বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসাধারণ প্রজ্ঞাবান নেতা

ড. আনু মাহ্মুদ

বাঙালিদের মনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার স্ফুরণ ঘটানোর জন্য যে রাজনৈতিক উদ্যম প্রয়োজন ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাই সেক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করেছিলেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবি পেশ করার পর ১৯৬৯-এর মার্চ থেকে ১৯৭১-এর মার্চ পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত হন, এর মধ্যে আবার ঐতিহাসিকভাবে গভীর তাৎপর্যবাহী একটি নির্বাচনী অভিযান পরিচালনার মধ্য দিয়ে তার নেতৃত্বের অনন্য সাধারণ রূপটি ফুটে ওঠে।

১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত রাজনৈতিক সংগ্রামকালে এসব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ রাখাটা তার এক অসামান্য কীর্তি। বাঙালিদের মধ্যকার সামান্য অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানি শাসকরা যাতে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি থেকে বিচ্যুত করতে না পারে সেজন্য বঙ্গবন্ধু অতন্ত্র প্রহরীর মতো সদা-সজাগ থেকেছেন। এ আলোচ্য দুটি বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণের অবিসংবাদিত নেতা এবং তাদের জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেন। এ সময় কালেই একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের পরিচয় ছাপিয়ে তিনি এ বাংলায় ও বাংলাদেশের মানুষের কাছে যেন কিংবদন্তি হয়ে উঠলেন।

তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের লোক, ছিলেন জনতার নেতা। রাজনীতির তাত্ত্বিক প-িত তিনি কখনই ছিলেন না। তিনি একজন সর্বজ্ঞানী স্কলার অথবা কোনো এক বা একাধিক বিষয়ে অসাধারণ দক্ষতাসম্পন্ন একজন বিশেষজ্ঞও ছিলেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রজ্ঞাবান একজন নেতা। তিনি ছিলেন মানুষের লোক। মানুষের কাছ থেকে তিনি গ্রহণ করতে পারতেন, বিচার-বিবেচনার রসদ সঞ্চয় করতে পারতেন। সব বিষয়ে শেষ ভরসা করতেন মানুষের ওপরে। মানুষের ওপর, জনতার ওপর তার এমন অপার ভালোবাসা ও নৈকট্যই তার অপরিবর্তনের প্রগতিমুখীন হওয়াটাকে স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল।

শুরুতে তিনি ছিলেন এক দুরন্ত কিশোর-মুজিবুর, অনেকের কাছে মুজিব ভাই। এরপর মুজিবুর রহমান অথবা শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তীতে বহুদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে তার নাম ছিল ‘শেখ সাহেব’, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন পরিচয় ‘বঙ্গবন্ধু’। আর একাত্তরের পর তিনিই হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি এবং ‘জাতির পিতা’। তিন দশক সময়কালের মধ্যে এভাবেই ঘটেছিল তার অবস্থানের উত্তরণ।

তিনি তার তিন দশকের রাজনৈতিক জীবনে তার চিন্তাধারা-জীবন দর্শনেও উত্তরণ ঘটেছিল, শুরুটা ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের ছাত্রকর্মী হিসেবে। কিন্তু সে সময়ও মুসলিম লীগের মধ্যে উদারনৈতিক ও কিছুটা প্রগতিশীল যে প্রবণতা ও অংশ ছিল, বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই আবুল হাশেম-সোহরাওয়ার্দী সাহেবের অনুগামী। তিনি ছিলেন ঢাকার নবাবদের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের বিরুদ্ধে। তিনি একই সাথে ছিলেন নেতাজী সুভাষ বোসের ভক্ত। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, ও কমিউনিস্ট- এই তিন দলের ঝাণ্ডা নিয়ে কলকাতায় ‘রশিদ আলী দিবস’ পালনসহ নানা কর্মসূচিতে সঙ্গী-সাথী অনুগামীসহ তিনি ছিলেন একজন উৎসাহী যৌবন দীপ্ত অংশগ্রহণকারী।

মুসলিম লীগের কর্মী থাকার সময় থেকেই কমিউনিস্ট ও বামপন্থিদের সাথে তার পরিচয়, কিছুটা ঘনিষ্ঠতার সূচনা। তখন থেকেই তার মাঝে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি একটি গভীর মনের টানের উন্মেষ। সাথে সাথে অসাম্প্রদায়িক বোধের জাগরণ।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালি জাতির ওপর পরিচালিত শোষণ-বঞ্চনা, বাংলা ভাষার ওপর আঘাত, প্রতিক্রিয়াশালী অংশের দ্বারা মুসলিম লীগের নেতৃত্বে করায়ত্ত হওয়া তাকে অতিদ্রুতই পাকিস্তান সম্পর্কে মোহমুক্ত করে তোলে, সাধারণ কর্মচারীদের দাবি নিয়ে সংগ্রাম করে তিনি কারাগারে যান। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তিনি ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগের একজন প্রধান সংগঠক হয়ে ওঠেন। জেলে ও জেলের বাইরে কাজ করতে করতে কমিউনিস্ট ও বামপন্থিদের সাথে তার সংযোগ আরও ঘনিষ্ঠ হয়।

সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের বছরগুলোতে কারাগারগুলো ভরে উঠল রাজনৈতিক বন্দিদের দিয়ে। ‘শেখ সাহেব’ এবং আরও অনেককে যেতে হলো কারাগারে। অনেকের জন্যই হয়ে উঠল একবার জেলে ঢোকা, কিছুদিন পর জেল থেকে বের হয়ে আসা, তারপর আবার জেলে যাওয়া, অন্যান্য সব রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ‘শেখ সাহেবেও দেখলেন যে, ‘আমরা তো আসি-যাই, কিন্তু জেলখানায় প্রায় স্থায়ী বসবাসকারী হয়ে রয়েছেন একঝাঁক ঋষিতুল্য কমিউনিস্ট নেতা। তাদের কাজ তো দেখি সব সময় আমাদের অভ্যর্থনা জানানো ও বিদায় দেয়া।’ কমিউনিস্টদের আত্মত্যাগ তাকে অভিভূত করে। এ কারণে তিনি আজীবন কমিউনিস্টদের শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তাদের সমাজতন্ত্রের আদর্শের প্রতিও একটি সহানুভূতি ও আকর্ষণ তার মধ্যে গড়ে উঠতে থাকে। তাতে তিনি ছিলেন সোজাসাপটা কাজের মানুষ। তিনি তার অসাধারণ প্রজ্ঞা ও হৃদয়ের সিগন্যাল বুঝে অগ্রসর হতেন। সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ নিয়ে তত ব্যস্ত থাকতেন না। কমিউনিস্টদের তিনি ঠাট্টা করে বলতেন, ‘আপনাদের বুদ্ধি একটু বেশি, তবে আক্কেল একটু কম; তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি কমিউনিস্টদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নিতেন। তাদের পরামর্শ মেনে চলতেন, এমনটা সব সময় না ঘটলেও সেই পরামর্শগুলো হিসাবে নিতেন।

’৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর ‘শেখ সাহেব’ বুঝতে পারেন, এখন স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে রেখে বাঙালির স্বাধিকারের জন্য জোরেশোরে নামার সময় এসে গেছে। তিনি ৬ দফা দাবি পেশ করে আন্দোলনে নেমে পড়েন। আওয়ামী লীগের প্রবীন ও নাম ডাকওয়ালা নেতাদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে তিনি দৃঢ়চেতনাভাবে এগিয়ে যেতে থাকেন। আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের আক্রমণকে উপেক্ষা করে ‘শেখ সাহেব’ সাহসী মহাবীরের মতো আপসহীনভাবে এগিয়ে যেতে থাকেন বাঙালির স্বাধিকারের দাবি নিয়ে। দলের কর্মীরাই শুধু নয়, সমগ্র দেশবাসী, এ ৬ দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তার পেছনে সমবেত হতে থাকেন।

সরকার মরিয়া হয়ে তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাকে সবদিক দিয়ে ‘শেষ করে দেয়ার’ চেষ্টায় নামে। কিন্তু ‘শেখ সাহেব’ ছিলেন ইতিহাসের পক্ষে, তিনি ইতিহাস সৃষ্টির জন্য একজন ‘ইতিহাসের মহানায়কের’ যেসব বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী থাকা অপরিহার্য সেরূপ প্রজ্ঞা, জেদ, প্রত্যয় ও দক্ষতাসম্পন্ন একজন জননেতা ছিলেন। পাকিস্তান-সরকারের প্রতিটি আঘাত সে সময় তার জন্য বরমাল্য স্বরূপ ভূষণ হয়ে ওঠে। ক্রমান্বয়ে তার জনপ্রিয়তা অসামান্য উঁচুস্তরে পৌঁছে যায়, তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির একক ও অবিসংবাদিত নেতা। ৬ দফাকে প্রগতিশীল কর্মসূচিতে সমৃদ্ধ করে রচিত হয় ঐতিহাসিক ১১ দফা। সংগঠিত হল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। জেল থেকে মুক্ত হয়ে আসেন মহানায়ক ‘শেখ সাহেব’ হয়ে ওঠেন ‘বঙ্গবন্ধু’।

’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু তার দলকে নিয়ে অভূতপূর্ব বিজয় ছিনিয়ে আনেন। ইয়াহিয়া খান সেই বিজয়কে কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে জাতীয় পরিষদের বৈঠক বাতিল করে দেন। দেশের অঘোষিত সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার অধিকারকে এভাবে নস্যাৎ করার পথ গ্রহণ করা হয়। প্রতিবাদে গর্জে ওঠে সমগ্র বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধু জনতার ক্রোধ ও স্বাধিকারের প্রত্যয়কে দারুণ করে জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে এগিয়ে নেন। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্বাধীনতার পথে বাঙালির যাত্রার শীর্ষপর্যায়ের ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অধ্যায়ের সূচনা সেখান থেকেই। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে জেগে ওঠা জাতির ঐক্যের প্রতীক। স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক।

১৬ ডিসেম্বর নয় মাসব্যাপী এক সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ এবং ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ হয় লাল-সবুজের পতাকার বাংলাদেশ। কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ১০ জানুয়ারি পদার্পণ করেন জাতির জনক। নতুন রাষ্ট্রের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় সাংবিধানিক রূপ প্রদানের কাজটি তার নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। রচিত হয় ’৭২-এর সংবিধান, ঘোষিত হয় চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি। সৃষ্টি হয় নয়া ইতিহাস।

‘ইতিহাসের মহানায়ক’ যে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন, তা একাধারে তার এবং জনগণের অমর সৃষ্টি এই সৃষ্টির মূল নির্যাস হলো নতুন বৈশিষ্ট্য ও চরিতসম্পন্ন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ, আর তার চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের স্বরূপ হলো- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সংবলিত ’৭২ সালের সংবিধান। অনেক উপাদান দিয়েই একটি দেশের একটি ‘রাজনৈতিক পর্ব’ রচিত হতে পারে। কিন্তু সব উপাদান দিয়ে একটি দেশের ‘ইতিহাস’ সৃষ্টি হয় না। ইতিহাস সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন হয় ‘ঐতিহাসিক উপাদান’, চার রাষ্ট্রীয় আদর্শসম্পন্ন নতুন রাষ্ট্রের জন্মের প্রধান স্থপতি হওয়াটাই হলো সেই এতিহাসিক উপাদান; যার কারণে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছেন ‘ইতিহাসের মহানায়ক।’ ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার হলো ’৭২-এর সংবিধানের মূল আদর্শিক ভিত্তি।

১৯৭২ সালে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-

‘ছাত্রজীবন থেকে আজ পর্যন্ত আমার এই সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রাম কতিপয় চিন্তাধারার ওপর গড়ে উঠেছে। এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী তথা সকল মেহনতি মানুষের জীবনে শান্তি সমৃদ্ধি ও সাম্য প্রতিষ্ঠাই আমার চিন্তাধারার মূল বিষয়বস্তু। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। কাজেই কৃষকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে আমি জানি শোষণ কাকে বলে। এ দেশে যুগ যুগ ধরে শোষিত হয়েছে কৃষক। শোষিত হয়েছে শ্রমিক, শোষিত হয়েছে বুদ্ধিজীবীসহ সকল মেহনতি মানুষ। এ দেশের জমিদার, জোতদার, মহাজন ও তাদের আমলা-টাউটদের চলে শোষণ। শোষণ চলে ফড়িয়া ব্যবসায়ী ও পুঁজিবাদের, শোষণ চলে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদের। এ দেশের সোনার মানুষ, এ দেশের মাটির মানুষ শোষণে শোষণে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের মুক্তির পথ কী? এই প্রশ্ন আমাকেও দিশেহারা করে ফেলে। পরে আমি পথের সন্ধান পাই। আমার কোনো কোনো সহযোগী রাজনৈতিক দল ও প্রগতিশীল বন্ধুবান্ধব বলেন শ্রেণী-সংগ্রামের কথা। কিন্তু আমি বলি জাতীয়তাবাদের কথা। এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, তার জবাবে আমি বলি, যার যার ধর্ম তার তার- এরই ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের কথা, শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সমাজতন্ত্র চাই। কিন্তু রক্তপাত ঘটিয়ে নয়- গণতান্ত্রিক পন্থায়, সংসদীয় বিধিবিধানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে চাই সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা।

আমার এই মতবাদ বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করেই দাঁড় করিয়েছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, যুগোশ্লাভিয়া প্রত্যকে নিজ নিজ অবস্থা মোতাবেক গড়ে তুলছে সমাজতন্ত্র। আমি মনে করি, বাংলাদেশকেও অগ্রসর হতে হবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র- এই চারটি মূল সূত্র ধরে, বাংলাদেশের নিজস্ব পথ ধরে।’

বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে উল্লেখ করেন- হানাদার পাকিস্তানিরা যাওয়ার পূর্বে ১৬ ডিসেম্বরের আগে কারফিউ দিয়ে ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গায় আমার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল, উদ্দেশ্য ছিল- বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করব, ধ্বংস করব, বাঙালি স্বাধীনতা পেলেও এই স্বাধীনতা রাখতে পারবে না। ইনশাআল্লাহ স্বাধীনতা রক্ষা হয়েছে। বাংলাদেশ দুনিয়ায় এসেছে, বাংলাদেশ থাকবে, কেউ একে ধ্বংস করতে পারবে না।

আমি দুনিয়ার প্রত্যেক রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব চাই, কারো সাথে দুমনি করতে চাই না। সকলের সাথে বন্ধুত্ব করে আমরা শান্তি চাই। আমার মানুষ দুঃখী, আমার মানুষ না খেয়ে কষ্ট পায়, আমি যখন বাংলাদেশ সরকার পেলাম যখন পাকিস্তানের জেল থেকে বের হয়ে স্বাধীন দেশে এলাম, তখন আমি শুধু বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই পেলাম। ব্যাংকে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না, আমাদের গোল্ড রিজার্ভ ছিল না। শুধু কাগজ নিয়ে আমরা সাড়ে সাত কোটি লোকের সরকার শুরু করলাম। গত তিন-চার বছরে না হলেও বিদেশ থেকে ২২ কোটি মণ খাবার বাংলাদেশে আনতে হয়েছে।

আর একটি কথা কেন সিস্টেম পরিবর্তন করলাম? সিস্টেম পরিবর্তন করলাম দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, আমি বিশ্বাস করি ক্ষমতা বন্দুকের নলে, আমি বিশ্বাস করি, ক্ষমতা জনগণের কাছে। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করে নাই। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে দুঃখী মানুষকে ভালোবেসে, বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে শোষণহীন সমাজ কায়েম করার জন্য। আপনাদের মনে আছে, আমার কথার মধ্যে শুধু কথা ছিল- রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায়, যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে, যদি দুঃখী মানুষেরা পেটভরে ভাত খেতে না পায়, কাপড় পরতে না পারে, বেকার সমস্যা দূর না হয়- তা হলে মানুষের জীবনে শান্তি ফিরে আসতে পারে না।

সরকারি আইন করে কোনদিন দুর্নীতিবাজদের দূর করা সম্ভব নয়, জনগণের সমর্থন ছাড়া। আপনারা সংঘবদ্ধ হোন, ঘরে ঘরে আপনাদের দুর্গ গড়তে হবে দুর্নীতিবাজদের খতম করার জন্য। বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের দুঃখ মোচন করার জন্য। পাকিস্তান সব নিয়ে গেছে, কিন্তু চোর রেখে গেছে। এই চোর তারা নিয়ে গেলে বাঁচতাম। সরকারি কর্মচারীদের বলি মনে রেখো- এটা স্বাধীন দেশ। এটা ব্রিটিশের কলোনি নয়। পাকিস্তানের কলোনি নয়। যে লোককে দেখবে- তার চেহারাটা তোমার বাবার মতো, তোমার ভাইয়ের মতো। তারই পরিশ্রমের পয়সায় তুমি মাইনে পাও।

এই যে কী হয়েছে, সমাজের সমাজব্যবস্থায় যেন ঘুণ ধরে গেছে। এ সমাজের প্রতি চরম আঘাত করতে চাই। যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানিদের, সে আঘাত করতে চাই এই ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থাকে- আমি এ লক্ষ্য অর্জনে আপনাদের সমর্থন চাই।

[লেখক : কলামিস্ট]

anumahmud@yahoo.com

শুক্রবার, ২৭ মার্চ ২০২০ , ১৩ চৈত্র ১৪২৬, ২৭ রজব সানি ১৪৪১

বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসাধারণ প্রজ্ঞাবান নেতা

ড. আনু মাহ্মুদ

বাঙালিদের মনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার স্ফুরণ ঘটানোর জন্য যে রাজনৈতিক উদ্যম প্রয়োজন ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাই সেক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করেছিলেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবি পেশ করার পর ১৯৬৯-এর মার্চ থেকে ১৯৭১-এর মার্চ পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত হন, এর মধ্যে আবার ঐতিহাসিকভাবে গভীর তাৎপর্যবাহী একটি নির্বাচনী অভিযান পরিচালনার মধ্য দিয়ে তার নেতৃত্বের অনন্য সাধারণ রূপটি ফুটে ওঠে।

১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত রাজনৈতিক সংগ্রামকালে এসব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ রাখাটা তার এক অসামান্য কীর্তি। বাঙালিদের মধ্যকার সামান্য অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানি শাসকরা যাতে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি থেকে বিচ্যুত করতে না পারে সেজন্য বঙ্গবন্ধু অতন্ত্র প্রহরীর মতো সদা-সজাগ থেকেছেন। এ আলোচ্য দুটি বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণের অবিসংবাদিত নেতা এবং তাদের জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেন। এ সময় কালেই একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের পরিচয় ছাপিয়ে তিনি এ বাংলায় ও বাংলাদেশের মানুষের কাছে যেন কিংবদন্তি হয়ে উঠলেন।

তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের লোক, ছিলেন জনতার নেতা। রাজনীতির তাত্ত্বিক প-িত তিনি কখনই ছিলেন না। তিনি একজন সর্বজ্ঞানী স্কলার অথবা কোনো এক বা একাধিক বিষয়ে অসাধারণ দক্ষতাসম্পন্ন একজন বিশেষজ্ঞও ছিলেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রজ্ঞাবান একজন নেতা। তিনি ছিলেন মানুষের লোক। মানুষের কাছ থেকে তিনি গ্রহণ করতে পারতেন, বিচার-বিবেচনার রসদ সঞ্চয় করতে পারতেন। সব বিষয়ে শেষ ভরসা করতেন মানুষের ওপরে। মানুষের ওপর, জনতার ওপর তার এমন অপার ভালোবাসা ও নৈকট্যই তার অপরিবর্তনের প্রগতিমুখীন হওয়াটাকে স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল।

শুরুতে তিনি ছিলেন এক দুরন্ত কিশোর-মুজিবুর, অনেকের কাছে মুজিব ভাই। এরপর মুজিবুর রহমান অথবা শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তীতে বহুদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে তার নাম ছিল ‘শেখ সাহেব’, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন পরিচয় ‘বঙ্গবন্ধু’। আর একাত্তরের পর তিনিই হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি এবং ‘জাতির পিতা’। তিন দশক সময়কালের মধ্যে এভাবেই ঘটেছিল তার অবস্থানের উত্তরণ।

তিনি তার তিন দশকের রাজনৈতিক জীবনে তার চিন্তাধারা-জীবন দর্শনেও উত্তরণ ঘটেছিল, শুরুটা ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের ছাত্রকর্মী হিসেবে। কিন্তু সে সময়ও মুসলিম লীগের মধ্যে উদারনৈতিক ও কিছুটা প্রগতিশীল যে প্রবণতা ও অংশ ছিল, বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই আবুল হাশেম-সোহরাওয়ার্দী সাহেবের অনুগামী। তিনি ছিলেন ঢাকার নবাবদের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের বিরুদ্ধে। তিনি একই সাথে ছিলেন নেতাজী সুভাষ বোসের ভক্ত। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, ও কমিউনিস্ট- এই তিন দলের ঝাণ্ডা নিয়ে কলকাতায় ‘রশিদ আলী দিবস’ পালনসহ নানা কর্মসূচিতে সঙ্গী-সাথী অনুগামীসহ তিনি ছিলেন একজন উৎসাহী যৌবন দীপ্ত অংশগ্রহণকারী।

মুসলিম লীগের কর্মী থাকার সময় থেকেই কমিউনিস্ট ও বামপন্থিদের সাথে তার পরিচয়, কিছুটা ঘনিষ্ঠতার সূচনা। তখন থেকেই তার মাঝে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি একটি গভীর মনের টানের উন্মেষ। সাথে সাথে অসাম্প্রদায়িক বোধের জাগরণ।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালি জাতির ওপর পরিচালিত শোষণ-বঞ্চনা, বাংলা ভাষার ওপর আঘাত, প্রতিক্রিয়াশালী অংশের দ্বারা মুসলিম লীগের নেতৃত্বে করায়ত্ত হওয়া তাকে অতিদ্রুতই পাকিস্তান সম্পর্কে মোহমুক্ত করে তোলে, সাধারণ কর্মচারীদের দাবি নিয়ে সংগ্রাম করে তিনি কারাগারে যান। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তিনি ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগের একজন প্রধান সংগঠক হয়ে ওঠেন। জেলে ও জেলের বাইরে কাজ করতে করতে কমিউনিস্ট ও বামপন্থিদের সাথে তার সংযোগ আরও ঘনিষ্ঠ হয়।

সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের বছরগুলোতে কারাগারগুলো ভরে উঠল রাজনৈতিক বন্দিদের দিয়ে। ‘শেখ সাহেব’ এবং আরও অনেককে যেতে হলো কারাগারে। অনেকের জন্যই হয়ে উঠল একবার জেলে ঢোকা, কিছুদিন পর জেল থেকে বের হয়ে আসা, তারপর আবার জেলে যাওয়া, অন্যান্য সব রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ‘শেখ সাহেবেও দেখলেন যে, ‘আমরা তো আসি-যাই, কিন্তু জেলখানায় প্রায় স্থায়ী বসবাসকারী হয়ে রয়েছেন একঝাঁক ঋষিতুল্য কমিউনিস্ট নেতা। তাদের কাজ তো দেখি সব সময় আমাদের অভ্যর্থনা জানানো ও বিদায় দেয়া।’ কমিউনিস্টদের আত্মত্যাগ তাকে অভিভূত করে। এ কারণে তিনি আজীবন কমিউনিস্টদের শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তাদের সমাজতন্ত্রের আদর্শের প্রতিও একটি সহানুভূতি ও আকর্ষণ তার মধ্যে গড়ে উঠতে থাকে। তাতে তিনি ছিলেন সোজাসাপটা কাজের মানুষ। তিনি তার অসাধারণ প্রজ্ঞা ও হৃদয়ের সিগন্যাল বুঝে অগ্রসর হতেন। সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ নিয়ে তত ব্যস্ত থাকতেন না। কমিউনিস্টদের তিনি ঠাট্টা করে বলতেন, ‘আপনাদের বুদ্ধি একটু বেশি, তবে আক্কেল একটু কম; তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি কমিউনিস্টদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নিতেন। তাদের পরামর্শ মেনে চলতেন, এমনটা সব সময় না ঘটলেও সেই পরামর্শগুলো হিসাবে নিতেন।

’৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর ‘শেখ সাহেব’ বুঝতে পারেন, এখন স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে রেখে বাঙালির স্বাধিকারের জন্য জোরেশোরে নামার সময় এসে গেছে। তিনি ৬ দফা দাবি পেশ করে আন্দোলনে নেমে পড়েন। আওয়ামী লীগের প্রবীন ও নাম ডাকওয়ালা নেতাদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে তিনি দৃঢ়চেতনাভাবে এগিয়ে যেতে থাকেন। আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের আক্রমণকে উপেক্ষা করে ‘শেখ সাহেব’ সাহসী মহাবীরের মতো আপসহীনভাবে এগিয়ে যেতে থাকেন বাঙালির স্বাধিকারের দাবি নিয়ে। দলের কর্মীরাই শুধু নয়, সমগ্র দেশবাসী, এ ৬ দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তার পেছনে সমবেত হতে থাকেন।

সরকার মরিয়া হয়ে তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাকে সবদিক দিয়ে ‘শেষ করে দেয়ার’ চেষ্টায় নামে। কিন্তু ‘শেখ সাহেব’ ছিলেন ইতিহাসের পক্ষে, তিনি ইতিহাস সৃষ্টির জন্য একজন ‘ইতিহাসের মহানায়কের’ যেসব বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী থাকা অপরিহার্য সেরূপ প্রজ্ঞা, জেদ, প্রত্যয় ও দক্ষতাসম্পন্ন একজন জননেতা ছিলেন। পাকিস্তান-সরকারের প্রতিটি আঘাত সে সময় তার জন্য বরমাল্য স্বরূপ ভূষণ হয়ে ওঠে। ক্রমান্বয়ে তার জনপ্রিয়তা অসামান্য উঁচুস্তরে পৌঁছে যায়, তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির একক ও অবিসংবাদিত নেতা। ৬ দফাকে প্রগতিশীল কর্মসূচিতে সমৃদ্ধ করে রচিত হয় ঐতিহাসিক ১১ দফা। সংগঠিত হল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। জেল থেকে মুক্ত হয়ে আসেন মহানায়ক ‘শেখ সাহেব’ হয়ে ওঠেন ‘বঙ্গবন্ধু’।

’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু তার দলকে নিয়ে অভূতপূর্ব বিজয় ছিনিয়ে আনেন। ইয়াহিয়া খান সেই বিজয়কে কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে জাতীয় পরিষদের বৈঠক বাতিল করে দেন। দেশের অঘোষিত সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার অধিকারকে এভাবে নস্যাৎ করার পথ গ্রহণ করা হয়। প্রতিবাদে গর্জে ওঠে সমগ্র বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধু জনতার ক্রোধ ও স্বাধিকারের প্রত্যয়কে দারুণ করে জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে এগিয়ে নেন। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্বাধীনতার পথে বাঙালির যাত্রার শীর্ষপর্যায়ের ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অধ্যায়ের সূচনা সেখান থেকেই। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে জেগে ওঠা জাতির ঐক্যের প্রতীক। স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক।

১৬ ডিসেম্বর নয় মাসব্যাপী এক সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ এবং ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ হয় লাল-সবুজের পতাকার বাংলাদেশ। কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ১০ জানুয়ারি পদার্পণ করেন জাতির জনক। নতুন রাষ্ট্রের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় সাংবিধানিক রূপ প্রদানের কাজটি তার নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। রচিত হয় ’৭২-এর সংবিধান, ঘোষিত হয় চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি। সৃষ্টি হয় নয়া ইতিহাস।

‘ইতিহাসের মহানায়ক’ যে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন, তা একাধারে তার এবং জনগণের অমর সৃষ্টি এই সৃষ্টির মূল নির্যাস হলো নতুন বৈশিষ্ট্য ও চরিতসম্পন্ন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ, আর তার চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের স্বরূপ হলো- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সংবলিত ’৭২ সালের সংবিধান। অনেক উপাদান দিয়েই একটি দেশের একটি ‘রাজনৈতিক পর্ব’ রচিত হতে পারে। কিন্তু সব উপাদান দিয়ে একটি দেশের ‘ইতিহাস’ সৃষ্টি হয় না। ইতিহাস সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন হয় ‘ঐতিহাসিক উপাদান’, চার রাষ্ট্রীয় আদর্শসম্পন্ন নতুন রাষ্ট্রের জন্মের প্রধান স্থপতি হওয়াটাই হলো সেই এতিহাসিক উপাদান; যার কারণে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছেন ‘ইতিহাসের মহানায়ক।’ ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার হলো ’৭২-এর সংবিধানের মূল আদর্শিক ভিত্তি।

১৯৭২ সালে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-

‘ছাত্রজীবন থেকে আজ পর্যন্ত আমার এই সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রাম কতিপয় চিন্তাধারার ওপর গড়ে উঠেছে। এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী তথা সকল মেহনতি মানুষের জীবনে শান্তি সমৃদ্ধি ও সাম্য প্রতিষ্ঠাই আমার চিন্তাধারার মূল বিষয়বস্তু। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। কাজেই কৃষকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে আমি জানি শোষণ কাকে বলে। এ দেশে যুগ যুগ ধরে শোষিত হয়েছে কৃষক। শোষিত হয়েছে শ্রমিক, শোষিত হয়েছে বুদ্ধিজীবীসহ সকল মেহনতি মানুষ। এ দেশের জমিদার, জোতদার, মহাজন ও তাদের আমলা-টাউটদের চলে শোষণ। শোষণ চলে ফড়িয়া ব্যবসায়ী ও পুঁজিবাদের, শোষণ চলে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদের। এ দেশের সোনার মানুষ, এ দেশের মাটির মানুষ শোষণে শোষণে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের মুক্তির পথ কী? এই প্রশ্ন আমাকেও দিশেহারা করে ফেলে। পরে আমি পথের সন্ধান পাই। আমার কোনো কোনো সহযোগী রাজনৈতিক দল ও প্রগতিশীল বন্ধুবান্ধব বলেন শ্রেণী-সংগ্রামের কথা। কিন্তু আমি বলি জাতীয়তাবাদের কথা। এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, তার জবাবে আমি বলি, যার যার ধর্ম তার তার- এরই ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের কথা, শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সমাজতন্ত্র চাই। কিন্তু রক্তপাত ঘটিয়ে নয়- গণতান্ত্রিক পন্থায়, সংসদীয় বিধিবিধানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে চাই সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা।

আমার এই মতবাদ বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করেই দাঁড় করিয়েছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, যুগোশ্লাভিয়া প্রত্যকে নিজ নিজ অবস্থা মোতাবেক গড়ে তুলছে সমাজতন্ত্র। আমি মনে করি, বাংলাদেশকেও অগ্রসর হতে হবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র- এই চারটি মূল সূত্র ধরে, বাংলাদেশের নিজস্ব পথ ধরে।’

বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে উল্লেখ করেন- হানাদার পাকিস্তানিরা যাওয়ার পূর্বে ১৬ ডিসেম্বরের আগে কারফিউ দিয়ে ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গায় আমার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল, উদ্দেশ্য ছিল- বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করব, ধ্বংস করব, বাঙালি স্বাধীনতা পেলেও এই স্বাধীনতা রাখতে পারবে না। ইনশাআল্লাহ স্বাধীনতা রক্ষা হয়েছে। বাংলাদেশ দুনিয়ায় এসেছে, বাংলাদেশ থাকবে, কেউ একে ধ্বংস করতে পারবে না।

আমি দুনিয়ার প্রত্যেক রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব চাই, কারো সাথে দুমনি করতে চাই না। সকলের সাথে বন্ধুত্ব করে আমরা শান্তি চাই। আমার মানুষ দুঃখী, আমার মানুষ না খেয়ে কষ্ট পায়, আমি যখন বাংলাদেশ সরকার পেলাম যখন পাকিস্তানের জেল থেকে বের হয়ে স্বাধীন দেশে এলাম, তখন আমি শুধু বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই পেলাম। ব্যাংকে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না, আমাদের গোল্ড রিজার্ভ ছিল না। শুধু কাগজ নিয়ে আমরা সাড়ে সাত কোটি লোকের সরকার শুরু করলাম। গত তিন-চার বছরে না হলেও বিদেশ থেকে ২২ কোটি মণ খাবার বাংলাদেশে আনতে হয়েছে।

আর একটি কথা কেন সিস্টেম পরিবর্তন করলাম? সিস্টেম পরিবর্তন করলাম দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, আমি বিশ্বাস করি ক্ষমতা বন্দুকের নলে, আমি বিশ্বাস করি, ক্ষমতা জনগণের কাছে। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করে নাই। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে দুঃখী মানুষকে ভালোবেসে, বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে শোষণহীন সমাজ কায়েম করার জন্য। আপনাদের মনে আছে, আমার কথার মধ্যে শুধু কথা ছিল- রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায়, যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে, যদি দুঃখী মানুষেরা পেটভরে ভাত খেতে না পায়, কাপড় পরতে না পারে, বেকার সমস্যা দূর না হয়- তা হলে মানুষের জীবনে শান্তি ফিরে আসতে পারে না।

সরকারি আইন করে কোনদিন দুর্নীতিবাজদের দূর করা সম্ভব নয়, জনগণের সমর্থন ছাড়া। আপনারা সংঘবদ্ধ হোন, ঘরে ঘরে আপনাদের দুর্গ গড়তে হবে দুর্নীতিবাজদের খতম করার জন্য। বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের দুঃখ মোচন করার জন্য। পাকিস্তান সব নিয়ে গেছে, কিন্তু চোর রেখে গেছে। এই চোর তারা নিয়ে গেলে বাঁচতাম। সরকারি কর্মচারীদের বলি মনে রেখো- এটা স্বাধীন দেশ। এটা ব্রিটিশের কলোনি নয়। পাকিস্তানের কলোনি নয়। যে লোককে দেখবে- তার চেহারাটা তোমার বাবার মতো, তোমার ভাইয়ের মতো। তারই পরিশ্রমের পয়সায় তুমি মাইনে পাও।

এই যে কী হয়েছে, সমাজের সমাজব্যবস্থায় যেন ঘুণ ধরে গেছে। এ সমাজের প্রতি চরম আঘাত করতে চাই। যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানিদের, সে আঘাত করতে চাই এই ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থাকে- আমি এ লক্ষ্য অর্জনে আপনাদের সমর্থন চাই।

[লেখক : কলামিস্ট]

anumahmud@yahoo.com