ব্যক্তিগত দূরত্ব রেখে সামাজিক বন্ধন সুরক্ষা

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

এমন ঢাকা শহরকে কেউ কোনদিন দেখেনি। কদিন হলো এই চেনা শহরটা যেন একেবারে অচেনা হয়ে গেছে। ঈদ, পূজা-পার্বণের ছুটি-ছাটায়ও এমন ফাঁকা হয়নি জনবহুল মহানগরী ঢাকা। এমনকি ষাটের দশকের কম ঘনবসতির ঢাকা শহরের রাজপথ অলিগলিতে লোক সমাগম দেখা যেত সব সময়ই। কিন্তু আজ ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকার শুন্য সড়কে দুয়েকটা খালি রিকশায় চালকের প্যাডেল মেরে চলার দৃশ্যে ভেতরটা হু হু করে ওঠে। অজানা আশঙ্কায় কেঁদে ওঠে মন। স্কুল, কলেজসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে ১৭ মার্চ থেকে। কোচিং সেন্টার, তাও বন্ধ। শুনেছি বাসায় প্রাইভেট পড়াতেও আসছেন না টিউটরগণ। এ যেন এক দারুণ অচলাবস্থা। সড়কে গণপরিবহন, প্রাইভেট কার বলতে নেই। যে ফ্লাইওভারে একসময় যানজট লেগে থাকতো তাও আজ বিরান। দিনদুপুরেও যেন স্তব্ধ নিশুতি রাত। এ যেন এক প্রেতপুরি। গাড়ি চলাচলের শব্দ নেই। চারদিকে দোকানপাট সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে পূর্ণ লকডাউন। দু-চারটে খোলা দোকান যা খোলা রয়েছে তাতে প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। বেশি জিনিষ মজুদ করে রাখার পক্ষে আমি নই। তবে শুনছি মানুষ চাল-ডাল কিনে ঘর ভরে ফেলেছে। এই সুযোগে মুনফালোভী ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম। চাল, ডাল, তেল, নুন- কিছুই আর আগের দামে পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষের এই বিপদে কোথায় তাদের পাশে দাঁড়াবে তা নয়, করোনাভাইরাস আতঙ্ককে পুঁজি করে জিম্মি করা হলো সাধারণ জনগণকে। সাবান, হ্যান্ডওয়াশের বাজার হয়ে গেছে ফতুর। হ্যান্ড সেনিটাইজারের ব্যবহার না জানলেও মানুষ কিনেছে দেদারছে। দামও হাঁকাচ্ছে যে যার খুশি মতো। ক্রেতা, বিক্রেতা কেউ কেউ ঘরে বসে হ্যন্ড সেনিটাইজার বানানো প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ফেসবুক, ইউটিউব এ ব্যাপারে সক্রিয় সব সময়েই। কে কোথায় বললো, থানকুনি পাতা খেলে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি মিলবে। ভাইরাল হলো খবরটি। আর যায় কোথায়, চার-পাঁচটা থানকুনি পাতা বিক্রি হলো ৩০-৪০ টাকায়। ঢাকার আশপাশসহ বাংলাদেশের সকল থানকুনি পাতার বাগান, ঝোপঝাড় সাফ। আমাদের হুজুগে স্বভাবটা খুব একটুও বদলায়নি। এভাবে আর কত কিছু কতটা কেনা যাবে। যারা দিন আনে দিন খায় তাদের কী হবে! চারিদিকে হাহাকার। এই প্রাণঘাতী মারণকীট কবে নিঃশেষ হবে কেউ তা আজও জানে না।

গেল ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু। সেখানকার একটি প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ে পিএইচডি’র গবেষক আমার বড় ছেলের কাছে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণের খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি। উহানের কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি মাছ-মাংস বিক্রির বাজার থেকে নাকি করোনাভাইরাস ছড়াতে শুরু করেছে। ওখানে জলজ প্রাণী থেকে বন্যপ্রাণীর মাংস বিক্রি হয়। কথাটা কেন যেন বিশ্বাস হতে চায়নি। নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলে সপরিবারে কাটিয়েছি বেশ কবছর সেখানকার বাজারেও বন্যপ্রাণীর মাংস ‘বুশমিট’ নামে বিক্রি হতো। প্রকাশ্যে জ্যান্ত ইদুরও হরহামেশা বিক্রি হতে দেখেছি। সেখানকার লোকজন ইদুরসহ অনেক বন্যপ্রাণীর মাংস ঝলসিয়ে খায়। কিন্তু সেখানে তো এ ধরনের কোন ভাইরাস সংক্রমণের খবর শুনিনি। উহানে করোনাভাইরাসের বিস্তার লাভের পর ভার্সিটিগুলোর ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আবদ্ধ করে রাখা হয় প্রায় ১০-১২ দিন। ধীরে ধীরে করোনাভাইরাসের অপ্রতিরোধ্য সংক্রমণ বাড়তে থাকে। উহান শহরের বাইরে হুবেই প্রদেশ ছাড়িয়ে অন্য প্রদশগুলোতে চলে করোনা বিস্তার। তর তর করে বাড়ে মৃতের সংখ্যা। বন্ধ হয়ে যায় ভার্সিটির সকল কার্যক্রম। রাস্তাঘাট, দোকানপাট জন শূন্য হতে থাকে। খাবার-দাবার এর সীমিত ব্যবস্থাপনার মধ্যে জনগণকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। এমন একসময় বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টায় ৩১২ জন বাংলাদেশিকে (যাদের মধ্যে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী) উহান থেকে ঢাকায় বিশেষ বিমান পাঠিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়। হজ ক্যাম্পে এদের প্রয়োজনীয় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করে চৌদ্দ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখার পর সুস্থ দেহে আরও দশ দিন নিজ নিজ বাড়িতে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দীর্ঘ সময় বিশেষ ব্যবস্থায় এ ধরনের কোয়ারেন্টিনে থাকার কারণে চীন প্রত্যাগত ৩১২ জন বাংলাদেশি দ্বারা কেউ কোরানাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন বলে জানা যায়নি। এমনকি তারাও আর কাউকে সংক্রমিত করেনি।

কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধে পরবর্তীতে ইতালি থেকে প্রত্যাগত বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশিকে প্রশাসনের প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট জায়গায় কোয়ারেন্টিনের রাখতে না পারায়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রসহ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি হযরত শাজজালাল বিমানবন্দরে এসে নির্বিঘে্নে যে যার বাড়িতে চলে যান। সীমিত সংখ্যক বিদেশ প্রত্যাগতদের শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকায় তাদের ভাইরাস পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়। ঢাকার কিছু হাসপাতালে কোরানাভাইরাস আক্রান্তদের নামমাত্র চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা হয়। স্বাস্থ্য আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা প্রতিদিন সংবাদ মাধ্যমে দেশের করোনা পরিস্থিতি, চিকিৎসা, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ব্যাপারে ব্রিফিং করেন। এ ব্যাপারে তার নিরলস প্রচেষ্টা জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। তবে শাহজালাল বিমানবন্দরে শুধু থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে প্রত্যাগতদের শরীরের তাপমাত্রা মেপে তাদের শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি সন্দেহাতীতভাবে নিরূপণ সম্ভব হয়নি। কেননা এই ভাইরাস থেকে রোগ সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর লক্ষণ প্রকাশের যে সময়কাল (গুপ্তিকাল) ১৪ দিন। বিমানবন্দরে পৌঁছা মুহূর্তে কারও শরীরে তাপমাত্রা বা রোগের অন্য কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত না হলেও পরবর্তী ১৪ দিনের মধ্যে যে কোনো সময়ে তা প্রকাশ পেতে পারে। আসলে ঘটেছেও তাই। স্থলবন্দর থেকে দেশে আসা মানুষের বেলায়ও সম্ভবত একই ঘটনা ঘটার কথা। কেননা এসব মানুষ ঘরে ফিরে হোম কোয়ারেন্টিনের বদলে ‘নো-কোয়ারেন্টিনে’ থেকেছেন। এদের বেশির ভাগই স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করেছেন। হাটে-বাজারে গেছেন। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কোলাকুলি করেছেন। কেউ পরিবারের সঙ্গে থেকে কেউ নিজের পিতা, কেউ নিজের স্ত্রী বা সন্তানকে সংক্রমিত করেছেন। তাদের কেউ কেউ মারাও গেছেন। বাঙালির এ ধরনের উদার প্রীতির উদাহরণ সর্বজন স্বীকৃত। এভাবেই করোনাভাইরাস বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে। প্রথম থেকে দেশের বাহির থেকে লোকজন দেশে আসার পথগুলো বন্ধ করে দিয়ে শহরে শহরে লকডাউন ঘোষিত হলে হয়তো করোনাভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা কিছুটা হ্রাস পেতো। লকডাউন ঘোষণার আগেই যথেষ্ট সময় পেয়ে বিদেশ প্রত্যাগতরা শহরময়, গ্রাম-গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণে সহায়তা করেছে। মার্চের ২৭ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশে ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৪৮ জন, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৫ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ৫ জন।

শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের চেনা-জানা উর্বর শহরগুলো করোনাভাইরাস সংক্রমণে ক্রমশ মৃত্যুপুরিতে রূপ নিয়েছে। এশিয়া ছাড়িয়ে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এমনকি আফ্রিকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই ছোট এক প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস কোভিড-১৯। এই মুহূর্তে সারা বিশ্ব ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৬,২০,৯৩৮ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১,৩৭,৩৬৩ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ২৮,৬৫৩ জন। মৃত্যুর সংখ্যা বিচারে এখন স্পেন ইতালিকেও ছাড়িয়ে যেতে চলেছে। চীনে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৩,২৯৫ জন। এক সময় চীনের উহানের পর করোনা আক্রান্ত এবং মৃত রোগীর সংখ্যা ইতালিতেই ছিল সবচেয়ে বেশি। ২৮ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় স্পেনে মারা গেছেন ৫,৮১২ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী। ফ্রান্সে লকডাউন ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হলেও মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১,৯৯৫ জনে। যুক্তরাজ্যে করোনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১,০১৯এবং এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ হাজার ৮৯ জন। ইরানে মারা গেছেন ২,৫১৭ জন। নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শহরগুলোতেও ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে হয়েছে ১,৯০৩ জন।

এখন থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত সব ধরনের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে আসা মানুষের দ্বারা ভাইরাস সংক্রমণের আর সম্ভবনা নেই। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় যথেষ্ট প্রচারাভিযান চলছে। সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। রাস্তায় জনগণের এবং যানবাহনের চলাচল এবং অন্যান্য নির্দেশ পালন নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বারবার হাত ধোয়ার অভ্যেস গড়ে তোলার তাগিদ দেয়া হচ্ছে মিডিয়ায়। এমনকি ২০ মিনিট ধরে ভালোভাবে হাত ধোয়র কৌশল রপ্ত করারও ব্যাপক প্রচার চলে। রাস্তায় চলচলের সময় মাস্ক ব্যবহারের কথাও বলা হচ্ছে। এমন কি হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় কনুই দিয়ে হাত ঢেকে রাখতে বলা হয়। দেশে প্রথমত গণপরিবহন এবং পরে সব রকম যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। অবশেষে দেশব্যাপী লকডাইন ঘোষণার পর থেকে ঢাকা থেকে মানুষ ছুটে গেছেন মফস্বল শহরে বা গ্রামে। তবে গ্রামের রাস্তাঘাটেরও একই অবস্থা বলা চলছে। সবাই আজ গৃহবন্দি অর্থাৎ রয়েছেন সেলফ বা হোম কোয়ারেন্টিনে। যে যেখানেই থাকুন, করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। সাবান-পানি দিয়ে ২০ মিনিট ধরে হাত না ধুয়ে চোখ, নাক, মুখ স্পর্শ না করা। খোলা রাখা কিছু বড় দোকানের সামনে দেখলাম, এক মিটার দূরে দূরে বর্গাকৃতি বা গোলাকার দাগ কেটে রাখা হয়েছে। মানুষজন এ নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই ওষুধের মতো জরুরি জিনিষ কিনছেন। ব্যক্তিগত এমন সাবধানতাই করোনা সংক্রমণ থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারে। কেউ আক্রান্ত বলে মনে হলে উচিত হবে নিজেকে পরিবারের সদস্যদের কাছে থেকে আলাদা ঘরে থেকে রোগের উপসর্গ বুঝে নিজে কোনো ওষুধ না খেয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া। এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের হেল্পলাইন সব সময়ের জন্য খোলা রয়েছে। তবে এখান থেকে মানুষ যেন যথাযথ সেবা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। রোগ শনাক্তকরণের পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

