প্রার্থীর নাম প্রকাশে চমক

যেসব কারণে ছিটকে পড়লেন নাসির

সপ্তাহব্যাপী পুরো নগরে আলোচনা-সমালোচনা, ফেসবুকে পাল্টাপাল্টি স্ট্যাটাসের অবসান ঘটিয়ে গত শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের মেয়র পদের মনোনয়ন নিয়ে কাক্সিক্ষত প্রার্থীর নাম প্রকাশ্যে আসায় চট্টগ্রামজুড়ে চমক সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে চসিক মেয়র পদে যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিলেন আ জ ম নাছির উদ্দীন। কিন্তু গত শনিবার নেয়া দলীয় সিদ্ধান্তে নাছিরকে হটিয়ে একেবারেই আলোচনার বাইরে থাকা রেজাউল করিম চৌধুরী মনোনয়ন পেয়ে যাওয়ার ঘটনায় চট্টগ্রামজুড়ে এই চমক সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে নাছির কেন ছিটকে পড়লেন সে নিয়েও আলোচনার বড় ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

জানা গেছে, ওই দিনই চমক দিয়েই নৌকার মাঝির নাম ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরীর প্রতিই আস্থা রাখেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। আর চসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ঘোষণার মধ্য দিয়ে মনোনয়ন নিয়ে সপ্তাহজুড়ে চলা নগরবাসীর উৎকণ্ঠার অবসান হলো।

জানা গেছে, গত সপ্তাহব্যাপী আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর নাম লোকমুখে পরিবর্তন হলেও প্রকৃতপক্ষে কে মনোনয়ন পাচ্ছেন তার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন নগরবাসী। অবশেষে গত শনিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেয়র পদে মনোনিয়নে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরীর নাম ঘোষণা করেন।

এর আগে গত ১০ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে সম্ভাব্য প্রার্থীরা মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। পাঁচ দিনে নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন, নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু, যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির পুত্র মুজিবুর রহমান, প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী সন্তান হেলাল উদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, প্রয়াত সাংসদ মঈনুদ্দীন খান বাদলের স্ত্রী সেলিনা খান, সাবেক প্যানেল মেয়র রেখা আলম চৌধুরী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা মো. এমদাদুল ইসলাম, মো. ইনসান আলী, বিজয় মেলা উদযাপন পরিষদের মহাসচিব মোহাম্মদ ইউনুছ, সাবেক সিটি মেয়র মনজুর আলম, চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম, নগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা একেএম বেলায়েত হোসেন, মো. এরশাদুল আমীন, মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন ও দীপক কুমার পালিত মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন।

মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ১৯৬৬ সাল থেকে রাজনীতির মাঠে ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ, ছয় দফা আন্দোলন, এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জনগণের কাছাকাছি ছিলাম। এখন নেত্রী আমার উপর আস্থা রেখেছেন। নির্বাচনে জয়ী হলে নগরবাসীর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখব।

এদিকে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ছিটকে পড়ার বিষয়ে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকের মতে, মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরাগভাজন হওয়া, নিজস্ব বলয়ের বাইরে যেতে না পারা, বন্দরকেন্দ্রিক বাণিজ্য নিয়ে সমালোচনায় পড়া, কয়েকটি আলোচিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিতর্কিত ভূমিকা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কর্মকাণ্ড নিয়ে তেমন আশা তৈরি করতে না পারা, বক্তব্য দিয়ে বিতর্ক তৈরি করা- এসব নানা কারণে ‘মেয়রের চেয়ার’ হাতছাড়া হচ্ছে নাছিরের। তবে শেষ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর খুনির ভাইয়ের সঙ্গে নাছিরের একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর পরিস্থিতি পুরোপুরি তার বিরুদ্ধে চলে যায় বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।

২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হন আ জ ম নাছির উদ্দীন। এর আগে ২০১৩ সালে তাকে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

তবে প্রায় তিন দশক ধরে চট্টগ্রাম নগরীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির উদ্দীনকে ঘিরে বিভক্ত। ২০১৫’র ওই নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়েও পাননি মহিউদ্দিন চৌধুরী। আড়াই বছরের মাথায় ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। সেই বিতর্কে নিজেকে এতটাই ‘প্রতিহিংসার’ জায়গায় নিয়ে গেছেন আ জ ম নাছির, যে এবার নিজেকেই তার প্রতিফল ভোগ করতে হলো, মন্তব্য অনেকের।

নগর আওয়ামী লীগের একজন সহসভাপতি নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, মহিউদ্দিন চৌধুরীর বলয়ের সঙ্গে দিনে দিনে দূরত্ব এত বাড়িয়েছেন আ জ ম নাছির যে শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। তিনি বলেন, মহিউদ্দিন ভাই মনোনয়ন না পেলেও ওনার নেতাকর্মীরা সবাই নাছিরের পক্ষে নির্বাচনে কাজ করেছিলেন। কিন্তু মেয়র হওয়ার পর নাছির মহিউদ্দিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে এমন সব বক্তব্য-বিবৃতি দিতে থাকেন, তাতে নেতাকর্মীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।

এদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে গত সাড়ে চার বছরের কর্মকাণ্ড নিয়েও দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা আছে। নগর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেয়র প্রার্থী হিসেবে আ জ ম নাছিরের প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল জলাবদ্ধতা নিরসন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি সেটাকে এড়িয়ে গিয়ে জলাবদ্ধতা নিরসন সিটি করপোরেশনের কাজ নয় বলে বক্তব্য দিতে শুরু করেন। স্কুলে শিক্ষার্থীদের বেতন পাঁচগুণ বৃদ্ধি করেন। মেয়াদের প্রথম তিন বছর সিটি করপোরেশনের দৃশ্যমান কোন কাজই ছিল না। শেষ মুহূর্তে এসে খাল খনন, সড়ক ও নালা-নর্দমা সংস্কারসহ কয়েক হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প নেন। তবে নগরীর দুটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের কাজ সঠিক সময়ে শেষ করতে না পারায় নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এছাড়া ওয়াসার পাইপলাইন স্থাপনের কাজ নিয়ে সারা শহরে খোঁড়াখুঁড়ির সমালোচনাও সহ্য করতে হচ্ছে মেয়রকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, নির্বাচিত মেয়র হিসেবে তিনি সেবা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে পারেননি। এর মধ্যে গৃহায়ণের এক প্রকৌশলীকে চড় মারার অভিযোগ নিয়ে বিতর্কিত হন নাছির।

অভিযোগ আছে- নগর আওয়ামী লীগের মহিউদ্দিন অনুসারী নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন আ জ ম নাছির। মহিউদ্দিন চৌধুরী জীবিত থাকাবস্থায় ২০১৬ সালে নগরীর কোতোয়ালী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করেন হাসান মনসুরকে। কিন্তু নাছিরের বিরোধিতার কারণে মনসুর তার দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। একপর্যায়ে তাকে পদ ছাড়তে হয়। এ ধরনের ঘটনা থানা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ এবং যুবলীগ-ছাত্রলীগেও ঘটেছে।

জানতে চাইলে হাসান মনসুর বলেন, ওনার (নাছির) সরাসরি বিরোধিতার কারণে আমি পদ পাওয়ার পরও কাজ করতে পারিনি। আমি তৃণমূলের ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এসেছি। আমি মহিউদ্দিন ভাইয়ের কর্মী, তাই ওনার বিরাগভাজন হয়েছিলাম। উনি আমাকে কোন মিটিংয়ে পর্যন্ত ঢুকতে দেননি। তিনি নিজের লোক ছাড়া কাউকে আপন করতে পারেন না। আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মীকে উনি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে হয়রানি করেছেন। অথচ আমরা সবাই মিলেমিশে ওনাকে জিতিয়ে এনেছিলাম।

তবে সর্বশেষ ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ছবি নাছিরের মনোনয়ন পুরোপুরি অনিশ্চিত করে দেয় বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। ওই ছবিতে নাছিরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খানের ভাই মামুনুর রশিদ হেলাল ও চাচাতো ভাই আওয়ামী লীগ নেতা আকরাম খানকে দেখা যায়। এই ছবিটি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর তোলপাড় ওঠে। যদিও নাছিরের অনুসারীদের দাবি, ছবিটি এডিট করা।

নগর আওয়ামী লীগের একজন সহ-সভাপতি বলেন, গতবার মনোনয়ন পাওয়ার সময় নাছিরকে দলের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে অনেক বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হয়েছিল। এবার নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে তেমন বিরোধিতা ছিল না। তবে চট্টগ্রামের নেতাদের পাশে পাননি নাছির। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে- তিনি সার্বজনীন নেতা হতে পারেননি। পেশিশক্তি নির্ভর রাজনীতির কারণে তাকে অনেকে ভয় পান। এরপরও মনোনয়নের জোরালো আলোচনায় তিনি ছিলেন। কিন্তু ফেসবুকে ছবিটি কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়ার মতো হয়েছে।

সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৪ ফল্গুন ১৪২৬, ২২ জমাদিউল সানি ১৪৪১

চট্টগ্রামে মেয়র পদে আ’লীগের

প্রার্থীর নাম প্রকাশে চমক

যেসব কারণে ছিটকে পড়লেন নাসির

নিরুপম দাশগুপ্ত, চট্টগ্রাম ব্যুরো

সপ্তাহব্যাপী পুরো নগরে আলোচনা-সমালোচনা, ফেসবুকে পাল্টাপাল্টি স্ট্যাটাসের অবসান ঘটিয়ে গত শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের মেয়র পদের মনোনয়ন নিয়ে কাক্সিক্ষত প্রার্থীর নাম প্রকাশ্যে আসায় চট্টগ্রামজুড়ে চমক সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে চসিক মেয়র পদে যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিলেন আ জ ম নাছির উদ্দীন। কিন্তু গত শনিবার নেয়া দলীয় সিদ্ধান্তে নাছিরকে হটিয়ে একেবারেই আলোচনার বাইরে থাকা রেজাউল করিম চৌধুরী মনোনয়ন পেয়ে যাওয়ার ঘটনায় চট্টগ্রামজুড়ে এই চমক সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে নাছির কেন ছিটকে পড়লেন সে নিয়েও আলোচনার বড় ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

জানা গেছে, ওই দিনই চমক দিয়েই নৌকার মাঝির নাম ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরীর প্রতিই আস্থা রাখেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। আর চসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ঘোষণার মধ্য দিয়ে মনোনয়ন নিয়ে সপ্তাহজুড়ে চলা নগরবাসীর উৎকণ্ঠার অবসান হলো।

জানা গেছে, গত সপ্তাহব্যাপী আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর নাম লোকমুখে পরিবর্তন হলেও প্রকৃতপক্ষে কে মনোনয়ন পাচ্ছেন তার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন নগরবাসী। অবশেষে গত শনিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেয়র পদে মনোনিয়নে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরীর নাম ঘোষণা করেন।

এর আগে গত ১০ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে সম্ভাব্য প্রার্থীরা মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। পাঁচ দিনে নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন, নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু, যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির পুত্র মুজিবুর রহমান, প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী সন্তান হেলাল উদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, প্রয়াত সাংসদ মঈনুদ্দীন খান বাদলের স্ত্রী সেলিনা খান, সাবেক প্যানেল মেয়র রেখা আলম চৌধুরী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা মো. এমদাদুল ইসলাম, মো. ইনসান আলী, বিজয় মেলা উদযাপন পরিষদের মহাসচিব মোহাম্মদ ইউনুছ, সাবেক সিটি মেয়র মনজুর আলম, চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম, নগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা একেএম বেলায়েত হোসেন, মো. এরশাদুল আমীন, মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন ও দীপক কুমার পালিত মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন।

মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ১৯৬৬ সাল থেকে রাজনীতির মাঠে ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ, ছয় দফা আন্দোলন, এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জনগণের কাছাকাছি ছিলাম। এখন নেত্রী আমার উপর আস্থা রেখেছেন। নির্বাচনে জয়ী হলে নগরবাসীর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখব।

এদিকে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ছিটকে পড়ার বিষয়ে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকের মতে, মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরাগভাজন হওয়া, নিজস্ব বলয়ের বাইরে যেতে না পারা, বন্দরকেন্দ্রিক বাণিজ্য নিয়ে সমালোচনায় পড়া, কয়েকটি আলোচিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিতর্কিত ভূমিকা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কর্মকাণ্ড নিয়ে তেমন আশা তৈরি করতে না পারা, বক্তব্য দিয়ে বিতর্ক তৈরি করা- এসব নানা কারণে ‘মেয়রের চেয়ার’ হাতছাড়া হচ্ছে নাছিরের। তবে শেষ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর খুনির ভাইয়ের সঙ্গে নাছিরের একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর পরিস্থিতি পুরোপুরি তার বিরুদ্ধে চলে যায় বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।

২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হন আ জ ম নাছির উদ্দীন। এর আগে ২০১৩ সালে তাকে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

তবে প্রায় তিন দশক ধরে চট্টগ্রাম নগরীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির উদ্দীনকে ঘিরে বিভক্ত। ২০১৫’র ওই নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়েও পাননি মহিউদ্দিন চৌধুরী। আড়াই বছরের মাথায় ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। সেই বিতর্কে নিজেকে এতটাই ‘প্রতিহিংসার’ জায়গায় নিয়ে গেছেন আ জ ম নাছির, যে এবার নিজেকেই তার প্রতিফল ভোগ করতে হলো, মন্তব্য অনেকের।

নগর আওয়ামী লীগের একজন সহসভাপতি নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, মহিউদ্দিন চৌধুরীর বলয়ের সঙ্গে দিনে দিনে দূরত্ব এত বাড়িয়েছেন আ জ ম নাছির যে শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। তিনি বলেন, মহিউদ্দিন ভাই মনোনয়ন না পেলেও ওনার নেতাকর্মীরা সবাই নাছিরের পক্ষে নির্বাচনে কাজ করেছিলেন। কিন্তু মেয়র হওয়ার পর নাছির মহিউদ্দিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে এমন সব বক্তব্য-বিবৃতি দিতে থাকেন, তাতে নেতাকর্মীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।

এদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে গত সাড়ে চার বছরের কর্মকাণ্ড নিয়েও দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা আছে। নগর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেয়র প্রার্থী হিসেবে আ জ ম নাছিরের প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল জলাবদ্ধতা নিরসন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি সেটাকে এড়িয়ে গিয়ে জলাবদ্ধতা নিরসন সিটি করপোরেশনের কাজ নয় বলে বক্তব্য দিতে শুরু করেন। স্কুলে শিক্ষার্থীদের বেতন পাঁচগুণ বৃদ্ধি করেন। মেয়াদের প্রথম তিন বছর সিটি করপোরেশনের দৃশ্যমান কোন কাজই ছিল না। শেষ মুহূর্তে এসে খাল খনন, সড়ক ও নালা-নর্দমা সংস্কারসহ কয়েক হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প নেন। তবে নগরীর দুটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের কাজ সঠিক সময়ে শেষ করতে না পারায় নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এছাড়া ওয়াসার পাইপলাইন স্থাপনের কাজ নিয়ে সারা শহরে খোঁড়াখুঁড়ির সমালোচনাও সহ্য করতে হচ্ছে মেয়রকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, নির্বাচিত মেয়র হিসেবে তিনি সেবা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে পারেননি। এর মধ্যে গৃহায়ণের এক প্রকৌশলীকে চড় মারার অভিযোগ নিয়ে বিতর্কিত হন নাছির।

অভিযোগ আছে- নগর আওয়ামী লীগের মহিউদ্দিন অনুসারী নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন আ জ ম নাছির। মহিউদ্দিন চৌধুরী জীবিত থাকাবস্থায় ২০১৬ সালে নগরীর কোতোয়ালী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করেন হাসান মনসুরকে। কিন্তু নাছিরের বিরোধিতার কারণে মনসুর তার দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। একপর্যায়ে তাকে পদ ছাড়তে হয়। এ ধরনের ঘটনা থানা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ এবং যুবলীগ-ছাত্রলীগেও ঘটেছে।

জানতে চাইলে হাসান মনসুর বলেন, ওনার (নাছির) সরাসরি বিরোধিতার কারণে আমি পদ পাওয়ার পরও কাজ করতে পারিনি। আমি তৃণমূলের ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এসেছি। আমি মহিউদ্দিন ভাইয়ের কর্মী, তাই ওনার বিরাগভাজন হয়েছিলাম। উনি আমাকে কোন মিটিংয়ে পর্যন্ত ঢুকতে দেননি। তিনি নিজের লোক ছাড়া কাউকে আপন করতে পারেন না। আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মীকে উনি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে হয়রানি করেছেন। অথচ আমরা সবাই মিলেমিশে ওনাকে জিতিয়ে এনেছিলাম।

তবে সর্বশেষ ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ছবি নাছিরের মনোনয়ন পুরোপুরি অনিশ্চিত করে দেয় বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। ওই ছবিতে নাছিরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খানের ভাই মামুনুর রশিদ হেলাল ও চাচাতো ভাই আওয়ামী লীগ নেতা আকরাম খানকে দেখা যায়। এই ছবিটি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর তোলপাড় ওঠে। যদিও নাছিরের অনুসারীদের দাবি, ছবিটি এডিট করা।

নগর আওয়ামী লীগের একজন সহ-সভাপতি বলেন, গতবার মনোনয়ন পাওয়ার সময় নাছিরকে দলের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে অনেক বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হয়েছিল। এবার নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে তেমন বিরোধিতা ছিল না। তবে চট্টগ্রামের নেতাদের পাশে পাননি নাছির। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে- তিনি সার্বজনীন নেতা হতে পারেননি। পেশিশক্তি নির্ভর রাজনীতির কারণে তাকে অনেকে ভয় পান। এরপরও মনোনয়নের জোরালো আলোচনায় তিনি ছিলেন। কিন্তু ফেসবুকে ছবিটি কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়ার মতো হয়েছে।