শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করা হোক

শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। দেশ গড়ার কারিগর। তাদের বেড়ে উঠা ও মানসিক বিকাশের জন্য দরকার উপযুক্ত ও নিরাপদ পরিবেশ। দরকার এমন একটি সমাজ যেখানে প্রতিটি শিশু বেড়ে উঠবে বৈষম্যহীনভাবে। মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি প্রতিটি শিশু আরো কতগুলো অধিকার নিয়ে জন্মলাভ করে। যেগুলোকে আমরা জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ হিসাবে জানি।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নের নিমিত্তে বাংলাদেশে ‘শিশু আইন ২০১৩’ পাস করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। বিশেষ করে শিশু ভিক্ষাবৃত্তির ক্ষেত্রে। শিশু আইন ২০১৩ এর ৭১ নং ধারায় বলা হয়েছে-

‘যদি কোন ব্যক্তি কোন শিশুকে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে নিয়োগ করেন বা কোন শিশুর দ্বারা ভিক্ষা করান অথবা শিশুর হেফাজত, তত্ত্বাবধান বা দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত কোন ব্যক্তি যদি কোন শিশুকে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে নিয়োগদানে প্রশ্রয়দান, উৎসাহ প্রদান কিংবা ভিক্ষার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন, তাহলে তিনি এই আইনের অধীন অপরাধী বলে গণ্য হবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য তিনি অনধিক (৫) পাঁচ বৎসর কারাদণ্ড অথবা অনধিক (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে শিশু ভিক্ষাবৃত্তি কমার চেয়ে দিনদিন বেড?েই চলছে।। সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তরের পরিপত্র অনুযায়ী রাজধানীতে ভিক্ষুকের সংখ্যা ৫০হাজার। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন প্রকৃত সংখ্যা তিন লাখের বেশি। যার মাঝে১৫ থেকে ১৭ শতাংশ শিশু। ঢাকা শহরের প্রতিটি মোড়ে এসব শিশু ভিক্ষুকদের দেখা যায়। চলার পথে জামা-কাপড় হাত-পা ধরে ভিক্ষা চায়। হাড্ডিসার মলিন চেহারা গুলো দেখলে খুব মায়া লাগে। আমরা কখনো কিছু টাকা-পয়সা দেই আবার কখনো বিরক্ত হই। কিন্তু শিশু ভিক্ষাবৃত্তি যে বড? ধরনের অপরাধ তা আমাদের মনেই আসে না। সাধারণ মানুষের কথা বলে লাভ কি যেখানে খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় বড? বড? সিন্ডিকেট এসব ভিক্ষা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে। বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ সুবিধাবঞ্চিত এসব কোমলমতি শিশুদেরকে ভিক্ষা করতে বাধ্য করছে। সুস্থ সবল শিশুদেরকে বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসব শিশুদেরকে ঢাকায় এনে বিভিন্ন এলাকায় ভাগ করে ১০০ বা ২০০ টাকা করে চাঁদা নিচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে রাজধানীতে প্রতিদিন ২০০ কোটি টাকার ভিক্ষা বাণিজ্য হয়। সে হিসেবে মাসে ৬০০ কোটি টাকা ও বছরে ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার বিরাট এক ব্যবসা। বিভিন্ন শক্তিশালী সিন্ডিকেট এসব নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের হাত অনেক লম্বা।

উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে খোদ রাজধানীতে দেশের শতকরা শিশু শ্রমিকের ৫০% কাজ করে। তাদের মাঝে আবার ৯% ভিক্ষাবৃত্তিতে জডিত। গড়ে তাদের বয়স ১০ এর নিচে। আরো ভয়াবহ সংবাদ হচ্ছে ঢাকা শহরে পথশিশু আছে ২০থেকে ২৫ লাখ। এদের মাঝে ৫০ হাজার শিশু আক্ষরিক অর্থেই রাস্তায় থাকে। যাদের ১০% যৌনকর্মী, ৮৬% মাদকাসক্ত।

মূলত শিশু ভিক্ষাবৃত্তির জন্য দায়ী দারিদ্র্যতা, অজ্ঞতা, সমাজ-রাষ্ট্রের উদাসীনতা। সর্বোপরি সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবের বিষয়টিও এডিয়ে যাওয়া যায় না। যার ফলশ্রুতিতে নিরাপদ শৈশবের পরিবর্তে শিশুরা ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ছে অথবা জড়াতে বাধ্য করা হচ্ছে।

অসহায় দরিদ্র লোকেরা মানুষের সাহায্য চাইতেই পারে এটা বিশ্বের প্রায় সব দেশেই আছে কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যখন ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নেয়া হয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে এটা এক বড? সমস্যা।

শিশুদের মাঝে ভিক্ষাবৃত্তির প্রভাব সুদূরপ্রসারী। সুন্দর আলোকিত ভবিষ্যৎ এর পরিবর্তে এই শিশুদের আজীবন লজ্জার গ্লানি বয়ে বেডাতে হয়। পরনির্ভরশীলতার শৃঙ্খলে আটকে থাকতে হয়। এর সঙ্গে আছে জঙ্গিবাদ, অনৈতিক কাজ, মাদক ব্যবসা ও চোরাকারবারির মতো সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। যেখানে আমরা একটু চেষ্টা করলেই পারতাম একটি শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে তার পরিবর্তে আমরা তাদেরকে ঠেলে দিচ্ছি অন্ধকারের অতল গহবরে।

ভিক্ষাবৃত্তি বিশেষ করে শিশু ভিক্ষাবৃত্তি প্রতিকারের জন্য চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও পুনর্বাসন। চাই রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর জবাবদিহিতা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসা। সিন্ডিকেটগুলোর বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি। তাদের মূলোৎপাটন করে আইনের আওতায় আনতে হবে। যদি আমরা এগুলো না করতে পারি তাহলে ২০৩০ সালের মাঝে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। তাই এখনই সময় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার এবং শিশু ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করার। এটি করতে পারলে মুজিববর্ষ আরো মহিমান্বিত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

ইনআমুল হাসান আরিফ

শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও খবর

মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৫ ফল্গুন ১৪২৬, ২৩ জমাদিউল সানি ১৪৪১

শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করা হোক

শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। দেশ গড়ার কারিগর। তাদের বেড়ে উঠা ও মানসিক বিকাশের জন্য দরকার উপযুক্ত ও নিরাপদ পরিবেশ। দরকার এমন একটি সমাজ যেখানে প্রতিটি শিশু বেড়ে উঠবে বৈষম্যহীনভাবে। মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি প্রতিটি শিশু আরো কতগুলো অধিকার নিয়ে জন্মলাভ করে। যেগুলোকে আমরা জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ হিসাবে জানি।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নের নিমিত্তে বাংলাদেশে ‘শিশু আইন ২০১৩’ পাস করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। বিশেষ করে শিশু ভিক্ষাবৃত্তির ক্ষেত্রে। শিশু আইন ২০১৩ এর ৭১ নং ধারায় বলা হয়েছে-

‘যদি কোন ব্যক্তি কোন শিশুকে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে নিয়োগ করেন বা কোন শিশুর দ্বারা ভিক্ষা করান অথবা শিশুর হেফাজত, তত্ত্বাবধান বা দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত কোন ব্যক্তি যদি কোন শিশুকে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে নিয়োগদানে প্রশ্রয়দান, উৎসাহ প্রদান কিংবা ভিক্ষার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন, তাহলে তিনি এই আইনের অধীন অপরাধী বলে গণ্য হবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য তিনি অনধিক (৫) পাঁচ বৎসর কারাদণ্ড অথবা অনধিক (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে শিশু ভিক্ষাবৃত্তি কমার চেয়ে দিনদিন বেড?েই চলছে।। সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তরের পরিপত্র অনুযায়ী রাজধানীতে ভিক্ষুকের সংখ্যা ৫০হাজার। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন প্রকৃত সংখ্যা তিন লাখের বেশি। যার মাঝে১৫ থেকে ১৭ শতাংশ শিশু। ঢাকা শহরের প্রতিটি মোড়ে এসব শিশু ভিক্ষুকদের দেখা যায়। চলার পথে জামা-কাপড় হাত-পা ধরে ভিক্ষা চায়। হাড্ডিসার মলিন চেহারা গুলো দেখলে খুব মায়া লাগে। আমরা কখনো কিছু টাকা-পয়সা দেই আবার কখনো বিরক্ত হই। কিন্তু শিশু ভিক্ষাবৃত্তি যে বড? ধরনের অপরাধ তা আমাদের মনেই আসে না। সাধারণ মানুষের কথা বলে লাভ কি যেখানে খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় বড? বড? সিন্ডিকেট এসব ভিক্ষা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে। বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ সুবিধাবঞ্চিত এসব কোমলমতি শিশুদেরকে ভিক্ষা করতে বাধ্য করছে। সুস্থ সবল শিশুদেরকে বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসব শিশুদেরকে ঢাকায় এনে বিভিন্ন এলাকায় ভাগ করে ১০০ বা ২০০ টাকা করে চাঁদা নিচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে রাজধানীতে প্রতিদিন ২০০ কোটি টাকার ভিক্ষা বাণিজ্য হয়। সে হিসেবে মাসে ৬০০ কোটি টাকা ও বছরে ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার বিরাট এক ব্যবসা। বিভিন্ন শক্তিশালী সিন্ডিকেট এসব নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের হাত অনেক লম্বা।

উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে খোদ রাজধানীতে দেশের শতকরা শিশু শ্রমিকের ৫০% কাজ করে। তাদের মাঝে আবার ৯% ভিক্ষাবৃত্তিতে জডিত। গড়ে তাদের বয়স ১০ এর নিচে। আরো ভয়াবহ সংবাদ হচ্ছে ঢাকা শহরে পথশিশু আছে ২০থেকে ২৫ লাখ। এদের মাঝে ৫০ হাজার শিশু আক্ষরিক অর্থেই রাস্তায় থাকে। যাদের ১০% যৌনকর্মী, ৮৬% মাদকাসক্ত।

মূলত শিশু ভিক্ষাবৃত্তির জন্য দায়ী দারিদ্র্যতা, অজ্ঞতা, সমাজ-রাষ্ট্রের উদাসীনতা। সর্বোপরি সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবের বিষয়টিও এডিয়ে যাওয়া যায় না। যার ফলশ্রুতিতে নিরাপদ শৈশবের পরিবর্তে শিশুরা ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ছে অথবা জড়াতে বাধ্য করা হচ্ছে।

অসহায় দরিদ্র লোকেরা মানুষের সাহায্য চাইতেই পারে এটা বিশ্বের প্রায় সব দেশেই আছে কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যখন ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নেয়া হয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে এটা এক বড? সমস্যা।

শিশুদের মাঝে ভিক্ষাবৃত্তির প্রভাব সুদূরপ্রসারী। সুন্দর আলোকিত ভবিষ্যৎ এর পরিবর্তে এই শিশুদের আজীবন লজ্জার গ্লানি বয়ে বেডাতে হয়। পরনির্ভরশীলতার শৃঙ্খলে আটকে থাকতে হয়। এর সঙ্গে আছে জঙ্গিবাদ, অনৈতিক কাজ, মাদক ব্যবসা ও চোরাকারবারির মতো সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। যেখানে আমরা একটু চেষ্টা করলেই পারতাম একটি শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে তার পরিবর্তে আমরা তাদেরকে ঠেলে দিচ্ছি অন্ধকারের অতল গহবরে।

ভিক্ষাবৃত্তি বিশেষ করে শিশু ভিক্ষাবৃত্তি প্রতিকারের জন্য চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও পুনর্বাসন। চাই রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর জবাবদিহিতা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসা। সিন্ডিকেটগুলোর বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি। তাদের মূলোৎপাটন করে আইনের আওতায় আনতে হবে। যদি আমরা এগুলো না করতে পারি তাহলে ২০৩০ সালের মাঝে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। তাই এখনই সময় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার এবং শিশু ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করার। এটি করতে পারলে মুজিববর্ষ আরো মহিমান্বিত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

ইনআমুল হাসান আরিফ

শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।