করোনাভাইরাসের কবিরাজগণ

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

করোনাভাইরাসের আতঙ্কের মধ্যে ওয়াজ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ রোগের বিভিন্ন কবিরাজি ও বিশ্লেষণ পড়ে মানুষের মন অস্থির হয়ে উঠছে। ফেসবুকের কবিরাজি হচ্ছে, করোনাভাইরাস কয়েকদিন গলার ভেতর চুপ করে বসে থাকে, গরম পানি খেলে ভাইরাস মরে যায় বা পানির সঙ্গে পেটে চলে গেলে আর কার্যকর থাকে না। থানকুচি পাতা করোনাভাইরাস প্রতিরোধক, ভিনেগার আর রসুন খেলে এই ভাইরাস ভয়ে পালায় ইত্যাদি। করোনার ভয় দেখিয়ে হাদিস, কালামের ব্যাপক প্রচারণাও চলছে। করোনাভাইরাস নির্মূলে যে সব হাদিস ওয়াজ ও ফেসবুকে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে তা হলো, আল্লাহ এমন কোন রোগ পাঠাননি যার আরোগ্যের ব্যবস্থা দেননি (আধুনিক প্রকাশনী-৫২৬৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৬৩)। এই হাদিসে কিন্তু বর্তমানে ফার্মাসিতে যে সব ওষুধ বিক্রি হয় সেই সব ওষুধের কথা বলা হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ নবীজী অসুস্থ হলে তার মুখে ওষুধ ঢালতেও নিষেধ করেছিলেন (আধুনিক প্রকাশনী-৫২৯৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৯০)। হাদিসের সূত্রে ওয়াজ এবং ফেসবুকে রোগ হলে যা খেতে বলা হচ্ছে তা হলো মধু এবং কালোজিরা। মধু দ্বারা রোগমুক্তির কথা পবিত্র কোরআনেও উল্লেখ রয়েছে (সূরাহ আন-নাহল : ৬৯)। হাদিস অনুযায়ী মৃত্যু ব্যতীত সব রোগের মহৌষধ হচ্ছে কালোজিরা (আধুনিক প্রকাশনী-৫২৭৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৭২); আজওয়া খেজুর খেলে বিষও ক্ষতি করতে পারে না (আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৪৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২৪৩); জমজম কূপের পানি কোনো রোগ থেকে আরোগ্য লাভের উদ্দেশ্যে পান করলে আল্লাহ আরোগ্য দান করেন (দারাকুতনি, মুসতাদরেকে হাকেম, তারগিব), ভারতীয় চন্দন কাঠ ব্যবহারে সাতটি রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় (আধুনিক প্রকাশনী-৫২৮১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৭৭); জাহান্নামের তাপে সৃষ্ট জ্বর থেকে মুক্তি পেতে পানি ঢালতে হবে (আধুনিক প্রকাশনী-৫৩০৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২০১)। করোনার গজব থেকে মুক্তি পেতে এইসব ধর্মীয় নির্দেশনা কোন মুসলিম দেশ মানছে বলে শোনা যায়নি। সবাই ধরনা দিচ্ছে, ইহুদি-নাসারাদের আবিষ্কৃত কিটস, ভেন্টিলেটর, ব্যক্তিগত সুরক্ষার পোশাক সংগ্রহে। উটের প্রস্রাব পানে রোগ নিরাময়ের নির্দেশন হাদিসে রয়েছে বিধায় (আধুনিক প্রকাশনী-৫৩০৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২০৩) অনেকে উটের প্রস্রাব পান করে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রত্যাশা করছেন। করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে হাদিস অনুযায়ী (আধুনিক প্রকাশনী-৫৩০১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৯৭) নির্ধারিত কয়েকটি সুরা পড়ে ঝাড়-ফুঁক করা জরুরি বলে ওয়াজে বারবার উল্লেখ করা হচ্ছে। করোনাভাইরাস ছড়ায় থুতু থেকে, কিন্তু ঝাড়-ফুঁকের সঙ্গে থুতু ছিটানো হাদিস অনুয়ায়ী বিধেয় (আধুনিক প্রকাশনী-৫৩২৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২২২)। তবে শিঙ্গা লাগিয়ে রোগমুক্তির যে নির্দেশনা হাদিসে রয়েছে (আধুনিক প্রকাশনী-৫২৮৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৭৯) তার কথা কোন আলেমকে এই মহামারির হাত থেকে বাঁচার জন্য বলতে শুনছি না। হিন্দু ধর্মের কিছু লোকও এই সুযোগে করোনার ওষুধ আবিষ্কার করে ফেলেছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল হিন্দু মহাসভা করোনা ঠেকাতে গোমূত্র একমাত্র মহৌষধি বলে দাবি করেছে, এ দাবির কারণে অনেক হিন্দু গর্ভবতী গাভীর মূত্র পান করে যাচ্ছেন। অ্যালকোহল সমৃদ্ধ হ্যান্ড স্যানিটাইজার করোনাভাইরাস ধ্বংসে কার্যকর বিধায় অনেকে বেশি বেশি মদ খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। অনেকে স্যানিটাইজারের অভাবে মদ দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ভাইরাস মুক্ত করছেন।

