রোহিঙ্গারা বিদেশে বাংলাদেশি পরিচয়ে!

মোহাম্মদ আবু নোমান

অসহায় মানুষের সরলতা এবং তাদের স্বপ্নকে পুঁজি করে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে কতিপয় দালালচক্র। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! ঝুঁকিপূর্ণ পথে পা বাড়িয়ে তারা গন্তব্যে যেতে পারছে না। তার আগেই চিরতরে অনেকের স্বপ্নের মৃত্যু হয়। উন্নত জীবনের আশায় অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের সলিল সমাধি ঘটছে অথৈ সাগরে। দরিদ্র মানুষের জীবন-জীবিকার প্রাণান্তকর সংগ্রামকে পুঁজি করে মানব পাচারকারীরা আধুনিক দাস ব্যবসার মতো যে অমানবিক বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে তার বীভৎস রূপ উদ্ঘাটিত হওয়া যেমন জরুরি, তেমনি এ সমস্যা মোকাবেলায় সবাইকে আন্তরিক ও কঠোর হতে হবে।

কয়েক বছর আগে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাঠানোর সময় কয়েকশ’ বাংলাদেশির সলিল সমাধির ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। একই রকম চাঞ্চল্যের সৃষ্টি ও দেশব্যাপী তোলপাড় হয়েছিল থাইল্যান্ডের জঙ্গলে শত শত বাংলাদেশির গণকবর আবিষ্কৃত হওয়ার পর। এমনকি মালয়েশিয়ায়ও পাওয়া যায় গণকবর। বিপজ্জনক পথে মানবপাচার যে বন্ধ হয়নি, তার সর্বশেষ উদাহরণ গত ১২ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে বঙ্গোপসাগরে ট্রলারডুবির ঘটনা। সেন্টমার্টিনের অদূরে বঙ্গোপসাগরে মারা যাওয়া ১৯ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই ট্রলারে নারী ও শিশুসহ ১৩৮ জন যাত্রী ছিল। উদ্ধার হওয়া জীবিত যাত্রীর সংখ্যা ছিল ৭৩ জন। জানা যায়, একই দিন মালয়েশিয়ায় পাচারের উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গাবোঝাই আরো দুটি নৌকা ওই নৌকাটির সঙ্গে প্রায় একই সময়ে রওনা দেয়। সে নৌকা দুটির হদিস জানা যায়নি। শুধু দেশের সমুদ্র এলাকায় নয়, বিভিন্ন সময় লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালি যাওয়ার পথেও একাধিক নৌকাডুবির ঘটনায় বহু বাংলাদেশি মারা গেছেন। সেন্টমার্টিনের অদূরে সমুদ্রে যাত্রীবাহী ট্রলারডুবির ঘটনায় আমরা হতবাক হলেও বিস্মিত নই। বস্তুত বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে অবৈধ বিদেশযাত্রায় মানবপাচার চক্র যেভাবে বেপরোয়া ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে- এটা তারই অংশ। ২০১৫ সালে ৬০০ যাত্রী নিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় বঙ্গোপসাগরে একটি ট্রলার আটক করেছিল বাংলাদেশ নৌবাহিনী। বেশ কিছুদিন ধরে বন্ধ থাকার পর নতুন করে শুরু হয়েছে নৌপথে মানবপাচার। এবার টার্গেট করা হয়েছে বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী হতদরিদ্র মায়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। পেটের দায়ে কিংবা উন্নত জীবনের আশায় এসব মানুষ পাচারকারীদের প্রলোভনে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। সমুদ্রসহ দুর্গম পথে পাচারের সময় কেউ কেউ মারাও যাচ্ছেন। অনেক কিশোরী ও নারীর ঠাঁই হচ্ছে ভিনদেশের যৌনপল্লীতে।

মায়ানমারে নির্যাতন এবং বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরের ক্ষুদ্র পরিসরে মানবেতর জীবনযাপন ও জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার জোরালো সম্ভাবনা না থাকায় দালালদের লোভের বলি হয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে গোপনে ক্যাম্প ছাড়ছে রোহিঙ্গারা। কারণ নিজ দেশ থেকে পালিয়ে আসা এ জনগোষ্ঠীর বিপুলসংখ্যক মানুষ দীর্ঘদিন ধরে শরণার্থী শিবিরে জীবনযাপনে হতাশ হয়ে পড়েছে; যা তাদের উৎসাহিত করছে নানা প্রলোভনের দিকে। এটা থেকে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপজ্জনকভাবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে হলেও বাঁচতে চাইছে। এভাবে ট্রলারডুবিতে মৃত্যু, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে দীর্ঘ কারাবাস, পথে পথে নানা বিপদ ও নির্যাতনের তোয়াক্কা করছে না অবৈধভাবে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে দেশত্যাগীরা। অনেকেই বিদেশের কারাগারে বছরের পর বছর বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন। স্বজনরা জানেনও না তাদের জন্য উপার্জন করতে যাওয়া প্রিয়জনটি বিপদে কিংবা আদৌ বেঁচে আছেন কিনা।

এছাড়া শুধু পুরুষই নয়! জীবনের গল্প বদলে ফেলার আশায় অনেক নারী ঝুঁকিপূর্ণ পথে বিদেশে গিয়ে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে প্রতারিত হয়েছেন। পাচার হওয়া নারী ও শিশুদের যৌনশোষণমূলক কাজে জড়াতেও বাধ্য করা হচ্ছে। অনেককে আটকে রেখে আদায় করা হচ্ছে মুক্তিপণ। ডুবে যাওয়া রোহিঙ্গাবোঝাই ট্রলারটির অনেকেই মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন বিয়ের পাত্রী হিসেবে। ট্রলারডুবিতে নিহতের মধ্যে ১২ জনই রোহিঙ্গা তরুণী, যারা বিয়ে করে সংসার পাতার স্বপ্নে দলবেঁধে মালয়েশিয়া যাচ্ছিল বলে জানিয়েছে উদ্ধার হওয়া অন্য তরুণীরা। ট্রলারে থাকা যাত্রীদের উদ্ধৃত করে বিভিন্ন বার্তা সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, ডুবে যাওয়ার সময়ে ট্রলারে যাত্রী ছিল ১৩৮ জন।

বিদেশ থেকে জীবন নিয়ে কোনোমতে ফিরে আসা মানুষদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে নানা বিভীষিকার চিত্র। ভালো চাকরি ও উন্নত জীবনের টোপ দিয়ে মানব পাচারকারীরা তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা। রোহিঙ্গা ক্যাম্প এখন নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে হলেও সে নিরাপত্তা ঘেরাটোপ থেকে তাদের কারা, কাদের সহায়তায় ক্যাম্পের বাইরে এনে পাচার করছে, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। মানবপাচারের এ নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে না পারা ভবিষ্যতের জন্য অশনিসঙ্কেত।

রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে এভাবে যাওয়ার চেষ্টা ও প্রাণহানিতে নষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি; যা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় গিয়ে নিজেদের বাংলাদেশি বলে পরিচয় দেয়। তাই যে কোনোভাবেই হোক এটি বন্ধে প্রশাসনকে কঠোর ও তৎপর হতে হবে। মানবপাচারকারী দালাল চক্রের কারণে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি জনশক্তি রপ্তানি বিঘি্নত হচ্ছে। মানবপাচার একটি বড় ধরনের অপরাধ। দালাল চক্রের সদস্যরা মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দেয়ার নাম করে বিপুল অর্থ নিয়ে হতভাগ্যদের সাগরে ফেলে দিয়েছে- এমন নজিরও কম নয়। মালয়েশিয়ায় অভিবাসন পেতে ইচ্ছুকদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়ার ঘটনাও রয়েছে।

এছাড়া মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা ‘অ্যাথনিক ক্লিনজিং’ তথা গণহত্যার শিকার, রাষ্ট্রহীন হওয়া ও কোনো দেশের পাসপোর্ট গ্রহণের সুযোগ না থাকায় রোহিঙ্গারা পরিচয় গোপন করে অবৈধভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে সৌদি আরবে গিয়েছে। এ সংখ্যা ৫০ হাজারের উপরে। আমরা জানতে চাই, রোহিঙ্গারা কীভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেলো? এখনো যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিচ্ছে না, তার গ্যারান্টি কী? রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহে নষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি; যা সৌদি শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবে কর্মরত অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা কর্মীকে বাংলাদেশে ফেরত আনার জন্য চাপ দিতে শুরু করেছে সে দেশের সরকার। বাংলাদেশের প্রধান এবং সবচেয়ে বড় বৈদেশিক শ্রম বাজার সৌদি আরবে প্রবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের সংকট মোকাবেলা করছে। অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে হাজার হাজার বাংলাদেশি কর্মী ফেরত আসছে। এখন রোহিঙ্গা শ্রমিক ফেরাতে সৌদি আরবের চাপ দেশের জন্য বড় বিপদ বলে আমরা মনে করছি। বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের চাপ বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো বড় ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপদের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে সৌদি আরব ইতিপূর্বে অনানুষ্ঠানিকভাবে তাগিদ দিলেও এখন আনুষ্ঠানিক চাপ ও আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হওয়ায় এ বিষয়ে বাংলাদেশকে গ্রহণযোগ্য কূটনৈতিক সমাধানে পৌঁছানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

জানা যায়, কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন আদালতে ৩৯৮টি মানবপাচার মামলা বিচারাধীন। পুলিশ বলছে, মামলার আসামিরা সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে জামিনে বেরিয়ে এসে আবার মানবপাচারে জড়াচ্ছে। সারাদেশে মানবপাচার চক্রে জড়িত ৪৭০ জন। শুধু ঢাকা বিভাগের নয়টি জেলায়ই রয়েছে তালিকাভুক্ত ৯৪ জন মানবপাচারকারী। এ সিন্ডিকেটটিতে জনপ্রতিনিধি ছাড়াও রয়েছেন একাধিক নারী। কিছু প্রতিষ্ঠানও এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত। পাচারে জড়িত বাহকরা ধরা পড়লেও রাঘববোয়ালদের টিকি এখনও স্পর্শ করা যাচ্ছে না। মানব পাচারের এই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। মানবপাচারে জড়িত রাঘববোয়ালদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাই বাহক বা চুনোপুঁটি ধরা পড়লেও হোতারা ধরা পড়ছে না। অনেক সময় মানবপাচার আর মাদকপাচার কার্যক্রম চলছে একই কেন্দ্র থেকে।

পুলিশের তথ্যমতে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট থেকে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে ২৮টি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় পুলিশ, বিজিবি ও কোস্টগার্ড ১৯৭ জনের লাশ উদ্ধার করে। এ পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছে অন্তত ৫০০ জন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এত ঘটনার পরও কেন মানবপাচারের হোতাদের শনাক্ত করা হচ্ছে না?

জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এখন ৪০ থেকে ৪৫টির মতো দালাল চক্র সক্রিয়। এ জন্য রোহিঙ্গারা ৩০ থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত দালালদের দিচ্ছে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছে এ পরিমাণ টাকা কত বড় অঙ্কের তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পাচারকারীরা একদিকে অতি সহজে রোহিঙ্গাদের রাজি করাতে পারে, অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে টাকা নিতে পারলে ফেরত দেয়ার ঝুঁকিও থাকে না। আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে স্থানীয়দের তো বটেই, রোহিঙ্গাদেরও সচেতন করা জরুরি। মনে রাখতে হবে, দালাল চক্রের নিশানা এখন রোহিঙ্গাদের। তাছাড়া মানবপাচারকারীদের খপ্পরে বিশেষত তারাই পড়ে, যারা বেকার কিংবা দেশে কাঙ্খিত কর্ম করতে পারছে না। ফলে মানবপাচার বন্ধে বেকারদের কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে মানব পাচারকারীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মানব পাচারবিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে টায়ার-২ ওয়াচ লিস্টে রাখা হয়েছে। যার অর্থ, মানব পাচারের যে ন্যূনতম মানদ- সেটা বাংলাদেশ ধরে রাখতে পারেনি। এই মানদণ্ডে দীর্ঘদিন থাকলে অনেক দেশ বাংলাদেশি নাগরিকদের অন অ্যারাইভালো ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে কঠোর হয়ে থাকবে। আমরা বিস্মিত যে, একটি প্রতিবেদন বলছে, ২০১২ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ছয় শতাধিক মামলা হলেও একটিরও বিচার হয়নি। আমরা মনে করি, তাদের বিচার হতেই হবে। এক্ষেত্রে দালালচক্র চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা জরুরি।

abunoman1972@gmail.com

মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৫ ফল্গুন ১৪২৬, ২৩ জমাদিউল সানি ১৪৪১

রোহিঙ্গারা বিদেশে বাংলাদেশি পরিচয়ে!

মোহাম্মদ আবু নোমান

অসহায় মানুষের সরলতা এবং তাদের স্বপ্নকে পুঁজি করে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে কতিপয় দালালচক্র। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! ঝুঁকিপূর্ণ পথে পা বাড়িয়ে তারা গন্তব্যে যেতে পারছে না। তার আগেই চিরতরে অনেকের স্বপ্নের মৃত্যু হয়। উন্নত জীবনের আশায় অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের সলিল সমাধি ঘটছে অথৈ সাগরে। দরিদ্র মানুষের জীবন-জীবিকার প্রাণান্তকর সংগ্রামকে পুঁজি করে মানব পাচারকারীরা আধুনিক দাস ব্যবসার মতো যে অমানবিক বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে তার বীভৎস রূপ উদ্ঘাটিত হওয়া যেমন জরুরি, তেমনি এ সমস্যা মোকাবেলায় সবাইকে আন্তরিক ও কঠোর হতে হবে।

কয়েক বছর আগে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাঠানোর সময় কয়েকশ’ বাংলাদেশির সলিল সমাধির ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। একই রকম চাঞ্চল্যের সৃষ্টি ও দেশব্যাপী তোলপাড় হয়েছিল থাইল্যান্ডের জঙ্গলে শত শত বাংলাদেশির গণকবর আবিষ্কৃত হওয়ার পর। এমনকি মালয়েশিয়ায়ও পাওয়া যায় গণকবর। বিপজ্জনক পথে মানবপাচার যে বন্ধ হয়নি, তার সর্বশেষ উদাহরণ গত ১২ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে বঙ্গোপসাগরে ট্রলারডুবির ঘটনা। সেন্টমার্টিনের অদূরে বঙ্গোপসাগরে মারা যাওয়া ১৯ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই ট্রলারে নারী ও শিশুসহ ১৩৮ জন যাত্রী ছিল। উদ্ধার হওয়া জীবিত যাত্রীর সংখ্যা ছিল ৭৩ জন। জানা যায়, একই দিন মালয়েশিয়ায় পাচারের উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গাবোঝাই আরো দুটি নৌকা ওই নৌকাটির সঙ্গে প্রায় একই সময়ে রওনা দেয়। সে নৌকা দুটির হদিস জানা যায়নি। শুধু দেশের সমুদ্র এলাকায় নয়, বিভিন্ন সময় লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালি যাওয়ার পথেও একাধিক নৌকাডুবির ঘটনায় বহু বাংলাদেশি মারা গেছেন। সেন্টমার্টিনের অদূরে সমুদ্রে যাত্রীবাহী ট্রলারডুবির ঘটনায় আমরা হতবাক হলেও বিস্মিত নই। বস্তুত বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে অবৈধ বিদেশযাত্রায় মানবপাচার চক্র যেভাবে বেপরোয়া ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে- এটা তারই অংশ। ২০১৫ সালে ৬০০ যাত্রী নিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় বঙ্গোপসাগরে একটি ট্রলার আটক করেছিল বাংলাদেশ নৌবাহিনী। বেশ কিছুদিন ধরে বন্ধ থাকার পর নতুন করে শুরু হয়েছে নৌপথে মানবপাচার। এবার টার্গেট করা হয়েছে বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী হতদরিদ্র মায়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। পেটের দায়ে কিংবা উন্নত জীবনের আশায় এসব মানুষ পাচারকারীদের প্রলোভনে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। সমুদ্রসহ দুর্গম পথে পাচারের সময় কেউ কেউ মারাও যাচ্ছেন। অনেক কিশোরী ও নারীর ঠাঁই হচ্ছে ভিনদেশের যৌনপল্লীতে।

মায়ানমারে নির্যাতন এবং বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরের ক্ষুদ্র পরিসরে মানবেতর জীবনযাপন ও জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার জোরালো সম্ভাবনা না থাকায় দালালদের লোভের বলি হয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে গোপনে ক্যাম্প ছাড়ছে রোহিঙ্গারা। কারণ নিজ দেশ থেকে পালিয়ে আসা এ জনগোষ্ঠীর বিপুলসংখ্যক মানুষ দীর্ঘদিন ধরে শরণার্থী শিবিরে জীবনযাপনে হতাশ হয়ে পড়েছে; যা তাদের উৎসাহিত করছে নানা প্রলোভনের দিকে। এটা থেকে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপজ্জনকভাবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে হলেও বাঁচতে চাইছে। এভাবে ট্রলারডুবিতে মৃত্যু, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে দীর্ঘ কারাবাস, পথে পথে নানা বিপদ ও নির্যাতনের তোয়াক্কা করছে না অবৈধভাবে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে দেশত্যাগীরা। অনেকেই বিদেশের কারাগারে বছরের পর বছর বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন। স্বজনরা জানেনও না তাদের জন্য উপার্জন করতে যাওয়া প্রিয়জনটি বিপদে কিংবা আদৌ বেঁচে আছেন কিনা।

এছাড়া শুধু পুরুষই নয়! জীবনের গল্প বদলে ফেলার আশায় অনেক নারী ঝুঁকিপূর্ণ পথে বিদেশে গিয়ে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে প্রতারিত হয়েছেন। পাচার হওয়া নারী ও শিশুদের যৌনশোষণমূলক কাজে জড়াতেও বাধ্য করা হচ্ছে। অনেককে আটকে রেখে আদায় করা হচ্ছে মুক্তিপণ। ডুবে যাওয়া রোহিঙ্গাবোঝাই ট্রলারটির অনেকেই মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন বিয়ের পাত্রী হিসেবে। ট্রলারডুবিতে নিহতের মধ্যে ১২ জনই রোহিঙ্গা তরুণী, যারা বিয়ে করে সংসার পাতার স্বপ্নে দলবেঁধে মালয়েশিয়া যাচ্ছিল বলে জানিয়েছে উদ্ধার হওয়া অন্য তরুণীরা। ট্রলারে থাকা যাত্রীদের উদ্ধৃত করে বিভিন্ন বার্তা সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, ডুবে যাওয়ার সময়ে ট্রলারে যাত্রী ছিল ১৩৮ জন।

বিদেশ থেকে জীবন নিয়ে কোনোমতে ফিরে আসা মানুষদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে নানা বিভীষিকার চিত্র। ভালো চাকরি ও উন্নত জীবনের টোপ দিয়ে মানব পাচারকারীরা তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা। রোহিঙ্গা ক্যাম্প এখন নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে হলেও সে নিরাপত্তা ঘেরাটোপ থেকে তাদের কারা, কাদের সহায়তায় ক্যাম্পের বাইরে এনে পাচার করছে, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। মানবপাচারের এ নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে না পারা ভবিষ্যতের জন্য অশনিসঙ্কেত।

রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে এভাবে যাওয়ার চেষ্টা ও প্রাণহানিতে নষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি; যা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় গিয়ে নিজেদের বাংলাদেশি বলে পরিচয় দেয়। তাই যে কোনোভাবেই হোক এটি বন্ধে প্রশাসনকে কঠোর ও তৎপর হতে হবে। মানবপাচারকারী দালাল চক্রের কারণে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি জনশক্তি রপ্তানি বিঘি্নত হচ্ছে। মানবপাচার একটি বড় ধরনের অপরাধ। দালাল চক্রের সদস্যরা মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দেয়ার নাম করে বিপুল অর্থ নিয়ে হতভাগ্যদের সাগরে ফেলে দিয়েছে- এমন নজিরও কম নয়। মালয়েশিয়ায় অভিবাসন পেতে ইচ্ছুকদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়ার ঘটনাও রয়েছে।

এছাড়া মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা ‘অ্যাথনিক ক্লিনজিং’ তথা গণহত্যার শিকার, রাষ্ট্রহীন হওয়া ও কোনো দেশের পাসপোর্ট গ্রহণের সুযোগ না থাকায় রোহিঙ্গারা পরিচয় গোপন করে অবৈধভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে সৌদি আরবে গিয়েছে। এ সংখ্যা ৫০ হাজারের উপরে। আমরা জানতে চাই, রোহিঙ্গারা কীভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেলো? এখনো যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিচ্ছে না, তার গ্যারান্টি কী? রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহে নষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি; যা সৌদি শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবে কর্মরত অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা কর্মীকে বাংলাদেশে ফেরত আনার জন্য চাপ দিতে শুরু করেছে সে দেশের সরকার। বাংলাদেশের প্রধান এবং সবচেয়ে বড় বৈদেশিক শ্রম বাজার সৌদি আরবে প্রবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের সংকট মোকাবেলা করছে। অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে হাজার হাজার বাংলাদেশি কর্মী ফেরত আসছে। এখন রোহিঙ্গা শ্রমিক ফেরাতে সৌদি আরবের চাপ দেশের জন্য বড় বিপদ বলে আমরা মনে করছি। বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের চাপ বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো বড় ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপদের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে সৌদি আরব ইতিপূর্বে অনানুষ্ঠানিকভাবে তাগিদ দিলেও এখন আনুষ্ঠানিক চাপ ও আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হওয়ায় এ বিষয়ে বাংলাদেশকে গ্রহণযোগ্য কূটনৈতিক সমাধানে পৌঁছানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

জানা যায়, কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন আদালতে ৩৯৮টি মানবপাচার মামলা বিচারাধীন। পুলিশ বলছে, মামলার আসামিরা সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে জামিনে বেরিয়ে এসে আবার মানবপাচারে জড়াচ্ছে। সারাদেশে মানবপাচার চক্রে জড়িত ৪৭০ জন। শুধু ঢাকা বিভাগের নয়টি জেলায়ই রয়েছে তালিকাভুক্ত ৯৪ জন মানবপাচারকারী। এ সিন্ডিকেটটিতে জনপ্রতিনিধি ছাড়াও রয়েছেন একাধিক নারী। কিছু প্রতিষ্ঠানও এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত। পাচারে জড়িত বাহকরা ধরা পড়লেও রাঘববোয়ালদের টিকি এখনও স্পর্শ করা যাচ্ছে না। মানব পাচারের এই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। মানবপাচারে জড়িত রাঘববোয়ালদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাই বাহক বা চুনোপুঁটি ধরা পড়লেও হোতারা ধরা পড়ছে না। অনেক সময় মানবপাচার আর মাদকপাচার কার্যক্রম চলছে একই কেন্দ্র থেকে।

পুলিশের তথ্যমতে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট থেকে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে ২৮টি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় পুলিশ, বিজিবি ও কোস্টগার্ড ১৯৭ জনের লাশ উদ্ধার করে। এ পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছে অন্তত ৫০০ জন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এত ঘটনার পরও কেন মানবপাচারের হোতাদের শনাক্ত করা হচ্ছে না?

জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এখন ৪০ থেকে ৪৫টির মতো দালাল চক্র সক্রিয়। এ জন্য রোহিঙ্গারা ৩০ থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত দালালদের দিচ্ছে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছে এ পরিমাণ টাকা কত বড় অঙ্কের তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পাচারকারীরা একদিকে অতি সহজে রোহিঙ্গাদের রাজি করাতে পারে, অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে টাকা নিতে পারলে ফেরত দেয়ার ঝুঁকিও থাকে না। আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে স্থানীয়দের তো বটেই, রোহিঙ্গাদেরও সচেতন করা জরুরি। মনে রাখতে হবে, দালাল চক্রের নিশানা এখন রোহিঙ্গাদের। তাছাড়া মানবপাচারকারীদের খপ্পরে বিশেষত তারাই পড়ে, যারা বেকার কিংবা দেশে কাঙ্খিত কর্ম করতে পারছে না। ফলে মানবপাচার বন্ধে বেকারদের কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে মানব পাচারকারীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মানব পাচারবিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে টায়ার-২ ওয়াচ লিস্টে রাখা হয়েছে। যার অর্থ, মানব পাচারের যে ন্যূনতম মানদ- সেটা বাংলাদেশ ধরে রাখতে পারেনি। এই মানদণ্ডে দীর্ঘদিন থাকলে অনেক দেশ বাংলাদেশি নাগরিকদের অন অ্যারাইভালো ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে কঠোর হয়ে থাকবে। আমরা বিস্মিত যে, একটি প্রতিবেদন বলছে, ২০১২ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ছয় শতাধিক মামলা হলেও একটিরও বিচার হয়নি। আমরা মনে করি, তাদের বিচার হতেই হবে। এক্ষেত্রে দালালচক্র চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা জরুরি।

abunoman1972@gmail.com