কর্মকর্তাদের বেপরোয়া গাড়িবিলাস

ইইডির ৩৮টি গাড়ির ২৮টিই বেহাত ফেরত চাইলেই ধমক

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি) ৩৮টি গাড়ির ২৮টিই বেহাত। মিতসুবিশি পাজেরো স্পোর্ট, কিউএক্স, নিশান এক্স-ট্রেইলসহ বিভিন্ন খ্যাতনামা ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল এসব গাড়ি ব্যবহার করে বিলাসিতায় মেতেছেন শিক্ষা প্রশাসনের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা। সংস্থার প্রধান কার্যালয়ের কমপক্ষে ২৮টি গাড়ি ব্যবহার করছেন কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী ও প্রাধিকারহীন কর্মকর্তারা। গতবছর অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাও ব্যবহার করছেন এ সংস্থার গাড়ি। সংস্থা প্রধান নিজেও স্বপরিবারে ব্যবহার করছেন পাজেরো স্পোর্ট ব্র্যান্ডের দুটি গাড়ি, যার সুযোগ নিচ্ছেন অন্যরাও। অথচ ইইডির যাদের প্রাধিকার সেই জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলীরা বাধ্য হয়ে ‘সাইট ভিজিট’ (প্রকল্প কাজ পরিদর্শন) করছেন কখনও পাবলিক পরিবহনে, কখনও একটি গাড়ি দু’তিনজন কর্মকর্তা সমন্বয় করে। এ কারণে তত্ত্বাবধায়ক ও নির্বাহী প্রকৌশলীদের অনেকেই সাইট ভিজিট কমিয়ে দিয়েছেন। এতে অসাধু ঠিকাদারদেরও পোয়া-বারো; তারা অবকাঠামো নির্মাণে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন। গাড়ি ফেরত চাইলে বদলি ও নানা রকম হয়রানির শিকার হতে পারেন-এমন আশঙ্কায় নিঃশ্চুপ ইইডির শীর্ষ কর্মকর্তারা। ইতোমধ্যে ধমকও খেয়েছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। যারা অবৈধভাবে গাড়ি ব্যবহার করছেন, তারা ‘লক বই’ এ স্বাক্ষর করছেন না; সবই বাধ্য হয়ে করছে ইইডি।

প্রভাবশালীদের বিলাসিতায় ব্যবহার হওয়া গাড়ির জ্বালানি খরচ ও অন্যান্য ব্যয়ের জোগান দেয়া হচ্ছে ইইডি ও শিক্ষার বিভিন্ন প্রকল্প থেকে। কয়েকটি গাড়ির ব্যয় অদৃশ্য খাত বা বিকল্প উৎস থেকে যোগান দেয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। গাড়ির জ্বালানি যোগান দেয়ার দায়িত্বে থাকা হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তাও কম যাচ্ছেন না। তিনিও জোরপূর্বক একটি পাজেরো জিপ ব্যবহার করছেন। অন্যান্য গাড়ির জ্বালানির যোগান দেয়ায়ও অর্থ ‘নয়-ছয়’ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ইইডি’তে সদ্য পদায়ন পাওয়া একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, ‘আমি জেলাপর্যায়ে কর্মরত থাকার সময় নির্বাহী প্রকৌশলীর জন্য নিজস্ব গাড়ি ছিল। কিন্তু প্রধান কার্যালয়ে এসে দেখি গাড়ি নিয়ে তেলেসমাতি কাণ্ড। আমার জন্য কোন গাড়ি নেই। নতুন সবকটি গাড়িই ব্যবহার করছেন মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতাধর কর্মকর্তারা। সিনিয়র প্রকৌশলীরা ব্যবহার করছেন পুরোনো গাড়িগুলো।’

ইইডি’র প্রধান কার্যালয়ে কয়টি গাড়ি রয়েছে এবং এগুলো কারা ব্যবহার করছে, জানতে চাইলে ইইডির পরিবহন বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী জার্জিস ইউ রহমান সংবাদকে বলেন, ‘হেড অফিসে ৩৮টি গাড়ি রয়েছে। কারা এগুলো ব্যবহার করছে, তা আমি বলতে পারব না।’

এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানতে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘যারাই গাড়িগুলো ব্যবহার করুক না কেন, তারা অফিসিয়াল কাজেই ব্যবহার করছেন।’ প্রাধিকার না থাকলেও ওই কর্মকর্তা নিজেও একটি গাড়ি ব্যবহার করছেন।