ফুটপাতে যে সব মাস্ক বিক্রি হচ্ছে সেগুলোর কোনটিই ভাইরাস প্রতিরোধক বলে মনে হয় না এবং এগুলো কোনরূপ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা ছাড়াই দীর্ঘদিন একই ব্যক্তি বারবার ব্যবহার করছেন। ফুটপাত থেকে মাস্ক বাছাই করতে গিয়ে গ্রাহকেরা মুখে লাগিয়ে আবার রেখে দিচ্ছেন, আরেকজন হয়তো মুখে লাগানো সেই মাস্কটিই কিনে ব্যবহার করছেন। খবরে দেখলাম, ব্যবহারের পর পরিত্যক্ত সার্জিক্যাল মাস্ক পরিষ্কার ও ইস্ত্রি করে আবার বিক্রি করা হচ্ছে। ধর্ম প্রচারকরাও বসে নেই, সবাই নামাজের ওজুর ফজিলত বর্ণনা করে যাচ্ছেন। অনেকে তো এমনও বিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন যে, শুধু ওজু করার কারণে কোন ঈমানদার মুসলমানের ধারে কাছেও করোনা আসতে পারবে না। এই লোকগুলোকে কেউ অনুভূতিতে আঘাত লাগার ভয়ে থামাচ্ছেও না। চিকিৎসকেরা সাবান দিয়ে কমপক্ষে বিশ সেকেন্ড হাত ঘষতে বলেছেন। যেখানে ওজু করা হয় সেখানে সাবান রাখার ব্যবস্থা রেখে তা ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব বলে করোনা প্রতিরোধক হিসেবে ওজু নিশ্চয় কার্যকর হবে।

কোরআন শরিফ বিকৃত করার দায়ে চীনকে শাস্তি দেয়ার জন্য যে ভাইরাস আল্লাহর গজব হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভূত হলো তা যে ঈমানদার মুসলমানদেরও আক্রমণ করবে সেই জ্ঞান ওয়াজকারী ও ফেসবুকের ধর্মপ্রচারকদের ছিল না। চীনের লোকজন মরতে থাকলে কিছু মুসলমান খুশিতে টগবগ করতে থাকেন, আর ধর্মের মাহাত্ম প্রচারে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। অবশ্য হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহতায়ালা অতীতের বিভিন্ন জাতি-গোত্রকে মহামারীর মাধ্যমে শাস্তি দিয়েছেন (তিরমিজি, হাদিস : ১০৬৫)। ইরানের শিয়াদের অনেকে মুসলমান হিসেবে স্বীকার করেন না বিধায় ইরানে করোনাভাইরাসের আঘাতকেও গজব রূপে গণ্য করা হচ্ছে। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ছড়ালো তখন প্রায় সবাই একযোগে বলতে শুরু করে দিলেন যে, পৃথিবীতে পাপাচার ও অশ্লীলতায় ভরে গেছে, এই মহামারীর সৃষ্টি করে আল্লাহতালা অশ্লীলতার বিরুদ্ধে একটি সতর্কবার্তা পাঠিয়েছেন। পাপের জন্যই বিভিন্ন আজাব ও মহামারী নেমে আসে বলে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে; কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়লে তাদের মধ্যে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী ব্যাপক আকার ধারণকরে (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪০১৯)। কিন্তু যে অশ্লীলতার কথা বলা হচ্ছে তা তো আদি যুগে আরও বেশি ছিল। পশ্চিমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে নতুন করে কোন অশ্লীলতার সৃষ্টি হয়েছে বলে তো মনে হয় না, সমকামিতার অভিযোগও নতুন নয়- জগত সৃষ্টির পর থেকেই সমকামিতার শুরু; অবশ্য ইদানীং মাদ্রাসামক্তবে তা বেড়েছে। রক্ষণশীল দেশ সৌদি আরব, ইরান মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশেও কি অশ্লীলতায় ভরে গেছে। এ পর্যন্ত ১৯৭টি দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। যেদিন সৌদি আরব ওমরাহ হজ বন্ধ করে দিল, যেদিন থেকে বিভিন্ন দেশে মসজিদে নামাজ আদায় স্থগিত করা হলো, যেদিন সব মুসলিম দেশ করোনায় আক্রান্ত হলো সেদিন থেকে ধর্মের মাহাত্ম প্রচারকদের সুর পরিবর্তন হয়ে গেল; এখন ফেসবুকের ধর্ম প্রচারকেরা করোনাকে আশীর্বাদ হিসেবে দেখছেন- এখন মানুষ ভয়ে শুধু আল্লাহ, রাসুলের স্মরণ করছেন বিধায় তারা এই রোগের দীর্ঘস্থায়িত্ব কামনা করছেন। এ ভাইরাস নাকি ঈমানের শক্তি পরীক্ষা করতে অবতীর্ণ হয়েছে, তাই এ ভাইরাস ঈমানদার মুসলমানদের জন্য আল্লাহর তরফ থেকে একটি রহমত। নেক আমল করে যারা ঈমান শক্ত রাখতে পারবেন তাদের এই ভাইরাস কিচ্ছু করতে পারবে না। মহামারীতে মৃত্যু হলেও এমন বান্দা শহীদের মর্যাদাপাবে (আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩১৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২০৯)। ইহকালে স্বল্প মেয়াদের জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে মোমিনদের বেহেস্ত লাভের একটি মোক্ষম সুযোগ এসেছে। হিন্দু মহাসভার সভাপতি স্বামী চক্রপাণিকরোনাভাইরাসকে ‘রাগী দেবতা’ বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, যারা নিরীহ প্রাণীকে ভক্ষণ করে তাদের মৃত্যু ও সাজার শাস্তির বাণী শোনাবার জন্য এ ভাইরাস এসেছে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, পরিবেশ ধ্বংসকারী মানুষদের ওপর প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে, মানুষ গৃহবন্দি হওয়ায় প্রকৃতির দূষণ কমছে।

