ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষা খুবই জরুরি

মোহাম্মদ শাহজাহান

করোনাভাইরাস তিন মাসে বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটেছে গত এক মাসে। এমন আতঙ্কের মাস বর্তমান প্রজন্মের কেউ হয়তো আর দেখেনি। বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সন্ত্রাসসহ নানা কারণে শত শত মানুষ মারা গেছে। এর সবগুলোই ছিল অঞ্চলভিত্তিক। গত ডিসেম্বরের শুরুতেই চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়ে নোভেল করোনাভাইরাস। মাস খানেক আগে ১ মার্চ এই ভাইরাসে বিশ্বে মৃতের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৯৭৬ জন। এর মধ্যে ২ হাজার ৮৭০ জনই ছিল চীনের। তখন ৫৩টি দেশ ও অঞ্চলে এই ভাইরাসটি ছড়িয়েছিল। ৮৮ হাজার ৫৮৫ জন হয়েছিলেন আক্রান্ত। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ১ এপ্রিল বুধবার রাত ১১টা পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ৫৪১ জনে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৯ লাখ ১২ হাজার ৯৭ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৮৪ হাজার মানুষ। এ সময় ৪ হাজার ৮০৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ রোগের প্রতিষেধক কোনো ওষুধ এ পর্যন্ত আবিষ্কার না হওয়ায় লাশের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তবে যেখান থেকে এই ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু সেই চীনে মৃত্যুহার নিম্নগামী হলেও সংক্রমণের মহাধাক্কায় চরমভাবে বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য। কোভিড-১৯ বা করোনা সংক্রমণ জোরেশোরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে আফ্রিকা এবং এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও। এখন মার্চের বিভীষিকা ছাড়িয়ে গেছে এপ্রিলে। এই মুহূর্তে পরিস্থিতির ভয়াবহতা দেখে বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বর্তমান বিশ্ব আরেকটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ৩১ মার্চ সদর দপ্তরে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সম্ভাব্য আর্থ-সামাজিক প্রভার নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশকালে বলেছেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবজাতি ভয়াবহতম সংকটে পড়েছে। ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে যে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তা বিশ্বে কয়েক দশক ধরে বিরাজমান আপাত শান্তির জন্য প্রকৃত হুমকি হয়ে উঠেছে। কোভিড-১৯ রোগ বিশ্বের প্রত্যেক মানুষের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। এই সংকট যে অর্থনৈতিক মন্দা ডেকে আনছে, সাম্প্রতিক ইতিহাসে তার কোনো তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটি মানবিক সংকট। করোনাভাইরাস সমাজের গভীরে আঘাত হানছে।’

করোনা-যুদ্ধে জয়ী হতে সকল দেশই সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সংক্রমণ মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে এবং নিচ্ছে। তবে কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যেই বেশ সাফল্য দেখিয়েছে। করোনা মোকিবলায় বিশ্বের সামনে এক নম্বর উদাহরণ দক্ষিণ কোরিয়া। এশিয়ার অন্য দেশগুলো লকডাউনের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও দক্ষিণ কোরিয়া হেঁটেছে ভিন্নপথে। এই দেশ পরীক্ষার ওপর জোর দিয়েছে সবচেয়ে বেশি। ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই পরীক্ষা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে জোরদার করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হাসপাতালগুলোর সামনে পরীক্ষার বুথ খোলা হয় ফোনবুথের মতো। সেদেশের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা কোরিয়ান সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (কেসিডিসি) দেয়া তথ্যমতে, ১ এপ্রিল পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রায় ৪ লাখ ২১ হাজার ৫৪৭ জনকে পরীক্ষা করা হয়েছে। মোট জনসংখ্যা অনুযায়ী লাখ প্রতি ৮১৮ জনকে পরীক্ষা করা হয়েছে। জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যািলয়ের দেয়া তথ্যমতে, দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৯ হাজার ৯৭৬ জন। ইতিমধ্যে ১৬৯ জন মারা গেছেন। ৫ হাজার ৮২৮ জন সুস্থ আছেন। ২ এপ্রিল নতুন শনাক্ত হয়েছে ৮৯ জন এবং মারা গেছেন ৪ জন। করোনা মোকাবিলায় সিঙ্গাপুরও দক্ষিণ কোরিয়াকে অনুসরণ করছে। জানুয়ারি থেকেই সিঙ্গাপুরে পরীক্ষা কার্যক্রম জোরদার করা হয়। ২ এপ্রিল পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৪৯ জন, মারা গেছেন ৪ জন। ২ এপ্রিল পর্যন্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ৪৯ জন এবং মারা গেছেন ১ জন।

পরীক্ষা কার্যক্রমের ওপর বরাবরই জোর দিয়ে আসছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। তাছাড়া সামাজিক দূরত্বতো অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। ১৬ মার্চ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গোব্রেয়াসুস বলেন, ‘সব দেশের জন্য আমাদের একটি সাধারণ বার্তা হলো- পরীক্ষা, পরীক্ষা, পরীক্ষা। সন্দেহভাজন প্রত্যেককে পরীক্ষা করুন। যদি তারা করোনায় সংক্রমিত হন, তাদের পৃথক করুন এবং তাদের সংস্পর্শ আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত ও পরীক্ষা নিশ্চিত করুন।’ করোনা মোকাবিলায় জার্মানিতেও পরীক্ষার ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। জার্মানিতে করোনাভাইরাসের পরীক্ষার কাজটি করছে ওই দেশের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও দমন গবেষণা সংস্থা রবার্ঁ কোচ ইনস্টিটিউট। সংস্থাটির দেয়া বিপোর্টে বলা হয়েছে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত সে দেশের ৯ লাখ ১৮ হাজার ৪৬০ জনের পরীক্ষা করা হয়েছে। ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী জার্মানির বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৮ কোটি ২৮ লাখ। এই হিসাব মতে দেশটিতে প্রতি লাখে ১ হাজার ১০৯ জনকে পরীক্ষা করা হয়েছে। ভিয়েতনাম একেবারে চীন সীমান্তের লাগোয়া দেশ। দেশটি করোনা পরিস্থিতি খুবই দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিয়ে যাচ্ছে। ১ এপ্রিল পর্যন্ত করোনা সংক্রমণে শনাক্ত ২২৭ ব্যক্তির মধ্যে সবাই জীবিত রয়েছেন। ৭৫ জন সুস্থ হয়ে ফিরে গেছেন বাড়িতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী যথাযথভাবে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ায় তারা এই সাফল্য পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সার্কভুক্ত দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলংকা, নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটান করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এদের সাফল্যের মূলে রয়েছে করোনা শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি যথাসময়ে সব রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করার পদক্ষেপ নিয়েছে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ইতালিসহ কয়েকটি দেশে এই মহামারী কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। করোনাভাইরাসে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ও মৃত্যু ঘটছে যুক্তরাষ্ট্রে। এরপরই আছে স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ বহু দেশ। করোনার হানায় ৩ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ডসংখ্যক ১ হাজার ১৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। স্পেনে এদিন মারা গেছেন ৯৩২ জন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সার্বক্ষণিক হিসাব রাখা ওয়াল্ডওমিটারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ৩ এপ্রিল দিবাগত রাত ১২টা পর্যন্ত এতে আক্রান্ত হয়েছেন ১০ লাখ ৭৪ হাজার ২৯০ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ২ লাখ ২৬ হাজার ৫২ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। মারা গেছেন ৫৬ হাজার ৯৮৯ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ৩৯ হাজারের বেশি মানুষের মোট আক্রান্তের ৫ শতাংশের অবস্থা সংকটাপন্ন। করোনায় ৩ এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ৬৫ হাজার ৫০৬ জন। মারা গেছেন ৬ হাজার ৭৮৬ জন। করোনায় বিপর্যস্ত ইতালি ও স্পেনে যত মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, এর চেয়ে বেশি শনাক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। কিছু ভুলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে করোনা পরিস্থিতি আজকে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এই ভাইরাসকে ট্রাম্প প্রশাসন শুরুতে তেমন গুরুত্বই দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার ২ মাস পর পরিস্থিতি মহামারী রূপ নিয়েছে। এই ২ মাসে সরকার ভাইরাস মোকাবিলায় তেমন কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। টেস্ট কিট, ভেনটিলেটর, পিপিই, মাস্কসহ প্রয়োজনীয় উপকরণের মজুতও গড়ে তোলেনি যুক্তরাষ্ট্র সরকার। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কমসংখ্যক মানুষের পরীক্ষা করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে লকডাউনের ঘোষণাও আসে বিলম্বে।

২১ মার্চ হোয়াইট হাউজের করোনা টাস্কফোর্সের কর্মকর্তা ডা. ডেবোরা ব্রিক্স ও অ্যাটনি ফাউসি বলেন, ‘আগামী কয়েক সপ্তাহে বিশ্বে করোনা ভাইরাসে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা যেতে পারে।’ অথচ যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ২০ জানুয়ারি। এরপর ৫০ দিন রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ছাড়িয়ে যায় ১০ মার্চ। এরপর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা। ২২ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, করোনা পরিস্থিতি বেশ ভালোভাবেই আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’ ১০ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্পের মন্তব্য ছিল- ‘আমাদের দেশে মাত্র ১১ জন আক্রান্ত হয়েছে এবং তারাও সেরে উঠছেন।’ ২৫ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘আপনারা হয়তো করোনাভাইরাস নিয়ে প্রশ্ন করবেন। আমি বলছি, যুক্তরাষ্ট্রে বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আছে।’ বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। কেবল নিউইয়র্ক রাজ্যেই মৃতের সংখ্যা আড়াই হাজার স্পর্শ করেছে। আক্রান্তও মৃত্যু বিবেচনায় পরের অঙ্গরাজ্যগুলো হচ্ছেÑ নিউজার্সি, ক্যালিফোনিয়া, মিশিগান ও লুইজিয়ানা। ৩ এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে ২৪ ঘণ্টায় ৬৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনায়। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৫৬৩ জন। দেশটিতে মৃতের সংখ্যা ৩ এপ্রিল পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬০৫ জনে। মৃতদের মধ্যে ২ ব্রিটিশ নার্সও রয়েছেন। আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছেছে ৩৮ হাজার ১৬৮ জনে। করোনায় আক্রান্ত বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনগণ তাঁর স্বেচ্ছা অন্তরীণ অবস্থান থেকে ১ এপ্রিল রাতে এক ভিডিও বার্তায় নাগরিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘শনাক্তকরণ পরীক্ষার মাধ্যমেই এই রোগকে হারানো যাবে, সংকট পেরোনো যাবে।’ বার্তায় প্রধানমন্ত্রী শনাক্তকরণ পরীক্ষা ব্যাপকভাবে বাড়ানোর আশ্বাসও প্রদান করেন। কিন্তু সপ্তাহখানেক ধরেই বরিস জনগণ পরীক্ষা বাড়ানোর বিষয়টি বলে আসছেন। প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে মৃতের সংখ্যা বাড়তে দেখে হতাশ কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন ইতালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো আমরাও কি ভয়াবহতার দিকে ধাবিত হচ্ছি?’ প্রধানমন্ত্রীর ঘোর সমর্থক টেলিগ্রাফের শিরোনাম ছিল বেশ আক্রমণাত্মক। বড় বড় অক্ষরে ‘যেসব প্রশ্নের উত্তর নেই।’ উপশিরোনাম : শনাক্তকরণ পরীক্ষায় ব্রিটেন অন্য দেশগুলো থেকে পিছিয়ে কেন সরকার বলতে পারে না, এত কম সংখ্যায় স্বাস্থ্যকর্মীর পরীক্ষা হয়েছে কেন এবং অ্যান্টিবডি (শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধক) পরীক্ষা কবে হবে?

স্পেনে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত মৃত্যু বেড়ে পৌঁছেছে ১০ হাজার ৯৩৫ জনে এবং আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছেছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৭১০ জনে। তবে স্পেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, সে দেশে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমছে। এদিকে জার্মানিতে আক্রান্ত সংখ্যা চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। তবে তারা মৃতের সংখ্যা সর্বনিম্নে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ৩ এপ্রিল পর্যন্ত জার্মানিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৮৭ হাজার ২৪৪ জন। মারা গেছেন ১ হাজার ১৩৮ জন। জার্মান সরকার বলছে, তারা করোনার বিস্তার রোধে যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে তা কাজে দিচ্ছে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনাভাইরাস রিসোর্স সেন্টারের হিসাব মতে, ৪ এপ্রিল শনিবার রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ সারা বিশ্বে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৫৯ হাজার ৫১৫ জন। আর সুস্থ হয়ে উঠেছেন ২ লাখ ৩৭ হাজার ৪৩৬ জন। গ্রিনিচ মান সময়ের (জিএমটি) সঙ্গে মিলিয়ে প্রতিদিনকার মৃত্যুর হিসাব রাখছে ওয়াল্ডওমিটারস ডট ইনফো। তাদের হিসাব মতে, বাংলাদেশ সময় ৩ এপ্রিল শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা বিশ্বে মোট আক্রান্ত হন ১ লাখ ১ হাজার ৫৭৮ জন। এর আগে একদিনে এত মানুষ আক্রান্ত হননি। আগেরদিন আক্রান্ত হয়েছিলেন ৭৯ হাজার ৮৬৪ জন। আর ওই ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৫ হাজার ৯৯০ জন। এটাও একদিনে সর্বোচ্চ রেকর্ড। এর আগের রেকর্ড ছিল একদিন আগে ৫ হাজার ৯৭৪ জন।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মহামারী মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যায়ের একটি টেকনিক্যাল কমিটি রয়েছে। ভাইরাস প্রতিরোধে গৃহীত স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পর্যালোচনা ও সমন্বয়ে প্রত্যেক বিভাগে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় পর্যায়ে একটি কমিটি রয়েছে। একই সঙ্গে জেলা প্রশাসকের (ডিসি) নেতৃত্বে জেলা কমিটি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে উপজেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটি করা হয়েছে। এমন উল্লেখ করার মতো তৎপরতা সত্ত্বেও দেশে করোনার সংক্রমণ ও এর বিস্তৃতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনার উপসর্গ বা লক্ষণ নিয়ে প্রতিদিনই লোকজন মারা যাচ্ছেন। তাদের অনেকেরই নমুনা সংগ্রহ বা পরীক্ষা করা হচ্ছে না। যে জন্য দেশে কোথায় কতজন করোনায় আক্রান্ত রোগী রয়েছে এ নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হচ্ছে। এই ধোঁয়াশা থেকে যে কোনো মূল্যে বের হয়ে আসতে হবে। করোনা ধোঁয়াশা থেকে নানা রকম গুজব বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে দেখা গেছে, মারা যাওয়ার তিনদিন পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ‘মৃতের নমুনা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গেছে তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ’ ২৯ মার্চ রোববার শ্বাসকষ্ট ও জ্বরে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার রসুলবাগে ৪৫ বছর বয়সের এক নারীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হয়। ঢামেক কর্তৃপক্ষ রোগী ভর্তি না করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। স্বজনরা রোগীকে বাড়িতে নিয়ে যান। বাড়িতে অবস্থার অবনতি ঘটলে ওই অসুস্থ নারীকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নেয়ার পর তিনি মারা যান। স্বজনরা লাশ নারায়ণগঞ্জ স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করেন। কুর্মিটোলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মারা যাওয়া রোগীর নমুনা আইইডিসিআরে পাঠায়। তিনদিন পর আইইডিসিআর জানায়, ওই নারীর করোনা ভাইরাস পজিটিভ ছিল অর্থাৎ তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। এই ঘটনা ২ এপ্রিল ঘটেছে। খবর পেয়ে জেলা প্রশাসন ২ এপ্রিল রাতেই মারা যাওয়া নারীর এলাকায় লকডাউন ঘোষণা করে। স্বাভাবিক কারণেই আশপাশের লোকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক।

৫ এপ্রিল রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৬৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। আগের ২৪ ঘণ্টায় ৪৩৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে মৃতের সংখ্যা ১ জন বেড়ে ৮ থেকে ৯ জন হয়েছে। উল্লেখ্য, ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্তের ঘোষণা দেয়া হয়। ৪ এপ্রিল পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৭০ জন। ৫ এপ্রিল ১৮ জন বেড়ে আক্রান্তের সংখ্যা হলো ৮৮ জন। নতুন ৩ জন সুস্থ হয়েছেন। এই নিয়ে মোট সুস্থ মানুষের সংখ্যা ৫৫ জন। করোনা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বারবার তাগিদ দিয়ে বলছে, সব দেশের প্রতি আমাদের উপদেশ- ‘পরীক্ষা, পরীক্ষা, পরীক্ষা।’ গত দুদিনে (৩ ও ৪ এপ্রিল) পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। বাংলাদেশের জনঘনত্ব ও এখানকার মানুষের জীবনযাপনের ধরন বিবেচনায় নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞই আমাদের দেশকে উচ্চ ঝুঁকির দেশ হিসেবে বিবেচনা করছেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। অতি সম্প্র্রতি বিদেশ থেকে ৭ লাখ মানুষ দেশে এসেছেন। এদের অনেকেই এসেছেন করোনার মৃত্যুপুরী ইতালি থেকে। কিন্তু পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৬৮ জনের। এই ৭ লাখ মানুষ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা কত লাখ মানুষের সংস্পর্শে গেছেন, সেই হিসাবও কারো জানা নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, ‘অজ্ঞাত কোনো মানুষ যদি করোনা বহন করে সবার সঙ্গে চলাফেরা ও মেলামেশা করে, তাহলে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। দ্রুত শনাক্ত করা গেলে দেশ রক্ষা পাবে, ডাক্তার-নার্স রক্ষা পাবেন, জনগণ রক্ষা পাবেন। আমরা কেউই সুরক্ষিত নয়। এমতাবস্থায় যে কোনো মূল্যে শনাক্তকরণ ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।’ বাংলাদেশে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৪৩৪ জনের নমুনা পরীক্ষার পর আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৬১ জন থেকে বেড়ে ৭০ জন আর ৫ এপ্রিল ৩৬৭ জনের পরীক্ষার পর ১৮ জন বেড়ে রোগীর সংখ্যা ৭০ থেকে ৮৮ জন। তাহলে দেখা যায়, ৮০১ (৪৩৪+৩৬৭) জনের নমুনা পরীক্ষায় সংক্রমণের সংখ্যা বাড়লো ২৭ জন। তাহলে ১৭ কোটি মানুষের দেশে ১৭ লাখ সন্দেহভাজন ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষা করা হলে সেই হারে রোগীর সংখ্যা একটি ভয়াবহ সংখ্যায় গিয়ে দাঁড়াবে। এমতাবস্থায় দেশকে বাঁচাতে, দেশের মানুষকে বাঁচাতে ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষা যেমন জরুরি তেমনি যুদ্ধকালীন অবস্থা বিবেচনা করে জনসাধারণকে ধরে রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ দুটি কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার পথ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই খুঁজে বের করতে হবে।

৫ এপ্রিল ২০২০

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্র বিষয়ে গবেষক; সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা সম্পাদক]

bandhu.ch77@yahoo.com

মঙ্গলবার, ০৭ এপ্রিল ২০২০ , ২৪ চৈত্র ১৪২৬, ১২ শাবান ১৪৪১

ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষা খুবই জরুরি

মোহাম্মদ শাহজাহান

করোনাভাইরাস তিন মাসে বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটেছে গত এক মাসে। এমন আতঙ্কের মাস বর্তমান প্রজন্মের কেউ হয়তো আর দেখেনি। বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সন্ত্রাসসহ নানা কারণে শত শত মানুষ মারা গেছে। এর সবগুলোই ছিল অঞ্চলভিত্তিক। গত ডিসেম্বরের শুরুতেই চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়ে নোভেল করোনাভাইরাস। মাস খানেক আগে ১ মার্চ এই ভাইরাসে বিশ্বে মৃতের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৯৭৬ জন। এর মধ্যে ২ হাজার ৮৭০ জনই ছিল চীনের। তখন ৫৩টি দেশ ও অঞ্চলে এই ভাইরাসটি ছড়িয়েছিল। ৮৮ হাজার ৫৮৫ জন হয়েছিলেন আক্রান্ত। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ১ এপ্রিল বুধবার রাত ১১টা পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ৫৪১ জনে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৯ লাখ ১২ হাজার ৯৭ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৮৪ হাজার মানুষ। এ সময় ৪ হাজার ৮০৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ রোগের প্রতিষেধক কোনো ওষুধ এ পর্যন্ত আবিষ্কার না হওয়ায় লাশের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তবে যেখান থেকে এই ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু সেই চীনে মৃত্যুহার নিম্নগামী হলেও সংক্রমণের মহাধাক্কায় চরমভাবে বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য। কোভিড-১৯ বা করোনা সংক্রমণ জোরেশোরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে আফ্রিকা এবং এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও। এখন মার্চের বিভীষিকা ছাড়িয়ে গেছে এপ্রিলে। এই মুহূর্তে পরিস্থিতির ভয়াবহতা দেখে বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বর্তমান বিশ্ব আরেকটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ৩১ মার্চ সদর দপ্তরে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সম্ভাব্য আর্থ-সামাজিক প্রভার নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশকালে বলেছেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবজাতি ভয়াবহতম সংকটে পড়েছে। ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে যে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তা বিশ্বে কয়েক দশক ধরে বিরাজমান আপাত শান্তির জন্য প্রকৃত হুমকি হয়ে উঠেছে। কোভিড-১৯ রোগ বিশ্বের প্রত্যেক মানুষের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। এই সংকট যে অর্থনৈতিক মন্দা ডেকে আনছে, সাম্প্রতিক ইতিহাসে তার কোনো তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটি মানবিক সংকট। করোনাভাইরাস সমাজের গভীরে আঘাত হানছে।’

করোনা-যুদ্ধে জয়ী হতে সকল দেশই সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সংক্রমণ মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে এবং নিচ্ছে। তবে কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যেই বেশ সাফল্য দেখিয়েছে। করোনা মোকিবলায় বিশ্বের সামনে এক নম্বর উদাহরণ দক্ষিণ কোরিয়া। এশিয়ার অন্য দেশগুলো লকডাউনের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও দক্ষিণ কোরিয়া হেঁটেছে ভিন্নপথে। এই দেশ পরীক্ষার ওপর জোর দিয়েছে সবচেয়ে বেশি। ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই পরীক্ষা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে জোরদার করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হাসপাতালগুলোর সামনে পরীক্ষার বুথ খোলা হয় ফোনবুথের মতো। সেদেশের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা কোরিয়ান সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (কেসিডিসি) দেয়া তথ্যমতে, ১ এপ্রিল পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রায় ৪ লাখ ২১ হাজার ৫৪৭ জনকে পরীক্ষা করা হয়েছে। মোট জনসংখ্যা অনুযায়ী লাখ প্রতি ৮১৮ জনকে পরীক্ষা করা হয়েছে। জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যািলয়ের দেয়া তথ্যমতে, দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৯ হাজার ৯৭৬ জন। ইতিমধ্যে ১৬৯ জন মারা গেছেন। ৫ হাজার ৮২৮ জন সুস্থ আছেন। ২ এপ্রিল নতুন শনাক্ত হয়েছে ৮৯ জন এবং মারা গেছেন ৪ জন। করোনা মোকাবিলায় সিঙ্গাপুরও দক্ষিণ কোরিয়াকে অনুসরণ করছে। জানুয়ারি থেকেই সিঙ্গাপুরে পরীক্ষা কার্যক্রম জোরদার করা হয়। ২ এপ্রিল পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৪৯ জন, মারা গেছেন ৪ জন। ২ এপ্রিল পর্যন্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ৪৯ জন এবং মারা গেছেন ১ জন।

পরীক্ষা কার্যক্রমের ওপর বরাবরই জোর দিয়ে আসছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। তাছাড়া সামাজিক দূরত্বতো অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। ১৬ মার্চ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গোব্রেয়াসুস বলেন, ‘সব দেশের জন্য আমাদের একটি সাধারণ বার্তা হলো- পরীক্ষা, পরীক্ষা, পরীক্ষা। সন্দেহভাজন প্রত্যেককে পরীক্ষা করুন। যদি তারা করোনায় সংক্রমিত হন, তাদের পৃথক করুন এবং তাদের সংস্পর্শ আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত ও পরীক্ষা নিশ্চিত করুন।’ করোনা মোকাবিলায় জার্মানিতেও পরীক্ষার ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। জার্মানিতে করোনাভাইরাসের পরীক্ষার কাজটি করছে ওই দেশের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও দমন গবেষণা সংস্থা রবার্ঁ কোচ ইনস্টিটিউট। সংস্থাটির দেয়া বিপোর্টে বলা হয়েছে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত সে দেশের ৯ লাখ ১৮ হাজার ৪৬০ জনের পরীক্ষা করা হয়েছে। ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী জার্মানির বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৮ কোটি ২৮ লাখ। এই হিসাব মতে দেশটিতে প্রতি লাখে ১ হাজার ১০৯ জনকে পরীক্ষা করা হয়েছে। ভিয়েতনাম একেবারে চীন সীমান্তের লাগোয়া দেশ। দেশটি করোনা পরিস্থিতি খুবই দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিয়ে যাচ্ছে। ১ এপ্রিল পর্যন্ত করোনা সংক্রমণে শনাক্ত ২২৭ ব্যক্তির মধ্যে সবাই জীবিত রয়েছেন। ৭৫ জন সুস্থ হয়ে ফিরে গেছেন বাড়িতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী যথাযথভাবে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ায় তারা এই সাফল্য পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সার্কভুক্ত দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলংকা, নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটান করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এদের সাফল্যের মূলে রয়েছে করোনা শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি যথাসময়ে সব রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করার পদক্ষেপ নিয়েছে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ইতালিসহ কয়েকটি দেশে এই মহামারী কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। করোনাভাইরাসে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ও মৃত্যু ঘটছে যুক্তরাষ্ট্রে। এরপরই আছে স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ বহু দেশ। করোনার হানায় ৩ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ডসংখ্যক ১ হাজার ১৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। স্পেনে এদিন মারা গেছেন ৯৩২ জন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সার্বক্ষণিক হিসাব রাখা ওয়াল্ডওমিটারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ৩ এপ্রিল দিবাগত রাত ১২টা পর্যন্ত এতে আক্রান্ত হয়েছেন ১০ লাখ ৭৪ হাজার ২৯০ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ২ লাখ ২৬ হাজার ৫২ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। মারা গেছেন ৫৬ হাজার ৯৮৯ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ৩৯ হাজারের বেশি মানুষের মোট আক্রান্তের ৫ শতাংশের অবস্থা সংকটাপন্ন। করোনায় ৩ এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ৬৫ হাজার ৫০৬ জন। মারা গেছেন ৬ হাজার ৭৮৬ জন। করোনায় বিপর্যস্ত ইতালি ও স্পেনে যত মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, এর চেয়ে বেশি শনাক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। কিছু ভুলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে করোনা পরিস্থিতি আজকে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এই ভাইরাসকে ট্রাম্প প্রশাসন শুরুতে তেমন গুরুত্বই দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার ২ মাস পর পরিস্থিতি মহামারী রূপ নিয়েছে। এই ২ মাসে সরকার ভাইরাস মোকাবিলায় তেমন কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। টেস্ট কিট, ভেনটিলেটর, পিপিই, মাস্কসহ প্রয়োজনীয় উপকরণের মজুতও গড়ে তোলেনি যুক্তরাষ্ট্র সরকার। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কমসংখ্যক মানুষের পরীক্ষা করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে লকডাউনের ঘোষণাও আসে বিলম্বে।

২১ মার্চ হোয়াইট হাউজের করোনা টাস্কফোর্সের কর্মকর্তা ডা. ডেবোরা ব্রিক্স ও অ্যাটনি ফাউসি বলেন, ‘আগামী কয়েক সপ্তাহে বিশ্বে করোনা ভাইরাসে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা যেতে পারে।’ অথচ যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ২০ জানুয়ারি। এরপর ৫০ দিন রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ছাড়িয়ে যায় ১০ মার্চ। এরপর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা। ২২ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, করোনা পরিস্থিতি বেশ ভালোভাবেই আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’ ১০ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্পের মন্তব্য ছিল- ‘আমাদের দেশে মাত্র ১১ জন আক্রান্ত হয়েছে এবং তারাও সেরে উঠছেন।’ ২৫ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘আপনারা হয়তো করোনাভাইরাস নিয়ে প্রশ্ন করবেন। আমি বলছি, যুক্তরাষ্ট্রে বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আছে।’ বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। কেবল নিউইয়র্ক রাজ্যেই মৃতের সংখ্যা আড়াই হাজার স্পর্শ করেছে। আক্রান্তও মৃত্যু বিবেচনায় পরের অঙ্গরাজ্যগুলো হচ্ছেÑ নিউজার্সি, ক্যালিফোনিয়া, মিশিগান ও লুইজিয়ানা। ৩ এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে ২৪ ঘণ্টায় ৬৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনায়। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৫৬৩ জন। দেশটিতে মৃতের সংখ্যা ৩ এপ্রিল পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬০৫ জনে। মৃতদের মধ্যে ২ ব্রিটিশ নার্সও রয়েছেন। আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছেছে ৩৮ হাজার ১৬৮ জনে। করোনায় আক্রান্ত বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনগণ তাঁর স্বেচ্ছা অন্তরীণ অবস্থান থেকে ১ এপ্রিল রাতে এক ভিডিও বার্তায় নাগরিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘শনাক্তকরণ পরীক্ষার মাধ্যমেই এই রোগকে হারানো যাবে, সংকট পেরোনো যাবে।’ বার্তায় প্রধানমন্ত্রী শনাক্তকরণ পরীক্ষা ব্যাপকভাবে বাড়ানোর আশ্বাসও প্রদান করেন। কিন্তু সপ্তাহখানেক ধরেই বরিস জনগণ পরীক্ষা বাড়ানোর বিষয়টি বলে আসছেন। প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে মৃতের সংখ্যা বাড়তে দেখে হতাশ কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন ইতালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো আমরাও কি ভয়াবহতার দিকে ধাবিত হচ্ছি?’ প্রধানমন্ত্রীর ঘোর সমর্থক টেলিগ্রাফের শিরোনাম ছিল বেশ আক্রমণাত্মক। বড় বড় অক্ষরে ‘যেসব প্রশ্নের উত্তর নেই।’ উপশিরোনাম : শনাক্তকরণ পরীক্ষায় ব্রিটেন অন্য দেশগুলো থেকে পিছিয়ে কেন সরকার বলতে পারে না, এত কম সংখ্যায় স্বাস্থ্যকর্মীর পরীক্ষা হয়েছে কেন এবং অ্যান্টিবডি (শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধক) পরীক্ষা কবে হবে?

স্পেনে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত মৃত্যু বেড়ে পৌঁছেছে ১০ হাজার ৯৩৫ জনে এবং আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছেছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৭১০ জনে। তবে স্পেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, সে দেশে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমছে। এদিকে জার্মানিতে আক্রান্ত সংখ্যা চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। তবে তারা মৃতের সংখ্যা সর্বনিম্নে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ৩ এপ্রিল পর্যন্ত জার্মানিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৮৭ হাজার ২৪৪ জন। মারা গেছেন ১ হাজার ১৩৮ জন। জার্মান সরকার বলছে, তারা করোনার বিস্তার রোধে যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে তা কাজে দিচ্ছে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনাভাইরাস রিসোর্স সেন্টারের হিসাব মতে, ৪ এপ্রিল শনিবার রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ সারা বিশ্বে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৫৯ হাজার ৫১৫ জন। আর সুস্থ হয়ে উঠেছেন ২ লাখ ৩৭ হাজার ৪৩৬ জন। গ্রিনিচ মান সময়ের (জিএমটি) সঙ্গে মিলিয়ে প্রতিদিনকার মৃত্যুর হিসাব রাখছে ওয়াল্ডওমিটারস ডট ইনফো। তাদের হিসাব মতে, বাংলাদেশ সময় ৩ এপ্রিল শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা বিশ্বে মোট আক্রান্ত হন ১ লাখ ১ হাজার ৫৭৮ জন। এর আগে একদিনে এত মানুষ আক্রান্ত হননি। আগেরদিন আক্রান্ত হয়েছিলেন ৭৯ হাজার ৮৬৪ জন। আর ওই ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৫ হাজার ৯৯০ জন। এটাও একদিনে সর্বোচ্চ রেকর্ড। এর আগের রেকর্ড ছিল একদিন আগে ৫ হাজার ৯৭৪ জন।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মহামারী মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যায়ের একটি টেকনিক্যাল কমিটি রয়েছে। ভাইরাস প্রতিরোধে গৃহীত স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পর্যালোচনা ও সমন্বয়ে প্রত্যেক বিভাগে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় পর্যায়ে একটি কমিটি রয়েছে। একই সঙ্গে জেলা প্রশাসকের (ডিসি) নেতৃত্বে জেলা কমিটি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে উপজেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটি করা হয়েছে। এমন উল্লেখ করার মতো তৎপরতা সত্ত্বেও দেশে করোনার সংক্রমণ ও এর বিস্তৃতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনার উপসর্গ বা লক্ষণ নিয়ে প্রতিদিনই লোকজন মারা যাচ্ছেন। তাদের অনেকেরই নমুনা সংগ্রহ বা পরীক্ষা করা হচ্ছে না। যে জন্য দেশে কোথায় কতজন করোনায় আক্রান্ত রোগী রয়েছে এ নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হচ্ছে। এই ধোঁয়াশা থেকে যে কোনো মূল্যে বের হয়ে আসতে হবে। করোনা ধোঁয়াশা থেকে নানা রকম গুজব বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে দেখা গেছে, মারা যাওয়ার তিনদিন পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ‘মৃতের নমুনা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গেছে তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ’ ২৯ মার্চ রোববার শ্বাসকষ্ট ও জ্বরে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার রসুলবাগে ৪৫ বছর বয়সের এক নারীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হয়। ঢামেক কর্তৃপক্ষ রোগী ভর্তি না করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। স্বজনরা রোগীকে বাড়িতে নিয়ে যান। বাড়িতে অবস্থার অবনতি ঘটলে ওই অসুস্থ নারীকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নেয়ার পর তিনি মারা যান। স্বজনরা লাশ নারায়ণগঞ্জ স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করেন। কুর্মিটোলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মারা যাওয়া রোগীর নমুনা আইইডিসিআরে পাঠায়। তিনদিন পর আইইডিসিআর জানায়, ওই নারীর করোনা ভাইরাস পজিটিভ ছিল অর্থাৎ তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। এই ঘটনা ২ এপ্রিল ঘটেছে। খবর পেয়ে জেলা প্রশাসন ২ এপ্রিল রাতেই মারা যাওয়া নারীর এলাকায় লকডাউন ঘোষণা করে। স্বাভাবিক কারণেই আশপাশের লোকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক।

৫ এপ্রিল রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৬৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। আগের ২৪ ঘণ্টায় ৪৩৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে মৃতের সংখ্যা ১ জন বেড়ে ৮ থেকে ৯ জন হয়েছে। উল্লেখ্য, ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্তের ঘোষণা দেয়া হয়। ৪ এপ্রিল পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৭০ জন। ৫ এপ্রিল ১৮ জন বেড়ে আক্রান্তের সংখ্যা হলো ৮৮ জন। নতুন ৩ জন সুস্থ হয়েছেন। এই নিয়ে মোট সুস্থ মানুষের সংখ্যা ৫৫ জন। করোনা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বারবার তাগিদ দিয়ে বলছে, সব দেশের প্রতি আমাদের উপদেশ- ‘পরীক্ষা, পরীক্ষা, পরীক্ষা।’ গত দুদিনে (৩ ও ৪ এপ্রিল) পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। বাংলাদেশের জনঘনত্ব ও এখানকার মানুষের জীবনযাপনের ধরন বিবেচনায় নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞই আমাদের দেশকে উচ্চ ঝুঁকির দেশ হিসেবে বিবেচনা করছেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। অতি সম্প্র্রতি বিদেশ থেকে ৭ লাখ মানুষ দেশে এসেছেন। এদের অনেকেই এসেছেন করোনার মৃত্যুপুরী ইতালি থেকে। কিন্তু পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৬৮ জনের। এই ৭ লাখ মানুষ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা কত লাখ মানুষের সংস্পর্শে গেছেন, সেই হিসাবও কারো জানা নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, ‘অজ্ঞাত কোনো মানুষ যদি করোনা বহন করে সবার সঙ্গে চলাফেরা ও মেলামেশা করে, তাহলে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। দ্রুত শনাক্ত করা গেলে দেশ রক্ষা পাবে, ডাক্তার-নার্স রক্ষা পাবেন, জনগণ রক্ষা পাবেন। আমরা কেউই সুরক্ষিত নয়। এমতাবস্থায় যে কোনো মূল্যে শনাক্তকরণ ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।’ বাংলাদেশে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৪৩৪ জনের নমুনা পরীক্ষার পর আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৬১ জন থেকে বেড়ে ৭০ জন আর ৫ এপ্রিল ৩৬৭ জনের পরীক্ষার পর ১৮ জন বেড়ে রোগীর সংখ্যা ৭০ থেকে ৮৮ জন। তাহলে দেখা যায়, ৮০১ (৪৩৪+৩৬৭) জনের নমুনা পরীক্ষায় সংক্রমণের সংখ্যা বাড়লো ২৭ জন। তাহলে ১৭ কোটি মানুষের দেশে ১৭ লাখ সন্দেহভাজন ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষা করা হলে সেই হারে রোগীর সংখ্যা একটি ভয়াবহ সংখ্যায় গিয়ে দাঁড়াবে। এমতাবস্থায় দেশকে বাঁচাতে, দেশের মানুষকে বাঁচাতে ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষা যেমন জরুরি তেমনি যুদ্ধকালীন অবস্থা বিবেচনা করে জনসাধারণকে ধরে রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ দুটি কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার পথ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই খুঁজে বের করতে হবে।

৫ এপ্রিল ২০২০

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্র বিষয়ে গবেষক; সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা সম্পাদক]

bandhu.ch77@yahoo.com