একুশে গ্রন্থমেলায় অপ্রতুল একুশের বই

বাঙালি জাতি-উন্নত ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও অনন্য সভ্যতার গর্বিত উত্তরাধিকারী জাতি। পৃথিবীর একমাত্র জাতি ‘বাঙালি’-ই তার মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। গতিশীল সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ এই জাতির মহান ভাষা আন্দোলনের সেই অমর ২১ ফেব্রুয়ারি আজ সারাবিশ্বের সব জাতির মাতৃভাষা দিবস। শুধু তাই নয়, বাঙালি জাতি তার মহান ভাষা আন্দোলেনের শহীদদের স্মরণে প্রতিবছর যে বইমেলার আয়োজন করে থাকে; সেই বইমেলাও পৃথিবীর যেকোন বইমেলার চেয়ে একেবারে আলাদা। আবেগ-আবেদনে তো বটেই, পৃথিবীর যেকোন বইমেলার চেয়ে বাঙালির ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র ভিন্নতা রয়েছে মাসব্যাপী সময়কাল এবং বইপ্রকাশের ক্ষেত্রেও। কেননা বাঙালির অমর একুশের চেতনাঋদ্ধ এই বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর যে পরিমাণে বই প্রকাশিত হয়, তার পৃথিবীর আর কোন বইমেলাকে কেন্দ্র করে হয় না। কিন্তু পরিতাপের বিষয়-যে গ্রন্থমেলার নামের সঙ্গে অমর একুশে জড়িত, সে মেলাতেই ভাষা আন্দোলন নিয়ে নতুন বইয়ের দেখা পাওয়া যায় না। ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের এই বইমেলায় বরাবরের মতো এবারও ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রকাশিত নতুন বইয়ের সংখ্যা খুবই কম। একুশের চেতনাকে ধারণ করা বইমেলায় প্রতিদিনই শতাধিক বই প্রকাশ হলেও ভাষা আন্দোলন নিয়ে নেই উল্লেখযোগ্য গবেষণাধর্মী বই। এবারের মেলায় এখন পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার নতুন বই প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু যে ভাষা শহীদদের স্মরণে গ্রন্থমেলা, সেখানে অপ্রতুল ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বই। শুধু চলতি গ্রন্থমেলা নয়, গত কয়েকবছর ধরে গ্রন্থমেলায় একুশের বইয়ের আকাল চলছে।

প্রকাশকরা বলছেন, ১৯৭০ সালে জহির রায়হানের অমর সৃষ্টি ‘একুশের গল্প’র তপু চরিত্রের পর এ আন্দোলন নিয়ে আর ওই মানের কোন মানসম্মত সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি। তাদের ভাষায়, ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই প্রকাশে তাদের বিপুল আগ্রহ থাকলেও পা-ুলিপির অভাবে তারা তা পারছেন না। আবার যা দু’একটি লেখা আসছে তারও মান ভালো না হওয়ায় এসব লেখা জনসমাদৃত হচ্ছে না। অন্যদিকে একুশের বইয়ের চাহিদাও কম, তাই নামিদামি লেখকদের এ বিষয়ে লেখতে চাপও দিতে পারেন না তারা। যদিও পাঠক বলছেন অন্যকথা। তাদের মতে, মেলায় ভালো মানের ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বই আসছে না। যা আসছে তাতেও খুব আগ্রহী হওয়া যাচ্ছে না। পাঠকদের মতে, ভালো মানের বই বাজারে আসলে সেটি পাঠক খুঁজে নেবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই প্রকাশকদের এ বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত।

জানা যায়, চলতি মেলায় প্রায় ৬শ’ প্রকাশনাকে স্টল বরাদ্দ দিয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি। কিন্তু এসব প্রকাশনার ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বইয়ের সংখ্যা একেবারেই কম। বেশিরভাগ প্রকাশনারই এ বিষয়ে কোন নতুন বই মেলায় আসেনি। সেটি বড় কিংবা ছোট প্রকাশনা হোক। শুধু তাই নয়, খোদ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ২৬টি নতুন বইয়ের মধ্যে ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বই মাত্র দুটি।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’-এর ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন কাজল সংবাদকে বলেন, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পাণ্ডুলিপির অভাবে ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই প্রকাশ করতে পারিনি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই লেখা বেশ গবেষণালব্ধ এবং সৃজনশীল কাজ। ভালো পাণ্ডুলিপি পেলে বই প্রকাশ করতে আমাদের আপত্তি নেই। কাকলী প্রকাশনীর কর্ণধার নাসির উদ্দিন সেলিম বলেন, ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বইয়ের চাহিদা কম। যার কারণে ভালো মানের লেখকদের এ বিষয়ে লেখতে চাপও দিতে পারছেন না তারা। অন্যপ্রকাশের বিক্রয়কর্মী আলা উদ্দিন টিপু বলেন, আমাদের এখানে উপন্যাস, কবিতা, গল্প এসব বই বেশি চলছে। পাঠক ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বইয়ের প্রতি তেমন আগ্রহী নন, ভালো মানের পাণ্ডুলিপিও পাওয়া যায় না, তাই এ বিষয়ে লেখা বই আসেনি। স্টুডেন্ট ওয়েজ-এর প্রকাশক মো. লেয়াকত উল্লাহ বলেন, এ বিষয়ে লেখতে হলে অধিক পড়াশোনা প্রয়োজন। খুব ভালো না জেনে যে কেউ বই প্রকাশে আগ্রহী হন না।

মেলায় বেশ কয়েকটি স্টল ও প্যাভেলিয়ন ঘুরে দেখা যায়, একুশের বইয়ের সংখ্যা হাতেগোনা। বেশিরভাগ প্রকাশনারই এ বিষয়ে নতুন কোন বই মেলায় আসেনি। যেসব প্রকাশনার এসেছে তাও দু’একটির মধ্যে সীমাবদ্ধ। অন্তত ২০টি স্টল ও প্যাভেলিয়ন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

চলতি বছর মেলায় আসা ভাষা আন্দোলনভিত্তিক উল্লেখযোগ্য নতুন বইয়ের মধ্যে রয়েছে- বাংলা একাডেমির একুশের প্রবন্ধ, ভাষার গান; প্রথমা প্রকাশনীর ‘একুশের শহীদ : ছয় ভাষাশহীদের জীবনকথা’; আগামী প্রকাশনী থেকে ভাষাসংগ্রামী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ভাষাতত্ত্ব, ভাষাসাম্রাজ্যবাদ ও মানবাধিকার; কথা প্রকাশের ভাষাসংগ্রামী এমএ ওয়াদুদ; বিশ্বসাহিত্য ভবনের ভাষা আন্দোলন কিশোর ইতিহাস ইত্যাদি।

এদিকে পাঠক বলছেন ভালো মানের বই মেলায় আসলে অবশ্যই পাঠক সেটি কেনে নেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ভালো মানের একুশের বই আসলে পাঠক কেন নেবে না সেটির উত্তর আমি খুঁজে পাই না। আমি মনে করি প্রকাশকদের বইয়ের মানের ওপর নজর দিতে হবে। তাহলে পাঠকও বাড়বে। পাঠক আগ্রহী নয়, এমন কথা আমি বিশ্বাস করি না।

শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৮ ফল্গুন ১৪২৬, ২৬ জমাদিউল সানি ১৪৪১

একুশে গ্রন্থমেলায় অপ্রতুল একুশের বই

আবদুল্লাহ আল জোবায়ের

বাঙালি জাতি-উন্নত ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও অনন্য সভ্যতার গর্বিত উত্তরাধিকারী জাতি। পৃথিবীর একমাত্র জাতি ‘বাঙালি’-ই তার মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। গতিশীল সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ এই জাতির মহান ভাষা আন্দোলনের সেই অমর ২১ ফেব্রুয়ারি আজ সারাবিশ্বের সব জাতির মাতৃভাষা দিবস। শুধু তাই নয়, বাঙালি জাতি তার মহান ভাষা আন্দোলেনের শহীদদের স্মরণে প্রতিবছর যে বইমেলার আয়োজন করে থাকে; সেই বইমেলাও পৃথিবীর যেকোন বইমেলার চেয়ে একেবারে আলাদা। আবেগ-আবেদনে তো বটেই, পৃথিবীর যেকোন বইমেলার চেয়ে বাঙালির ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র ভিন্নতা রয়েছে মাসব্যাপী সময়কাল এবং বইপ্রকাশের ক্ষেত্রেও। কেননা বাঙালির অমর একুশের চেতনাঋদ্ধ এই বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর যে পরিমাণে বই প্রকাশিত হয়, তার পৃথিবীর আর কোন বইমেলাকে কেন্দ্র করে হয় না। কিন্তু পরিতাপের বিষয়-যে গ্রন্থমেলার নামের সঙ্গে অমর একুশে জড়িত, সে মেলাতেই ভাষা আন্দোলন নিয়ে নতুন বইয়ের দেখা পাওয়া যায় না। ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের এই বইমেলায় বরাবরের মতো এবারও ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রকাশিত নতুন বইয়ের সংখ্যা খুবই কম। একুশের চেতনাকে ধারণ করা বইমেলায় প্রতিদিনই শতাধিক বই প্রকাশ হলেও ভাষা আন্দোলন নিয়ে নেই উল্লেখযোগ্য গবেষণাধর্মী বই। এবারের মেলায় এখন পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার নতুন বই প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু যে ভাষা শহীদদের স্মরণে গ্রন্থমেলা, সেখানে অপ্রতুল ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বই। শুধু চলতি গ্রন্থমেলা নয়, গত কয়েকবছর ধরে গ্রন্থমেলায় একুশের বইয়ের আকাল চলছে।

প্রকাশকরা বলছেন, ১৯৭০ সালে জহির রায়হানের অমর সৃষ্টি ‘একুশের গল্প’র তপু চরিত্রের পর এ আন্দোলন নিয়ে আর ওই মানের কোন মানসম্মত সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি। তাদের ভাষায়, ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই প্রকাশে তাদের বিপুল আগ্রহ থাকলেও পা-ুলিপির অভাবে তারা তা পারছেন না। আবার যা দু’একটি লেখা আসছে তারও মান ভালো না হওয়ায় এসব লেখা জনসমাদৃত হচ্ছে না। অন্যদিকে একুশের বইয়ের চাহিদাও কম, তাই নামিদামি লেখকদের এ বিষয়ে লেখতে চাপও দিতে পারেন না তারা। যদিও পাঠক বলছেন অন্যকথা। তাদের মতে, মেলায় ভালো মানের ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বই আসছে না। যা আসছে তাতেও খুব আগ্রহী হওয়া যাচ্ছে না। পাঠকদের মতে, ভালো মানের বই বাজারে আসলে সেটি পাঠক খুঁজে নেবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই প্রকাশকদের এ বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত।

জানা যায়, চলতি মেলায় প্রায় ৬শ’ প্রকাশনাকে স্টল বরাদ্দ দিয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি। কিন্তু এসব প্রকাশনার ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বইয়ের সংখ্যা একেবারেই কম। বেশিরভাগ প্রকাশনারই এ বিষয়ে কোন নতুন বই মেলায় আসেনি। সেটি বড় কিংবা ছোট প্রকাশনা হোক। শুধু তাই নয়, খোদ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ২৬টি নতুন বইয়ের মধ্যে ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বই মাত্র দুটি।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’-এর ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন কাজল সংবাদকে বলেন, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পাণ্ডুলিপির অভাবে ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই প্রকাশ করতে পারিনি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই লেখা বেশ গবেষণালব্ধ এবং সৃজনশীল কাজ। ভালো পাণ্ডুলিপি পেলে বই প্রকাশ করতে আমাদের আপত্তি নেই। কাকলী প্রকাশনীর কর্ণধার নাসির উদ্দিন সেলিম বলেন, ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বইয়ের চাহিদা কম। যার কারণে ভালো মানের লেখকদের এ বিষয়ে লেখতে চাপও দিতে পারছেন না তারা। অন্যপ্রকাশের বিক্রয়কর্মী আলা উদ্দিন টিপু বলেন, আমাদের এখানে উপন্যাস, কবিতা, গল্প এসব বই বেশি চলছে। পাঠক ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বইয়ের প্রতি তেমন আগ্রহী নন, ভালো মানের পাণ্ডুলিপিও পাওয়া যায় না, তাই এ বিষয়ে লেখা বই আসেনি। স্টুডেন্ট ওয়েজ-এর প্রকাশক মো. লেয়াকত উল্লাহ বলেন, এ বিষয়ে লেখতে হলে অধিক পড়াশোনা প্রয়োজন। খুব ভালো না জেনে যে কেউ বই প্রকাশে আগ্রহী হন না।

মেলায় বেশ কয়েকটি স্টল ও প্যাভেলিয়ন ঘুরে দেখা যায়, একুশের বইয়ের সংখ্যা হাতেগোনা। বেশিরভাগ প্রকাশনারই এ বিষয়ে নতুন কোন বই মেলায় আসেনি। যেসব প্রকাশনার এসেছে তাও দু’একটির মধ্যে সীমাবদ্ধ। অন্তত ২০টি স্টল ও প্যাভেলিয়ন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

চলতি বছর মেলায় আসা ভাষা আন্দোলনভিত্তিক উল্লেখযোগ্য নতুন বইয়ের মধ্যে রয়েছে- বাংলা একাডেমির একুশের প্রবন্ধ, ভাষার গান; প্রথমা প্রকাশনীর ‘একুশের শহীদ : ছয় ভাষাশহীদের জীবনকথা’; আগামী প্রকাশনী থেকে ভাষাসংগ্রামী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ভাষাতত্ত্ব, ভাষাসাম্রাজ্যবাদ ও মানবাধিকার; কথা প্রকাশের ভাষাসংগ্রামী এমএ ওয়াদুদ; বিশ্বসাহিত্য ভবনের ভাষা আন্দোলন কিশোর ইতিহাস ইত্যাদি।

এদিকে পাঠক বলছেন ভালো মানের বই মেলায় আসলে অবশ্যই পাঠক সেটি কেনে নেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ভালো মানের একুশের বই আসলে পাঠক কেন নেবে না সেটির উত্তর আমি খুঁজে পাই না। আমি মনে করি প্রকাশকদের বইয়ের মানের ওপর নজর দিতে হবে। তাহলে পাঠকও বাড়বে। পাঠক আগ্রহী নয়, এমন কথা আমি বিশ্বাস করি না।