ছোঁয়াচে রোগের অস্তিত্ব নিয়েও ধর্মের ভেতরে বিরোধ পরিলক্ষিত হয়। বুখারি শরীফে বলা হয়েছে, ছোঁয়াচে রোগবলতে কিছু নেই; আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত : ‘আমি রসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, সংক্রমণ বলতে কিছু নেই’ (আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৫১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২৪৭)। এই হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে মসজিদে মসজিদে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে, বলা হচ্ছে- করোনাকে যারা ছোঁয়াছে রোগ বলে বিশ্বাস করবে তাদের ঈমান ধ্বংস হয় যাবে, ছোঁয়াছে রোগ বিশ্বাস করা কুফরি এবং শিরকের সমতুল্য, কোন মুসলমান এ রোগে মরবে না, এই রোগ কাফিরদের ওপর আল্লাহর আপতিত গজব। লিফলেট বিতরণকারীদের দোষ নেই, কারণপ্লেগ রোগকে একই হাদিসে আজাব এবং রহমত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে (আধুনিক প্রকাশনী-৫৩১৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২১০)। কয়েকটি হাদিসে আবার ছোঁয়াছে রোগের অস্তিত্বেরও উল্লেখ রয়েছে। একটি হাদিসে রোগাক্রান্ত উটের সঙ্গে সুস্থ উট রাখতে নিষেধ করা হয়েছে (আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩৫১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২৪৭), অন্য হাদিসে কুষ্ঠরোগী থেকে পলায়ন করতেও বলা হয়েছে। নবীজী আবার একজন কুষ্ঠ রোগীর সঙ্গে বসে খাবারও খেয়েছেন। আরেকটি হাদিসে বর্তমানে অবলম্বিত কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনের নির্দেশনা রয়েছে; কোন এলাকায় মহামারি দেখা দিলে ওই এলাকায় গমন ও নির্গমন দুটোই নিষিদ্ধ করা হয়েছে (বুখারী, আস-সহিহ ৫/২১৬৩; মুসলিম, আস-সহিহ ৪/১৭৩৮, ১৭৩৯)। সৌদি আরব ওমরাহ বন্ধ করে দিলেও বাংলাদেশ সরকার মসজিদে জামাতে নামাজ পড়া বন্ধ করতে নির্দেশ দিতে ভয় করছেন। মুফতি ও মুহাদ্দিস ফয়জুল্লাহ আমানের একটি লেখা থেকে পরিলক্ষিত হয় যে, বিশেষ অবস্থায় মজজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার দরকার নেই; কারণ নবী করিম (স.) বৃষ্টির কারণে মসজিদে না এসে ঘরে নামাজ পড়তে বলেছেন এবং হযরত বেলাল তা আজানে ঘোষণা করে মুসল্লিদের জানিয়েও দিয়েছেন। আরেক দল ঈমাম বলছেন, যত দুর্যোগই আসুক না কেন জামাআতে নামাজ পড়া বন্ধ করা যাবে না। মসজিদে নামাজ পড়াবন্ধ করার ইহুদি চক্রান্ত রুখে দিতে দুয়েকজন মৌলভীর নেতৃত্বে কিশোর ও যুবক বয়সের ছেলেরা মিছিলও করেছে।

