স্বাধীনতা দিবসের প্রত্যয়

‘মুজিববর্ষ’ ও বিশ্বব্যাপী ‘করোনা’ মহামারীর মধ্যে দাঁড়িয়ে আমরা আজ স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছি। একদিকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষকে আগামী ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা; অন্যদিকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর জন্য আমাদের অধীর অপেক্ষা- অর্থাৎ বাঙালির গৌরব কীর্তিত হওয়ার মুহূর্তে বেঁচে থাকা নিয়ে সংকটের নিদারুণ মানসিক চাপে দিশেহারা আমরা। তবু যেহেতু ২৬ মার্চ, যেহেতু বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার দিন, যেহেতু দুর্যোগ মোকাবিলার প্রত্যয়- সব মিলে এই দিবসের তাৎপর্য আমাদের জীবনে অনেক বড়। গভীরতর অর্থে, চেতনার পরিমাপে স্বাধীনতার একটি ব্যাপক এবং বহুমাত্রিক রূপ রয়েছে। ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানি স্বৈরশাসনবিরোধী প্রতিটি আন্দোলনের সেই অনিঃশেষ চেতনা আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন করেছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের গণজাগরণ ও সংগ্রামী চেতনার স্পর্শে এক অপরিমেয় সম্ভাবনায় উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল আমাদের জনতা। সেই উজ্জীবনী শক্তি একাত্তরের রক্তস্নাত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে বর্তমান সময়েও বহমান। সংগত কারণেই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতিতে স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্যকে নতুন করে মূল্যায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জাতীয় জীবনে অপরিমেয় ত্যাগ, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও সাফল্যের সূর্যোদয়ে গৌরবময়। বাঙালির ইতিহাসের রয়েছে গতিশীল ও দ্বন্দ্বময় ধারা। পলাশীর বিপর্যয় (১৭৫৭), সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭), কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বিভেদের রাজনীতি, পাকিস্তান আন্দোলন, ১৯৪৭-এর অসংগত রাজনৈতিক মীমাংসা, ভাষা-আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান প্রভৃতি ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জীবনে সেই ঐতিহাসিক নিয়মেই চরম অগ্নিপরীক্ষা। এই পরীক্ষায় সামষ্টিক অস্তিত্বের প্রশ্নে সমগ্র জাতি এক অভিন্ন বিন্দুতে মিলিত হয় এবং নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি তার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাকে করতলগত করে। যুদ্ধোত্তরকালে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা সদ্য স্বাধীন দেশের বাস্তবতায় ছিল ভয়ঙ্কর ও অনাকাক্সিক্ষত। এ সময় থেকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের নবতর অভিযাত্রা ব্যাহত করা হয়েছিল। সে সময় যুগান্তকারী সব পরিবর্তন-সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হওয়ার পরই আবার রুদ্ধ হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের মুক্ত চেতনা, গণতন্ত্রায়ন ও শিল্পায়নের অবাধ বিকাশ হলো প্রলম্বিত। দীর্ঘ ২১ বছর পর পুনরায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন, জয় বাংলা ধ্বনিত হলো এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হলো। আর ২০০৮ ও ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে একাধারে ১১ বছর ক্ষমতায় থাকায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বর্তমান প্রজন্ম তথা আড়াই কোটি তরুণ ভোটার আজ উজ্জীবিত। সেই তরুণসমাজই আবার করোনাভাইরাস মুক্ত বিশ্ব গড়ার প্রত্যয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।-

২.

২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ কলেজ মাঠে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনি প্রচারণার অংশ হিসেবে আয়োজিত জনসভায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীদের প্রতিহত করতে নৌকায় ভোট দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীদের প্রতিহত করতে এবং যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে যারা হাত মিলিয়েছে তাদের রুখতে নৌকায় ভোট দিতে হবে।’ সারা দেশবাসীর কাছে তার আবেদন ছিল- যুদ্ধাপরাধী, খুনি, অগ্নিসন্ত্রাসীরা যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে সেজন্য নৌকায় ভোট দিতে হবে। আরও একবার আওয়ামী লীগকে জনগণের সেবা করার সুযোগ দিতে হবে। অন্যদিকে তিনি বলেন, ‘আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। জাতির পিতা স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের। আমি সেই লক্ষ্যে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছি।’ রাষ্ট্রনায়কের এই কথার মধ্যেও স্বাধীনতার প্রত্যয় অভিব্যক্ত হয়েছে। এর আগে একই বছর শোকের মাস আগস্টে তিনি বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করা হয়েছে।’ সেদিন তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষমতা ভোগের বস্তু নয়, ক্ষমতা হচ্ছে দায়িত্ব পালন। কাজেই সেই দায়িত্বটাই পালন করতে চাই। আমি সবসময় মনে রাখি যে, আমার বাবা দেশটাকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন, তাই জনগণের সেবা করাটা আমার প্রথম কর্তব্য।’ অর্থাৎ একজন রাষ্ট্রনায়কের প্রধান কর্তব্য জনগণের সেবা করা যা বঙ্গবন্ধু তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংগ্রাম আর সরকার প্রধান হিসেবে দেখিয়ে গেছেন। দেশপ্রেমিক শাসক আর জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার লালন করার মধ্যে স্বাধীনতার প্রত্যয় প্রকাশ পায়। প্রধানমন্ত্রীর কথার সূত্র ধরে বলতে হয়, স্বাধীনতা দিবসের ৪৯ বছর পূর্তিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে গেছে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পরও আমরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে নির্মূল করতে পারিনি। আমরা মনে করেছিলাম, রণাঙ্গনের সংগ্রামের ভেতর দিয়ে পাকিস্তানপন্থিদের অস্তিত্ব বিলীন হবে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে দেখলাম বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর ওই বাংলাদেশ বিরোধীরাই ২১ বছর একাধারে এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছে। এবং উপহার দিয়েছে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, সন্ত্রাস আর দুর্নীতি। তবে একথা মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই প্রধান প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। অবশ্য আজকে স্বাধীনতা দিবসে মনে রাখতে হবে আওয়ামী লীগ সবসময় এদেশের ‘উন্নয়ন’ ও ‘অগ্রগতি’ নিয়ে কথা বলেছে; দুর্যোগ মোকাবিলায় সচেষ্ট হয়েছে। অপরদিকে বিএনপির বক্তব্যে প্রাধান্য পেয়েছে ‘ক্ষমতা’র আকাক্সক্ষা। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আওয়ামী লীগের দিক থেকে উত্থাপিত হয়েছে বারবার। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে প্রগতিপন্থি। কেননা আমরা তাদেরই নেতৃত্বে স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু বিএনপির স্লোগানই হচ্ছে ‘ক্ষমতা’। আর সেই ‘ক্ষমতা’ পাওয়ায় বিএনপির প্রধান সহযোগী হচ্ছে জামায়াতে ইসলাম। গণতন্ত্র বিরোধী শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া কি সম্ভব? শুধু তাই নয় বিএনপির নিজের ভাবমূর্তি গণতান্ত্রিক কি? গত ১১ বছরে তাদের সুযোগ ছিল বিরোধী দল হিসেবে জনগণের আস্থার জায়গা তৈরি করা। বিশেষ করে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ, ১৫ আগস্টের নির্মমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বর্জন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা- তবেই তাদের দলীয় ভাবমূর্তি স্বচ্ছ হতো।মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্র আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম অনুধ্যান ছিল। কারণ আমাদের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির একেবারে মর্মমূলে রয়েছে গণতন্ত্রের আদর্শ। বাঙালির গণতান্ত্রিক চেতনাকে যখন রুদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল তদানীন্তন পাকিস্তান, তারই প্রতিবাদে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী দলকে একাত্তরে ক্ষমতায় যেতে দেওয়া হয়নি বলে যুদ্ধ হয়েছিল। এটা তাৎক্ষণিক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ। অবশ্য গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বঞ্চিত করার ঘটনা অনেকদিনের। সেই ইতিহাসে বাংলাদেশের মানুষকে, নানান প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ ও আপসহীন নেতৃত্বে ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬-দফা, ’৬৯-এর ১১-দফা ও গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে বাঙালি জাতি। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগষ্ঠিরতা অর্জন করে। ফলে বৈধ ভিত্তি পায় বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা। আবার এ কথাও সত্যি যে গত দীর্ঘ ৪৮ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার পথ মসৃণ ছিল না। কখনো একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় আর একাধিকবার সামরিক অভুত্থানে পিছিয়ে পড়েছে এদেশ। আজ যখন বাংলাদেশ ‘করোনাভাইরাসে’র দুর্যোগের মুখোমুখি তখন ঐক্যের তথা সংহতির কথা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। ফলে ফিরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রসঙ্গ। কারণ মুক্তিযুদ্ধ ছিল ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম; সম্মিলিত প্রয়াস। বিশ্বব্যাপী বর্তমান দুর্যোগে আমাদের ‘একাত্তর’-এর চেতনা এবং স্বাধীনতা দিবস অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে।

৩.

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীন রাষ্ট্র, নিজস্ব পতাকা ও জাতীয় সংগীত। ত্রিশ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ মা-বোনের অসামান্য আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। এজন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৭১-এ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা ও মুক্তির যে ডাক তিনি দিয়েছিলেন সেখান থেকে যাত্রারম্ভে অতীতের সংগ্রামের ইতিহাসকে স্মরণ করে ভবিষ্যৎপ্রসারি করতে হবে দৃষ্টিভঙ্গিকে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করে মুজিবনগর সরকার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রথম বাংলাদেশ সরকার হিসেবে খ্যাত এই সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল, ‘১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল। ... সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি।’ অবশ্য বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের আগে তার দেয়া ঘোষণাটি স্মরণ করা যায় এখানে- ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আমার আহ্বান, আপনারা যে যেখানেই থাকুন এবং যার যা কিছু আছে তা দিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করুন। বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বিতাড়িত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের এ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’

৪.

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ও নয় মাসের প্রতিরোধ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় বাংলাদেশের সংবিধান। গত ৪৮ বছরে সংবিধান সংশোধন হয়েছে ১৬ বার। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিভিন্ন সময়ে অগণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসে এই সংবিধানের চার মূলনীতিও বদলে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনী আনে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের পাশাপাশি অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ বিবেচনায় সর্বোচ্চ দণ্ডের বিধান রাখা হয় এ সংশোধনীতে। এছাড়া এ সংশোধনীর মাধ্যমে ’৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতি বাঙালি ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘সমাজতন্ত্র’, ‘গণতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ফিরিয়ে আনা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই ঘোষণাপত্র অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো স্বাধীন ভাবে বাঁচা, ব্যক্তিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক মুক্তি, সব মৌলিক অধিকার সমানভাবে নিশ্চিত করা। অর্থাৎ বৈষম্যহীন, মুক্ত এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন, রাষ্ট্রে বলিষ্ঠ জাতি হিসেবে আমাদের বিকাশের সুযোগ থাকা এবং রাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা আমাদের মানব সত্তা বিশ্বে মর্যাদা পাবে। কিন্তু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি প্রবেশ করায় স্বাধীনভাবে বিকশিত হওয়ার প্রত্যয় ব্যাহত হচ্ছে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা অনেক ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে আমাদেরকে এই স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন। কিন্তু দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও চেতনাকে অবমাননা করছে। সমাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আদর্শ ও নৈতিকতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং। তার শাসনামলে ১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘... সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়তে হলে দেশবাসীকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না- চরিত্রের পরিবর্তন না হলে এই অভাগা দেশের ভাগ্য ফেরানো যাবে কি না সন্দেহ। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের সবকে আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি করতে হবে।’ স্বাধীনতা দিবসের প্রত্যয় হোক- ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ওই কথা অনুসারে বলতে হয়, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতি, আইনকানুন প্রণয়ন ও প্রয়োগই যথেষ্ট নয়; তার জন্য সামগ্রিক এবং নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ন্যাশন মাস্ট বি ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট করাপশন। পাবলিক ওপিনিয়ন মবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যাবে না।’ স্বাধীনতার পর থেকেই দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় বহুবিধ আইন, বিধি-বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর আরও কিছু নতুন আইন প্রণয়ন করেছে, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার উন্নয়নে বেশ কিছু নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে এবং এগুলোর ব্যবস্থাপনা ও পদ্ধতির উন্নয়ন সাধন করা হয়েছে। ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৫-২০২০) শেখ হাসিনা সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রণীত ‘বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০১০-২০২১’ শীর্ষক দলিলে দুর্নীতি দমনকে একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। এ আন্দোলনে সবাইকে অংশীদার হতে উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে। এছাড়া দুর্নীতি দমনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম যেসব আইনগত মহাজোট সরকারের সময় প্রণীত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন-২০০৯’, ‘তথ্য অধিকার আইন-২০০৯’, ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯’, ‘সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন-২০০৯’, ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন-২০০৯’, ‘চার্টার্ড সেক্রেটারিজ আইন-২০১০’, ‘জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন-২০১১’, ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২’, ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২’, ‘প্রতিযোগিতা আইন-২০১২’ ইত্যাদি। এসব আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে দুর্নীতিমুক্ত রাখার প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, দুর্নীতি প্রতিরোধের বিধান ব্রিটিশ আমল থেকেই চালু রয়েছে। ১৮৬০ সালের Penal Code-এ দুর্নীতি প্রতিরোধের বিধান আছে। ১৯৪৭ সালে দুর্নীতি দমন আইন পাস হয়। ২০০৪ সালের ৫ নম্বর আইনে ‘দেশে দুর্নীতি ও দুর্নীতিমূলক কার্য প্রতিরোধের লক্ষ্যে দুর্নীতি ও অন্যান্য সুনির্দিষ্ট অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনার জন্য একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান’ প্রণীত হয়। এই আইনের আওতায় যেসব কার্য অপরাধ বলে বিবেচিত হয় তা হলো : ‘(ক) The Prevention of Corruption Act, 1947 (Act 11 of 1947)- এর অধীন শাস্তিযোগ্য অপরাধ; (খ) The Penal Code 1860 (Act XLV of 1860)-এর sections ১৬১-১৬৯, ২১৭, ২১৮, ৪০৮, ৪০৯ and ৪৭৭A -এর অধীন শাস্তিযোগ্য অপরাধসমূহ;’ এবং এসব অপরাধের সঙ্গে সংযুক্ত সহায়তাকারী ও ষড়যন্ত্রমূলক ও প্রচেষ্টামূলক অপরাধকার্য। ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২’-এর আওতাধীন অপরাধও দুর্নীতি হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু দুর্নীতিকে শুধু আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে দমন করা সম্ভব নয়, তার জন্য প্রয়োজন সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। এজন্য সরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, সুশীল সমাজ ও নাগরিকগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে দেশের যুবসমাজ বড় শক্তি।

৫.

স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের কথা বলতে হয়। এই বাংলাদেশ এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন হয়েছে। যে ‘শিক্ষানীতি ২০১০’-এ ছাত্রদের চরিত্র গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শিক্ষানীতির ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ তিন- অংশে বলা হয়েছে: ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে তোলা ও তাদের চিন্তা-চেতনায় দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ এবং তাদের চরিত্রে সুনাগরিকের গুণাবলি (যেমন : ন্যায়বোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ, কর্তব্যবোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, শৃঙ্খলা, সৎ জীবনযাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ, অধ্যবসায় ইত্যাদি) বিকাশ ঘটানো’ হবে। মূলত শিক্ষা সংক্রান্ত শেখ হাসিনার ভাবনার বাস্তবায়নই হচ্ছে জাতীয় শিক্ষানীতি’২০১০। অর্থাৎ জাতীয় শিক্ষানীতিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত। মুক্তিযুদ্ধের সরকারের সময় এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের কয়েকটি উন্নয়ন চিত্র এরকম- ২০০৬ সালের মাথাপিছু আয় যেখানে ছিল ৫৪৩ ডলার সেখানে ২০১৮ সালে হয়েছে ১৮০০ ডলার। পোশাক শ্রমিকের মাসিক বেতন ১৬০০ টাকা থেকে ৮০০০ টাকা উন্নীত হয়েছে। আগে বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হতো না, এখন বছরের প্রথম দিন ৩৭ কোটির বেশি বই বিতরণ করা হয়। শিক্ষার হার ৪৩.৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭২.৯ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার এখন প্রায় ২০ শতাংশ। খাদ্য ঘাটতির দেশ ছিল ২০০৬ সালে এখন খাদ্যে উদ্বৃত্তের দেশ। প্রবৃদ্ধির হার ৫.০৪ থেকে ৭.৮৬ এ উন্নীত হয়েছে। ২০১৮ সালের ১১ মে মহাকাশে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ উৎক্ষেপন হওয়ার মধ্য দিয়ে এদেশের ভাবমূর্তি বিশ্বের কাছে আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। পোশাক রপ্তানিতে এদেশ বৈশ্বিক অবস্থানের দিক থেকে ২য়। বাংলাদেশ আজ ধান বা চাল উৎপাদনে ৪র্থ, সবজিতে ৩য়, মিঠা পানির মাছে ৩য়, আলু উৎপাদনে ৭ম। মানব উন্নয়ন সূচকে এদেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত হচ্ছে রাষ্ট্র। ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে উন্নয়ন, অগ্রগতির শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও পথ রচনা করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং দেশকে শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তৃতীয়বার একটানা দেশ সেবার সুযোগ পেয়েছে। তার আগেই মহাজোট সরকারের আমলে দেশবাসী সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত এখন, অপুষ্টির অভিশাপ দূর হতে যাচ্ছে; দারিদ্র্যের লজ্জা ঘুচেছে, নিরক্ষরতা দূর হচ্ছে, শিক্ষিত দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে উঠছে, শিল্প-সভ্যতার ভিত্তি রচিত হয়েছে; ‘মুজিববর্ষে’ প্রতি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে বেকারত্বের অবসান ও কোটি কোটি যুবসমাজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটচ্ছে; যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হচ্ছে, পরিকল্পিত নগর-জনপদ গড়ে উঠছে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ সমৃদ্ধির সোপানে পা রাখছে। রাজনীতি থেকে হিংসা, হানাহানি, সংঘাতের অবসান হচ্ছে, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের ধারা থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে এসেছে; গড়ে উঠেছে একটি সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। ২০৪১ সালের বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের পর্যায় পেরিয়ে এক শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ, সুখী এবং উন্নত জনপদ। সুশাসন, জনগণের সক্ষমতা ও ক্ষমতায়ন হবে এই অগ্রযাত্রার মূলমন্ত্র।

৬.

একাত্তরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস থেকে যে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয় সেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রকাঠামো পেয়েছি। যে রাষ্ট্রের ভিত্তি গণতন্ত্র, সামাজিক সাম্য এবং মৌলিক অধিকার চর্চা। আজ আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে মর্যাদায় অভিষিক্ত। যে রাজনৈতিক সংগ্রাম আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে এই রাষ্ট্রের জন্ম সেই ইতিহাসকে যথাযথ উপলব্ধি করাই হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই চেতনার মধ্যে দাবি আদায়ের আদর্শ রয়েছে, মুক্তির স্বপ্ন আছে আর আছে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ না করার মূল্যবোধ। অন্যদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য ও মানবাধিকার আমাদের স্বাধীনতা দিবসের অন্যতম প্রত্যয়।

[লেখক :ড. মিল্টন বিশ্বাস,বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]

writermiltonbiswas@gmail.com)

বৃহস্পতিবার, ২৬ মার্চ ২০২০ , ১২ চৈত্র ১৪২৬, ২৬ রজব সানি ১৪৪১

স্বাধীনতা দিবসের প্রত্যয়

‘মুজিববর্ষ’ ও বিশ্বব্যাপী ‘করোনা’ মহামারীর মধ্যে দাঁড়িয়ে আমরা আজ স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছি। একদিকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষকে আগামী ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা; অন্যদিকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর জন্য আমাদের অধীর অপেক্ষা- অর্থাৎ বাঙালির গৌরব কীর্তিত হওয়ার মুহূর্তে বেঁচে থাকা নিয়ে সংকটের নিদারুণ মানসিক চাপে দিশেহারা আমরা। তবু যেহেতু ২৬ মার্চ, যেহেতু বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার দিন, যেহেতু দুর্যোগ মোকাবিলার প্রত্যয়- সব মিলে এই দিবসের তাৎপর্য আমাদের জীবনে অনেক বড়। গভীরতর অর্থে, চেতনার পরিমাপে স্বাধীনতার একটি ব্যাপক এবং বহুমাত্রিক রূপ রয়েছে। ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানি স্বৈরশাসনবিরোধী প্রতিটি আন্দোলনের সেই অনিঃশেষ চেতনা আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন করেছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের গণজাগরণ ও সংগ্রামী চেতনার স্পর্শে এক অপরিমেয় সম্ভাবনায় উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল আমাদের জনতা। সেই উজ্জীবনী শক্তি একাত্তরের রক্তস্নাত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে বর্তমান সময়েও বহমান। সংগত কারণেই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতিতে স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্যকে নতুন করে মূল্যায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জাতীয় জীবনে অপরিমেয় ত্যাগ, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও সাফল্যের সূর্যোদয়ে গৌরবময়। বাঙালির ইতিহাসের রয়েছে গতিশীল ও দ্বন্দ্বময় ধারা। পলাশীর বিপর্যয় (১৭৫৭), সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭), কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বিভেদের রাজনীতি, পাকিস্তান আন্দোলন, ১৯৪৭-এর অসংগত রাজনৈতিক মীমাংসা, ভাষা-আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান প্রভৃতি ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জীবনে সেই ঐতিহাসিক নিয়মেই চরম অগ্নিপরীক্ষা। এই পরীক্ষায় সামষ্টিক অস্তিত্বের প্রশ্নে সমগ্র জাতি এক অভিন্ন বিন্দুতে মিলিত হয় এবং নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি তার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাকে করতলগত করে। যুদ্ধোত্তরকালে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা সদ্য স্বাধীন দেশের বাস্তবতায় ছিল ভয়ঙ্কর ও অনাকাক্সিক্ষত। এ সময় থেকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের নবতর অভিযাত্রা ব্যাহত করা হয়েছিল। সে সময় যুগান্তকারী সব পরিবর্তন-সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হওয়ার পরই আবার রুদ্ধ হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের মুক্ত চেতনা, গণতন্ত্রায়ন ও শিল্পায়নের অবাধ বিকাশ হলো প্রলম্বিত। দীর্ঘ ২১ বছর পর পুনরায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন, জয় বাংলা ধ্বনিত হলো এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হলো। আর ২০০৮ ও ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে একাধারে ১১ বছর ক্ষমতায় থাকায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বর্তমান প্রজন্ম তথা আড়াই কোটি তরুণ ভোটার আজ উজ্জীবিত। সেই তরুণসমাজই আবার করোনাভাইরাস মুক্ত বিশ্ব গড়ার প্রত্যয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।-

২.

২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ কলেজ মাঠে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনি প্রচারণার অংশ হিসেবে আয়োজিত জনসভায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীদের প্রতিহত করতে নৌকায় ভোট দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীদের প্রতিহত করতে এবং যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে যারা হাত মিলিয়েছে তাদের রুখতে নৌকায় ভোট দিতে হবে।’ সারা দেশবাসীর কাছে তার আবেদন ছিল- যুদ্ধাপরাধী, খুনি, অগ্নিসন্ত্রাসীরা যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে সেজন্য নৌকায় ভোট দিতে হবে। আরও একবার আওয়ামী লীগকে জনগণের সেবা করার সুযোগ দিতে হবে। অন্যদিকে তিনি বলেন, ‘আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। জাতির পিতা স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের। আমি সেই লক্ষ্যে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছি।’ রাষ্ট্রনায়কের এই কথার মধ্যেও স্বাধীনতার প্রত্যয় অভিব্যক্ত হয়েছে। এর আগে একই বছর শোকের মাস আগস্টে তিনি বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করা হয়েছে।’ সেদিন তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষমতা ভোগের বস্তু নয়, ক্ষমতা হচ্ছে দায়িত্ব পালন। কাজেই সেই দায়িত্বটাই পালন করতে চাই। আমি সবসময় মনে রাখি যে, আমার বাবা দেশটাকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন, তাই জনগণের সেবা করাটা আমার প্রথম কর্তব্য।’ অর্থাৎ একজন রাষ্ট্রনায়কের প্রধান কর্তব্য জনগণের সেবা করা যা বঙ্গবন্ধু তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংগ্রাম আর সরকার প্রধান হিসেবে দেখিয়ে গেছেন। দেশপ্রেমিক শাসক আর জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার লালন করার মধ্যে স্বাধীনতার প্রত্যয় প্রকাশ পায়। প্রধানমন্ত্রীর কথার সূত্র ধরে বলতে হয়, স্বাধীনতা দিবসের ৪৯ বছর পূর্তিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে গেছে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পরও আমরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে নির্মূল করতে পারিনি। আমরা মনে করেছিলাম, রণাঙ্গনের সংগ্রামের ভেতর দিয়ে পাকিস্তানপন্থিদের অস্তিত্ব বিলীন হবে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে দেখলাম বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর ওই বাংলাদেশ বিরোধীরাই ২১ বছর একাধারে এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছে। এবং উপহার দিয়েছে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, সন্ত্রাস আর দুর্নীতি। তবে একথা মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই প্রধান প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। অবশ্য আজকে স্বাধীনতা দিবসে মনে রাখতে হবে আওয়ামী লীগ সবসময় এদেশের ‘উন্নয়ন’ ও ‘অগ্রগতি’ নিয়ে কথা বলেছে; দুর্যোগ মোকাবিলায় সচেষ্ট হয়েছে। অপরদিকে বিএনপির বক্তব্যে প্রাধান্য পেয়েছে ‘ক্ষমতা’র আকাক্সক্ষা। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আওয়ামী লীগের দিক থেকে উত্থাপিত হয়েছে বারবার। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে প্রগতিপন্থি। কেননা আমরা তাদেরই নেতৃত্বে স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু বিএনপির স্লোগানই হচ্ছে ‘ক্ষমতা’। আর সেই ‘ক্ষমতা’ পাওয়ায় বিএনপির প্রধান সহযোগী হচ্ছে জামায়াতে ইসলাম। গণতন্ত্র বিরোধী শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া কি সম্ভব? শুধু তাই নয় বিএনপির নিজের ভাবমূর্তি গণতান্ত্রিক কি? গত ১১ বছরে তাদের সুযোগ ছিল বিরোধী দল হিসেবে জনগণের আস্থার জায়গা তৈরি করা। বিশেষ করে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ, ১৫ আগস্টের নির্মমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বর্জন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা- তবেই তাদের দলীয় ভাবমূর্তি স্বচ্ছ হতো।মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্র আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম অনুধ্যান ছিল। কারণ আমাদের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির একেবারে মর্মমূলে রয়েছে গণতন্ত্রের আদর্শ। বাঙালির গণতান্ত্রিক চেতনাকে যখন রুদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল তদানীন্তন পাকিস্তান, তারই প্রতিবাদে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী দলকে একাত্তরে ক্ষমতায় যেতে দেওয়া হয়নি বলে যুদ্ধ হয়েছিল। এটা তাৎক্ষণিক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ। অবশ্য গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বঞ্চিত করার ঘটনা অনেকদিনের। সেই ইতিহাসে বাংলাদেশের মানুষকে, নানান প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ ও আপসহীন নেতৃত্বে ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬-দফা, ’৬৯-এর ১১-দফা ও গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে বাঙালি জাতি। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগষ্ঠিরতা অর্জন করে। ফলে বৈধ ভিত্তি পায় বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা। আবার এ কথাও সত্যি যে গত দীর্ঘ ৪৮ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার পথ মসৃণ ছিল না। কখনো একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় আর একাধিকবার সামরিক অভুত্থানে পিছিয়ে পড়েছে এদেশ। আজ যখন বাংলাদেশ ‘করোনাভাইরাসে’র দুর্যোগের মুখোমুখি তখন ঐক্যের তথা সংহতির কথা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। ফলে ফিরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রসঙ্গ। কারণ মুক্তিযুদ্ধ ছিল ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম; সম্মিলিত প্রয়াস। বিশ্বব্যাপী বর্তমান দুর্যোগে আমাদের ‘একাত্তর’-এর চেতনা এবং স্বাধীনতা দিবস অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে।

৩.

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীন রাষ্ট্র, নিজস্ব পতাকা ও জাতীয় সংগীত। ত্রিশ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ মা-বোনের অসামান্য আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। এজন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৭১-এ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা ও মুক্তির যে ডাক তিনি দিয়েছিলেন সেখান থেকে যাত্রারম্ভে অতীতের সংগ্রামের ইতিহাসকে স্মরণ করে ভবিষ্যৎপ্রসারি করতে হবে দৃষ্টিভঙ্গিকে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করে মুজিবনগর সরকার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রথম বাংলাদেশ সরকার হিসেবে খ্যাত এই সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল, ‘১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল। ... সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি।’ অবশ্য বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের আগে তার দেয়া ঘোষণাটি স্মরণ করা যায় এখানে- ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আমার আহ্বান, আপনারা যে যেখানেই থাকুন এবং যার যা কিছু আছে তা দিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করুন। বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বিতাড়িত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের এ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’

৪.

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ও নয় মাসের প্রতিরোধ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় বাংলাদেশের সংবিধান। গত ৪৮ বছরে সংবিধান সংশোধন হয়েছে ১৬ বার। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিভিন্ন সময়ে অগণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসে এই সংবিধানের চার মূলনীতিও বদলে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনী আনে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের পাশাপাশি অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ বিবেচনায় সর্বোচ্চ দণ্ডের বিধান রাখা হয় এ সংশোধনীতে। এছাড়া এ সংশোধনীর মাধ্যমে ’৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতি বাঙালি ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘সমাজতন্ত্র’, ‘গণতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ফিরিয়ে আনা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই ঘোষণাপত্র অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো স্বাধীন ভাবে বাঁচা, ব্যক্তিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক মুক্তি, সব মৌলিক অধিকার সমানভাবে নিশ্চিত করা। অর্থাৎ বৈষম্যহীন, মুক্ত এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন, রাষ্ট্রে বলিষ্ঠ জাতি হিসেবে আমাদের বিকাশের সুযোগ থাকা এবং রাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা আমাদের মানব সত্তা বিশ্বে মর্যাদা পাবে। কিন্তু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি প্রবেশ করায় স্বাধীনভাবে বিকশিত হওয়ার প্রত্যয় ব্যাহত হচ্ছে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা অনেক ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে আমাদেরকে এই স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন। কিন্তু দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও চেতনাকে অবমাননা করছে। সমাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আদর্শ ও নৈতিকতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং। তার শাসনামলে ১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘... সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়তে হলে দেশবাসীকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না- চরিত্রের পরিবর্তন না হলে এই অভাগা দেশের ভাগ্য ফেরানো যাবে কি না সন্দেহ। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের সবকে আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি করতে হবে।’ স্বাধীনতা দিবসের প্রত্যয় হোক- ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ওই কথা অনুসারে বলতে হয়, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতি, আইনকানুন প্রণয়ন ও প্রয়োগই যথেষ্ট নয়; তার জন্য সামগ্রিক এবং নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ন্যাশন মাস্ট বি ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট করাপশন। পাবলিক ওপিনিয়ন মবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যাবে না।’ স্বাধীনতার পর থেকেই দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় বহুবিধ আইন, বিধি-বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর আরও কিছু নতুন আইন প্রণয়ন করেছে, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার উন্নয়নে বেশ কিছু নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে এবং এগুলোর ব্যবস্থাপনা ও পদ্ধতির উন্নয়ন সাধন করা হয়েছে। ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৫-২০২০) শেখ হাসিনা সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রণীত ‘বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০১০-২০২১’ শীর্ষক দলিলে দুর্নীতি দমনকে একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। এ আন্দোলনে সবাইকে অংশীদার হতে উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে। এছাড়া দুর্নীতি দমনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম যেসব আইনগত মহাজোট সরকারের সময় প্রণীত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন-২০০৯’, ‘তথ্য অধিকার আইন-২০০৯’, ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯’, ‘সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন-২০০৯’, ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন-২০০৯’, ‘চার্টার্ড সেক্রেটারিজ আইন-২০১০’, ‘জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন-২০১১’, ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২’, ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২’, ‘প্রতিযোগিতা আইন-২০১২’ ইত্যাদি। এসব আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে দুর্নীতিমুক্ত রাখার প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, দুর্নীতি প্রতিরোধের বিধান ব্রিটিশ আমল থেকেই চালু রয়েছে। ১৮৬০ সালের Penal Code-এ দুর্নীতি প্রতিরোধের বিধান আছে। ১৯৪৭ সালে দুর্নীতি দমন আইন পাস হয়। ২০০৪ সালের ৫ নম্বর আইনে ‘দেশে দুর্নীতি ও দুর্নীতিমূলক কার্য প্রতিরোধের লক্ষ্যে দুর্নীতি ও অন্যান্য সুনির্দিষ্ট অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনার জন্য একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান’ প্রণীত হয়। এই আইনের আওতায় যেসব কার্য অপরাধ বলে বিবেচিত হয় তা হলো : ‘(ক) The Prevention of Corruption Act, 1947 (Act 11 of 1947)- এর অধীন শাস্তিযোগ্য অপরাধ; (খ) The Penal Code 1860 (Act XLV of 1860)-এর sections ১৬১-১৬৯, ২১৭, ২১৮, ৪০৮, ৪০৯ and ৪৭৭A -এর অধীন শাস্তিযোগ্য অপরাধসমূহ;’ এবং এসব অপরাধের সঙ্গে সংযুক্ত সহায়তাকারী ও ষড়যন্ত্রমূলক ও প্রচেষ্টামূলক অপরাধকার্য। ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২’-এর আওতাধীন অপরাধও দুর্নীতি হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু দুর্নীতিকে শুধু আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে দমন করা সম্ভব নয়, তার জন্য প্রয়োজন সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। এজন্য সরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, সুশীল সমাজ ও নাগরিকগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে দেশের যুবসমাজ বড় শক্তি।

৫.

স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের কথা বলতে হয়। এই বাংলাদেশ এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন হয়েছে। যে ‘শিক্ষানীতি ২০১০’-এ ছাত্রদের চরিত্র গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শিক্ষানীতির ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ তিন- অংশে বলা হয়েছে: ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে তোলা ও তাদের চিন্তা-চেতনায় দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ এবং তাদের চরিত্রে সুনাগরিকের গুণাবলি (যেমন : ন্যায়বোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ, কর্তব্যবোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, শৃঙ্খলা, সৎ জীবনযাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ, অধ্যবসায় ইত্যাদি) বিকাশ ঘটানো’ হবে। মূলত শিক্ষা সংক্রান্ত শেখ হাসিনার ভাবনার বাস্তবায়নই হচ্ছে জাতীয় শিক্ষানীতি’২০১০। অর্থাৎ জাতীয় শিক্ষানীতিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত। মুক্তিযুদ্ধের সরকারের সময় এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের কয়েকটি উন্নয়ন চিত্র এরকম- ২০০৬ সালের মাথাপিছু আয় যেখানে ছিল ৫৪৩ ডলার সেখানে ২০১৮ সালে হয়েছে ১৮০০ ডলার। পোশাক শ্রমিকের মাসিক বেতন ১৬০০ টাকা থেকে ৮০০০ টাকা উন্নীত হয়েছে। আগে বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হতো না, এখন বছরের প্রথম দিন ৩৭ কোটির বেশি বই বিতরণ করা হয়। শিক্ষার হার ৪৩.৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭২.৯ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার এখন প্রায় ২০ শতাংশ। খাদ্য ঘাটতির দেশ ছিল ২০০৬ সালে এখন খাদ্যে উদ্বৃত্তের দেশ। প্রবৃদ্ধির হার ৫.০৪ থেকে ৭.৮৬ এ উন্নীত হয়েছে। ২০১৮ সালের ১১ মে মহাকাশে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ উৎক্ষেপন হওয়ার মধ্য দিয়ে এদেশের ভাবমূর্তি বিশ্বের কাছে আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। পোশাক রপ্তানিতে এদেশ বৈশ্বিক অবস্থানের দিক থেকে ২য়। বাংলাদেশ আজ ধান বা চাল উৎপাদনে ৪র্থ, সবজিতে ৩য়, মিঠা পানির মাছে ৩য়, আলু উৎপাদনে ৭ম। মানব উন্নয়ন সূচকে এদেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত হচ্ছে রাষ্ট্র। ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে উন্নয়ন, অগ্রগতির শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও পথ রচনা করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং দেশকে শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তৃতীয়বার একটানা দেশ সেবার সুযোগ পেয়েছে। তার আগেই মহাজোট সরকারের আমলে দেশবাসী সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত এখন, অপুষ্টির অভিশাপ দূর হতে যাচ্ছে; দারিদ্র্যের লজ্জা ঘুচেছে, নিরক্ষরতা দূর হচ্ছে, শিক্ষিত দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে উঠছে, শিল্প-সভ্যতার ভিত্তি রচিত হয়েছে; ‘মুজিববর্ষে’ প্রতি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে বেকারত্বের অবসান ও কোটি কোটি যুবসমাজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটচ্ছে; যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হচ্ছে, পরিকল্পিত নগর-জনপদ গড়ে উঠছে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ সমৃদ্ধির সোপানে পা রাখছে। রাজনীতি থেকে হিংসা, হানাহানি, সংঘাতের অবসান হচ্ছে, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের ধারা থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে এসেছে; গড়ে উঠেছে একটি সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। ২০৪১ সালের বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের পর্যায় পেরিয়ে এক শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ, সুখী এবং উন্নত জনপদ। সুশাসন, জনগণের সক্ষমতা ও ক্ষমতায়ন হবে এই অগ্রযাত্রার মূলমন্ত্র।

৬.

একাত্তরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস থেকে যে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয় সেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রকাঠামো পেয়েছি। যে রাষ্ট্রের ভিত্তি গণতন্ত্র, সামাজিক সাম্য এবং মৌলিক অধিকার চর্চা। আজ আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে মর্যাদায় অভিষিক্ত। যে রাজনৈতিক সংগ্রাম আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে এই রাষ্ট্রের জন্ম সেই ইতিহাসকে যথাযথ উপলব্ধি করাই হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই চেতনার মধ্যে দাবি আদায়ের আদর্শ রয়েছে, মুক্তির স্বপ্ন আছে আর আছে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ না করার মূল্যবোধ। অন্যদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য ও মানবাধিকার আমাদের স্বাধীনতা দিবসের অন্যতম প্রত্যয়।

[লেখক :ড. মিল্টন বিশ্বাস,বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]

writermiltonbiswas@gmail.com)