মুজিব শাসন আমল : ১৯৭২

১৩ ফেব্রুয়ারি

বর্বরবাহিনী ষাট লাখ গৃহ ধ্বংস করেছে

কোলকাতা। বাংলাদেশ সরকার এ বছরের মে মাসের মধ্যেই সারাদেশের ৬২টি আদর্শ গ্রাম স্থাপনের কথা চিন্তা করছে বলে সাহায্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রী জনাব এ এইচএম কামারুজ্জামান জানিয়েছেন। জনাব কামারুজ্জামান আজ কোলকাতায় সাংবাদিকদের কাছে বলেন যে, দখলদারবাহিনী ৯ মাস সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ৬০ লাখ গৃহ ধ্বংস করেছে। অল্প সময়ের মধ্যে এই বিপুলসংখ্যক গৃহ পুনঃনির্মাণ সম্ভব নয়। সরকার সুপরিকল্পিতভাবে পরিকল্পনা করছে বলে তিনি জানান। পুনর্বাসন মন্ত্রী বলেন যে, প্রতিটি মহকুমায় একটি করে আদর্শ গ্রাম প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ ব্যাপারে অর্থ ছাড়াও সরঞ্জামের অভাব। রয়েছে। ভারত, জার্মানি, বৃটেন, অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও জাপান সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে। শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন সম্পকে জনাব কামারুজ্জামান বলেন যে, এ পর্যন্ত ৭৮ লাখ শরণার্থী দেশে ফিরে গেছে। অবশিষ্ট শরণার্থীরা চলতি মাসের শেষাশেষি ফিরে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

মার্চের শেষ ভাগে গণপরিষদ বসবে : জনাব কামারুজ্জামান কোলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশ গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হবে বলে আশা করা যায়। তিনি আরো বলেন যে, শাসনতন্ত্রের খসড়া তৈরির কাজ প্রায় সমাপ্ত এবং যথাশীঘ্রই সম্ভব তা গণপরিষদে প্রেরণ করা হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১ মার্চ সোভিয়েত ইউনিয়নে সফরে যাবেন বলে এ মাসে অধিবেশন সম্ভব হলো না।

প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে এক নয়া অধ্যায় সংযোজন করেছে। নবজাত রাষ্ট্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা উল্লেখ করে সিনেটর কেনেডি বলেন, এ শিশু রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আপনাদের ওপরই। বাংলাদেশি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, যারা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতিতে বিশ্বাস করেন না বাংলাদেশের নজরে তাদের শিক্ষা দেবে।

সরকার ছিল না জনগণ ছিল : মার্কিন সরকার যদিও বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থন করেনি তথাপি মার্কিন জনগণ এদেশের সংগ্রামী মানুষের দোসর ছিল। মানুষের মহান মূল্যবোধের মর্যাদা দিয়েই তারা বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন। তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে সিনেটর কেনেডি ঘোষণা করেন, “আমি বাংলাদেশের জনগণের জন্য মার্কিন জনগণের শুভেচ্ছবাণী নিয়ে এসেছি।’ তিনি আরো বলেন যে, আমেরিকানরা পরম আগ্রহে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারা দেখেছেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এ যুদ্ধে সবাই অংশগ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, আমরা সবাই বাঙালি’ আমরা সবাই আমেরিকান, আমরা সবাই মানুষ। আমরা মানুষ্যত্বে বিশ্বাস করি। সভা চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা জয়বাংলা, জয় কেনেডি, কেনেডি তোমায় ভালোবাসি এসব স্লোগান করেন।

বিমানবন্দরে : সকালে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বিমান বন্দরে পৌঁছালে আন্তরিক সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বিমানবন্দরে বাংলার তরুণ সমাজ সিনেটর কেনেডিকে এক নজর দেখার জন্য এতো পাগলপারা হয়ে পড়ে যে, সরকারি নিয়ম শৃঙ্খলা পর্যন্ত বিকল হয়ে যায়। ছাত্রছাত্রীরা তাকে এক প্রকার ঘিরে রাখে। ফলে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব এম আর সিদ্দিকী যথাসমেয় তাকে স্বাগত জানাতে পারেনি। বহু কষ্টে তরুণ তরুণীদের ভিড়ের মধ্যে থেকে কোনো রকম বের করে আনলে প্রথমে বাণিজ্যমন্ত্রী তাকে বাংলার মাটিতে সু-স্বাগতম জানান। এরপরপরই আওয়ামী লীগের পক্ষে জনাব আবদুর রাজ্জাক এবং ন্যাপ নেতা জনাব মহিউদ্দিন তাকে ফুলের মালা পরিয়ে দেন। তারা কিছুক্ষণ অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত সিনেটর কেনেডিকে অভিনন্দন জানাতে পেরেছিলেন। বিমান বন্দরে সিনেটর কেনেডির জন্য একটি লালগালিচা বিছানো হয়েছিল। অনেক হতাশ তরুণ তরুণী মালা দিতে না পেরে পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ করেন। বলাবাহুল্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় একই দৃশ্যের অবতারণা হয়।

আজকের কর্মসূচি : আজ মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তিনি সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশে থাকাকালে সিনেটর অত্যন্ত ব্যস্ত দিন কাটাবেন। উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সিনেটর কেনেডি এবারই প্রথম ঢাকায় এলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তিনি বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পাকিস্তানি প্রতিপক্ষ তা নাকচ করে দেন।

সূত্র : দিনলিপি, বঙ্গবন্ধুর শাসন সময়, ১৯৭২

রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৩ ফল্গুন ১৪২৬, ২১ জমাদিউল সানি ১৪৪১

মুজিব শতবর্ষ

মুজিব শাসন আমল : ১৯৭২

১৩ ফেব্রুয়ারি

বর্বরবাহিনী ষাট লাখ গৃহ ধ্বংস করেছে

কোলকাতা। বাংলাদেশ সরকার এ বছরের মে মাসের মধ্যেই সারাদেশের ৬২টি আদর্শ গ্রাম স্থাপনের কথা চিন্তা করছে বলে সাহায্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রী জনাব এ এইচএম কামারুজ্জামান জানিয়েছেন। জনাব কামারুজ্জামান আজ কোলকাতায় সাংবাদিকদের কাছে বলেন যে, দখলদারবাহিনী ৯ মাস সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ৬০ লাখ গৃহ ধ্বংস করেছে। অল্প সময়ের মধ্যে এই বিপুলসংখ্যক গৃহ পুনঃনির্মাণ সম্ভব নয়। সরকার সুপরিকল্পিতভাবে পরিকল্পনা করছে বলে তিনি জানান। পুনর্বাসন মন্ত্রী বলেন যে, প্রতিটি মহকুমায় একটি করে আদর্শ গ্রাম প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ ব্যাপারে অর্থ ছাড়াও সরঞ্জামের অভাব। রয়েছে। ভারত, জার্মানি, বৃটেন, অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও জাপান সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে। শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন সম্পকে জনাব কামারুজ্জামান বলেন যে, এ পর্যন্ত ৭৮ লাখ শরণার্থী দেশে ফিরে গেছে। অবশিষ্ট শরণার্থীরা চলতি মাসের শেষাশেষি ফিরে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

মার্চের শেষ ভাগে গণপরিষদ বসবে : জনাব কামারুজ্জামান কোলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশ গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হবে বলে আশা করা যায়। তিনি আরো বলেন যে, শাসনতন্ত্রের খসড়া তৈরির কাজ প্রায় সমাপ্ত এবং যথাশীঘ্রই সম্ভব তা গণপরিষদে প্রেরণ করা হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১ মার্চ সোভিয়েত ইউনিয়নে সফরে যাবেন বলে এ মাসে অধিবেশন সম্ভব হলো না।

প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে এক নয়া অধ্যায় সংযোজন করেছে। নবজাত রাষ্ট্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা উল্লেখ করে সিনেটর কেনেডি বলেন, এ শিশু রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আপনাদের ওপরই। বাংলাদেশি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, যারা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতিতে বিশ্বাস করেন না বাংলাদেশের নজরে তাদের শিক্ষা দেবে।

সরকার ছিল না জনগণ ছিল : মার্কিন সরকার যদিও বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থন করেনি তথাপি মার্কিন জনগণ এদেশের সংগ্রামী মানুষের দোসর ছিল। মানুষের মহান মূল্যবোধের মর্যাদা দিয়েই তারা বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন। তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে সিনেটর কেনেডি ঘোষণা করেন, “আমি বাংলাদেশের জনগণের জন্য মার্কিন জনগণের শুভেচ্ছবাণী নিয়ে এসেছি।’ তিনি আরো বলেন যে, আমেরিকানরা পরম আগ্রহে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারা দেখেছেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এ যুদ্ধে সবাই অংশগ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, আমরা সবাই বাঙালি’ আমরা সবাই আমেরিকান, আমরা সবাই মানুষ। আমরা মানুষ্যত্বে বিশ্বাস করি। সভা চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা জয়বাংলা, জয় কেনেডি, কেনেডি তোমায় ভালোবাসি এসব স্লোগান করেন।

বিমানবন্দরে : সকালে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বিমান বন্দরে পৌঁছালে আন্তরিক সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বিমানবন্দরে বাংলার তরুণ সমাজ সিনেটর কেনেডিকে এক নজর দেখার জন্য এতো পাগলপারা হয়ে পড়ে যে, সরকারি নিয়ম শৃঙ্খলা পর্যন্ত বিকল হয়ে যায়। ছাত্রছাত্রীরা তাকে এক প্রকার ঘিরে রাখে। ফলে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব এম আর সিদ্দিকী যথাসমেয় তাকে স্বাগত জানাতে পারেনি। বহু কষ্টে তরুণ তরুণীদের ভিড়ের মধ্যে থেকে কোনো রকম বের করে আনলে প্রথমে বাণিজ্যমন্ত্রী তাকে বাংলার মাটিতে সু-স্বাগতম জানান। এরপরপরই আওয়ামী লীগের পক্ষে জনাব আবদুর রাজ্জাক এবং ন্যাপ নেতা জনাব মহিউদ্দিন তাকে ফুলের মালা পরিয়ে দেন। তারা কিছুক্ষণ অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত সিনেটর কেনেডিকে অভিনন্দন জানাতে পেরেছিলেন। বিমান বন্দরে সিনেটর কেনেডির জন্য একটি লালগালিচা বিছানো হয়েছিল। অনেক হতাশ তরুণ তরুণী মালা দিতে না পেরে পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ করেন। বলাবাহুল্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় একই দৃশ্যের অবতারণা হয়।

আজকের কর্মসূচি : আজ মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তিনি সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশে থাকাকালে সিনেটর অত্যন্ত ব্যস্ত দিন কাটাবেন। উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সিনেটর কেনেডি এবারই প্রথম ঢাকায় এলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তিনি বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পাকিস্তানি প্রতিপক্ষ তা নাকচ করে দেন।

সূত্র : দিনলিপি, বঙ্গবন্ধুর শাসন সময়, ১৯৭২