ফেসবুক ঘাটলে মনে হয়, বিভিন্ন পেশার মতো ফেসবুক ব্যবহারকারীগণও দুই ভাগে বিভক্ত- একদল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থক, অন্য দল আওয়ামী লীগ বিরোধী। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা নিয়ে দুই গ্রুপের সমর্থকদের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। সরকারবিরোধীরা রোগী ও মৃত ব্যক্তির সংখ্যা বেশি হলেই যেন খুশি হয়; অহর্নিশ তারা করোনায় মৃত ব্যক্তির কল্পিত লাশ গুনে গুনে হয়রান। সারা পৃথিবীতে করোনাভাইরাসে মৃতদের সবাইকে বাংলাদেশের মৃত বলে ঘোষণা করলে তারা খুশি হতেন। চিকিৎসার সব সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ইতালি, আমেরিকা, স্পেনসহ অনেক উন্নত দেশ এই রোগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তাই বলে সরকারের ব্যর্থতা যে নেই তা কিন্তু নয়। সরকারের ব্যর্থতা অন্যখানে- কিছুনেতার অতিকথন। সরকারের দায়িত্বশীল নেতারা অতিকথনে সব সময় খেই হারিয়ে ফেলেন, সীমাবদ্ধ তার কথা মনে থাকে না। জানুয়ারির প্রথমদিকে চীনে এই রোগ চিহ্নিত হওয়ার পর থেকে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি দুই মাস সময় পেয়েও বাংলাদেশের নেতারা শুধু কথার ফুলঝুরি উড়িয়েছেন, বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হয়নি, রাখা হয়নি প্রয়োজনীয় মেডিকেল সরঞ্জামাদি; কোন খোঁজখবর না নিয়েই বারবার বলাহয়েছে, ‘আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত’। বিমানে বসে হাঁচি-কাশি নেই এমন একটি লিখিত ঘোষণা দিয়েই যাত্রীরা কোন পরীক্ষা ছাড়াই বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। প্রথমদিকে এই সুস্থ যাত্রীদের কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলেও মনে হয় না। অবশ্য পরামর্শ দিলেই যে যাত্রীরা শুনত তার কোন নিশ্চয়তা নেই- পরামর্শ শুনতে বাধ্য করার প্রয়োজন ছিল।

কিউবার আবিষ্কৃত ইন্টারফেরন আলফা টু-বি নামের ওষুধ করোনা আক্রান্তদের সুস্থ করে তুলতে চীনের চিকিৎসকরা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন। ইতালিতে কিউবা ওষুধ ও চিকিৎসক পাঠিয়েছে। মার্কিন গবেষকরাও করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছে এবং সীমিতভাবে তা ব্যবহারও করা হচ্ছে। ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য জাপানে ব্যবহৃত এক ধরনের ওষুধ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে চীনে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের যে কিট বিদেশ থেকে আসে তা অনেক ব্যয়বহুল এবং ব্যবহারে দক্ষ লোকের প্রয়োজন। ডা. বিজন কুমার শীলের নেতৃত্বে গণস্বাস্থকেন্দ্র এক ধরনের কিট আবিষ্কার করেছে যা ব্যবহার করে বাংলাদেশ করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারবে। চিকিৎসক ও চিকিৎসায় নিয়োজিত কর্মীদের জন্য ভাইরাস নিরোধক পোশাক বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে। সুখের বিষয় হচ্ছে, গজব দিয়ে অশ্লীল ও পাপাচারে মত্ত ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সবার মৃত্যু নিশ্চিত করা হলেও তাদের আবিষ্কৃত ওষুধ খেয়ে রোগ মুক্তি পেতে কোন ঈমানদার লোকের আপত্তির কথা এখনও শোনা যায়নি, অ্যালকোহল সমৃদ্ধ হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে কোন ফতোয়া আজ পর্যন্ত দেয়া হয়নি। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী দেখার জন্য যে দেশে শত শত লোক ছুটে আসে, যে দেশে ধর্মের নামে মিথ্যা প্রচারেলোক বিশ্বাস করে যে, চীনের প্রধানমন্ত্রী মসজিদে মসজিদে গিয়ে ক্ষমা চাচ্ছেন সেই দেশের লোকদের সচেতনকরা দুরূহ। করোনা অর্থাৎ সংক্রামক নিয়ে হাদিসে বিপরীতমুখী মতো থাকায় সাধারণ মুসলমানেরাও বিভ্রান্ত; ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার ভয়ে সরকারও এসব প্রচারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারছে না। ইতালির প্রধানমন্ত্রী করোনা বিস্তারে প্রথমদিকে অবহেলা করায় এখন আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, নিজের অপরাধ ঢাকার জন্য বাধ্য হয়ে আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন। ধর্মকর্মে আগ্রহী নয় এমন তিনটি সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবা, রাশিয়া এবং চীন থেকে চিকিৎসা সরঞ্জামাদি নিয়ে চিকিৎসক ও নার্স উপস্থিত হয়েছেন ইতালি, ইরাক ও ইরানে। ইন্দোনেশিয়ায় অনেক লোক আক্রান্ত হয়েছেন, মালয়েশিয়া সেনাবাহিনী তলব করেছে, সৌদি আরব সান্ধ্য আইন জারি করতে বাধ্য হয়েছে। কোন ধর্মই সামাজিক দায়বদ্ধতা অস্বীকার করে না; তাই ব্যক্তিগত অভিরুচি বা অনুভূতি দিয়ে মানব সমাজকে এই রোগেআক্রান্ত করার অধিকার কারও নেই।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ২৯ মার্চ ২০২০ , ১৫ চৈত্র ১৪২৬, ২৯ রজব সানি ১৪৪১

