সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বাস করলেও সার্বিক উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত

বৃহত্তর ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসরত বিশাল আদিবাসী সম্প্রদায় প্রায় ২০০ বছর ধরে এই এলাকায় সামপ্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করে আসেছে। গারো পাহাড়ের পাদদেশে বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহের সমতল এলাকায় বাঙালি মুসলিম ও হিন্দু পরিবারের সঙ্গে অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে আদিবাসীর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করছে। মাঝে মধ্যে সাম্প্রদায়িক সমস্যা যে হয় না-তা নয়। তবে ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী এলাকা হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে আদিবাসীরা মুসলমানদের সঙ্গে মিলেমিশে জীবিকা, শিক্ষা, সামাজিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করছে। যেখানে জাতিগত কোন বিরোধ নেই। তবে পাহাড়ি আদিবাসীদের উন্নয়নে যেমন নিজস্ব মন্ত্রণালয় রয়েছে এ অঞ্চলের সমতল আদিবাসীদের জন্যে কোন মন্ত্রণালয় না থাকায় সার্বিক উন্নয়ন থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে।

ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী উপজেলা হালুয়াঘাটের আঁচকিপাড়া, ঝলঝলিয়া, জখমকূড়া, বুটিয়া পাড়া, গাবড়াখালি, ঘিলাভূই, শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ীর পানিহাতা, বারোমারী, নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর, কলমাকান্দাসহ আশপাশের উপজেলার আদিবাসীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি থাকলেও সামগ্রীকভাবে তাদের আর্থিক অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হচ্ছে না। আদিবাসীর বিভিন্ন সম্প্রাদায়ের মধ্যে ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলায় গারো, হাজং, কোচ, বানাই, হদি, বর্মন ও বংশীসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে গারো সম্প্র্রদায়ের বিভিন্ন গোত্রের পরিবারই বেশি। এসব এলাকায় দু-চারটি পরিবার ছাড়া বেশিরভাগ আদিবাসীরা কায়িক পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। এসব সীমান্তের সমতল অঞ্চলের গারোদের জীবনমানে প্রতিনিয়ত চলছে বাঁচার লড়াই। এখানে নেই কোন জীবিকার উৎস। শুধু মাত্র কৃষির ওপর নির্ভর করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। গারো সম্প্রদায়ের মধ্যে আদি থেকেই মাতৃতান্ত্রিক প্রথা চালু থাকায় পরিবারের নারীরাই জীবিকার কাজ করে। এক সময় কৃষি কাজ ছাড়াও নারীরা বন থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাকি অংশ বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করা ছিল নিয়মিত আয়ের উৎস। বর্তমানে বন বিভাগের নিষেধাজ্ঞার কারণে কাঠ সংগ্রগেহর কাজ এখন আর তারা করতে পারে না। ফলে নারীরা এখন ক্ষেতে খামারে কাজ করার পাশপাশি ছোট আকারে ব্যবসা করেও তারা জীবিকা নির্বাহ করছে। ধোবাউড়া উপজেলার ঘোষগাঁও ইউনিয়নের চন্দ্রকোনা গ্রামের বিধবা গারো নারী নিশা রানী চংখেং স্বামী মারা যাওয়ার পর ২০ বছর ধরে চন্দ্রকোনা বাজারে চায়ের দোকার করে তার এক ছেলে ও এক মেয়েকে পড়ালেখা করাচ্ছে। নিশা রানি চংখেং জানান, স্বামী ছাড়া তার সংসার টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে চললেও এখানে চায়ের দোকান করে ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে তার কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি। নিশা রানীর প্রতিবেশী মুরগির খামারের মালিক জালাল উদ্দিন জানান, আমরা একে অপরের যে কোন কাজে সারা দিই। নিশা রানীর মতো এ এলাকায় অনেক গারো নারীরা কৃষিকাজ ছাড়াও ছোটখাঠো ব্যবসা বাণিজ্য করে সংসার চালাচ্ছে। সেখানে কাজের ক্ষেত্রে নারীর সম্মান রক্ষা বা সাম্প্রদায়িক কোন সমস্যায় তাদের পড়তে হয় না। এসব এলাকায় কর্মসংস্থানে কোন উৎস না থাকায় অত্যন্ত পরিশ্রমী গারো নারীরা সাবলম্বী হতে চাইলেও তা পারছে না। কিছুদিন আগে এ অঞ্চলে বেশকিছু এনজিও কাজ করায় সেখানে আদিবাসীদের এটা বিরাট অংশের কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল। বর্তমানে সে অঞ্চলে এনজিওগুলো তাদের কর্মকা- প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এ অঞ্চলে এ যাবৎ কোন শিল্পকারখানাও গড়ে উঠেনি। কোন উদ্যোক্তা নেই। ব্যক্তিপর্যায় কিছু ক্ষুদ্র কুঠির শিল্প, মাছ ও পশু পালন খামার থাকলেও তা অপ্রতুল। এসব ব্যাপারে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন বলে জানান আদিবাসী ক্ষুদ্র কুঠির শিল্প উদ্যোক্তারা। এ ব্যাপারে ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্যে আলাদা মন্ত্রণালয় থাকলেও এ অঞ্চলের সমতল আদিবাসীদের জন্যে নেই কোন মন্ত্রণালয়। ফলে পাহড়ি আদিবাসীরা যে সুবিধা ভোগ করে তা এ অঞ্চলের আদিবাসীরা পাচ্ছে না। নিজস্ব মন্ত্রণালয় থাকায় পাহাড়ি আদিবাসীদের উন্নয়নে প্রতি অর্থ বছরেই অর্থ বরাদ্দ থাকলেও সমতল আদিবাসীরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সমতল আদিবাসীদের জন্যে ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণ তহবিল থেকে কিছু থোক বরাদ্দ পেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। যা টেকসই উন্নয়নে কাজে লাগে না। তবে বর্তমানে গারো সম্প্রদায়ের শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত বেশিরভাগ তরুন-তরুণীই এখন শহরমুখী। তারা ঢাকা, ময়মনসিংহ শহর ছাড়াও দেশের বড় বড় শহরে মেয়েরা পার্লারে অথবা গার্মেন্ট কারখানায় আর ছেলেরা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় সিকিউরিটি গার্ড বা অফিস সহকারীরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেও কাজ করছে। এতে সংসারে খরচ ছাড়াও ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে নিজেরা স্বাবলম্বী হচ্ছে। এ ব্যাপারে গারো সম্প্রদায়ের আর এক বিধবা নারী কবিতা আজমী জানান, তার দুুই মেয়ে পার্লারে কাজ করে। একজন রংপুর অন্যজন নারায়ণগঞ্জে। মেয়েদের আয়ের টাকায়ই তার সংসার চলে। তিনি আরও বলেন, তাদের কাজের জায়গায় তার মেয়েরা সম্পূর্ণ নিরাপদ ও সম্মানের সঙ্গেই কাজ করছে। ভালোমুনিরা মানমিত্র নামে আর এক নারী জানান, তার স্বামী ঢাকা শহরে সিকিউরিটি গার্ডেরও চাকরি করেন। তিনি বাড়িতে থেকে ছেলে মেয়েদের স্বাচ্ছন্দ্যে লেখাপড়া করাচ্ছেন।

এসব অঞ্চলের আদিবাসীরা বাংলা শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। নিজেদের ভাষা থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সে ভাষা প্রচলিত নয়। তাই শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা মাধ্যমেই তারা শিক্ষিত হচ্ছে। তবে তারা বাংলা ভাষাভাষীদের সঙ্গে কথা বলার সময় বাংলা ভাষা ব্যবহার করে নিজেদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করে। তবে এসব এলাকার আদিবাসিদের মধ্যে শিক্ষার হার অনেকাংশে বেড়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এসব এলাকায় রয়েছে। তবে উচ্চশিক্ষার জন্য তাদের বিভিন্ন শহরে যেতে হয়। এসব ব্যাপারে বাংলাদেশ ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও গারো সমাজ নিয়ে গবেষণার কাজে লিপ্ত জেমস জর্নেশ চিরাণ বলেন, একেবারে দুর্গম এলাকা ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই এ রকম বলা যাবে না। এসব এলাকার আদিবাসীদের শিক্ষার হার বেড়েছে কিন্তু সুযোগের অভাব ও আর্থিক অভাব অনটনের কারণে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না। তবে তিনি নিজস্ব ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের নিজস্ব ভাষা হারিয়ে যেতে বসেছে। তিনি বলেন, আমাদের এই অঞ্চলে প্রচলিত ভাষার নাম ‘আবেং’ ভাষা। যদিও সরকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (সরকার ঘোষিত সম্প্রদায়) এর ভাষা সংরক্ষণের জন্য সরকারি উদ্যোগে আদিবাসী বই প্রকাশ করে আমদের এ অঞ্চলে সরবরাহ করছে। তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এছাড়া এই ভাষা শিক্ষা দেয়ার মতো আমাদের কোন শিক্ষক নেই। এ ভাষা শিক্ষা দেয়ার জন্যে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। তাছাড় যে ভাষায় এই বইগুলো প্রকাশ করা হয়েছে তা আমাদের প্রচলিত ভাষা ‘আবেং’ ভাষা নয়। এটি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিভিন্ন আদিবাসী ভাষার সংকলিত একটি রূপ যার নাম “আচিক” ভাষা। এই ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে আমাদের অঞ্চলের আদিবাসীদের প্রচলিত ভাষার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। তিনি বলেন, আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার সরকারের উদ্যোগটি এখনো সভা-সেমিনারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।

ভাষার মতোই গারোদের মধ্যে মিশ্র সংস্কৃতি বিরাজমান। এ অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি গঠনে ভূমিকা রেখেছে। বিভিন্ন উপজাতি গারো, হাজং, বানাই, কোচ, ডালু, হদি, আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি ঐতিহ্য ধরে রেখে, তাদের কৃষ্টি কালচার আজো বিদ্যমান। গারোদের কিছু কিছু অনুষ্ঠান যেমন- ওয়াংগালা, আগাল মাকাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান ধুমধাম করে পালিত হয়। তাদের প্রচলিত সংগীত চর্চায় আজও জারি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, গানের সংস্কৃতির ধারা অব্যাহত রেখেছে। পোশাক সংস্কৃতির ঐতিহ্যে তারা শাড়ির বদলে বাড়িতে বোনা দকমান্দা, দকশাড়ি, বাগেশ এসব পোশাক পরিধান করে। পুরুষরা সাধারণত দকশাড়ি পড়ে। ময়মনসিংহ অঞ্চলে বসবাসকারী গারো সংস্কৃতির প্রধান উৎসব ওয়াংগালা। এটি নতুন ফসল ঘরে তোলার উৎসবও বলা হয়। সাধারণত শীতের শুরুতে এই অনুষ্ঠানটি বেশ ধুমধাম করে পালন করা হয়। এসব আচার অনুষ্ঠানে বাঙালি মুসলমানদের অবাদ বিচরণ রয়েছে। প্রশাসনিকভাবেও এসব অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা জোরদার করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করে।

গারো সমাজের গকেষক জেমস জর্নেশ চিরাণ জানান, এ অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষ ক্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। সারা বছরেই তারা খ্রিস্টান দর্মীয় আচার আচরণ নিশ্চিন্তে পালন করে। তিনি বলেন, এ অঞ্চলে জাতিগত বিবাধ কোন দিনই ছিল না, এখনও নেই। তবে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা যে ঘটে না তা নয়। সেটা ব্যক্তি পর্যায় জমি সক্রান্ত বা ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে কিছু বিবাধ মাঝে মধ্যে ঘটে। তবে জাতিগত বা সাম্প্রদায়িক কোন অস্থিরতা এ অঞ্চলে নেই।

বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৬ ফল্গুন ১৪২৬, ২৪ জমাদিউল সানি ১৪৪১

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বাস করলেও সার্বিক উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত

শরীফুজ্জামান টিটু

বৃহত্তর ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসরত বিশাল আদিবাসী সম্প্রদায় প্রায় ২০০ বছর ধরে এই এলাকায় সামপ্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করে আসেছে। গারো পাহাড়ের পাদদেশে বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহের সমতল এলাকায় বাঙালি মুসলিম ও হিন্দু পরিবারের সঙ্গে অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে আদিবাসীর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করছে। মাঝে মধ্যে সাম্প্রদায়িক সমস্যা যে হয় না-তা নয়। তবে ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী এলাকা হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে আদিবাসীরা মুসলমানদের সঙ্গে মিলেমিশে জীবিকা, শিক্ষা, সামাজিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করছে। যেখানে জাতিগত কোন বিরোধ নেই। তবে পাহাড়ি আদিবাসীদের উন্নয়নে যেমন নিজস্ব মন্ত্রণালয় রয়েছে এ অঞ্চলের সমতল আদিবাসীদের জন্যে কোন মন্ত্রণালয় না থাকায় সার্বিক উন্নয়ন থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে।

ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী উপজেলা হালুয়াঘাটের আঁচকিপাড়া, ঝলঝলিয়া, জখমকূড়া, বুটিয়া পাড়া, গাবড়াখালি, ঘিলাভূই, শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ীর পানিহাতা, বারোমারী, নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর, কলমাকান্দাসহ আশপাশের উপজেলার আদিবাসীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি থাকলেও সামগ্রীকভাবে তাদের আর্থিক অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হচ্ছে না। আদিবাসীর বিভিন্ন সম্প্রাদায়ের মধ্যে ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলায় গারো, হাজং, কোচ, বানাই, হদি, বর্মন ও বংশীসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে গারো সম্প্র্রদায়ের বিভিন্ন গোত্রের পরিবারই বেশি। এসব এলাকায় দু-চারটি পরিবার ছাড়া বেশিরভাগ আদিবাসীরা কায়িক পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। এসব সীমান্তের সমতল অঞ্চলের গারোদের জীবনমানে প্রতিনিয়ত চলছে বাঁচার লড়াই। এখানে নেই কোন জীবিকার উৎস। শুধু মাত্র কৃষির ওপর নির্ভর করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। গারো সম্প্রদায়ের মধ্যে আদি থেকেই মাতৃতান্ত্রিক প্রথা চালু থাকায় পরিবারের নারীরাই জীবিকার কাজ করে। এক সময় কৃষি কাজ ছাড়াও নারীরা বন থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাকি অংশ বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করা ছিল নিয়মিত আয়ের উৎস। বর্তমানে বন বিভাগের নিষেধাজ্ঞার কারণে কাঠ সংগ্রগেহর কাজ এখন আর তারা করতে পারে না। ফলে নারীরা এখন ক্ষেতে খামারে কাজ করার পাশপাশি ছোট আকারে ব্যবসা করেও তারা জীবিকা নির্বাহ করছে। ধোবাউড়া উপজেলার ঘোষগাঁও ইউনিয়নের চন্দ্রকোনা গ্রামের বিধবা গারো নারী নিশা রানী চংখেং স্বামী মারা যাওয়ার পর ২০ বছর ধরে চন্দ্রকোনা বাজারে চায়ের দোকার করে তার এক ছেলে ও এক মেয়েকে পড়ালেখা করাচ্ছে। নিশা রানি চংখেং জানান, স্বামী ছাড়া তার সংসার টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে চললেও এখানে চায়ের দোকান করে ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে তার কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি। নিশা রানীর প্রতিবেশী মুরগির খামারের মালিক জালাল উদ্দিন জানান, আমরা একে অপরের যে কোন কাজে সারা দিই। নিশা রানীর মতো এ এলাকায় অনেক গারো নারীরা কৃষিকাজ ছাড়াও ছোটখাঠো ব্যবসা বাণিজ্য করে সংসার চালাচ্ছে। সেখানে কাজের ক্ষেত্রে নারীর সম্মান রক্ষা বা সাম্প্রদায়িক কোন সমস্যায় তাদের পড়তে হয় না। এসব এলাকায় কর্মসংস্থানে কোন উৎস না থাকায় অত্যন্ত পরিশ্রমী গারো নারীরা সাবলম্বী হতে চাইলেও তা পারছে না। কিছুদিন আগে এ অঞ্চলে বেশকিছু এনজিও কাজ করায় সেখানে আদিবাসীদের এটা বিরাট অংশের কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল। বর্তমানে সে অঞ্চলে এনজিওগুলো তাদের কর্মকা- প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এ অঞ্চলে এ যাবৎ কোন শিল্পকারখানাও গড়ে উঠেনি। কোন উদ্যোক্তা নেই। ব্যক্তিপর্যায় কিছু ক্ষুদ্র কুঠির শিল্প, মাছ ও পশু পালন খামার থাকলেও তা অপ্রতুল। এসব ব্যাপারে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন বলে জানান আদিবাসী ক্ষুদ্র কুঠির শিল্প উদ্যোক্তারা। এ ব্যাপারে ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্যে আলাদা মন্ত্রণালয় থাকলেও এ অঞ্চলের সমতল আদিবাসীদের জন্যে নেই কোন মন্ত্রণালয়। ফলে পাহড়ি আদিবাসীরা যে সুবিধা ভোগ করে তা এ অঞ্চলের আদিবাসীরা পাচ্ছে না। নিজস্ব মন্ত্রণালয় থাকায় পাহাড়ি আদিবাসীদের উন্নয়নে প্রতি অর্থ বছরেই অর্থ বরাদ্দ থাকলেও সমতল আদিবাসীরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সমতল আদিবাসীদের জন্যে ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণ তহবিল থেকে কিছু থোক বরাদ্দ পেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। যা টেকসই উন্নয়নে কাজে লাগে না। তবে বর্তমানে গারো সম্প্রদায়ের শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত বেশিরভাগ তরুন-তরুণীই এখন শহরমুখী। তারা ঢাকা, ময়মনসিংহ শহর ছাড়াও দেশের বড় বড় শহরে মেয়েরা পার্লারে অথবা গার্মেন্ট কারখানায় আর ছেলেরা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় সিকিউরিটি গার্ড বা অফিস সহকারীরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেও কাজ করছে। এতে সংসারে খরচ ছাড়াও ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে নিজেরা স্বাবলম্বী হচ্ছে। এ ব্যাপারে গারো সম্প্রদায়ের আর এক বিধবা নারী কবিতা আজমী জানান, তার দুুই মেয়ে পার্লারে কাজ করে। একজন রংপুর অন্যজন নারায়ণগঞ্জে। মেয়েদের আয়ের টাকায়ই তার সংসার চলে। তিনি আরও বলেন, তাদের কাজের জায়গায় তার মেয়েরা সম্পূর্ণ নিরাপদ ও সম্মানের সঙ্গেই কাজ করছে। ভালোমুনিরা মানমিত্র নামে আর এক নারী জানান, তার স্বামী ঢাকা শহরে সিকিউরিটি গার্ডেরও চাকরি করেন। তিনি বাড়িতে থেকে ছেলে মেয়েদের স্বাচ্ছন্দ্যে লেখাপড়া করাচ্ছেন।

এসব অঞ্চলের আদিবাসীরা বাংলা শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। নিজেদের ভাষা থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সে ভাষা প্রচলিত নয়। তাই শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা মাধ্যমেই তারা শিক্ষিত হচ্ছে। তবে তারা বাংলা ভাষাভাষীদের সঙ্গে কথা বলার সময় বাংলা ভাষা ব্যবহার করে নিজেদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করে। তবে এসব এলাকার আদিবাসিদের মধ্যে শিক্ষার হার অনেকাংশে বেড়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এসব এলাকায় রয়েছে। তবে উচ্চশিক্ষার জন্য তাদের বিভিন্ন শহরে যেতে হয়। এসব ব্যাপারে বাংলাদেশ ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও গারো সমাজ নিয়ে গবেষণার কাজে লিপ্ত জেমস জর্নেশ চিরাণ বলেন, একেবারে দুর্গম এলাকা ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই এ রকম বলা যাবে না। এসব এলাকার আদিবাসীদের শিক্ষার হার বেড়েছে কিন্তু সুযোগের অভাব ও আর্থিক অভাব অনটনের কারণে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না। তবে তিনি নিজস্ব ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের নিজস্ব ভাষা হারিয়ে যেতে বসেছে। তিনি বলেন, আমাদের এই অঞ্চলে প্রচলিত ভাষার নাম ‘আবেং’ ভাষা। যদিও সরকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (সরকার ঘোষিত সম্প্রদায়) এর ভাষা সংরক্ষণের জন্য সরকারি উদ্যোগে আদিবাসী বই প্রকাশ করে আমদের এ অঞ্চলে সরবরাহ করছে। তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এছাড়া এই ভাষা শিক্ষা দেয়ার মতো আমাদের কোন শিক্ষক নেই। এ ভাষা শিক্ষা দেয়ার জন্যে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। তাছাড় যে ভাষায় এই বইগুলো প্রকাশ করা হয়েছে তা আমাদের প্রচলিত ভাষা ‘আবেং’ ভাষা নয়। এটি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিভিন্ন আদিবাসী ভাষার সংকলিত একটি রূপ যার নাম “আচিক” ভাষা। এই ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে আমাদের অঞ্চলের আদিবাসীদের প্রচলিত ভাষার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। তিনি বলেন, আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার সরকারের উদ্যোগটি এখনো সভা-সেমিনারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।

ভাষার মতোই গারোদের মধ্যে মিশ্র সংস্কৃতি বিরাজমান। এ অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি গঠনে ভূমিকা রেখেছে। বিভিন্ন উপজাতি গারো, হাজং, বানাই, কোচ, ডালু, হদি, আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি ঐতিহ্য ধরে রেখে, তাদের কৃষ্টি কালচার আজো বিদ্যমান। গারোদের কিছু কিছু অনুষ্ঠান যেমন- ওয়াংগালা, আগাল মাকাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান ধুমধাম করে পালিত হয়। তাদের প্রচলিত সংগীত চর্চায় আজও জারি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, গানের সংস্কৃতির ধারা অব্যাহত রেখেছে। পোশাক সংস্কৃতির ঐতিহ্যে তারা শাড়ির বদলে বাড়িতে বোনা দকমান্দা, দকশাড়ি, বাগেশ এসব পোশাক পরিধান করে। পুরুষরা সাধারণত দকশাড়ি পড়ে। ময়মনসিংহ অঞ্চলে বসবাসকারী গারো সংস্কৃতির প্রধান উৎসব ওয়াংগালা। এটি নতুন ফসল ঘরে তোলার উৎসবও বলা হয়। সাধারণত শীতের শুরুতে এই অনুষ্ঠানটি বেশ ধুমধাম করে পালন করা হয়। এসব আচার অনুষ্ঠানে বাঙালি মুসলমানদের অবাদ বিচরণ রয়েছে। প্রশাসনিকভাবেও এসব অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা জোরদার করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করে।

গারো সমাজের গকেষক জেমস জর্নেশ চিরাণ জানান, এ অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষ ক্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। সারা বছরেই তারা খ্রিস্টান দর্মীয় আচার আচরণ নিশ্চিন্তে পালন করে। তিনি বলেন, এ অঞ্চলে জাতিগত বিবাধ কোন দিনই ছিল না, এখনও নেই। তবে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা যে ঘটে না তা নয়। সেটা ব্যক্তি পর্যায় জমি সক্রান্ত বা ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে কিছু বিবাধ মাঝে মধ্যে ঘটে। তবে জাতিগত বা সাম্প্রদায়িক কোন অস্থিরতা এ অঞ্চলে নেই।