বেহাত হওয়া গাড়িগুলো ফেরত আনার উদ্যোগ নেয়া হবে কীনা জানতে চাইলে ইইডি’র প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) বুলবুল আখতার সংবাদকে বলেন, ‘কার গাড়ির সমস্যা হচ্ছে? যার সমস্যা হচ্ছে তাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলেন; দরকার হলে আমার গাড়ি দিয়ে দেব। আমি রিকশায় চড়ব। কিন্তু সচিব স্যারের গাড়ি নিয়ে আসতে পারব না; মন্ত্রী স্যারের বাসা থেকে গাড়ি নিয়ে আসতে পারব না, মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে আমি গাড়ি চাইতে পারব না।’

এছাড়াও যাদের সম্মান করে গাড়ি দেয়া হয়েছে, তাদের কারও কাছেই তিনি গাড়ি ফেরত চাইতে পারবেন না বলে জানান।

প্রসঙ্গত, সাধারণত মন্ত্রিসভার সদস্য ও সচিবদের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিবহন পুল থেকেই গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়। ইইডির প্রধান কার্যালয়ের একজন প্রধান প্রকৌশলী, তিনজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও ছয়জন নির্বাহী প্রকৌশলী কর্মরত রয়েছেন। তারা সরকারি গাড়ি ব্যবহারে প্রাধিকারভুক্ত। বর্তমানে প্রধান কার্যালয়ের দু’জন নির্বাহী প্রকৌশলী এবং ঢাকার বাইরে কর্মরত ছয়জন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী গাড়ি পাচ্ছেন না; তারা কখনও সহকর্মীদের গাড়ি এবং কখনও পাবলিক পরিবহনে যাতায়াত করছেন। যদিও ইইডির দু’জন জুনিয়র কর্মকর্তা জোরপূর্বক সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। গাড়ি ফেরত চাইলে তারা ক্ষেপে যেতে পারেন-এমন আশঙ্কায় শীর্ষ কর্মকর্তাও নিঃশ্চুপ রয়েছেন।

কারা ব্যবহার করছে বিলাসবহুল গাড়িগুলো

প্রধান প্রকৌশলীর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ইইডির প্রধান কার্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৩৮টি গাড়ির মধ্যে ব্র্যান্ড নিউ মিতসুবিশি পাজেরো স্পোর্ট, কিউএক্স ও নিশান এক্স-ট্রেইল জিপ গাড়িই বেশি। গাড়ির জ্বালানির যোগান দেয়ার দায়িত্বে থাকা ইইডির হিসাব শাখার কর্মকর্তা ইউনূস আলী জোরপূর্বক ব্যবহার করছেন একটি পাজেরো গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩৩৭০৬), সরকারের সুদমুক্ত ঋণ সুবিধা নিয়ে গাড়ি কিনেও দীর্ঘদিন ধরে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তিনজন প্রভাবশালী নারী কর্মকর্তা তিনটি বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করছেন, যাদের একজনকে সম্প্রতি একই মন্ত্রণালয়ের অন্য একটি সংস্থায় বদলি করা হয়েছে। আরেক অতিরিক্ত সচিব প্রায় দেড় বছর আগে ইইডির একটি পদে কর্মরত ছিলেন; কিন্তু তিনি গাড়ি ফেরত দেননি। সম্প্রতি একটি গাড়ি ফেরত চেয়ে ধমক খেয়েছেন ইইডির এক কর্মকর্তা। অপর কর্মকর্তা ব্যবহার করছেন একটি প্রকল্পের গাড়ি। ওই তিন কর্মকর্তাই ঋণের টাকায় কেনা গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিমাসে সরকার থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকাও নিচ্ছেন। মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার শীর্ষ কর্মকর্তাও ব্যবহার করছেন ইইডির গাড়ি।

একই মন্ত্রণালয়ের আরও তিনজন প্রভাবশালী উপসচিব (উপমন্ত্রীর দফতরে একজন) সুদমুক্ত ঋণ সুবিধা নিয়ে গাড়ি কিনেও অবৈধভাবে ব্যবহার করছেন ইইডির গাড়ি। মাউশির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও ব্যবহার করছেন দুটি গাড়ি, যেগুলো প্রকল্পের টাকায় কেনা। গত ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যাওয়া শিক্ষা প্রশাসনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা এখনও ইইডির ‘পাজেরো স্পোর্ট’ ব্র্যান্ডের একটি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-১৫৩৬০৬) ব্যবহার করছেন, যে গাড়িটির চালক ‘মিলন’। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের বর্তমান সচিবকেও ‘রিজার্ভ বা অতিরিক্ত’ হিসেবে দেয়ার জন্য নতুন একটি আরেকটি গাড়ি প্রস্তুত রেখেছেন ইইডির শীর্ষ কর্মকর্তা।

