পরীক্ষা, পরীক্ষা এবং পরীক্ষা

খন্দকার মুনতাসীর মামুন

করোনা শনাক্তের জন্য পরীক্ষা করতেই হবে। করোনার বিস্তার ঠেকানোর প্রধান উপায় হলো করোনা সংক্রমিত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা, তাদের বিচ্ছিন্ন করা এবং সংক্রমিতরা কাদের সংস্পর্শে এসেছে, তাদের খুঁজে বের করে কোয়ারেন্টিনে রাখা। এজন্য সন্দেহভাজন সব মানুষকে পরীক্ষার আওতায় আনা জরুরি। আর এজন্য করোনা ভাইরাস নিয়ে নতুন সতর্ক বার্তা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তাদের বার্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লাইন হচ্ছে- ‘টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট।’

ইউরোপ, আমেরিকার মতো পশ্চিম বিশ্বে কার্যত মহামারীর চেহারা নিয়েছে করোনাভাইরাস। তার আগে চীনে মৃত্যু হয়েছে হাজার হাজার মানুষের। গোটা বিশ্ব কার্যত অবরুদ্ধ। ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, আমেরিকায় প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। কিন্তু সেই তুলনায় ভারতীয় উপমহাদেশ কিংবা আফ্রিকায় আক্রান্তের সংখ্যা অনেকটাই কম। এর কারণ কি এ সমস্ত জায়গায় করোনার প্রকোপ কম, নাকি সাধারণ মানুষ করোনার লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও হাসপাতালে যাচ্ছেন না? এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কবার্তাতেও সে প্রশ্নেরই ইঙ্গিত রয়েছে। তথ্য বলছে, অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলোতে সাধারণ মানুষ শরীর খারাপ হলেও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাচ্ছেন না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতি ১০ লাখে ৪ হাজার ৪০০ জন মানুষ করোনার পরীক্ষা করাচ্ছেন। সেখানে ভারতে প্রতি ১০ লাখে করোনা পরীক্ষা করাতে যাচ্ছেন মাত্র তিনজন। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলোতে করোনার সংক্রমণ কতটা ঘটছে, এখনও তা স্পষ্ট করে বোঝাই যাচ্ছে না। প্রথম পর্বে চিকিৎসা হলে করোনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কিন্তু তা গোপন করলে মৃত্যুর আশঙ্কা বাড়ে। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মৃত্যুর হার হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি আরও একটি প্রশ্ন উঠছে- এ সমস্ত দেশে করোনা পরীক্ষা করার যথেষ্ট বন্দোবস্ত আছে তো?

ক’দিন আগেও বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরীক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) নির্ধারিত ফোন নম্বরে কল করে সিংহভাগ মানুষ কাক্সিক্ষত সেবা পায়নি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টে গেছে। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের কথা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রথম স্বীকার করা হয় গত ৮ মার্চ। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ১২৩। মৃতের সংখ্যা ১২। এর আগে তিনদিনে-প্রতিদিন দ্বিগুণ হয়েছে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা; সংখ্যাগািল হচ্ছে ৯-১৮-৩৫. যদিও এ সময়ের মধ্যে করোনার উপসর্গ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক অসুস্থ ব্যক্তি মারা গেছেন। কিন্তু যেহেতু মৃত্যুর আগে তাদের করোনা পরীক্ষা করা হয়নি এবং মৃত্যুর পর সংগৃহীত নমুনায় কি পাওয়া গেছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা জানা যাচ্ছে না, তাই তারা জ্বর, গলা ব্যথা, শ্বাসকষ্ট বা খুসখুসে কাশি রোগে মারা গেছেন বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। দেশে এসব রোগে মৃত্যুর সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়াও নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তার বিষয়।

