করোনাভাইরাসের নিজস্ব কোনো উচ্চাশা নেই

একেএম মাজহারুল ইসলাম

আমাদের জীবনকালে আমরা বিশ্বযুদ্ধ দেখিনি, বৈশ্বিক মহামারী যেমন বার্ডফ্লু, সার্স, মার্স, ইবোলা ইত্যাদি দেখেছি। কিন্তু এই কোভিড-১৯ সবকিছুকে ছাপিয়ে এমন এক পৃথিবীর সামনে আমাদের দাঁড় করিয়েছে যেই পৃথিবী আমাদের একেবারেই অচেনা। আমরা সবাই জানি যে চীনের উহান থেকে শুরু হয়ে এ ভাইরাসটি পৃথিবীর ১৯৯ দেশে আঘাত করেছে। বদলে দিয়েছে জীবনের সব হিসাব, সব চেনা সমীকরণ। আমাদের দেখিয়েছে কিভাবে ভেঙে পড়ছে বৃহৎ সব কাঠামো, যেই কাঠামোগুলোতে আমাদের চিরায়ত আস্থা; অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি। মানুষেরা এ পৃথিবীতে হয়েছে ইতিহাসের যে কোন সময়ের চেয়ে অসহায়। আমার জীবনে আমি এমন সময় আর কখনও দেখিনি। গত ১০ দিন ধরে আমি নিজের ঘরে নিজেকে বন্দী করে রেখেছি। কতদিন এভাবে থাকতে হবে শুধু ভাইরাসটিই বলতে পারবে, মানুষের পক্ষে বলা দুষ্কর।

মানব ইতিহাসের গোড়া থেকেই মহামারী ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে যে কোন মহামারীরই কিছু কারণ ও কিছু পূর্বাভাস থাকে। Frank Snowden তারবিখ্যা Z `Epidemics and Society : From the Black Death to the Present’ (2019) বইটিতে বলেছেন, `Epidemic diseases are not random events that afflict societies capriciously and without warning. Every society produces its own specific vulnerabilities. To study them is to understand that society’ structure, its standard of living, and its political priorities’ [সংক্রামক রোগ কোন দৈব ঘটনা নয় যা মানুষের সমাজকে কোনরকম পূর্বাভাস ছাড়াই খামখেয়ালি ভাবে পীড়িত করে। প্রত্যেক সমাজই তার নিজস্ব নির্দিষ্ট দুর্বলতা তৈরি করে। সেই সব বিষয় অধ্যয়ন করতে হলে সেই সমাজের কাঠামো, তার জীবনমান এবং তার রাজনৈতিক অগ্রাধিকারগুলো বুঝতে হবে]।

এখন এটা খুব একটা ভেবে দেখার সময় নয় কেন বা কার কারণে কিংবা কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে এই কোভিড-১৯ ভাইরাসটির সংক্রমণ শুরু হলো, বরং কিভাবে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেটাই এখন মূল এজেন্ডা। এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে মহামারী শুধু যে প্রাকৃতিক বিষয় তা নয়, এটা সংস্কৃতিকও।

কলেরা এক বিরাট সংক্রমণে পরিণত হয়েছিল যখন মানুষেরা নগরে বসতি স্থাপন শুরু করেছিল কিন্তু তাদের পয়োব্যবস্থা একটি মান পর্যায়ে উন্নত করার আগ পর্যন্ত তা কমছিল না। কলেরাই আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে আমাদের নিজেদের মল-মূত্র ব্যবস্থাপনা করতে হবে।

করোনাভাইরাস কোন ধর্ম কি বলছে, কোন দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি, কাকে পুনর্বার নির্বাচিত হতে হবে ইত্যাদি পরোয়া করে না। সেই অর্থে ভাইরাসের আছে এক নৈতিকভাবে নিরপেক্ষ সত্তা যার কোন লিবারেল- কনজারভেটিভ, হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ, আওয়ামী লীগ-বিএনপির পক্ষপাতিত্ব নেই। ভাইরাসের নিজস্ব কোন উচ্চাশা নেই। নেই তার কোন নিজস্ব লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, প্রয়োজন কিংবা বাসনা। কারণ ভাইরাসের নিজস্ব কোন মস্তিষ্ক নেই। এটাই এক নিদারুণ বিপন্নতা আর অসহায়ত্ব যে মানুষ প্রাণীজগতে তার সবচেয়ে বড় আর ক্ষমতাবান মস্তিষ্ক নিয়েও একটি মস্তিষ্কহীন অনুজীবের সঙ্গে পেরে উঠছে না।