দেশের কিছু হাসপাতালে ভাইরাস আক্রান্তদের জন্য কিছু বেড প্রস্তুত করা হলেও ঢাকার একমাত্র হাসপাতালে ২৯টি আইসিইউ বেড রয়েছে। চিকিৎসার জন্য ভেন্টিলেশনসহ জীবন রক্ষাকারী সব উপাদান সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে রাখতে হবে। গরিব রোগীদের জন্য বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও খাদ্য সংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ রবাদ্দ রাখতে হবে। ঢাকার বাইরের হাসপাতালে রোগীর স্বাস্থ্যসেবার পরিধি ও মান বাড়াতে হবে। চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয় থেকে হাসপাতালে দায়িত্বরত প্রতিটি কর্মীর জন্য নিরপত্তা পোশাক, মুখোশ, গ্লোভস দিতে হবে। তারা নিরাপদ না থাকলে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করবেন কে? সদ্য চীন থেকে আনা পিপিই কিটস এবং অন্যান্য চিকিৎসাসামগ্রী হাসপাতালগুলোতে যথাযথভাবে দ্রুত বন্টন করতে হবে। দেশের মানুষকে হোম কোয়ারেন্টিনের সময় ব্যক্তিগত সুরক্ষার পাশাপাশি সামাজিক দায়দায়িত্ব পালন চালিয়ে যেতে হবে। কেউ যেন ব্যক্তিগত দূরত্বকে সামাজিক দূরত্ব ভেবে ভুল না করে বসেন। সেলফ কোয়ারেন্টিন বা স্বেচ্ছা বিচ্ছিন্ন থাকা কোনোমতেই ‘সোশ্যাল আইসোলেশন’ বা সামাজিক ব্যবধান সৃষ্টি নয়। বাইরে না বেরিয়ে ল্যান্ডফোন অথবা সেলফোন কিম্বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের খোঁজখবর রাখতে হবে। কাছে না গিয়েও তাদের বিপদে-আপদে সৎ পরামর্শ দিয়ে বিশেষ উপকারে আসা যেতে পারে। কোয়ারেন্টিনের অবসর সময়টা বই পড়ে, টেলিভিশন দেখে কাটানো যেতে পারে। তা হলে একঘেয়েমিও কেটে যাবে। ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবই পড়ে স্কুল বন্ধের ঘাটতিটা পুষিয়ে নিতে হবে। স্কুল কলেজ খুলে গেলে পরীক্ষা শুরু হতে আর বেশি সময় লাগবে না। এখনকার সময়টা আলসেমিতে কাটালে পরে এর মাশুল পরীক্ষায় দিতে হবে। তাই কোনোমতেই বাইরে বেরোনো নয়। যা করতে হবে ঘরের মধ্যে বসে। অতি প্রয়োজনে একান্ত কাউকে বেরোতে হলে ব্যক্তিগত সুরক্ষার নিয়মাবলি মেনে কাজ সেরেই দ্রুত ঘরে ফিরে আসতে হবে। ঘরে ঢোকার আগেই হাত, সমস্ত মুখম-ল, পা ভালো করে সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এর আগে ঘরের দরজার হাতল বা অন্য কোনো আসবাবপত্রই ছোঁয়া যাবে না। সামনে আমাদের এক যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের মতো এক ভয়াল যুদ্ধ। যুদ্ধ-অজানা, অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে। এ শক্তি বড়ই প্রাণঘাতী। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো এতো মারণাস্ত্র তৈরি করে শত্রু দমনে পারঙ্গম, অথচ ক্ষুদ্র এক করোনাভাইরাসের কাছে সবাই আজ পরাস্ত। তাই একে মোকাবিলা করতে হবে নির্ভয়ে, সুকৌশলে। করোনাভাইরাসের জন্য কোনো আতঙ্ক নয়, চাই সতর্কতা আর সাবধানতা। সাহসের সঙ্গে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সবার সমন্বিত প্রয়াসই এই প্রাণঘাতী রোগ থেকে দিতে পারে মুক্তি। একজনের সতর্কতা বাঁচাতে পারে অন্যকে। রক্ষা করতে পারে দেশের কোটি মানুষের জীবন।

[লেখক : প্রকৌশলী, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক]

সোমবার, ৩০ মার্চ ২০২০ , ১৬ চৈত্র ১৪২৬, ৩০ রজব সানি ১৪৪১

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধ

ব্যক্তিগত দূরত্ব রেখে সামাজিক বন্ধন সুরক্ষা

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

এমন ঢাকা শহরকে কেউ কোনদিন দেখেনি। কদিন হলো এই চেনা শহরটা যেন একেবারে অচেনা হয়ে গেছে। ঈদ, পূজা-পার্বণের ছুটি-ছাটায়ও এমন ফাঁকা হয়নি জনবহুল মহানগরী ঢাকা। এমনকি ষাটের দশকের কম ঘনবসতির ঢাকা শহরের রাজপথ অলিগলিতে লোক সমাগম দেখা যেত সব সময়ই। কিন্তু আজ ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকার শুন্য সড়কে দুয়েকটা খালি রিকশায় চালকের প্যাডেল মেরে চলার দৃশ্যে ভেতরটা হু হু করে ওঠে। অজানা আশঙ্কায় কেঁদে ওঠে মন। স্কুল, কলেজসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে ১৭ মার্চ থেকে। কোচিং সেন্টার, তাও বন্ধ। শুনেছি বাসায় প্রাইভেট পড়াতেও আসছেন না টিউটরগণ। এ যেন এক দারুণ অচলাবস্থা। সড়কে গণপরিবহন, প্রাইভেট কার বলতে নেই। যে ফ্লাইওভারে একসময় যানজট লেগে থাকতো তাও আজ বিরান। দিনদুপুরেও যেন স্তব্ধ নিশুতি রাত। এ যেন এক প্রেতপুরি। গাড়ি চলাচলের শব্দ নেই। চারদিকে দোকানপাট সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে পূর্ণ লকডাউন। দু-চারটে খোলা দোকান যা খোলা রয়েছে তাতে প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। বেশি জিনিষ মজুদ করে রাখার পক্ষে আমি নই। তবে শুনছি মানুষ চাল-ডাল কিনে ঘর ভরে ফেলেছে। এই সুযোগে মুনফালোভী ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম। চাল, ডাল, তেল, নুন- কিছুই আর আগের দামে পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষের এই বিপদে কোথায় তাদের পাশে দাঁড়াবে তা নয়, করোনাভাইরাস আতঙ্ককে পুঁজি করে জিম্মি করা হলো সাধারণ জনগণকে। সাবান, হ্যান্ডওয়াশের বাজার হয়ে গেছে ফতুর। হ্যান্ড সেনিটাইজারের ব্যবহার না জানলেও মানুষ কিনেছে দেদারছে। দামও হাঁকাচ্ছে যে যার খুশি মতো। ক্রেতা, বিক্রেতা কেউ কেউ ঘরে বসে হ্যন্ড সেনিটাইজার বানানো প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ফেসবুক, ইউটিউব এ ব্যাপারে সক্রিয় সব সময়েই। কে কোথায় বললো, থানকুনি পাতা খেলে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি মিলবে। ভাইরাল হলো খবরটি। আর যায় কোথায়, চার-পাঁচটা থানকুনি পাতা বিক্রি হলো ৩০-৪০ টাকায়। ঢাকার আশপাশসহ বাংলাদেশের সকল থানকুনি পাতার বাগান, ঝোপঝাড় সাফ। আমাদের হুজুগে স্বভাবটা খুব একটুও বদলায়নি। এভাবে আর কত কিছু কতটা কেনা যাবে। যারা দিন আনে দিন খায় তাদের কী হবে! চারিদিকে হাহাকার। এই প্রাণঘাতী মারণকীট কবে নিঃশেষ হবে কেউ তা আজও জানে না।

গেল ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু। সেখানকার একটি প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ে পিএইচডি’র গবেষক আমার বড় ছেলের কাছে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণের খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি। উহানের কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি মাছ-মাংস বিক্রির বাজার থেকে নাকি করোনাভাইরাস ছড়াতে শুরু করেছে। ওখানে জলজ প্রাণী থেকে বন্যপ্রাণীর মাংস বিক্রি হয়। কথাটা কেন যেন বিশ্বাস হতে চায়নি। নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলে সপরিবারে কাটিয়েছি বেশ কবছর সেখানকার বাজারেও বন্যপ্রাণীর মাংস ‘বুশমিট’ নামে বিক্রি হতো। প্রকাশ্যে জ্যান্ত ইদুরও হরহামেশা বিক্রি হতে দেখেছি। সেখানকার লোকজন ইদুরসহ অনেক বন্যপ্রাণীর মাংস ঝলসিয়ে খায়। কিন্তু সেখানে তো এ ধরনের কোন ভাইরাস সংক্রমণের খবর শুনিনি। উহানে করোনাভাইরাসের বিস্তার লাভের পর ভার্সিটিগুলোর ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আবদ্ধ করে রাখা হয় প্রায় ১০-১২ দিন। ধীরে ধীরে করোনাভাইরাসের অপ্রতিরোধ্য সংক্রমণ বাড়তে থাকে। উহান শহরের বাইরে হুবেই প্রদেশ ছাড়িয়ে অন্য প্রদশগুলোতে চলে করোনা বিস্তার। তর তর করে বাড়ে মৃতের সংখ্যা। বন্ধ হয়ে যায় ভার্সিটির সকল কার্যক্রম। রাস্তাঘাট, দোকানপাট জন শূন্য হতে থাকে। খাবার-দাবার এর সীমিত ব্যবস্থাপনার মধ্যে জনগণকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। এমন একসময় বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টায় ৩১২ জন বাংলাদেশিকে (যাদের মধ্যে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী) উহান থেকে ঢাকায় বিশেষ বিমান পাঠিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়। হজ ক্যাম্পে এদের প্রয়োজনীয় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করে চৌদ্দ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখার পর সুস্থ দেহে আরও দশ দিন নিজ নিজ বাড়িতে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দীর্ঘ সময় বিশেষ ব্যবস্থায় এ ধরনের কোয়ারেন্টিনে থাকার কারণে চীন প্রত্যাগত ৩১২ জন বাংলাদেশি দ্বারা কেউ কোরানাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন বলে জানা যায়নি। এমনকি তারাও আর কাউকে সংক্রমিত করেনি।

কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধে পরবর্তীতে ইতালি থেকে প্রত্যাগত বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশিকে প্রশাসনের প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট জায়গায় কোয়ারেন্টিনের রাখতে না পারায়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রসহ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি হযরত শাজজালাল বিমানবন্দরে এসে নির্বিঘে্নে যে যার বাড়িতে চলে যান। সীমিত সংখ্যক বিদেশ প্রত্যাগতদের শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকায় তাদের ভাইরাস পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়। ঢাকার কিছু হাসপাতালে কোরানাভাইরাস আক্রান্তদের নামমাত্র চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা হয়। স্বাস্থ্য আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা প্রতিদিন সংবাদ মাধ্যমে দেশের করোনা পরিস্থিতি, চিকিৎসা, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ব্যাপারে ব্রিফিং করেন। এ ব্যাপারে তার নিরলস প্রচেষ্টা জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। তবে শাহজালাল বিমানবন্দরে শুধু থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে প্রত্যাগতদের শরীরের তাপমাত্রা মেপে তাদের শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি সন্দেহাতীতভাবে নিরূপণ সম্ভব হয়নি। কেননা এই ভাইরাস থেকে রোগ সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর লক্ষণ প্রকাশের যে সময়কাল (গুপ্তিকাল) ১৪ দিন। বিমানবন্দরে পৌঁছা মুহূর্তে কারও শরীরে তাপমাত্রা বা রোগের অন্য কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত না হলেও পরবর্তী ১৪ দিনের মধ্যে যে কোনো সময়ে তা প্রকাশ পেতে পারে। আসলে ঘটেছেও তাই। স্থলবন্দর থেকে দেশে আসা মানুষের বেলায়ও সম্ভবত একই ঘটনা ঘটার কথা। কেননা এসব মানুষ ঘরে ফিরে হোম কোয়ারেন্টিনের বদলে ‘নো-কোয়ারেন্টিনে’ থেকেছেন। এদের বেশির ভাগই স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করেছেন। হাটে-বাজারে গেছেন। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কোলাকুলি করেছেন। কেউ পরিবারের সঙ্গে থেকে কেউ নিজের পিতা, কেউ নিজের স্ত্রী বা সন্তানকে সংক্রমিত করেছেন। তাদের কেউ কেউ মারাও গেছেন। বাঙালির এ ধরনের উদার প্রীতির উদাহরণ সর্বজন স্বীকৃত। এভাবেই করোনাভাইরাস বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে। প্রথম থেকে দেশের বাহির থেকে লোকজন দেশে আসার পথগুলো বন্ধ করে দিয়ে শহরে শহরে লকডাউন ঘোষিত হলে হয়তো করোনাভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা কিছুটা হ্রাস পেতো। লকডাউন ঘোষণার আগেই যথেষ্ট সময় পেয়ে বিদেশ প্রত্যাগতরা শহরময়, গ্রাম-গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণে সহায়তা করেছে। মার্চের ২৭ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশে ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৪৮ জন, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৫ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ৫ জন।

শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের চেনা-জানা উর্বর শহরগুলো করোনাভাইরাস সংক্রমণে ক্রমশ মৃত্যুপুরিতে রূপ নিয়েছে। এশিয়া ছাড়িয়ে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এমনকি আফ্রিকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই ছোট এক প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস কোভিড-১৯। এই মুহূর্তে সারা বিশ্ব ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৬,২০,৯৩৮ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১,৩৭,৩৬৩ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ২৮,৬৫৩ জন। মৃত্যুর সংখ্যা বিচারে এখন স্পেন ইতালিকেও ছাড়িয়ে যেতে চলেছে। চীনে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৩,২৯৫ জন। এক সময় চীনের উহানের পর করোনা আক্রান্ত এবং মৃত রোগীর সংখ্যা ইতালিতেই ছিল সবচেয়ে বেশি। ২৮ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় স্পেনে মারা গেছেন ৫,৮১২ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী। ফ্রান্সে লকডাউন ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হলেও মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১,৯৯৫ জনে। যুক্তরাজ্যে করোনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১,০১৯এবং এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ হাজার ৮৯ জন। ইরানে মারা গেছেন ২,৫১৭ জন। নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শহরগুলোতেও ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে হয়েছে ১,৯০৩ জন।

এখন থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত সব ধরনের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে আসা মানুষের দ্বারা ভাইরাস সংক্রমণের আর সম্ভবনা নেই। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় যথেষ্ট প্রচারাভিযান চলছে। সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। রাস্তায় জনগণের এবং যানবাহনের চলাচল এবং অন্যান্য নির্দেশ পালন নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বারবার হাত ধোয়ার অভ্যেস গড়ে তোলার তাগিদ দেয়া হচ্ছে মিডিয়ায়। এমনকি ২০ মিনিট ধরে ভালোভাবে হাত ধোয়র কৌশল রপ্ত করারও ব্যাপক প্রচার চলে। রাস্তায় চলচলের সময় মাস্ক ব্যবহারের কথাও বলা হচ্ছে। এমন কি হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় কনুই দিয়ে হাত ঢেকে রাখতে বলা হয়। দেশে প্রথমত গণপরিবহন এবং পরে সব রকম যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। অবশেষে দেশব্যাপী লকডাইন ঘোষণার পর থেকে ঢাকা থেকে মানুষ ছুটে গেছেন মফস্বল শহরে বা গ্রামে। তবে গ্রামের রাস্তাঘাটেরও একই অবস্থা বলা চলছে। সবাই আজ গৃহবন্দি অর্থাৎ রয়েছেন সেলফ বা হোম কোয়ারেন্টিনে। যে যেখানেই থাকুন, করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। সাবান-পানি দিয়ে ২০ মিনিট ধরে হাত না ধুয়ে চোখ, নাক, মুখ স্পর্শ না করা। খোলা রাখা কিছু বড় দোকানের সামনে দেখলাম, এক মিটার দূরে দূরে বর্গাকৃতি বা গোলাকার দাগ কেটে রাখা হয়েছে। মানুষজন এ নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই ওষুধের মতো জরুরি জিনিষ কিনছেন। ব্যক্তিগত এমন সাবধানতাই করোনা সংক্রমণ থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারে। কেউ আক্রান্ত বলে মনে হলে উচিত হবে নিজেকে পরিবারের সদস্যদের কাছে থেকে আলাদা ঘরে থেকে রোগের উপসর্গ বুঝে নিজে কোনো ওষুধ না খেয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া। এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের হেল্পলাইন সব সময়ের জন্য খোলা রয়েছে। তবে এখান থেকে মানুষ যেন যথাযথ সেবা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। রোগ শনাক্তকরণের পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

দেশের কিছু হাসপাতালে ভাইরাস আক্রান্তদের জন্য কিছু বেড প্রস্তুত করা হলেও ঢাকার একমাত্র হাসপাতালে ২৯টি আইসিইউ বেড রয়েছে। চিকিৎসার জন্য ভেন্টিলেশনসহ জীবন রক্ষাকারী সব উপাদান সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে রাখতে হবে। গরিব রোগীদের জন্য বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও খাদ্য সংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ রবাদ্দ রাখতে হবে। ঢাকার বাইরের হাসপাতালে রোগীর স্বাস্থ্যসেবার পরিধি ও মান বাড়াতে হবে। চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয় থেকে হাসপাতালে দায়িত্বরত প্রতিটি কর্মীর জন্য নিরপত্তা পোশাক, মুখোশ, গ্লোভস দিতে হবে। তারা নিরাপদ না থাকলে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করবেন কে? সদ্য চীন থেকে আনা পিপিই কিটস এবং অন্যান্য চিকিৎসাসামগ্রী হাসপাতালগুলোতে যথাযথভাবে দ্রুত বন্টন করতে হবে। দেশের মানুষকে হোম কোয়ারেন্টিনের সময় ব্যক্তিগত সুরক্ষার পাশাপাশি সামাজিক দায়দায়িত্ব পালন চালিয়ে যেতে হবে। কেউ যেন ব্যক্তিগত দূরত্বকে সামাজিক দূরত্ব ভেবে ভুল না করে বসেন। সেলফ কোয়ারেন্টিন বা স্বেচ্ছা বিচ্ছিন্ন থাকা কোনোমতেই ‘সোশ্যাল আইসোলেশন’ বা সামাজিক ব্যবধান সৃষ্টি নয়। বাইরে না বেরিয়ে ল্যান্ডফোন অথবা সেলফোন কিম্বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের খোঁজখবর রাখতে হবে। কাছে না গিয়েও তাদের বিপদে-আপদে সৎ পরামর্শ দিয়ে বিশেষ উপকারে আসা যেতে পারে। কোয়ারেন্টিনের অবসর সময়টা বই পড়ে, টেলিভিশন দেখে কাটানো যেতে পারে। তা হলে একঘেয়েমিও কেটে যাবে। ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবই পড়ে স্কুল বন্ধের ঘাটতিটা পুষিয়ে নিতে হবে। স্কুল কলেজ খুলে গেলে পরীক্ষা শুরু হতে আর বেশি সময় লাগবে না। এখনকার সময়টা আলসেমিতে কাটালে পরে এর মাশুল পরীক্ষায় দিতে হবে। তাই কোনোমতেই বাইরে বেরোনো নয়। যা করতে হবে ঘরের মধ্যে বসে। অতি প্রয়োজনে একান্ত কাউকে বেরোতে হলে ব্যক্তিগত সুরক্ষার নিয়মাবলি মেনে কাজ সেরেই দ্রুত ঘরে ফিরে আসতে হবে। ঘরে ঢোকার আগেই হাত, সমস্ত মুখম-ল, পা ভালো করে সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এর আগে ঘরের দরজার হাতল বা অন্য কোনো আসবাবপত্রই ছোঁয়া যাবে না। সামনে আমাদের এক যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের মতো এক ভয়াল যুদ্ধ। যুদ্ধ-অজানা, অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে। এ শক্তি বড়ই প্রাণঘাতী। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো এতো মারণাস্ত্র তৈরি করে শত্রু দমনে পারঙ্গম, অথচ ক্ষুদ্র এক করোনাভাইরাসের কাছে সবাই আজ পরাস্ত। তাই একে মোকাবিলা করতে হবে নির্ভয়ে, সুকৌশলে। করোনাভাইরাসের জন্য কোনো আতঙ্ক নয়, চাই সতর্কতা আর সাবধানতা। সাহসের সঙ্গে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সবার সমন্বিত প্রয়াসই এই প্রাণঘাতী রোগ থেকে দিতে পারে মুক্তি। একজনের সতর্কতা বাঁচাতে পারে অন্যকে। রক্ষা করতে পারে দেশের কোটি মানুষের জীবন।

[লেখক : প্রকৌশলী, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক]