করোনার প্রভাবে বিপর্যস্ত কৃষি

নিতাই চন্দ্র রায়

বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, মহামারীসহ যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, লাগতার হরতাল এবং ধর্মঘটের সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এদেশের কৃষি ও কৃষক। কারণ, তারা শাকসবজি ও ফলমূলের মতো পচনশীল পণ্য উৎপাদন করেন। এসব পণ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য তাদের নিজস্ব কোন ব্যবস্থা নেই। আলু ছাড়া আপদকালীন সময়ে কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য দেশে নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক হিমাহার। প্রকৃতির নিয়মেই এসব পচনশীল শাকসবজি, ফলমূল বড় হয়। পরিপক্বতা লাভ করে। সময়মতো সংগ্রহ না করলে পচে নষ্ট হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। এ ক্ষেত্রে কৃষক বড় অসহায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে কৃষকে বাঁচানোর জন্য উন্নত দেশগুলোতে শস্য বীমার প্রচলন থাকলেও বাংলাদেশে তা নেই। করোনার কারণে কৃষিপণ্যের দর পতনে কৃষক, পোলট্রি খামারি, মৎস্য চাষি এবং দুগ্ধখামারিরা পড়েছেন মহা বিপদে।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস পরিস্থিতির প্রভাবে কুড়িগ্রামে কমে গেছে একেবারে সবজির দাম। ক্রেতা সংকটে পানির দামে বিক্রি হচ্ছে সবজি। এখন প্রতিটি লাউ ৫ টাকা আর বেগুন ২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন কৃষক। এতে লাভ তো দূরের কথা উৎপাদন খরচই উঠছে না। কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে ২০০ টাকা মণের শসা এখন ৮০ টাকা, ৪০০ টাকা মণ দরের বেগুন এখন ৮০ টাকা এবং ২০ টাকা দামের লাউ প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকা দামে। তারপরও ক্রেতা মিলছে না। শিবনাম গ্রামের একজন কৃষক বলেন, বর্তমানে প্রতি মণ মিষ্টি কুমড়া বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা, যা কয়েক দিন আগেও বিক্রি হয়েছে ৫০০ টাকা মণে। এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হতো ১৫ টাকা, এখন সেটা বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা কেজি দরে। ট্রাকের অভাবে আলু ঢাকাসহ অন্যান্য স্থানে পাঠানো যাচ্ছে না।

করোনা-আতঙ্কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার তরমুজ চাষিরা। রাঙাবালী উপজেলায় এ বছর ৮ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে। ৮ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষে কৃষকের খরচ হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত উৎপাদিত তরমুজের মাত্র ৫ % বিক্রি হয়েছে। বাকি ৯৫% তরমুজ ক্ষেতে রয়েছে। কিছু চাষি আংশিক জমির তরমুজ আগাম বিক্রি করেছেন। কেউ কেউ আবার বিক্রি শুরুই করতে পারেননি। সবেমাত্র ফসল কাটার উপযোগী হয়েছে। এখনই বাজারজাত করার সময়। লঞ্চ ও ট্রাক চলাচল না করায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তরমুজ পাঠানো যাচ্ছে না। করোনার কারণে স্থানীয় বাজারগুলোতেও তরমুজের চাহিদা নেই। ফলে ক্ষেতেই পচে নষ্ট হচ্ছে হাজার চাষির স্বপ্ন, পাকা তরমুজ। যদি এক মাসের অধিক এ এঅবস্থা অব্যাহত থাকে তাহলে শতকরা ৮০ ভাগ তরমুজই নষ্ট হয়ে যাবে এবং তরমুজ চাষিদের ক্ষতি হবে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা।

শুধু কুড়িগ্রাম ও পটুয়াখালীতেই নয়, সারা দেশের মতো চট্টগ্রামের কৃষকেরা পানির দামে শাকসবজি বিক্রি করে চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন। চট্টগ্রামে কাঁচা পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার রেয়াজউদ্দিন বাজার। সবজির জন্য বিখ্যাত উপজেলা সীতাকু-, শঙ্খ নদ-তীরবর্তী এলাকা সাতকানিয়া, চন্দনাইশসহ বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে সবজি আসে এ বাজারে। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির কারণে ক্রেতা নেই বাজারে। ফলে পচনশীল সবজি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ কৃষকসহ এ খাতে জড়িত পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবজির বড় পাইকারি বাজার দোহাজারির রেলস্টেশন এলাকা। এ বাজারে সাতকানিয়া ও চন্দনাইশের বিভিন্ন চরের কৃষকেরা নৌকা করে সবজি নিয়ে ভোরে হাজির হন। নগরীর বড় পাইকাররা সেখান থেকে সবজি কিনে রেয়াজ উদ্দিন বাজার কিংবা আছদগঞ্জের আড়তগুলোতে নিয়ে যান। এরপর বিভিন্ন হাত বদল হয়ে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে ভোক্তার কাছে পৌঁছে এসব সবজি। কিন্তু করোনার প্রভাবে ভেঙে পড়েছেন কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পরিবহন চেইন। সবজি কিংবা খাদ্যপণ্য বেচাকেনা ও পরিবহনে সরকারি নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও লোকসানের ভয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীরা মোকামের হাটগুলোতে না আসায় দাম পচ্ছেন না কৃষক। জানা গেছে, চরাঞ্চলের সবজির বড় পাইকারি বাজার চন্দনাইশের দোহাজারী, খোদার হাট, আনোয়ারার সরকার হাট, বাঁশখালীর টাইম বাজারে অন্যান্য দিনের মতো গত কয়েক দিনে সবজি নিয়ে আসেন কৃষক। কিন্তু কোন পাইকারি ব্যবসায়ী নগরী থেকে ওইসব বাজারে না যাওয়ায় অতি অল্প দামে বিক্রি হয়েছে হাটে আসা শাকসবজি। করোনার প্রভাবের আগ পর্যন্ত চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাটবাজারে প্রতিটি সবজি ১৫-২০ টাকা কেজির নিচে বিক্রি হয়নি। বর্তমানে চট্টগ্রামের বিভিন্ন মোকামে প্রতি কেজি বেগুন ৫-৭ টাকা, কাঁচামরিচ ৮-১০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৮ টাকা, মূলা ২-৫ টাকা, লাউ প্রতিটি ৫-৭ টাকা, বাঁধাকপি প্রতিটি ২-৪ টাকা এবং প্রতি কেজি আলু ১০ থেকে ১৫ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। একই অবস্থা নগরীর আছাদগঞ্জের পাইকারি বাজারেও। নৌকায় বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে সবজি এসে এই বাজারের সব আড়ত ভরে গেছে। কিন্তু নগরীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারে ব্যবসায়ী কিংবা ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতারা বাজারে আসছেন না। এতে টমেটো, বাঁধাকপি, বেগুনসহ সব সবজি নষ্ট হতে শুরু করেছে।

করোনায় ভয়াবহ সংকটে পড়েছে দেশের পোলট্রি খাত। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে ব্রয়লারের ছোট বাচ্ছা উৎপাদকারী ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতিদিন ২ লাখ মুরগির বাচ্চা মেরে ফেলছে হ্যাচারি প্রতিষ্ঠানগুলো। গাজীপুর জেলার টঙ্গী কদাবো এলাকার এক পোলট্রি খামারি ১০ লাখ টাকা লোকসান দিয়ে কয়েক দিন আগে ডিম পাড়া আড়াই হাজার মুরগি বিক্রি করে দেন। ডিমের দাম ক্রমান্বয়ে কমতে থাকায় এবং খাবারের দাম বাড়তে থাকায় তিনি লোকসান দিয়ে ডিমপাড়া মুরগিগুলো বিক্রি করতে বাধ্য হন। করোনার আগে যে ডিম প্রতিটি বিক্রি হয়েছে ৭.০ টাকা দামে, এখন সেই ডিম খামার থেকে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৫.০০ থেকে ৫.৫০ টাকায়। ডিমের দাম কমলেও কিন্তু খাদ্যে এবং ওষুধের দাম কমেনি। কোন কোন ক্ষেত্রে বেড়েছে। মানুষের আয়-উপার্জন না থাকা, গণপরিবহন বন্ধ থাকাসহ বিভিন্ন কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে গুজব ছড়ানো হয়েছে যে, পোলট্রি বা ব্রয়লার মুরগি খেলে করোনাভাইরাস ছড়ায়- এ অপপ্রচারের কারণে দেশের অনেক জায়গায় ব্রয়লার মুরগির ভোক্তা কমে গেছে। মুরগির মাংস খাওয়া নিয়ে অযথা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে মানুষের মনে।

করোনার প্রভাবে সারা দেশের দুগ্ধ খামারে নেমে এসেছে বিপর্যয়। বড় খামারিরা বিকল্প ব্যবস্থায় সামান্য হলেও দুধ প্রক্রিয়াজাত করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিচ্ছেন। কিন্তু প্রান্তিক খামারিরা করোনার ধাক্কায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে কেউ কেউ গাভী বিক্রি করে দিচ্ছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দিনে অন্তত ৯০ কোটি টাকার দুধ অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ)। বিডিএফএ আশঙ্কা করছে, চলমান অবস্থা এক মাস অব্যাহত থাকলে দুগ্ধ খাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে আড়াই হাজার কোটি টাকা। অন্য সময় দেশের বিখ্যাত দুধ উৎপাদকারী এলাকা, সিরাজগঞ্জে প্রতি লিটার দুধ ৪০ থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হলেও বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা লিটার দামে। এতে গাভীর খাবারে টাকাই তোলা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন ৯৯ লাখ টন, দুধ উৎপাদিত হচ্ছে। উৎপাদিত দুধের শতকরা ৫ ভাগ কিনে দেশের বিভিন্ন দুগ্ধ প্রক্রিয়াকারী পতিষ্ঠান। বাকি ৯৫ ভাগের ক্রেতা হলো গ্রামগঞ্জের মিষ্টি ও চায়ের দোকান এবং সাধারণ মানুষ। দেশে খামারের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। এর ওপর সোয়া কোটি লোকের জীবন-জীবিকা জড়িত।

নভেল করোনাভাইরাসের কারণে দাম কম, শ্রমিক ও পরিবহন সংকটের কারণে চাঁচড়া মৎস্য পল্লীর হ্যাচারিগুলোতে রেণু উৎপাদনে দেখা দিয়েছে চরম বিপর্যয়। বন্ধ হয়েছে বেচাকেনা। এরই প্রেক্ষিতে গত ২৮ মার্চ থেকে এক যোগে বন্ধ হয়ে গেছে ৩৪টি মৎস্য রেণু খামার। এসব হ্যাচারি বন্ধ থাকলে প্রতি সপ্তাহে ১০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ রেণু যশোর থেকে সরবরাহ করা হয়। মাছ চাষের এ ভরা মৌসুমে হ্যাচারিগুলি বন্ধ থাকলে দেশের সামগ্রিক মাছ উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ।

বাংলাদেশ শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণই নয়, এদেশ থেকে উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। কৃষি উন্নয়নের এ ধারাকে অব্যাহত রাখতে অন্যান্য খাতের মতো করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি খাতকে সরকারিভাবে সার্বিক সহযোগিতা করতে হবে। ৬ মাসের জন্য কৃষির সব খাতে ঋণের সুদ মওকুফ করতে হবে। ঘোষণা করতে হবে বিভিন্ন কৃষিবান্ধব প্যাকেজ। কৃষি উৎপাদন সামগ্রী যেমন সার, বীজ, কীটনাশক এবং মাছ, হাঁস-মুরগি, গবাদি পশুর খাবার ও ওষুধ সরবাহ নিবিঘœ করতে হবে। পোলট্রি মুরগি খেলে করোনা ছড়ায়- এই গুজব মোকাবিলায় পত্র-পত্রিকা ও টেভিশনে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করতে হবে। প্রান্তিক দুগ্ধ খামারিদের গোখাদ্য সহায়তা প্রদান করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সঠিক তালিকা তৈরি করে তাদের আর্থিক সহায়তা করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পোলট্রি খামারিদের জন্য অনুরূপ প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে। মনে রাখতে হবে কৃষিতে ভর্তুকি, কৃষিতে প্রণোদণা কোন সাহায্য নয়- এটা এক ধরনের বিনিয়োগ, যা দেশের কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও বফতানি বাণিজ্যকে ত্বরান্বিত করে।

[লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাক (কৃষি), নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লি.]

netairoy18@yahoo.com

রবিবার, ০৫ এপ্রিল ২০২০ , ২২ চৈত্র ১৪২৬, ১০ শাবান ১৪৪১

করোনার প্রভাবে বিপর্যস্ত কৃষি

নিতাই চন্দ্র রায়

বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, মহামারীসহ যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, লাগতার হরতাল এবং ধর্মঘটের সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এদেশের কৃষি ও কৃষক। কারণ, তারা শাকসবজি ও ফলমূলের মতো পচনশীল পণ্য উৎপাদন করেন। এসব পণ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য তাদের নিজস্ব কোন ব্যবস্থা নেই। আলু ছাড়া আপদকালীন সময়ে কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য দেশে নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক হিমাহার। প্রকৃতির নিয়মেই এসব পচনশীল শাকসবজি, ফলমূল বড় হয়। পরিপক্বতা লাভ করে। সময়মতো সংগ্রহ না করলে পচে নষ্ট হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। এ ক্ষেত্রে কৃষক বড় অসহায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে কৃষকে বাঁচানোর জন্য উন্নত দেশগুলোতে শস্য বীমার প্রচলন থাকলেও বাংলাদেশে তা নেই। করোনার কারণে কৃষিপণ্যের দর পতনে কৃষক, পোলট্রি খামারি, মৎস্য চাষি এবং দুগ্ধখামারিরা পড়েছেন মহা বিপদে।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস পরিস্থিতির প্রভাবে কুড়িগ্রামে কমে গেছে একেবারে সবজির দাম। ক্রেতা সংকটে পানির দামে বিক্রি হচ্ছে সবজি। এখন প্রতিটি লাউ ৫ টাকা আর বেগুন ২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন কৃষক। এতে লাভ তো দূরের কথা উৎপাদন খরচই উঠছে না। কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে ২০০ টাকা মণের শসা এখন ৮০ টাকা, ৪০০ টাকা মণ দরের বেগুন এখন ৮০ টাকা এবং ২০ টাকা দামের লাউ প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকা দামে। তারপরও ক্রেতা মিলছে না। শিবনাম গ্রামের একজন কৃষক বলেন, বর্তমানে প্রতি মণ মিষ্টি কুমড়া বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা, যা কয়েক দিন আগেও বিক্রি হয়েছে ৫০০ টাকা মণে। এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হতো ১৫ টাকা, এখন সেটা বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা কেজি দরে। ট্রাকের অভাবে আলু ঢাকাসহ অন্যান্য স্থানে পাঠানো যাচ্ছে না।

করোনা-আতঙ্কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার তরমুজ চাষিরা। রাঙাবালী উপজেলায় এ বছর ৮ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে। ৮ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষে কৃষকের খরচ হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত উৎপাদিত তরমুজের মাত্র ৫ % বিক্রি হয়েছে। বাকি ৯৫% তরমুজ ক্ষেতে রয়েছে। কিছু চাষি আংশিক জমির তরমুজ আগাম বিক্রি করেছেন। কেউ কেউ আবার বিক্রি শুরুই করতে পারেননি। সবেমাত্র ফসল কাটার উপযোগী হয়েছে। এখনই বাজারজাত করার সময়। লঞ্চ ও ট্রাক চলাচল না করায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তরমুজ পাঠানো যাচ্ছে না। করোনার কারণে স্থানীয় বাজারগুলোতেও তরমুজের চাহিদা নেই। ফলে ক্ষেতেই পচে নষ্ট হচ্ছে হাজার চাষির স্বপ্ন, পাকা তরমুজ। যদি এক মাসের অধিক এ এঅবস্থা অব্যাহত থাকে তাহলে শতকরা ৮০ ভাগ তরমুজই নষ্ট হয়ে যাবে এবং তরমুজ চাষিদের ক্ষতি হবে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা।

শুধু কুড়িগ্রাম ও পটুয়াখালীতেই নয়, সারা দেশের মতো চট্টগ্রামের কৃষকেরা পানির দামে শাকসবজি বিক্রি করে চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন। চট্টগ্রামে কাঁচা পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার রেয়াজউদ্দিন বাজার। সবজির জন্য বিখ্যাত উপজেলা সীতাকু-, শঙ্খ নদ-তীরবর্তী এলাকা সাতকানিয়া, চন্দনাইশসহ বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে সবজি আসে এ বাজারে। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির কারণে ক্রেতা নেই বাজারে। ফলে পচনশীল সবজি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ কৃষকসহ এ খাতে জড়িত পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবজির বড় পাইকারি বাজার দোহাজারির রেলস্টেশন এলাকা। এ বাজারে সাতকানিয়া ও চন্দনাইশের বিভিন্ন চরের কৃষকেরা নৌকা করে সবজি নিয়ে ভোরে হাজির হন। নগরীর বড় পাইকাররা সেখান থেকে সবজি কিনে রেয়াজ উদ্দিন বাজার কিংবা আছদগঞ্জের আড়তগুলোতে নিয়ে যান। এরপর বিভিন্ন হাত বদল হয়ে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে ভোক্তার কাছে পৌঁছে এসব সবজি। কিন্তু করোনার প্রভাবে ভেঙে পড়েছেন কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পরিবহন চেইন। সবজি কিংবা খাদ্যপণ্য বেচাকেনা ও পরিবহনে সরকারি নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও লোকসানের ভয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীরা মোকামের হাটগুলোতে না আসায় দাম পচ্ছেন না কৃষক। জানা গেছে, চরাঞ্চলের সবজির বড় পাইকারি বাজার চন্দনাইশের দোহাজারী, খোদার হাট, আনোয়ারার সরকার হাট, বাঁশখালীর টাইম বাজারে অন্যান্য দিনের মতো গত কয়েক দিনে সবজি নিয়ে আসেন কৃষক। কিন্তু কোন পাইকারি ব্যবসায়ী নগরী থেকে ওইসব বাজারে না যাওয়ায় অতি অল্প দামে বিক্রি হয়েছে হাটে আসা শাকসবজি। করোনার প্রভাবের আগ পর্যন্ত চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাটবাজারে প্রতিটি সবজি ১৫-২০ টাকা কেজির নিচে বিক্রি হয়নি। বর্তমানে চট্টগ্রামের বিভিন্ন মোকামে প্রতি কেজি বেগুন ৫-৭ টাকা, কাঁচামরিচ ৮-১০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৮ টাকা, মূলা ২-৫ টাকা, লাউ প্রতিটি ৫-৭ টাকা, বাঁধাকপি প্রতিটি ২-৪ টাকা এবং প্রতি কেজি আলু ১০ থেকে ১৫ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। একই অবস্থা নগরীর আছাদগঞ্জের পাইকারি বাজারেও। নৌকায় বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে সবজি এসে এই বাজারের সব আড়ত ভরে গেছে। কিন্তু নগরীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারে ব্যবসায়ী কিংবা ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতারা বাজারে আসছেন না। এতে টমেটো, বাঁধাকপি, বেগুনসহ সব সবজি নষ্ট হতে শুরু করেছে।

করোনায় ভয়াবহ সংকটে পড়েছে দেশের পোলট্রি খাত। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে ব্রয়লারের ছোট বাচ্ছা উৎপাদকারী ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতিদিন ২ লাখ মুরগির বাচ্চা মেরে ফেলছে হ্যাচারি প্রতিষ্ঠানগুলো। গাজীপুর জেলার টঙ্গী কদাবো এলাকার এক পোলট্রি খামারি ১০ লাখ টাকা লোকসান দিয়ে কয়েক দিন আগে ডিম পাড়া আড়াই হাজার মুরগি বিক্রি করে দেন। ডিমের দাম ক্রমান্বয়ে কমতে থাকায় এবং খাবারের দাম বাড়তে থাকায় তিনি লোকসান দিয়ে ডিমপাড়া মুরগিগুলো বিক্রি করতে বাধ্য হন। করোনার আগে যে ডিম প্রতিটি বিক্রি হয়েছে ৭.০ টাকা দামে, এখন সেই ডিম খামার থেকে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৫.০০ থেকে ৫.৫০ টাকায়। ডিমের দাম কমলেও কিন্তু খাদ্যে এবং ওষুধের দাম কমেনি। কোন কোন ক্ষেত্রে বেড়েছে। মানুষের আয়-উপার্জন না থাকা, গণপরিবহন বন্ধ থাকাসহ বিভিন্ন কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে গুজব ছড়ানো হয়েছে যে, পোলট্রি বা ব্রয়লার মুরগি খেলে করোনাভাইরাস ছড়ায়- এ অপপ্রচারের কারণে দেশের অনেক জায়গায় ব্রয়লার মুরগির ভোক্তা কমে গেছে। মুরগির মাংস খাওয়া নিয়ে অযথা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে মানুষের মনে।

করোনার প্রভাবে সারা দেশের দুগ্ধ খামারে নেমে এসেছে বিপর্যয়। বড় খামারিরা বিকল্প ব্যবস্থায় সামান্য হলেও দুধ প্রক্রিয়াজাত করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিচ্ছেন। কিন্তু প্রান্তিক খামারিরা করোনার ধাক্কায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে কেউ কেউ গাভী বিক্রি করে দিচ্ছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দিনে অন্তত ৯০ কোটি টাকার দুধ অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ)। বিডিএফএ আশঙ্কা করছে, চলমান অবস্থা এক মাস অব্যাহত থাকলে দুগ্ধ খাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে আড়াই হাজার কোটি টাকা। অন্য সময় দেশের বিখ্যাত দুধ উৎপাদকারী এলাকা, সিরাজগঞ্জে প্রতি লিটার দুধ ৪০ থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হলেও বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা লিটার দামে। এতে গাভীর খাবারে টাকাই তোলা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন ৯৯ লাখ টন, দুধ উৎপাদিত হচ্ছে। উৎপাদিত দুধের শতকরা ৫ ভাগ কিনে দেশের বিভিন্ন দুগ্ধ প্রক্রিয়াকারী পতিষ্ঠান। বাকি ৯৫ ভাগের ক্রেতা হলো গ্রামগঞ্জের মিষ্টি ও চায়ের দোকান এবং সাধারণ মানুষ। দেশে খামারের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। এর ওপর সোয়া কোটি লোকের জীবন-জীবিকা জড়িত।

নভেল করোনাভাইরাসের কারণে দাম কম, শ্রমিক ও পরিবহন সংকটের কারণে চাঁচড়া মৎস্য পল্লীর হ্যাচারিগুলোতে রেণু উৎপাদনে দেখা দিয়েছে চরম বিপর্যয়। বন্ধ হয়েছে বেচাকেনা। এরই প্রেক্ষিতে গত ২৮ মার্চ থেকে এক যোগে বন্ধ হয়ে গেছে ৩৪টি মৎস্য রেণু খামার। এসব হ্যাচারি বন্ধ থাকলে প্রতি সপ্তাহে ১০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ রেণু যশোর থেকে সরবরাহ করা হয়। মাছ চাষের এ ভরা মৌসুমে হ্যাচারিগুলি বন্ধ থাকলে দেশের সামগ্রিক মাছ উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ।

বাংলাদেশ শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণই নয়, এদেশ থেকে উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। কৃষি উন্নয়নের এ ধারাকে অব্যাহত রাখতে অন্যান্য খাতের মতো করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি খাতকে সরকারিভাবে সার্বিক সহযোগিতা করতে হবে। ৬ মাসের জন্য কৃষির সব খাতে ঋণের সুদ মওকুফ করতে হবে। ঘোষণা করতে হবে বিভিন্ন কৃষিবান্ধব প্যাকেজ। কৃষি উৎপাদন সামগ্রী যেমন সার, বীজ, কীটনাশক এবং মাছ, হাঁস-মুরগি, গবাদি পশুর খাবার ও ওষুধ সরবাহ নিবিঘœ করতে হবে। পোলট্রি মুরগি খেলে করোনা ছড়ায়- এই গুজব মোকাবিলায় পত্র-পত্রিকা ও টেভিশনে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করতে হবে। প্রান্তিক দুগ্ধ খামারিদের গোখাদ্য সহায়তা প্রদান করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সঠিক তালিকা তৈরি করে তাদের আর্থিক সহায়তা করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পোলট্রি খামারিদের জন্য অনুরূপ প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে। মনে রাখতে হবে কৃষিতে ভর্তুকি, কৃষিতে প্রণোদণা কোন সাহায্য নয়- এটা এক ধরনের বিনিয়োগ, যা দেশের কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও বফতানি বাণিজ্যকে ত্বরান্বিত করে।

[লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাক (কৃষি), নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লি.]

netairoy18@yahoo.com