চল নিজের নিকেতনে’ স্বামী বিবেকানন্দের এই ভুয়োদর্শনে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। সকল প্রকার সংকীর্ণতা রহিত সুভাষ দত্ত সর্ববাদী মতাদর্শের ছিলেন। তিনি অকপটে লিখেছেন-

আমি ধর্মান্ধ নই, আমার ভেতর কোন সংকীর্ণতা নেই। আমি আজমীর শরীফে গিয়েছি বেশ কয়েকবার। শাহজালাল, শাহ পরাণ, শাহ মোস্তান, হাইকোর্টের মাজার, মিরপুরের মাজার এসব জায়গায় আমি গিয়েছি। টুপি পরে বা মাথায় পাগড়ি দিয়ে ধ্যান করেছি, মোনাজাত করেছি। আমি মিলাদ মাহফিলে শরিক হয়েছি। চার্চে নতজানু হয়ে যীশুর সামনে প্রার্থনা করেছি, গেছি বৌদ্ধবিহারে।’

অনন্য সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী সুভাষ দত্তের শিল্পভাবনার শর্ত ও মূল্যবোধ ছিল- জীবন সংগ্রামে মুখর তুখোড় তৎপরতা শেষে শিকড়ের কাছে প্রত্যাবর্তন, নিজের উপলব্ধির কাছে ফিরে আসা। পৈত্রিক নিবাস বগুড়ার সারিয়াকান্দি ধুনটের হাটশের গ্রামে আর লেখাপড়ার হাতেখড়ি দিনাজপুরে মাতুলালয়ে, বড় হয়েছেন সেখানে। নিজে পড়াশুনার পাঠ মাঝপথে চুকিয়ে ‘ফিল্মের টানে’ সুদূর বোম্বেতে পাড়ি জমিয়েছিলেন, সেখানে ’অনেক কিছু’ করার পর দেশে, সেই দিনাজপুরেই ফিরেছিলেন। ‘জীবিকার শহর ঢাকায়’ তার পদার্পণ ১৯৫৩ সালের ২৩ নভেম্বর।

ঢাকায় সিনেমার প্রচারপত্র ও আর্ট ডিরেকশন এবং বংলা উর্দু ছবিতে কৌতুকপ্রদ চরিত্রে অভিনয় করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিলেন। অসম্ভব অনুসন্ধিৎসু এবং সূক্ষ্ম দৃষ্টির অধিকারী কঠোর পরিশ্রমী এই মানুষটির সব সময় আগ্রহ ছিল সৃজনশীল কিছু করার। জীবনকে যেমন দেখতেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তেমনি এর শিল্পীত রূপায়নেও ভাবতেন বেশি। আর এজন্য তার পড়াশুনা ও অধ্যবসায় শেষমেশ মেষে সেলুলয়েডের ফিতার ক্যানভাসে জীবনের নিত্যতাকে তুলে ধরার।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্প যখন পশ্চিম বাংলার সেরা সব বাংলা ছবি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ছবির প্রচ- ঢেউয়ের ধাক্কায় নিরুদ্দেশ যাত্রী, এই ঢাকাতেও উর্দু ছবি নির্মানের বন্যা বইতে শুরু করেছিল, বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষার আান্দোলনে রক্ত দিতে হচ্ছিল, স্বাধিকার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অয়োময় আকাক্সক্ষা যখন দানা বাঁধছিল সেই সময়ে ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্ত ‘সুতরাং’ ছবি নির্মাণ করে বাঙালির, বাংলা সংস্কৃতির, সৃজনশীলতার, মৌলিকত্বের মর্মমূলে যেন আত্মবিশ্বাসের বিজয় নিশান উড়িয়ে দিলেন। সুতরাং সবাই নুতন- চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার, নায়িকা, নায়ক, প্রযোজক, এরা সবাই যেন এক কাতারে শামিল হলেন- নতুন পথের, প্রত্যয়দীপ্ত নবযাত্রার অভিষেক ঘটাতে। সুভাষ দত্ত ‘সুতরাং’ করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প নেন ১৯৬২ সালের শেষের দিকে। পত্রিকায় সুতরাং বানানোর বিজ্ঞাপন দেখে বাংলাবাজারের মেসে বসবাসকারী জনৈক সত্য সাহা ( ১৯৩৪-১৯৯৯) সত্যিই সাহস করে এসে সুরকার হতে চাইলেন।

