বাবুল দে
রাজধানী ঢাকার একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা লোহারপুল। পুরোনো ঢাকার শত বছরের ঐতিহ্যবাহী লোহারপুল-সংলগ্ন মালাকারটোলায় একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনী নির্মম গণহত্যা করেছিল। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী প্রথম হামলা করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর। এরপর একে একে রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানা ইপিআর সদর দফতরে হামলা করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। তার দু’দিন পরে পুরোনো ঢাকায় সবচেয়ে বড় গণহত্যা করে এই মালাকারটোলায় হিন্দু মহল্লায়। মহল্লার বিভিন্ন বাড়িতে হামলা করে অস্ত্রের মুখে বেছে বেছে হিন্দুদের ধরে নিয়ে এসে লোহার পুলে লাইন দিয়ে মেশিনগানের ব্রাশফায়ারে হত্যা করে ১৫ জন নিরীহ মানুষকে। এই ১৫ বীর সন্তানের তাজা রক্তে সেদিন ভেসে গিয়েছিল লোহার পুল। তাদের নিথর দেহগুলো দীর্ঘ সময় পড়েছিল লোহার পুলেই। পরে পাকিস্তান সেনারা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে নিয়ে সে মরদেহগুলো ফেলে দেয়। শহীদদের স্বজনরা কোন দিন খুঁজে পায়নি তাদের মরদেহ।
সে দিনের সেই নির্মম গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন আমার পিতা কালিপদ দে এবং দুই ভাই দুলাল দে ও বিপ্লব দে। অন্যদের সঙ্গে তাদেরও লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে পাকিস্তানি সেনারা। ব্রাশফায়ারে দুই ভাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে বেচে যান আমার বাবা। আমার বাবার বুকের বাম পাশ ও বাম হাতে গুলি লাগে। বাবা আরও কয়েকজন আহত মানুষের সঙ্গে লোহার পুলের নিচের দোলাই খালের ময়লা-আবর্জনার মধ্যে মরা মানুষের মতো পড়ে থাকেন। এভাবেই বাবা বেঁচে যান। কিন্তু আমার দুই ভাইয়ের লাশও খুঁজে পাইনি।
সাতচল্লিশে দেশ ভাগের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও দেশ শাসন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবনের কোন ক্ষেত্রেই কখনোই তাদের ন্যায্য অধিকার পায়নি। বরং চরম বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়। সেই বঞ্চনা-বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ জেগে ওঠে। দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের পর একাত্তরে বঙ্গবন্ধু চূড়ান্ত আন্দোলনের ডাক দেন। তার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানিরা সৈন্যরা একাত্তরের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে শুরু করে নির্মম গণহত্যা। পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার মধ্যে একটি বড় হত্যাকা- ছিল পুরোনো ঢাকার মালাকারটোলা গণহত্যা।
একাত্তরে বর্বর পাকিস্তান বাহিনীর হত্যাকা- ও নির্যাতনে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পাকিস্তানিদের হাতে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এবং হত্যার শিকার হয়েছেন বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। এমন কোন শহর-গ্রাম নেই যেখানে পাকিস্তানিরা বেছে বেছে হিন্দুদের হত্যা করেনি, হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়নি। পাকিস্তান বাহিনী গণহত্যা শুরুর পর ঢাকা শহরের পাড়ায় পাড়ায় ঢুকে নির্বিচারে মানুষ হত্যার উৎসবে মেতে উঠেছিল। পুরোনো ঢাকায় তারা বেছে বেছে হিন্দু পাড়ায় বেশি হত্যাকা- চালিয়েছে। আর পুরোনো ঢাকার মধ্যে সূত্রাপুরের মালাকারটোলার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন সবচেয়ে বেশি হত্যা-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। একাত্তরের ২৭ মার্চ রাতে মালাকারটোলার প্রতিটি হিন্দু বাড়িতে হামলা করে পাকিস্তানিরা। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে হিন্দু নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের ধরে নিয়ে যায় মহল্লার পাশে ঐতিহ্যবাহী লোহার পুলে। সেখানে ব্রাশ ফায়ারে তাদের হত্যা করে।
আমাদের বাড়ি ছিল একাত্তরের সেই মৃত্যুপুরি মালাকারটোলায়। একাত্তরে সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকই ছিল বেশি। অনেক খ্যাতিমান লোক সে এলাকায় বসবাস করতেন, সাংস্কৃতিক তৎপরতাও অন্যান্য এলাকার চেয়ে সে এলাকায় ছিল বেশি। মালাকারটোলায় আমাদের বাড়িটি ছিল পুরান ঢাকার বাম রাজনীতির একটি কেন্দ্র। আমরা তিন ভাই ও পাঁচ বোন মা-বাবার সঙ্গে সে বাড়িতে থাকতাম। আমার বাবা ও ভাইয়েরা সবাই ছিলেন বাম আদর্শের কর্মী। বাবা কালিপদ দে ছিলেন সাম্যবাদী চিন্তার মানুষ, ভাই দুলাল দে ছিলেন ন্যাপের সক্রীয় কর্মী। আমাদের বাড়িতে সব সময়ই প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চ্চার আবহ ছিল। আমি তখন গেন্ডারিয়া হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। একুশের ফেব্রয়ারিতে আমরা গেন্ডারিয়া এলাকার ছাত্রছাত্রীরা বাংলা ভাষার পক্ষে বিভিন্ন সেøাগান লেখা প্লাকার্ড ফেন্টুন নিয়ে প্রভাত ফেরি নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যেতাম। সে সব প্লাকার্ড লেখা এবং জমা করা হতো আমাদের বাড়িতে। একবার আমাদের একুশের প্রভাত ফেরি এক সুন্দর হয়েছিল যে, আমাদের প্রভাত ফেরির ছবি তুলে তা জহির রায়হানের অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’য় ব্যবহার করা হয়।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরুর পর ২৬ মার্চ সারাদিন পুরোনো ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও থানায় হামলা চালিয়ে যাকে যে অবস্থায় পেয়েছে পাকিস্তানিরা মেসিনগানের ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। আমরা ভয়-আতঙ্ক আর কারফিউর কারণে বাড়ি থেকে বের হইনি। কিন্তু তখনও বুঝতে পারিনি পাকিস্তানিদের গণহত্যার বড় টার্গেট ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায়। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ শিথিল হলে আমি আমাদের আশেপাশের এলাকা দেখতে বের হই। বিধ্বস্ত চেহারা দেখি বিভিন্ন এলাকার। শাখারি পট্টিতে অনেক লাশ পড়ে থাকতে দেখি। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি সূত্রাপুর থানা, সেখানে গিয়ে দেখি পাকিস্তানিদের মর্টার আর মেশিনগানের গুলিতে পুরো ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। থানার ভেতরে গিয়ে দেখি এক পুলিশের লাশ পড়ে আছে। পাকিস্তানি সৈন্যবোঝাই গাড়ি লোহার পুলের ওপর দিয়ে যাওয়া আসা করছে। এরই মধ্যে দেখলাম একদল লোক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে লুটপাট করছে। অন্যদিকে অসংখ্য মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে শহর ছেড়ে। এসব দেখে চরম ভয় পেয়ে আবার বাড়ি ফিরে ঢাকা ছেড়ে পালানোর পরিকল্পনা করি। ঠিক করি আগামীকালই আমরা ঢাকা ছেড়ে বুড়িগঙ্গা নদী পেরিয়ে বিক্রমপুরের দিকে চলে যাবো। এসব ভাবনা চিন্তার মধ্যেই ২৭ মার্চ রাত নেমে আসে। রাতে পাকিস্তান বাহিনী হামলা করতে পারে ভেবে আমি পাশের মুসলমান বাড়িতে চলে যাই রাত কাটাতে। আমার বোনরাও অন্য এক বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। বাড়িতে থেকে যায় বাবা, ভাই দুলাল ও বিপ্লব। এলাকায় থমথমে পরিবেশ, মানুষের সাড়াশব্দ নেই, শুধু পাকিস্তান আর্মির গাড়ি চলাচলের আওয়াজ কানে আসে। সন্ধ্যা থেকে আবার কারফিউ শুরু হয়।
রাত প্রায় ১১টার দিকে একদল পাকিস্তানি মিলিটারি এসে আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে। দরজা খুলতে দেরি হওয়ায় দরজা ভেঙে তারা ঘরে ঢুকে আমার বাবা কালিপদ দে, ভাই দলুল দে ও ছোট ভাই বিপ্লবকে অস্ত্র তাক করে ধরে নিয়ে যায়। ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে পাকিস্তান আর্মি সবাইকে জেরা করে এবং কাপড় খুলে দেখে নিশ্চিত হয় যে, তারা সবাই হিন্দু। ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার অবুঝ ছোট ভাই বিপ্লব করুণ কণ্ঠে বাবার কাছে জানতে চায়, বাবা আমাদের তারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? বাবা কোন উত্তর দিতে পারেননি, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। এসব কথা বাবা পরে আমাদের বলেছেন।
আমাদের বাড়ি হামলা করার আগে-পরে পাকিস্তান আর্মি আরও কয়েকটি বাড়িতে হামলা করে অনেক লোককে ধরে নিয়ে যায়। রাত দুপুরে তাদের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় লোহারপুলে। সেখানে আবার তাদের পরীক্ষা করে দেখে সবাই হিন্দু কিনা। এরপর সবাইকে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে সবার দিকে মেশিন গান উচিয়ে ব্রাশফায়ার করে। গুলি খেয়ে সবাই লুটিয়ে পড়ে। তবে সৌভাগ্যক্রমে আমার বাবাসহ আরও দু’তিন জন বেচে যায়। আমার বাবার গালে ও কানে গুলি লাগে, দু’একজনের গায়ে একেবারেই গুলি লাগেনি। তবে তারা দোলাই খালের ময়লা পানিয়ে মরার মতো পড়ে থাকেন। পাকিস্তান আর্মি গুলি করার পর আহত শরীর নিয়ে আমার বাবাও মাটিতে শুয়ে থাকেন। কয়েক ঘণ্টা পর খুব ভোরে ফজর নামাজের আজানের শব্দ শুনে বাবা উঠতে চেষ্টা করেন। উঠেই তিনি দেখেন আমার ভাই দুলাল দে শুয়ে আছে পাশেই। তিনি খুব মিহি কণ্ঠে দুলালকে ডাকেন- এই দুলাল ওঠ, চল পালিয়ে যাই। কিন্তু একটু পরই বুঝতে পারেন দুলাল বেচে নেই। এরপরই তিনি খুব ভয় পেয়ে যান। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে তিনি আস্তে আস্তে দোলাই খালের পাড় দিয়ে হেটে কাছেই আমাদের পাড়ার পরিচিত ডা. আজিজুন্নেসার বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। ডা. আজিজুন্নেসা তাড়াতাড়ি তার গাড়ির ড্রাইভারকে দিয়ে বাবাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠান। আমরা সকালেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বুড়িগঙ্গা নদী পেরিয়ে বিক্রমপুরে এক আত্মীয় বাড়িতে চলে যাই। বাবা মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রায় এক সপ্তাহ চিকিৎসা নিয়ে প্রথমে বিক্রমপুর গিয়ে আমাদের সঙ্গে মিলিত হন। পরে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আমরা সবাই আগরতলায় চলে যাই। দেশ স্বাধীন হলে ঢাকায় ফিরে আসি।
আমার বাবা সেই গণহত্যার দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে তিন বছর বেচে ছিলেন। তখন একটি বিষয় আমি লক্ষ্য করি, তা হলো বাবা প্রায় প্রতিদিন রাতে কাউকে না জানিয়ে লোহার পুলে যে স্থানে পাকিস্তান আর্মি তাদের দাঁড় করিয়ে গুলি করেছিল, যে স্থানে তার আদরের দুই সন্তানকে হত্যা করেছিল পাকিস্তান বাহিনী, ঠিক সে জায়গায় গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন। তিনি সম্ভবত গণহত্যার সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারতেন না। বাবাকে এভাবে দেখে প্রায়ই আমার চোখে জল আসতো। আমিও এক ধরনের কষ্ট বুকে নিয়ে বাবার সেই বিধ্বস্ত মানসিক অবস্থা অনুভব করার চেষ্টা করতাম।
সেই হত্যাকা- থেকে রক্ষা পাওয়া আমাদের মহল্লার কয়েকজন বেশ কয়েক বছর বেঁচে ছিলেন। তাদের সঙ্গে প্রায় দেখা হতো মহল্লার বিভিন্ন বাড়িতে। সবাই অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সেই সময়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠতেন। তারা আক্ষেপ করতেন, তাদের যে স্বজনরা সেদিন জীবন দিয়েছেন তাদের কথা কেউ মনে রাখেনি।
সেই দিনের পর দীর্ঘ ৪৯ বছর কেটে গেছে কিন্তু আজও সেই গণহত্যার কথা মনে হলে একদিকে প্রিয় দুই ভাই হারানোর কষ্টে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে, অন্যদিকে মনের মধ্যে এক রাশ ক্ষোভ জমে ওঠে। প্রশ্ন জাগে স্বাধীন দেশে এত দিনেও সেই গণহত্যায় নিহতরা কেউ শহীদের মর্যাদা পেলেন না কেন? কেন আমরাও পাইনি শহীদ পরিবারের মর্যাদা, কেন কেউ আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন না? এ প্রশ্নের জবাব কারো কাছে পাইনি। এ দুঃখ কোথায় রাখি?
শুক্রবার, ২৭ মার্চ ২০২০ , ১৩ চৈত্র ১৪২৬, ২৭ রজব সানি ১৪৪১
বাবুল দে
রাজধানী ঢাকার একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা লোহারপুল। পুরোনো ঢাকার শত বছরের ঐতিহ্যবাহী লোহারপুল-সংলগ্ন মালাকারটোলায় একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনী নির্মম গণহত্যা করেছিল। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী প্রথম হামলা করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর। এরপর একে একে রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানা ইপিআর সদর দফতরে হামলা করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। তার দু’দিন পরে পুরোনো ঢাকায় সবচেয়ে বড় গণহত্যা করে এই মালাকারটোলায় হিন্দু মহল্লায়। মহল্লার বিভিন্ন বাড়িতে হামলা করে অস্ত্রের মুখে বেছে বেছে হিন্দুদের ধরে নিয়ে এসে লোহার পুলে লাইন দিয়ে মেশিনগানের ব্রাশফায়ারে হত্যা করে ১৫ জন নিরীহ মানুষকে। এই ১৫ বীর সন্তানের তাজা রক্তে সেদিন ভেসে গিয়েছিল লোহার পুল। তাদের নিথর দেহগুলো দীর্ঘ সময় পড়েছিল লোহার পুলেই। পরে পাকিস্তান সেনারা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে নিয়ে সে মরদেহগুলো ফেলে দেয়। শহীদদের স্বজনরা কোন দিন খুঁজে পায়নি তাদের মরদেহ।
সে দিনের সেই নির্মম গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন আমার পিতা কালিপদ দে এবং দুই ভাই দুলাল দে ও বিপ্লব দে। অন্যদের সঙ্গে তাদেরও লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে পাকিস্তানি সেনারা। ব্রাশফায়ারে দুই ভাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে বেচে যান আমার বাবা। আমার বাবার বুকের বাম পাশ ও বাম হাতে গুলি লাগে। বাবা আরও কয়েকজন আহত মানুষের সঙ্গে লোহার পুলের নিচের দোলাই খালের ময়লা-আবর্জনার মধ্যে মরা মানুষের মতো পড়ে থাকেন। এভাবেই বাবা বেঁচে যান। কিন্তু আমার দুই ভাইয়ের লাশও খুঁজে পাইনি।
