টেলিকম ॥ সুদিনের ভিত্তি

মোস্তাফা জব্বার

একটি পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে যে মার্চ মাসে করোনার জন্য দেশটির সকল মানুষ অন্তরীণ হয়ে যাবার পর দেশটা প্রযুক্তির কল্যাণেই সচল আছে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে টেলিকম প্রযুক্তির কথাই বলতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সিং বা ঘরে বসে অফিস করার প্রযুক্তি দিচ্ছে টেলিকম খাতই। এমনকি টিভিতে যখন স্কুলের ক্লাস হচ্ছে তাও টিভির বিকল্প হিসেবে ইন্টারনেটে স্ট্রিমিং করেও শিক্ষার বিস্তার ঘটছে। এবার করোনাকালীন সময়টি বোধহয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে প্রযুক্তি বিশেষত টেলিকম প্রযুক্তি ছাড়া ডিজিাল বিশ্বে টিকে থাকা যাবে না। আসুন একটু পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি টেলিকম খাতে ২০১৯ সালে আমরা কেমন ছিলাম।

উনিশ সাল পার হয়েছে। বিশেরও দুই মাস পার হয়ে গেলো। স্বাভাবিক কারণেই পেছনে ফিরে তাকানোটা আমার স্বভাবজাত কাজের একটি। আমার কাছে বছরটিকে অসাধারণ সম্ভাবনার মাইলফলক বলেই মনে হয়। একটি গতিশীল টেলিকম খাত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় কতোটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা কাউকে বোঝানোর দরকার নেই। একদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমলাতান্ত্রিকতা ও স্থবিরতাকে সচল সজীব ও বর্ণাঢ্য করে গড়ে তোলা অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর ন্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার ডিজিটাল মহাসড়কটি নির্মাণ করার বিদায়ী বছরটি ছিলো অনন্য নিয়ামক। একটি মাহেন্দ্রক্ষণ কেটেছে এই সময়টিতে। যদিও কেউ কেউ বছরটিকে ‘অস্থিরতায় টেলিকম খাত’ বলেছেন তথাপি তারা যে বছরটির অনালোকিত অংশটির একপাক্ষিক ব্যাখ্যা করেছেন সেটি এই নিবন্ধটি পাঠ করলে বোঝা যাবে। একতরফা সমালোচকরা প্রধানত টেলিকম খাতের তিনটি বিষয়ের ওপর দৃষ্টিপাত করেছেন। প্রথমটি জিপি-রবির কাছ থেকে সরকারের পাওনা আদায়ের বিষয়টি বহুল আলোচিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত মোবাইলের সেবার মান আগের চাইতেও খারাপ হয়েছে- এটিও ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়েছে। অন্যদিকে মোবাইলের কলরেট এক করায় গ্রাহকের ব্যয় বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তিনটি বিষয়েই প্রকৃত তথ্য সকলের জেনে রাখা উচিত। নিবন্ধের শেষভাগে আমরা বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবো। শুরুতে কেবল একটি বাক্যই উচ্চারণ করতে পারি যে, এই তিনটি বিষয়েই সরকারের কোন দায় ছিল না এবং সরকার সর্বশক্তি দিয়ে সমস্যাগুলোর ইতিবাচক সমাধান করার জন্য ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে ও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু কিছু অপারেটর পুরো বিষয়গুলোকে জটিলতম করে জনগণের দুর্ভোগও তৈরি করেছে। আশা করি তাদের জটিল অবস্থা তৈরি করার সময় উত্তীর্ণ হয়েছে। দেশের আইন ও জনগণের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সেবা দিতে না পারলে তাদের সংকট ঘনীভূত হলেও এই খাতে তাদের কাছে জিম্মি থাকার অবস্থাটি পাল্টে যেতে শুরু করেছে। ২০ সালের শেষে দেশবাসী তার প্রতিফলন দেখতে পাবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

কোন সন্দেহ নাই যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ডিজিটাল ডিভাইস উদ্ভাবন, উৎপাদন ও রপ্তানী এবং ডিজিটাল ডিভাইসের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করণ। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ডিজিটাল সংযুক্তি অপরিহার্য। এরই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক মাননীয় উপদেষ্টা সজীব আহমেদ জয়ের দিকনির্দেশনায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ডিজিটাল প্রযুক্তির মহাসড়ক নির্মাণসহ ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে তুলতে গত এক বছরে যুগান্তকারী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। এই খাতে ১৯ সালে যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে, বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন আছে তার একটি অতি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা যায়।

নির্বাচনী ইশতেহারের আলোকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের আওতাধীন বাস্তবায়নযোগ্য বিষয়াদি চিহ্নিত করে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা চুড়ান্তকরণ এবং সেই আলোকে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।

১. ২০১৯ সালে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর সফল উৎক্ষেপণ পরবর্তী বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এর কার্যক্রম চালু হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের ৩৪টিরও বেশি টিভি চ্যানেল অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। বাংলাদেশের বাইরেও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের বাজারজাতকরণ শুরু হয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ নির্মাণ, উৎক্ষেপণ ও ব্যবহারের পথনকশা তৈরি করা হয়েছে; যার ভিত্তিতে ২০২৩ সালের মাঝেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণ করা যাবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

২. চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা ডিজিটাল শিল্প বিপ্লব বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিভ্যুলিউশন ফোর পয়েন্ট জিরোর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রযুক্তির অভাবনীয় সংস্করণ ফাইভ জি চালু করার লক্ষ্যে পথনকশা প্রণয়ন সম্পন্ন করা হয়েছে এবং ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ফাইভ জি চালু করার বিষয়ে অবকাঠামো তৈরির প্রস্তুতি চলছে। ৫জি কবে কোথায় সম্প্রসারিত হবে তারও পথনকশা তৈরি হয়েছে।

৩. এমএনপি সেবা চালু করা হয়েছে। এর ফলে মোবাইল গ্রাহকগণ নাম্বার ঠিক রেখে পছন্দমত যে কোন অপারেটর পরিবর্তন করতে পারছেন। যদিও শীর্ষ অপারেটরের সঙ্গে অন্য অপারেটরদের শক্তিমত্তা দুর্বল থাকায় এর সর্বোচ্চ ব্যবহার এখনও হয়ে ওঠেনি। অন্যদিকে মোবাইলের আইএমইআই ডাটা ব্যাংক চালু করার ফলে অবৈধভাবে মোবাইল আমদানির পথ বন্ধ হচ্ছে এবং মোবাইলে অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে। এছাড়াও টেলিকম সেবা সুনিশ্চিত কল্পে সময়োপযোগী বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন ও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বস্তুত বর্তমানে নীতিমালার ঘাটতি এখন নেই বললেই বলা যেতে পারে।

৪. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষে বিনা মাশুলে বিটিসিএল ল্যান্ডফোন সংযোগ ও পুনঃসংযোগ প্রদান কার্যক্রম চালু হয়েছে। বিটিসিএল এর স্থির ফোনলাইনে মাসে ১৫০ টাকায় যতখুশি তত কথা বলা যাচ্ছে। মাসিক লাইনরেন্ট উঠিয়ে নেয়া হয়েছে এবং ৫২ পয়সায় মিনিট যে কোন মোবাইল অপারেটরে কথা বলা যাচ্ছে। বিটিসিএলের ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের সর্বনিম্ন হার প্রতি এমবিপিএস ৩৬০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৮০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। স্মরণ করা দরকার ২০০৮ সালে এই মূল্য ২৭ হাজার টাকা ছিলো। বিটিসিএল ৫৮৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফ্রি ওয়াইফাই জোন চালু করার লক্ষ্যে কার্যক্রম চলমান রেখেছে। এর মাঝে ১০০টি সংযোগ প্রদানের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বিটিসিএলের টেলিকম সেবা আধুনিকায়নে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এমওটিএন প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এর ফলে বিদমান প্রযুক্তিকে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় উপজেলা পর্যন্ত বিটিসিএল তাদের প্রযুক্তিকে ডিজিটাল করতে সক্ষম হচ্ছে।

৫. ২৬ মার্চ ১৯ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধন করার পর ডাক বিভাগ মোবাইল আর্থিক সেবা সার্ভিস নগদ চালু করেছে। এরই মাঝে নগদ এর দৈনিক লেনদের শত কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। ডিজিটাল ডাক টাকা চালু করার আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। যে কোন দিন এই সেবা চালু হবে। ডাক সেবাকে ডিজিটাল ডাক সেবায় রূপান্তরের মাধ্যমে ডাক বিভাগের অবকাঠামোকে কার্যকর ডিজিটাল কমার্সের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সারা দেশে ডিজিটাল ডাক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে ১৯ হাজারের বেশি উদ্যোক্তাকে এসব কেন্দ্রের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা সরকারের সেবা জনগণের কাছে পৌঁছানোর পাশাপাশি জনগণকে অন্যান্য ডিজিটাল সেবা দিচ্ছে। আগারগাঁওয়ে আধুনিক ডাক ভবনের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনা এখন একটি আইকন ভবনে পরিণত হয়েছে। দেশব্যাপী নতুন ডাকঘর নির্মাণ ও পুরানো ডাকঘর সংস্কারের পাশাপাশি ১৪টি ডাক বাছাই কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।

৬. দেশে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের বর্ধিত চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে ২০২৩ সালের মার্চে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত সি-মি-উই ৬ এ যুক্ত হওয়ার জন্য এরই মাঝে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। সাবমেরিন ক্যাবল থেকে ব্যান্ডউইথের মূল্য সর্বনিম্ন ২৮৫ টাকায় নামানো হয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানির ব্যান্ডউইথ ব্যবহার ১ টেরাবাইট অতিক্রম করেছে।

৭. টেলিটক দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার নেটওয়ার্ক বিস্তারের কাজ করছে। প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। এর আওতায় সিলেট সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অধীন হাওরসমূহে এবং মাতারবাড়ি, হাতিয়া, ভাসানটেক প্রভৃতি দ্বীপ অঞ্চলে টেলিটকের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিটিআরসির সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল বা এসওএফ তহবিলের অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। ফলে দেশের সকল দুর্গম এলাকায় সর্বশেষ মোবাইল প্রযুক্তি সম্প্রসারিত হচ্ছে। এছাড়াও সারা দেশে টেলিটক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ণ করে ও বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। টেলিটকের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

৮. টেলিফোন শিল্প সংস্থা ডিজিটাল ডিভাইস নির্মাণের উপযোগী করে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং নতুন প্রজন্মের ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন বাজারে এসেছে। এই সংস্থার প্রচলিত পণ্য ফোন সেট, মিটার ইত্যাদির উৎপাদনতো অব্যাহত রয়েছেই। বাংলাদেশে উৎপাদিত তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানিবান্ধব প্রদত্ত সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইতোমধ্যে নেপাল ও নাইজেরিয়ায় কম্পিউটার/ল্যাপটপের বড় অংকের চালান রপ্তানি হচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানির বিষয়টি পাইপ লাইনে রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এক লাখ ডলারের মোবাইল সেট রপ্তানির আদেশ পাওয়া গেছে। নতুন বছরে এই রপ্তানির কাজটি সম্পন্ন হবে।

৯. গুণগতমানের অপটিক্যাল ফাইভারের বর্ধিত চাহিদা পূরণের জন্য খুলনা বাংলাদেশ ক্যাবল শিল্প লিমিটেড, খুলনাকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালে ৪,৪২০.১৪৫ কিমি. অপটিকাল ফাইবার, টেলিযোগাযোগ কপার ক্যাবল এবং ২,০৪৬.৫৫৭ কিমি. এইচডিপি সিলিকন ডাক্ট উৎপাদন করা হয়েছে। আইসিটি ডিভিশনের ‘কানেক্টেড বাংলাদেশ’ প্রকল্পে ৮,১০০ কিমি. অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল সরবরাহের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। উৎপাদন বহুমুখীকরণের অংশ হিসাবে প্রায় ২৪.১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বৈদ্যুতিক ওভারহেড কন্ডাক্টর, সার্ভিস ড্রপ ক্যাবল ও ইনস্যুলেটেড ওয়্যার তৈরির প্ল্যান্ট স্থাপন কার্যক্রম চলছে।

১০. এসওএফ তহবিলের অর্থায়নে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের কানেক্টেড বাংলাদেশ প্রকল্পের আওতায় ৭৩৬টি ইউনিয়নে ফাইবার অপটিক্স কানেকসন দেবার প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। একইভাবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের শিশু কানন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাস্তবায়িত হচ্ছে প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলে ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের কাজ।

১১. টেলিকম অধিদপ্তরের মাধ্যমে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সাইবার থ্রেড ডিটেকসন ও রেসপন্স প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রকল্পটির দ্বিতীয়পর্যায় বিবেচনাধীন রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি দেশের দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৫১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল শিক্ষা প্রবর্তন করছে।

মোবাইল অপারেটরদ্বয়ের পাওনা আদায়, সেবা ও কলরেট : নিবন্ধের শুরুতেই বলেছি যে, এই প্রসঙ্গগুলো ২০১৯ সালের বহুল আলোচিত বিষয় ছিলো। জিপি রবির পাওনার ইতিহাস ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। সরকারের পক্ষ থেকে হিসাব নিরীক্ষা করে এই পাওনা নির্ধারণ করা হয়। বস্তুত এর মাঝে একবার বিষয়টি আদালতে যায় এবং আদালতের নির্দেশে দ্বিতীয়বার নিরীক্ষা করে সরকারের পক্ষ থেকে দাবিনামা পেশ করা হয়। এ দাবিনামা পেশ করার পরিপ্রেক্ষিতে উভয় অপারেটর আলোচনার প্রস্তাব দিলে টেলিকম বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয় এবং দুই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা আলোচনায় যুক্ত হয়ে দুই অপারেটরকেই একটি সহজ সমাধান প্রদান করে। কিন্তু অপারেটরদ্বয় সেই সহজ সমাধান গ্রহণ না করে আদালতের শরণাপন্ন হয়। খুব সঙ্গতকারণেই বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারে থাকে। আদালতের সিদ্ধান্তই এই বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে। এরই মাঝে জিপি আন্তর্জাতিক আদালতে যাবার হুমকি দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে উকিল নোটিশ দিয়েছে; যা এই দেশের কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। অপারেটরদের এ আচরণের ফলে মোবাইলের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ বন্ধ ছিলো। সেবার মানও কমেছে। এরই মাঝে আদালতের আদেশে জিপি এক হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে ও আগামী তিন মাসে আরও এক হাজার কোটি টাকা প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রবিকে ৫ কিস্তিতে ১৩৮ কোটি টাকা পরিশোধের নির্দশ দেয়ার পর তারা দুই কিস্তির টাকা পরিশোধও করেছে। বাংলাদেশের টেলিকম খাতের জন্য এটি একটি বড় ধরনের মাইলফলক।

মোবাইলের সেবার মান যে নেমেছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সেটি যে অসহনীয় সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। বিষয়টি বিগত সংসদেও আলোচিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো দুটি বড় অপারেটর যারা সরকারের পাওনা পরিশোধ নিয়ে বিরোধে ছিলো এবং সেটিকে কেন্দ্র করে নানা জটিলতা সৃষ্টি করেছে তারা স্পেকট্রম বা নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। তারা তাদের মুনাফা বাড়াচ্ছে অথচ তাদের যে পরিমাণ স্পেকট্রাম ও বিটিএস দরকার তা মোটেই নেই। যেহেতু অন্য দুটি অপারেটর বাজার দখল, নেটওয়ার্ক বা সেবার মানে বড় দুটির চাইতে শক্তিশালী নয় সেহেতু আমরা যে কারণে এমএনপি নীতি চালু করেছিলাম এবং মোবাইলের একটি একক মূল্য নির্ধারণ করেছিলাম তা তেমনভাবে কাজে লাগেনি। বরং সেটি বড় দুই অপারেটরের পক্ষেই গেছে। এসবের অন্যতম সমাধান হচ্ছে টেলিটকসহ দুর্বল অপারেটরদের সক্ষমতা বাড়ানো। আমরা টেলিটককে শক্তিশালী করার জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছি। আশা করি টেলিটক শক্তিশালী হলে মোবাইল বাজারের একচেটিয়া দাপট থাকবে না। আমার বিশ্বাস মোবাইল অপারেটর বিষয়ক এসব জটিলতা ২০২০ সালে সমাপ্তির শেষ প্রান্তে পৌঁছবে।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

ঢাকা ॥ ৩ এপ্রিল, ২০২০।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান; সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার-বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা এর প্রণেতা]

mustafajabbar@gmail.com

মঙ্গলবার, ০৭ এপ্রিল ২০২০ , ২৪ চৈত্র ১৪২৬, ১২ শাবান ১৪৪১

টেলিকম ॥ সুদিনের ভিত্তি

মোস্তাফা জব্বার

একটি পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে যে মার্চ মাসে করোনার জন্য দেশটির সকল মানুষ অন্তরীণ হয়ে যাবার পর দেশটা প্রযুক্তির কল্যাণেই সচল আছে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে টেলিকম প্রযুক্তির কথাই বলতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সিং বা ঘরে বসে অফিস করার প্রযুক্তি দিচ্ছে টেলিকম খাতই। এমনকি টিভিতে যখন স্কুলের ক্লাস হচ্ছে তাও টিভির বিকল্প হিসেবে ইন্টারনেটে স্ট্রিমিং করেও শিক্ষার বিস্তার ঘটছে। এবার করোনাকালীন সময়টি বোধহয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে প্রযুক্তি বিশেষত টেলিকম প্রযুক্তি ছাড়া ডিজিাল বিশ্বে টিকে থাকা যাবে না। আসুন একটু পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি টেলিকম খাতে ২০১৯ সালে আমরা কেমন ছিলাম।

উনিশ সাল পার হয়েছে। বিশেরও দুই মাস পার হয়ে গেলো। স্বাভাবিক কারণেই পেছনে ফিরে তাকানোটা আমার স্বভাবজাত কাজের একটি। আমার কাছে বছরটিকে অসাধারণ সম্ভাবনার মাইলফলক বলেই মনে হয়। একটি গতিশীল টেলিকম খাত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় কতোটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা কাউকে বোঝানোর দরকার নেই। একদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমলাতান্ত্রিকতা ও স্থবিরতাকে সচল সজীব ও বর্ণাঢ্য করে গড়ে তোলা অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর ন্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার ডিজিটাল মহাসড়কটি নির্মাণ করার বিদায়ী বছরটি ছিলো অনন্য নিয়ামক। একটি মাহেন্দ্রক্ষণ কেটেছে এই সময়টিতে। যদিও কেউ কেউ বছরটিকে ‘অস্থিরতায় টেলিকম খাত’ বলেছেন তথাপি তারা যে বছরটির অনালোকিত অংশটির একপাক্ষিক ব্যাখ্যা করেছেন সেটি এই নিবন্ধটি পাঠ করলে বোঝা যাবে। একতরফা সমালোচকরা প্রধানত টেলিকম খাতের তিনটি বিষয়ের ওপর দৃষ্টিপাত করেছেন। প্রথমটি জিপি-রবির কাছ থেকে সরকারের পাওনা আদায়ের বিষয়টি বহুল আলোচিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত মোবাইলের সেবার মান আগের চাইতেও খারাপ হয়েছে- এটিও ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়েছে। অন্যদিকে মোবাইলের কলরেট এক করায় গ্রাহকের ব্যয় বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তিনটি বিষয়েই প্রকৃত তথ্য সকলের জেনে রাখা উচিত। নিবন্ধের শেষভাগে আমরা বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবো। শুরুতে কেবল একটি বাক্যই উচ্চারণ করতে পারি যে, এই তিনটি বিষয়েই সরকারের কোন দায় ছিল না এবং সরকার সর্বশক্তি দিয়ে সমস্যাগুলোর ইতিবাচক সমাধান করার জন্য ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে ও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু কিছু অপারেটর পুরো বিষয়গুলোকে জটিলতম করে জনগণের দুর্ভোগও তৈরি করেছে। আশা করি তাদের জটিল অবস্থা তৈরি করার সময় উত্তীর্ণ হয়েছে। দেশের আইন ও জনগণের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সেবা দিতে না পারলে তাদের সংকট ঘনীভূত হলেও এই খাতে তাদের কাছে জিম্মি থাকার অবস্থাটি পাল্টে যেতে শুরু করেছে। ২০ সালের শেষে দেশবাসী তার প্রতিফলন দেখতে পাবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

কোন সন্দেহ নাই যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ডিজিটাল ডিভাইস উদ্ভাবন, উৎপাদন ও রপ্তানী এবং ডিজিটাল ডিভাইসের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করণ। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ডিজিটাল সংযুক্তি অপরিহার্য। এরই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক মাননীয় উপদেষ্টা সজীব আহমেদ জয়ের দিকনির্দেশনায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ডিজিটাল প্রযুক্তির মহাসড়ক নির্মাণসহ ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে তুলতে গত এক বছরে যুগান্তকারী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। এই খাতে ১৯ সালে যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে, বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন আছে তার একটি অতি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা যায়।

নির্বাচনী ইশতেহারের আলোকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের আওতাধীন বাস্তবায়নযোগ্য বিষয়াদি চিহ্নিত করে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা চুড়ান্তকরণ এবং সেই আলোকে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।

১. ২০১৯ সালে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর সফল উৎক্ষেপণ পরবর্তী বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এর কার্যক্রম চালু হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের ৩৪টিরও বেশি টিভি চ্যানেল অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। বাংলাদেশের বাইরেও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের বাজারজাতকরণ শুরু হয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ নির্মাণ, উৎক্ষেপণ ও ব্যবহারের পথনকশা তৈরি করা হয়েছে; যার ভিত্তিতে ২০২৩ সালের মাঝেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণ করা যাবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

২. চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা ডিজিটাল শিল্প বিপ্লব বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিভ্যুলিউশন ফোর পয়েন্ট জিরোর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রযুক্তির অভাবনীয় সংস্করণ ফাইভ জি চালু করার লক্ষ্যে পথনকশা প্রণয়ন সম্পন্ন করা হয়েছে এবং ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ফাইভ জি চালু করার বিষয়ে অবকাঠামো তৈরির প্রস্তুতি চলছে। ৫জি কবে কোথায় সম্প্রসারিত হবে তারও পথনকশা তৈরি হয়েছে।

৩. এমএনপি সেবা চালু করা হয়েছে। এর ফলে মোবাইল গ্রাহকগণ নাম্বার ঠিক রেখে পছন্দমত যে কোন অপারেটর পরিবর্তন করতে পারছেন। যদিও শীর্ষ অপারেটরের সঙ্গে অন্য অপারেটরদের শক্তিমত্তা দুর্বল থাকায় এর সর্বোচ্চ ব্যবহার এখনও হয়ে ওঠেনি। অন্যদিকে মোবাইলের আইএমইআই ডাটা ব্যাংক চালু করার ফলে অবৈধভাবে মোবাইল আমদানির পথ বন্ধ হচ্ছে এবং মোবাইলে অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে। এছাড়াও টেলিকম সেবা সুনিশ্চিত কল্পে সময়োপযোগী বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন ও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বস্তুত বর্তমানে নীতিমালার ঘাটতি এখন নেই বললেই বলা যেতে পারে।

৪. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষে বিনা মাশুলে বিটিসিএল ল্যান্ডফোন সংযোগ ও পুনঃসংযোগ প্রদান কার্যক্রম চালু হয়েছে। বিটিসিএল এর স্থির ফোনলাইনে মাসে ১৫০ টাকায় যতখুশি তত কথা বলা যাচ্ছে। মাসিক লাইনরেন্ট উঠিয়ে নেয়া হয়েছে এবং ৫২ পয়সায় মিনিট যে কোন মোবাইল অপারেটরে কথা বলা যাচ্ছে। বিটিসিএলের ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের সর্বনিম্ন হার প্রতি এমবিপিএস ৩৬০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৮০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। স্মরণ করা দরকার ২০০৮ সালে এই মূল্য ২৭ হাজার টাকা ছিলো। বিটিসিএল ৫৮৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফ্রি ওয়াইফাই জোন চালু করার লক্ষ্যে কার্যক্রম চলমান রেখেছে। এর মাঝে ১০০টি সংযোগ প্রদানের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বিটিসিএলের টেলিকম সেবা আধুনিকায়নে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এমওটিএন প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এর ফলে বিদমান প্রযুক্তিকে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় উপজেলা পর্যন্ত বিটিসিএল তাদের প্রযুক্তিকে ডিজিটাল করতে সক্ষম হচ্ছে।

৫. ২৬ মার্চ ১৯ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধন করার পর ডাক বিভাগ মোবাইল আর্থিক সেবা সার্ভিস নগদ চালু করেছে। এরই মাঝে নগদ এর দৈনিক লেনদের শত কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। ডিজিটাল ডাক টাকা চালু করার আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। যে কোন দিন এই সেবা চালু হবে। ডাক সেবাকে ডিজিটাল ডাক সেবায় রূপান্তরের মাধ্যমে ডাক বিভাগের অবকাঠামোকে কার্যকর ডিজিটাল কমার্সের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সারা দেশে ডিজিটাল ডাক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে ১৯ হাজারের বেশি উদ্যোক্তাকে এসব কেন্দ্রের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা সরকারের সেবা জনগণের কাছে পৌঁছানোর পাশাপাশি জনগণকে অন্যান্য ডিজিটাল সেবা দিচ্ছে। আগারগাঁওয়ে আধুনিক ডাক ভবনের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনা এখন একটি আইকন ভবনে পরিণত হয়েছে। দেশব্যাপী নতুন ডাকঘর নির্মাণ ও পুরানো ডাকঘর সংস্কারের পাশাপাশি ১৪টি ডাক বাছাই কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।

৬. দেশে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের বর্ধিত চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে ২০২৩ সালের মার্চে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত সি-মি-উই ৬ এ যুক্ত হওয়ার জন্য এরই মাঝে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। সাবমেরিন ক্যাবল থেকে ব্যান্ডউইথের মূল্য সর্বনিম্ন ২৮৫ টাকায় নামানো হয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানির ব্যান্ডউইথ ব্যবহার ১ টেরাবাইট অতিক্রম করেছে।

৭. টেলিটক দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার নেটওয়ার্ক বিস্তারের কাজ করছে। প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। এর আওতায় সিলেট সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অধীন হাওরসমূহে এবং মাতারবাড়ি, হাতিয়া, ভাসানটেক প্রভৃতি দ্বীপ অঞ্চলে টেলিটকের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিটিআরসির সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল বা এসওএফ তহবিলের অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। ফলে দেশের সকল দুর্গম এলাকায় সর্বশেষ মোবাইল প্রযুক্তি সম্প্রসারিত হচ্ছে। এছাড়াও সারা দেশে টেলিটক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ণ করে ও বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। টেলিটকের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

৮. টেলিফোন শিল্প সংস্থা ডিজিটাল ডিভাইস নির্মাণের উপযোগী করে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং নতুন প্রজন্মের ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন বাজারে এসেছে। এই সংস্থার প্রচলিত পণ্য ফোন সেট, মিটার ইত্যাদির উৎপাদনতো অব্যাহত রয়েছেই। বাংলাদেশে উৎপাদিত তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানিবান্ধব প্রদত্ত সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইতোমধ্যে নেপাল ও নাইজেরিয়ায় কম্পিউটার/ল্যাপটপের বড় অংকের চালান রপ্তানি হচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানির বিষয়টি পাইপ লাইনে রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এক লাখ ডলারের মোবাইল সেট রপ্তানির আদেশ পাওয়া গেছে। নতুন বছরে এই রপ্তানির কাজটি সম্পন্ন হবে।

৯. গুণগতমানের অপটিক্যাল ফাইভারের বর্ধিত চাহিদা পূরণের জন্য খুলনা বাংলাদেশ ক্যাবল শিল্প লিমিটেড, খুলনাকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালে ৪,৪২০.১৪৫ কিমি. অপটিকাল ফাইবার, টেলিযোগাযোগ কপার ক্যাবল এবং ২,০৪৬.৫৫৭ কিমি. এইচডিপি সিলিকন ডাক্ট উৎপাদন করা হয়েছে। আইসিটি ডিভিশনের ‘কানেক্টেড বাংলাদেশ’ প্রকল্পে ৮,১০০ কিমি. অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল সরবরাহের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। উৎপাদন বহুমুখীকরণের অংশ হিসাবে প্রায় ২৪.১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বৈদ্যুতিক ওভারহেড কন্ডাক্টর, সার্ভিস ড্রপ ক্যাবল ও ইনস্যুলেটেড ওয়্যার তৈরির প্ল্যান্ট স্থাপন কার্যক্রম চলছে।

১০. এসওএফ তহবিলের অর্থায়নে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের কানেক্টেড বাংলাদেশ প্রকল্পের আওতায় ৭৩৬টি ইউনিয়নে ফাইবার অপটিক্স কানেকসন দেবার প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। একইভাবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের শিশু কানন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাস্তবায়িত হচ্ছে প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলে ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের কাজ।

১১. টেলিকম অধিদপ্তরের মাধ্যমে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সাইবার থ্রেড ডিটেকসন ও রেসপন্স প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রকল্পটির দ্বিতীয়পর্যায় বিবেচনাধীন রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি দেশের দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৫১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল শিক্ষা প্রবর্তন করছে।

মোবাইল অপারেটরদ্বয়ের পাওনা আদায়, সেবা ও কলরেট : নিবন্ধের শুরুতেই বলেছি যে, এই প্রসঙ্গগুলো ২০১৯ সালের বহুল আলোচিত বিষয় ছিলো। জিপি রবির পাওনার ইতিহাস ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। সরকারের পক্ষ থেকে হিসাব নিরীক্ষা করে এই পাওনা নির্ধারণ করা হয়। বস্তুত এর মাঝে একবার বিষয়টি আদালতে যায় এবং আদালতের নির্দেশে দ্বিতীয়বার নিরীক্ষা করে সরকারের পক্ষ থেকে দাবিনামা পেশ করা হয়। এ দাবিনামা পেশ করার পরিপ্রেক্ষিতে উভয় অপারেটর আলোচনার প্রস্তাব দিলে টেলিকম বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয় এবং দুই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা আলোচনায় যুক্ত হয়ে দুই অপারেটরকেই একটি সহজ সমাধান প্রদান করে। কিন্তু অপারেটরদ্বয় সেই সহজ সমাধান গ্রহণ না করে আদালতের শরণাপন্ন হয়। খুব সঙ্গতকারণেই বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারে থাকে। আদালতের সিদ্ধান্তই এই বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে। এরই মাঝে জিপি আন্তর্জাতিক আদালতে যাবার হুমকি দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে উকিল নোটিশ দিয়েছে; যা এই দেশের কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। অপারেটরদের এ আচরণের ফলে মোবাইলের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ বন্ধ ছিলো। সেবার মানও কমেছে। এরই মাঝে আদালতের আদেশে জিপি এক হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে ও আগামী তিন মাসে আরও এক হাজার কোটি টাকা প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রবিকে ৫ কিস্তিতে ১৩৮ কোটি টাকা পরিশোধের নির্দশ দেয়ার পর তারা দুই কিস্তির টাকা পরিশোধও করেছে। বাংলাদেশের টেলিকম খাতের জন্য এটি একটি বড় ধরনের মাইলফলক।

মোবাইলের সেবার মান যে নেমেছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সেটি যে অসহনীয় সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। বিষয়টি বিগত সংসদেও আলোচিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো দুটি বড় অপারেটর যারা সরকারের পাওনা পরিশোধ নিয়ে বিরোধে ছিলো এবং সেটিকে কেন্দ্র করে নানা জটিলতা সৃষ্টি করেছে তারা স্পেকট্রম বা নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। তারা তাদের মুনাফা বাড়াচ্ছে অথচ তাদের যে পরিমাণ স্পেকট্রাম ও বিটিএস দরকার তা মোটেই নেই। যেহেতু অন্য দুটি অপারেটর বাজার দখল, নেটওয়ার্ক বা সেবার মানে বড় দুটির চাইতে শক্তিশালী নয় সেহেতু আমরা যে কারণে এমএনপি নীতি চালু করেছিলাম এবং মোবাইলের একটি একক মূল্য নির্ধারণ করেছিলাম তা তেমনভাবে কাজে লাগেনি। বরং সেটি বড় দুই অপারেটরের পক্ষেই গেছে। এসবের অন্যতম সমাধান হচ্ছে টেলিটকসহ দুর্বল অপারেটরদের সক্ষমতা বাড়ানো। আমরা টেলিটককে শক্তিশালী করার জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছি। আশা করি টেলিটক শক্তিশালী হলে মোবাইল বাজারের একচেটিয়া দাপট থাকবে না। আমার বিশ্বাস মোবাইল অপারেটর বিষয়ক এসব জটিলতা ২০২০ সালে সমাপ্তির শেষ প্রান্তে পৌঁছবে।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

ঢাকা ॥ ৩ এপ্রিল, ২০২০।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান; সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার-বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা এর প্রণেতা]

mustafajabbar@gmail.com