তবে এর চেয়েও উদ্বেগের বিষয় হলো, করোনাভাইরাসের লক্ষণ-উপসর্গ আছে পরীক্ষার জন্য এমন মানুষ নাকি খুঁজে পাচ্ছে না স্বাস্থ্য অধিদফতর। টেলিফোনে দেয়া ঠিকানা ও ফোন নম্বর ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়েও তাদের অধিকাংশের খোঁজ মিলছে না। অনেকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগও করা যাচ্ছে না। ফলে বিপুলসংখ্যক সন্দেহভাজন ব্যক্তি থেকে যাচ্ছেন করোনা পরীক্ষার বাইরে। এ পরিস্থিতি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

পরীক্ষার পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ অত্যন্ত ভালো। তবে এটি নিয়ে সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দুপুরে একজন পরিচালক এক ধরনের বক্তব্য দিলেন; আবার বিকালে মহাপরিচালক অন্য ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। পরীক্ষার পরিধি বাড়াতেই হবে। যত বেশি মানুষকে পরীক্ষার আওতায় আনা যাবে ততই ভালো হবে। কারণ বেশি পরীক্ষা হলে আক্রান্ত ব্যক্তি বেশি শনাক্ত হবে এবং তাকে আইসোলেশনে নেয়ার পাশাপাশি ওই ব্যক্তির সংস্পর্শে থাকা অন্য ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিনে নেয়া হবে। এতে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না। সুতরাং ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য সবার আগে পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ ও আইইডিসিআর কর্মকর্তারা এতদিন ধরে বিষয়টি কেন অনুধাবন করতে পারলেন না, সেটি তাদের কাছে জানতে চাওয়া প্রয়োজন।

সামাজিকভাবে সংক্রমণ শুরু হয়েছে বলেই বিদেশ ফেরতদের পরিবারের সদস্যের বাইরের মানুষও আক্রান্ত হয়েছে, মারা গেছে। এমন একটি মৃত্যুর পর ওই এলাকা লকডাউন করা হয়েছে। করোনা বেশি ছড়িয়েছে কিনা, সেটি জানতে হলে পরীক্ষার হার বাড়াতে হবে। অল্প কিছু টেস্ট করে এটি নিশ্চিত হয়ে বসে থাকলে বিপদ আসন্ন। করোনার সংক্রমণ যাদের মধ্যে রয়েছে, তাদের শনাক্ত করতে দেরি হলে এবং আক্রান্তদের আইসোলেশনে চিকিৎসাসেবা দেয়া না হলে সংক্রমণ ছড়াতেই থাকবে। পরবর্তীকালে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ধারণা করা হচ্ছে, লক্ষণ-উপসর্গ নিয়ে অনেকেই আত্মগোপন করেছেন। অথচ সন্দেহভাজনের উচিত তাদের নিজেদের জন্য, পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য এবং আশপাশের মানুষের ভালোর জন্য স্বেচ্ছায় পরীক্ষা করানো। প্রয়োজনে কোয়ারেন্টিনে যাওয়া। বরং সেটা না করা হলেই নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের বিপদ বাড়বে।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যে হারে পরীক্ষা চলছে, তাকে নিতান্ত অপ্রতুল বলেও বোঝানো যাবে না। এটা সিন্ধুতে এক বিন্দু পানি ফেলার চেয়েও কম। পরীক্ষার বিষয়টি শুধু সরকার সামলাতে পারবে না। তার একার হাতে রাখাও ঠিক হচ্ছে না। লকডাউন করতে গিয়ে বাংলাদেশ একটি গুরুতর ভুল করেছে। শহর ছিল বাংলাদেশের জন্য হটস্পট। গ্রামে এটা ধরা পড়েনি। শহর থেকে দলে দলে মানুষকে ছড়িয়ে পড়তে দিয়ে লকডাউন করা হয়েছে। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বিস্তৃত হয়েছে। কাজেই জরুরি ভিত্তিতে দেখা উচিত কোন অঞ্চল থেকে ফোন কল বেশি আসছে? সেখানে অনুসন্ধান ও জরিপ চালিয়ে দেখতে হবে যে, রোগটা সমাজে ঠিক কতটা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রয়োজনে সেখানে লকডাউন করে সন্দেহভাজনদের শনাক্ত করতে হবে এবং তাদের পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখনও কিছু কিছু অভিযোগ শোনা যাচ্ছে যে, জীবিত থাকা অবস্থায় পরীক্ষার জন্য আকুতি মিনতি করেও পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়নি। রোগী নিয়ে স্বজনদের এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরতে হচ্ছে। অসুস্থ অবস্থায় রোগী মারা যাওয়ার পর নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ অভিযোগগুলো এখনই খতিয়ে দেখতে হবে। প্রতিটি অভিযোগের তাৎক্ষণিক তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাংলাদেশে প্রতিদিন ১০০ জন নয়, প্রতিদিন গড়ে এক লাখ ব্যক্তির টেস্ট করাতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়াসহ অনেক দেশ এটা করে দেখিয়েছে। প্রয়োজনে বিভিন্ন বেসরকারি খাতের ল্যাব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরকারকে বসতে হবে। তাদের সব রকম সাহায্য দিতে হবে। দেশে যদি অনতিবিলম্বে ১০টি ল্যাবে একসঙ্গে প্রতিদিন ১০০ জনের টেস্ট শুরু করা হয়, তাহলে সহজেই প্রতিদিনের টেস্ট সংখ্যা এক হাজারে উন্নীত করা সম্ভব।

বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন আগামী দুই সপ্তাহ বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। করোনার প্রভাব দেশে কতটা পড়বে তা স্পষ্ট হয়ে যাবে এ সময়ের মধ্যেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, শুধু লকডাউনের মাধ্যমে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে করোনার মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। কাজেই প্রত্যেক সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে পরীক্ষার আওতায় আনতেই হবে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ও নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে আমরা কোন ধরনের সরঞ্জাম সংকটের কথা শুনতে চাই না। যদি কোথাও কোন সংকট থাকে তবে জরুরি ভিত্তিতে সেটা আমদানি করতে হবে এবং তার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। এক্ষেত্রে কোনরকম গাফিলতি হলে বাংলাদেশে মানবিক বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না।

Suva.muntasir@gmail.com

বুধবার, ০৮ এপ্রিল ২০২০ , ২৫ চৈত্র ১৪২৬, ১৩ শাবান ১৪৪১

পরীক্ষা, পরীক্ষা এবং পরীক্ষা

খন্দকার মুনতাসীর মামুন

করোনা শনাক্তের জন্য পরীক্ষা করতেই হবে। করোনার বিস্তার ঠেকানোর প্রধান উপায় হলো করোনা সংক্রমিত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা, তাদের বিচ্ছিন্ন করা এবং সংক্রমিতরা কাদের সংস্পর্শে এসেছে, তাদের খুঁজে বের করে কোয়ারেন্টিনে রাখা। এজন্য সন্দেহভাজন সব মানুষকে পরীক্ষার আওতায় আনা জরুরি। আর এজন্য করোনা ভাইরাস নিয়ে নতুন সতর্ক বার্তা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তাদের বার্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লাইন হচ্ছে- ‘টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট।’

ইউরোপ, আমেরিকার মতো পশ্চিম বিশ্বে কার্যত মহামারীর চেহারা নিয়েছে করোনাভাইরাস। তার আগে চীনে মৃত্যু হয়েছে হাজার হাজার মানুষের। গোটা বিশ্ব কার্যত অবরুদ্ধ। ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, আমেরিকায় প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। কিন্তু সেই তুলনায় ভারতীয় উপমহাদেশ কিংবা আফ্রিকায় আক্রান্তের সংখ্যা অনেকটাই কম। এর কারণ কি এ সমস্ত জায়গায় করোনার প্রকোপ কম, নাকি সাধারণ মানুষ করোনার লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও হাসপাতালে যাচ্ছেন না? এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কবার্তাতেও সে প্রশ্নেরই ইঙ্গিত রয়েছে। তথ্য বলছে, অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলোতে সাধারণ মানুষ শরীর খারাপ হলেও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাচ্ছেন না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতি ১০ লাখে ৪ হাজার ৪০০ জন মানুষ করোনার পরীক্ষা করাচ্ছেন। সেখানে ভারতে প্রতি ১০ লাখে করোনা পরীক্ষা করাতে যাচ্ছেন মাত্র তিনজন। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলোতে করোনার সংক্রমণ কতটা ঘটছে, এখনও তা স্পষ্ট করে বোঝাই যাচ্ছে না। প্রথম পর্বে চিকিৎসা হলে করোনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কিন্তু তা গোপন করলে মৃত্যুর আশঙ্কা বাড়ে। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মৃত্যুর হার হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি আরও একটি প্রশ্ন উঠছে- এ সমস্ত দেশে করোনা পরীক্ষা করার যথেষ্ট বন্দোবস্ত আছে তো?

