করোনা মহামারী : প্রত্যাশিত সামাজিক ও করপোরেট আচরণ

অধ্যাপক ড. জহুরুল আলম

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা এত দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে যে তা প্রতি মুহূর্তেই পরিবর্তিত আকার ধারণ করছে। এ মুহূর্তের প্রায় দশ লাখ বিশ হাজার আক্রান্তের ও প্রায় ৫৪ হাজার মৃত্যুর পরিসংখ্যানটির চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই যে পৃথিবীর ২০৪টি দেশে এই রোগ মহামারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ২১২৮ জন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ও ১১০ জনের মৃত্যু হচ্ছে। অর্থাৎ আক্রান্ত মোট রোগীর শতকরা ৫.২ ভাগেরও বেশি মৃত্যু বরণ করছে, আর সুস্থ ও মৃতের অনুপাতিক সম্পর্ক হচ্ছে ৮০:২০, যা অতি উচ্চ। উল্লেখযোগ্য যে নভেম্বরের শুরুতে চীনের হুবেই প্রদেশে এই মহামারীতে মৃত্যুর হার ছিল শতকরা ২ ভাগ, যা মার্চের ৩ তারিখে বেড়ে দাঁড়ায় ৩ ভাগে, আর বর্তমানে শতকরা ৫.২৪ ভাগ। বর্তমানে নতুন নতুন দেশে মহামারীটি ছড়িয়ে পড়ছে। আর যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের অনেক দেশে আক্রান্তের হার হঠাৎ করেই অতি দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে মোট আক্রান্তের শতকরা ১১ ভাগ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, যা এ রোগে বিশ্বের গড় মৃত্যু হারের চেয়ে দ্বিগুণেরও অধিক। সে দিক দিয়ে বাংলাদেশকে প্রচ্ছন্ন বিপজ্জনক দেশের কাতারে ফেলা সম্ভব। কিন্তু মোট আক্রান্তের সংখ্যা বিচারে তা এখনও প্রমাণিত সত্য হিসেবে উপস্থাপিত করা যায় না। বাংলাদেশে আপতদৃষ্টে অদ্যাবধি করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় নগণ্য, মোট ৫৬ জন। এর কিছু যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে, যার মধ্যে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সময়োপযোগী ও ধারাবাহিক ভূমিকা ও সেই সঙ্গে সচেতন নাগরিক সমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে এর ব্যত্যয়ও আছে। বিশেষত নীতি বাস্তবায়ন পর্যায়ে আমলাতান্ত্রিক ও দুর্নীতিপরায়ণতা বা কার্যসম্পাদনে অবহেলা প্রাথমিকভাবে যে অসুবিধাগুলোর সৃষ্টি করেছে ও যে ধরনের দুর্বলতার কারণে যে সব অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে তার ফলে জনমানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া সন্দেহজনক রোগাক্রান্তদের ঘনিষ্ঠ হওয়া অদূর ভবিষ্যতে কী ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে তা এখনো সাধারণ্যে স্পষ্ট নয় ও আমার মতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও তা অস্পষ্ট।

এমতাবস্তায় বর্তমান পরিসংখ্যান নিয়ে আত্মতুষ্টিতে থাকার কোন কারণ নেই। কোনভাবেই সুনির্ধারিত ও বহুল প্রচারিত প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলোকে কোন পর্যায়েই দুর্বল করা উচিত নয়। আপাতত নিম্নমাত্রার আক্রান্তের ও মৃতের সংখ্যাকে চূড়ান্ত ফলাফল ও ধারা বিবেচনা করার সুযোগ নেই। এ পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে কিছু বিষয় তুলে ধরার প্রয়োজন। আমাদের সাংগঠনিক ও ব্যক্তিগত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ঢাকা নগরের ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেকস্থানেই এখনও বাসা-বাড়ির বাইরে কিছু মানুষের একত্রিত হয়ে অড্ডা দেয়ার ঘটনা ঘটছে। এসব মানুষ তাদের এ সব সামাজিকতায় আগের মতোই চা-নাস্তা একত্রে গ্রহণ করছেন। ফলত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার যে প্রয়াস তা বিনষ্ট হচ্ছে। এরা প্রধানত দুটি বিষয় বোঝানোর চেষ্টা করে, তা হলো- করোনাভাইরাস বড়লোকের রোগ, এটা গরিবদেরকে আক্রান্ত করবে না। বলাই বাহুল্য এ ধরনের প্রচার বা ধ্যান-ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক ও আত্মধ্বংসী। দ্বিতীয়ত, কিছু মোল্লাতান্ত্রিক গোঁয়ার্তুমি বা ধর্মের নামে অপকর্ম ও অপপ্রচার আল্লাহ্ মৃত্যু নির্ধারিত করে রাখলে কেউ তা ঠেকাতে পারবে না। কাজেই কোন সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা নেই। ফলে কিছু মানুষের গোপনে বা প্রকাশ্যে মাহফিল করা বা জমায়েত হওয়া বন্ধ হয়নি। এটাও আত্মঘাতী। এর ফলে অনেক নিরীহ মানুষ আক্রান্ত হয়ে অন্য আরো বহু সংখ্যক মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। অথচ মহামারীর সময়ে নিজ নিজ অবস্থানে থাকা ও যেখানে মহামারীর বিপদ আছে সেখানে না যাওয়ার জন্য স্পষ্ট ভাবেই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা রয়েছে- যখন তোমরা কোথাও মহামারীর সংবাদ পাবে তখন সেদিকে যেও না। আর যদি তোমরা মহামারীতে আক্রান্ত ভূমিতে পূর্ব থেকেই অবস্থান করো তাহলে সেখান থেকে পালিয়ো না। (বুখারি : ৫৭৩৯, মুসলিম : ২২১৯)। কাজেই ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী মহামারীকালীন সময়ে সাবধানতা অবলম্বন করা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও বাধ্যতামূলক।

এ ছাড়া দরিদ্র মানুষদের সাহায্য করার নামে ব্যাক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে পরিচালিত কার্যক্রম আপাতত মানুষের উপকারের চেয়ে অপকার বেশি করছে। কারণ এর ফলে সবচেয়ে ফলপ্রসূ ও আবশ্যক যে আচরণটি এ মুহূর্তে প্রয়োজন, অর্থাৎ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোথাও এমন সাহায্য প্রদানের খবর রটে গেলে মানুষ দলে দলে সেদিকপানে ছুটে যায়। আর যারা এ ধরনের সাহায্য প্রদান করার কর্মসূচি পালন করেন তারাও নিজেদের নিরাপত্তার আবরণে আচ্ছাদিত রাখেন না। এ ধরনের ঘটনা ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি স্থানেই ঘটছে। এর প্রতিকার চেয়ে ৯৯৯ বা ৩৩৩ নম্বরগুলোতে জানিয়েও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। এসব নম্বর থেকে উপদেশ বিতরণ করার চেয়ে বিষয়টি সুরাহা করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেয়া জরুরি।

আরেকটি অতীব জরুরি বিষয় হচ্ছে, তথ্য বিভ্রাট ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার। সরকারি সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী মৃতের সংখ্যাকে সামাজিক মাধ্যমে বিশ্বাস না করে তাদের মনগড়া তথ্য সুচতুরভাবে প্রচার করার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে একটি গোষ্ঠীর মাধ্যমে। এটা জাতির ও গোটা বিশ্বের সব মানুষের এই মহাবিপদকে বিশেষ গোষ্ঠীর রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানোর কৌশল হিসেবেই করা হচ্ছে। সাধারণ্যে এক ধরনের ধারণা সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা নেয়া হচ্ছে যে বাংলাদেশে আরও অনেক মৃত্যু করোনার কারণে হয়েছে যা প্রচার করা হচ্ছে না। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এটাকে পরীক্ষা করার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে এটা জানার চেষ্টা যে কারও আত্মীয়, প্রতিবেশী বা এলাকায় কেউ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা বা মারা গেছেন কিনা তা জানা ও সেই সংখ্যাকে মোট আত্মীয়, প্রতিবেশী বা নিকটজনের সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করে আনুপাতিক হার বের করা। এই সহজ পদ্ধতির মাধ্যমে অন্ততপক্ষে কিছুটা হলেও মহামারীর তীব্রতা ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনুধাবন করা সম্ভব।

দিনমজুর, নিম্ন আয়ের মানুষ, বস্তিবাসীসহ অন্যান্য অরক্ষিত সম্প্রদায়কে সাহায্য করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিবিধ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ কার্যকরভাবে, অর্থাৎ সঠিক সময়ে সঠিকভাবে সম্পাদন করার জন্য সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি। ব্যক্তিগত বা বেসরকারি সহায়তার জন্য একটি নীতিমালা প্রয়োজন, যাতে করে এটি সাহায্যের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত, বিপথগামী বা মানুষের জীবনকে আরও বিপদসংকুল করে না তোলে। উপরন্তু এ ধরনের সাহায্যের মাধ্যমে যেন কোনভাবেই জঙ্গিবাদের পুনরুত্থান না ঘটে তা নিশ্চিত করা জরুরি। সাহায্য সামগ্রী স্বউদ্যোগে বাড়িতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা উচিত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার স্বার্থে। কোনভাবেই জনসমাগম করে ফটোসেশন করতে দেয়া যাবে না। এ ধরনের কর্ম যারা ইতোমধ্যে করেছে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা জরুরি যাতে করে আর কখনও কেউ এ ধরনের বিপজ্জনক খেলায় মেতে না ওঠে।

যতদিন পর্যন্ত সারা বিশ্বে এ রোগটি প্রশমিত হয়ে মানুষের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না আসছে ততদিন দেশের স্বার্থে যে সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা সম্ভব সেগুলো বন্ধ রাখা আবশ্যক। সব চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসাসেবী ও চিকিৎসালয়গুলোতে কর্মরত সবাই যারা রোগীদের প্রত্যক্ষভাবে সেবা প্রদান করছেন তাদের বিশ্বমানের সব ধরনের পরিচ্ছদ, যন্ত্রপাতি ও আসা যাওয়ার জন্য বিশেষ নিরাপত্তা বাহন সরবরাহ করা উচিত। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসাসেবীরাই এখন রোগীদের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মানুষ। তাদের ও তাদের পরিবার-পরিজনের সুব্যবস্থাই পারে একজন চিকিৎসাসেবীকে রোগীর সেবায় সর্বোতভাবে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে। এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় স্মরণযোগ্য যে সাম্প্রতিক ডেঙ্গু মহামারীর সময় প্রায় ৩ মাস সব সরকারি চিকিৎসালয়ে চিকিৎসকরা কোন ছুটি ছাড়াই দিনে ১৫ ঘণ্টা করে কাজ করেছেন। তাদের জন্য না ছিল সাপ্তাহিক ছুটি, না ছিল ঈদের ছুটি। এ সময়ে অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের সবাই নিয়মিত ছুটি ভোগ করেছে, একমাত্র চিকিৎসক বাদে। তাদের রোগীদের আত্মীয়স্বজনদের হাতে বিনা কারণে নিগৃহীত হতে হয়েছে। আমরা তাদের যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করিনি বা করতে পারিনি। যারা সুস্থ হয়ে ফিরে গেছেন তারাও তাদের মনে রেখেছেন কিনা জানা নেই।

যেসব প্রতিষ্ঠান জরুরি কাজে নিয়োজিত সে সব স্থানের কর্মীদের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা থাকা জরুরি। গার্মেন্ট সেক্টর পুনরায় চালু হলে সেখানেও মালিক পক্ষকে উপযুক্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা চালু করতে হবে। একজন কর্মী যদি তার প্রতিষ্ঠানকে বৎসরে এক লাখ টাকা মুনাফা দিতে পারে, তাহলে তার জন্য পাঁচ হাজার টাকা মূল্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা মালিক পক্ষের জন্য অসম্ভব কোন বিষয় নয়। এ ছাড়া বড় ব্যবসায়ী, উচ্চবিত্ত ও অন্যান্য সকলের উচিত সরকারের করোনা প্রতিরোধ উদ্যোগকে সফল করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে বা অন্য যে কোন বিশ্বাসযোগ্য স্থানে যথোপযুক্ত আর্থিক অনুদান প্রদান করা।

শহরগুলোতে ওয়াসা, সিটি কাউন্সিল বা পৌরসভার মাধ্যমে প্রতিটি সড়কে প্রতিদিন অন্ততপক্ষে একবার করে জীবাণুনাশক পানি ছিটানো আবশ্যক। এত করে করোনার সঙ্গে সঙ্গে আশু ডেঙ্গু মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপও কমানো সম্ভব। বর্তমান সরকার প্রধানের সততা ও নিষ্ঠা ও দেশের মানুষের প্রতি তার মমত্ববোধের বিষয়ে কারও কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু তার নির্দেশিত পথে চলার জন্য যে প্রজ্ঞা, কর্মস্পৃহা ও গতিময়তার প্রয়োজন তা আমলাতন্ত্রের নেই বিধায় জনপ্রতিনিধিদের আরও নিবিড়ভাবে মাঠপর্যায়ের কাজের গতিময়তা ও স্বচ্ছতা বিধান করতে হবে।

[লেখক : প্রেসিডেন্ট, গভর্ন্যান্স অ্যান্ড রাইটস সেন্টার (জিআরসি)]

রবিবার, ০৫ এপ্রিল ২০২০ , ২২ চৈত্র ১৪২৬, ১০ শাবান ১৪৪১

করোনা মহামারী : প্রত্যাশিত সামাজিক ও করপোরেট আচরণ

অধ্যাপক ড. জহুরুল আলম

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা এত দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে যে তা প্রতি মুহূর্তেই পরিবর্তিত আকার ধারণ করছে। এ মুহূর্তের প্রায় দশ লাখ বিশ হাজার আক্রান্তের ও প্রায় ৫৪ হাজার মৃত্যুর পরিসংখ্যানটির চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই যে পৃথিবীর ২০৪টি দেশে এই রোগ মহামারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ২১২৮ জন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ও ১১০ জনের মৃত্যু হচ্ছে। অর্থাৎ আক্রান্ত মোট রোগীর শতকরা ৫.২ ভাগেরও বেশি মৃত্যু বরণ করছে, আর সুস্থ ও মৃতের অনুপাতিক সম্পর্ক হচ্ছে ৮০:২০, যা অতি উচ্চ। উল্লেখযোগ্য যে নভেম্বরের শুরুতে চীনের হুবেই প্রদেশে এই মহামারীতে মৃত্যুর হার ছিল শতকরা ২ ভাগ, যা মার্চের ৩ তারিখে বেড়ে দাঁড়ায় ৩ ভাগে, আর বর্তমানে শতকরা ৫.২৪ ভাগ। বর্তমানে নতুন নতুন দেশে মহামারীটি ছড়িয়ে পড়ছে। আর যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের অনেক দেশে আক্রান্তের হার হঠাৎ করেই অতি দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে মোট আক্রান্তের শতকরা ১১ ভাগ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, যা এ রোগে বিশ্বের গড় মৃত্যু হারের চেয়ে দ্বিগুণেরও অধিক। সে দিক দিয়ে বাংলাদেশকে প্রচ্ছন্ন বিপজ্জনক দেশের কাতারে ফেলা সম্ভব। কিন্তু মোট আক্রান্তের সংখ্যা বিচারে তা এখনও প্রমাণিত সত্য হিসেবে উপস্থাপিত করা যায় না। বাংলাদেশে আপতদৃষ্টে অদ্যাবধি করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় নগণ্য, মোট ৫৬ জন। এর কিছু যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে, যার মধ্যে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সময়োপযোগী ও ধারাবাহিক ভূমিকা ও সেই সঙ্গে সচেতন নাগরিক সমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে এর ব্যত্যয়ও আছে। বিশেষত নীতি বাস্তবায়ন পর্যায়ে আমলাতান্ত্রিক ও দুর্নীতিপরায়ণতা বা কার্যসম্পাদনে অবহেলা প্রাথমিকভাবে যে অসুবিধাগুলোর সৃষ্টি করেছে ও যে ধরনের দুর্বলতার কারণে যে সব অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে তার ফলে জনমানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া সন্দেহজনক রোগাক্রান্তদের ঘনিষ্ঠ হওয়া অদূর ভবিষ্যতে কী ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে তা এখনো সাধারণ্যে স্পষ্ট নয় ও আমার মতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও তা অস্পষ্ট।

এমতাবস্তায় বর্তমান পরিসংখ্যান নিয়ে আত্মতুষ্টিতে থাকার কোন কারণ নেই। কোনভাবেই সুনির্ধারিত ও বহুল প্রচারিত প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলোকে কোন পর্যায়েই দুর্বল করা উচিত নয়। আপাতত নিম্নমাত্রার আক্রান্তের ও মৃতের সংখ্যাকে চূড়ান্ত ফলাফল ও ধারা বিবেচনা করার সুযোগ নেই। এ পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে কিছু বিষয় তুলে ধরার প্রয়োজন। আমাদের সাংগঠনিক ও ব্যক্তিগত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ঢাকা নগরের ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেকস্থানেই এখনও বাসা-বাড়ির বাইরে কিছু মানুষের একত্রিত হয়ে অড্ডা দেয়ার ঘটনা ঘটছে। এসব মানুষ তাদের এ সব সামাজিকতায় আগের মতোই চা-নাস্তা একত্রে গ্রহণ করছেন। ফলত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার যে প্রয়াস তা বিনষ্ট হচ্ছে। এরা প্রধানত দুটি বিষয় বোঝানোর চেষ্টা করে, তা হলো- করোনাভাইরাস বড়লোকের রোগ, এটা গরিবদেরকে আক্রান্ত করবে না। বলাই বাহুল্য এ ধরনের প্রচার বা ধ্যান-ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক ও আত্মধ্বংসী। দ্বিতীয়ত, কিছু মোল্লাতান্ত্রিক গোঁয়ার্তুমি বা ধর্মের নামে অপকর্ম ও অপপ্রচার আল্লাহ্ মৃত্যু নির্ধারিত করে রাখলে কেউ তা ঠেকাতে পারবে না। কাজেই কোন সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা নেই। ফলে কিছু মানুষের গোপনে বা প্রকাশ্যে মাহফিল করা বা জমায়েত হওয়া বন্ধ হয়নি। এটাও আত্মঘাতী। এর ফলে অনেক নিরীহ মানুষ আক্রান্ত হয়ে অন্য আরো বহু সংখ্যক মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। অথচ মহামারীর সময়ে নিজ নিজ অবস্থানে থাকা ও যেখানে মহামারীর বিপদ আছে সেখানে না যাওয়ার জন্য স্পষ্ট ভাবেই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা রয়েছে- যখন তোমরা কোথাও মহামারীর সংবাদ পাবে তখন সেদিকে যেও না। আর যদি তোমরা মহামারীতে আক্রান্ত ভূমিতে পূর্ব থেকেই অবস্থান করো তাহলে সেখান থেকে পালিয়ো না। (বুখারি : ৫৭৩৯, মুসলিম : ২২১৯)। কাজেই ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী মহামারীকালীন সময়ে সাবধানতা অবলম্বন করা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও বাধ্যতামূলক।

এ ছাড়া দরিদ্র মানুষদের সাহায্য করার নামে ব্যাক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে পরিচালিত কার্যক্রম আপাতত মানুষের উপকারের চেয়ে অপকার বেশি করছে। কারণ এর ফলে সবচেয়ে ফলপ্রসূ ও আবশ্যক যে আচরণটি এ মুহূর্তে প্রয়োজন, অর্থাৎ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোথাও এমন সাহায্য প্রদানের খবর রটে গেলে মানুষ দলে দলে সেদিকপানে ছুটে যায়। আর যারা এ ধরনের সাহায্য প্রদান করার কর্মসূচি পালন করেন তারাও নিজেদের নিরাপত্তার আবরণে আচ্ছাদিত রাখেন না। এ ধরনের ঘটনা ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি স্থানেই ঘটছে। এর প্রতিকার চেয়ে ৯৯৯ বা ৩৩৩ নম্বরগুলোতে জানিয়েও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। এসব নম্বর থেকে উপদেশ বিতরণ করার চেয়ে বিষয়টি সুরাহা করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেয়া জরুরি।

আরেকটি অতীব জরুরি বিষয় হচ্ছে, তথ্য বিভ্রাট ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার। সরকারি সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী মৃতের সংখ্যাকে সামাজিক মাধ্যমে বিশ্বাস না করে তাদের মনগড়া তথ্য সুচতুরভাবে প্রচার করার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে একটি গোষ্ঠীর মাধ্যমে। এটা জাতির ও গোটা বিশ্বের সব মানুষের এই মহাবিপদকে বিশেষ গোষ্ঠীর রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানোর কৌশল হিসেবেই করা হচ্ছে। সাধারণ্যে এক ধরনের ধারণা সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা নেয়া হচ্ছে যে বাংলাদেশে আরও অনেক মৃত্যু করোনার কারণে হয়েছে যা প্রচার করা হচ্ছে না। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এটাকে পরীক্ষা করার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে এটা জানার চেষ্টা যে কারও আত্মীয়, প্রতিবেশী বা এলাকায় কেউ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা বা মারা গেছেন কিনা তা জানা ও সেই সংখ্যাকে মোট আত্মীয়, প্রতিবেশী বা নিকটজনের সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করে আনুপাতিক হার বের করা। এই সহজ পদ্ধতির মাধ্যমে অন্ততপক্ষে কিছুটা হলেও মহামারীর তীব্রতা ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনুধাবন করা সম্ভব।

দিনমজুর, নিম্ন আয়ের মানুষ, বস্তিবাসীসহ অন্যান্য অরক্ষিত সম্প্রদায়কে সাহায্য করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিবিধ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ কার্যকরভাবে, অর্থাৎ সঠিক সময়ে সঠিকভাবে সম্পাদন করার জন্য সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি। ব্যক্তিগত বা বেসরকারি সহায়তার জন্য একটি নীতিমালা প্রয়োজন, যাতে করে এটি সাহায্যের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত, বিপথগামী বা মানুষের জীবনকে আরও বিপদসংকুল করে না তোলে। উপরন্তু এ ধরনের সাহায্যের মাধ্যমে যেন কোনভাবেই জঙ্গিবাদের পুনরুত্থান না ঘটে তা নিশ্চিত করা জরুরি। সাহায্য সামগ্রী স্বউদ্যোগে বাড়িতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা উচিত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার স্বার্থে। কোনভাবেই জনসমাগম করে ফটোসেশন করতে দেয়া যাবে না। এ ধরনের কর্ম যারা ইতোমধ্যে করেছে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা জরুরি যাতে করে আর কখনও কেউ এ ধরনের বিপজ্জনক খেলায় মেতে না ওঠে।

যতদিন পর্যন্ত সারা বিশ্বে এ রোগটি প্রশমিত হয়ে মানুষের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না আসছে ততদিন দেশের স্বার্থে যে সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা সম্ভব সেগুলো বন্ধ রাখা আবশ্যক। সব চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসাসেবী ও চিকিৎসালয়গুলোতে কর্মরত সবাই যারা রোগীদের প্রত্যক্ষভাবে সেবা প্রদান করছেন তাদের বিশ্বমানের সব ধরনের পরিচ্ছদ, যন্ত্রপাতি ও আসা যাওয়ার জন্য বিশেষ নিরাপত্তা বাহন সরবরাহ করা উচিত। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসাসেবীরাই এখন রোগীদের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মানুষ। তাদের ও তাদের পরিবার-পরিজনের সুব্যবস্থাই পারে একজন চিকিৎসাসেবীকে রোগীর সেবায় সর্বোতভাবে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে। এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় স্মরণযোগ্য যে সাম্প্রতিক ডেঙ্গু মহামারীর সময় প্রায় ৩ মাস সব সরকারি চিকিৎসালয়ে চিকিৎসকরা কোন ছুটি ছাড়াই দিনে ১৫ ঘণ্টা করে কাজ করেছেন। তাদের জন্য না ছিল সাপ্তাহিক ছুটি, না ছিল ঈদের ছুটি। এ সময়ে অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের সবাই নিয়মিত ছুটি ভোগ করেছে, একমাত্র চিকিৎসক বাদে। তাদের রোগীদের আত্মীয়স্বজনদের হাতে বিনা কারণে নিগৃহীত হতে হয়েছে। আমরা তাদের যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করিনি বা করতে পারিনি। যারা সুস্থ হয়ে ফিরে গেছেন তারাও তাদের মনে রেখেছেন কিনা জানা নেই।

যেসব প্রতিষ্ঠান জরুরি কাজে নিয়োজিত সে সব স্থানের কর্মীদের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা থাকা জরুরি। গার্মেন্ট সেক্টর পুনরায় চালু হলে সেখানেও মালিক পক্ষকে উপযুক্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা চালু করতে হবে। একজন কর্মী যদি তার প্রতিষ্ঠানকে বৎসরে এক লাখ টাকা মুনাফা দিতে পারে, তাহলে তার জন্য পাঁচ হাজার টাকা মূল্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা মালিক পক্ষের জন্য অসম্ভব কোন বিষয় নয়। এ ছাড়া বড় ব্যবসায়ী, উচ্চবিত্ত ও অন্যান্য সকলের উচিত সরকারের করোনা প্রতিরোধ উদ্যোগকে সফল করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে বা অন্য যে কোন বিশ্বাসযোগ্য স্থানে যথোপযুক্ত আর্থিক অনুদান প্রদান করা।

শহরগুলোতে ওয়াসা, সিটি কাউন্সিল বা পৌরসভার মাধ্যমে প্রতিটি সড়কে প্রতিদিন অন্ততপক্ষে একবার করে জীবাণুনাশক পানি ছিটানো আবশ্যক। এত করে করোনার সঙ্গে সঙ্গে আশু ডেঙ্গু মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপও কমানো সম্ভব। বর্তমান সরকার প্রধানের সততা ও নিষ্ঠা ও দেশের মানুষের প্রতি তার মমত্ববোধের বিষয়ে কারও কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু তার নির্দেশিত পথে চলার জন্য যে প্রজ্ঞা, কর্মস্পৃহা ও গতিময়তার প্রয়োজন তা আমলাতন্ত্রের নেই বিধায় জনপ্রতিনিধিদের আরও নিবিড়ভাবে মাঠপর্যায়ের কাজের গতিময়তা ও স্বচ্ছতা বিধান করতে হবে।

[লেখক : প্রেসিডেন্ট, গভর্ন্যান্স অ্যান্ড রাইটস সেন্টার (জিআরসি)]