‘সত্যেন সেন’- অদম্য মুক্ত প্রাণের শক্তি

এমআর খায়রুল উমাম

সত্যেন সেন। অদম্য প্রাণস্পৃহা সম্পন্ন এক মানুষ। মানবমুক্তির অমৃত জীবনধারায় সিক্ত। প্রগতিশীল সংস্কৃতি বিকাশের ধারক। ধ্রুপদী গণকথা শিল্পী। দেশের সব মানুষকে আপন ভেবে, নিজেকে তাদের একজন ভেবে মানব মুক্তির জন্য রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বলয় সৃষ্টিতে নিরলস শ্রম দিয়ে গিয়েছেন। চলার পথে ডাক দিয়েছেন সবাইকে। সংগঠিত করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু পিছন ফিরে দেখেননি। রাষ্ট্র তাকে জনবিচ্ছিন্ন করতে চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনভাবেই থামাতে পারেনি। যতবার রাষ্ট্র চেষ্টা করেছে ততবারই নতুন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ফেরৎ এসেছেন তিনি। ফেরৎ এসেছেন বাংলা সাহিত্যের প্রগতিবাদী লেখক হিসেবে, দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রগামী নেতা হিসেবে, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে। জীবন, জীবিকা আর পরিবার দেশের মানুষের কাছে ফিরে আসার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সাধারণভাবে যারা কাজ করেন তারা সমাদৃত হয় না কিন্তু বহুমুখী কাজ দিয়ে সমাজে সত্যেন সেন সমাদৃত।

দেশের মানুষকে নিপীড়ন মুক্ত করার স্বপ্ন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দীর্ঘ সময় কারাগারে কেটেছে তার। ব্রিটিশ গেল, পাকিস্তান গেল, বাংলাদেশ এলো কিন্তু সত্যেন সেনের কারাভোগের কোন পরিবর্তন হলো না। তাতে কিন্তু সংগ্রাম থামেনি। কারারুদ্ধ সময়টা প্রস্তুতিতে ব্যয় হয়েছে। নিজে শিক্ষার জন্য, বিরামহীন পড়াশোনার পাশাপাশি এসেছে সাহিত্য সাধনা। কারাগারে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে অর্থবহ করে অপরিসীমভাবে লিখে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। রাজনীতির সঙ্গে সাহিত্য-সৃষ্টি তার জীবনকে অসাধারণ অনন্য করে তুলেছে। এই বিশাল সাহিত্যভাণ্ডার সমাজ রূপান্তর ও মানবমুক্তির সংগ্রামকে আলোকপাত করেছে। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের শক্তিকে আলোকপাত করেছে। বাংলার সমাজ জীবনের ভাঙাগড়াকে আলোকপাত করেছে। মানবতাবোধের জাগরণকে আলোকপাত করেছে। শোষণ-বঞ্চনায় মানুষের নিরন্তর সংগ্রামকে আলোকপাত করেছে। বঞ্চনা কাতর মানুষের দীপ্ত সংগ্রামকে আলোকপাত করেছে, বিজ্ঞানের অবদানে বিশ্বদৃষ্টি পটপরিবর্তনকে আলোকপাত করেছে। আলোকপাত করেছে মুক্তি সংগ্রামের আকাক্সক্ষাকে, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীকে, নির্মোহ চিন্তা চেতনার পাশাপাশি হৃদয়গ্রাহী ইতিহাস সচেতন ও শিশুতোষ কুশলতাকে।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, জাতীয় মুক্তি আন্দোলন, প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণের আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে, সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তুলতে, সম্পৃক্ত করতে এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তাদের মনোজগতে কীভাবে পরিবর্তন আনা যায় সে ভাবনাই তিনি ভেবেছেন কারাগারে বসে। সমাজের অন্যায়-অবিচার, শোষণের বিরুদ্ধে মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ব্রত নিয়ে গড়ে তুলেছেন উদীচী। উত্তর দিক। উত্তর আকাশের ধ্রুবতারা। যে তারাকে সাথী করে অন্ধকার রাতে পথহারা নাবিক অভিষ্ট পথের দিকে এগিয়ে যায়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুথান এবং তার পথ ধরে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে উদীচীর গান-কবিতা-নাটক-গীতিআলেখ্য মানুষকে জুাগরণী মন্ত্রে উজ্জীবিত করে, উত্তর আকাশের ধ্রুবতারা তার নামের স্বার্থকতা লাভে সক্ষম হয়েছে। মানুষকে ভালোবেসে প্রাণের আবেগে সৃষ্ট উদীচী আলোকবর্তিকা হয়ে বিপন্ন মানবিকতার পক্ষে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পতাকা বয়ে চলেছে আজও।

সত্যেন সেন সমাজের সর্বস্তরে প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনাকে পৌঁছে দিতে নিজের সাহিত্য কর্মকে ব্যবহার করেছেন হাতিয়ার হিসেবে। আর অপরদিকে উদীচীর গানকে মাধ্যম হিসেবে যুক্ত করতে চেয়েছেন তাদের জীবনে। নিজের দর্শন ও চিন্তার প্রতিফলনকে মূর্ত করে তুলতে এ এক অনন্য প্রয়াস। নিজে সুকণ্ঠের অধিকারী, গান লিখেছেন, সুর করেছেন, গান গাইয়েছেন। কিছু গান মানুষের মুখে মুখে ফেরে আজও। গণসমাবেশে শোনা যায়। প্রতিটি গানই জীবনবোধে সতন্ত্র্য। অসুন্দরের বিরুদ্ধে সুন্দরের সুর, অসংগতির বিরুদ্ধে সংগতির সুর। অসংকোচ প্রত্যয়ে একমাত্র তিনিই বলতে পেরেছেন

আমি মানুষেরে ভালোবাসি এই মোর অপরাধ

হাসি মুখে তাই মাথা পেতে নেই দুঃখের আশীর্বাদ

মানুষের কাছে পেয়েছি যে বাণী তাই দিয়ে রচি গান

মানুষের লাগি ঢেলে দিয়ে যাব মানুষের দেয়া প্রাণ

সত্যেন সেন কৃষক আন্দোলনে যুক্ত হন তরুণ বয়সে। গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন একটা শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে গরিব-দুঃখী মানুষদের উদ্বুদ্ধ করে বিপ্লব সাধনের প্রত্যয়ে। কৃষকের মাঝে পুরাপুরি কৃষক হয়েই মিশে যেতেন তিনি। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফেরা, আধাপেটা আহার, অবসাদে ঘুমই ছিল যে কৃষকদের নিয়তি। ন্যূনতম বিনোদন নেই, মৌলিক অধিকারবোধ যাদের নেই সেই মানুষগুলোকে অধিকার সচেতন করা, সংগঠিত করা, বিনোদন দিয়ে উজ্জীবিত করার ব্রত নিয়ে এগিয়েছেন। লিখেছেন তাদের উদ্বুদ্ধ করার মুক্তিমন্ত্র :

চাষি দে তোর লাল সালাম তোর লাল নিশান রে

আঁধার পথে আলো দেয় সে মুশকিল আসান করে।

সত্যেন সেন জীবনের সবকিছুতেই মানুষের জীবন সংগ্রামকে প্রাধান্য দিয়েছেন। গানের মাধ্যমে মানুষকে জাগরুক করা সহজ বিবেচনায় শ্রমিকদের নিয়ে গান লিখেছেন, গেয়েছেন, গাইয়েছেন। শ্রমিকদের যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত মনের অন্ধকার, চিত্তের দীনতা ঘোচাতে তার আত্মনিয়োগ অসাধারণ। তার শাণিত কলম উচ্চারণ করেছে-

খেটে খেটে মরলি খালি

অভাবেই দিন কাটালি

দিনে দিনে সব খোয়ালি

এমনি কপাল পোড়া

সংস্কৃতি মানুষের মনস্তরের কোন জায়গাটিতে কাজ করে তা সত্যেন সেন বুঝতেন। জীবনের গভীর ভাবনার প্রকৃতি অনুভবে উত্তেজক বক্তৃতা-সে্লাগান-মিছিলে নয় সংস্কৃতি চর্চাকেই জীবনের চরম সত্য বলে মেনেছেন। পথ দেখিয়েছেন, আলো জ্বেলেছেন। মানব কল্যাণের সেই আলো যুগ থেকে যুগে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, সমাজ থেকে সমাজে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হলেই সত্যেন সেনের ত্যাগ পরিশ্রম আর সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন স্বার্থকতা লাভ করবে। একাজ বড়ই কঠিন। গুরুদায়িত্ব পালনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা জনবল সংকট। বর্তমান বাস্তবতা বিশাল লোকবল, নিবেদিত কর্মীদের ভিড়ে ভাবনাসমৃদ্ধ মানুষ অঙ্গীকার আর অনুশীলনেই থমকে আছে। বর্তমান উদীচীর কাণ্ডারীদের এই থমকে থাকা মানুষদের জাগাতে হবে। চারিদিকের আপসকামিতা দেখে থমকে থাকলে চলবে না। থমকে থাকা মানুষদের জাগাতে সত্যেন চর্চা জরুরি।

বিরল প্রতিভার মানুষ সত্যেন সেন। জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা।

রবিবার, ২৯ মার্চ ২০২০ , ১৫ চৈত্র ১৪২৬, ২৯ রজব সানি ১৪৪১

‘সত্যেন সেন’- অদম্য মুক্ত প্রাণের শক্তি

এমআর খায়রুল উমাম

সত্যেন সেন। অদম্য প্রাণস্পৃহা সম্পন্ন এক মানুষ। মানবমুক্তির অমৃত জীবনধারায় সিক্ত। প্রগতিশীল সংস্কৃতি বিকাশের ধারক। ধ্রুপদী গণকথা শিল্পী। দেশের সব মানুষকে আপন ভেবে, নিজেকে তাদের একজন ভেবে মানব মুক্তির জন্য রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বলয় সৃষ্টিতে নিরলস শ্রম দিয়ে গিয়েছেন। চলার পথে ডাক দিয়েছেন সবাইকে। সংগঠিত করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু পিছন ফিরে দেখেননি। রাষ্ট্র তাকে জনবিচ্ছিন্ন করতে চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনভাবেই থামাতে পারেনি। যতবার রাষ্ট্র চেষ্টা করেছে ততবারই নতুন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ফেরৎ এসেছেন তিনি। ফেরৎ এসেছেন বাংলা সাহিত্যের প্রগতিবাদী লেখক হিসেবে, দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রগামী নেতা হিসেবে, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে। জীবন, জীবিকা আর পরিবার দেশের মানুষের কাছে ফিরে আসার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সাধারণভাবে যারা কাজ করেন তারা সমাদৃত হয় না কিন্তু বহুমুখী কাজ দিয়ে সমাজে সত্যেন সেন সমাদৃত।

দেশের মানুষকে নিপীড়ন মুক্ত করার স্বপ্ন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দীর্ঘ সময় কারাগারে কেটেছে তার। ব্রিটিশ গেল, পাকিস্তান গেল, বাংলাদেশ এলো কিন্তু সত্যেন সেনের কারাভোগের কোন পরিবর্তন হলো না। তাতে কিন্তু সংগ্রাম থামেনি। কারারুদ্ধ সময়টা প্রস্তুতিতে ব্যয় হয়েছে। নিজে শিক্ষার জন্য, বিরামহীন পড়াশোনার পাশাপাশি এসেছে সাহিত্য সাধনা। কারাগারে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে অর্থবহ করে অপরিসীমভাবে লিখে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। রাজনীতির সঙ্গে সাহিত্য-সৃষ্টি তার জীবনকে অসাধারণ অনন্য করে তুলেছে। এই বিশাল সাহিত্যভাণ্ডার সমাজ রূপান্তর ও মানবমুক্তির সংগ্রামকে আলোকপাত করেছে। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের শক্তিকে আলোকপাত করেছে। বাংলার সমাজ জীবনের ভাঙাগড়াকে আলোকপাত করেছে। মানবতাবোধের জাগরণকে আলোকপাত করেছে। শোষণ-বঞ্চনায় মানুষের নিরন্তর সংগ্রামকে আলোকপাত করেছে। বঞ্চনা কাতর মানুষের দীপ্ত সংগ্রামকে আলোকপাত করেছে, বিজ্ঞানের অবদানে বিশ্বদৃষ্টি পটপরিবর্তনকে আলোকপাত করেছে। আলোকপাত করেছে মুক্তি সংগ্রামের আকাক্সক্ষাকে, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীকে, নির্মোহ চিন্তা চেতনার পাশাপাশি হৃদয়গ্রাহী ইতিহাস সচেতন ও শিশুতোষ কুশলতাকে।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, জাতীয় মুক্তি আন্দোলন, প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণের আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে, সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তুলতে, সম্পৃক্ত করতে এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তাদের মনোজগতে কীভাবে পরিবর্তন আনা যায় সে ভাবনাই তিনি ভেবেছেন কারাগারে বসে। সমাজের অন্যায়-অবিচার, শোষণের বিরুদ্ধে মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ব্রত নিয়ে গড়ে তুলেছেন উদীচী। উত্তর দিক। উত্তর আকাশের ধ্রুবতারা। যে তারাকে সাথী করে অন্ধকার রাতে পথহারা নাবিক অভিষ্ট পথের দিকে এগিয়ে যায়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুথান এবং তার পথ ধরে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে উদীচীর গান-কবিতা-নাটক-গীতিআলেখ্য মানুষকে জুাগরণী মন্ত্রে উজ্জীবিত করে, উত্তর আকাশের ধ্রুবতারা তার নামের স্বার্থকতা লাভে সক্ষম হয়েছে। মানুষকে ভালোবেসে প্রাণের আবেগে সৃষ্ট উদীচী আলোকবর্তিকা হয়ে বিপন্ন মানবিকতার পক্ষে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পতাকা বয়ে চলেছে আজও।

