ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনুন

দেশের ব্যাংক খাত গুটিকয়েক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে আছে বলে দাবি করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা এখন রাজনৈতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করছে না বলেও মনে করে সিপিডি। গত শনিবার রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে প্রস্তাবিত ‘ব্যাংক কমিশন’ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি এসব কথা বলেছে।

ব্যাংক খাত নিয়ে সিপিডি যা বলেছে সেটা সর্বৈব সত্য। ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি, উভয় ধরনের ব্যাংকই অস্বচ্ছতা, অব্যবস্থাপনা ও লুটপাটের আধারে পরিণত হয়েছে। ধনী ও শিল্পপতি গ্রাহকরা পরিণত হচ্ছেন ঋণখেলাপিতে। এরা আবার অনেকেই ব্যাংকেরও মালিক। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ দেয়া হচ্ছে, কিন্তু কোন সিকিউরিটি মানি নেই। যারা লোন নিচ্ছে তাদের ঠিকানাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ঊর্ধ্বতনদের দুর্নীতি। একের পর এক ব্যাংকের নাম আসছে এ তালিকায়। এমনকি এ খাতের পরিচালনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকও লুটের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা উধাও হয়ে গেছে। ব্যাংকিং খাতের এ দুরবস্থার প্রতিকার সাধনে কোন সফলতা নেই। খেলাপি ঋণকে তফসিলি সুবিধা দিয়ে চলমান ঋণে পরিণত করে এবং বাকি অংশকে ‘মন্দ ঋণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে অবলোপনের তালিকায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থাকে দৃশ্যত সহনশীল কিন্তু বাস্তবে চাপা দিয়ে রাখা হচ্ছে। ফলে এ খাতের দুর্নীতি আরও বাড়ছে। মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে বেশকিছু ব্যাংক। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে মানুষের অনাস্থা।

ব্যাংকিং খাতের মূল সমস্যাটা হচ্ছে সুশাসনের অভাব। সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকেই এটা মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে। সরকারি ব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পিতভাবে দুর্বল করে দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশনের খবরদারি চলছে। অথচ দুনিয়ার কোথাও ‘ব্যাংকিং ডিভিশন’ নামের কোন দানব নেই। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজ ব্যাংক মালিকদের হাতেই ব্যাংক পরিচালনার সর্বময় ক্ষমতা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে অর্পণ করা হয়েছে। পরিচালন পরিষদকে করা হয়েছে ঠুঁটো জগন্নাথ। বারবার খেলাপি ঋণে ছাড় না দিয়ে বরং আরেকটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ দুর্নীতিবাজদের সব ঋণ মওকুফ করে দেয়াই ভালো। এভাবে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ কেড়ে নিয়ে বিদেশে বেগমপাড়া বানানোর সুযোগ করে দেয়া হলে হয়তো এটাকেই রাষ্ট্রীয় নীতি মনে করে সবাই গ্রহণ করবে কিংবা অদৃষ্টের পরিহাস হিসেবে মেনে নেবে।

সংকট থেকে ব্যাংকিং খাতকে বের করে আনতে প্রয়োজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, ব্যাংকিং ডিভিশন তুলে দেয়া, যোগ্য লোকদের দায়িত্ব দেয়া ও ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ব্যাপক সংস্কার দরকার, এর ব্যবস্থাপনা যে অদক্ষ তা নতুন করে প্রমাণের প্রয়োজন নেই। সমন্বিত নীতিমালা প্রয়োগের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ বা অপরাধীকে ছাড় দেয়ার কোন সুযোগই রাখা যাবে না।

সরকারের ব্যাংক কমিশন গঠনের উদ্যোগ অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। ব্যাংক খাতের ওপর মানুষের আস্থা, স্বচ্ছতা ও বিশ্বস্ততার সংকট তৈরি হয়েছে। এ কারণে দেশে একটি ব্যাংক কমিশন গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে ব্যাংক কমিশন করতে হলে অবশ্যই রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকতে হবে। সেই সঙ্গে এই কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। যাদের দক্ষতা, যোগ্যতা, বিচক্ষণতা, সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই এবং যারা নির্মোহ তাদের ব্যাংক কমিশনের সদস্য করা উচিত।

সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ১০ ফল্গুন ১৪২৬, ২৮ জমাদিউল সানি ১৪৪১

ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনুন

দেশের ব্যাংক খাত গুটিকয়েক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে আছে বলে দাবি করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা এখন রাজনৈতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করছে না বলেও মনে করে সিপিডি। গত শনিবার রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে প্রস্তাবিত ‘ব্যাংক কমিশন’ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি এসব কথা বলেছে।

ব্যাংক খাত নিয়ে সিপিডি যা বলেছে সেটা সর্বৈব সত্য। ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি, উভয় ধরনের ব্যাংকই অস্বচ্ছতা, অব্যবস্থাপনা ও লুটপাটের আধারে পরিণত হয়েছে। ধনী ও শিল্পপতি গ্রাহকরা পরিণত হচ্ছেন ঋণখেলাপিতে। এরা আবার অনেকেই ব্যাংকেরও মালিক। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ দেয়া হচ্ছে, কিন্তু কোন সিকিউরিটি মানি নেই। যারা লোন নিচ্ছে তাদের ঠিকানাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ঊর্ধ্বতনদের দুর্নীতি। একের পর এক ব্যাংকের নাম আসছে এ তালিকায়। এমনকি এ খাতের পরিচালনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকও লুটের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা উধাও হয়ে গেছে। ব্যাংকিং খাতের এ দুরবস্থার প্রতিকার সাধনে কোন সফলতা নেই। খেলাপি ঋণকে তফসিলি সুবিধা দিয়ে চলমান ঋণে পরিণত করে এবং বাকি অংশকে ‘মন্দ ঋণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে অবলোপনের তালিকায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থাকে দৃশ্যত সহনশীল কিন্তু বাস্তবে চাপা দিয়ে রাখা হচ্ছে। ফলে এ খাতের দুর্নীতি আরও বাড়ছে। মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে বেশকিছু ব্যাংক। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে মানুষের অনাস্থা।

ব্যাংকিং খাতের মূল সমস্যাটা হচ্ছে সুশাসনের অভাব। সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকেই এটা মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে। সরকারি ব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পিতভাবে দুর্বল করে দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশনের খবরদারি চলছে। অথচ দুনিয়ার কোথাও ‘ব্যাংকিং ডিভিশন’ নামের কোন দানব নেই। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজ ব্যাংক মালিকদের হাতেই ব্যাংক পরিচালনার সর্বময় ক্ষমতা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে অর্পণ করা হয়েছে। পরিচালন পরিষদকে করা হয়েছে ঠুঁটো জগন্নাথ। বারবার খেলাপি ঋণে ছাড় না দিয়ে বরং আরেকটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ দুর্নীতিবাজদের সব ঋণ মওকুফ করে দেয়াই ভালো। এভাবে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ কেড়ে নিয়ে বিদেশে বেগমপাড়া বানানোর সুযোগ করে দেয়া হলে হয়তো এটাকেই রাষ্ট্রীয় নীতি মনে করে সবাই গ্রহণ করবে কিংবা অদৃষ্টের পরিহাস হিসেবে মেনে নেবে।

সংকট থেকে ব্যাংকিং খাতকে বের করে আনতে প্রয়োজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, ব্যাংকিং ডিভিশন তুলে দেয়া, যোগ্য লোকদের দায়িত্ব দেয়া ও ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ব্যাপক সংস্কার দরকার, এর ব্যবস্থাপনা যে অদক্ষ তা নতুন করে প্রমাণের প্রয়োজন নেই। সমন্বিত নীতিমালা প্রয়োগের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ বা অপরাধীকে ছাড় দেয়ার কোন সুযোগই রাখা যাবে না।

সরকারের ব্যাংক কমিশন গঠনের উদ্যোগ অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। ব্যাংক খাতের ওপর মানুষের আস্থা, স্বচ্ছতা ও বিশ্বস্ততার সংকট তৈরি হয়েছে। এ কারণে দেশে একটি ব্যাংক কমিশন গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে ব্যাংক কমিশন করতে হলে অবশ্যই রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকতে হবে। সেই সঙ্গে এই কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। যাদের দক্ষতা, যোগ্যতা, বিচক্ষণতা, সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই এবং যারা নির্মোহ তাদের ব্যাংক কমিশনের সদস্য করা উচিত।