৭৯২ জন নাগরিকের নিরাপত্তায় একজন পুলিশ

বড় একটি অংশ স্থাপনা ও প্রটোকলে নিয়োজিত বিঘ্নিত হচ্ছে মামলার তদন্ত নির্ভুল চার্জশিট ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে

বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যের সংখ্যা ২ লাখ ১২ হাজার ৭৯২ জন। এই পুলিশ জনসংখ্যা দেশের ১৬ কোটি মানুষের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছেন। আর ১৬ কোটি জনসংখ্যা হিসেবে ৭৯১ দশমিক ৩৮২ জনের নিরাপত্তায় রয়েছেন একজন পুলিশ। এটি হচ্ছে মোট পুলিশের সংখ্যার সঙ্গে দেশের মানুষের সংখ্যার আনুপাতিক হার। আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় এবং বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় এই সংখ্যা অত্যন্ত কম। এই কমসংখ্যার পুলিশের সঙ্গে বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো যুক্ত হয়েছে সরকার ও সরকারি মহল ও প্রভাবশালী ভিভিআইপি, ভিআইপি এবং নানা ধরনের স্থাপনা ও বাড়ি-গাড়ির নিরাপত্তার পাহারাদারির কাজ। এ কারণে বিভিন্ন মামলার তদন্তে ও নির্ভুল চার্জশিট প্রদানে বিলম্ব হওয়া, অপরাধীদের গ্রেফতার, অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার কার্যক্রম অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে।

পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে পুলিশ ক্যাডার রয়েছেন ৩ হাজার ৯৫ জন। ইন্সপেক্টর রয়েছেন ৬ হাজার ৮৬৯ জন, সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) ২৪ হাজার ৩৫৭ জন, নন-পুলিশ (সিভিল) রয়েছেন ১০ হাজার ৬১৪ জন, পুলিশ নন-ক্যাডার (কনস্টেবল-ইন্সপেক্টর) ১ লাখ ৯৯ হাজার ৮৩ জন। মোট পুলিশ সদস্যের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৮ জন। পুলিশের সব ইউনিট যথা ডিএমপি, র‌্যাব, সিআইডি, এসবি, পিবিআই, নৌপুলিশ, রেলওয়ে পুলিশ ইত্যাদির মধ্যে বেশি জনবল রয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি)।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, জাতিসংঘের মান অনুযায়ী, প্রতি ৪০০ জন লোকের বিপরীতে ১ জন পুলিশের আনুপাতিক হার অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে ১৬ কোটির জনসংখ্যার হারে কমপক্ষে ৪ লাখ পুলিশ দরকার। অথচ এখন আছে মাত্র ২ লাখ ১২ হাজার। আবার প্রতিবছর গড়ে ২ হাজার সদস্য পুলিশ বিভাগ থেকে অবসরে যাচ্ছেন। ঢাকা সারাদেশের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় ডিএমপিতে জনবলের সংখ্যাও অন্য ইউনিটের চেয়ে বেশি। দেশের অন্য স্থানের তুলনায় ঢাকায় রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, হরতাল-অবরোধ প্রতিনিয়ত থাকছেই। সেই সঙ্গে খুন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধও প্রতিনিয়ত সংঘঠিত হচ্ছে। আর এসব সামলাতে হচ্ছে পুলিশকেই।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রায় ৩৫ হাজার সদস্যকে রাত-দিন এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর সঙ্গে সরকারের ভিভিআইপি-ভিআইপি প্রটোকল এবং সরকারি দলের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির নিরাপত্তা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়, বাড়ি-গাড়ির গার্ড তো রয়েছেই। এছাড়া বিভিন্ন রেঞ্জে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবেও রাখা হয়েছে পুলিশের একটি বড় অংশকে, যাদের প্রয়োজনে মাঠে নামানো হয়। কিন্তু কাজ অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়নি পুলিশের। পুলিশকে কাজ করতে হচ্ছে ১২-১৮ ঘণ্টা। ক্ষেত্রবিশেষে ২০ ঘণ্টাও করতে হচ্ছে। আর অতিরিক্ত ডিউটির এই প্রভাব পড়ছে শরীরে।

২০১৫ সালের পুলিশ হাসপাতালের সর্বশেষ এক জরিপ অনুযায়ী, ১৯ শতাংশ পুলিশ সদস্য পেপটিক আলসার, ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ ডায়াবেটিস ও ৯ দশমিক ৫ শতাংশ হৃদরোগে ভুগছেন। এছাড়া ট্রমা অ্যান্ড ফ্র্যাকচারে ৯ শতাংশ, চর্মরোগে ৫ শতাংশ, কিডনিজনিত সমস্যায় ৫ শতাংশ, লিভার সমস্যায় ৩ শতাংশ, ক্যানসারে ১ দশমিক ৫ শতাংশ ও চোখের সমস্যায় ভুগছেন ১ দশমিক ৫ শতাংশ পুলিশ সদস্য। এছাড়া ১ শতাংশ পুলিশ সদস্য রয়েছেন যারা মানসিক নানা সমস্যায় ভুগছেন। এদের অধিকাংশ রোগের কারণ দীর্ঘ ডিউটি।

যখন যেই সরকার ক্ষমতায় আসে সেই সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা বহর আর সরকার দলীয় এমপিদের প্রটোকলেই বেশি সময় ব্যয় হচ্ছে পুলিশের। প্রায় প্রতিদিনই গড়ে মন্ত্রী-উপদেষ্টা আর এমপিসহ ভিআইপিদের ১০-১৫টি অনুষ্ঠান থাকে। এক্ষেত্রে কোন মন্ত্রী যদি সচিবালয় থেকে মিরপুর এলাকায় যেতে চান তাহলে তার যাত্রাপথের নিরাপত্তার জন্য মতিঝিল, রমনা, তেজগাঁও ও মিরপুর জোনের পুলিশকে রাত-দিন ব্যস্ত সময় পার করতে হয়। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট জোনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট থানার ওসি-দারোগা ও পুলিশ সদস্যদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, জনবল কম হওয়ায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজই দ্রুত সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। তাদের মতে, বিরোধী কোন দল বা জোট যখন রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়, তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য পুলিশকে বাড়তি সময় দিতেই হয়। এ কারণে বিভিন্ন মামলার তদন্তে বিলম্ব হয়, কোন মামলার চার্জশিট যথাসময়ে দেয়া সম্ভব হয় না, আবার দ্রুত সময়ে চার্জশিট প্রদান করলেও ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া, আদালতে মামলাজট, দুর্নীতি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়াও সম্ভব হয় না।

তবে কাগজে-কলমে ৭৯২ জনের নিরাপত্তায় একজন পুলিশ হলেও বাস্তবে ১ হাজারের বেশি। কারণ পুলিশের মোট জনবলের এক-তৃতীয়াংশই বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক অনুষ্ঠান, ভিআইপি ও ভিভিআইপিদের নিরাপত্তায় ব্যস্ত থাকে। এছাড়া বড় একটা অংশ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছে। অথচ প্রতিবেশী ভারতের মতো বড় দেশেও পুলিশের বিপরীতে এই সংখ্যা ৬৬০ জনে। দেশটির প্রথম সারির গণমাধ্যম জি নিউজের তথ্য মতে, সে দেশের ১৩২ কোটি জনগণের নিরাপত্তায় রয়েছে প্রায় ২০ লাখ পুলিশ। এছাড়াও স্ব স্ব দেশের গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ৫৬ লাখ জনসংখ্যার দেশ সিঙ্গাপুরে একজন পুলিশ ১৪০ জনের নিরাপত্তা দেয়। মালয়েশিয়ায় পুলিশ-জনগণের অনুপাত ২৪৯ (জনসংখ্যা ৩ কোটি ১১ লাখ), থাইল্যান্ডে ২৮০ (জনসংখ্যা ৬ কোটি ৮৮ লাখ), হংকংয়ে ১৮২ (জনসংখ্যা ৭৩ লাখ) এবং ফিলিপাইনে ৬৬৫ (জনসংখ্যা ১০ কোটি ৩৩ লাখ) জনের নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকে একজন পুলিশ।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট) এসএম রুহুল আমিন বলেন, ১৬ কোটি মানুষের জন্য এই পুলিশ পর্যাপ্ত নয়। তবে পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ২০০৮ সালে সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুই দফায় জনবল বাড়ানো হয়েছে। তারপরও আরও জনবলের দরকার আছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনাও আছে। তিনি বলেন, চাহিদার তুলনায় পুলিশের লোকবল কম হওয়ায় আদালতে মামলাজট, তদন্তে কালক্ষেপণ, চার্জশিট দিতে দেরি যেমন হয়, তেমনি কাজের মানের ঘাটতিও থাকে। এসব নিরসনে কাজ করা হচ্ছে।

পুলিশের প্রধান কাজ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, জনগণের সুরক্ষা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করা। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, ভিভিআইপি, ভিআইপির প্রটোকল এবং বিশেষ বিশেষ স্থাপনার নিরাপত্তার কাজে পুলিশ বাহিনীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে নিয়োজিত থাকতে হচ্ছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশ যদি আইন ও বিধিসম্মতভাবে এসব আসল কাজ করতে পারতো তাহলে আমাদের সমাজের স্থিতিশীলতা সুনিশ্চিত হতো এবং এর ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত হতো। এজন্য পুলিশের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। তবে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা বলছেন, পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি সিস্টেমে পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন একজন ওসিকে তার থানাধীন দৈনন্দিন কর্মকা- সম্পর্কে ২৪ ঘণ্টায়ই ওয়াকিবহাল থাকতে হয়। জনবল বৃদ্ধি করলেও এই সমস্যার সমাধান হবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত এসব পর্যায়ে নতুন কোন পরিবর্তন আনা না হবে।

আরও খবর
কর্মকর্তাদের বেপরোয়া গাড়িবিলাস
আ’লীগ সরকার সার্বিক উন্নয়নে বিশ্বাসী : প্রধানমন্ত্রী
কোয়ারেন্টাইন শেষে বাড়ি ফিরছেন ৩১৬ জন
নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত
অবৈধ আড়াইশ’ ইটভাটা
খালেদার মুক্তি দাবি করেও কোন সাড়া পাইনি ফখরুল
স্বামী ও বন্ধুর হাতে বর্বরোচিত নির্যাতনের শিকার গৃহবধূ
ছাত্রীকে যৌন হয়রানির দায়ে শিক্ষক রমজান আলী বহিষ্কার
‘রাইস ট্রান্সপ্লান্টার’ কমাবে খরচ বাঁচাবে কৃষি
মাকে হাতুড়ির আঘাতে দুই সন্তানকে শ্বাসরোধে হত্যা
শামীমাকে গ্রহণ করবে না বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে ২২৬০টি কলেজে আনন্দ র‌্যালি হবে
ক্ষণগণনা : আর ২৯ দিন
আ-মরি বাংলা ভাষা
চলচ্চিত্র তারকাসহ ২০ হাজার আইডি হ্যাক
আগামী মাসেই তীব্র গরমের পূর্বাভাস

রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৩ ফল্গুন ১৪২৬, ২১ জমাদিউল সানি ১৪৪১

৭৯২ জন নাগরিকের নিরাপত্তায় একজন পুলিশ

বড় একটি অংশ স্থাপনা ও প্রটোকলে নিয়োজিত বিঘ্নিত হচ্ছে মামলার তদন্ত নির্ভুল চার্জশিট ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে

মাসুদ রানা |

বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যের সংখ্যা ২ লাখ ১২ হাজার ৭৯২ জন। এই পুলিশ জনসংখ্যা দেশের ১৬ কোটি মানুষের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছেন। আর ১৬ কোটি জনসংখ্যা হিসেবে ৭৯১ দশমিক ৩৮২ জনের নিরাপত্তায় রয়েছেন একজন পুলিশ। এটি হচ্ছে মোট পুলিশের সংখ্যার সঙ্গে দেশের মানুষের সংখ্যার আনুপাতিক হার। আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় এবং বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় এই সংখ্যা অত্যন্ত কম। এই কমসংখ্যার পুলিশের সঙ্গে বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো যুক্ত হয়েছে সরকার ও সরকারি মহল ও প্রভাবশালী ভিভিআইপি, ভিআইপি এবং নানা ধরনের স্থাপনা ও বাড়ি-গাড়ির নিরাপত্তার পাহারাদারির কাজ। এ কারণে বিভিন্ন মামলার তদন্তে ও নির্ভুল চার্জশিট প্রদানে বিলম্ব হওয়া, অপরাধীদের গ্রেফতার, অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার কার্যক্রম অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে।

পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে পুলিশ ক্যাডার রয়েছেন ৩ হাজার ৯৫ জন। ইন্সপেক্টর রয়েছেন ৬ হাজার ৮৬৯ জন, সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) ২৪ হাজার ৩৫৭ জন, নন-পুলিশ (সিভিল) রয়েছেন ১০ হাজার ৬১৪ জন, পুলিশ নন-ক্যাডার (কনস্টেবল-ইন্সপেক্টর) ১ লাখ ৯৯ হাজার ৮৩ জন। মোট পুলিশ সদস্যের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৮ জন। পুলিশের সব ইউনিট যথা ডিএমপি, র‌্যাব, সিআইডি, এসবি, পিবিআই, নৌপুলিশ, রেলওয়ে পুলিশ ইত্যাদির মধ্যে বেশি জনবল রয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি)।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, জাতিসংঘের মান অনুযায়ী, প্রতি ৪০০ জন লোকের বিপরীতে ১ জন পুলিশের আনুপাতিক হার অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে ১৬ কোটির জনসংখ্যার হারে কমপক্ষে ৪ লাখ পুলিশ দরকার। অথচ এখন আছে মাত্র ২ লাখ ১২ হাজার। আবার প্রতিবছর গড়ে ২ হাজার সদস্য পুলিশ বিভাগ থেকে অবসরে যাচ্ছেন। ঢাকা সারাদেশের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় ডিএমপিতে জনবলের সংখ্যাও অন্য ইউনিটের চেয়ে বেশি। দেশের অন্য স্থানের তুলনায় ঢাকায় রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, হরতাল-অবরোধ প্রতিনিয়ত থাকছেই। সেই সঙ্গে খুন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধও প্রতিনিয়ত সংঘঠিত হচ্ছে। আর এসব সামলাতে হচ্ছে পুলিশকেই।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রায় ৩৫ হাজার সদস্যকে রাত-দিন এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর সঙ্গে সরকারের ভিভিআইপি-ভিআইপি প্রটোকল এবং সরকারি দলের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির নিরাপত্তা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়, বাড়ি-গাড়ির গার্ড তো রয়েছেই। এছাড়া বিভিন্ন রেঞ্জে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবেও রাখা হয়েছে পুলিশের একটি বড় অংশকে, যাদের প্রয়োজনে মাঠে নামানো হয়। কিন্তু কাজ অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়নি পুলিশের। পুলিশকে কাজ করতে হচ্ছে ১২-১৮ ঘণ্টা। ক্ষেত্রবিশেষে ২০ ঘণ্টাও করতে হচ্ছে। আর অতিরিক্ত ডিউটির এই প্রভাব পড়ছে শরীরে।

২০১৫ সালের পুলিশ হাসপাতালের সর্বশেষ এক জরিপ অনুযায়ী, ১৯ শতাংশ পুলিশ সদস্য পেপটিক আলসার, ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ ডায়াবেটিস ও ৯ দশমিক ৫ শতাংশ হৃদরোগে ভুগছেন। এছাড়া ট্রমা অ্যান্ড ফ্র্যাকচারে ৯ শতাংশ, চর্মরোগে ৫ শতাংশ, কিডনিজনিত সমস্যায় ৫ শতাংশ, লিভার সমস্যায় ৩ শতাংশ, ক্যানসারে ১ দশমিক ৫ শতাংশ ও চোখের সমস্যায় ভুগছেন ১ দশমিক ৫ শতাংশ পুলিশ সদস্য। এছাড়া ১ শতাংশ পুলিশ সদস্য রয়েছেন যারা মানসিক নানা সমস্যায় ভুগছেন। এদের অধিকাংশ রোগের কারণ দীর্ঘ ডিউটি।

যখন যেই সরকার ক্ষমতায় আসে সেই সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা বহর আর সরকার দলীয় এমপিদের প্রটোকলেই বেশি সময় ব্যয় হচ্ছে পুলিশের। প্রায় প্রতিদিনই গড়ে মন্ত্রী-উপদেষ্টা আর এমপিসহ ভিআইপিদের ১০-১৫টি অনুষ্ঠান থাকে। এক্ষেত্রে কোন মন্ত্রী যদি সচিবালয় থেকে মিরপুর এলাকায় যেতে চান তাহলে তার যাত্রাপথের নিরাপত্তার জন্য মতিঝিল, রমনা, তেজগাঁও ও মিরপুর জোনের পুলিশকে রাত-দিন ব্যস্ত সময় পার করতে হয়। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট জোনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট থানার ওসি-দারোগা ও পুলিশ সদস্যদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, জনবল কম হওয়ায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজই দ্রুত সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। তাদের মতে, বিরোধী কোন দল বা জোট যখন রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়, তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য পুলিশকে বাড়তি সময় দিতেই হয়। এ কারণে বিভিন্ন মামলার তদন্তে বিলম্ব হয়, কোন মামলার চার্জশিট যথাসময়ে দেয়া সম্ভব হয় না, আবার দ্রুত সময়ে চার্জশিট প্রদান করলেও ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া, আদালতে মামলাজট, দুর্নীতি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়াও সম্ভব হয় না।

তবে কাগজে-কলমে ৭৯২ জনের নিরাপত্তায় একজন পুলিশ হলেও বাস্তবে ১ হাজারের বেশি। কারণ পুলিশের মোট জনবলের এক-তৃতীয়াংশই বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক অনুষ্ঠান, ভিআইপি ও ভিভিআইপিদের নিরাপত্তায় ব্যস্ত থাকে। এছাড়া বড় একটা অংশ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছে। অথচ প্রতিবেশী ভারতের মতো বড় দেশেও পুলিশের বিপরীতে এই সংখ্যা ৬৬০ জনে। দেশটির প্রথম সারির গণমাধ্যম জি নিউজের তথ্য মতে, সে দেশের ১৩২ কোটি জনগণের নিরাপত্তায় রয়েছে প্রায় ২০ লাখ পুলিশ। এছাড়াও স্ব স্ব দেশের গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ৫৬ লাখ জনসংখ্যার দেশ সিঙ্গাপুরে একজন পুলিশ ১৪০ জনের নিরাপত্তা দেয়। মালয়েশিয়ায় পুলিশ-জনগণের অনুপাত ২৪৯ (জনসংখ্যা ৩ কোটি ১১ লাখ), থাইল্যান্ডে ২৮০ (জনসংখ্যা ৬ কোটি ৮৮ লাখ), হংকংয়ে ১৮২ (জনসংখ্যা ৭৩ লাখ) এবং ফিলিপাইনে ৬৬৫ (জনসংখ্যা ১০ কোটি ৩৩ লাখ) জনের নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকে একজন পুলিশ।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট) এসএম রুহুল আমিন বলেন, ১৬ কোটি মানুষের জন্য এই পুলিশ পর্যাপ্ত নয়। তবে পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ২০০৮ সালে সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুই দফায় জনবল বাড়ানো হয়েছে। তারপরও আরও জনবলের দরকার আছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনাও আছে। তিনি বলেন, চাহিদার তুলনায় পুলিশের লোকবল কম হওয়ায় আদালতে মামলাজট, তদন্তে কালক্ষেপণ, চার্জশিট দিতে দেরি যেমন হয়, তেমনি কাজের মানের ঘাটতিও থাকে। এসব নিরসনে কাজ করা হচ্ছে।

পুলিশের প্রধান কাজ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, জনগণের সুরক্ষা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করা। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, ভিভিআইপি, ভিআইপির প্রটোকল এবং বিশেষ বিশেষ স্থাপনার নিরাপত্তার কাজে পুলিশ বাহিনীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে নিয়োজিত থাকতে হচ্ছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশ যদি আইন ও বিধিসম্মতভাবে এসব আসল কাজ করতে পারতো তাহলে আমাদের সমাজের স্থিতিশীলতা সুনিশ্চিত হতো এবং এর ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত হতো। এজন্য পুলিশের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। তবে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা বলছেন, পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি সিস্টেমে পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন একজন ওসিকে তার থানাধীন দৈনন্দিন কর্মকা- সম্পর্কে ২৪ ঘণ্টায়ই ওয়াকিবহাল থাকতে হয়। জনবল বৃদ্ধি করলেও এই সমস্যার সমাধান হবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত এসব পর্যায়ে নতুন কোন পরিবর্তন আনা না হবে।