এছাড়াও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তি ও একাধিক সংস্থা, পরিকল্পনা কমিশন ও পল্টনে অবস্থিত শিক্ষার একটি অফিসের কর্মকর্তাও ব্যবহার করছেন ইইডির বিলাসবহুল গাড়ি। প্রকৌশলীদের ব্যবহার করা একাধিক গাড়ি নিয়মিত মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের জন্য ‘স্ট্যান্ডবাই’ বরাদ্দ রাখা হয়। পাজেরো ব্র্যান্ডের প্রায় অকেজো একটি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৭১৯৯) নিজ খরচে ব্যবহার করছেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর ডিপ্লোমা সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম। এই সমিতির নেতা উপ-সহকারী প্রকৌশলী জাফর শিকদার ‘অকশনে’র নামে একটি গাড়ি নিয়ে ব্যবহার করছেন।

জানতে চাইলে সিরাজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘আমরা কয়েকজন মিলে পুরোনো গাড়িটি ব্যবহার করছি।’ ইইডির সবচেয়ে সিনিয়র নির্বাহী প্রকৌশলী মীর মোয়াজ্জেম হোসেনও ব্যবহার করছেন একটি পুরোনো গাড়ি। বিভিন্ন জেলায় কর্মরত নির্বাহী প্রকৌশলীরাও ব্যবহার করছেন পুরোনো গাড়ি।

প্রধান প্রকৌশলীর দফতরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের চাহিদা অনুযায়ী যখন-তখন গাড়ি না দিলে বিভিন্ন ফাইল আটকে যায়, ঝুলে থাকে। তাছাড়া শাস্তিমূলক বদলির হুমকি দেয়া ও পদোন্নতি আটকে রাখা, বিদেশ ভ্রমণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিসহ নানা রকম ভোগান্তি পোহাতে হয়।’

গাড়ির ব্যয়ে ঘাপলা

মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখা থেকে জানা গেছে, ‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের (৩৩২ স্কুল) উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়নের শুরুতেই ২০১৮ সালের শেষের দিকে প্রকল্পের অর্থায়নে কেনা হয়েছিল মিতসুবিশি পাজেরো স্পোর্ট কিউএক্স এবং নিশান এক্স-ট্রেইল জিপ গাড়ি ব্র্যান্ডের চারটি গাড়ি। অথচ এই প্রকল্পের পরিচালক এবং উপ-পরিচালক গাড়ি ব্যবহারের প্রাধিকারভুক্ত।

প্রকল্পটির ডিপিপিতেই (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা বা প্রকল্প দলিল) কৌশলে দুটি গাড়ি ইইডির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়, যেগুলো বর্তমানে ইইডির নিয়ন্ত্রণে নেই। মজার ব্যাপার হলো- ইইডির জন্য বরাদ্দকৃত দুটি গাড়ি এবং প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত দুটি গাড়ির জ্বালানি খরচ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।

সাড়ে চার বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোপাইলে (ডিপিপি) চালকের বেতনভাতা ছাড়াই ইইডির জন্য কেনা দুটি গাড়ির (ইঞ্জিন নম্বর-এমআর২০৪২৫৯৩৯সি এবং ৪ডি৫৬ইউএটি০৮৯৬) মোট জ্বালানি ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ টাকা। অথচ প্রকল্প অফিস ও মাউশির জন্য কেনা দুটি গাড়ির জ্বালানি ব্যয় ও মেরামত খরচ ধরা হয়েছে ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

আরও খবর
আ’লীগ সরকার সার্বিক উন্নয়নে বিশ্বাসী : প্রধানমন্ত্রী
কোয়ারেন্টাইন শেষে বাড়ি ফিরছেন ৩১৬ জন
৭৯২ জন নাগরিকের নিরাপত্তায় একজন পুলিশ
নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত
অবৈধ আড়াইশ’ ইটভাটা
খালেদার মুক্তি দাবি করেও কোন সাড়া পাইনি ফখরুল
স্বামী ও বন্ধুর হাতে বর্বরোচিত নির্যাতনের শিকার গৃহবধূ
ছাত্রীকে যৌন হয়রানির দায়ে শিক্ষক রমজান আলী বহিষ্কার
‘রাইস ট্রান্সপ্লান্টার’ কমাবে খরচ বাঁচাবে কৃষি
মাকে হাতুড়ির আঘাতে দুই সন্তানকে শ্বাসরোধে হত্যা
শামীমাকে গ্রহণ করবে না বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে ২২৬০টি কলেজে আনন্দ র‌্যালি হবে
ক্ষণগণনা : আর ২৯ দিন
আ-মরি বাংলা ভাষা
চলচ্চিত্র তারকাসহ ২০ হাজার আইডি হ্যাক
আগামী মাসেই তীব্র গরমের পূর্বাভাস

রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৩ ফল্গুন ১৪২৬, ২১ জমাদিউল সানি ১৪৪১

শিক্ষা প্রশাসনে

কর্মকর্তাদের বেপরোয়া গাড়িবিলাস

ইইডির ৩৮টি গাড়ির ২৮টিই বেহাত ফেরত চাইলেই ধমক

রাকিব উদ্দিন

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি) ৩৮টি গাড়ির ২৮টিই বেহাত। মিতসুবিশি পাজেরো স্পোর্ট, কিউএক্স, নিশান এক্স-ট্রেইলসহ বিভিন্ন খ্যাতনামা ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল এসব গাড়ি ব্যবহার করে বিলাসিতায় মেতেছেন শিক্ষা প্রশাসনের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা। সংস্থার প্রধান কার্যালয়ের কমপক্ষে ২৮টি গাড়ি ব্যবহার করছেন কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী ও প্রাধিকারহীন কর্মকর্তারা। গতবছর অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাও ব্যবহার করছেন এ সংস্থার গাড়ি। সংস্থা প্রধান নিজেও স্বপরিবারে ব্যবহার করছেন পাজেরো স্পোর্ট ব্র্যান্ডের দুটি গাড়ি, যার সুযোগ নিচ্ছেন অন্যরাও। অথচ ইইডির যাদের প্রাধিকার সেই জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলীরা বাধ্য হয়ে ‘সাইট ভিজিট’ (প্রকল্প কাজ পরিদর্শন) করছেন কখনও পাবলিক পরিবহনে, কখনও একটি গাড়ি দু’তিনজন কর্মকর্তা সমন্বয় করে। এ কারণে তত্ত্বাবধায়ক ও নির্বাহী প্রকৌশলীদের অনেকেই সাইট ভিজিট কমিয়ে দিয়েছেন। এতে অসাধু ঠিকাদারদেরও পোয়া-বারো; তারা অবকাঠামো নির্মাণে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন। গাড়ি ফেরত চাইলে বদলি ও নানা রকম হয়রানির শিকার হতে পারেন-এমন আশঙ্কায় নিঃশ্চুপ ইইডির শীর্ষ কর্মকর্তারা। ইতোমধ্যে ধমকও খেয়েছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। যারা অবৈধভাবে গাড়ি ব্যবহার করছেন, তারা ‘লক বই’ এ স্বাক্ষর করছেন না; সবই বাধ্য হয়ে করছে ইইডি।

প্রভাবশালীদের বিলাসিতায় ব্যবহার হওয়া গাড়ির জ্বালানি খরচ ও অন্যান্য ব্যয়ের জোগান দেয়া হচ্ছে ইইডি ও শিক্ষার বিভিন্ন প্রকল্প থেকে। কয়েকটি গাড়ির ব্যয় অদৃশ্য খাত বা বিকল্প উৎস থেকে যোগান দেয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। গাড়ির জ্বালানি যোগান দেয়ার দায়িত্বে থাকা হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তাও কম যাচ্ছেন না। তিনিও জোরপূর্বক একটি পাজেরো জিপ ব্যবহার করছেন। অন্যান্য গাড়ির জ্বালানির যোগান দেয়ায়ও অর্থ ‘নয়-ছয়’ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ইইডি’তে সদ্য পদায়ন পাওয়া একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, ‘আমি জেলাপর্যায়ে কর্মরত থাকার সময় নির্বাহী প্রকৌশলীর জন্য নিজস্ব গাড়ি ছিল। কিন্তু প্রধান কার্যালয়ে এসে দেখি গাড়ি নিয়ে তেলেসমাতি কাণ্ড। আমার জন্য কোন গাড়ি নেই। নতুন সবকটি গাড়িই ব্যবহার করছেন মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতাধর কর্মকর্তারা। সিনিয়র প্রকৌশলীরা ব্যবহার করছেন পুরোনো গাড়িগুলো।’

