শিক্ষকদের সহযোগিতায় প্যাকেজে বিক্রি হচ্ছে নিষিদ্ধ নোট-গাইড

বন্ধের পথে গরিবের পড়ালেখা চিঠি চালাচালি করেই দায়িত্ব শেষ

সরকারি সব ধরনের নির্দেশনার প্রতি থোড়াইকেয়ার করে অবৈধ নোট-গাইড বই বিক্রিতো হচ্ছেই; তার ওপর এবার প্যাকেজ সিস্টেম চালু করা হয়েছে। কোম্পানিগুলো শিক্ষকদের সহযোগিতায় এই সিস্টেম চালু করেছে। তাই চাইলেও কেউ এখন আর পর্যায়ক্রমে কোন নোট-গাইড কিনতে পারবে না। একই কোম্পানির সব বই একসঙ্গেই কিনতে হবে। অবস্থা এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যাতে গরিব মানুষের সন্তানদের পড়ালেখা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। কারণ শিক্ষকদের পীড়াপিড়ির কারণে নোট-গাইড বই কিনতেই হচ্ছে। সরকারি কোন দফতরের কার্যকরী পদক্ষেপ না থাকায় এই অবস্থা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। ভুক্তভোগীরা অবিলম্বে এই অবস্থার অবসান দাবি করেছেন।

বেশ কয়েক বছর ধরে সরকারিভাবে নোট-গাইড বই পড়ানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এটি কেবলমাত্র কাগুজে নির্দেশনা। কোথাও নোট-গাইড বই পড়ানো বন্ধ হয়নি। যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এই অবস্থা গরিব মানুষের সন্তানদের পড়ালেখায় বাধার সৃষ্টি করছে। অনুসন্ধানে তেমন চিত্রই ওঠে এসেছে।

সরকারিভাবে ন্যাশনাল টেক্সট বুক বোর্ডের নির্ধারিত বইয়ের বাইরে আর কোন বই পড়ানো যাবে না বলে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয় বছর চারেক আগে। কিন্তু সেই নির্দেশনা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। বাস্তবায়ন করা দরকার বলে সরকারি কোন কর্মকর্তারা প্রয়োজনবোধ করছেন না। এ কারণে নোট-গাইড কোম্পানিগুলো রীতিমতো ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করছে। যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এবার সব সীমালংঘন করেছে। কোম্পানিগুলো এ বছর নোট-গাইড বই বিক্রি করছে প্যাকেজ সিস্টেমে। বিগত দিনে শিক্ষকদের চাপাচাপির কারণে গরিব মানুষ তাদের সুবিধা মতো নোট-গাইড বই কিনতে পারতেন। যখন যতটুকু সামর্থ্য সেই অনুযায়ী তারা একটি দুটি করে বই কিনে সন্তানদের দিতেন। কিন্তু সেই পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দিগন্ত, নিউটন, অনুপম, আল-ফাতাহ, পাঞ্জেরী, জননী, সাগরিকাসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি তাদের নোট-গাইড বই প্যাকেজ সিস্টেমে বাজারে ছেড়েছে। প্রত্যেক ক্লাসের সব নোট কিংবা গাইড বই একসঙ্গে বান্ডিল করে (প্যাকেজ) বাজারে ছাড়া হয়েছে। কোম্পানির নির্দেশ অনুযায়ী, বিক্রেতারা ওই বান্ডিল খুলে আলাদা করে কোন বই বিক্রি করছেন না। কেবল নোট-গাইড বইয়ের ক্ষেত্রে যে এটি করা হয়েছে তা না। ব্যাকরণ বইয়ের ক্ষেত্রেও একই কাজ করা হয়েছে। এখন কেউ চাইলেও কেবলমাত্র বাংলা কিংবা ইংরেজি ব্যাকরণ বই কিনতে পারবেন না। কিনতে চাইলে দুটো একসঙ্গে নিতে হবে। সঙ্গে অবাঞ্ছিত সল্যুশনও বাধ্যতামূলকভাবে নিতে হচ্ছে ক্রেতাকে। কেবলমাত্র ব্যাকরণ বই দুটি কিনতে সব মিলিয়ে সাতশ’ থেকে হাজার টাকা লেগে যাচ্ছে। প্যাকেজ সিস্টেমে বই কিনতে না পেরে প্রতিদিন অনেক গরিব ক্রেতাকে ফিরে যেতে হচ্ছে। যশোরের বই বাজারে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। তাই গরিবের লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হয়েছে।

গত শনিবার রফিকুল ইসলাম নামে একজন রিকশাচালক আক্ষেপ করে বলেন, ‘এক ছেলে সেভেনে পড়ে। তার জন্যে একটি বই কিনতে এসেছিলাম। কিন্তু স্কুল থেকে যে বই কিনতে বলেছে তা আলাদা করে বিক্রি করছে না। এ কারণে না কিনে ফিরে যাচ্ছি।’

সালমা ইসলাম নামে একজন ক্ষুব্ধ অভিভাবক বলেন, ‘বিক্রেতারা যতই বলুক তাদের কিছু করার নেই; তারা যদি বিক্রি না করে তাহলে কোম্পানির কী করার আছে। এ কারণে লাইব্রেরিগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারলে নোট-গাইড বই বিক্রি বন্ধ হতে বাধ্য।’

অনুসন্ধানে সম্মিলনী ইনস্টিটিউশন, এমএসটিপি স্কুল, বাদশাহ ফয়সাল ইসলামী ইনস্টিটিউট, আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়, উপশহর বাদশাহ ফয়সাল ইনস্টিটিউট, চুড়ামনকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, খয়েরতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পুলেরহাট হাইস্কুল, পুলেরহাট গার্লস স্কুল, প্রিপারেটরি স্কুলসহ যশোরাঞ্চলের প্রায়সব স্কুলে হাজার হাজার টাকার বিনিময়ে কোন না কোন কোম্পানির গাইড বই চালানো হচ্ছে। এসব স্কুল থেকে যে বুকলিস্ট দেয়া হচ্ছে তাতে স্কুলের কোন নাম থাকছে না। ফলে, অবলীলায় সংশ্লিষ্ট স্কুলের শিক্ষকরা অস্বীকার করতে পারছেন।

সরকার নোট-গাইড বই নিষিদ্ধ করলেও এটি বন্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না কোন দফতরই। কেবলমাত্র চিঠি চালাচালির মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। সর্বশেষ গত ২০ জানুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর থেকে একটি পত্র দেয়া হয়েছে শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে। মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশান উইংয়ের পরিচালক প্রফেসর আমির হোসেন স্বাক্ষরিত ওই পত্রে উল্লেখ রয়েছে, ‘কতিপয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট কারিকুলামের বাইরে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত বই বা নোট বই পড়তে/কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। যা বিধি পরিপন্থী ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এমতাবস্থায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের আওতাধীন তার অঞ্চল/জেলা/উপজেলা/থানার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উল্লিখিত বিধিবহির্ভূত কার্যক্রমসমূহ বন্ধের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।’ পত্রটি যশোর জেলা শিক্ষা অফিসে আসার পর সেটি উপজেলা শিক্ষা অফিসে পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আর উপজেলা শিক্ষা অফিসাররা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের এই পত্রটি বিভিন্ন স্কুলে পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছেন। এ বিষয়ে কথা হয় যশোরের আট উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের সঙ্গে।

সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার কামরুজ্জামান মো. জাহাঙ্গীর হুসাইন মিঞা, ঝিকরগাছার এএসএম জিল্লুর রশীদ, অভয়নগরের শহিদুল ইসলাম ও চৌগাছার আবুল কালাম রফিকুজ্জামান জানান, তারা পত্রটি বিভিন্ন স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এর বাইরে তাদের কিছুই করার নেই বলে জানান। কেশবপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বলে দিয়েছি যাতে নোট-গাইড বই না পড়ানো হয়। তারপরও মাঝে মাঝে গিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে যাচাই করি। কেউ যদি বাড়িতে নোট-গাইড বই কিনে পড়ে সেক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই।’

মণিরামপুরের উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বিকাশ চন্দ্র সরকার জানান, ‘বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তদারকি করা হয় নিষিদ্ধ নোট-গাইড বই পড়ানো হচ্ছে কি না।’ বাঘারপাড়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আকরাম হোসেন খান বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে ইউএনও স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে। আলোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

শিক্ষকরাই অর্থের বিনিময়ে নিষিদ্ধ নোট-গাইড বই শিক্ষার্থীদের কিনতে বাধ্য করছেন। বিনিময়ে কোম্পানিকে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিচ্ছেন। আর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষেত্রে। অবস্থা এমন পর্যায়ে শিক্ষকরা নিয়ে গেছেন যে, গরিবের পড়ালেখা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। এ নিয়ে কথা হয় যশোর শহরের শংকরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এসএম নজরুল ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, ‘বছরের প্রথম দিনে বই বিতরণ সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ। যা সারাবিশ্বে মডেল হয়েছে। তারপরও কিছু কিছু বই বিশেষ করে ব্যাকরণ বই যদি আরও উন্নত করা যায় তাহলে অবৈধ নোট-গাইড বই বন্ধ হবে।’

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (আওয়াল গ্রুপ) যশোর জেলা শাখার সভাপতি সুবোধ চন্দ্র বর্মণের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সমিতির মাধ্যমে এ ধরনের কোন কাজ হচ্ছে না। যে যার ব্যক্তিগতভাবে এটি করছে।’ শিক্ষকরা যেটি করছেন সেটি নৈতিক কি না জানতে চাইলে তিনি পরে কথা বলতে বলে লাইন কেটে দেন।

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির আরেক গ্রুপের যশোর সদর উপজেলার সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম বলেন, ‘আমাদের সমিতি এ ধরনের ব্যবসা উচ্ছেদ করেছে। শিক্ষার্থীরা যদি মনে করে তাহলে কিনবে। এক শ্রেণীর অভিভাবক একাধিক গাইড কেনেন। কোন শিক্ষক করলে গোপনে করেন।’

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি যশোর জেলা শাখার সভাপতি আবুল হাসান সরকার বলেন, ‘বিক্রেতাদের কিছুই করার নেই। উপরের লোকজন এক প্রকার বাধ্য করছে। এ বিষয়ে জসিমের সঙ্গে কথা বলেন।’

যশোর জেলা শিক্ষা অফিসার এএসএম আবদুল খালেক বলেন,‘আমরা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পত্রটি উপজেলায় পাঠিয়ে দিয়েছি।’ বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নেয়া হবে কি না সে বিষয়ে তিনি বলেন,‘ডিসি স্যারের সঙ্গে কথা বলে পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন,‘পত্রটি দেখার পর খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৪ ফল্গুন ১৪২৬, ২২ জমাদিউল সানি ১৪৪১

শিক্ষকদের সহযোগিতায় প্যাকেজে বিক্রি হচ্ছে নিষিদ্ধ নোট-গাইড

বন্ধের পথে গরিবের পড়ালেখা চিঠি চালাচালি করেই দায়িত্ব শেষ

যশোর অফিস

সরকারি সব ধরনের নির্দেশনার প্রতি থোড়াইকেয়ার করে অবৈধ নোট-গাইড বই বিক্রিতো হচ্ছেই; তার ওপর এবার প্যাকেজ সিস্টেম চালু করা হয়েছে। কোম্পানিগুলো শিক্ষকদের সহযোগিতায় এই সিস্টেম চালু করেছে। তাই চাইলেও কেউ এখন আর পর্যায়ক্রমে কোন নোট-গাইড কিনতে পারবে না। একই কোম্পানির সব বই একসঙ্গেই কিনতে হবে। অবস্থা এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যাতে গরিব মানুষের সন্তানদের পড়ালেখা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। কারণ শিক্ষকদের পীড়াপিড়ির কারণে নোট-গাইড বই কিনতেই হচ্ছে। সরকারি কোন দফতরের কার্যকরী পদক্ষেপ না থাকায় এই অবস্থা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। ভুক্তভোগীরা অবিলম্বে এই অবস্থার অবসান দাবি করেছেন।

বেশ কয়েক বছর ধরে সরকারিভাবে নোট-গাইড বই পড়ানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এটি কেবলমাত্র কাগুজে নির্দেশনা। কোথাও নোট-গাইড বই পড়ানো বন্ধ হয়নি। যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এই অবস্থা গরিব মানুষের সন্তানদের পড়ালেখায় বাধার সৃষ্টি করছে। অনুসন্ধানে তেমন চিত্রই ওঠে এসেছে।

সরকারিভাবে ন্যাশনাল টেক্সট বুক বোর্ডের নির্ধারিত বইয়ের বাইরে আর কোন বই পড়ানো যাবে না বলে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয় বছর চারেক আগে। কিন্তু সেই নির্দেশনা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। বাস্তবায়ন করা দরকার বলে সরকারি কোন কর্মকর্তারা প্রয়োজনবোধ করছেন না। এ কারণে নোট-গাইড কোম্পানিগুলো রীতিমতো ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করছে। যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এবার সব সীমালংঘন করেছে। কোম্পানিগুলো এ বছর নোট-গাইড বই বিক্রি করছে প্যাকেজ সিস্টেমে। বিগত দিনে শিক্ষকদের চাপাচাপির কারণে গরিব মানুষ তাদের সুবিধা মতো নোট-গাইড বই কিনতে পারতেন। যখন যতটুকু সামর্থ্য সেই অনুযায়ী তারা একটি দুটি করে বই কিনে সন্তানদের দিতেন। কিন্তু সেই পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দিগন্ত, নিউটন, অনুপম, আল-ফাতাহ, পাঞ্জেরী, জননী, সাগরিকাসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি তাদের নোট-গাইড বই প্যাকেজ সিস্টেমে বাজারে ছেড়েছে। প্রত্যেক ক্লাসের সব নোট কিংবা গাইড বই একসঙ্গে বান্ডিল করে (প্যাকেজ) বাজারে ছাড়া হয়েছে। কোম্পানির নির্দেশ অনুযায়ী, বিক্রেতারা ওই বান্ডিল খুলে আলাদা করে কোন বই বিক্রি করছেন না। কেবল নোট-গাইড বইয়ের ক্ষেত্রে যে এটি করা হয়েছে তা না। ব্যাকরণ বইয়ের ক্ষেত্রেও একই কাজ করা হয়েছে। এখন কেউ চাইলেও কেবলমাত্র বাংলা কিংবা ইংরেজি ব্যাকরণ বই কিনতে পারবেন না। কিনতে চাইলে দুটো একসঙ্গে নিতে হবে। সঙ্গে অবাঞ্ছিত সল্যুশনও বাধ্যতামূলকভাবে নিতে হচ্ছে ক্রেতাকে। কেবলমাত্র ব্যাকরণ বই দুটি কিনতে সব মিলিয়ে সাতশ’ থেকে হাজার টাকা লেগে যাচ্ছে। প্যাকেজ সিস্টেমে বই কিনতে না পেরে প্রতিদিন অনেক গরিব ক্রেতাকে ফিরে যেতে হচ্ছে। যশোরের বই বাজারে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। তাই গরিবের লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হয়েছে।

গত শনিবার রফিকুল ইসলাম নামে একজন রিকশাচালক আক্ষেপ করে বলেন, ‘এক ছেলে সেভেনে পড়ে। তার জন্যে একটি বই কিনতে এসেছিলাম। কিন্তু স্কুল থেকে যে বই কিনতে বলেছে তা আলাদা করে বিক্রি করছে না। এ কারণে না কিনে ফিরে যাচ্ছি।’

সালমা ইসলাম নামে একজন ক্ষুব্ধ অভিভাবক বলেন, ‘বিক্রেতারা যতই বলুক তাদের কিছু করার নেই; তারা যদি বিক্রি না করে তাহলে কোম্পানির কী করার আছে। এ কারণে লাইব্রেরিগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারলে নোট-গাইড বই বিক্রি বন্ধ হতে বাধ্য।’

অনুসন্ধানে সম্মিলনী ইনস্টিটিউশন, এমএসটিপি স্কুল, বাদশাহ ফয়সাল ইসলামী ইনস্টিটিউট, আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়, উপশহর বাদশাহ ফয়সাল ইনস্টিটিউট, চুড়ামনকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, খয়েরতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পুলেরহাট হাইস্কুল, পুলেরহাট গার্লস স্কুল, প্রিপারেটরি স্কুলসহ যশোরাঞ্চলের প্রায়সব স্কুলে হাজার হাজার টাকার বিনিময়ে কোন না কোন কোম্পানির গাইড বই চালানো হচ্ছে। এসব স্কুল থেকে যে বুকলিস্ট দেয়া হচ্ছে তাতে স্কুলের কোন নাম থাকছে না। ফলে, অবলীলায় সংশ্লিষ্ট স্কুলের শিক্ষকরা অস্বীকার করতে পারছেন।

সরকার নোট-গাইড বই নিষিদ্ধ করলেও এটি বন্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না কোন দফতরই। কেবলমাত্র চিঠি চালাচালির মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। সর্বশেষ গত ২০ জানুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর থেকে একটি পত্র দেয়া হয়েছে শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে। মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশান উইংয়ের পরিচালক প্রফেসর আমির হোসেন স্বাক্ষরিত ওই পত্রে উল্লেখ রয়েছে, ‘কতিপয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট কারিকুলামের বাইরে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত বই বা নোট বই পড়তে/কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। যা বিধি পরিপন্থী ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এমতাবস্থায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের আওতাধীন তার অঞ্চল/জেলা/উপজেলা/থানার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উল্লিখিত বিধিবহির্ভূত কার্যক্রমসমূহ বন্ধের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।’ পত্রটি যশোর জেলা শিক্ষা অফিসে আসার পর সেটি উপজেলা শিক্ষা অফিসে পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আর উপজেলা শিক্ষা অফিসাররা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের এই পত্রটি বিভিন্ন স্কুলে পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছেন। এ বিষয়ে কথা হয় যশোরের আট উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের সঙ্গে।

সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার কামরুজ্জামান মো. জাহাঙ্গীর হুসাইন মিঞা, ঝিকরগাছার এএসএম জিল্লুর রশীদ, অভয়নগরের শহিদুল ইসলাম ও চৌগাছার আবুল কালাম রফিকুজ্জামান জানান, তারা পত্রটি বিভিন্ন স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এর বাইরে তাদের কিছুই করার নেই বলে জানান। কেশবপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বলে দিয়েছি যাতে নোট-গাইড বই না পড়ানো হয়। তারপরও মাঝে মাঝে গিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে যাচাই করি। কেউ যদি বাড়িতে নোট-গাইড বই কিনে পড়ে সেক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই।’

মণিরামপুরের উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বিকাশ চন্দ্র সরকার জানান, ‘বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তদারকি করা হয় নিষিদ্ধ নোট-গাইড বই পড়ানো হচ্ছে কি না।’ বাঘারপাড়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আকরাম হোসেন খান বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে ইউএনও স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে। আলোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

শিক্ষকরাই অর্থের বিনিময়ে নিষিদ্ধ নোট-গাইড বই শিক্ষার্থীদের কিনতে বাধ্য করছেন। বিনিময়ে কোম্পানিকে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিচ্ছেন। আর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষেত্রে। অবস্থা এমন পর্যায়ে শিক্ষকরা নিয়ে গেছেন যে, গরিবের পড়ালেখা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। এ নিয়ে কথা হয় যশোর শহরের শংকরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এসএম নজরুল ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, ‘বছরের প্রথম দিনে বই বিতরণ সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ। যা সারাবিশ্বে মডেল হয়েছে। তারপরও কিছু কিছু বই বিশেষ করে ব্যাকরণ বই যদি আরও উন্নত করা যায় তাহলে অবৈধ নোট-গাইড বই বন্ধ হবে।’

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (আওয়াল গ্রুপ) যশোর জেলা শাখার সভাপতি সুবোধ চন্দ্র বর্মণের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সমিতির মাধ্যমে এ ধরনের কোন কাজ হচ্ছে না। যে যার ব্যক্তিগতভাবে এটি করছে।’ শিক্ষকরা যেটি করছেন সেটি নৈতিক কি না জানতে চাইলে তিনি পরে কথা বলতে বলে লাইন কেটে দেন।

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির আরেক গ্রুপের যশোর সদর উপজেলার সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম বলেন, ‘আমাদের সমিতি এ ধরনের ব্যবসা উচ্ছেদ করেছে। শিক্ষার্থীরা যদি মনে করে তাহলে কিনবে। এক শ্রেণীর অভিভাবক একাধিক গাইড কেনেন। কোন শিক্ষক করলে গোপনে করেন।’

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি যশোর জেলা শাখার সভাপতি আবুল হাসান সরকার বলেন, ‘বিক্রেতাদের কিছুই করার নেই। উপরের লোকজন এক প্রকার বাধ্য করছে। এ বিষয়ে জসিমের সঙ্গে কথা বলেন।’

যশোর জেলা শিক্ষা অফিসার এএসএম আবদুল খালেক বলেন,‘আমরা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পত্রটি উপজেলায় পাঠিয়ে দিয়েছি।’ বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নেয়া হবে কি না সে বিষয়ে তিনি বলেন,‘ডিসি স্যারের সঙ্গে কথা বলে পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন,‘পত্রটি দেখার পর খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’