মুজিব শাসন আমল : ১৯৭২

১৯ ফেব্রুয়ারি

দুটি রেল সেতুর পুনর্নির্মাণ

কোনো বিদেশির সহায়তা ব্যতিরেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে চট্টগ্রাম ও উত্তরবঙ্গের মধ্যে সংযোগকারী দুটো ব্রিজ নির্দিষ্ট সময়ের পুর্বেই পুনর্নির্মাণ সমাপ্ত করেছে। পাকিস্তান সৈন্যরা উক্ত ব্রিজ দুটোর ক্ষতি সাধন করে। এই ব্রিজ দুটো হলো ফেনীর সন্নিকটে মুহুরি ব্রিজ ও জামালপুরের নিকট ঝিনাই ব্রিজ। মুহুরি ব্রিজের নয়া নামকরণ করা হয়েছে শহীদ সেতু।

এপ্রিলের মধ্যে রেলপথ চালু হবে

১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট তিনশয়েরও বেশি রেলওয়ে সেতু বিধ্বস্ত হয়। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে ইতোমধ্যেই ২৬০টিরও বেশি বিধ্বস্থ রেলওয়ে সেতুর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ৪০টি আসছে এপ্রিল মাসের মধ্যেই মেরামত হয়ে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। শনিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশের যোগাযোগমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী তার বাসভবনে এই রিপোর্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সময় এ প্রশ্নের জবাবে জানান যে, কেবলমাত্র হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, ভৈরব ব্রিজ ও তিস্তার ব্রিজ ছাড়া বাংলাদেশের বিধ্বস্থ সবগুলো সেতুই আসছে এপ্রিলের মধ্যেই পুরোপুরিভাবে মেরামত করা হবে এবং সার্বিকভাবে রেলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হবে। তিনি আরও জানান যে, ওই প্রধান প্রধান রেলওয়ে সেতু তিনটি যাতে শিগগিরই মেরামত করানো যায় তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের এবং ভারতের প্রকৌশলীবৃন্দ ইতোমধ্যেই বিধ্বস্থ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, ভৈরব ব্রিজ ও তিস্তা ব্রিজকে মেরামত করার জন্য প্রয়োজনীয় জরিপ কার্য শুরু করেছেন বলে জনাব মনসুর আলী জানান। প্রসঙ্গত: তিনি বলেন-যতদিন পর্যন্ত দেশের ওই প্রধান সেতু তিনটিকে মেরামত করে ট্রেন চলাচলের উপযুক্ত করে তোলা না যায় ততদিন পর্যন্ত ব্রিজ এলাকায় পারাপারের জন্য সুষ্ঠু ফেরি ব্যবস্থা চালু থাকবে।

শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হবে

ঢাকা। বাংলাদেশে একটা শোষণমুক্ত সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের উদ্দেশ্যে জনগণের মধ্যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি ও নেতৃত্বদানের জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করা হবে। এই উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের একটা সাংগঠনিক কমিটি গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কমিটি ৪টি আদর্শ জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের জন্যে কাজ করে যাবে। দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহক কমিটির বৈঠকে মুক্তি অর্জনের পর থেকে দেশে বিরাজমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন। স্বাধীনতা অর্জনের পর অনুষ্ঠিত কার্য নির্বাহক কমিটির এই বৈঠকে কমিটির মোট ৫৪ জন সদস্যের মধ্যে ৫০ জন উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে মুজিবনগরে সর্বশেষ বৈঠক হয়। বর্বর পাকিস্তানবাহিনী ও তাদের দালালরা গত ৯ মাসে লুট, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে দেশের যে বিপর্যয় অবস্থার সৃষ্টি করে গেছে তার পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় নীতিমালা তৈরির জন্য দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পার্টির সাংগঠনিক সমস্যাবলী নিয়ে আলোচনা করা হয়। আওয়ামী লীগ কার্য নির্বাহক কমিটি পার্টির সভাপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্বে জাতিকে একটা শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রস্তাব গ্রহণ করে। কমিটির এক প্রস্তাবে সকল স্তরের জনগণকে জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে শরীক হওয়ার আহ্বান জানান হয়েছে। প্রস্তাবে সারাদেশে ২৫ ফেব্রুয়ারি হতে জাতির পুনর্গঠন সপ্তাহ পালনের আহ্বান জানান হয়েছে। ইয়াহিয়ার দস্যুবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও অন্যান্য নৃশংশতামূলক যেসব অপরাধকার্য সাধন করেছে তার প্রতি গুরুত্ব দেবার জন্য এবং এইগুলোর পরিকল্পনা প্রণেতাদের উপযুক্ত শাস্তি দানের জন্যও ওয়ার্কিং কমিটি সরকারকে আহ্বান জানান। মুক্তি সংগ্রামে যাহারা শহীদ হয়েছেন, তাদের পরিবারবর্গকে বিশেষ করে বিধবা, অনাথ এবং বর্বরবাহিনী দ্বারা নির্যাতিতা মহিলাদের পুনর্বাসনের সম্ভাব্য সকল রকম ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্য কমিটি সরকারকে অনুরোধ জানায়। সভায় বিশ্বের শান্তিপ্রিয় দেশগুলিকে বিশেষ করে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব-ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যকে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে সমর্থন দেওয়ায় ধন্যবাদ জানানো হয়। আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহ কমিটি পাকিস্থানস্থ বাঙালিদের দুরবস্থার জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। সভার প্রস্তাবে তাদের স্বদেশে ফিরেয়ে আনার জন্যে সম্ভাব্য সকল প্রকার প্রচেষ্টা চালানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক পাকিস্তানি বাহিনীর দালালদের বিচার ও শাস্তি বিধান এবং যেসব দালাল এখনও ধরা পড়েনি তাদের অবিলম্বে আটকের সুপারিশ করে। বৈঠকে সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের নির্মূলের উদ্দেশ্যে জনগণের সহযোগিতায় সরকারের সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলা হয় যে, জাতির অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সমাজ বিরোধী ব্যক্তিরা শান্তি প্রিয় নাগরিকদের হয়রানি ও শোষণপীরণ চালিয়ে যাচ্ছে। সভায় প্রথমে মাতৃভূমির মুক্তির সংগ্রামে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা গ্রহণের জন্য অভিনন্দন জানানো হয়। কার্যনির্বাহক কমিটি মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের উদ্দেশ্যে গভীর শোক প্রকাশ করে। কার্যনির্বাহক কমিটি জেলা ও মহকুমা আওয়ামী লীগ সদস্য ও সম্পাদকদের প্রতি তাদের স্ব স্ব এলাকার নিহত, আহত ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের নাম সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় পার্টি সেক্রেটারিয়েটে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছে।

তিনটি সাব কমিটি গঠন

শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সাব কমিটি : শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী (কনভেনর), এবং জনাব রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া ও আবদুল মোমিন তালুকদার (সদস্য)।

শাষণতন্ত্র সাব কমিটি : জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী এমসিএ (কনভেনর), এবং জনাব সোহরাব হোসেন এমসিএ ও আবদুল মান্নান এমসিএ সদস্য।

মেনিফেস্টো ও পলিসি প্লানিং সাব কমিটি : আইন ও পার্লামেন্টারিবিষয়কমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন (কনভেনর), জনাব আবদুর রব সেরনিয়াবত এমসিএ এবং মিসেস নুরজাহান মোর্শেদ এমসিএ সদস্য।

খাদ্য ঘাটতি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের

দাম বেড়ে চলেছে

নয়াদিল্লি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ক্রমশঃই বেড়ে চলায় এবং দেশে দারুন খাদ্যভাব দেখা দেয়ার প্রেক্ষিতে আজ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের মন্ত্রিসভায় এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান বেতার থেকে মূল্য বৃদ্ধি রোধের জন্য কতিপয় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে প্রচার করা হলেও জনৈক সরকারি মুখপাত্র এই মূল্যবৃদ্ধিকে কৃত্রিম বলে অভিহিত করেন। আজ রাতে মুখপাত্রের উক্তি উদ্ধৃত করে পাকিস্তান বেতার থেকে বলা হয় যে, শহর এলাকায় পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুত থাকা সত্ত্বেও মজুদকারীরা এই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে। কিছুকাল থেকেই শহর এলাকায় জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে, আর পল্লী এলাকায় বর্তমানে আটা, চিনি ও ভেষজ ঘি সম্পূর্ণ দুষ্পাপ্য হয়ে উঠেছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আজ পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলি ও জনগণ সমবেতভাবে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এ অবস্থার মধ্যে আবার শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলিও তাদের উৎপাদন বন্ধ করে শ্রমিকদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে বসে আছে। এই অবস্থা দেখেই সপ্তাহখানেক আগে জনাব ভুট্টো করাচিতে বাধ্য হয়ে বলেছিলেন যে, গত ২০ ডিসেম্বরে তার হাতে ক্ষমতা আসার পর থেকে দেশে “ঘেরাও” ও “জ্বালাও” একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি শ্রমিক ও অন্যান্য এমনকি বুদ্ধিজীবীদের প্রতিও তাদের অভাব অভিযোগ নিয়ে রাস্তায় নেমে হৈ চৈ না করার আবেদন জানিয়েছেন। কাজের মধ্যে কিছুটা আন্তরিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য জনাব ভুট্টো দেশের জন্য একটা নয়া শ্রমনীতি ঘোষণা করেন। এতে শ্রমিকদের বস্তির সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সপ্তাহখানেক আগে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী, ও প্রাদেশিক প্রতিনিধিদল রাওয়ালপিন্ডিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন। গত ৯ ফেব্রুয়ারিতে রাওয়ালপিন্ডির উক্ত পর্যালোচনা বৈঠকে আটা, চিনি, কেরোসিন, ভেষজ ঘিয়ের মূল্য ও সরাহ পরিস্থিতি বিবেচনা করা হয়। এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ড. মোবাশির হাসান। তিনি এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধিতে জনাব ভুট্টোর উদ্বেগের কথা জানান।

সূত্র : দিনলিপি, বঙ্গবন্ধুর শাসন সময়, ১৯৭২

বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৭ ফল্গুন ১৪২৬, ২৫ জমাদিউল সানি ১৪৪১

মুজিব শতবর্ষ

মুজিব শাসন আমল : ১৯৭২

১৯ ফেব্রুয়ারি

দুটি রেল সেতুর পুনর্নির্মাণ

কোনো বিদেশির সহায়তা ব্যতিরেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে চট্টগ্রাম ও উত্তরবঙ্গের মধ্যে সংযোগকারী দুটো ব্রিজ নির্দিষ্ট সময়ের পুর্বেই পুনর্নির্মাণ সমাপ্ত করেছে। পাকিস্তান সৈন্যরা উক্ত ব্রিজ দুটোর ক্ষতি সাধন করে। এই ব্রিজ দুটো হলো ফেনীর সন্নিকটে মুহুরি ব্রিজ ও জামালপুরের নিকট ঝিনাই ব্রিজ। মুহুরি ব্রিজের নয়া নামকরণ করা হয়েছে শহীদ সেতু।

এপ্রিলের মধ্যে রেলপথ চালু হবে

১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট তিনশয়েরও বেশি রেলওয়ে সেতু বিধ্বস্ত হয়। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে ইতোমধ্যেই ২৬০টিরও বেশি বিধ্বস্থ রেলওয়ে সেতুর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ৪০টি আসছে এপ্রিল মাসের মধ্যেই মেরামত হয়ে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। শনিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশের যোগাযোগমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী তার বাসভবনে এই রিপোর্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সময় এ প্রশ্নের জবাবে জানান যে, কেবলমাত্র হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, ভৈরব ব্রিজ ও তিস্তার ব্রিজ ছাড়া বাংলাদেশের বিধ্বস্থ সবগুলো সেতুই আসছে এপ্রিলের মধ্যেই পুরোপুরিভাবে মেরামত করা হবে এবং সার্বিকভাবে রেলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হবে। তিনি আরও জানান যে, ওই প্রধান প্রধান রেলওয়ে সেতু তিনটি যাতে শিগগিরই মেরামত করানো যায় তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের এবং ভারতের প্রকৌশলীবৃন্দ ইতোমধ্যেই বিধ্বস্থ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, ভৈরব ব্রিজ ও তিস্তা ব্রিজকে মেরামত করার জন্য প্রয়োজনীয় জরিপ কার্য শুরু করেছেন বলে জনাব মনসুর আলী জানান। প্রসঙ্গত: তিনি বলেন-যতদিন পর্যন্ত দেশের ওই প্রধান সেতু তিনটিকে মেরামত করে ট্রেন চলাচলের উপযুক্ত করে তোলা না যায় ততদিন পর্যন্ত ব্রিজ এলাকায় পারাপারের জন্য সুষ্ঠু ফেরি ব্যবস্থা চালু থাকবে।

শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হবে

ঢাকা। বাংলাদেশে একটা শোষণমুক্ত সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের উদ্দেশ্যে জনগণের মধ্যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি ও নেতৃত্বদানের জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করা হবে। এই উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের একটা সাংগঠনিক কমিটি গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কমিটি ৪টি আদর্শ জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের জন্যে কাজ করে যাবে। দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহক কমিটির বৈঠকে মুক্তি অর্জনের পর থেকে দেশে বিরাজমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন। স্বাধীনতা অর্জনের পর অনুষ্ঠিত কার্য নির্বাহক কমিটির এই বৈঠকে কমিটির মোট ৫৪ জন সদস্যের মধ্যে ৫০ জন উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে মুজিবনগরে সর্বশেষ বৈঠক হয়। বর্বর পাকিস্তানবাহিনী ও তাদের দালালরা গত ৯ মাসে লুট, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে দেশের যে বিপর্যয় অবস্থার সৃষ্টি করে গেছে তার পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় নীতিমালা তৈরির জন্য দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পার্টির সাংগঠনিক সমস্যাবলী নিয়ে আলোচনা করা হয়। আওয়ামী লীগ কার্য নির্বাহক কমিটি পার্টির সভাপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্বে জাতিকে একটা শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রস্তাব গ্রহণ করে। কমিটির এক প্রস্তাবে সকল স্তরের জনগণকে জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে শরীক হওয়ার আহ্বান জানান হয়েছে। প্রস্তাবে সারাদেশে ২৫ ফেব্রুয়ারি হতে জাতির পুনর্গঠন সপ্তাহ পালনের আহ্বান জানান হয়েছে। ইয়াহিয়ার দস্যুবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও অন্যান্য নৃশংশতামূলক যেসব অপরাধকার্য সাধন করেছে তার প্রতি গুরুত্ব দেবার জন্য এবং এইগুলোর পরিকল্পনা প্রণেতাদের উপযুক্ত শাস্তি দানের জন্যও ওয়ার্কিং কমিটি সরকারকে আহ্বান জানান। মুক্তি সংগ্রামে যাহারা শহীদ হয়েছেন, তাদের পরিবারবর্গকে বিশেষ করে বিধবা, অনাথ এবং বর্বরবাহিনী দ্বারা নির্যাতিতা মহিলাদের পুনর্বাসনের সম্ভাব্য সকল রকম ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্য কমিটি সরকারকে অনুরোধ জানায়। সভায় বিশ্বের শান্তিপ্রিয় দেশগুলিকে বিশেষ করে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব-ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যকে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে সমর্থন দেওয়ায় ধন্যবাদ জানানো হয়। আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহ কমিটি পাকিস্থানস্থ বাঙালিদের দুরবস্থার জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। সভার প্রস্তাবে তাদের স্বদেশে ফিরেয়ে আনার জন্যে সম্ভাব্য সকল প্রকার প্রচেষ্টা চালানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক পাকিস্তানি বাহিনীর দালালদের বিচার ও শাস্তি বিধান এবং যেসব দালাল এখনও ধরা পড়েনি তাদের অবিলম্বে আটকের সুপারিশ করে। বৈঠকে সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের নির্মূলের উদ্দেশ্যে জনগণের সহযোগিতায় সরকারের সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলা হয় যে, জাতির অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সমাজ বিরোধী ব্যক্তিরা শান্তি প্রিয় নাগরিকদের হয়রানি ও শোষণপীরণ চালিয়ে যাচ্ছে। সভায় প্রথমে মাতৃভূমির মুক্তির সংগ্রামে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা গ্রহণের জন্য অভিনন্দন জানানো হয়। কার্যনির্বাহক কমিটি মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের উদ্দেশ্যে গভীর শোক প্রকাশ করে। কার্যনির্বাহক কমিটি জেলা ও মহকুমা আওয়ামী লীগ সদস্য ও সম্পাদকদের প্রতি তাদের স্ব স্ব এলাকার নিহত, আহত ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের নাম সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় পার্টি সেক্রেটারিয়েটে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছে।

তিনটি সাব কমিটি গঠন

শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সাব কমিটি : শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী (কনভেনর), এবং জনাব রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া ও আবদুল মোমিন তালুকদার (সদস্য)।

শাষণতন্ত্র সাব কমিটি : জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী এমসিএ (কনভেনর), এবং জনাব সোহরাব হোসেন এমসিএ ও আবদুল মান্নান এমসিএ সদস্য।

মেনিফেস্টো ও পলিসি প্লানিং সাব কমিটি : আইন ও পার্লামেন্টারিবিষয়কমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন (কনভেনর), জনাব আবদুর রব সেরনিয়াবত এমসিএ এবং মিসেস নুরজাহান মোর্শেদ এমসিএ সদস্য।

খাদ্য ঘাটতি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের

দাম বেড়ে চলেছে

নয়াদিল্লি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ক্রমশঃই বেড়ে চলায় এবং দেশে দারুন খাদ্যভাব দেখা দেয়ার প্রেক্ষিতে আজ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের মন্ত্রিসভায় এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান বেতার থেকে মূল্য বৃদ্ধি রোধের জন্য কতিপয় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে প্রচার করা হলেও জনৈক সরকারি মুখপাত্র এই মূল্যবৃদ্ধিকে কৃত্রিম বলে অভিহিত করেন। আজ রাতে মুখপাত্রের উক্তি উদ্ধৃত করে পাকিস্তান বেতার থেকে বলা হয় যে, শহর এলাকায় পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুত থাকা সত্ত্বেও মজুদকারীরা এই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে। কিছুকাল থেকেই শহর এলাকায় জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে, আর পল্লী এলাকায় বর্তমানে আটা, চিনি ও ভেষজ ঘি সম্পূর্ণ দুষ্পাপ্য হয়ে উঠেছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আজ পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলি ও জনগণ সমবেতভাবে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এ অবস্থার মধ্যে আবার শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলিও তাদের উৎপাদন বন্ধ করে শ্রমিকদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে বসে আছে। এই অবস্থা দেখেই সপ্তাহখানেক আগে জনাব ভুট্টো করাচিতে বাধ্য হয়ে বলেছিলেন যে, গত ২০ ডিসেম্বরে তার হাতে ক্ষমতা আসার পর থেকে দেশে “ঘেরাও” ও “জ্বালাও” একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি শ্রমিক ও অন্যান্য এমনকি বুদ্ধিজীবীদের প্রতিও তাদের অভাব অভিযোগ নিয়ে রাস্তায় নেমে হৈ চৈ না করার আবেদন জানিয়েছেন। কাজের মধ্যে কিছুটা আন্তরিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য জনাব ভুট্টো দেশের জন্য একটা নয়া শ্রমনীতি ঘোষণা করেন। এতে শ্রমিকদের বস্তির সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সপ্তাহখানেক আগে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী, ও প্রাদেশিক প্রতিনিধিদল রাওয়ালপিন্ডিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন। গত ৯ ফেব্রুয়ারিতে রাওয়ালপিন্ডির উক্ত পর্যালোচনা বৈঠকে আটা, চিনি, কেরোসিন, ভেষজ ঘিয়ের মূল্য ও সরাহ পরিস্থিতি বিবেচনা করা হয়। এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ড. মোবাশির হাসান। তিনি এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধিতে জনাব ভুট্টোর উদ্বেগের কথা জানান।

সূত্র : দিনলিপি, বঙ্গবন্ধুর শাসন সময়, ১৯৭২