ইইডি’র প্রধান কার্যালয়ে কয়টি গাড়ি রয়েছে এবং এগুলো কারা ব্যবহার করছে, জানতে চাইলে ইইডির পরিবহন বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী জার্জিস ইউ রহমান সংবাদকে বলেন, ‘হেড অফিসে ৩৮টি গাড়ি রয়েছে। কারা এগুলো ব্যবহার করছে, তা আমি বলতে পারব না।’

এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানতে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘যারাই গাড়িগুলো ব্যবহার করুক না কেন, তারা অফিসিয়াল কাজেই ব্যবহার করছেন।’ প্রাধিকার না থাকলেও ওই কর্মকর্তা নিজেও একটি গাড়ি ব্যবহার করছেন।

বেহাত হওয়া গাড়িগুলো ফেরত আনার উদ্যোগ নেয়া হবে কীনা জানতে চাইলে ইইডি’র প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) বুলবুল আখতার সংবাদকে বলেন, ‘কার গাড়ির সমস্যা হচ্ছে? যার সমস্যা হচ্ছে তাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলেন; দরকার হলে আমার গাড়ি দিয়ে দেব। আমি রিকশায় চড়ব। কিন্তু সচিব স্যারের গাড়ি নিয়ে আসতে পারব না; মন্ত্রী স্যারের বাসা থেকে গাড়ি নিয়ে আসতে পারব না, মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে আমি গাড়ি চাইতে পারব না।’

এছাড়াও যাদের সম্মান করে গাড়ি দেয়া হয়েছে, তাদের কারও কাছেই তিনি গাড়ি ফেরত চাইতে পারবেন না বলে জানান।

প্রসঙ্গত, সাধারণত মন্ত্রিসভার সদস্য ও সচিবদের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিবহন পুল থেকেই গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়। ইইডির প্রধান কার্যালয়ের একজন প্রধান প্রকৌশলী, তিনজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও ছয়জন নির্বাহী প্রকৌশলী কর্মরত রয়েছেন। তারা সরকারি গাড়ি ব্যবহারে প্রাধিকারভুক্ত। বর্তমানে প্রধান কার্যালয়ের দু’জন নির্বাহী প্রকৌশলী এবং ঢাকার বাইরে কর্মরত ছয়জন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী গাড়ি পাচ্ছেন না; তারা কখনও সহকর্মীদের গাড়ি এবং কখনও পাবলিক পরিবহনে যাতায়াত করছেন। যদিও ইইডির দু’জন জুনিয়র কর্মকর্তা জোরপূর্বক সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। গাড়ি ফেরত চাইলে তারা ক্ষেপে যেতে পারেন-এমন আশঙ্কায় শীর্ষ কর্মকর্তাও নিঃশ্চুপ রয়েছেন।

কারা ব্যবহার করছে বিলাসবহুল গাড়িগুলো

প্রধান প্রকৌশলীর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ইইডির প্রধান কার্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৩৮টি গাড়ির মধ্যে ব্র্যান্ড নিউ মিতসুবিশি পাজেরো স্পোর্ট, কিউএক্স ও নিশান এক্স-ট্রেইল জিপ গাড়িই বেশি। গাড়ির জ্বালানির যোগান দেয়ার দায়িত্বে থাকা ইইডির হিসাব শাখার কর্মকর্তা ইউনূস আলী জোরপূর্বক ব্যবহার করছেন একটি পাজেরো গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩৩৭০৬), সরকারের সুদমুক্ত ঋণ সুবিধা নিয়ে গাড়ি কিনেও দীর্ঘদিন ধরে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তিনজন প্রভাবশালী নারী কর্মকর্তা তিনটি বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করছেন, যাদের একজনকে সম্প্রতি একই মন্ত্রণালয়ের অন্য একটি সংস্থায় বদলি করা হয়েছে। আরেক অতিরিক্ত সচিব প্রায় দেড় বছর আগে ইইডির একটি পদে কর্মরত ছিলেন; কিন্তু তিনি গাড়ি ফেরত দেননি। সম্প্রতি একটি গাড়ি ফেরত চেয়ে ধমক খেয়েছেন ইইডির এক কর্মকর্তা। অপর কর্মকর্তা ব্যবহার করছেন একটি প্রকল্পের গাড়ি। ওই তিন কর্মকর্তাই ঋণের টাকায় কেনা গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিমাসে সরকার থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকাও নিচ্ছেন। মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার শীর্ষ কর্মকর্তাও ব্যবহার করছেন ইইডির গাড়ি।

