মুজিব শাসন আমল : ১৯৭২

১৫ ফেব্রুয়ারি

সার্জেন্ট জহুরুলের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে হবে

শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের একমাত্র উপায় হলো তার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্যে কাজ করা। তার স্বপ্নের দেশ বাংলাকে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং নির্ভেজাল জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা। মঙ্গলবার শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্র জমায়েতে বাংলার সংগ্রামী ছাত্রসমাজ এ কথা বলেন।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সভাপতি জনাব আ স ম আবদুর রব শহীদ জহুরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকালে এ মন্তব্য করেন। তারা সার্জেন্ট জহুরুলের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার দৃপ্ত শপথও গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিক সার্জেন্ট জহুরুল হকের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী মঙ্গলবার। রাজধানী ঢাকায় যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয়েছে।

সার্জেন্ট জহুরুল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন। প্রহসনমূলক বিচার চলাকালীন জঙ্গিবাহিনী তাকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে গুলি করে হত্যা করে এই দিনে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদের মাজারে সার্জেন্ট জহুরুলের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে ফাতেহা পাঠ করেন। এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর গতকালের প্রথম কাজ। তার। সঙ্গে ছিলেন শহীদ সার্জেন্ট জহুরের মাতা-পিতা এবং নিকটতম বন্ধুগণ। এছাড়াও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুস সামাদ আজাদও শহীদের মাজারে শপথ গ্রহণ, ফাতেহা পাঠ ও পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ দিনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলা ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এবং আলিয়া মাদ্রাসা ছাত্রলীগ। শহীদ সার্জেন্ট জহুর দিবস পালন করেছেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কর্মীগণ ভোর পাঁচটায় প্রভাত ফেরী করে শহীদের মাজারে গমন করে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন। তারা শহীদের বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার আত্মার শান্তি কামনা করেন। তারপর মিছিলসহকারে তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েত হন। সেখানে তারা শহীদ জহুরুলের নির্দেশিত পথে সকল মানুষের জন্য একটি শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করার শপথ গ্রহণ করেছেন। তারপর একটি মিছিলসহকারে তারা শহর প্রদিক্ষণ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

কানাডার স্বীকৃতি

অটোয়া। কানাডা বাংলাদেশকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। রয়টার পরিবেশিত খবরে বলা হয় যে, বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দানকারী কমনওয়েলথ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কানাডাই সর্বশেষ বৃহৎ রাষ্ট্র। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে প্রেরিত এক বাণীতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী মি. ট্রুডো এই আশা প্রকাশ করেন যে, দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কে সম্প্রীতি ও পারস্পরিক উপকারিতা প্রমাণিত হবে। অপরদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইকেল সার্ক বলেন যে, ঢাকায় এখনো কানাডীয় রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়নি। তবে প্রতিবেশি রাষ্ট্রে নিযুক্ত একজন কূটনীতিক ঢাকায় রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হবে। বাংলাদেশকে যেসব কমনওয়েলথভুক্ত দেশ এখনো স্বীকৃতি দেয়নি তারা হলো, সিংহল, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর এবং আফ্রিকার প্রায় এক ডজন দেশ।

রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও কায়েমি স্বার্থ

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ সম্পর্কে আজ আর কোনো দ্বিমত নেই। বঙ্গবন্ধু সরকার গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জোট নিরপেক্ষ পরাষ্ট্রনীতিকে রাষ্ট্রীয় আদেশের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠন এবং বুদ্ধিজীবীসহ সমাজের সকল মতের লোক সরকারের উপরোক্ত মূলনীতিগুলোকে সমর্থন করেছেন। কেউই এর বিরুদ্ধে আপত্তি করেননি। সবাই চান এই মৌল আদর্শের ভিত্তিতে নিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে কাজ করে যতশীঘ্র সম্ভব শোষণমুক্ত সমৃদ্ধশালী নতুন সমাজ ব্যবস্থা বাংলাদেশে গড়ে উঠুক। সকলেরই আশা বঙ্গবন্ধুর সরকার যে চারটি নীতি সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছেন তা পরিপূর্ণ সাফল্যমণ্ডিত হয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবন শোষণ, বঞ্চনা এবং দুঃখ-দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হোক- বাংলাদেশ নতুন জীবনের কলকাকলীতে মুখর হয়ে উঠুক।

এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, কোনো ভালো আদর্শ গ্রহণ করলেই যে তা আপনা আপনি বাস্তবায়িত হবে তার কোনো মানে নেই। আদর্শ রূপায়নের জন্য চাই সুষ্ঠু পরিকল্পনা, দক্ষ ও কর্তব্যপরায়ণ প্রশাসন ব্যবস্থা, উপযুক্ত সাংগঠনিক কাঠামো এবং একাগ্রতা ও নিষ্ঠা। এগুলোর যে কোনো একটার অভাব ঘটলে আদর্শের বাস্তবায়ন এবং দেশের পুনর্গঠন সম্ভবপর নয়। এসব বিষয়ে আমাদের সরকারের আন্তরিকতার কোনো অভাব আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও বাস্তবে এমন সব সমস্যা থাকতে পারে যা সরকারের আন্তরিকতাকে ভ-ুল করে দিতে পারে। সরকারি কর্মচারীদের দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার অভাব এবং দুর্নীতিদুষ্ট মনোবৃত্তির কথা এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বঙ্গবন্ধু বলেছেন- ‘বাংলাদেশ থেকে ঘুষ, দুর্নীতি আর শোষণ মুছে যাক। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুষ, দুর্নীতি এবং শোষণ মুছে যায়নি। সরকারি প্রশাসন যন্ত্র থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরে স্বার্থবাদী মহল এখনো ঘুষ, দুর্নীতি ও শোষণের ছিদ্রপথ তৈরি করে যাচ্ছে বলে হরহামেশা অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। দুর্নীতি এমনই একটি মারাত্মক ব্যাধি যে বঙ্গবন্ধু বা মন্ত্রিসভার শুভকামনা করলেই এতো বড় রোগটা সেরে যাবে না। রোগ নিরাময়ের জন্য উপযুক্ত দাওয়াইয়েরও ব্যবস্থা করা দরকার।’

যে রাষ্ট্রীয় আদর্শের কথা সবাই বলছেন তাকে বাস্তবে রূপায়ণের পথে দুর্নীতি সর্বাধিক মারাত্মক বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এতে কোনোই সন্দেহ নেই। দুর্নীতির ভূতকে সম্পূর্ণভাবে না তাড়ানো পর্যন্ত সমাজবাদী অর্থনীতি কায়েমের পথে অগ্র পদক্ষেপ নিয়ে কোনোই লাভ হবে না। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গর্ভেই দুর্নীতির জন্ম। তাই সমাজে যতদিন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বহাল থাকবে দুর্নীতি ততদিন টিকে থাকবে। কাজেই সমাজবাদী ব্যবস্থা কায়েমের উদ্যোগ নেবার সঙ্গে সঙ্গেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভিতটাকেও ভেঙে ফেলার কর্মসূচি নিতে হবে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সমাজে বিভিন্ন রকমের কায়েমি স্বার্থবাদী শ্রেণীর জন্ম দিয়েছে এবং যতদিন পুঁজিবাদী কাঠামো বহাল থাকবে এই কায়েমী স্বার্থবাদী শ্রেণীগুলোও ততদিন বেঁচে থাকবে। জনসাধারণের রক্ত চুষে খেয়েই কায়েমী স্বার্থবাদীরা ভুড়ি মোটা করে এবং ঘুষ ও দুর্নীতি হচ্ছে জনসাধারণের রক্ত চোষার একটা সহজ উপায়। তাই দেশে যতদিন কায়েমী স্বার্থবাদী শ্রেণীগুলো বেঁচে থাকবে দুর্নীতিও ততদিন বহাল তবিয়তে টিকে থাকবে। কাজেই দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। আগে কায়েমী স্বার্থবাদীদের শিরদাঁড়া ভেঙে ফেলা দরকার।

সরকারি আমলারা কায়েমী স্বার্থেরই একটা বিশেষ রূপ। আমাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে বিরাজমান কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীগুলো জনসাধারণকে শোষণ করার সুযোগ পায়। কাজেই সমাজের বুক থেকেই কায়েমী স্বার্থকে উৎখাত করার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সরকারি প্রশাসন যন্ত্রকে কায়েমী স্বার্থের কজা থেকে মুক্ত করা। অতএব দেখা যাচ্ছে যে সরকারি প্রশাসন যন্ত্র যতদিন পর্যন্ত কায়েমী স্বার্থবাদীদের কব্জা থেকে মুক্ত না হবে ততদিন কায়েমী স্বার্থের অভিশাপ থেকে দেশ মুক্ত হতে পারবে না। তাই সকলের আগে যে কাজটা করা দরকার, সেটা হলো সরকারি প্রশাসন। যন্ত্রের আমূল সংস্কার সাধন। আমরা আশা করি, শোষণ ও দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে দেশকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করার স্বার্থে বঙ্গবন্ধুর সরকার সর্বাগ্রে সরকারি প্রশাসন যন্ত্রকে ধোলাই করার যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এভাবেই শুধু প্রশাসন ব্যবস্থা দুর্নীতিমুক্ত হতে পারবে এবং কায়েমীস্বার্থের ভূতও শাসন যন্ত্র থেকে বিদায় নেবে। কেবলমাত্র তারপরেই রাষ্ট্রীয় আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হবে- তার আগে নয়। সুতরাং এ বিষয়টার ওপর যথোপুযোক্ত। গুরুত্ব আরোপ করার জন্যে আমরা সরকারের জরুরি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

সংকীর্ণতার মধ্যে জাতীয় পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করুন- সৈয়দ নজরুল ইসলাম

ঢাকা। বাংলাদেশ সরকারের শিল্প ও প্রাকৃতিক দপ্তরের মন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে বীর সৈনিকের ভূমিকা পালনের জন্য দেশের শ্রমিক নেতা এবং শিল্প শ্রমিকদের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের সর্বত্র শিল্প কারখানগুলোতে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ইতোমধ্যেই এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। কোনো কোনো কলকারখানায় স্থানীয় ও অস্থানীয় শ্রমিকদের মধ্যে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি এবং জেলাগত সংকীর্ণতার খবর বঙ্গবন্ধু এবং আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বাংলাদেশের সব নাগরিকেরই সর্বত্র সব প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অধিকার আছে এবং এ ব্যাপারে স্থানীয় ও অস্থানীয় বা জেলাগত সংকীর্ণতার কোনো স্থান নেই। সে যেখানেরই অধিবাসী হোন না কেন, আমাদের একমাত্র পরিচয় আমরা বাঙালি।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শ্রমিক ভাইদের প্রতি বাঙালি হিসেবে প্রত্যেককে বাংলাদেশের পুনর্গঠনের আত্মনিয়োগ করার আবেদন জানিয়েছেন। বর্তমানে আমরা দেশকে পুনর্গঠনের কাজে ব্যাপৃত রয়েছি। এই মুহূর্তে এই ধরনের সংকীর্ণতা আমাদের অগ্রগতিকে ব্যাহত করুক তা বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রেত নয়। তাই সকল শিল্প এলাকার শ্রমিক নেতৃবৃন্দ এবং শ্রমিক ভাইদের প্রতি সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে দেশ পুনর্গঠনের কাজে সাহসী সৈনিকের ভূমিকা পালনের জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। অতপর আর কোথাও জেলাগত সংকীর্ণতা যেন সমস্যা হিসেবে দেখা না দেয়। সে ব্যাপারে নজর রাখার জন্যও শ্রমিক নেতা, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীবৃন্দের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি।

সূত্র : দিনলিপি, বঙ্গবন্ধুর শাসন সময়, ১৯৭২

বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৬ ফল্গুন ১৪২৬, ২৪ জমাদিউল সানি ১৪৪১

মুজিব শতবর্ষ

মুজিব শাসন আমল : ১৯৭২

১৫ ফেব্রুয়ারি

সার্জেন্ট জহুরুলের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে হবে

শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের একমাত্র উপায় হলো তার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্যে কাজ করা। তার স্বপ্নের দেশ বাংলাকে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং নির্ভেজাল জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা। মঙ্গলবার শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্র জমায়েতে বাংলার সংগ্রামী ছাত্রসমাজ এ কথা বলেন।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সভাপতি জনাব আ স ম আবদুর রব শহীদ জহুরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকালে এ মন্তব্য করেন। তারা সার্জেন্ট জহুরুলের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার দৃপ্ত শপথও গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিক সার্জেন্ট জহুরুল হকের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী মঙ্গলবার। রাজধানী ঢাকায় যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয়েছে।

সার্জেন্ট জহুরুল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন। প্রহসনমূলক বিচার চলাকালীন জঙ্গিবাহিনী তাকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে গুলি করে হত্যা করে এই দিনে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদের মাজারে সার্জেন্ট জহুরুলের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে ফাতেহা পাঠ করেন। এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর গতকালের প্রথম কাজ। তার। সঙ্গে ছিলেন শহীদ সার্জেন্ট জহুরের মাতা-পিতা এবং নিকটতম বন্ধুগণ। এছাড়াও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুস সামাদ আজাদও শহীদের মাজারে শপথ গ্রহণ, ফাতেহা পাঠ ও পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ দিনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলা ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এবং আলিয়া মাদ্রাসা ছাত্রলীগ। শহীদ সার্জেন্ট জহুর দিবস পালন করেছেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কর্মীগণ ভোর পাঁচটায় প্রভাত ফেরী করে শহীদের মাজারে গমন করে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন। তারা শহীদের বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার আত্মার শান্তি কামনা করেন। তারপর মিছিলসহকারে তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েত হন। সেখানে তারা শহীদ জহুরুলের নির্দেশিত পথে সকল মানুষের জন্য একটি শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করার শপথ গ্রহণ করেছেন। তারপর একটি মিছিলসহকারে তারা শহর প্রদিক্ষণ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

কানাডার স্বীকৃতি

অটোয়া। কানাডা বাংলাদেশকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। রয়টার পরিবেশিত খবরে বলা হয় যে, বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দানকারী কমনওয়েলথ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কানাডাই সর্বশেষ বৃহৎ রাষ্ট্র। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে প্রেরিত এক বাণীতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী মি. ট্রুডো এই আশা প্রকাশ করেন যে, দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কে সম্প্রীতি ও পারস্পরিক উপকারিতা প্রমাণিত হবে। অপরদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইকেল সার্ক বলেন যে, ঢাকায় এখনো কানাডীয় রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়নি। তবে প্রতিবেশি রাষ্ট্রে নিযুক্ত একজন কূটনীতিক ঢাকায় রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হবে। বাংলাদেশকে যেসব কমনওয়েলথভুক্ত দেশ এখনো স্বীকৃতি দেয়নি তারা হলো, সিংহল, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর এবং আফ্রিকার প্রায় এক ডজন দেশ।

রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও কায়েমি স্বার্থ

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ সম্পর্কে আজ আর কোনো দ্বিমত নেই। বঙ্গবন্ধু সরকার গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জোট নিরপেক্ষ পরাষ্ট্রনীতিকে রাষ্ট্রীয় আদেশের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠন এবং বুদ্ধিজীবীসহ সমাজের সকল মতের লোক সরকারের উপরোক্ত মূলনীতিগুলোকে সমর্থন করেছেন। কেউই এর বিরুদ্ধে আপত্তি করেননি। সবাই চান এই মৌল আদর্শের ভিত্তিতে নিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে কাজ করে যতশীঘ্র সম্ভব শোষণমুক্ত সমৃদ্ধশালী নতুন সমাজ ব্যবস্থা বাংলাদেশে গড়ে উঠুক। সকলেরই আশা বঙ্গবন্ধুর সরকার যে চারটি নীতি সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছেন তা পরিপূর্ণ সাফল্যমণ্ডিত হয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবন শোষণ, বঞ্চনা এবং দুঃখ-দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হোক- বাংলাদেশ নতুন জীবনের কলকাকলীতে মুখর হয়ে উঠুক।

এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, কোনো ভালো আদর্শ গ্রহণ করলেই যে তা আপনা আপনি বাস্তবায়িত হবে তার কোনো মানে নেই। আদর্শ রূপায়নের জন্য চাই সুষ্ঠু পরিকল্পনা, দক্ষ ও কর্তব্যপরায়ণ প্রশাসন ব্যবস্থা, উপযুক্ত সাংগঠনিক কাঠামো এবং একাগ্রতা ও নিষ্ঠা। এগুলোর যে কোনো একটার অভাব ঘটলে আদর্শের বাস্তবায়ন এবং দেশের পুনর্গঠন সম্ভবপর নয়। এসব বিষয়ে আমাদের সরকারের আন্তরিকতার কোনো অভাব আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও বাস্তবে এমন সব সমস্যা থাকতে পারে যা সরকারের আন্তরিকতাকে ভ-ুল করে দিতে পারে। সরকারি কর্মচারীদের দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার অভাব এবং দুর্নীতিদুষ্ট মনোবৃত্তির কথা এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বঙ্গবন্ধু বলেছেন- ‘বাংলাদেশ থেকে ঘুষ, দুর্নীতি আর শোষণ মুছে যাক। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুষ, দুর্নীতি এবং শোষণ মুছে যায়নি। সরকারি প্রশাসন যন্ত্র থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরে স্বার্থবাদী মহল এখনো ঘুষ, দুর্নীতি ও শোষণের ছিদ্রপথ তৈরি করে যাচ্ছে বলে হরহামেশা অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। দুর্নীতি এমনই একটি মারাত্মক ব্যাধি যে বঙ্গবন্ধু বা মন্ত্রিসভার শুভকামনা করলেই এতো বড় রোগটা সেরে যাবে না। রোগ নিরাময়ের জন্য উপযুক্ত দাওয়াইয়েরও ব্যবস্থা করা দরকার।’

যে রাষ্ট্রীয় আদর্শের কথা সবাই বলছেন তাকে বাস্তবে রূপায়ণের পথে দুর্নীতি সর্বাধিক মারাত্মক বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এতে কোনোই সন্দেহ নেই। দুর্নীতির ভূতকে সম্পূর্ণভাবে না তাড়ানো পর্যন্ত সমাজবাদী অর্থনীতি কায়েমের পথে অগ্র পদক্ষেপ নিয়ে কোনোই লাভ হবে না। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গর্ভেই দুর্নীতির জন্ম। তাই সমাজে যতদিন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বহাল থাকবে দুর্নীতি ততদিন টিকে থাকবে। কাজেই সমাজবাদী ব্যবস্থা কায়েমের উদ্যোগ নেবার সঙ্গে সঙ্গেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভিতটাকেও ভেঙে ফেলার কর্মসূচি নিতে হবে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সমাজে বিভিন্ন রকমের কায়েমি স্বার্থবাদী শ্রেণীর জন্ম দিয়েছে এবং যতদিন পুঁজিবাদী কাঠামো বহাল থাকবে এই কায়েমী স্বার্থবাদী শ্রেণীগুলোও ততদিন বেঁচে থাকবে। জনসাধারণের রক্ত চুষে খেয়েই কায়েমী স্বার্থবাদীরা ভুড়ি মোটা করে এবং ঘুষ ও দুর্নীতি হচ্ছে জনসাধারণের রক্ত চোষার একটা সহজ উপায়। তাই দেশে যতদিন কায়েমী স্বার্থবাদী শ্রেণীগুলো বেঁচে থাকবে দুর্নীতিও ততদিন বহাল তবিয়তে টিকে থাকবে। কাজেই দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। আগে কায়েমী স্বার্থবাদীদের শিরদাঁড়া ভেঙে ফেলা দরকার।

সরকারি আমলারা কায়েমী স্বার্থেরই একটা বিশেষ রূপ। আমাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে বিরাজমান কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীগুলো জনসাধারণকে শোষণ করার সুযোগ পায়। কাজেই সমাজের বুক থেকেই কায়েমী স্বার্থকে উৎখাত করার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সরকারি প্রশাসন যন্ত্রকে কায়েমী স্বার্থের কজা থেকে মুক্ত করা। অতএব দেখা যাচ্ছে যে সরকারি প্রশাসন যন্ত্র যতদিন পর্যন্ত কায়েমী স্বার্থবাদীদের কব্জা থেকে মুক্ত না হবে ততদিন কায়েমী স্বার্থের অভিশাপ থেকে দেশ মুক্ত হতে পারবে না। তাই সকলের আগে যে কাজটা করা দরকার, সেটা হলো সরকারি প্রশাসন। যন্ত্রের আমূল সংস্কার সাধন। আমরা আশা করি, শোষণ ও দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে দেশকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করার স্বার্থে বঙ্গবন্ধুর সরকার সর্বাগ্রে সরকারি প্রশাসন যন্ত্রকে ধোলাই করার যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এভাবেই শুধু প্রশাসন ব্যবস্থা দুর্নীতিমুক্ত হতে পারবে এবং কায়েমীস্বার্থের ভূতও শাসন যন্ত্র থেকে বিদায় নেবে। কেবলমাত্র তারপরেই রাষ্ট্রীয় আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হবে- তার আগে নয়। সুতরাং এ বিষয়টার ওপর যথোপুযোক্ত। গুরুত্ব আরোপ করার জন্যে আমরা সরকারের জরুরি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

সংকীর্ণতার মধ্যে জাতীয় পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করুন- সৈয়দ নজরুল ইসলাম

ঢাকা। বাংলাদেশ সরকারের শিল্প ও প্রাকৃতিক দপ্তরের মন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে বীর সৈনিকের ভূমিকা পালনের জন্য দেশের শ্রমিক নেতা এবং শিল্প শ্রমিকদের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের সর্বত্র শিল্প কারখানগুলোতে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ইতোমধ্যেই এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। কোনো কোনো কলকারখানায় স্থানীয় ও অস্থানীয় শ্রমিকদের মধ্যে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি এবং জেলাগত সংকীর্ণতার খবর বঙ্গবন্ধু এবং আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বাংলাদেশের সব নাগরিকেরই সর্বত্র সব প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অধিকার আছে এবং এ ব্যাপারে স্থানীয় ও অস্থানীয় বা জেলাগত সংকীর্ণতার কোনো স্থান নেই। সে যেখানেরই অধিবাসী হোন না কেন, আমাদের একমাত্র পরিচয় আমরা বাঙালি।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শ্রমিক ভাইদের প্রতি বাঙালি হিসেবে প্রত্যেককে বাংলাদেশের পুনর্গঠনের আত্মনিয়োগ করার আবেদন জানিয়েছেন। বর্তমানে আমরা দেশকে পুনর্গঠনের কাজে ব্যাপৃত রয়েছি। এই মুহূর্তে এই ধরনের সংকীর্ণতা আমাদের অগ্রগতিকে ব্যাহত করুক তা বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রেত নয়। তাই সকল শিল্প এলাকার শ্রমিক নেতৃবৃন্দ এবং শ্রমিক ভাইদের প্রতি সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে দেশ পুনর্গঠনের কাজে সাহসী সৈনিকের ভূমিকা পালনের জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। অতপর আর কোথাও জেলাগত সংকীর্ণতা যেন সমস্যা হিসেবে দেখা না দেয়। সে ব্যাপারে নজর রাখার জন্যও শ্রমিক নেতা, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীবৃন্দের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি।

সূত্র : দিনলিপি, বঙ্গবন্ধুর শাসন সময়, ১৯৭২