তার নায়িকা চট্টগ্রামের মিনা পাল। তার আবিষ্কারের কাহিনটিও অভিনব।

‘আমি ছবির ষোলোটি দৃশ্যের স্কেচ এঁকে পাঠালাম। স্কেচ দেখে মিনার ছবি তুলে আনলেন সত্য সাহা। কয়েকটি ফটোগ্রাফ খুবই ভালো লাগল। বললাম, ঠিক আছে। ওকে আসতে বলো। তারপর মিনা তার বাপ এবং বোনদের নিয়ে ঢাকায় এলো। এখন আমার দুই প্রডিউসার ওকে দেখে হৈ চৈ করে উঠলেন। আরে, এ দেখছি খুবই ছোট মেয়ে। বাচ্চা মেয়ে। একে দিয়ে হব নাকি। মিনা পাল ফ্রক পরা ছিল। আমি বললাম, ফ্রকটা ছেড়ে শাড়ি পরে এসো।

ওরা নবাবপুরে, ঢাকা বোডিংয়ে উঠেছিল। সে হোটেলে গিয়ে শাড়ি পরে এলো। দেখলাম ভালোই লাগছে। মুহূর্তে শুয়োপোকা থেকে প্রজাপতির মতো মিনা পাল থেকে কবরী বেরিয়ে আসে। ওর চেহারার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল ওর হাসি।

তার সেরা চলচ্চিত্রগুলোর মর্মবাণী হল শিকড়ের কাছে ফিরে আসা। ‘সুতরাং’ ছবিতে তার নিজের অভিনীত চরিত্র সিপাহী জব্ব্ার শহরে ব্যস্ত সমস্ত কর্ম জীবন ছেড়ে ‘ওরে মন ছুটে চল মধুমতি গায়’, গাইতে গাইতে ফিরেছে গ্রামে। ‘কত ঘুরে এলাম কত দেখে এলাম অশান্ত মনে আমি ছুটে এলাম...আমার গায়ের মতো কভু দেখিনি, সে যে আমার জন্মভূমি...’ আলিঙ্গনের সাধু বাবার মতো সুভাষ দত্ত তার শিল্পকর্মে, বসুন্ধরায় সেই মাটির কাছে ফিরে যাওয়ার আকুতি প্রকাশ করেছেন। তিনি নিজের দেশ, মাটি ও মানুষকে সর্বোচ্চ মহিমায় দেখিয়েছেন। ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দী হয়েও সেই অভিনয় সুনামের সুবাদে পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনের শ্রদ্ধা ও সমীহবোধের কারণে মুক্তি পেয়েছিলেন। নিজের সেই মুক্ত পাওয়ার স্মৃতিকে ‘অরুনোদয়ের অগ্নি সাক্ষীতে’ আনোয়ার হোসেনের অভিনয় জীবনের মধ্যে তুলে ধরেছেন। ‘সুতরাং’ ছবিতে নিজের প্রেমিকা জরিনার মাতৃহারা সস্তানকে লালনপালনের দায়িত্ব নেয়ার ঔদার্য যেমন দেখিয়েছেন তেমনি ১৯৭২ সানে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বীরাঙ্গনাদের সামাজিক পুনর্বাসনে রেখেছেন মানবীয় দর্শনের ব্যাখ্যা ও সমাধানের প্রেরণা। অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকির ‘গলির ধারের ছেলেটি’র চলচ্চিত্রায়নে (ডুমুরের ফুল) একই সঙ্গে শিশু মনস্তত্বের ও মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গির এমন কাব্যিক শোকগাথা নির্মাণ করেন; যা একটি ধ্রুপদি শিল্পকর্মে উন্নীত হয়। ‘আবির্ভাব’ ও ‘বসুন্ধরা’ ছবিতে সন্তানময়ী মায়ের আবেগ ও আকিঞ্চন আকাক্সক্ষাকে শৈল্পিক তুলিতে বিমূর্ত করেছেন। তার তাবৎ চলচ্চিত্রেই মানবিক মূল্যবোধের, সমাজ দর্শনের এবং নিবিষ্ট চিন্তা-চেতনার ভাষ্যে বাঙময় হয়ে উঠেছে।

নারী শিক্ষার অগ্রদূত মহিয়সী মহিলা বেগম রোকেয়ার ওপর সরকারি অনুদানে তার নির্মীয়মান শেষ ছবি শেষ করার ব্যাপারে তিনি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন- এ ছবিতে তিনি বেগম রোকেয়ার সামাজিক ভূমিকাকে বিশেষ ব্যঞ্জনায় তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। দৈনিক ইত্তেফাকে ‘বেগম রোকেয়ার সামাজিক ভূমিকা’ শীর্ষক আমার একটি প্রবন্ধ পড়ে এ ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ বোধ করেছিলেন। সামাজিক গবেষণার প্রতি তার নিষ্ঠা ছিল, প্রচুর পড়াশুনা করতেন। দুর্ভাগ্য, অলঙ্ঘনীয় জটিলতার আবর্ত ও অবগুন্ঠন থেকে বেগম রোকেয়ার ওপর ছবিটি নির্মাণে পৃষ্টপোষকতা সুনিশ্চিত করা যায়নি। এ নিয়ে তিনি প্রায়ই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতেন। কালজয়ী এক সৃজনশীল কাজের অপ্রকাশের এই অব্যক্ত বেদনাবোধ নিয়েই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।

সুভাষ দত্ত একজন মহৎ প্রাণ শিল্পী ছিলেন। চলচ্চিত্রকে শিল্প মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে তার প্রয়াসের যেমন অন্ত ছিল না আবার তার হাতেই বাংলা চলচ্চিত্রে পুঁজি বিনিয়োগের সার্থকতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বলাবাহুল্য তিনিই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে নাবালকত্ব থেকে সাবালকত্বে, উর্দু ছবির ভাববন্ধন থেকে বাংলা ছবিকে রক্তমাংসসহ সবল সতেজ ও শিল্প বিনিয়োগ উপযোগী করে তোলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। পুরো ষাট ও সত্তরের দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথিকৃত ছিলেন তিনি।

[লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান]

শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ১ ফল্গুন ১৪২৬, ১৯ জমাদিউল সানি ১৪৪১

আমজনতার অর্থনীতি

একজন সৃজনশীল সুভাষ দত্ত

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

image

বিশিষ্ট অভিনেতা, চলচ্চিত্রকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সুভাষ দত্ত (৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৩০-১৬ নভেম্বর ২০১২) ছিলেন একজন সৃজনশীল সত্তা, কুশলী কৃতবিদ, সৎ ও স্বচ্ছ মনের অধিকারী। প্রায় এক যুগ আগে নিজের সহযাত্রী আত্মীয়ের সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু দেখে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তার উপলব্ধির স্তরে এমন আলোড়ন সৃষ্টি হয় যে, পরবর্তী কালে তিনি সর্ববাদী, সাত্ত্বিক সাধনায় নিবেদিত হন। তার ‘আলিঙ্গন’ ছবিতে এ ধরনের একটি চরিত্রের সঙ্গে সাক্ষাত ঘটেছিল আমাদের। তার মধ্যে আমরা এমন একটি চরিত্রের সন্ধান পাই যার কাছে সকল ধর্ম ও মতের মধ্যে ঐকমত্যের মর্মবাণী অনুভূত হয়। রামকৃষ্ণ মিশনের অনুরক্ত অনুসারী, বেলুড়মঠের নরেন্দ্রপুরের আত্মিক সাধনার সাত্ত্বিক পুরুষ সুভাষ দত্ত ‘মনরে চল নিজের নিকেতনে’ স্বামী বিবেকানন্দের এই ভুয়োদর্শনে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। সকল প্রকার সংকীর্ণতা রহিত সুভাষ দত্ত সর্ববাদী মতাদর্শের ছিলেন। তিনি অকপটে লিখেছেন-

আমি ধর্মান্ধ নই, আমার ভেতর কোন সংকীর্ণতা নেই। আমি আজমীর শরীফে গিয়েছি বেশ কয়েকবার। শাহজালাল, শাহ পরাণ, শাহ মোস্তান, হাইকোর্টের মাজার, মিরপুরের মাজার এসব জায়গায় আমি গিয়েছি। টুপি পরে বা মাথায় পাগড়ি দিয়ে ধ্যান করেছি, মোনাজাত করেছি। আমি মিলাদ মাহফিলে শরিক হয়েছি। চার্চে নতজানু হয়ে যীশুর সামনে প্রার্থনা করেছি, গেছি বৌদ্ধবিহারে।’

অনন্য সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী সুভাষ দত্তের শিল্পভাবনার শর্ত ও মূল্যবোধ ছিল- জীবন সংগ্রামে মুখর তুখোড় তৎপরতা শেষে শিকড়ের কাছে প্রত্যাবর্তন, নিজের উপলব্ধির কাছে ফিরে আসা। পৈত্রিক নিবাস বগুড়ার সারিয়াকান্দি ধুনটের হাটশের গ্রামে আর লেখাপড়ার হাতেখড়ি দিনাজপুরে মাতুলালয়ে, বড় হয়েছেন সেখানে। নিজে পড়াশুনার পাঠ মাঝপথে চুকিয়ে ‘ফিল্মের টানে’ সুদূর বোম্বেতে পাড়ি জমিয়েছিলেন, সেখানে ’অনেক কিছু’ করার পর দেশে, সেই দিনাজপুরেই ফিরেছিলেন। ‘জীবিকার শহর ঢাকায়’ তার পদার্পণ ১৯৫৩ সালের ২৩ নভেম্বর।

ঢাকায় সিনেমার প্রচারপত্র ও আর্ট ডিরেকশন এবং বংলা উর্দু ছবিতে কৌতুকপ্রদ চরিত্রে অভিনয় করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিলেন। অসম্ভব অনুসন্ধিৎসু এবং সূক্ষ্ম দৃষ্টির অধিকারী কঠোর পরিশ্রমী এই মানুষটির সব সময় আগ্রহ ছিল সৃজনশীল কিছু করার। জীবনকে যেমন দেখতেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তেমনি এর শিল্পীত রূপায়নেও ভাবতেন বেশি। আর এজন্য তার পড়াশুনা ও অধ্যবসায় শেষমেশ মেষে সেলুলয়েডের ফিতার ক্যানভাসে জীবনের নিত্যতাকে তুলে ধরার।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্প যখন পশ্চিম বাংলার সেরা সব বাংলা ছবি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ছবির প্রচ- ঢেউয়ের ধাক্কায় নিরুদ্দেশ যাত্রী, এই ঢাকাতেও উর্দু ছবি নির্মানের বন্যা বইতে শুরু করেছিল, বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষার আান্দোলনে রক্ত দিতে হচ্ছিল, স্বাধিকার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অয়োময় আকাক্সক্ষা যখন দানা বাঁধছিল সেই সময়ে ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্ত ‘সুতরাং’ ছবি নির্মাণ করে বাঙালির, বাংলা সংস্কৃতির, সৃজনশীলতার, মৌলিকত্বের মর্মমূলে যেন আত্মবিশ্বাসের বিজয় নিশান উড়িয়ে দিলেন। সুতরাং সবাই নুতন- চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার, নায়িকা, নায়ক, প্রযোজক, এরা সবাই যেন এক কাতারে শামিল হলেন- নতুন পথের, প্রত্যয়দীপ্ত নবযাত্রার অভিষেক ঘটাতে। সুভাষ দত্ত ‘সুতরাং’ করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প নেন ১৯৬২ সালের শেষের দিকে। পত্রিকায় সুতরাং বানানোর বিজ্ঞাপন দেখে বাংলাবাজারের মেসে বসবাসকারী জনৈক সত্য সাহা ( ১৯৩৪-১৯৯৯) সত্যিই সাহস করে এসে সুরকার হতে চাইলেন।

তার নায়িকা চট্টগ্রামের মিনা পাল। তার আবিষ্কারের কাহিনটিও অভিনব।

‘আমি ছবির ষোলোটি দৃশ্যের স্কেচ এঁকে পাঠালাম। স্কেচ দেখে মিনার ছবি তুলে আনলেন সত্য সাহা। কয়েকটি ফটোগ্রাফ খুবই ভালো লাগল। বললাম, ঠিক আছে। ওকে আসতে বলো। তারপর মিনা তার বাপ এবং বোনদের নিয়ে ঢাকায় এলো। এখন আমার দুই প্রডিউসার ওকে দেখে হৈ চৈ করে উঠলেন। আরে, এ দেখছি খুবই ছোট মেয়ে। বাচ্চা মেয়ে। একে দিয়ে হব নাকি। মিনা পাল ফ্রক পরা ছিল। আমি বললাম, ফ্রকটা ছেড়ে শাড়ি পরে এসো।

ওরা নবাবপুরে, ঢাকা বোডিংয়ে উঠেছিল। সে হোটেলে গিয়ে শাড়ি পরে এলো। দেখলাম ভালোই লাগছে। মুহূর্তে শুয়োপোকা থেকে প্রজাপতির মতো মিনা পাল থেকে কবরী বেরিয়ে আসে। ওর চেহারার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল ওর হাসি।

তার সেরা চলচ্চিত্রগুলোর মর্মবাণী হল শিকড়ের কাছে ফিরে আসা। ‘সুতরাং’ ছবিতে তার নিজের অভিনীত চরিত্র সিপাহী জব্ব্ার শহরে ব্যস্ত সমস্ত কর্ম জীবন ছেড়ে ‘ওরে মন ছুটে চল মধুমতি গায়’, গাইতে গাইতে ফিরেছে গ্রামে। ‘কত ঘুরে এলাম কত দেখে এলাম অশান্ত মনে আমি ছুটে এলাম...আমার গায়ের মতো কভু দেখিনি, সে যে আমার জন্মভূমি...’ আলিঙ্গনের সাধু বাবার মতো সুভাষ দত্ত তার শিল্পকর্মে, বসুন্ধরায় সেই মাটির কাছে ফিরে যাওয়ার আকুতি প্রকাশ করেছেন। তিনি নিজের দেশ, মাটি ও মানুষকে সর্বোচ্চ মহিমায় দেখিয়েছেন। ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দী হয়েও সেই অভিনয় সুনামের সুবাদে পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনের শ্রদ্ধা ও সমীহবোধের কারণে মুক্তি পেয়েছিলেন। নিজের সেই মুক্ত পাওয়ার স্মৃতিকে ‘অরুনোদয়ের অগ্নি সাক্ষীতে’ আনোয়ার হোসেনের অভিনয় জীবনের মধ্যে তুলে ধরেছেন। ‘সুতরাং’ ছবিতে নিজের প্রেমিকা জরিনার মাতৃহারা সস্তানকে লালনপালনের দায়িত্ব নেয়ার ঔদার্য যেমন দেখিয়েছেন তেমনি ১৯৭২ সানে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বীরাঙ্গনাদের সামাজিক পুনর্বাসনে রেখেছেন মানবীয় দর্শনের ব্যাখ্যা ও সমাধানের প্রেরণা। অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকির ‘গলির ধারের ছেলেটি’র চলচ্চিত্রায়নে (ডুমুরের ফুল) একই সঙ্গে শিশু মনস্তত্বের ও মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গির এমন কাব্যিক শোকগাথা নির্মাণ করেন; যা একটি ধ্রুপদি শিল্পকর্মে উন্নীত হয়। ‘আবির্ভাব’ ও ‘বসুন্ধরা’ ছবিতে সন্তানময়ী মায়ের আবেগ ও আকিঞ্চন আকাক্সক্ষাকে শৈল্পিক তুলিতে বিমূর্ত করেছেন। তার তাবৎ চলচ্চিত্রেই মানবিক মূল্যবোধের, সমাজ দর্শনের এবং নিবিষ্ট চিন্তা-চেতনার ভাষ্যে বাঙময় হয়ে উঠেছে।

নারী শিক্ষার অগ্রদূত মহিয়সী মহিলা বেগম রোকেয়ার ওপর সরকারি অনুদানে তার নির্মীয়মান শেষ ছবি শেষ করার ব্যাপারে তিনি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন- এ ছবিতে তিনি বেগম রোকেয়ার সামাজিক ভূমিকাকে বিশেষ ব্যঞ্জনায় তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। দৈনিক ইত্তেফাকে ‘বেগম রোকেয়ার সামাজিক ভূমিকা’ শীর্ষক আমার একটি প্রবন্ধ পড়ে এ ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ বোধ করেছিলেন। সামাজিক গবেষণার প্রতি তার নিষ্ঠা ছিল, প্রচুর পড়াশুনা করতেন। দুর্ভাগ্য, অলঙ্ঘনীয় জটিলতার আবর্ত ও অবগুন্ঠন থেকে বেগম রোকেয়ার ওপর ছবিটি নির্মাণে পৃষ্টপোষকতা সুনিশ্চিত করা যায়নি। এ নিয়ে তিনি প্রায়ই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতেন। কালজয়ী এক সৃজনশীল কাজের অপ্রকাশের এই অব্যক্ত বেদনাবোধ নিয়েই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।

সুভাষ দত্ত একজন মহৎ প্রাণ শিল্পী ছিলেন। চলচ্চিত্রকে শিল্প মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে তার প্রয়াসের যেমন অন্ত ছিল না আবার তার হাতেই বাংলা চলচ্চিত্রে পুঁজি বিনিয়োগের সার্থকতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বলাবাহুল্য তিনিই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে নাবালকত্ব থেকে সাবালকত্বে, উর্দু ছবির ভাববন্ধন থেকে বাংলা ছবিকে রক্তমাংসসহ সবল সতেজ ও শিল্প বিনিয়োগ উপযোগী করে তোলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। পুরো ষাট ও সত্তরের দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথিকৃত ছিলেন তিনি।

[লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান]