গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু

সম্মিলিত গণতান্ত্রিক শক্তির মোকাবিলায় তিন দিনের আবু হোসেনী রাজ খতম পরিষদে শেখ মুজিবুরের অনাস্থা প্রস্তাব ১৫৬-১৪২ ভোটে গৃহীত আওয়ামী কোয়ালিশনের প্রতি ন্যাপ দলের ঐক্যবদ্ধ সমর্থন : প্রতিক্রিয়াশীল জোটের পতনে গণমনে উল্লাস পরাজিত প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগে গড়িমসি : রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টির কারসাজি

অবশেষে সম্মিলিত গণতান্ত্রিক শক্তির মোকাবিলায় নিতান্ত স্বাভাবিকভাবে ৩ দিনের আবু হোসেনী রাজের পতন ঘটিল। গতকাল (সোমবার) পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত অনাস্থা প্রস্তাব ১৫৬-১৪২ ভোটে গৃহীত হয়। সাম্প্রতিক চুক্তি মোতাবেক ন্যাপ দলের ২৮ জন সদ্য আওয়ামী কোয়ালিশন তথা অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোটদান করেন।

ষড়যন্ত্র রাজনীতির মাধ্যমে সাময়িকভাবে ক্ষমতাসীন প্রতিক্রিয়াশীল জোটের পতনে। রাজধানীর সব মহলে বিশেষ করিয়া গণতান্ত্রিক শিবিরে বিপুল উল্লাস পরিলক্ষিত হয়। জনসাধারণের স্বস্তি ও আনন্দের ভাব লক্ষ্য করিলে মনে হয় যে, প্রদেশের রাজনৈতিক জীবনের ওপর হইতে একটি জগদ্দল পাথর নামিয়া গিয়াছে।

গদী আঁকড়াইয়া থাকার জন্য কেএসপি মুসলিম লীগ-নেজাম চক্র শেষ মুহূর্ত। পর্যন্ত সর্বপ্রকার ছলবল ও কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু পরিষদে চরমভাবে পরাজিত হওয়ার পরও তাহাদের ছলাকলার অবসান ঘটে নাই। জনাব আবু হোসেন সরকার পরাজিত হইলে সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করিবেন বলিয়া পরিষদে জোর গলায় ঘোষণা করিলেও এবং পরাজিত প্রধানমন্ত্রীর অবিলম্বে পদত্যাগই একমাত্র পার্লামেন্টারি রেওয়াজ হওয়া সত্ত্বেও তিনি পদত্যাগ করেন নাই। রাজনৈতিক মহলের মতে প্রদেশের রাজনীতিতে অচলাবস্থা সৃষ্টি করিয়া কেন্দ্রের একটি অদৃশ্য হস্তকে পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৩ ধারা জারীর সুযোগ দানের উদ্দেশ্যেই এইরূপ কারসাজি করা হইতেছে।

ষড়যন্ত্রের রাজনীতির ফলে আওয়ামী কোয়ালিশন সরকারের পতন ঘটাইয়া তিনজন সদস্য বিশিষ্ট আবু হোসেনী সরকার মন্ত্রিত্ব গ্রহণের কয়েক ঘণ্টা পরই পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাবের সম্মুখীন হয়। জনাব শেখ মুজিবুর রহমান এই অনাস্থা প্রস্তাব আনয়ন করেন। গতকল্য (সোমবার) বেলা ১০ ঘটিকায় উক্ত প্রস্তাব আলোচনার দিন ধার্য করা হইয়াছিল।

গতকল্য তিন ঘণ্টাকাল পরিষদের অধিবেশন চলার পর ডিভিশনে আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভার সাড়ে তিন দিনের আয়ুস্কালের অবসান ঘটে।

পরিষদে আলোচনার পূর্ণ বিবরণ

গত শুক্রবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক কেএসপি কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাব আলোচনার জন্য গতকল্য (সোমবার) সকাল দশ ঘটিকার সময় ডেপুটি স্পিকার জনাব শাহেদ আলীর সভাপতিত্বে প্রাদেশিক ব্যবস্থা পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়।

অধিবেশনের কাজ শুরু হইবার পরই নেজামে ইসলাম দলের জনাব ফরিদ আহমদ এক অধিকারের প্রশ্ন উখ্যান করিয়া বলেন যে, গঠনতন্ত্র মোতাবেক কোন সদস্য ‘অফিসেস অব প্রফিট’ (লাভজনক পদ) গ্রহণ করিলে তিনি প্রাদেশিক কিংবা কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্যপদে অযোগ্য হইয়া যান। উক্ত পরিপ্রেক্ষিতে জনাব ফরিদ আহমদ বলেন যে, যেহেতু পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের পাঁচজন সদস্য অফিসেস অব প্রফিট গ্রহণ করিয়াছেন সেহেতু তাহাদের সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবার জন্য ব্যাপারটি নির্বাচনী কমিশনের নিকট প্রেরণ করা হউক। জনাব ফরিদ আহমদ বলেন যে, উক্ত সদস্যগণ বর্তমান বিরোধীদলে রহিয়াছেন। আওয়ামী কোয়ালিশন দলের নেতা জনাব আতাউর রহমান খান, জনাব ফরিদ আহমদের অভিযোগের প্রতিবাদ জ্ঞাপন করিয়া বলেন যে, আইন অনুযায়ী উক্ত সদস্যগণ পরিষদের সদস্যপদে অযোগ্য নন। তবে ব্যাপারটি নির্বাচনী কমিশনের নিকট প্রেরণ করা যাইতে পারে এবং উক্ত সদস্যগণ বর্তমান অনাস্থা প্রস্তাব আলোচনায়তেও অংশগ্রহণ করিতে পারেন।

শ্রী মনোরঞ্জন ধরও জনাব ফরিদ আহমদের বিরোধিতা করিয়া বলেন যে, পাবলিক প্রসিকিউটার এবং সরকারি উকিলগণকে সরকারী কর্মচারী হিসাবে গণ্য করা যাইতে পারে না। তদুপরি উক্ত ব্যাপারটি অনেক দেরিতে উত্থাপন করা হইয়াছে।

অর্থমন্ত্রী শ্রী প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ী শ্রী ধরের বিরোধিতা করিয়া বলেন যে, ব্যাপারটি দেরিতে উত্থাপিত হয় নাই। প্রকৃতপক্ষে উক্ত সদস্যগণ লাভজনক পক্ষ (অফিসেস অব প্রফিট) অধিকার করিয়া রহিয়াছেন কিনা পরিষদ সে সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল না। শ্রী লাহিড়ী ডেপুটি স্পিকারকে উক্ত সদস্যদের নাম নির্বাচনী কমিশনে প্রেরণের অনুরোধ জানান।

ডেপুটি স্পিকার জনাব শাহেদ আলী গত মার্চ মাসে স্পিকার জনাব আবদুল হাকিমের একটি রুলিং পাঠ করিয়া সুনান। উহাতে উক্ত সদস্যদের পদগুলি “অফিসেস অব প্রফিট” এর আওতাধীন নহে।

অতঃপর শেখ মুজিবুর রহমান জনাব আবু হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আলোচনার্থ পেশ করিয়া বলেন যে, বর্তমান কে এস পি কোয়ালিশন দল পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থাভাজন নহে। গণতন্ত্রের অনুসারী জনাব আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী কোয়ালিশন দল গত বুধবারে পরাজয় বরণ করার পর অনতিবিলম্বে পদত্যাগ করেন।

শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, বর্তমানে কেএসপি কোয়ালিশন দল সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন সত্ত্বেও যদি গদি আঁকড়াইয়া থাকিতে চায় তবে তাহা গণতন্ত্রের বরখেলাপ হইবে। তিনি বলেন যে, পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য যদি জনাব আবু হোসেন সরকারকে সমর্থন জ্ঞাপন করেন, তবে নিশ্চয়ই তিনি তাহা মানিতে প্রস্তুত।

শেখ মুজিবুর রহমান জনাব আবু হোসেন সরকারকে পরিষদের ভোটাভুটির মোকাবিলা করার আহবান জানান।

জনাব হাশিমুদ্দীন (মুঃ লীগ) বলেন যে, সরকার পক্ষও পরিষদের সিদ্ধান্ত মানিয়া চলিবে। আওয়ামী লীগের মত তাহারাও গণতন্ত্রের অনুসারী। তিনি এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, জনাব আবু হোসেন সরকার মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করার পর তিন দিন মাত্র অতিবাহিত হয়, এই সময়ের মধ্যে তিনি কোন কাজ করিবার সুযোগ পান নাই। তদুপরি বর্তমান আর্থিক বৎসরের বাজেটও পাশ করিতে হইবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জনাব সরকারের বিরুদ্ধে বর্তমানে অনাস্থা প্রস্তাব আনা যুক্তিযুক্ত নহে। আওয়ামী লীগের উপর দোষারূপ করিয়া বলেন যে, দেশে বিশৃংখলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপিত হইয়াছে। তিনি বলেন যে, আওয়ামী লীগ আগুন লইয়া খেলিতেছে। অবশেষে এই আগুনে তাহাদিগকেও দন্ধ হইতে হইবে।

জনাব হাশিমুদ্দীন বলেন যে, অনাস্থা প্রস্তাবটি যখন উত্থাপিত হইয়াছে তখন উহার উপর আলোচনা করা উচিত।

জনাব ফরিদ আহমদ বলেন যে, স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপিত হইয়াছে বলিয়া জনাব মুজিবুর রহমান যা দাবি করেন, তাহা ঠিক নহে। গত সাতদিন যাবৎ যে রাজনৈতিক তৎপরতা চলিয়াছে তাহা স্বাভাবিক নহে। আওয়ামী লীগ যথাযথ গণতন্ত্রের অনুসরণ করিতেছে না বলিয়া জনাব ফরিদ আহমদ অভিযোগ করিয়া বলেন যে, আওয়ামী লীগ কুট পার্লামেন্টারি রাজনীতির খেলায় মাতিয়াছে। তিনি বলেন যে, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গত বুধবার আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারকে সমর্থন করিলে তাহাদের পতন ঘটিত না। তিনি আরও বলেন যে, ন্যাপ ও আওয়ামী কোয়ালিশন দল যে সমস্ত কার্য করিয়াছে তাহা গণতন্ত্রসম্মত নহে। জনাব হাশেমুদ্দিন বলেন যে, আওয়ামী কোয়ালিশন সরকারের পতনের পর ন্যাপের সহিত পাঁচ পয়েন্ট সম্পর্কিত সমঝোতা সৃষ্টির ফলে তাহাদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত। হয়। ফলে জনাব আতাউর রহমান খান পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করিতে চাহিয়া ছিলেন। এই সমস্ত কার্যকলাপকে অগণতান্ত্রিক আখ্যাদান করিয়া জনাব হাশিমুদ্দিন বলেন যে, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বর্তমান পরিস্থিতি এবং রাজনীতিকে ঘোলা করিবার প্রয়াস করিতেছে। তিনি বলেন যে, কোন সরকার কুশাসন, দুর্নীতি ইত্যাদি দ্বারা অযোগ্য প্রমাণিত হইলে সেই সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব তোলা হয়। কিন্তু বর্তমান আবু হোসেন মন্ত্রিসভা কোন প্রকার কাজ করিবারই সুযোগ পান নাই। শেখ মুজিবুর কর্তৃক আনীত অনাস্থা প্রস্তাব সমর্থন করিয়া ন্যাপ পার্লামেন্টারি পার্টি দলের নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশ বলেন যে, কৃষক শ্রমিক পার্টি এবং তাহার সমর্থনকারী দলসমূহের অতীত কার্যাবলী বিবেচনা করিয়াই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি আওয়ামী কোয়ালিশন সরকারকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তিনি বলেন যে, আট বৎসর শাসন আমলে মুসলিম লীগ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি এবং সিয়াটো বাগদাদ ইত্যাদি চুক্তিতে সামিল হইয়া দেশের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করিয়াছে। তিনি বলেন যে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থের বিবেচনায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি আওয়ামী কোয়ালিশনকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে।

দৈনিক মিল্লাত : ২৪ জুন ১৯৫৮

রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৩ ফল্গুন ১৪২৬, ২১ জমাদিউল সানি ১৪৪১

গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু

সম্মিলিত গণতান্ত্রিক শক্তির মোকাবিলায় তিন দিনের আবু হোসেনী রাজ খতম পরিষদে শেখ মুজিবুরের অনাস্থা প্রস্তাব ১৫৬-১৪২ ভোটে গৃহীত আওয়ামী কোয়ালিশনের প্রতি ন্যাপ দলের ঐক্যবদ্ধ সমর্থন : প্রতিক্রিয়াশীল জোটের পতনে গণমনে উল্লাস পরাজিত প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগে গড়িমসি : রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টির কারসাজি

অবশেষে সম্মিলিত গণতান্ত্রিক শক্তির মোকাবিলায় নিতান্ত স্বাভাবিকভাবে ৩ দিনের আবু হোসেনী রাজের পতন ঘটিল। গতকাল (সোমবার) পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত অনাস্থা প্রস্তাব ১৫৬-১৪২ ভোটে গৃহীত হয়। সাম্প্রতিক চুক্তি মোতাবেক ন্যাপ দলের ২৮ জন সদ্য আওয়ামী কোয়ালিশন তথা অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোটদান করেন।

ষড়যন্ত্র রাজনীতির মাধ্যমে সাময়িকভাবে ক্ষমতাসীন প্রতিক্রিয়াশীল জোটের পতনে। রাজধানীর সব মহলে বিশেষ করিয়া গণতান্ত্রিক শিবিরে বিপুল উল্লাস পরিলক্ষিত হয়। জনসাধারণের স্বস্তি ও আনন্দের ভাব লক্ষ্য করিলে মনে হয় যে, প্রদেশের রাজনৈতিক জীবনের ওপর হইতে একটি জগদ্দল পাথর নামিয়া গিয়াছে।

গদী আঁকড়াইয়া থাকার জন্য কেএসপি মুসলিম লীগ-নেজাম চক্র শেষ মুহূর্ত। পর্যন্ত সর্বপ্রকার ছলবল ও কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু পরিষদে চরমভাবে পরাজিত হওয়ার পরও তাহাদের ছলাকলার অবসান ঘটে নাই। জনাব আবু হোসেন সরকার পরাজিত হইলে সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করিবেন বলিয়া পরিষদে জোর গলায় ঘোষণা করিলেও এবং পরাজিত প্রধানমন্ত্রীর অবিলম্বে পদত্যাগই একমাত্র পার্লামেন্টারি রেওয়াজ হওয়া সত্ত্বেও তিনি পদত্যাগ করেন নাই। রাজনৈতিক মহলের মতে প্রদেশের রাজনীতিতে অচলাবস্থা সৃষ্টি করিয়া কেন্দ্রের একটি অদৃশ্য হস্তকে পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৩ ধারা জারীর সুযোগ দানের উদ্দেশ্যেই এইরূপ কারসাজি করা হইতেছে।

ষড়যন্ত্রের রাজনীতির ফলে আওয়ামী কোয়ালিশন সরকারের পতন ঘটাইয়া তিনজন সদস্য বিশিষ্ট আবু হোসেনী সরকার মন্ত্রিত্ব গ্রহণের কয়েক ঘণ্টা পরই পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাবের সম্মুখীন হয়। জনাব শেখ মুজিবুর রহমান এই অনাস্থা প্রস্তাব আনয়ন করেন। গতকল্য (সোমবার) বেলা ১০ ঘটিকায় উক্ত প্রস্তাব আলোচনার দিন ধার্য করা হইয়াছিল।

গতকল্য তিন ঘণ্টাকাল পরিষদের অধিবেশন চলার পর ডিভিশনে আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভার সাড়ে তিন দিনের আয়ুস্কালের অবসান ঘটে।

পরিষদে আলোচনার পূর্ণ বিবরণ

গত শুক্রবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক কেএসপি কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাব আলোচনার জন্য গতকল্য (সোমবার) সকাল দশ ঘটিকার সময় ডেপুটি স্পিকার জনাব শাহেদ আলীর সভাপতিত্বে প্রাদেশিক ব্যবস্থা পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়।

অধিবেশনের কাজ শুরু হইবার পরই নেজামে ইসলাম দলের জনাব ফরিদ আহমদ এক অধিকারের প্রশ্ন উখ্যান করিয়া বলেন যে, গঠনতন্ত্র মোতাবেক কোন সদস্য ‘অফিসেস অব প্রফিট’ (লাভজনক পদ) গ্রহণ করিলে তিনি প্রাদেশিক কিংবা কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্যপদে অযোগ্য হইয়া যান। উক্ত পরিপ্রেক্ষিতে জনাব ফরিদ আহমদ বলেন যে, যেহেতু পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের পাঁচজন সদস্য অফিসেস অব প্রফিট গ্রহণ করিয়াছেন সেহেতু তাহাদের সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবার জন্য ব্যাপারটি নির্বাচনী কমিশনের নিকট প্রেরণ করা হউক। জনাব ফরিদ আহমদ বলেন যে, উক্ত সদস্যগণ বর্তমান বিরোধীদলে রহিয়াছেন। আওয়ামী কোয়ালিশন দলের নেতা জনাব আতাউর রহমান খান, জনাব ফরিদ আহমদের অভিযোগের প্রতিবাদ জ্ঞাপন করিয়া বলেন যে, আইন অনুযায়ী উক্ত সদস্যগণ পরিষদের সদস্যপদে অযোগ্য নন। তবে ব্যাপারটি নির্বাচনী কমিশনের নিকট প্রেরণ করা যাইতে পারে এবং উক্ত সদস্যগণ বর্তমান অনাস্থা প্রস্তাব আলোচনায়তেও অংশগ্রহণ করিতে পারেন।

শ্রী মনোরঞ্জন ধরও জনাব ফরিদ আহমদের বিরোধিতা করিয়া বলেন যে, পাবলিক প্রসিকিউটার এবং সরকারি উকিলগণকে সরকারী কর্মচারী হিসাবে গণ্য করা যাইতে পারে না। তদুপরি উক্ত ব্যাপারটি অনেক দেরিতে উত্থাপন করা হইয়াছে।

অর্থমন্ত্রী শ্রী প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ী শ্রী ধরের বিরোধিতা করিয়া বলেন যে, ব্যাপারটি দেরিতে উত্থাপিত হয় নাই। প্রকৃতপক্ষে উক্ত সদস্যগণ লাভজনক পক্ষ (অফিসেস অব প্রফিট) অধিকার করিয়া রহিয়াছেন কিনা পরিষদ সে সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল না। শ্রী লাহিড়ী ডেপুটি স্পিকারকে উক্ত সদস্যদের নাম নির্বাচনী কমিশনে প্রেরণের অনুরোধ জানান।

ডেপুটি স্পিকার জনাব শাহেদ আলী গত মার্চ মাসে স্পিকার জনাব আবদুল হাকিমের একটি রুলিং পাঠ করিয়া সুনান। উহাতে উক্ত সদস্যদের পদগুলি “অফিসেস অব প্রফিট” এর আওতাধীন নহে।

অতঃপর শেখ মুজিবুর রহমান জনাব আবু হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আলোচনার্থ পেশ করিয়া বলেন যে, বর্তমান কে এস পি কোয়ালিশন দল পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থাভাজন নহে। গণতন্ত্রের অনুসারী জনাব আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী কোয়ালিশন দল গত বুধবারে পরাজয় বরণ করার পর অনতিবিলম্বে পদত্যাগ করেন।

শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, বর্তমানে কেএসপি কোয়ালিশন দল সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন সত্ত্বেও যদি গদি আঁকড়াইয়া থাকিতে চায় তবে তাহা গণতন্ত্রের বরখেলাপ হইবে। তিনি বলেন যে, পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য যদি জনাব আবু হোসেন সরকারকে সমর্থন জ্ঞাপন করেন, তবে নিশ্চয়ই তিনি তাহা মানিতে প্রস্তুত।

শেখ মুজিবুর রহমান জনাব আবু হোসেন সরকারকে পরিষদের ভোটাভুটির মোকাবিলা করার আহবান জানান।

জনাব হাশিমুদ্দীন (মুঃ লীগ) বলেন যে, সরকার পক্ষও পরিষদের সিদ্ধান্ত মানিয়া চলিবে। আওয়ামী লীগের মত তাহারাও গণতন্ত্রের অনুসারী। তিনি এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, জনাব আবু হোসেন সরকার মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করার পর তিন দিন মাত্র অতিবাহিত হয়, এই সময়ের মধ্যে তিনি কোন কাজ করিবার সুযোগ পান নাই। তদুপরি বর্তমান আর্থিক বৎসরের বাজেটও পাশ করিতে হইবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জনাব সরকারের বিরুদ্ধে বর্তমানে অনাস্থা প্রস্তাব আনা যুক্তিযুক্ত নহে। আওয়ামী লীগের উপর দোষারূপ করিয়া বলেন যে, দেশে বিশৃংখলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপিত হইয়াছে। তিনি বলেন যে, আওয়ামী লীগ আগুন লইয়া খেলিতেছে। অবশেষে এই আগুনে তাহাদিগকেও দন্ধ হইতে হইবে।

জনাব হাশিমুদ্দীন বলেন যে, অনাস্থা প্রস্তাবটি যখন উত্থাপিত হইয়াছে তখন উহার উপর আলোচনা করা উচিত।

জনাব ফরিদ আহমদ বলেন যে, স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপিত হইয়াছে বলিয়া জনাব মুজিবুর রহমান যা দাবি করেন, তাহা ঠিক নহে। গত সাতদিন যাবৎ যে রাজনৈতিক তৎপরতা চলিয়াছে তাহা স্বাভাবিক নহে। আওয়ামী লীগ যথাযথ গণতন্ত্রের অনুসরণ করিতেছে না বলিয়া জনাব ফরিদ আহমদ অভিযোগ করিয়া বলেন যে, আওয়ামী লীগ কুট পার্লামেন্টারি রাজনীতির খেলায় মাতিয়াছে। তিনি বলেন যে, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গত বুধবার আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারকে সমর্থন করিলে তাহাদের পতন ঘটিত না। তিনি আরও বলেন যে, ন্যাপ ও আওয়ামী কোয়ালিশন দল যে সমস্ত কার্য করিয়াছে তাহা গণতন্ত্রসম্মত নহে। জনাব হাশেমুদ্দিন বলেন যে, আওয়ামী কোয়ালিশন সরকারের পতনের পর ন্যাপের সহিত পাঁচ পয়েন্ট সম্পর্কিত সমঝোতা সৃষ্টির ফলে তাহাদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত। হয়। ফলে জনাব আতাউর রহমান খান পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করিতে চাহিয়া ছিলেন। এই সমস্ত কার্যকলাপকে অগণতান্ত্রিক আখ্যাদান করিয়া জনাব হাশিমুদ্দিন বলেন যে, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বর্তমান পরিস্থিতি এবং রাজনীতিকে ঘোলা করিবার প্রয়াস করিতেছে। তিনি বলেন যে, কোন সরকার কুশাসন, দুর্নীতি ইত্যাদি দ্বারা অযোগ্য প্রমাণিত হইলে সেই সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব তোলা হয়। কিন্তু বর্তমান আবু হোসেন মন্ত্রিসভা কোন প্রকার কাজ করিবারই সুযোগ পান নাই। শেখ মুজিবুর কর্তৃক আনীত অনাস্থা প্রস্তাব সমর্থন করিয়া ন্যাপ পার্লামেন্টারি পার্টি দলের নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশ বলেন যে, কৃষক শ্রমিক পার্টি এবং তাহার সমর্থনকারী দলসমূহের অতীত কার্যাবলী বিবেচনা করিয়াই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি আওয়ামী কোয়ালিশন সরকারকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তিনি বলেন যে, আট বৎসর শাসন আমলে মুসলিম লীগ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি এবং সিয়াটো বাগদাদ ইত্যাদি চুক্তিতে সামিল হইয়া দেশের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করিয়াছে। তিনি বলেন যে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থের বিবেচনায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি আওয়ামী কোয়ালিশনকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে।

দৈনিক মিল্লাত : ২৪ জুন ১৯৫৮