লাউয়াছড়া-১

বন নয়, বাঁশ বাগান

[মিশ্র চিরসবুজ বন লাউয়াছড়া মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জে অবস্থিত। চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গলের নিকটবর্র্তী এই বর্ষারণ্য বিরল প্রজাতির উল্লুক গিবনের যেমন বিচরণ ক্ষেত্র তেমনি নানা জাতের বৃক্ষগুল্ম আর জীব-অণুজীবেরও আবাসস্থল। ‘সংবাদ’এর নিজস্ব বার্তা পরিবেশক ঘুরে এসে জানাচ্ছেন লাউয়াছড়ার বর্তমান অবস্থা। তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব প্রকাশিত হলো আজ।]

বনে ঢোকার মুখে গোড়ায় চুন দিয়ে যত্নে রাখা বেশ কিছু বিদেশি বড় গাছ, ঘন ঝোঁপঝাড়, আকাশ ঢেকে দেয়া জাঁই বাঁশের ¯স্নিগ্ধ রূপ আর বেপরোয়া কিছু দেশি গাছের বিস্তার দেখে লাউয়াছড়া বনকে একটি মিশ্র চিরসবুজ বন বলেই মনে হবে। গাছে গাছে বানর, উল্লুক আর কাঠবিড়ালির লাফ-ঝাঁপ দেখে, ঘুঘুর গম্ভীর ডাক, আশপাশের লোকালয়ে হানা দিয়ে হাঁস আর ছাগল গিলে খাওয়া অজগরের গল্প শুনে মনে হবে লাউয়াছড়া বন্যপ্রাণীর একটি আদর্শ অভয়ারণ্য। শুধু সাহস করে বনটির খানিকটা গভীরে প্রবেশ করলেই বোঝা যাবে লাউয়াছড়া এখন আর মিশ্র চিরসবুজ বনও নয়, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যও নয়, শত বছরের অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন বুকে নিয়ে লাউয়াছড়া এখন একটি বাঁশ বাগান। টানা দুই দিন লাউয়াছড়া বনে ঘোরাঘুরি করে দেখা গেছে বনের পশ্চিম ও দক্ষিণাংশে অরণ্যের উপস্থিতি আছে ঠিকই, পূর্ব দিকটায়ও আছে কিছু বৃক্ষ; কিন্তু উত্তর দিক প্রায় পুরোটাই ফাঁকা। দ্রুত বাড়ে এমন কিছু গাছ আর বাঁশ লাগিয়ে ঝোপঝাড় তৈরি করে শূন্যতা ঢাকার দুর্বল প্রয়াস আছে সর্বত্র।

স্থানীয় বনজীবী এবং বন নিয়ে ভাবেন এমন মানুষেরা জানান, লাউয়াছড়া বনে এখন আর আগের মতো গাছ চুরি হয় না। কারণ চুরি করার মতো বড় গাছ এখন আর লাউয়াছড়ায় নেই। ঘন অরণ্য নেই বলে বানর আর উল্লুকেরা খাদ্যের সন্ধানে বনে ঢুকবার মুখটায় আর খাসিয়া পুঞ্জিসংলগ্ন জুমেই বেশি বিচরণ করে, অজগররা হানা দেয় লোকালয়ে। অথচ এক সময় এই বনটির চেহারা ছিল একদম অন্যরকম। স্থানীয়দের বয়ানে সেই অন্যরকম বনের চিত্রও উঠে আসে। গাছের কথা বলতেই একজন প্রবচন শোনানোর মতো করে বললেন- বারো রাতা, তেরো জাম। খুদি জাম, কালো জাম, বড়পাতি জাম, গোলাপ জাম- স্মৃতি হাতরে কেউ কেউ বলতে থাকেন তেরো জাতের জাম গাছের নাম। এ রকম রাতা বা লালি গাছও ছিল নাকি বারো জাতের। চিকরাশি গাছ দিয়ে হতো ঘরের দরোজা, রাঙ্গি গাছের কাঠ দিয়ে হতো ঘরের পাটাতন, নৌকা। ঘরের চৌকাঠ, মারুইল আর রোয়া হতো আওয়াল গাছের কাঠ দিয়ে। আওয়াল গাছও ছিল দু’রকম, সাদা আর লাল আওয়াল। কাঁচা থাকতেই পেরেক বসানো লাগত, শুকিয়ে গেলে হাতুরির শত পিটাপিটিতেও লোহার পেরেক আর ঢোকানো যেতোনা আওয়ালের গায়ে, এমন শক্ত। বাঁশের কি বাহারি নাম- কালি, মৃত্তিঙ্গা। মসকন, জারুল, পাইখ্যারা, ডুমুর, কালাওঝা গাছে থাকতো পাখিরা। চ্যাংপিসলা গাছের ছাল দিয়ে হতো নাকি আমাশয় রোগের ওষুধ। লাউয়াছড়ার শনখোলায় গরু চরাতে এসে পিস্টি, পিঠালি, লটকন, ডেউয়া, চাম কাঁঠাল, কাউ, বনবড়ই খেতো লছমি নারায়ণ সোনারুর মতো পাশর্^বর্তী গ্রামের আরো অনেকে। কুমড়ি ফল ছিল হরিণের খাবার আর কুমড়ির পাতা দিয়ে বিড়ি বানিয়ে টানত সে যুগের মানুষেরা। চিনি বট, ময়না বটের নাম শোনান লাউয়াছড়া খাসিয়াপুঞ্জির বাসিন্দা হাতেম আলী লন্ড। বলেন, ‘আমলকি, হরতকি, বয়রার গাছ আছিল বেজান। কতো কবিরাজ, কত ওষুধ কোম্পানির লোক আইতো লতাপাতা, ফলমূল নেয়ার লেইগা, অখন কেউ আয়না’। প্রয়াত লছমন মুন্ডার মেয়ে মিনতি মুন্ডা জানান ‘আমার বাবায়তো বাঘের দুধও খাইছে’। সত্যি সত্যি প্রয়াত লছমন মুন্ডা বাঘের দুধ খেয়েছিল কিনা তার প্রমাণ হাজির করা কঠিন হলেও লাউয়াছড়ায় যে এক সময় বাঘ ছিল তার সাক্ষ্য দিচ্ছে লাউয়াছড়ার পরিদর্শক মন্তব্য বইয়ে ১৯৫৫ সালে লেখা সিলেটের জেলা প্রশাসকের একটি মন্তব্য। জেলা প্রশাসক সেই মন্তব্যে জেনারেল ভ্যান ফ্লিট নামের একজন ব্রিটিশকে বাঘ শিকারে সহযোগিতা করার জন্য তৎকালীন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও তার সহযোগীদের সাধুবাদ জানান।

এমন সমৃদ্ধ একটি বনভূমির আজ এই করুণ হাল কেন- তার উত্তর শুধু স্থানীয়দের বয়ানে নয়, আছে ইতিহাসের পাতায়ও। নানান জাতের দেশি গাছ, পাখপাখালি, জীব-অনুজীব আর বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণে প্রকৃতির আপন নিয়মে বনভূমির যে বাস্তুসংস্থান গড়ে ওঠে তার উপর প্রথম আঘাত আসে ১৯২০ সালে। প্রাকৃতিক বন উজার করে বনায়ন শুরু করে ইংরেজরা। তাদের আসবাবপত্রের জন্য প্রয়োজন ছিল সেগুন, জাহাজের জন্য প্রয়োজন ছিল লোহা কাঠ। সেগুন আর লোহা গাছে ভরে ফেললো পুরো বন। পেপার মিলের জন্য লাগালো জাঁই বাঁশ আর মালাখান। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এই ধ্বংসযজ্ঞ চলার পরও দেশি গাছকে হঠানো গেলোনা। মানুষের হাতের স্পর্শ ছাড়াই পাখিদের আয়োজনে নতুন লাগানো বিদেশি গাছের ফাঁকেফোকরে গজিয়ে উঠতে থাকে আওয়াল, রাঙ্গি, জারুল, চিকরাশির মতো অপ্রতিরোধ্য দেশি গাছ। প্রাকৃতিক বনের পরিচয় মুছে গেল। দেশি-বিদেশি গাছের সহাবস্থানের জন্য মিশ্র চিরহরিৎ বন বলে পরিচিতি পেলো লাউয়াছড়া। কিন্তু ধ্বংসযজ্ঞ থামেনি পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ আমলেও। সংঘবদ্ধ গাছ লোপাটে বন যখন প্রায় উজার ১৯৯৬ সালে ২৭৮০ হেক্টর আয়তনের লাউয়াছড়া বনাঞ্চলের ১২৫০ হেক্টর এলাকাকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণের বনটিতে তখন থেকে অবাধ বিচরণ শুরু হয় পর্যটকদের। মাইক বাজিয়ে শত শত মানুষের পিকনিক করা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে ওঠে। জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে ‘জোরে শব্দ করে বা উচ্চস্বরে মাইক বাজাবেন না’ লিখে কর্তারা তাদের দায়িত্ব সেরেছেন। ধ্বংসের ষোলকলা পূর্ণ করে মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টালের তত্ত্বাবধানে ১৯৯৭ সালের ১৪ই জুনে ঘটা মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্র বিস্ফোরণ। বিস্ফোরনের আগুনে পুরো বন ঝলসে কয়লা হওয়ার ঘটনাটিকে গবেষক পাভেল পার্থ ‘পরিবেশ গণহত্যা’ বলে অবিহিত করেন। ২০০৬ সালে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানকে বনবিভাগের ওয়াইল্ড লাইফ ডিভিশনের ব্যবস্থাপনায় আনা হলেও অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি বলে জানান ‘লাউয়াছড়া বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা আন্দোলনের’ নেতারা। সংগঠনটির সদস্য সচিব অ্যাডভেকেট মো. আবুল হাসান জানান লাউয়াছড়া বনে যে তিন ঘণ্টার চিহ্নিত পায়ে হাটার পথ আছে ওই পথে হাঁটলেই কেটে নেয়া গাছের অসংখ্য গোড়া দেখতে পাবেন। সংগঠনের যুগ্ম সদস্য সচিব প্রিতম দাশ ও একজন খাসিয়া তরুণকে নিয়ে এই প্রতিবেদকও বনের ভেতরে প্রবেশ করে। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরই বেশকিছু বড় আকারের লোহা গাছ চোখে আটকায়। এই গাছগুলো এখনো লোপাট না হওয়া প্রসঙ্গে খাসিয়া তরুণ জানান সেগুন বা অন্য গাছের মতো সহজে লোহা গাছ কেটে নেয়া যায় না। এক তো ওজন বেশি, অন্যদিকে একাধিক করাত ও অধিক লোকের প্রয়োজন হয়। খুব বেশি ভেতরে নয় বলে এইসব গাছ কাটা ও ফেলার আওয়াজ এতো বেশি হবে যে এই চুরি গোপনে করা সম্ভব হবে না। আরও খানিকটা গভীরে গেলে এমন গাছ আর চোখে পড়বে না বলে জানান। আরও খানিকটা গহীনে যাওয়ার পর লোহা গাছ তেমন চোখে না পড়লেও আরও দু’ধরনের বড় গাছের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই গাছ দুটো সম্পর্কে ঐ খাসিয়া তরুণ জানান, একটির নাম চাম কাঁঠাল অন্যটির নাম বলচ। বলছ গাছ গায়-গতরে বড় হয় ঠিকই কিন্তু ভেতরটা নরম বলে এই গাছের বিক্রয় মূল্য নেই। চাম কাঁঠালের বিক্রয়মূল্য থাকলেও এই গাছগুলো নতুন লাগানো বিধায় ভেতরে শুধুই পল, এখনও সার হয়নি বলে কেটে বাণিজ্যিকভাবে সুবিধা করা যাবে না। আরও ভেতরে যাওয়ার পর দেখা গেলো মাথার ওপরে গহন-গহীন বনের ছায়া তো দূরের কথা, সূর্যমনি আলো করে রেখেছে চারদিক। শুধু পথের দুপাশে লাগানো চিকন চিকন কিছু কনকইর বাঁশ নিতান্ত নিরিহ ভঙ্গিতে নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁশের ফাঁকফোকর দিয়ে বেশ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছিল অতীতে কেটে নেয়া বড় বড় গাছের গোড়াগুলোকে।

বনের প্রায় অর্ধেক জায়গায় গাছ নেই এবং বনের প্রায় এক দশমাংশ ভূমি আছে প্রভাবশালীদের দখলে- এমন কথাও জানান স্থানীয়দের কেউ কেউ। যদিও স্থানীয়দের করা এইসব অভিযোগ মানতে নারাজ এই বনের তত্ত্বাবধানে থাকা বনবিভাগের ওয়াইল্ডলাইফ ডিভিশনের দুই কর্মকর্তা। লাউয়াছড়া বীট কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন ক্ষিপ্ত গলায় বলেন, লাউয়াছড়ার এক ইঞ্চি ভূমিও কারো দখলে নাই, এইসব অভিযোগ যারা করে তাদের ঘাড়ের কাপড় সরালে চুরি করা গাছ বহনের দাগ দেখা যাবে। তবে রেঞ্জ কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেন সরাসরি স্বীকার কিংবা অস্বীকার কোনটাই না করে বলেন, বন্যপ্রাণীর খাদ্যসংকট দূর করতে সুফল প্রজেক্টের আওতায় আমরা ৫০ হেক্টর জায়গায় নতুন করে ফলজগাছের বনায়ন শুরু করেছি। বালিগাঁও, লঙ্গুরপাড়, মোকামটিলা, রাশটিলা, বাঘমারা, সরইবাড়ি ও ডলুবাড়িতে প্রভাবশালীদের দখলে থাকা বনের ভূমি প্রসঙ্গে বলেন, জাতীয় উদ্যানের ইকো ট্যুরিজম উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ হয়ে গেলেই সীমানা জরিপ করতে টাস্কফোর্স হবে, তখন আর এই সমস্যা থাকবে না। বনকে আগের মতো প্রাকৃতিক বনে রূপান্তর না করে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত রেখে কি বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য করা সম্ভব- এমন প্রশ্নের জবাবে জনাব মোনায়েম জানান, এই বন কখনও প্রাকৃতিক বন ছিল না, এই বন মানুষের বনায়নে তৈরি, এই বন বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য না, এই বন জাতীয় উদ্যান। পর্যটক আসায় আগের বছর ৬৮ লাখ টাকা রেভিনিউ পেয়েছে সরকার, পর্যটকদের জন্য এই বন উন্মুক্তই থাকবে।

image
আরও খবর
৯ লাখ ২৬ হাজার শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেলেও প্রশ্ন নোট-গাইড থেকে
খালেদার প্যারোলে মুক্তির সিদ্ধান্ত আদালতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত করতে সহযোগিতা জরুরি
সরকারি চিকিৎসকদের বাইরে প্র্যাকটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে : প্রধানমন্ত্রী
এখন নারীরাও ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিতে পারবেন সুপ্রিম কোর্ট
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ৮৩তম জন্মবার্ষিকী আজ
কীভাবে মেট্রোরেলে চড়বেন তথ্য দিতে ঢাকায় মকআপ ট্রেন
গ্যাস বিস্ফোরণে নিহত ১, দগ্ধ ৭
ক্ষণগণনা : আর ২৭ দিন
আ-মরি বাংলা ভাষা
মোবাইল টাওয়ারের বিকিরণে ক্ষতির কিছু পাওয়া যায়নি বিটিআরসি
ভোলায় বিশ দিনে ৫ ধর্ষণ
কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার চেয়ে বন্দীর সংখ্যা দ্বিগুণ
বন নয়, বাঁশ বাগান

মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৫ ফল্গুন ১৪২৬, ২৩ জমাদিউল সানি ১৪৪১

লাউয়াছড়া-১

বন নয়, বাঁশ বাগান

কাজী শাহীদুল ইসলাম, মৌলভীবাজার থেকে ফিরে

image

[মিশ্র চিরসবুজ বন লাউয়াছড়া মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জে অবস্থিত। চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গলের নিকটবর্র্তী এই বর্ষারণ্য বিরল প্রজাতির উল্লুক গিবনের যেমন বিচরণ ক্ষেত্র তেমনি নানা জাতের বৃক্ষগুল্ম আর জীব-অণুজীবেরও আবাসস্থল। ‘সংবাদ’এর নিজস্ব বার্তা পরিবেশক ঘুরে এসে জানাচ্ছেন লাউয়াছড়ার বর্তমান অবস্থা। তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব প্রকাশিত হলো আজ।]

বনে ঢোকার মুখে গোড়ায় চুন দিয়ে যত্নে রাখা বেশ কিছু বিদেশি বড় গাছ, ঘন ঝোঁপঝাড়, আকাশ ঢেকে দেয়া জাঁই বাঁশের ¯স্নিগ্ধ রূপ আর বেপরোয়া কিছু দেশি গাছের বিস্তার দেখে লাউয়াছড়া বনকে একটি মিশ্র চিরসবুজ বন বলেই মনে হবে। গাছে গাছে বানর, উল্লুক আর কাঠবিড়ালির লাফ-ঝাঁপ দেখে, ঘুঘুর গম্ভীর ডাক, আশপাশের লোকালয়ে হানা দিয়ে হাঁস আর ছাগল গিলে খাওয়া অজগরের গল্প শুনে মনে হবে লাউয়াছড়া বন্যপ্রাণীর একটি আদর্শ অভয়ারণ্য। শুধু সাহস করে বনটির খানিকটা গভীরে প্রবেশ করলেই বোঝা যাবে লাউয়াছড়া এখন আর মিশ্র চিরসবুজ বনও নয়, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যও নয়, শত বছরের অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন বুকে নিয়ে লাউয়াছড়া এখন একটি বাঁশ বাগান। টানা দুই দিন লাউয়াছড়া বনে ঘোরাঘুরি করে দেখা গেছে বনের পশ্চিম ও দক্ষিণাংশে অরণ্যের উপস্থিতি আছে ঠিকই, পূর্ব দিকটায়ও আছে কিছু বৃক্ষ; কিন্তু উত্তর দিক প্রায় পুরোটাই ফাঁকা। দ্রুত বাড়ে এমন কিছু গাছ আর বাঁশ লাগিয়ে ঝোপঝাড় তৈরি করে শূন্যতা ঢাকার দুর্বল প্রয়াস আছে সর্বত্র।

স্থানীয় বনজীবী এবং বন নিয়ে ভাবেন এমন মানুষেরা জানান, লাউয়াছড়া বনে এখন আর আগের মতো গাছ চুরি হয় না। কারণ চুরি করার মতো বড় গাছ এখন আর লাউয়াছড়ায় নেই। ঘন অরণ্য নেই বলে বানর আর উল্লুকেরা খাদ্যের সন্ধানে বনে ঢুকবার মুখটায় আর খাসিয়া পুঞ্জিসংলগ্ন জুমেই বেশি বিচরণ করে, অজগররা হানা দেয় লোকালয়ে। অথচ এক সময় এই বনটির চেহারা ছিল একদম অন্যরকম। স্থানীয়দের বয়ানে সেই অন্যরকম বনের চিত্রও উঠে আসে। গাছের কথা বলতেই একজন প্রবচন শোনানোর মতো করে বললেন- বারো রাতা, তেরো জাম। খুদি জাম, কালো জাম, বড়পাতি জাম, গোলাপ জাম- স্মৃতি হাতরে কেউ কেউ বলতে থাকেন তেরো জাতের জাম গাছের নাম। এ রকম রাতা বা লালি গাছও ছিল নাকি বারো জাতের। চিকরাশি গাছ দিয়ে হতো ঘরের দরোজা, রাঙ্গি গাছের কাঠ দিয়ে হতো ঘরের পাটাতন, নৌকা। ঘরের চৌকাঠ, মারুইল আর রোয়া হতো আওয়াল গাছের কাঠ দিয়ে। আওয়াল গাছও ছিল দু’রকম, সাদা আর লাল আওয়াল। কাঁচা থাকতেই পেরেক বসানো লাগত, শুকিয়ে গেলে হাতুরির শত পিটাপিটিতেও লোহার পেরেক আর ঢোকানো যেতোনা আওয়ালের গায়ে, এমন শক্ত। বাঁশের কি বাহারি নাম- কালি, মৃত্তিঙ্গা। মসকন, জারুল, পাইখ্যারা, ডুমুর, কালাওঝা গাছে থাকতো পাখিরা। চ্যাংপিসলা গাছের ছাল দিয়ে হতো নাকি আমাশয় রোগের ওষুধ। লাউয়াছড়ার শনখোলায় গরু চরাতে এসে পিস্টি, পিঠালি, লটকন, ডেউয়া, চাম কাঁঠাল, কাউ, বনবড়ই খেতো লছমি নারায়ণ সোনারুর মতো পাশর্^বর্তী গ্রামের আরো অনেকে। কুমড়ি ফল ছিল হরিণের খাবার আর কুমড়ির পাতা দিয়ে বিড়ি বানিয়ে টানত সে যুগের মানুষেরা। চিনি বট, ময়না বটের নাম শোনান লাউয়াছড়া খাসিয়াপুঞ্জির বাসিন্দা হাতেম আলী লন্ড। বলেন, ‘আমলকি, হরতকি, বয়রার গাছ আছিল বেজান। কতো কবিরাজ, কত ওষুধ কোম্পানির লোক আইতো লতাপাতা, ফলমূল নেয়ার লেইগা, অখন কেউ আয়না’। প্রয়াত লছমন মুন্ডার মেয়ে মিনতি মুন্ডা জানান ‘আমার বাবায়তো বাঘের দুধও খাইছে’। সত্যি সত্যি প্রয়াত লছমন মুন্ডা বাঘের দুধ খেয়েছিল কিনা তার প্রমাণ হাজির করা কঠিন হলেও লাউয়াছড়ায় যে এক সময় বাঘ ছিল তার সাক্ষ্য দিচ্ছে লাউয়াছড়ার পরিদর্শক মন্তব্য বইয়ে ১৯৫৫ সালে লেখা সিলেটের জেলা প্রশাসকের একটি মন্তব্য। জেলা প্রশাসক সেই মন্তব্যে জেনারেল ভ্যান ফ্লিট নামের একজন ব্রিটিশকে বাঘ শিকারে সহযোগিতা করার জন্য তৎকালীন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও তার সহযোগীদের সাধুবাদ জানান।

এমন সমৃদ্ধ একটি বনভূমির আজ এই করুণ হাল কেন- তার উত্তর শুধু স্থানীয়দের বয়ানে নয়, আছে ইতিহাসের পাতায়ও। নানান জাতের দেশি গাছ, পাখপাখালি, জীব-অনুজীব আর বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণে প্রকৃতির আপন নিয়মে বনভূমির যে বাস্তুসংস্থান গড়ে ওঠে তার উপর প্রথম আঘাত আসে ১৯২০ সালে। প্রাকৃতিক বন উজার করে বনায়ন শুরু করে ইংরেজরা। তাদের আসবাবপত্রের জন্য প্রয়োজন ছিল সেগুন, জাহাজের জন্য প্রয়োজন ছিল লোহা কাঠ। সেগুন আর লোহা গাছে ভরে ফেললো পুরো বন। পেপার মিলের জন্য লাগালো জাঁই বাঁশ আর মালাখান। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এই ধ্বংসযজ্ঞ চলার পরও দেশি গাছকে হঠানো গেলোনা। মানুষের হাতের স্পর্শ ছাড়াই পাখিদের আয়োজনে নতুন লাগানো বিদেশি গাছের ফাঁকেফোকরে গজিয়ে উঠতে থাকে আওয়াল, রাঙ্গি, জারুল, চিকরাশির মতো অপ্রতিরোধ্য দেশি গাছ। প্রাকৃতিক বনের পরিচয় মুছে গেল। দেশি-বিদেশি গাছের সহাবস্থানের জন্য মিশ্র চিরহরিৎ বন বলে পরিচিতি পেলো লাউয়াছড়া। কিন্তু ধ্বংসযজ্ঞ থামেনি পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ আমলেও। সংঘবদ্ধ গাছ লোপাটে বন যখন প্রায় উজার ১৯৯৬ সালে ২৭৮০ হেক্টর আয়তনের লাউয়াছড়া বনাঞ্চলের ১২৫০ হেক্টর এলাকাকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণের বনটিতে তখন থেকে অবাধ বিচরণ শুরু হয় পর্যটকদের। মাইক বাজিয়ে শত শত মানুষের পিকনিক করা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে ওঠে। জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে ‘জোরে শব্দ করে বা উচ্চস্বরে মাইক বাজাবেন না’ লিখে কর্তারা তাদের দায়িত্ব সেরেছেন। ধ্বংসের ষোলকলা পূর্ণ করে মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টালের তত্ত্বাবধানে ১৯৯৭ সালের ১৪ই জুনে ঘটা মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্র বিস্ফোরণ। বিস্ফোরনের আগুনে পুরো বন ঝলসে কয়লা হওয়ার ঘটনাটিকে গবেষক পাভেল পার্থ ‘পরিবেশ গণহত্যা’ বলে অবিহিত করেন। ২০০৬ সালে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানকে বনবিভাগের ওয়াইল্ড লাইফ ডিভিশনের ব্যবস্থাপনায় আনা হলেও অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি বলে জানান ‘লাউয়াছড়া বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা আন্দোলনের’ নেতারা। সংগঠনটির সদস্য সচিব অ্যাডভেকেট মো. আবুল হাসান জানান লাউয়াছড়া বনে যে তিন ঘণ্টার চিহ্নিত পায়ে হাটার পথ আছে ওই পথে হাঁটলেই কেটে নেয়া গাছের অসংখ্য গোড়া দেখতে পাবেন। সংগঠনের যুগ্ম সদস্য সচিব প্রিতম দাশ ও একজন খাসিয়া তরুণকে নিয়ে এই প্রতিবেদকও বনের ভেতরে প্রবেশ করে। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরই বেশকিছু বড় আকারের লোহা গাছ চোখে আটকায়। এই গাছগুলো এখনো লোপাট না হওয়া প্রসঙ্গে খাসিয়া তরুণ জানান সেগুন বা অন্য গাছের মতো সহজে লোহা গাছ কেটে নেয়া যায় না। এক তো ওজন বেশি, অন্যদিকে একাধিক করাত ও অধিক লোকের প্রয়োজন হয়। খুব বেশি ভেতরে নয় বলে এইসব গাছ কাটা ও ফেলার আওয়াজ এতো বেশি হবে যে এই চুরি গোপনে করা সম্ভব হবে না। আরও খানিকটা গভীরে গেলে এমন গাছ আর চোখে পড়বে না বলে জানান। আরও খানিকটা গহীনে যাওয়ার পর লোহা গাছ তেমন চোখে না পড়লেও আরও দু’ধরনের বড় গাছের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই গাছ দুটো সম্পর্কে ঐ খাসিয়া তরুণ জানান, একটির নাম চাম কাঁঠাল অন্যটির নাম বলচ। বলছ গাছ গায়-গতরে বড় হয় ঠিকই কিন্তু ভেতরটা নরম বলে এই গাছের বিক্রয় মূল্য নেই। চাম কাঁঠালের বিক্রয়মূল্য থাকলেও এই গাছগুলো নতুন লাগানো বিধায় ভেতরে শুধুই পল, এখনও সার হয়নি বলে কেটে বাণিজ্যিকভাবে সুবিধা করা যাবে না। আরও ভেতরে যাওয়ার পর দেখা গেলো মাথার ওপরে গহন-গহীন বনের ছায়া তো দূরের কথা, সূর্যমনি আলো করে রেখেছে চারদিক। শুধু পথের দুপাশে লাগানো চিকন চিকন কিছু কনকইর বাঁশ নিতান্ত নিরিহ ভঙ্গিতে নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁশের ফাঁকফোকর দিয়ে বেশ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছিল অতীতে কেটে নেয়া বড় বড় গাছের গোড়াগুলোকে।

বনের প্রায় অর্ধেক জায়গায় গাছ নেই এবং বনের প্রায় এক দশমাংশ ভূমি আছে প্রভাবশালীদের দখলে- এমন কথাও জানান স্থানীয়দের কেউ কেউ। যদিও স্থানীয়দের করা এইসব অভিযোগ মানতে নারাজ এই বনের তত্ত্বাবধানে থাকা বনবিভাগের ওয়াইল্ডলাইফ ডিভিশনের দুই কর্মকর্তা। লাউয়াছড়া বীট কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন ক্ষিপ্ত গলায় বলেন, লাউয়াছড়ার এক ইঞ্চি ভূমিও কারো দখলে নাই, এইসব অভিযোগ যারা করে তাদের ঘাড়ের কাপড় সরালে চুরি করা গাছ বহনের দাগ দেখা যাবে। তবে রেঞ্জ কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেন সরাসরি স্বীকার কিংবা অস্বীকার কোনটাই না করে বলেন, বন্যপ্রাণীর খাদ্যসংকট দূর করতে সুফল প্রজেক্টের আওতায় আমরা ৫০ হেক্টর জায়গায় নতুন করে ফলজগাছের বনায়ন শুরু করেছি। বালিগাঁও, লঙ্গুরপাড়, মোকামটিলা, রাশটিলা, বাঘমারা, সরইবাড়ি ও ডলুবাড়িতে প্রভাবশালীদের দখলে থাকা বনের ভূমি প্রসঙ্গে বলেন, জাতীয় উদ্যানের ইকো ট্যুরিজম উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ হয়ে গেলেই সীমানা জরিপ করতে টাস্কফোর্স হবে, তখন আর এই সমস্যা থাকবে না। বনকে আগের মতো প্রাকৃতিক বনে রূপান্তর না করে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত রেখে কি বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য করা সম্ভব- এমন প্রশ্নের জবাবে জনাব মোনায়েম জানান, এই বন কখনও প্রাকৃতিক বন ছিল না, এই বন মানুষের বনায়নে তৈরি, এই বন বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য না, এই বন জাতীয় উদ্যান। পর্যটক আসায় আগের বছর ৬৮ লাখ টাকা রেভিনিউ পেয়েছে সরকার, পর্যটকদের জন্য এই বন উন্মুক্তই থাকবে।