সত্যেন সেন সমাজের সর্বস্তরে প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনাকে পৌঁছে দিতে নিজের সাহিত্য কর্মকে ব্যবহার করেছেন হাতিয়ার হিসেবে। আর অপরদিকে উদীচীর গানকে মাধ্যম হিসেবে যুক্ত করতে চেয়েছেন তাদের জীবনে। নিজের দর্শন ও চিন্তার প্রতিফলনকে মূর্ত করে তুলতে এ এক অনন্য প্রয়াস। নিজে সুকণ্ঠের অধিকারী, গান লিখেছেন, সুর করেছেন, গান গাইয়েছেন। কিছু গান মানুষের মুখে মুখে ফেরে আজও। গণসমাবেশে শোনা যায়। প্রতিটি গানই জীবনবোধে সতন্ত্র্য। অসুন্দরের বিরুদ্ধে সুন্দরের সুর, অসংগতির বিরুদ্ধে সংগতির সুর। অসংকোচ প্রত্যয়ে একমাত্র তিনিই বলতে পেরেছেন

আমি মানুষেরে ভালোবাসি এই মোর অপরাধ

হাসি মুখে তাই মাথা পেতে নেই দুঃখের আশীর্বাদ

মানুষের কাছে পেয়েছি যে বাণী তাই দিয়ে রচি গান

মানুষের লাগি ঢেলে দিয়ে যাব মানুষের দেয়া প্রাণ

সত্যেন সেন কৃষক আন্দোলনে যুক্ত হন তরুণ বয়সে। গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন একটা শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে গরিব-দুঃখী মানুষদের উদ্বুদ্ধ করে বিপ্লব সাধনের প্রত্যয়ে। কৃষকের মাঝে পুরাপুরি কৃষক হয়েই মিশে যেতেন তিনি। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফেরা, আধাপেটা আহার, অবসাদে ঘুমই ছিল যে কৃষকদের নিয়তি। ন্যূনতম বিনোদন নেই, মৌলিক অধিকারবোধ যাদের নেই সেই মানুষগুলোকে অধিকার সচেতন করা, সংগঠিত করা, বিনোদন দিয়ে উজ্জীবিত করার ব্রত নিয়ে এগিয়েছেন। লিখেছেন তাদের উদ্বুদ্ধ করার মুক্তিমন্ত্র :

চাষি দে তোর লাল সালাম তোর লাল নিশান রে

আঁধার পথে আলো দেয় সে মুশকিল আসান করে।

সত্যেন সেন জীবনের সবকিছুতেই মানুষের জীবন সংগ্রামকে প্রাধান্য দিয়েছেন। গানের মাধ্যমে মানুষকে জাগরুক করা সহজ বিবেচনায় শ্রমিকদের নিয়ে গান লিখেছেন, গেয়েছেন, গাইয়েছেন। শ্রমিকদের যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত মনের অন্ধকার, চিত্তের দীনতা ঘোচাতে তার আত্মনিয়োগ অসাধারণ। তার শাণিত কলম উচ্চারণ করেছে-

খেটে খেটে মরলি খালি

অভাবেই দিন কাটালি

দিনে দিনে সব খোয়ালি

এমনি কপাল পোড়া

সংস্কৃতি মানুষের মনস্তরের কোন জায়গাটিতে কাজ করে তা সত্যেন সেন বুঝতেন। জীবনের গভীর ভাবনার প্রকৃতি অনুভবে উত্তেজক বক্তৃতা-সে্লাগান-মিছিলে নয় সংস্কৃতি চর্চাকেই জীবনের চরম সত্য বলে মেনেছেন। পথ দেখিয়েছেন, আলো জ্বেলেছেন। মানব কল্যাণের সেই আলো যুগ থেকে যুগে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, সমাজ থেকে সমাজে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হলেই সত্যেন সেনের ত্যাগ পরিশ্রম আর সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন স্বার্থকতা লাভ করবে। একাজ বড়ই কঠিন। গুরুদায়িত্ব পালনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা জনবল সংকট। বর্তমান বাস্তবতা বিশাল লোকবল, নিবেদিত কর্মীদের ভিড়ে ভাবনাসমৃদ্ধ মানুষ অঙ্গীকার আর অনুশীলনেই থমকে আছে। বর্তমান উদীচীর কাণ্ডারীদের এই থমকে থাকা মানুষদের জাগাতে হবে। চারিদিকের আপসকামিতা দেখে থমকে থাকলে চলবে না। থমকে থাকা মানুষদের জাগাতে সত্যেন চর্চা জরুরি।

বিরল প্রতিভার মানুষ সত্যেন সেন। জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা।