প্রিয়জনের শেষ পদচিহ্নে স্বজনরা

দোকানিরা ব্যস্ত ছিলেন শেষ মুহূর্তের বেচাকেনায়, দূর থেকে আসা ব্যবসায়ী আর ক্রেতাদের ছিল ফেরার তাড়া, রাস্তায় ছিল পথচারী আর চলতি পথের যাত্রীদের ভিড়, ছিল আড্ডা, হাঁকডাক, রিকশার বেল, গাড়ির হর্ন। ঠিক এক বছর আগে, এমনই এক বসন্তের রাতে হঠাৎ বিস্ফোরণের পর নরককুণ্ডে পরিণত হয় চকবাজরের চুড়িহাট্টা মোড়। সে আগুন কেড়ে নেয় ৭১ জনের প্রাণ। সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের বছর পূর্তির দিনে বৃহস্পতিবার সকালে চুড়িহাট্টা মোড়ের পোড়া ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে হাজির হন নিহতদের স্বজনরা। বাবা এসে রাস্তার পিচে হাত বুলিয়ে যেন সন্তানের শেষ পদচিহ্নের স্পর্শ নিতে চান। স্বামী আর সন্তানের ছবি হাতে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকা এক নারীর বেদনাক্লিষ্ট চোখ দুটো বলে দেয়, তার অপেক্ষা কখনও ফুরাবার নয়। এই চুড়িহাট্টা মোড়ে এমআর টেলিকম নামে একটি দোকান চালাতেন চাঁদনীঘাটের কেবি রুদ্র রোডের দুই ভাই মাসুদ রানা ও মাহবুবুর রহমান রাজু। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে আগুনের লেলিহান শিখা যখন সবকিছু গ্রাস করে নিল, তারা আর দোকান থেকে বের হতে পারেননি।

রানা-রাজুর বাবা সাহেব উল্লাহও বৃহস্পতিবার সকালে এসেছিলেন চুড়িহাট্টা মোড়ে। দুই ছেলের দোকানের মেঝেতে হাত বুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, এখানে আমার ছেলেরা বসেছিল। বাবা মোহাম্মদ আলী আর চাচা অপু রায়হানের সঙ্গে সেই রাতে আগুনে পুড়ে লাশ হয় তিন বছরের শিশু আরাফাত আলী। চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদ মার্কেটের নিচতলায় গামছা-তোয়ালে-তসবিহসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের দোকান ছিল পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলীদের। মাঝেমধ্যেই বাসা থেকে এসে বাবা-চাচাদের সঙ্গে সময় কাটাতো ছোট্ট আরাফাত।

রাত সাড়ে ১০টার দিকে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নেয়ার মধ্যেই ঘটে সেই বিস্ফোরণ। সামান্য সময় আগে দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান আলী-অপুদের আরেক ভাই দীপু হোসেন। বৃহস্পতিবার সকালে সেই দোকানের সামনে দাঁড়ানো স্বজনদের চোখে অশ্রু বাঁধ মানছিল না। পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার মাধবখালী ইউনিয়নের সন্তোষপুর গ্রামের মো. মজিবুর রহমান হাওলাদার চুড়িহাট্টা এলাকায় ভাড়ায় ভ্যান গাড়িতে করে মালামাল পরিবহন করতেন। পুরো রাস্তা অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হলে তার আর বাঁচার পথ ছিল না। আরও অনেকের সঙ্গে মজিবুর রহমানের ছেলে সুমন হাওলাদারও বৃহস্পতিবার সকালে চুড়িহাট্টার মোড়ে ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে হাজির হয়েছিলেন। তিনি বললেন, বাবাকে হারানোর পর লেখাপড়া চালিয়ে নিতে তাকে কঠিন সংগ্রামের মধ্যে পড়তে হয়েছে।

ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে জড়ো হওয়া ক্ষতিগ্রস্ত অনেকের কণ্ঠে ছিল ক্ষোভ। বুকে কালো ব্যাজ পরে ক্ষতিপূরণের দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করছিলেন তারা। সেই রাতের প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই এসেছিলেন অনানুষ্ঠানিক এই শোক সমাবেশে। সোহেল নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বললেন, সেই রাতে তার চোখের সামনে একটি গাড়ি থেকে আরেকটি গাড়িতে ছড়িয়ে পড়ছিল আগুন। আগুনের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে রিকশায় বসা অবস্থাতেই পুড়ে এক দম্পতি ও তাদের কোলের শিশুকে মরতে দেখেন তিনি। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডে আশপাশের আরও কয়েকটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট ১৪ ঘণ্টার চেষ্টায় যখন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে, ততক্ষণে শ্মশানে পরিণত হয়েছে চুড়িহাট্টা। ঘটনাস্থল থেকে ৬৭ জনের পোড়া লাশ মর্গে পাঠান উদ্ধারকর্মীরা। পরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭১ জনে।

শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৮ ফল্গুন ১৪২৬, ২৬ জমাদিউল সানি ১৪৪১

চুড়িহাট্টায়

প্রিয়জনের শেষ পদচিহ্নে স্বজনরা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

দোকানিরা ব্যস্ত ছিলেন শেষ মুহূর্তের বেচাকেনায়, দূর থেকে আসা ব্যবসায়ী আর ক্রেতাদের ছিল ফেরার তাড়া, রাস্তায় ছিল পথচারী আর চলতি পথের যাত্রীদের ভিড়, ছিল আড্ডা, হাঁকডাক, রিকশার বেল, গাড়ির হর্ন। ঠিক এক বছর আগে, এমনই এক বসন্তের রাতে হঠাৎ বিস্ফোরণের পর নরককুণ্ডে পরিণত হয় চকবাজরের চুড়িহাট্টা মোড়। সে আগুন কেড়ে নেয় ৭১ জনের প্রাণ। সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের বছর পূর্তির দিনে বৃহস্পতিবার সকালে চুড়িহাট্টা মোড়ের পোড়া ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে হাজির হন নিহতদের স্বজনরা। বাবা এসে রাস্তার পিচে হাত বুলিয়ে যেন সন্তানের শেষ পদচিহ্নের স্পর্শ নিতে চান। স্বামী আর সন্তানের ছবি হাতে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকা এক নারীর বেদনাক্লিষ্ট চোখ দুটো বলে দেয়, তার অপেক্ষা কখনও ফুরাবার নয়। এই চুড়িহাট্টা মোড়ে এমআর টেলিকম নামে একটি দোকান চালাতেন চাঁদনীঘাটের কেবি রুদ্র রোডের দুই ভাই মাসুদ রানা ও মাহবুবুর রহমান রাজু। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে আগুনের লেলিহান শিখা যখন সবকিছু গ্রাস করে নিল, তারা আর দোকান থেকে বের হতে পারেননি।

রানা-রাজুর বাবা সাহেব উল্লাহও বৃহস্পতিবার সকালে এসেছিলেন চুড়িহাট্টা মোড়ে। দুই ছেলের দোকানের মেঝেতে হাত বুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, এখানে আমার ছেলেরা বসেছিল। বাবা মোহাম্মদ আলী আর চাচা অপু রায়হানের সঙ্গে সেই রাতে আগুনে পুড়ে লাশ হয় তিন বছরের শিশু আরাফাত আলী। চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদ মার্কেটের নিচতলায় গামছা-তোয়ালে-তসবিহসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের দোকান ছিল পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলীদের। মাঝেমধ্যেই বাসা থেকে এসে বাবা-চাচাদের সঙ্গে সময় কাটাতো ছোট্ট আরাফাত।

রাত সাড়ে ১০টার দিকে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নেয়ার মধ্যেই ঘটে সেই বিস্ফোরণ। সামান্য সময় আগে দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান আলী-অপুদের আরেক ভাই দীপু হোসেন। বৃহস্পতিবার সকালে সেই দোকানের সামনে দাঁড়ানো স্বজনদের চোখে অশ্রু বাঁধ মানছিল না। পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার মাধবখালী ইউনিয়নের সন্তোষপুর গ্রামের মো. মজিবুর রহমান হাওলাদার চুড়িহাট্টা এলাকায় ভাড়ায় ভ্যান গাড়িতে করে মালামাল পরিবহন করতেন। পুরো রাস্তা অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হলে তার আর বাঁচার পথ ছিল না। আরও অনেকের সঙ্গে মজিবুর রহমানের ছেলে সুমন হাওলাদারও বৃহস্পতিবার সকালে চুড়িহাট্টার মোড়ে ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে হাজির হয়েছিলেন। তিনি বললেন, বাবাকে হারানোর পর লেখাপড়া চালিয়ে নিতে তাকে কঠিন সংগ্রামের মধ্যে পড়তে হয়েছে।

ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে জড়ো হওয়া ক্ষতিগ্রস্ত অনেকের কণ্ঠে ছিল ক্ষোভ। বুকে কালো ব্যাজ পরে ক্ষতিপূরণের দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করছিলেন তারা। সেই রাতের প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই এসেছিলেন অনানুষ্ঠানিক এই শোক সমাবেশে। সোহেল নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বললেন, সেই রাতে তার চোখের সামনে একটি গাড়ি থেকে আরেকটি গাড়িতে ছড়িয়ে পড়ছিল আগুন। আগুনের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে রিকশায় বসা অবস্থাতেই পুড়ে এক দম্পতি ও তাদের কোলের শিশুকে মরতে দেখেন তিনি। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডে আশপাশের আরও কয়েকটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট ১৪ ঘণ্টার চেষ্টায় যখন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে, ততক্ষণে শ্মশানে পরিণত হয়েছে চুড়িহাট্টা। ঘটনাস্থল থেকে ৬৭ জনের পোড়া লাশ মর্গে পাঠান উদ্ধারকর্মীরা। পরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭১ জনে।