দেশের বাইরে প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনার

গাজী মহিবুর রহমান

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর ধর্ম-বর্ণে ভিন্নতা থাকলেও ভাষা ও সংস্কৃতি প্রায় এক ও অভিন্ন। এই রাষ্ট্রটি কোন বিশেষ ধর্ম, বর্ণ বা শ্রেণীর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি। বরং ১৯৭১ সালে ধর্মের দোহাই দিয়ে গঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ, বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মূলমন্ত্র করে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন স্বার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের দ্বারা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা একটি স্বাধীন স্বার্বভৌম জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এই রাষ্ট্রটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এখানকার প্রায় শতভাগ মানুষ জন্মগতভাবেই বাংলা ভাষায় কথা বলে। আর তাই হয়তো মাতৃভাষা বাংলার সঙ্গে মিল রেখে দেশের নামকরণ হয়েছে বাংলাদেশ। সত্যিই এমনটা বিরল দেশের নাম বাংলা, আর সেই দেশের মাতৃভাষা তথা রাষ্ট্রভাষার নামও বাংলা। ভাষার প্রতি কি বিনম্র শ্রদ্ধা এই ভুখণ্ডের মানুষগুলোর! নিজের ভাষায়, মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্টার জন্য সালাম, বরকত, রফিক জব্বারসহ নাম না জানা অনেক ভাইয়ের প্রাণ বিসর্জন দেয়ার ইতিহাস সবারই জানা। এই ইতিহাস এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিস্তৃত। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারাবিশ্বে পালন করা হয়। পৃথিবীতে ভাষার জন্য প্রাণ দেয়ার দৃষ্টান্ত আমার অন্তত জানা নেই। আর তাইতো বাংলাদেশিরা পৃথিবীর যে যেই প্রান্তেই থাকুক না কেন ভুলতে পারে না নাড়ির টান, শিকরের টান, দেশমাতৃকার কথা। ক্ষণে ক্ষণে মনেপড়ে সেই ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলোর কথা।

বিশ্বের যেসব দেশে বাঙালি অভিবাসী হিসেবে নোঙর গেড়েছে তার মধ্যে নিঃসন্দেহে বিলেত বা ব্রিটেন অন্যতম। বিলেতে বাঙালিদের অগ্রযাত্রা খুবই সম্ভাবনাময়। বিলেতে বাঙালির ইতিহাস শুরুর দিকে কষ্টের হলেও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এমনকি বর্তমান সময়েও অনেক ভালো অবস্থা বিরাজ করছে। তার প্রমাণ কিন্তু ব্রিটেনের সর্বশেষ পার্লামেন্ট নির্বাচনের দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাই। ভাগ্যান্বেষনে একদিন দু-মুঠো ভাতের জন্য বিলেতে গিয়ে এখন চারজন বাঙ্গালী ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এমপি হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করছে। এটা সত্যিই গর্বের; আনন্দের।

ব্রিটেনের লন্ডন এবং বার্মিংহামের পরেই যে শহরে সবচেয়ে সংখ্যাধিক বাঙালির বসবাস সেটা নিঃসন্দেহে ওল্ডহাম। এখানে প্রায় পঁচিশ/ত্রিশ হাজার ব্রিটিশ বাংলাদেশি স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। এখানে বাংলাদেশিদের পদচারণা বেশ পুরনো। এখানকার রাস্তা-ঘাট, দোকানপাটগুলোতে বাঙালিদের আনাগোনা দেখে প্রায়শই মনে হতে পারে- এ যেন প্রবাসে একখণ্ড বাংলাদেশ। কাজের সন্ধানে বাঙালিরা একদিন জাহাজে করে এখানে এসে গড়ে তুলেছে স্থায়ী বসতি; যা ইতিমধ্যেই দ্বিতীয় পেড়িয়ে তৃতীয় প্রজন্মে পদার্পণ করেছে।

ওল্ডহাম, ইংল্যান্ডের নর্থওয়েস্টের একটি ঐতিহ্যবাহী শহর। এক সময় শিল্প এলাকা হিসেবে বেশ খ্যাতি ছিল এই ছোট্ট শহরটির। কিন্তু বর্তমানে সবকিছুকে ছাপিয়ে এই শহরটি বাংলাদেশিদের কাছে এক ঐতিহাসিক ঘটনার নীরব সাক্ষী। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য আত্মদানকারী শহীদদের স্মরণে এই ওল্ডহাম শহরেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে দেশের বাইরে প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনার।

বিলেতে জন্ম নেয়া নতুন প্রজন্মের বেশিরভাগ ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ছেলেমেয়েরা প্রয়োজনীয় কয়েকটি বাংলা শব্দ ছাড়া যেমন পারে না বলতে তেমনি পারে না লিখতে। এসব নতুন প্রজন্ম তথা বিলেতবাসীকে বাংলা ভাষার ইতিহাস জানান দেওয়ার জন্যই হোক আর নাড়ির টানেই হোক ১৯৯০ সালে ওল্ডহামের কিছু যুবক স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য লোকাল কাউন্সিলের কাছে আবেদন জানান। সমসাময়িককালে ওল্ডহামের বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও এ দাবির প্রতি একাত্মতা জানায়। তখনকার ওল্ডহাম কাউন্সিলের বাঙালি কাউন্সিলার এবং সাবেক মেয়র জনাব আবদুল জব্বার সাহেবের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ওল্ডহাম কাউন্সিল একটি স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য পঁচিশ (২৫০০০) হাজার পাউন্ড এবং ওল্ডহামের মেইন রোড নামক সড়কে প্রয়োজনীয় জায়গা বরাদ্দ করে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে নির্মিত ওল্ডহামের এই স্থায়ী শহীদ মিনারটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৯৬ সালে এবং ১৯৯৭ সালে তা সবার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। যা কিনা বাংলাদেশের বাইরে স্থায়ীভাবে নির্মিত প্রথম কোন শহীদ মিনার। দৃশ্যত ব্যাপারটিকে খুব আহামরি কিছু মনে না হলেও তাৎপর্যগত দিক থেকে এটি বাঙালি জাতীয়তাবোধ এবং চেতনায় এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত। পরবর্তীতে লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে আরও একটি স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়।

এই স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের আগেও বিলেতের প্রবাসী বাঙালিরা ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতো কিন্তু সেটা হয়তো কোন কমিউনিটি সেন্টারের ভিতরে অস্থায়ীভাবে নির্মিত নামেমাত্র শহীদ মিনারে। আর ’৯৭ সালে এই স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের পর থেকে ওল্ডহাম ছাড়াও ম্যানচেস্টার, হাইড, বার্নলি, ব্রাডফোর্ড এমনকি বার্মিংহাম থেকেও বাঙালিরা একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ বেদিতে ফুল দিতে এসে জড়ো হয়। শুধু তাই নয় ম্যানচেস্টারে অবস্থিত বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনারের কার্যালয়ের সহকারী হাইকমিশনার এবং অন্যান্য ষ্টাফরাও এই শহীদ মিনারেই ফুল দিয়ে থাকেন।

এখানকার যান্ত্রিক জীবনে কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে নিত্যদিনের জীবন যাত্রায় বাংলা ভাষা ব্যবহারের সুযোগ নিতান্তই কদাচিৎ কিন্তু বাংলা যে তাদের মায়ের ভাষা তাকে তো প্রবাসজীবনের প্রতিকূল পরিবেশ দিয়ে ধমিয়ে রাখা যায় না। বিলেতে বসবাসরত বাঙ্গালীরা পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি যতটা না আকৃষ্ট হয়েছে তার চেয়ে বরং নিজেদের কৃষ্টি, কালচার, ইতিহাস, ঐতিহ্যকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে সে দেশের মূলধারার প্রতিটি সেক্টরে। এরই পথ ধরে আজ শাড়ি পরা কোন গ্রাম্য বধূ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এমপির আসনে। ইতিমধ্যেই বিলেতে মুলধারার রাজনীতিতে সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশের কোন প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করা রোশনারা আলী এমপি, টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাচিত প্রথম নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমানের মতো জন্মসূত্রে বাংলাদেশিরা। এরই ধারাবাহিকতায় এমপি হয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিকী, রুপা হক প্রমুখ। চরম অর্থনৈতিক মন্দায় যেখানে বিলেতের অনেক নামিদামি ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে টিক সেই সময়ে একজন সফল ব্যাবসায়ী হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছেন আরেক জন্মসূত্রে বাংলাদেশি ইকবাল আহমেদ ওবিই। আরেকজন তো দস্তুর মতো সারা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন যিনি ওখানকার বাঙালি কমিউনিটিতে ব্রিটিশ হাইকমিশনার হিসেবে পরিচিত, হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী ব্রিটেনের এক দক্ষ কূটনীতিক হয়ে উঠেছেন আর কত্থক এর গুরু কোরিওগ্রাফার আকরাম খানের কথা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না। এরকম বাংলাদেশে জন্ম নেয়া, বেড়ে উঠা আরো অসংখ্য প্রতিভাবান সুযোগের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। আর বিলেতে জন্ম নেয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা সরকারি বড় অফিসার এসব তো এখন অহরহ। ’৫২-এর চেতনা, ’৭১-এর প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে বিশ্ব দরবারে বাঙালিরা একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে- এমনটাই প্রত্যাশা করে বিলেতে বসবাসকারী ব্রিটিশ-বাংলাদেশিরা। আর সেই ক্ষেত্রে ওল্ডহামে নির্মিত দেশের বাইরে প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনারটিই হতে পারে তাদের চেতনা এবং প্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু।

ওল্ডহাম, ম্যানচেস্টার থেকে ফিরে

[লেখক : কলাম লেখক]

gmrahman1980@gmail.com

শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৮ ফল্গুন ১৪২৬, ২৬ জমাদিউল সানি ১৪৪১

দেশের বাইরে প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনার

গাজী মহিবুর রহমান

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর ধর্ম-বর্ণে ভিন্নতা থাকলেও ভাষা ও সংস্কৃতি প্রায় এক ও অভিন্ন। এই রাষ্ট্রটি কোন বিশেষ ধর্ম, বর্ণ বা শ্রেণীর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি। বরং ১৯৭১ সালে ধর্মের দোহাই দিয়ে গঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ, বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মূলমন্ত্র করে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন স্বার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের দ্বারা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা একটি স্বাধীন স্বার্বভৌম জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এই রাষ্ট্রটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এখানকার প্রায় শতভাগ মানুষ জন্মগতভাবেই বাংলা ভাষায় কথা বলে। আর তাই হয়তো মাতৃভাষা বাংলার সঙ্গে মিল রেখে দেশের নামকরণ হয়েছে বাংলাদেশ। সত্যিই এমনটা বিরল দেশের নাম বাংলা, আর সেই দেশের মাতৃভাষা তথা রাষ্ট্রভাষার নামও বাংলা। ভাষার প্রতি কি বিনম্র শ্রদ্ধা এই ভুখণ্ডের মানুষগুলোর! নিজের ভাষায়, মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্টার জন্য সালাম, বরকত, রফিক জব্বারসহ নাম না জানা অনেক ভাইয়ের প্রাণ বিসর্জন দেয়ার ইতিহাস সবারই জানা। এই ইতিহাস এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিস্তৃত। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারাবিশ্বে পালন করা হয়। পৃথিবীতে ভাষার জন্য প্রাণ দেয়ার দৃষ্টান্ত আমার অন্তত জানা নেই। আর তাইতো বাংলাদেশিরা পৃথিবীর যে যেই প্রান্তেই থাকুক না কেন ভুলতে পারে না নাড়ির টান, শিকরের টান, দেশমাতৃকার কথা। ক্ষণে ক্ষণে মনেপড়ে সেই ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলোর কথা।

বিশ্বের যেসব দেশে বাঙালি অভিবাসী হিসেবে নোঙর গেড়েছে তার মধ্যে নিঃসন্দেহে বিলেত বা ব্রিটেন অন্যতম। বিলেতে বাঙালিদের অগ্রযাত্রা খুবই সম্ভাবনাময়। বিলেতে বাঙালির ইতিহাস শুরুর দিকে কষ্টের হলেও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এমনকি বর্তমান সময়েও অনেক ভালো অবস্থা বিরাজ করছে। তার প্রমাণ কিন্তু ব্রিটেনের সর্বশেষ পার্লামেন্ট নির্বাচনের দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাই। ভাগ্যান্বেষনে একদিন দু-মুঠো ভাতের জন্য বিলেতে গিয়ে এখন চারজন বাঙ্গালী ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এমপি হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করছে। এটা সত্যিই গর্বের; আনন্দের।

ব্রিটেনের লন্ডন এবং বার্মিংহামের পরেই যে শহরে সবচেয়ে সংখ্যাধিক বাঙালির বসবাস সেটা নিঃসন্দেহে ওল্ডহাম। এখানে প্রায় পঁচিশ/ত্রিশ হাজার ব্রিটিশ বাংলাদেশি স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। এখানে বাংলাদেশিদের পদচারণা বেশ পুরনো। এখানকার রাস্তা-ঘাট, দোকানপাটগুলোতে বাঙালিদের আনাগোনা দেখে প্রায়শই মনে হতে পারে- এ যেন প্রবাসে একখণ্ড বাংলাদেশ। কাজের সন্ধানে বাঙালিরা একদিন জাহাজে করে এখানে এসে গড়ে তুলেছে স্থায়ী বসতি; যা ইতিমধ্যেই দ্বিতীয় পেড়িয়ে তৃতীয় প্রজন্মে পদার্পণ করেছে।

ওল্ডহাম, ইংল্যান্ডের নর্থওয়েস্টের একটি ঐতিহ্যবাহী শহর। এক সময় শিল্প এলাকা হিসেবে বেশ খ্যাতি ছিল এই ছোট্ট শহরটির। কিন্তু বর্তমানে সবকিছুকে ছাপিয়ে এই শহরটি বাংলাদেশিদের কাছে এক ঐতিহাসিক ঘটনার নীরব সাক্ষী। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য আত্মদানকারী শহীদদের স্মরণে এই ওল্ডহাম শহরেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে দেশের বাইরে প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনার।

বিলেতে জন্ম নেয়া নতুন প্রজন্মের বেশিরভাগ ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ছেলেমেয়েরা প্রয়োজনীয় কয়েকটি বাংলা শব্দ ছাড়া যেমন পারে না বলতে তেমনি পারে না লিখতে। এসব নতুন প্রজন্ম তথা বিলেতবাসীকে বাংলা ভাষার ইতিহাস জানান দেওয়ার জন্যই হোক আর নাড়ির টানেই হোক ১৯৯০ সালে ওল্ডহামের কিছু যুবক স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য লোকাল কাউন্সিলের কাছে আবেদন জানান। সমসাময়িককালে ওল্ডহামের বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও এ দাবির প্রতি একাত্মতা জানায়। তখনকার ওল্ডহাম কাউন্সিলের বাঙালি কাউন্সিলার এবং সাবেক মেয়র জনাব আবদুল জব্বার সাহেবের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ওল্ডহাম কাউন্সিল একটি স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য পঁচিশ (২৫০০০) হাজার পাউন্ড এবং ওল্ডহামের মেইন রোড নামক সড়কে প্রয়োজনীয় জায়গা বরাদ্দ করে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে নির্মিত ওল্ডহামের এই স্থায়ী শহীদ মিনারটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৯৬ সালে এবং ১৯৯৭ সালে তা সবার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। যা কিনা বাংলাদেশের বাইরে স্থায়ীভাবে নির্মিত প্রথম কোন শহীদ মিনার। দৃশ্যত ব্যাপারটিকে খুব আহামরি কিছু মনে না হলেও তাৎপর্যগত দিক থেকে এটি বাঙালি জাতীয়তাবোধ এবং চেতনায় এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত। পরবর্তীতে লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে আরও একটি স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়।

এই স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের আগেও বিলেতের প্রবাসী বাঙালিরা ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতো কিন্তু সেটা হয়তো কোন কমিউনিটি সেন্টারের ভিতরে অস্থায়ীভাবে নির্মিত নামেমাত্র শহীদ মিনারে। আর ’৯৭ সালে এই স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের পর থেকে ওল্ডহাম ছাড়াও ম্যানচেস্টার, হাইড, বার্নলি, ব্রাডফোর্ড এমনকি বার্মিংহাম থেকেও বাঙালিরা একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ বেদিতে ফুল দিতে এসে জড়ো হয়। শুধু তাই নয় ম্যানচেস্টারে অবস্থিত বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনারের কার্যালয়ের সহকারী হাইকমিশনার এবং অন্যান্য ষ্টাফরাও এই শহীদ মিনারেই ফুল দিয়ে থাকেন।

এখানকার যান্ত্রিক জীবনে কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে নিত্যদিনের জীবন যাত্রায় বাংলা ভাষা ব্যবহারের সুযোগ নিতান্তই কদাচিৎ কিন্তু বাংলা যে তাদের মায়ের ভাষা তাকে তো প্রবাসজীবনের প্রতিকূল পরিবেশ দিয়ে ধমিয়ে রাখা যায় না। বিলেতে বসবাসরত বাঙ্গালীরা পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি যতটা না আকৃষ্ট হয়েছে তার চেয়ে বরং নিজেদের কৃষ্টি, কালচার, ইতিহাস, ঐতিহ্যকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে সে দেশের মূলধারার প্রতিটি সেক্টরে। এরই পথ ধরে আজ শাড়ি পরা কোন গ্রাম্য বধূ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এমপির আসনে। ইতিমধ্যেই বিলেতে মুলধারার রাজনীতিতে সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশের কোন প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করা রোশনারা আলী এমপি, টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাচিত প্রথম নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমানের মতো জন্মসূত্রে বাংলাদেশিরা। এরই ধারাবাহিকতায় এমপি হয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিকী, রুপা হক প্রমুখ। চরম অর্থনৈতিক মন্দায় যেখানে বিলেতের অনেক নামিদামি ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে টিক সেই সময়ে একজন সফল ব্যাবসায়ী হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছেন আরেক জন্মসূত্রে বাংলাদেশি ইকবাল আহমেদ ওবিই। আরেকজন তো দস্তুর মতো সারা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন যিনি ওখানকার বাঙালি কমিউনিটিতে ব্রিটিশ হাইকমিশনার হিসেবে পরিচিত, হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী ব্রিটেনের এক দক্ষ কূটনীতিক হয়ে উঠেছেন আর কত্থক এর গুরু কোরিওগ্রাফার আকরাম খানের কথা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না। এরকম বাংলাদেশে জন্ম নেয়া, বেড়ে উঠা আরো অসংখ্য প্রতিভাবান সুযোগের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। আর বিলেতে জন্ম নেয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা সরকারি বড় অফিসার এসব তো এখন অহরহ। ’৫২-এর চেতনা, ’৭১-এর প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে বিশ্ব দরবারে বাঙালিরা একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে- এমনটাই প্রত্যাশা করে বিলেতে বসবাসকারী ব্রিটিশ-বাংলাদেশিরা। আর সেই ক্ষেত্রে ওল্ডহামে নির্মিত দেশের বাইরে প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনারটিই হতে পারে তাদের চেতনা এবং প্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু।

ওল্ডহাম, ম্যানচেস্টার থেকে ফিরে

[লেখক : কলাম লেখক]

gmrahman1980@gmail.com