করোনাভাইরাসের কবিরাজগণ

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

করোনাভাইরাসের আতঙ্কের মধ্যে ওয়াজ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ রোগের বিভিন্ন কবিরাজি ও বিশ্লেষণ পড়ে মানুষের মন অস্থির হয়ে উঠছে। ফেসবুকের কবিরাজি হচ্ছে, করোনাভাইরাস কয়েকদিন গলার ভেতর চুপ করে বসে থাকে, গরম পানি খেলে ভাইরাস মরে যায় বা পানির সঙ্গে পেটে চলে গেলে আর কার্যকর থাকে না। থানকুচি পাতা করোনাভাইরাস প্রতিরোধক, ভিনেগার আর রসুন খেলে এই ভাইরাস ভয়ে পালায় ইত্যাদি। করোনার ভয় দেখিয়ে হাদিস, কালামের ব্যাপক প্রচারণাও চলছে। করোনাভাইরাস নির্মূলে যে সব হাদিস ওয়াজ ও ফেসবুকে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে তা হলো, আল্লাহ এমন কোন রোগ পাঠাননি যার আরোগ্যের ব্যবস্থা দেননি (আধুনিক প্রকাশনী-৫২৬৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৬৩)। এই হাদিসে কিন্তু বর্তমানে ফার্মাসিতে যে সব ওষুধ বিক্রি হয় সেই সব ওষুধের কথা বলা হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ নবীজী অসুস্থ হলে তার মুখে ওষুধ ঢালতেও নিষেধ করেছিলেন (আধুনিক প্রকাশনী-৫২৯৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৯০)। হাদিসের সূত্রে ওয়াজ এবং ফেসবুকে রোগ হলে যা খেতে বলা হচ্ছে তা হলো মধু এবং কালোজিরা। মধু দ্বারা রোগমুক্তির কথা পবিত্র কোরআনেও উল্লেখ রয়েছে (সূরাহ আন-নাহল : ৬৯)। হাদিস অনুযায়ী মৃত্যু ব্যতীত সব রোগের মহৌষধ হচ্ছে কালোজিরা (আধুনিক প্রকাশনী-৫২৭৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৭২); আজওয়া খেজুর খেলে বিষও ক্ষতি করতে পারে না (আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৪৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২৪৩); জমজম কূপের পানি কোনো রোগ থেকে আরোগ্য লাভের উদ্দেশ্যে পান করলে আল্লাহ আরোগ্য দান করেন (দারাকুতনি, মুসতাদরেকে হাকেম, তারগিব), ভারতীয় চন্দন কাঠ ব্যবহারে সাতটি রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় (আধুনিক প্রকাশনী-৫২৮১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৭৭); জাহান্নামের তাপে সৃষ্ট জ্বর থেকে মুক্তি পেতে পানি ঢালতে হবে (আধুনিক প্রকাশনী-৫৩০৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২০১)। করোনার গজব থেকে মুক্তি পেতে এইসব ধর্মীয় নির্দেশনা কোন মুসলিম দেশ মানছে বলে শোনা যায়নি। সবাই ধরনা দিচ্ছে, ইহুদি-নাসারাদের আবিষ্কৃত কিটস, ভেন্টিলেটর, ব্যক্তিগত সুরক্ষার পোশাক সংগ্রহে। উটের প্রস্রাব পানে রোগ নিরাময়ের নির্দেশন হাদিসে রয়েছে বিধায় (আধুনিক প্রকাশনী-৫৩০৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২০৩) অনেকে উটের প্রস্রাব পান করে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রত্যাশা করছেন। করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে হাদিস অনুযায়ী (আধুনিক প্রকাশনী-৫৩০১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৯৭) নির্ধারিত কয়েকটি সুরা পড়ে ঝাড়-ফুঁক করা জরুরি বলে ওয়াজে বারবার উল্লেখ করা হচ্ছে। করোনাভাইরাস ছড়ায় থুতু থেকে, কিন্তু ঝাড়-ফুঁকের সঙ্গে থুতু ছিটানো হাদিস অনুয়ায়ী বিধেয় (আধুনিক প্রকাশনী-৫৩২৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২২২)। তবে শিঙ্গা লাগিয়ে রোগমুক্তির যে নির্দেশনা হাদিসে রয়েছে (আধুনিক প্রকাশনী-৫২৮৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫১৭৯) তার কথা কোন আলেমকে এই মহামারির হাত থেকে বাঁচার জন্য বলতে শুনছি না। হিন্দু ধর্মের কিছু লোকও এই সুযোগে করোনার ওষুধ আবিষ্কার করে ফেলেছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল হিন্দু মহাসভা করোনা ঠেকাতে গোমূত্র একমাত্র মহৌষধি বলে দাবি করেছে, এ দাবির কারণে অনেক হিন্দু গর্ভবতী গাভীর মূত্র পান করে যাচ্ছেন। অ্যালকোহল সমৃদ্ধ হ্যান্ড স্যানিটাইজার করোনাভাইরাস ধ্বংসে কার্যকর বিধায় অনেকে বেশি বেশি মদ খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। অনেকে স্যানিটাইজারের অভাবে মদ দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ভাইরাস মুক্ত করছেন।

ফুটপাতে যে সব মাস্ক বিক্রি হচ্ছে সেগুলোর কোনটিই ভাইরাস প্রতিরোধক বলে মনে হয় না এবং এগুলো কোনরূপ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা ছাড়াই দীর্ঘদিন একই ব্যক্তি বারবার ব্যবহার করছেন। ফুটপাত থেকে মাস্ক বাছাই করতে গিয়ে গ্রাহকেরা মুখে লাগিয়ে আবার রেখে দিচ্ছেন, আরেকজন হয়তো মুখে লাগানো সেই মাস্কটিই কিনে ব্যবহার করছেন। খবরে দেখলাম, ব্যবহারের পর পরিত্যক্ত সার্জিক্যাল মাস্ক পরিষ্কার ও ইস্ত্রি করে আবার বিক্রি করা হচ্ছে। ধর্ম প্রচারকরাও বসে নেই, সবাই নামাজের ওজুর ফজিলত বর্ণনা করে যাচ্ছেন। অনেকে তো এমনও বিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন যে, শুধু ওজু করার কারণে কোন ঈমানদার মুসলমানের ধারে কাছেও করোনা আসতে পারবে না। এই লোকগুলোকে কেউ অনুভূতিতে আঘাত লাগার ভয়ে থামাচ্ছেও না। চিকিৎসকেরা সাবান দিয়ে কমপক্ষে বিশ সেকেন্ড হাত ঘষতে বলেছেন। যেখানে ওজু করা হয় সেখানে সাবান রাখার ব্যবস্থা রেখে তা ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব বলে করোনা প্রতিরোধক হিসেবে ওজু নিশ্চয় কার্যকর হবে।

কোরআন শরিফ বিকৃত করার দায়ে চীনকে শাস্তি দেয়ার জন্য যে ভাইরাস আল্লাহর গজব হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভূত হলো তা যে ঈমানদার মুসলমানদেরও আক্রমণ করবে সেই জ্ঞান ওয়াজকারী ও ফেসবুকের ধর্মপ্রচারকদের ছিল না। চীনের লোকজন মরতে থাকলে কিছু মুসলমান খুশিতে টগবগ করতে থাকেন, আর ধর্মের মাহাত্ম প্রচারে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। অবশ্য হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহতায়ালা অতীতের বিভিন্ন জাতি-গোত্রকে মহামারীর মাধ্যমে শাস্তি দিয়েছেন (তিরমিজি, হাদিস : ১০৬৫)। ইরানের শিয়াদের অনেকে মুসলমান হিসেবে স্বীকার করেন না বিধায় ইরানে করোনাভাইরাসের আঘাতকেও গজব রূপে গণ্য করা হচ্ছে। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ছড়ালো তখন প্রায় সবাই একযোগে বলতে শুরু করে দিলেন যে, পৃথিবীতে পাপাচার ও অশ্লীলতায় ভরে গেছে, এই মহামারীর সৃষ্টি করে আল্লাহতালা অশ্লীলতার বিরুদ্ধে একটি সতর্কবার্তা পাঠিয়েছেন। পাপের জন্যই বিভিন্ন আজাব ও মহামারী নেমে আসে বলে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে; কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়লে তাদের মধ্যে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী ব্যাপক আকার ধারণকরে (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪০১৯)। কিন্তু যে অশ্লীলতার কথা বলা হচ্ছে তা তো আদি যুগে আরও বেশি ছিল। পশ্চিমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে নতুন করে কোন অশ্লীলতার সৃষ্টি হয়েছে বলে তো মনে হয় না, সমকামিতার অভিযোগও নতুন নয়- জগত সৃষ্টির পর থেকেই সমকামিতার শুরু; অবশ্য ইদানীং মাদ্রাসামক্তবে তা বেড়েছে। রক্ষণশীল দেশ সৌদি আরব, ইরান মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশেও কি অশ্লীলতায় ভরে গেছে। এ পর্যন্ত ১৯৭টি দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। যেদিন সৌদি আরব ওমরাহ হজ বন্ধ করে দিল, যেদিন থেকে বিভিন্ন দেশে মসজিদে নামাজ আদায় স্থগিত করা হলো, যেদিন সব মুসলিম দেশ করোনায় আক্রান্ত হলো সেদিন থেকে ধর্মের মাহাত্ম প্রচারকদের সুর পরিবর্তন হয়ে গেল; এখন ফেসবুকের ধর্ম প্রচারকেরা করোনাকে আশীর্বাদ হিসেবে দেখছেন- এখন মানুষ ভয়ে শুধু আল্লাহ, রাসুলের স্মরণ করছেন বিধায় তারা এই রোগের দীর্ঘস্থায়িত্ব কামনা করছেন। এ ভাইরাস নাকি ঈমানের শক্তি পরীক্ষা করতে অবতীর্ণ হয়েছে, তাই এ ভাইরাস ঈমানদার মুসলমানদের জন্য আল্লাহর তরফ থেকে একটি রহমত। নেক আমল করে যারা ঈমান শক্ত রাখতে পারবেন তাদের এই ভাইরাস কিচ্ছু করতে পারবে না। মহামারীতে মৃত্যু হলেও এমন বান্দা শহীদের মর্যাদাপাবে (আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩১৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২০৯)। ইহকালে স্বল্প মেয়াদের জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে মোমিনদের বেহেস্ত লাভের একটি মোক্ষম সুযোগ এসেছে। হিন্দু মহাসভার সভাপতি স্বামী চক্রপাণিকরোনাভাইরাসকে ‘রাগী দেবতা’ বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, যারা নিরীহ প্রাণীকে ভক্ষণ করে তাদের মৃত্যু ও সাজার শাস্তির বাণী শোনাবার জন্য এ ভাইরাস এসেছে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, পরিবেশ ধ্বংসকারী মানুষদের ওপর প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে, মানুষ গৃহবন্দি হওয়ায় প্রকৃতির দূষণ কমছে।

ছোঁয়াচে রোগের অস্তিত্ব নিয়েও ধর্মের ভেতরে বিরোধ পরিলক্ষিত হয়। বুখারি শরীফে বলা হয়েছে, ছোঁয়াচে রোগবলতে কিছু নেই; আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত : ‘আমি রসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, সংক্রমণ বলতে কিছু নেই’ (আধুনিক প্রকাশনী-৫৩৫১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২৪৭)। এই হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে মসজিদে মসজিদে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে, বলা হচ্ছে- করোনাকে যারা ছোঁয়াছে রোগ বলে বিশ্বাস করবে তাদের ঈমান ধ্বংস হয় যাবে, ছোঁয়াছে রোগ বিশ্বাস করা কুফরি এবং শিরকের সমতুল্য, কোন মুসলমান এ রোগে মরবে না, এই রোগ কাফিরদের ওপর আল্লাহর আপতিত গজব। লিফলেট বিতরণকারীদের দোষ নেই, কারণপ্লেগ রোগকে একই হাদিসে আজাব এবং রহমত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে (আধুনিক প্রকাশনী-৫৩১৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২১০)। কয়েকটি হাদিসে আবার ছোঁয়াছে রোগের অস্তিত্বেরও উল্লেখ রয়েছে। একটি হাদিসে রোগাক্রান্ত উটের সঙ্গে সুস্থ উট রাখতে নিষেধ করা হয়েছে (আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩৫১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৫২৪৭), অন্য হাদিসে কুষ্ঠরোগী থেকে পলায়ন করতেও বলা হয়েছে। নবীজী আবার একজন কুষ্ঠ রোগীর সঙ্গে বসে খাবারও খেয়েছেন। আরেকটি হাদিসে বর্তমানে অবলম্বিত কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনের নির্দেশনা রয়েছে; কোন এলাকায় মহামারি দেখা দিলে ওই এলাকায় গমন ও নির্গমন দুটোই নিষিদ্ধ করা হয়েছে (বুখারী, আস-সহিহ ৫/২১৬৩; মুসলিম, আস-সহিহ ৪/১৭৩৮, ১৭৩৯)। সৌদি আরব ওমরাহ বন্ধ করে দিলেও বাংলাদেশ সরকার মসজিদে জামাতে নামাজ পড়া বন্ধ করতে নির্দেশ দিতে ভয় করছেন। মুফতি ও মুহাদ্দিস ফয়জুল্লাহ আমানের একটি লেখা থেকে পরিলক্ষিত হয় যে, বিশেষ অবস্থায় মজজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার দরকার নেই; কারণ নবী করিম (স.) বৃষ্টির কারণে মসজিদে না এসে ঘরে নামাজ পড়তে বলেছেন এবং হযরত বেলাল তা আজানে ঘোষণা করে মুসল্লিদের জানিয়েও দিয়েছেন। আরেক দল ঈমাম বলছেন, যত দুর্যোগই আসুক না কেন জামাআতে নামাজ পড়া বন্ধ করা যাবে না। মসজিদে নামাজ পড়াবন্ধ করার ইহুদি চক্রান্ত রুখে দিতে দুয়েকজন মৌলভীর নেতৃত্বে কিশোর ও যুবক বয়সের ছেলেরা মিছিলও করেছে।

ফেসবুক ঘাটলে মনে হয়, বিভিন্ন পেশার মতো ফেসবুক ব্যবহারকারীগণও দুই ভাগে বিভক্ত- একদল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থক, অন্য দল আওয়ামী লীগ বিরোধী। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা নিয়ে দুই গ্রুপের সমর্থকদের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। সরকারবিরোধীরা রোগী ও মৃত ব্যক্তির সংখ্যা বেশি হলেই যেন খুশি হয়; অহর্নিশ তারা করোনায় মৃত ব্যক্তির কল্পিত লাশ গুনে গুনে হয়রান। সারা পৃথিবীতে করোনাভাইরাসে মৃতদের সবাইকে বাংলাদেশের মৃত বলে ঘোষণা করলে তারা খুশি হতেন। চিকিৎসার সব সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ইতালি, আমেরিকা, স্পেনসহ অনেক উন্নত দেশ এই রোগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তাই বলে সরকারের ব্যর্থতা যে নেই তা কিন্তু নয়। সরকারের ব্যর্থতা অন্যখানে- কিছুনেতার অতিকথন। সরকারের দায়িত্বশীল নেতারা অতিকথনে সব সময় খেই হারিয়ে ফেলেন, সীমাবদ্ধ তার কথা মনে থাকে না। জানুয়ারির প্রথমদিকে চীনে এই রোগ চিহ্নিত হওয়ার পর থেকে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি দুই মাস সময় পেয়েও বাংলাদেশের নেতারা শুধু কথার ফুলঝুরি উড়িয়েছেন, বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হয়নি, রাখা হয়নি প্রয়োজনীয় মেডিকেল সরঞ্জামাদি; কোন খোঁজখবর না নিয়েই বারবার বলাহয়েছে, ‘আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত’। বিমানে বসে হাঁচি-কাশি নেই এমন একটি লিখিত ঘোষণা দিয়েই যাত্রীরা কোন পরীক্ষা ছাড়াই বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। প্রথমদিকে এই সুস্থ যাত্রীদের কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলেও মনে হয় না। অবশ্য পরামর্শ দিলেই যে যাত্রীরা শুনত তার কোন নিশ্চয়তা নেই- পরামর্শ শুনতে বাধ্য করার প্রয়োজন ছিল।

কিউবার আবিষ্কৃত ইন্টারফেরন আলফা টু-বি নামের ওষুধ করোনা আক্রান্তদের সুস্থ করে তুলতে চীনের চিকিৎসকরা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন। ইতালিতে কিউবা ওষুধ ও চিকিৎসক পাঠিয়েছে। মার্কিন গবেষকরাও করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছে এবং সীমিতভাবে তা ব্যবহারও করা হচ্ছে। ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য জাপানে ব্যবহৃত এক ধরনের ওষুধ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে চীনে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের যে কিট বিদেশ থেকে আসে তা অনেক ব্যয়বহুল এবং ব্যবহারে দক্ষ লোকের প্রয়োজন। ডা. বিজন কুমার শীলের নেতৃত্বে গণস্বাস্থকেন্দ্র এক ধরনের কিট আবিষ্কার করেছে যা ব্যবহার করে বাংলাদেশ করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারবে। চিকিৎসক ও চিকিৎসায় নিয়োজিত কর্মীদের জন্য ভাইরাস নিরোধক পোশাক বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে। সুখের বিষয় হচ্ছে, গজব দিয়ে অশ্লীল ও পাপাচারে মত্ত ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সবার মৃত্যু নিশ্চিত করা হলেও তাদের আবিষ্কৃত ওষুধ খেয়ে রোগ মুক্তি পেতে কোন ঈমানদার লোকের আপত্তির কথা এখনও শোনা যায়নি, অ্যালকোহল সমৃদ্ধ হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে কোন ফতোয়া আজ পর্যন্ত দেয়া হয়নি। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী দেখার জন্য যে দেশে শত শত লোক ছুটে আসে, যে দেশে ধর্মের নামে মিথ্যা প্রচারেলোক বিশ্বাস করে যে, চীনের প্রধানমন্ত্রী মসজিদে মসজিদে গিয়ে ক্ষমা চাচ্ছেন সেই দেশের লোকদের সচেতনকরা দুরূহ। করোনা অর্থাৎ সংক্রামক নিয়ে হাদিসে বিপরীতমুখী মতো থাকায় সাধারণ মুসলমানেরাও বিভ্রান্ত; ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার ভয়ে সরকারও এসব প্রচারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারছে না। ইতালির প্রধানমন্ত্রী করোনা বিস্তারে প্রথমদিকে অবহেলা করায় এখন আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, নিজের অপরাধ ঢাকার জন্য বাধ্য হয়ে আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন। ধর্মকর্মে আগ্রহী নয় এমন তিনটি সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবা, রাশিয়া এবং চীন থেকে চিকিৎসা সরঞ্জামাদি নিয়ে চিকিৎসক ও নার্স উপস্থিত হয়েছেন ইতালি, ইরাক ও ইরানে। ইন্দোনেশিয়ায় অনেক লোক আক্রান্ত হয়েছেন, মালয়েশিয়া সেনাবাহিনী তলব করেছে, সৌদি আরব সান্ধ্য আইন জারি করতে বাধ্য হয়েছে। কোন ধর্মই সামাজিক দায়বদ্ধতা অস্বীকার করে না; তাই ব্যক্তিগত অভিরুচি বা অনুভূতি দিয়ে মানব সমাজকে এই রোগেআক্রান্ত করার অধিকার কারও নেই।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com