নব্য উদার অর্থনীতি ও বিশ্বব্যবস্থা পরার্থপরতাকে এক দুরারোগ্য ব্যাধি আখ্যায়িত করে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাকেই সব রোগের উপশম বানিয়ে বিশ্বকে এক নাজুক বিভীষিকায় পরিণত করেছে। যখন মহামারীর মতো বিপদগুলো আসে, তখন আমরা জানি আমাদের পরস্পরের ওপর আস্থা আর ভালোবাসাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে এবং যে কোন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের সহায়তা করে।

আমরা জানি, যে বহু ব্যক্তি আর পরিবার এই করোনা উদ্ভূত লকডাউন এফোর্ড করতে পারছে না। তাদের জীবন আর জীবিকার জন্য ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে। অনেকেই বলছে যে আমি করোনায় মরার আগে ক্ষুধায় মরে যাব। রাষ্ট্র তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। এমনকি এই বিপদের দিনে একটা হ্যান্ড স্যানিটাইজারও দিতে পারছে না। বিত্তবানরা টাকা দিয়ে এতদিন সব কিছু কিনেছে। টাকা দিয়ে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি কিনতে পারছে না। আমাদের একমাত্র অবলম্বন এখন সচেতনতা আর মানুষ হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষমতাটিকে সামনে নিয়ে আসা। সেই অসম্ভব ক্ষমতাটির নাম হলো ‘মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা’। সেই ভালোবাসা থেকেই ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন’ মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা স্যানিটাইজার বানিয়ে গরিব মানুষদের বিতরণ করে। যেই ভালোবাসার শক্তিতেই স্বাস্থ্য কর্মীরা, চিকিৎসকরা জীবন বিপন্ন করে অসহায় আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান। সেই ভালোবাসার পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়েই আজ আমাদের করোনাকে জয় করতে হবে।

কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু যেই ভ্যাকসিন মানবের সভ্যতাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী বাঁচিয়ে রেখেছে, তার নাম ‘ভালোবাসা’। এ ‘ভালোবাসা’র শক্তিই বিপদের দিনে আমাদের শৃঙ্খলা দেবে, করোনার করাল গ্রাস থেকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে।

[লেখক : এডজাঙ্কট প্রফেসর, ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব এপ্লাইড এন্ত্রোপলজি ]

আরও খবর
করোনার কাল

শুক্রবার, ০৩ এপ্রিল ২০২০ , ২০ চৈত্র ১৪২৬, ৮ শাবান ১৪৪১

করোনাভাইরাসের নিজস্ব কোনো উচ্চাশা নেই

একেএম মাজহারুল ইসলাম

আমাদের জীবনকালে আমরা বিশ্বযুদ্ধ দেখিনি, বৈশ্বিক মহামারী যেমন বার্ডফ্লু, সার্স, মার্স, ইবোলা ইত্যাদি দেখেছি। কিন্তু এই কোভিড-১৯ সবকিছুকে ছাপিয়ে এমন এক পৃথিবীর সামনে আমাদের দাঁড় করিয়েছে যেই পৃথিবী আমাদের একেবারেই অচেনা। আমরা সবাই জানি যে চীনের উহান থেকে শুরু হয়ে এ ভাইরাসটি পৃথিবীর ১৯৯ দেশে আঘাত করেছে। বদলে দিয়েছে জীবনের সব হিসাব, সব চেনা সমীকরণ। আমাদের দেখিয়েছে কিভাবে ভেঙে পড়ছে বৃহৎ সব কাঠামো, যেই কাঠামোগুলোতে আমাদের চিরায়ত আস্থা; অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি। মানুষেরা এ পৃথিবীতে হয়েছে ইতিহাসের যে কোন সময়ের চেয়ে অসহায়। আমার জীবনে আমি এমন সময় আর কখনও দেখিনি। গত ১০ দিন ধরে আমি নিজের ঘরে নিজেকে বন্দী করে রেখেছি। কতদিন এভাবে থাকতে হবে শুধু ভাইরাসটিই বলতে পারবে, মানুষের পক্ষে বলা দুষ্কর।

মানব ইতিহাসের গোড়া থেকেই মহামারী ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে যে কোন মহামারীরই কিছু কারণ ও কিছু পূর্বাভাস থাকে। Frank Snowden তারবিখ্যা Z `Epidemics and Society : From the Black Death to the Present’ (2019) বইটিতে বলেছেন, `Epidemic diseases are not random events that afflict societies capriciously and without warning. Every society produces its own specific vulnerabilities. To study them is to understand that society’ structure, its standard of living, and its political priorities’ [সংক্রামক রোগ কোন দৈব ঘটনা নয় যা মানুষের সমাজকে কোনরকম পূর্বাভাস ছাড়াই খামখেয়ালি ভাবে পীড়িত করে। প্রত্যেক সমাজই তার নিজস্ব নির্দিষ্ট দুর্বলতা তৈরি করে। সেই সব বিষয় অধ্যয়ন করতে হলে সেই সমাজের কাঠামো, তার জীবনমান এবং তার রাজনৈতিক অগ্রাধিকারগুলো বুঝতে হবে]।

এখন এটা খুব একটা ভেবে দেখার সময় নয় কেন বা কার কারণে কিংবা কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে এই কোভিড-১৯ ভাইরাসটির সংক্রমণ শুরু হলো, বরং কিভাবে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেটাই এখন মূল এজেন্ডা। এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে মহামারী শুধু যে প্রাকৃতিক বিষয় তা নয়, এটা সংস্কৃতিকও।

কলেরা এক বিরাট সংক্রমণে পরিণত হয়েছিল যখন মানুষেরা নগরে বসতি স্থাপন শুরু করেছিল কিন্তু তাদের পয়োব্যবস্থা একটি মান পর্যায়ে উন্নত করার আগ পর্যন্ত তা কমছিল না। কলেরাই আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে আমাদের নিজেদের মল-মূত্র ব্যবস্থাপনা করতে হবে।

করোনাভাইরাস কোন ধর্ম কি বলছে, কোন দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি, কাকে পুনর্বার নির্বাচিত হতে হবে ইত্যাদি পরোয়া করে না। সেই অর্থে ভাইরাসের আছে এক নৈতিকভাবে নিরপেক্ষ সত্তা যার কোন লিবারেল- কনজারভেটিভ, হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ, আওয়ামী লীগ-বিএনপির পক্ষপাতিত্ব নেই। ভাইরাসের নিজস্ব কোন উচ্চাশা নেই। নেই তার কোন নিজস্ব লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, প্রয়োজন কিংবা বাসনা। কারণ ভাইরাসের নিজস্ব কোন মস্তিষ্ক নেই। এটাই এক নিদারুণ বিপন্নতা আর অসহায়ত্ব যে মানুষ প্রাণীজগতে তার সবচেয়ে বড় আর ক্ষমতাবান মস্তিষ্ক নিয়েও একটি মস্তিষ্কহীন অনুজীবের সঙ্গে পেরে উঠছে না।

নব্য উদার অর্থনীতি ও বিশ্বব্যবস্থা পরার্থপরতাকে এক দুরারোগ্য ব্যাধি আখ্যায়িত করে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাকেই সব রোগের উপশম বানিয়ে বিশ্বকে এক নাজুক বিভীষিকায় পরিণত করেছে। যখন মহামারীর মতো বিপদগুলো আসে, তখন আমরা জানি আমাদের পরস্পরের ওপর আস্থা আর ভালোবাসাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে এবং যে কোন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের সহায়তা করে।

আমরা জানি, যে বহু ব্যক্তি আর পরিবার এই করোনা উদ্ভূত লকডাউন এফোর্ড করতে পারছে না। তাদের জীবন আর জীবিকার জন্য ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে। অনেকেই বলছে যে আমি করোনায় মরার আগে ক্ষুধায় মরে যাব। রাষ্ট্র তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। এমনকি এই বিপদের দিনে একটা হ্যান্ড স্যানিটাইজারও দিতে পারছে না। বিত্তবানরা টাকা দিয়ে এতদিন সব কিছু কিনেছে। টাকা দিয়ে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি কিনতে পারছে না। আমাদের একমাত্র অবলম্বন এখন সচেতনতা আর মানুষ হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষমতাটিকে সামনে নিয়ে আসা। সেই অসম্ভব ক্ষমতাটির নাম হলো ‘মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা’। সেই ভালোবাসা থেকেই ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন’ মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা স্যানিটাইজার বানিয়ে গরিব মানুষদের বিতরণ করে। যেই ভালোবাসার শক্তিতেই স্বাস্থ্য কর্মীরা, চিকিৎসকরা জীবন বিপন্ন করে অসহায় আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান। সেই ভালোবাসার পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়েই আজ আমাদের করোনাকে জয় করতে হবে।

কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু যেই ভ্যাকসিন মানবের সভ্যতাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী বাঁচিয়ে রেখেছে, তার নাম ‘ভালোবাসা’। এ ‘ভালোবাসা’র শক্তিই বিপদের দিনে আমাদের শৃঙ্খলা দেবে, করোনার করাল গ্রাস থেকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে।

[লেখক : এডজাঙ্কট প্রফেসর, ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব এপ্লাইড এন্ত্রোপলজি ]