সাতচল্লিশে দেশ ভাগের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও দেশ শাসন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবনের কোন ক্ষেত্রেই কখনোই তাদের ন্যায্য অধিকার পায়নি। বরং চরম বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়। সেই বঞ্চনা-বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ জেগে ওঠে। দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের পর একাত্তরে বঙ্গবন্ধু চূড়ান্ত আন্দোলনের ডাক দেন। তার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানিরা সৈন্যরা একাত্তরের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে শুরু করে নির্মম গণহত্যা। পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার মধ্যে একটি বড় হত্যাকা- ছিল পুরোনো ঢাকার মালাকারটোলা গণহত্যা।
একাত্তরে বর্বর পাকিস্তান বাহিনীর হত্যাকা- ও নির্যাতনে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পাকিস্তানিদের হাতে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এবং হত্যার শিকার হয়েছেন বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। এমন কোন শহর-গ্রাম নেই যেখানে পাকিস্তানিরা বেছে বেছে হিন্দুদের হত্যা করেনি, হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়নি। পাকিস্তান বাহিনী গণহত্যা শুরুর পর ঢাকা শহরের পাড়ায় পাড়ায় ঢুকে নির্বিচারে মানুষ হত্যার উৎসবে মেতে উঠেছিল। পুরোনো ঢাকায় তারা বেছে বেছে হিন্দু পাড়ায় বেশি হত্যাকা- চালিয়েছে। আর পুরোনো ঢাকার মধ্যে সূত্রাপুরের মালাকারটোলার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন সবচেয়ে বেশি হত্যা-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। একাত্তরের ২৭ মার্চ রাতে মালাকারটোলার প্রতিটি হিন্দু বাড়িতে হামলা করে পাকিস্তানিরা। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে হিন্দু নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের ধরে নিয়ে যায় মহল্লার পাশে ঐতিহ্যবাহী লোহার পুলে। সেখানে ব্রাশ ফায়ারে তাদের হত্যা করে।
আমাদের বাড়ি ছিল একাত্তরের সেই মৃত্যুপুরি মালাকারটোলায়। একাত্তরে সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকই ছিল বেশি। অনেক খ্যাতিমান লোক সে এলাকায় বসবাস করতেন, সাংস্কৃতিক তৎপরতাও অন্যান্য এলাকার চেয়ে সে এলাকায় ছিল বেশি। মালাকারটোলায় আমাদের বাড়িটি ছিল পুরান ঢাকার বাম রাজনীতির একটি কেন্দ্র। আমরা তিন ভাই ও পাঁচ বোন মা-বাবার সঙ্গে সে বাড়িতে থাকতাম। আমার বাবা ও ভাইয়েরা সবাই ছিলেন বাম আদর্শের কর্মী। বাবা কালিপদ দে ছিলেন সাম্যবাদী চিন্তার মানুষ, ভাই দুলাল দে ছিলেন ন্যাপের সক্রীয় কর্মী। আমাদের বাড়িতে সব সময়ই প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চ্চার আবহ ছিল। আমি তখন গেন্ডারিয়া হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। একুশের ফেব্রয়ারিতে আমরা গেন্ডারিয়া এলাকার ছাত্রছাত্রীরা বাংলা ভাষার পক্ষে বিভিন্ন সেøাগান লেখা প্লাকার্ড ফেন্টুন নিয়ে প্রভাত ফেরি নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যেতাম। সে সব প্লাকার্ড লেখা এবং জমা করা হতো আমাদের বাড়িতে। একবার আমাদের একুশের প্রভাত ফেরি এক সুন্দর হয়েছিল যে, আমাদের প্রভাত ফেরির ছবি তুলে তা জহির রায়হানের অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’য় ব্যবহার করা হয়।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরুর পর ২৬ মার্চ সারাদিন পুরোনো ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও থানায় হামলা চালিয়ে যাকে যে অবস্থায় পেয়েছে পাকিস্তানিরা মেসিনগানের ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। আমরা ভয়-আতঙ্ক আর কারফিউর কারণে বাড়ি থেকে বের হইনি। কিন্তু তখনও বুঝতে পারিনি পাকিস্তানিদের গণহত্যার বড় টার্গেট ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায়। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ শিথিল হলে আমি আমাদের আশেপাশের এলাকা দেখতে বের হই। বিধ্বস্ত চেহারা দেখি বিভিন্ন এলাকার। শাখারি পট্টিতে অনেক লাশ পড়ে থাকতে দেখি। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি সূত্রাপুর থানা, সেখানে গিয়ে দেখি পাকিস্তানিদের মর্টার আর মেশিনগানের গুলিতে পুরো ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। থানার ভেতরে গিয়ে দেখি এক পুলিশের লাশ পড়ে আছে। পাকিস্তানি সৈন্যবোঝাই গাড়ি লোহার পুলের ওপর দিয়ে যাওয়া আসা করছে। এরই মধ্যে দেখলাম একদল লোক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে লুটপাট করছে। অন্যদিকে অসংখ্য মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে শহর ছেড়ে। এসব দেখে চরম ভয় পেয়ে আবার বাড়ি ফিরে ঢাকা ছেড়ে পালানোর পরিকল্পনা করি। ঠিক করি আগামীকালই আমরা ঢাকা ছেড়ে বুড়িগঙ্গা নদী পেরিয়ে বিক্রমপুরের দিকে চলে যাবো। এসব ভাবনা চিন্তার মধ্যেই ২৭ মার্চ রাত নেমে আসে। রাতে পাকিস্তান বাহিনী হামলা করতে পারে ভেবে আমি পাশের মুসলমান বাড়িতে চলে যাই রাত কাটাতে। আমার বোনরাও অন্য এক বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। বাড়িতে থেকে যায় বাবা, ভাই দুলাল ও বিপ্লব। এলাকায় থমথমে পরিবেশ, মানুষের সাড়াশব্দ নেই, শুধু পাকিস্তান আর্মির গাড়ি চলাচলের আওয়াজ কানে আসে। সন্ধ্যা থেকে আবার কারফিউ শুরু হয়।
রাত প্রায় ১১টার দিকে একদল পাকিস্তানি মিলিটারি এসে আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে। দরজা খুলতে দেরি হওয়ায় দরজা ভেঙে তারা ঘরে ঢুকে আমার বাবা কালিপদ দে, ভাই দলুল দে ও ছোট ভাই বিপ্লবকে অস্ত্র তাক করে ধরে নিয়ে যায়। ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে পাকিস্তান আর্মি সবাইকে জেরা করে এবং কাপড় খুলে দেখে নিশ্চিত হয় যে, তারা সবাই হিন্দু। ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার অবুঝ ছোট ভাই বিপ্লব করুণ কণ্ঠে বাবার কাছে জানতে চায়, বাবা আমাদের তারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? বাবা কোন উত্তর দিতে পারেননি, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। এসব কথা বাবা পরে আমাদের বলেছেন।
আমাদের বাড়ি হামলা করার আগে-পরে পাকিস্তান আর্মি আরও কয়েকটি বাড়িতে হামলা করে অনেক লোককে ধরে নিয়ে যায়। রাত দুপুরে তাদের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় লোহারপুলে। সেখানে আবার তাদের পরীক্ষা করে দেখে সবাই হিন্দু কিনা। এরপর সবাইকে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে সবার দিকে মেশিন গান উচিয়ে ব্রাশফায়ার করে। গুলি খেয়ে সবাই লুটিয়ে পড়ে। তবে সৌভাগ্যক্রমে আমার বাবাসহ আরও দু’তিন জন বেচে যায়। আমার বাবার গালে ও কানে গুলি লাগে, দু’একজনের গায়ে একেবারেই গুলি লাগেনি। তবে তারা দোলাই খালের ময়লা পানিয়ে মরার মতো পড়ে থাকেন। পাকিস্তান আর্মি গুলি করার পর আহত শরীর নিয়ে আমার বাবাও মাটিতে শুয়ে থাকেন। কয়েক ঘণ্টা পর খুব ভোরে ফজর নামাজের আজানের শব্দ শুনে বাবা উঠতে চেষ্টা করেন। উঠেই তিনি দেখেন আমার ভাই দুলাল দে শুয়ে আছে পাশেই। তিনি খুব মিহি কণ্ঠে দুলালকে ডাকেন- এই দুলাল ওঠ, চল পালিয়ে যাই। কিন্তু একটু পরই বুঝতে পারেন দুলাল বেচে নেই। এরপরই তিনি খুব ভয় পেয়ে যান। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে তিনি আস্তে আস্তে দোলাই খালের পাড় দিয়ে হেটে কাছেই আমাদের পাড়ার পরিচিত ডা. আজিজুন্নেসার বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। ডা. আজিজুন্নেসা তাড়াতাড়ি তার গাড়ির ড্রাইভারকে দিয়ে বাবাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠান। আমরা সকালেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বুড়িগঙ্গা নদী পেরিয়ে বিক্রমপুরে এক আত্মীয় বাড়িতে চলে যাই। বাবা মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রায় এক সপ্তাহ চিকিৎসা নিয়ে প্রথমে বিক্রমপুর গিয়ে আমাদের সঙ্গে মিলিত হন। পরে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আমরা সবাই আগরতলায় চলে যাই। দেশ স্বাধীন হলে ঢাকায় ফিরে আসি।
আমার বাবা সেই গণহত্যার দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে তিন বছর বেচে ছিলেন। তখন একটি বিষয় আমি লক্ষ্য করি, তা হলো বাবা প্রায় প্রতিদিন রাতে কাউকে না জানিয়ে লোহার পুলে যে স্থানে পাকিস্তান আর্মি তাদের দাঁড় করিয়ে গুলি করেছিল, যে স্থানে তার আদরের দুই সন্তানকে হত্যা করেছিল পাকিস্তান বাহিনী, ঠিক সে জায়গায় গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন। তিনি সম্ভবত গণহত্যার সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারতেন না। বাবাকে এভাবে দেখে প্রায়ই আমার চোখে জল আসতো। আমিও এক ধরনের কষ্ট বুকে নিয়ে বাবার সেই বিধ্বস্ত মানসিক অবস্থা অনুভব করার চেষ্টা করতাম।
সেই হত্যাকা- থেকে রক্ষা পাওয়া আমাদের মহল্লার কয়েকজন বেশ কয়েক বছর বেঁচে ছিলেন। তাদের সঙ্গে প্রায় দেখা হতো মহল্লার বিভিন্ন বাড়িতে। সবাই অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সেই সময়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠতেন। তারা আক্ষেপ করতেন, তাদের যে স্বজনরা সেদিন জীবন দিয়েছেন তাদের কথা কেউ মনে রাখেনি।
সেই দিনের পর দীর্ঘ ৪৯ বছর কেটে গেছে কিন্তু আজও সেই গণহত্যার কথা মনে হলে একদিকে প্রিয় দুই ভাই হারানোর কষ্টে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে, অন্যদিকে মনের মধ্যে এক রাশ ক্ষোভ জমে ওঠে। প্রশ্ন জাগে স্বাধীন দেশে এত দিনেও সেই গণহত্যায় নিহতরা কেউ শহীদের মর্যাদা পেলেন না কেন? কেন আমরাও পাইনি শহীদ পরিবারের মর্যাদা, কেন কেউ আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন না? এ প্রশ্নের জবাব কারো কাছে পাইনি। এ দুঃখ কোথায় রাখি?