ক’দিন আগেও বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরীক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) নির্ধারিত ফোন নম্বরে কল করে সিংহভাগ মানুষ কাক্সিক্ষত সেবা পায়নি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টে গেছে। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের কথা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রথম স্বীকার করা হয় গত ৮ মার্চ। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ১২৩। মৃতের সংখ্যা ১২। এর আগে তিনদিনে-প্রতিদিন দ্বিগুণ হয়েছে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা; সংখ্যাগািল হচ্ছে ৯-১৮-৩৫. যদিও এ সময়ের মধ্যে করোনার উপসর্গ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক অসুস্থ ব্যক্তি মারা গেছেন। কিন্তু যেহেতু মৃত্যুর আগে তাদের করোনা পরীক্ষা করা হয়নি এবং মৃত্যুর পর সংগৃহীত নমুনায় কি পাওয়া গেছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা জানা যাচ্ছে না, তাই তারা জ্বর, গলা ব্যথা, শ্বাসকষ্ট বা খুসখুসে কাশি রোগে মারা গেছেন বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। দেশে এসব রোগে মৃত্যুর সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়াও নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তার বিষয়।

তবে এর চেয়েও উদ্বেগের বিষয় হলো, করোনাভাইরাসের লক্ষণ-উপসর্গ আছে পরীক্ষার জন্য এমন মানুষ নাকি খুঁজে পাচ্ছে না স্বাস্থ্য অধিদফতর। টেলিফোনে দেয়া ঠিকানা ও ফোন নম্বর ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়েও তাদের অধিকাংশের খোঁজ মিলছে না। অনেকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগও করা যাচ্ছে না। ফলে বিপুলসংখ্যক সন্দেহভাজন ব্যক্তি থেকে যাচ্ছেন করোনা পরীক্ষার বাইরে। এ পরিস্থিতি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

পরীক্ষার পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ অত্যন্ত ভালো। তবে এটি নিয়ে সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দুপুরে একজন পরিচালক এক ধরনের বক্তব্য দিলেন; আবার বিকালে মহাপরিচালক অন্য ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। পরীক্ষার পরিধি বাড়াতেই হবে। যত বেশি মানুষকে পরীক্ষার আওতায় আনা যাবে ততই ভালো হবে। কারণ বেশি পরীক্ষা হলে আক্রান্ত ব্যক্তি বেশি শনাক্ত হবে এবং তাকে আইসোলেশনে নেয়ার পাশাপাশি ওই ব্যক্তির সংস্পর্শে থাকা অন্য ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিনে নেয়া হবে। এতে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না। সুতরাং ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য সবার আগে পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ ও আইইডিসিআর কর্মকর্তারা এতদিন ধরে বিষয়টি কেন অনুধাবন করতে পারলেন না, সেটি তাদের কাছে জানতে চাওয়া প্রয়োজন।