একই মন্ত্রণালয়ের আরও তিনজন প্রভাবশালী উপসচিব (উপমন্ত্রীর দফতরে একজন) সুদমুক্ত ঋণ সুবিধা নিয়ে গাড়ি কিনেও অবৈধভাবে ব্যবহার করছেন ইইডির গাড়ি। মাউশির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও ব্যবহার করছেন দুটি গাড়ি, যেগুলো প্রকল্পের টাকায় কেনা। গত ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যাওয়া শিক্ষা প্রশাসনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা এখনও ইইডির ‘পাজেরো স্পোর্ট’ ব্র্যান্ডের একটি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-১৫৩৬০৬) ব্যবহার করছেন, যে গাড়িটির চালক ‘মিলন’। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের বর্তমান সচিবকেও ‘রিজার্ভ বা অতিরিক্ত’ হিসেবে দেয়ার জন্য নতুন একটি আরেকটি গাড়ি প্রস্তুত রেখেছেন ইইডির শীর্ষ কর্মকর্তা।

এছাড়াও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তি ও একাধিক সংস্থা, পরিকল্পনা কমিশন ও পল্টনে অবস্থিত শিক্ষার একটি অফিসের কর্মকর্তাও ব্যবহার করছেন ইইডির বিলাসবহুল গাড়ি। প্রকৌশলীদের ব্যবহার করা একাধিক গাড়ি নিয়মিত মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের জন্য ‘স্ট্যান্ডবাই’ বরাদ্দ রাখা হয়। পাজেরো ব্র্যান্ডের প্রায় অকেজো একটি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৭১৯৯) নিজ খরচে ব্যবহার করছেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর ডিপ্লোমা সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম। এই সমিতির নেতা উপ-সহকারী প্রকৌশলী জাফর শিকদার ‘অকশনে’র নামে একটি গাড়ি নিয়ে ব্যবহার করছেন।

জানতে চাইলে সিরাজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘আমরা কয়েকজন মিলে পুরোনো গাড়িটি ব্যবহার করছি।’ ইইডির সবচেয়ে সিনিয়র নির্বাহী প্রকৌশলী মীর মোয়াজ্জেম হোসেনও ব্যবহার করছেন একটি পুরোনো গাড়ি। বিভিন্ন জেলায় কর্মরত নির্বাহী প্রকৌশলীরাও ব্যবহার করছেন পুরোনো গাড়ি।

প্রধান প্রকৌশলীর দফতরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের চাহিদা অনুযায়ী যখন-তখন গাড়ি না দিলে বিভিন্ন ফাইল আটকে যায়, ঝুলে থাকে। তাছাড়া শাস্তিমূলক বদলির হুমকি দেয়া ও পদোন্নতি আটকে রাখা, বিদেশ ভ্রমণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিসহ নানা রকম ভোগান্তি পোহাতে হয়।’

গাড়ির ব্যয়ে ঘাপলা

মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখা থেকে জানা গেছে, ‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের (৩৩২ স্কুল) উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়নের শুরুতেই ২০১৮ সালের শেষের দিকে প্রকল্পের অর্থায়নে কেনা হয়েছিল মিতসুবিশি পাজেরো স্পোর্ট কিউএক্স এবং নিশান এক্স-ট্রেইল জিপ গাড়ি ব্র্যান্ডের চারটি গাড়ি। অথচ এই প্রকল্পের পরিচালক এবং উপ-পরিচালক গাড়ি ব্যবহারের প্রাধিকারভুক্ত।

প্রকল্পটির ডিপিপিতেই (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা বা প্রকল্প দলিল) কৌশলে দুটি গাড়ি ইইডির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়, যেগুলো বর্তমানে ইইডির নিয়ন্ত্রণে নেই। মজার ব্যাপার হলো- ইইডির জন্য বরাদ্দকৃত দুটি গাড়ি এবং প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত দুটি গাড়ির জ্বালানি খরচ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।

সাড়ে চার বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোপাইলে (ডিপিপি) চালকের বেতনভাতা ছাড়াই ইইডির জন্য কেনা দুটি গাড়ির (ইঞ্জিন নম্বর-এমআর২০৪২৫৯৩৯সি এবং ৪ডি৫৬ইউএটি০৮৯৬) মোট জ্বালানি ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ টাকা। অথচ প্রকল্প অফিস ও মাউশির জন্য কেনা দুটি গাড়ির জ্বালানি ব্যয় ও মেরামত খরচ ধরা হয়েছে ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা।