শহীদ স্মরণে

চিত্রাঙ্গদা চক্রবর্তী

স্বাধীনতার পরে ৭২টা বছর কেটে গেছে। আজও দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বহু মানুষ বেঁচে আছেন। কিন্তু ভারতবাসী কি সত্যিই আজ স্বাধীন? স্বাধীনতার ৭৩তম বছরে, আজকের ভারতবর্ষে এই প্রশ্ন খুবই প্রকট হয়ে উঠেছে। কারণ সেই যন্ত্রণাকাতর মানুষজন ছাড়াও দেশের কোটি কোটি মানুষ মনে করছেন, এখন দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধে তারা শামিল হয়েছেন। আর তাই তো ভারতবর্ষের আকাশ বাতাস ক্রমেই উত্তাল হয়ে উঠছে একটি শব্দে, তা হলো ‘আজাদি’, ‘আজাদি’ আর ‘আজাদি’।

কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার পর নোটবন্দী বা ডিমনিটাইজেশন চালু করার কারণে দেশের সাধারণ মানুষ কী বিপদেই না পড়েছিল! তারপরে জিএসটি থাবা বসালো। এখন আরও বহুলাংশে, দেশের মানুষ এই সরকারের দমনপীড়নে একেবারেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কারণ দেশে বেকারের সংখ্যা সর্বোচ্চ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া, গত তিন দশকের মধ্যে আর্থিক বৃদ্ধির গতি সর্বনিম্ন, যা বাংলাদেশেরও নিচে, নতুন চাকরি সৃষ্টি হচ্ছে না, উপরন্তু পুরনোদের চাকরিও চলে যাচ্ছে। এসব জ্বলন্ত সমস্যার কারণে দেশবাসী যাতে লড়াইয়ের পথে না নামে, তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার খুব সুচতুরভাবে পরপর অন্যায় কাজ করে চলেছে। যার মধ্যে প্রধান হলো ধর্মের নামে গোটা দেশের বিভাজন, কাশ্মীরের মানুষের মতামত না নিয়ে ৩৭০ ধারা বিলোপ করা ইত্যাদি। গোটা কাশ্মীর আজ জেলখানায় পরিণত। কাশ্মীরের সাবেক তিন মুখ্যমন্ত্রী বিনাবিচারে আজও গৃহবন্দী! এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এনপিআর, এনআরসি এবং ক্যা লাগু করার অপচেষ্টা, যার বিরোধিতায় সারা দেশে অ-বিজেপি সমস্ত দল এবং কোটি কোটি মানুষ লড়াইয়ের পথে একত্র হয়েছে। লড়াইয়ের ময়দানে ছাত্র এবং মহিলাদের ভূমিকা বিশেষভাবেই উল্লেখের দাবি রাখে। উত্তরপ্রদেশ, কর্নাটক, আসাম- এই তিন রাজ্যে আগেই এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেন বা রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জি), এনপিআর (ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্ট্রার বা জাতীয় অধিবাসীপঞ্জি) ক্যা, (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট বা নাগরিকত্ত সংশোধনী আইন-২০১৯)-এর ঘোষণা করার কারণে কয়েকজন মারা গিয়েছেন। এই মৃত্যুর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নামও যুক্ত হলো! এসব কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ জেলার জলঙ্গী থানার অন্তর্গত সাহেবনগরের মানুষজন বিশেষ করে যুব সম্প্রদায় গত ১৪ ডিসেম্বর সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল বা সিএবি নামক প্রস্তাবিত জনবিরোধী বিলের বিরোধিতা করে (যেটা পরবর্তীকালে পার্লামেন্টে বিল হিসেবে পাস হয়ে সিএএ নামে চিহ্নিত হয়েছে, সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) একটি মিছিল ডেকে সাগরপাড়া গ্রামের দিকে যাওয়ার সময়, জলঙ্গী থানার পুলিশ বাহিনী বন্দুক রিভলবার উঁচিয়ে সেই মিছিলকে আটকানোর চেষ্টা করে। কেন বা কার নির্দেশে পুলিশ অমন কাজ করলো তা জানতে চাওয়ায় পুলিশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ফলে মিছিলের লোকজনও উত্তেজিত না হয়ে পারেনি। তারা পুলিশের গাড়ি ভাংচুর করে। এরপর সেই উত্তেজনাকে শান্তিপ্রিয় প্রতিবাদে পরিণত করতে ১৭ ডিসেম্বর ওই এলাকার নানাস্তরের মানুষজন একত্রিত হয়ে ‘ভারতীয় নাগরিক মঞ্চ’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করে। মৌলানা মিনারুল শেখ, শিক্ষক আবদুল জব্বার, অধ্যাপক ফয়সাল কবীর, মুদাসসর নঈম সরকার প্রমুখ ৩০ জন ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত এই নাগরিক মঞ্চে বিজেপি আর তৃণমূল ছাড়া আর সমস্ত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা যুক্ত হয়েছে। ২০ ডিসেম্বর স্থানীয় পঞ্চায়েতের মাঠে, বিপুল জনসমাগমের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উক্ত মঞ্চের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এনআরসি’র (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন) বিরোধিতা করে এটি ছিল ওই মঞ্চের ডাকা প্রথম জনসভা। উল্লেখ্য, প্রথমদিকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ওই মঞ্চ বা জনসভার বিরোধিতা করলেও পরবর্তীকালে ওই দলেরই শুভবুদ্ধি সম্পন্ন কিছু মানুষ মঞ্চের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়। যেমন তৃণমূলের সংখ্যালঘু সেলের জেলা কমিটির সদস্য গোলাম রহমান বিশ্বাস, এবং তৃণমূল শাসিত জলঙ্গী পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য নুর সেলিম শেখ প্রমুখ।

গত ২৯ জানুয়ারি মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড ওই অঞ্চলে একটি বনধ ডেকে সাহেবনগর বাজারে অবরোধ করে। ওইদিন ছিল সরস্বতী পুজো। সরস্বতী পুজোর কোন কাজে কিন্তু সেদিন বাধা দেওয়া হয়নি বলে স্থানীয় লোকেরা জানান। সময় তখন সকাল সাড়ে ৯টা। হঠাৎ করেই তৃণমূলের ব্লক সভাপতি তহিরুদ্দীন এবং স্থানীয় তৃণমূল শাসিত পঞ্চায়েত প্রধান তমান্না ইয়াসমিনের স্বামী মিল্টনের নেতৃত্বে একদল গুণ্ডা পিস্তল, বোমা ইত্যাদি নিয়ে মঞ্চের নিরস্ত্র জনগণের ওপর আক্রমণ শুরু করে। সূত্র মারফত জানা গেছে, পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়িতে যথেষ্ট বোমা, গুলি, মজুত রাখা ছিল। সেখান থেকেই প্রধানের স্বামী মিল্টন এবং তহিরুদ্দীন প্রকাশ্যে এলোপাতাড়ি গুলি ও বোমা ছুড়তে থাকে। আর অন্যান্য দলীয় গুণ্ডারা ওই মানুষজনের ওপর অবাধে লাঠিপেটা শুরু করে। লাঠির আঘাতে অনেকেই আহত হয়। তাদের মধ্যে আবদুল জব্বারের আঘাত ছিল গুরুতর। অবস্থা বেগতিক দেখে মঞ্চের লোকেরাও সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতে থাকে। সেই প্রতিরোধ দেখে মিল্টন এবং তহিরুদ্দীন প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে গুলি ও বোমা ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায়। ঠিক ওই সময় ঘটনাস্থলে অবস্থিত একটি মসজিদ পরিষ্কার করে বেরিয়ে আসছিলেন ৬৪ বছরের আনারুল বিশ্বাস। ‘স্বচক্ষে দেখলাম তহিরুদ্দীনের ছোড়া গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাবা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন’ বলে জানান আনারুলের এক ছেলে সাহারুল বিশ্বাস। প্রচণ্ড হৈ চৈ এবং গুলি বোমার শব্দে, কী হয়েছে দেখার জন্য পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়ির একদম উল্টো দিকে বসবাসকারী, নিতান্তই দরিদ্র পরিবারের ১৬ বছরের সালাউদ্দীন বাড়ি সংলগ্ন বড়ো রাস্তায় আসতেই মিল্টনের ভাই সালাউদ্দীনকে লক্ষ্য করে একটি বোমা ছোড়ে। সেই বোমা থেকে পায়ে স্পিøন্টারের আঘাতে সালাউদ্দীন রাস্তায় পড়ে গেলে মিল্টন সালাউদ্দীনের বাঁ কানের ঠিক তলায় গুলি করে এবং সেখানেই সে মারা যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শী ইমজামামুল বিশ্বাস জানান। আরও অনেকেই সেদিন বোমা, গুলির আঘাতে আহত হয়। এদের মধ্যে পালাতে গিয়ে তহিরুদ্দীনের ভাই মনসুরুদ্দীনও গুলির আঘাতে গুরুতরভাবে আহত হয়। আশ্চর্যের বিষয়, এ সমস্ত ঘটনাই পুলিশের সামনেই ঘটেছে। পুলিশ ছিল নীরব দর্শক।

ব্যক্তিগতভাবে গত ৯ ফেব্রুয়ারি গিয়েছিলাম জলঙ্গীতে। সেখানে গিয়ে জানা যায়, ২৯ জানুয়ারির পরে দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও বারোজন দোষীর কেউ ধরা পড়েনি। এমনকি দুই মৃত ব্যক্তির বাড়িতে প্রশাসনের প্রতিনিধি, স্থানীয় এমএল এবিডিও কেউই আসেনি। বা মুখ্যমন্ত্রী, যিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বটে, কোন বিবৃতিও দেননি! কোন রাজনৈতিক দলের তরফে কেউই আসেনি। সেভ ডেমোক্রেসি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক অধ্যাপক চঞ্চল চক্রবর্তীসহ চারজনের একটি প্রতিনিধি দল সর্বপ্রথম জলঙ্গীতে গিয়ে দুটি পরিবার এবং সাহেবনগর গ্রামের বেশ কয়েকজন মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। গ্রামবাসীরা পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা এবং প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করলে সেভ ডেমোক্রেসির প্রতিনিধিরা জলঙ্গী থানায় গিয়ে দেখেন একজন সিভিক পুলিশ ছাড়া কেউই থানায় নেই। তারা অপেক্ষা করে চলে আসেন। উল্লেখ্য, রাতে ফেরার পথে, আইবি বিভাগের একজন সেভ ডেমোক্রেসির রাজ্য কমিটির সদস্য, বিখ্যাত বিজ্ঞানী এবং ক্যানসারের ওষুধের অন্যতম আবিষ্কারক অধ্যাপক ডক্টর পার্থ সারথী রায়কে ফোন করে জানতে চায় যে তারা কোথায় আছেন। পার্থ বাবু বলেন তারা ট্রেনে ফিরছেন। তার কাছ থেকে জানা যায় যে সেভ ডেমোক্রেসির প্রতিনিধিরা থানায় গেলে, থানার বড়বাবু, মেজোবাবুসহ সবাই টয়লেট এবং অন্যত্র লুকিয়ে ছিলেন। পরে তারা ওই থানার ওসি, জেলার পুলিশ সুপারকে ফোন করে অবিলম্বে ১২ জন দোষীকে গ্রেপ্তার করার জন্য চাপ দেন। এই ঘটনা এবং গত ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রায় হাজার পাঁচেক গ্রামবাসী, যাদের মধ্যে তৃণমূলের বহু কর্মীও ছিলেন, থানার সামনে শান্তিপূর্ণভাবে ধরনায় বসার পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ ফেব্রুয়ারি মিল্টনকে কলকাতার রাজারহাট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। আবার এমনও শোনা যায় যে বহরমপুর থেকেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বহরমপুর থেকেই যে মিল্টন ধরা পড়েছে, এমন মতের পক্ষে কিছু সত্য কারণ রয়েছে। স্থানীয় মানুষদের কথায় মিল্টন প্রতিদিন কাশির সিরাপ পান করতো। সেদিন মিল্টন ১০০ বোতলের মতো কাশির সিরাপ নিতে এসছিল। এছাড়াও তার ঘুমের ওষুধের আসক্তিও ছিল। তবে এই প্রতিবেদন লেখার দিন পর্যন্ত অপর দোষী তহিরুদ্দীনকে কিন্তু গ্রেপ্তার করা যায়নি।

পরিতাপের বিষয়, এতবড়ো একটা ঘটনা ঘটে গেল, পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি, এনপি আর এবং ক্যা-এর বিরোধিতা করে প্রতিবাদে শামিল হওয়া প্রথম দুই ব্যক্তির মৃত্যুর পরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুঁ শব্দটি করেননি। উল্টে গত ১৪ তারিখ বিধানসভায় এই নিয়ে সিপিএম এবং কংগ্রেসের বিধায়করা সরব হলে পর তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘সরস্বতী পুজোর দিন বনধ কেন? আমরা ঘরে ঘরে সরস্বতী পুজো করি। দুর্গা পুজো, কালীপুজো ইদের দিন কি কেউ বনধ ডাকে? সাম্প্রদায়িক তাস খেলার জন্য সরস্বতী পুজোর দিন বনধ ডেকেছিলেন? ওই মৃত্যুর জন্য আপনারা দায়ী।’ এর উত্তরে কংগ্রেসের এক বিধায়ক বলেন, ‘সরস্বতী পুজোর দিন বনধ হয়েছে তো কি হয়েছে? সরস্বতী পুজো বলে গুলি চালিয়ে দেওয়া কি যুক্তিযুক্ত? মদ খেয়ে মারা গেলে টাকা দেবেন আর গুলিতে মারা গেলে টাকা দেবেন না? বিজেপি চটে যাবে বলে?’ উল্লেখ্য, রাজ্যপালের ভাষণেও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) বিরুদ্ধে অন্য রাজ্যে মৃত্যুর ঘটনার উল্লেখ থাকলেও জলঙ্গীর ঘটনা নিয়ে একটি কথাও ছিল না!

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুসলমান প্রীতির কথা সর্বজনবিদিত। তিনিই প্রথম পশ্চিমবঙ্গে ইমাম ভাতা চালু করেন। ইদের সময় রাজ্যের সর্বত্র বড়ো বড়ো হোরডিংয়ে মুসলমান লোকেদের সঙ্গে একাসনে প্রার্থন (মুসলমান নারীদের মতো) বা ইফতার করার কথা কে না জানে? মুখে তিনি মোদি, অমিত শাহ বা বিজেপি এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য জনসভায় কি ভাষণটাই না দেন! অথচ জলঙ্গীর ঘটনায়, তার দলের নেতাকর্মীরা সরাসরি যুক্ত থাকায় তিনি মুখে কুলুপ এঁটেছেন।

জলঙ্গীতে তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধান তমান্না ইয়াসমিনের স্বামী মিল্টন এবং ব্লক সভাপতি তহিরুদ্দীনের ছোড়া গুলিতে মৃত আমারুল বিশ্বাস এবং সালাউদ্দিনের রক্তের দাম বড্ড বেশি। কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বতোভাবে জনবিরোধী এনপিআর, এনআরসি এবং ক্যা-এর বিরোধিতায় সারা দেশ যখন উত্তাল, দেশের প্রায় সর্বত্র যখন শাহিনবাগের প্রতিবাদে কেঁপে উঠছে, যখন প্রতিদিন হাজারে হাজারে মানুষ পথে নেমে বিক্ষোভে, প্রতিবাদে, প্রতিরোধে সুনামি ঘটিয়ে চলছে, তখন বহু লড়াই, সংগ্রামের আঁতুড়ঘর বা পীঠস্থান পশ্চিমবঙ্গেও সেসব লড়াই, সংগ্রামে যুক্ত জনজোয়ার, কেন্দ্রে বা কয়েকটি রাজ্যের বিজেপি সরকারের কাছে রীতিমতো ভয়ের কারণ হয়ে উঠছে। ঠিক সেরকমই দেশের এক কোণে এই রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার জলঙ্গীতে, দ্বিতীয়বারের এই আজাদি বা স্বাধীনতার, যুদ্ধে গত ২৯ জানুয়ারি শাসক দলের নেতাদের গুলিতে প্রথম যে দু’জন নিরীহ মানুষ মৃত্যুবরণ করলেন, একদম সত্যতা বজায় রেখে, দেশের এই পর্বের ইতিহাস লেখা হলে, আনারুল বিশ্বাস এবং কিশোর সালাউদ্দীনের নামের আগে ‘শহীদ’ শব্দটি অবশ্যই স্থান পাবে। তাদের রক্তের ঋণ কে শোধ করবে? আজ শুভবোধসম্পন্ন মানুষজনের সঙ্গে আমিও সেই শহীদ-যুগলের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা আর প্রণাম জানাই। আর এনআরসি, এনপিআর, ক্যা-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হওয়া, আমাদের রাজ্যে প্রথম এই দুই শহীদের নাম রক্তাক্ষরে লেখা থাকবে- এমনই আশা রইলো।

বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৭ ফল্গুন ১৪২৬, ২৫ জমাদিউল সানি ১৪৪১

শহীদ স্মরণে

চিত্রাঙ্গদা চক্রবর্তী

স্বাধীনতার পরে ৭২টা বছর কেটে গেছে। আজও দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বহু মানুষ বেঁচে আছেন। কিন্তু ভারতবাসী কি সত্যিই আজ স্বাধীন? স্বাধীনতার ৭৩তম বছরে, আজকের ভারতবর্ষে এই প্রশ্ন খুবই প্রকট হয়ে উঠেছে। কারণ সেই যন্ত্রণাকাতর মানুষজন ছাড়াও দেশের কোটি কোটি মানুষ মনে করছেন, এখন দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধে তারা শামিল হয়েছেন। আর তাই তো ভারতবর্ষের আকাশ বাতাস ক্রমেই উত্তাল হয়ে উঠছে একটি শব্দে, তা হলো ‘আজাদি’, ‘আজাদি’ আর ‘আজাদি’।

কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার পর নোটবন্দী বা ডিমনিটাইজেশন চালু করার কারণে দেশের সাধারণ মানুষ কী বিপদেই না পড়েছিল! তারপরে জিএসটি থাবা বসালো। এখন আরও বহুলাংশে, দেশের মানুষ এই সরকারের দমনপীড়নে একেবারেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কারণ দেশে বেকারের সংখ্যা সর্বোচ্চ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া, গত তিন দশকের মধ্যে আর্থিক বৃদ্ধির গতি সর্বনিম্ন, যা বাংলাদেশেরও নিচে, নতুন চাকরি সৃষ্টি হচ্ছে না, উপরন্তু পুরনোদের চাকরিও চলে যাচ্ছে। এসব জ্বলন্ত সমস্যার কারণে দেশবাসী যাতে লড়াইয়ের পথে না নামে, তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার খুব সুচতুরভাবে পরপর অন্যায় কাজ করে চলেছে। যার মধ্যে প্রধান হলো ধর্মের নামে গোটা দেশের বিভাজন, কাশ্মীরের মানুষের মতামত না নিয়ে ৩৭০ ধারা বিলোপ করা ইত্যাদি। গোটা কাশ্মীর আজ জেলখানায় পরিণত। কাশ্মীরের সাবেক তিন মুখ্যমন্ত্রী বিনাবিচারে আজও গৃহবন্দী! এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এনপিআর, এনআরসি এবং ক্যা লাগু করার অপচেষ্টা, যার বিরোধিতায় সারা দেশে অ-বিজেপি সমস্ত দল এবং কোটি কোটি মানুষ লড়াইয়ের পথে একত্র হয়েছে। লড়াইয়ের ময়দানে ছাত্র এবং মহিলাদের ভূমিকা বিশেষভাবেই উল্লেখের দাবি রাখে। উত্তরপ্রদেশ, কর্নাটক, আসাম- এই তিন রাজ্যে আগেই এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেন বা রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জি), এনপিআর (ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্ট্রার বা জাতীয় অধিবাসীপঞ্জি) ক্যা, (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট বা নাগরিকত্ত সংশোধনী আইন-২০১৯)-এর ঘোষণা করার কারণে কয়েকজন মারা গিয়েছেন। এই মৃত্যুর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নামও যুক্ত হলো! এসব কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ জেলার জলঙ্গী থানার অন্তর্গত সাহেবনগরের মানুষজন বিশেষ করে যুব সম্প্রদায় গত ১৪ ডিসেম্বর সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল বা সিএবি নামক প্রস্তাবিত জনবিরোধী বিলের বিরোধিতা করে (যেটা পরবর্তীকালে পার্লামেন্টে বিল হিসেবে পাস হয়ে সিএএ নামে চিহ্নিত হয়েছে, সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) একটি মিছিল ডেকে সাগরপাড়া গ্রামের দিকে যাওয়ার সময়, জলঙ্গী থানার পুলিশ বাহিনী বন্দুক রিভলবার উঁচিয়ে সেই মিছিলকে আটকানোর চেষ্টা করে। কেন বা কার নির্দেশে পুলিশ অমন কাজ করলো তা জানতে চাওয়ায় পুলিশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ফলে মিছিলের লোকজনও উত্তেজিত না হয়ে পারেনি। তারা পুলিশের গাড়ি ভাংচুর করে। এরপর সেই উত্তেজনাকে শান্তিপ্রিয় প্রতিবাদে পরিণত করতে ১৭ ডিসেম্বর ওই এলাকার নানাস্তরের মানুষজন একত্রিত হয়ে ‘ভারতীয় নাগরিক মঞ্চ’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করে। মৌলানা মিনারুল শেখ, শিক্ষক আবদুল জব্বার, অধ্যাপক ফয়সাল কবীর, মুদাসসর নঈম সরকার প্রমুখ ৩০ জন ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত এই নাগরিক মঞ্চে বিজেপি আর তৃণমূল ছাড়া আর সমস্ত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা যুক্ত হয়েছে। ২০ ডিসেম্বর স্থানীয় পঞ্চায়েতের মাঠে, বিপুল জনসমাগমের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উক্ত মঞ্চের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এনআরসি’র (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন) বিরোধিতা করে এটি ছিল ওই মঞ্চের ডাকা প্রথম জনসভা। উল্লেখ্য, প্রথমদিকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ওই মঞ্চ বা জনসভার বিরোধিতা করলেও পরবর্তীকালে ওই দলেরই শুভবুদ্ধি সম্পন্ন কিছু মানুষ মঞ্চের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়। যেমন তৃণমূলের সংখ্যালঘু সেলের জেলা কমিটির সদস্য গোলাম রহমান বিশ্বাস, এবং তৃণমূল শাসিত জলঙ্গী পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য নুর সেলিম শেখ প্রমুখ।

গত ২৯ জানুয়ারি মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড ওই অঞ্চলে একটি বনধ ডেকে সাহেবনগর বাজারে অবরোধ করে। ওইদিন ছিল সরস্বতী পুজো। সরস্বতী পুজোর কোন কাজে কিন্তু সেদিন বাধা দেওয়া হয়নি বলে স্থানীয় লোকেরা জানান। সময় তখন সকাল সাড়ে ৯টা। হঠাৎ করেই তৃণমূলের ব্লক সভাপতি তহিরুদ্দীন এবং স্থানীয় তৃণমূল শাসিত পঞ্চায়েত প্রধান তমান্না ইয়াসমিনের স্বামী মিল্টনের নেতৃত্বে একদল গুণ্ডা পিস্তল, বোমা ইত্যাদি নিয়ে মঞ্চের নিরস্ত্র জনগণের ওপর আক্রমণ শুরু করে। সূত্র মারফত জানা গেছে, পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়িতে যথেষ্ট বোমা, গুলি, মজুত রাখা ছিল। সেখান থেকেই প্রধানের স্বামী মিল্টন এবং তহিরুদ্দীন প্রকাশ্যে এলোপাতাড়ি গুলি ও বোমা ছুড়তে থাকে। আর অন্যান্য দলীয় গুণ্ডারা ওই মানুষজনের ওপর অবাধে লাঠিপেটা শুরু করে। লাঠির আঘাতে অনেকেই আহত হয়। তাদের মধ্যে আবদুল জব্বারের আঘাত ছিল গুরুতর। অবস্থা বেগতিক দেখে মঞ্চের লোকেরাও সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতে থাকে। সেই প্রতিরোধ দেখে মিল্টন এবং তহিরুদ্দীন প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে গুলি ও বোমা ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায়। ঠিক ওই সময় ঘটনাস্থলে অবস্থিত একটি মসজিদ পরিষ্কার করে বেরিয়ে আসছিলেন ৬৪ বছরের আনারুল বিশ্বাস। ‘স্বচক্ষে দেখলাম তহিরুদ্দীনের ছোড়া গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাবা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন’ বলে জানান আনারুলের এক ছেলে সাহারুল বিশ্বাস। প্রচণ্ড হৈ চৈ এবং গুলি বোমার শব্দে, কী হয়েছে দেখার জন্য পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়ির একদম উল্টো দিকে বসবাসকারী, নিতান্তই দরিদ্র পরিবারের ১৬ বছরের সালাউদ্দীন বাড়ি সংলগ্ন বড়ো রাস্তায় আসতেই মিল্টনের ভাই সালাউদ্দীনকে লক্ষ্য করে একটি বোমা ছোড়ে। সেই বোমা থেকে পায়ে স্পিøন্টারের আঘাতে সালাউদ্দীন রাস্তায় পড়ে গেলে মিল্টন সালাউদ্দীনের বাঁ কানের ঠিক তলায় গুলি করে এবং সেখানেই সে মারা যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শী ইমজামামুল বিশ্বাস জানান। আরও অনেকেই সেদিন বোমা, গুলির আঘাতে আহত হয়। এদের মধ্যে পালাতে গিয়ে তহিরুদ্দীনের ভাই মনসুরুদ্দীনও গুলির আঘাতে গুরুতরভাবে আহত হয়। আশ্চর্যের বিষয়, এ সমস্ত ঘটনাই পুলিশের সামনেই ঘটেছে। পুলিশ ছিল নীরব দর্শক।

ব্যক্তিগতভাবে গত ৯ ফেব্রুয়ারি গিয়েছিলাম জলঙ্গীতে। সেখানে গিয়ে জানা যায়, ২৯ জানুয়ারির পরে দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও বারোজন দোষীর কেউ ধরা পড়েনি। এমনকি দুই মৃত ব্যক্তির বাড়িতে প্রশাসনের প্রতিনিধি, স্থানীয় এমএল এবিডিও কেউই আসেনি। বা মুখ্যমন্ত্রী, যিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বটে, কোন বিবৃতিও দেননি! কোন রাজনৈতিক দলের তরফে কেউই আসেনি। সেভ ডেমোক্রেসি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক অধ্যাপক চঞ্চল চক্রবর্তীসহ চারজনের একটি প্রতিনিধি দল সর্বপ্রথম জলঙ্গীতে গিয়ে দুটি পরিবার এবং সাহেবনগর গ্রামের বেশ কয়েকজন মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। গ্রামবাসীরা পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা এবং প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করলে সেভ ডেমোক্রেসির প্রতিনিধিরা জলঙ্গী থানায় গিয়ে দেখেন একজন সিভিক পুলিশ ছাড়া কেউই থানায় নেই। তারা অপেক্ষা করে চলে আসেন। উল্লেখ্য, রাতে ফেরার পথে, আইবি বিভাগের একজন সেভ ডেমোক্রেসির রাজ্য কমিটির সদস্য, বিখ্যাত বিজ্ঞানী এবং ক্যানসারের ওষুধের অন্যতম আবিষ্কারক অধ্যাপক ডক্টর পার্থ সারথী রায়কে ফোন করে জানতে চায় যে তারা কোথায় আছেন। পার্থ বাবু বলেন তারা ট্রেনে ফিরছেন। তার কাছ থেকে জানা যায় যে সেভ ডেমোক্রেসির প্রতিনিধিরা থানায় গেলে, থানার বড়বাবু, মেজোবাবুসহ সবাই টয়লেট এবং অন্যত্র লুকিয়ে ছিলেন। পরে তারা ওই থানার ওসি, জেলার পুলিশ সুপারকে ফোন করে অবিলম্বে ১২ জন দোষীকে গ্রেপ্তার করার জন্য চাপ দেন। এই ঘটনা এবং গত ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রায় হাজার পাঁচেক গ্রামবাসী, যাদের মধ্যে তৃণমূলের বহু কর্মীও ছিলেন, থানার সামনে শান্তিপূর্ণভাবে ধরনায় বসার পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ ফেব্রুয়ারি মিল্টনকে কলকাতার রাজারহাট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। আবার এমনও শোনা যায় যে বহরমপুর থেকেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বহরমপুর থেকেই যে মিল্টন ধরা পড়েছে, এমন মতের পক্ষে কিছু সত্য কারণ রয়েছে। স্থানীয় মানুষদের কথায় মিল্টন প্রতিদিন কাশির সিরাপ পান করতো। সেদিন মিল্টন ১০০ বোতলের মতো কাশির সিরাপ নিতে এসছিল। এছাড়াও তার ঘুমের ওষুধের আসক্তিও ছিল। তবে এই প্রতিবেদন লেখার দিন পর্যন্ত অপর দোষী তহিরুদ্দীনকে কিন্তু গ্রেপ্তার করা যায়নি।

পরিতাপের বিষয়, এতবড়ো একটা ঘটনা ঘটে গেল, পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি, এনপি আর এবং ক্যা-এর বিরোধিতা করে প্রতিবাদে শামিল হওয়া প্রথম দুই ব্যক্তির মৃত্যুর পরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুঁ শব্দটি করেননি। উল্টে গত ১৪ তারিখ বিধানসভায় এই নিয়ে সিপিএম এবং কংগ্রেসের বিধায়করা সরব হলে পর তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘সরস্বতী পুজোর দিন বনধ কেন? আমরা ঘরে ঘরে সরস্বতী পুজো করি। দুর্গা পুজো, কালীপুজো ইদের দিন কি কেউ বনধ ডাকে? সাম্প্রদায়িক তাস খেলার জন্য সরস্বতী পুজোর দিন বনধ ডেকেছিলেন? ওই মৃত্যুর জন্য আপনারা দায়ী।’ এর উত্তরে কংগ্রেসের এক বিধায়ক বলেন, ‘সরস্বতী পুজোর দিন বনধ হয়েছে তো কি হয়েছে? সরস্বতী পুজো বলে গুলি চালিয়ে দেওয়া কি যুক্তিযুক্ত? মদ খেয়ে মারা গেলে টাকা দেবেন আর গুলিতে মারা গেলে টাকা দেবেন না? বিজেপি চটে যাবে বলে?’ উল্লেখ্য, রাজ্যপালের ভাষণেও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) বিরুদ্ধে অন্য রাজ্যে মৃত্যুর ঘটনার উল্লেখ থাকলেও জলঙ্গীর ঘটনা নিয়ে একটি কথাও ছিল না!

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুসলমান প্রীতির কথা সর্বজনবিদিত। তিনিই প্রথম পশ্চিমবঙ্গে ইমাম ভাতা চালু করেন। ইদের সময় রাজ্যের সর্বত্র বড়ো বড়ো হোরডিংয়ে মুসলমান লোকেদের সঙ্গে একাসনে প্রার্থন (মুসলমান নারীদের মতো) বা ইফতার করার কথা কে না জানে? মুখে তিনি মোদি, অমিত শাহ বা বিজেপি এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য জনসভায় কি ভাষণটাই না দেন! অথচ জলঙ্গীর ঘটনায়, তার দলের নেতাকর্মীরা সরাসরি যুক্ত থাকায় তিনি মুখে কুলুপ এঁটেছেন।

জলঙ্গীতে তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধান তমান্না ইয়াসমিনের স্বামী মিল্টন এবং ব্লক সভাপতি তহিরুদ্দীনের ছোড়া গুলিতে মৃত আমারুল বিশ্বাস এবং সালাউদ্দিনের রক্তের দাম বড্ড বেশি। কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বতোভাবে জনবিরোধী এনপিআর, এনআরসি এবং ক্যা-এর বিরোধিতায় সারা দেশ যখন উত্তাল, দেশের প্রায় সর্বত্র যখন শাহিনবাগের প্রতিবাদে কেঁপে উঠছে, যখন প্রতিদিন হাজারে হাজারে মানুষ পথে নেমে বিক্ষোভে, প্রতিবাদে, প্রতিরোধে সুনামি ঘটিয়ে চলছে, তখন বহু লড়াই, সংগ্রামের আঁতুড়ঘর বা পীঠস্থান পশ্চিমবঙ্গেও সেসব লড়াই, সংগ্রামে যুক্ত জনজোয়ার, কেন্দ্রে বা কয়েকটি রাজ্যের বিজেপি সরকারের কাছে রীতিমতো ভয়ের কারণ হয়ে উঠছে। ঠিক সেরকমই দেশের এক কোণে এই রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার জলঙ্গীতে, দ্বিতীয়বারের এই আজাদি বা স্বাধীনতার, যুদ্ধে গত ২৯ জানুয়ারি শাসক দলের নেতাদের গুলিতে প্রথম যে দু’জন নিরীহ মানুষ মৃত্যুবরণ করলেন, একদম সত্যতা বজায় রেখে, দেশের এই পর্বের ইতিহাস লেখা হলে, আনারুল বিশ্বাস এবং কিশোর সালাউদ্দীনের নামের আগে ‘শহীদ’ শব্দটি অবশ্যই স্থান পাবে। তাদের রক্তের ঋণ কে শোধ করবে? আজ শুভবোধসম্পন্ন মানুষজনের সঙ্গে আমিও সেই শহীদ-যুগলের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা আর প্রণাম জানাই। আর এনআরসি, এনপিআর, ক্যা-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হওয়া, আমাদের রাজ্যে প্রথম এই দুই শহীদের নাম রক্তাক্ষরে লেখা থাকবে- এমনই আশা রইলো।