সামাজিকভাবে সংক্রমণ শুরু হয়েছে বলেই বিদেশ ফেরতদের পরিবারের সদস্যের বাইরের মানুষও আক্রান্ত হয়েছে, মারা গেছে। এমন একটি মৃত্যুর পর ওই এলাকা লকডাউন করা হয়েছে। করোনা বেশি ছড়িয়েছে কিনা, সেটি জানতে হলে পরীক্ষার হার বাড়াতে হবে। অল্প কিছু টেস্ট করে এটি নিশ্চিত হয়ে বসে থাকলে বিপদ আসন্ন। করোনার সংক্রমণ যাদের মধ্যে রয়েছে, তাদের শনাক্ত করতে দেরি হলে এবং আক্রান্তদের আইসোলেশনে চিকিৎসাসেবা দেয়া না হলে সংক্রমণ ছড়াতেই থাকবে। পরবর্তীকালে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ধারণা করা হচ্ছে, লক্ষণ-উপসর্গ নিয়ে অনেকেই আত্মগোপন করেছেন। অথচ সন্দেহভাজনের উচিত তাদের নিজেদের জন্য, পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য এবং আশপাশের মানুষের ভালোর জন্য স্বেচ্ছায় পরীক্ষা করানো। প্রয়োজনে কোয়ারেন্টিনে যাওয়া। বরং সেটা না করা হলেই নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের বিপদ বাড়বে।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যে হারে পরীক্ষা চলছে, তাকে নিতান্ত অপ্রতুল বলেও বোঝানো যাবে না। এটা সিন্ধুতে এক বিন্দু পানি ফেলার চেয়েও কম। পরীক্ষার বিষয়টি শুধু সরকার সামলাতে পারবে না। তার একার হাতে রাখাও ঠিক হচ্ছে না। লকডাউন করতে গিয়ে বাংলাদেশ একটি গুরুতর ভুল করেছে। শহর ছিল বাংলাদেশের জন্য হটস্পট। গ্রামে এটা ধরা পড়েনি। শহর থেকে দলে দলে মানুষকে ছড়িয়ে পড়তে দিয়ে লকডাউন করা হয়েছে। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বিস্তৃত হয়েছে। কাজেই জরুরি ভিত্তিতে দেখা উচিত কোন অঞ্চল থেকে ফোন কল বেশি আসছে? সেখানে অনুসন্ধান ও জরিপ চালিয়ে দেখতে হবে যে, রোগটা সমাজে ঠিক কতটা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রয়োজনে সেখানে লকডাউন করে সন্দেহভাজনদের শনাক্ত করতে হবে এবং তাদের পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখনও কিছু কিছু অভিযোগ শোনা যাচ্ছে যে, জীবিত থাকা অবস্থায় পরীক্ষার জন্য আকুতি মিনতি করেও পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়নি। রোগী নিয়ে স্বজনদের এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরতে হচ্ছে। অসুস্থ অবস্থায় রোগী মারা যাওয়ার পর নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ অভিযোগগুলো এখনই খতিয়ে দেখতে হবে। প্রতিটি অভিযোগের তাৎক্ষণিক তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাংলাদেশে প্রতিদিন ১০০ জন নয়, প্রতিদিন গড়ে এক লাখ ব্যক্তির টেস্ট করাতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়াসহ অনেক দেশ এটা করে দেখিয়েছে। প্রয়োজনে বিভিন্ন বেসরকারি খাতের ল্যাব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরকারকে বসতে হবে। তাদের সব রকম সাহায্য দিতে হবে। দেশে যদি অনতিবিলম্বে ১০টি ল্যাবে একসঙ্গে প্রতিদিন ১০০ জনের টেস্ট শুরু করা হয়, তাহলে সহজেই প্রতিদিনের টেস্ট সংখ্যা এক হাজারে উন্নীত করা সম্ভব।

বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন আগামী দুই সপ্তাহ বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। করোনার প্রভাব দেশে কতটা পড়বে তা স্পষ্ট হয়ে যাবে এ সময়ের মধ্যেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, শুধু লকডাউনের মাধ্যমে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে করোনার মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। কাজেই প্রত্যেক সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে পরীক্ষার আওতায় আনতেই হবে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ও নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে আমরা কোন ধরনের সরঞ্জাম সংকটের কথা শুনতে চাই না। যদি কোথাও কোন সংকট থাকে তবে জরুরি ভিত্তিতে সেটা আমদানি করতে হবে এবং তার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। এক্ষেত্রে কোনরকম গাফিলতি হলে বাংলাদেশে মানবিক বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না।

Suva.muntasir@gmail.com